উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ১১
নিষিদ্ধের প্রতি মানুষের কৌতূহল বