#আমার_হৃদয়ে_সে
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব-৩৬
আমি ফারিহার কিছুটা সামনে বসা ছিলাম।আমার কারণে হয়তো ফারিয়াকে আমার পেছন থেকে দেখতে সমস্যা হচ্ছিল।আমি সরে এবার আরেকটু দূরে বসলাম।বসে পেছন থেকে বলা মহিলার দিকে কেনজানি অজান্তে তাকালাম।দৃষ্টিটা মুহূর্তে সেখানেই আঁটকে গেলো!আমার সেই স্থির দৃষ্টির সামনে অভির মা দাঁড়িয়ে আছেন এখন।মানে আমার প্রথম শাশুড়ী মা!তিনি প্রথমে আমাকে খেয়াল করলেন না।যখন ফারিহার দিকে হেসে এগিয়ে আসতে নিলেন তখন আমাকে দেখলেন।মুহূর্তে উধাও হয়ে গেলো উনার মুখের হাসি।চলন্ত পা স্থির হয়ে গেল।তাকিয়ে থাকলেন আমার মুখের দিকে।আমার ভেতরটা মুচড়ে উঠলো যেন।আমি বিছানা থেকে নেমে উনার সামনে এসে দাঁড়ালাম।আর আলতো জড়িয়ে ধরলাম।বললাম,
“মা?কেমন আছেন,আপনি?”
সাথে সাথে জবাব এলো না।কয়েক সেকেন্ডস বাদে বললেন,
“এইতো আল্লাহ রাখছে..।তুমি?”
“ভালো,মা।বাসার সবাই কেমন আছে মা? বাবা?রিমি আপু?টিপি?সবাই ভালো আছে?”
“ভালো।”
এবার কাঁধ থেকে মাথা তুললাম।উনার দিকে ক্ষীণ চোখে তাকালাম। আগের মতন উনার মুখে আজ খুশি খুশি ভাবটা পেলাম না।কেমন মনমরা মনমরা করে আছেন!ভেতরটা আমার আরেক দফা মুচড়ে উঠলো।চারপাশে আলতো চোখ বুলালাম।উপস্থিত সবাই আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে।মা,হাসনা এবং রুনুও।তবে তাদের চোখেমুখে বিস্ময়তার ভাব।হয়তো ভাবছে, ইনি কে?আর ইনাকে মা বলে সম্বোধন করলাম কেন?!আমি ফের আবার অভির মার দিকে তাকাই।বলি,
“অনেকদিন পর দেখা হলো আপনার সাথে মা!ভাবতেই পারি নি আজ দেখা হবে!”
উনি হাসলেন।হাসিটা কেমনজানি মলিন ছিল।আমার কাছে একদম স্বস্তি বোধ লাগলো না।এত হাসিখুশি মানুষটা এভাবে হাসছে কেন!?ভাবনার মাঝে কেমন উদাসীন গলায় বলেন,
“আমিও।”
“একা এসেছেন,মা?”
“নাহ।”
“কে এসেছে সাথে?”
“অভির বাবা।”
“কোথায় উনি?”
“বাইরে আছে হয়তো।”
এমন সময় আমার বর্তমান শাশুড়ী মা এগিয়ে আসেন আমাদের দিকে।এসে আমাকে বলেন,
“ইনি সম্পর্কে তোমার কি হোন, পারিসা?”
“মা ইনিই অভির মা।যার কথা তোমাকে ওইদিন বললাম!”
আমার বর্তমান শাশুড়ী মার মুখটা মুহূর্তে হাসোজ্জল হয়ে উঠলো।হবেই না বা কেন,বলুন?আমার প্রথম শাশুড়ী মা যে আমাকে ভীষণ ভালোবাসতো।ঠিক পরের বিয়েতে প্রথম শাশুড়ী মার মতন দ্বিতীয় আরেকটা মারও যে ভালোবাসা পেলাম সে কথা কি আর না বলে থাকতে পেরেছি?পারি নি!হৃদয়ের মা বলেন,
“তাই নাকি?আপা জানেন?পারিসার থেকে আপনার অনেক কথা শুনলাম!আপনি খুব ভালো।ওকে খুব আদর করেছেন!”
অভির মা বলেন,
“আপনি পারি সার শাশুড়ী? ”
“জ্বী।”
“পারিসার বিয়ে হয়েছে?”
এ’কথা বলামাত্র আমি মাথাটা কিঞ্চিৎ নুইয়ে আনলাম।হৃদয়ের মা বলেন,
“জ্বী।আমার ছেলে হৃদয়ের সাথে পারিসার বিয়ে হয়েছে।”
“ওহ।দোয়া করি পারিসার সংসারিক জীবন সুখী এবং আরো সুখময় হোক।”
বলে শাশুড়ী মা দীর্ঘ একটা শ্বাস ছাড়েন।আমার শাশুড়ী মা হাসেন।আমি হাসতে পারলাম না।উনার দীর্ঘশ্বাসটির প্রতিটি কণা আমার হৃদয়কে ছুঁয়ে গেলো!হৃদয়টা ব্যদনায় ভরে গেল।আমার কেনজানি মনে হচ্ছে শাশুড়ী মা আগের মতন খুব একটা ভালো নেই।যদি সত্যিই ভালো না থাকে তবে ভীষণ জানতে ইচ্ছে কেন ভালো নেই! এই মুহূর্তে উনাকে একটা প্রশ্ন করতে ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছে!প্রশ্নটি হলো,”মা?অভির বউ কেমন?ভালো ত?”
কিন্তু পারলাম না।কেনজানি বিবেকে বাঁধা পড়লো!তারপর আরো কিছুক্ষণ কথা বলেন আমার শাশুড়ী মা এবং অভির মা।আমি আর কিছু বলিনি।পাশে চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি উদাসীন মনে!কিছু কথা উনাদের হয়তো মস্তিষ্ক ঢুকেছে আবার হয়তো ঢুকেও নি!
৫৭.
রাতে খাবার খেতে বসেছি সবাই।খাবার খাওয়ার মাঝে হঠাৎ শাশুড়ী মা,
“অভির বউ বোধহয় ভালো পড়ে নি!শুনলাম সে নাকি তার বউকে নিয়ে অন্য জায়গায় থাকে তোমার শাশুড়ী যে বললো আজ আমাকে।আজকালকার বউরা না ভীষণ খারাপ!শ্বশুর-শাশুড়ীকে কীভাবে শ্রদ্ধা করবে তা জানে না!”
আমার ভাত খাওয়ার হাত চলা শ্লথ হয়ে গেলো
হৃদয় আমার ডানপাশের চেয়ারে বসা।সে ভাতের নালা মুখে ফুঁড়ছে আর বলছে,
“কোন অভির কথা বলছো?”
“পারিসার প্রথমে যেখানে বিয়ে হয়েছিলো!”
“ওহ!উনার সাথে তোমার কোথায় দেখা হয়েছে আবার?”
“বিয়েতে!”
“মুস্তাফা আঙ্কেলের কি হোন উনি?”
“তোর মুস্তাফা আঙ্কেলের দূরসম্পর্কের আত্মীয় অভির বাবা।অভির বাবাও তো আজ এসেছিলো নাকি বিয়েতে!”
“ওহ!পরিচয় তো আর করিয়ে দিলে না!”
বলে হৃদয় মৃদু হাসি টানলো।মার থেকে চোখ সরিয়ে তারপর আমার দিকে তাকালো।ওপর দৃষ্টিতে আমি ভাতের নালা ঢলতে শুরু করলাম।শাশুড়ী মা বলেন,
“আর অভি ছেলেটা আসলেই খারাপ!প্রথম বউকে বুঝে নি!এখন দ্বিতীয় বউকে বুঝেছে।দ্বিতীয় বউকে বুঝে মা-বাবাকে পর করে দিয়েছে!কত যে অভিশাপ নিতেছে!”
“মা দয়া করে এই টপিক বাদ দাও।ভাত খেতে বসেছো ভাত খাওয়া শেষ করো!”
বলে হৃদয় নিজেও খাবারে মন দেয়।অধীর মনোযোগ দেয়!প্রসঙ্গত সে অভির ব্যাপারটা এড়াতে খাবারের তাগাদা দেয়।বিয়ের পর থেকেই দেখতেছি হৃদয় অভির বিষয়ে উদাসীনতা।সে অভি নামের কেউ আমার অতীতে ছিল বা অভির সাথে আমার আগে বিয়ে হয়েছিল এটা যেন সে মানতেই চায় না।সে বুঝাতে চায় আমিই তার প্রথম।এবং সেও আমার প্রথম!মাঝখান দিয়ে কোনো ভিলেনটিলেন নাই!আর থাকবেও না!বিয়ের এই পনেরো দিনের মধ্যে হৃদয়ের এই বিষয়টা আমার বেশ নজরে আসে।যদিও সে আমাকেতা বুঝতে দেয়না।তবে আমি বুঝি!
৫৮.
আরো অনেকগুলো দিন এভাবে দেখতে দেখতে পার হয়ে যায়।এরমাঝে খালামণিদের বাসা থেকে আমি এবং হৃদয় কয়েকদিন থেকে বেড়িয়ে আসি।এবং আমাদের বাসা থেকেও বেড়িয়ে আসি!মোটামুটি সবকিছুই স্বাভাবিক চলছে আরকি।এ বাড়ির, মানে হৃদয়দের বাড়িও স্বাভাবিক।আমার শ্বশুরের অস্বাভাবিকতা আগের মতন এখন আর তেমন নেই।এই যেমন তিনি আগে মন চাইলে বাসায় হালকাপাতলা খাবার খেতেন।আর বেশি সময় বাইরে খেতেন। এখন আর তা নেই।এখন তিনি সব খাবার বাসায়ই খান।কোনোদিন আমার হাতের খান।কোনোদিন মার হাতের।উনার মাঝে এই পরিবর্তন দেখতেছি মুস্তাফা চাচার মেয়ের বিয়ের পর থেকে ই!হুটহাট উনার ওহেন পরিবর্তনের মানে আমরা কেউই বুঝি নি।যেদিন বাবা বাসায় খাওয়া শুরু করলেন মা এই রুম থেকে ওই রুম।আবার ওই রুম থেকে এই রুম!একদম দৌড়াদৌড়ির মধ্যে ছিলেন আমাদের বিষয়টা জানাতে।আমাদের দেখামাত্রই চট করে এক্টা উদ্ভট কথা বলে উঠলেন,
“হয়তো মুস্তাফা ভাই উনার মেয়ের বিয়ের খাবারে তোদের বাবাকে তাবিজ খাইয়ে দিয়েছে।নাহলে রাগটা কোথায়?রাগ থাকলে তো খেতো না!এখন খাচ্ছে!রাগ আর নাই!”
মার কথা শুনে সেদিন আমাদের খুব দমফাটা হাসি!খুব হেসেছি।তবে মার কথাটা পুরোপুরি সত্য হয়নি!বাবা খাবার টা বাসায় খাচ্ছে ঠিকা আছে।কিন্তু আমাদের সাথে কথাবার্তা সেই আগের মতনই রয়ে গেছে।পরিবর্তন শুধু খাওয়াতে!আর কিছু না!
৫৯.
ছাদে টবে অনেকগুলো গাছের ফুল ফুঁটেছে।লাল গোলাপ ফুঁটেছে।গোলাপী গোলাপ!গন্ধরাজও ফুঁটেছে দেখছি অনেক।ফুল বাগান করা আমার শ্বশুরের শখ বেশি।এই ছাদে প্রায় দশটা জাতের ফুলগাছ আছে।যারমধ্যে আটটা জাতেরই গাছ লাগানো আমার শ্বশুরের হাতের।আর বাকি দুইটা হাসনা লাগিয়েছে।সেও পছন্দ করে ফুলবাগান করতে।এই অভ্যেস টা হয়তো সে বাবার থেকে পেয়েছে।শাশুড়ী মা আবার এটা পছন্দ করেন না।তিনি শুধু সবজির বাগান করতে ভালোবাসেন।ছাদে কিন্তু মিষ্টি কুমড়া,বেগুন,পুইশাক, ঢেঁড়স এবং ঝিঙ্গার গাছ আছে।সেগুলো শাশুড়ী মা বাবার হাতে বাজার থেকে আনিয়ে নিজে রোপণ করেছেন হয়তো।কয়েকটা কুমড়াও হয়েছে।লম্বা দড়ির মতন ঠাঁটার সাথে ঝুঁলে আছে।আমি সেগুলোতে তাকালাম না বেশিক্ষণ।ছুটে গেলাম লাল গোলাপের দিকে।গোলাপে আলতো হাত বুলালাম।আর দুই তিনটা গোলাপ থেকে প্রাণভরে সুভাসও নিলাম।এমন সময় ঘাড়ে চিমটি খেলাম কারো।”আহ”শব্দ তুলে চোখমুখ কুঁচকে আনতেই পেছন থেকে,
“এত গোলাপ ছুঁইতে হবে না।ক’মাস পরতো আমাদের কোলেই গোলাপ ফুঁটবে!তখন প্রাণভরে ছুঁইয়ো। ”
বলে হৃদয় আবারো হাসে।আমি মাথাটা আলতো নুইয়ে ফেললাম লজ্জায়!আর না চাইতেও পেটের দিকে নজর আওড়ালাম।আজ আমি একমাসের অন্তঃসত্ত্বা! গতকাল বিকেলে বেলকনির দড়িতে জামাকাপড় রোদে শুকাতে দিলে হঠাৎ আমি মাথা ঘুরিয়ে নিচে পড়ে যাই।পরে হৃদয় বাসায় ডাক্তার নিয়ে আসে।ডাক্তার পরিক্ষা নিরীক্ষা করে।পরিক্ষা নিরিক্ষা করার পর এই তথ্য দেয় যে, হঠাৎ ঘুরিয়ে পড়ি একমাস অন্তঃসত্ত্বার কারণে!
চলবে….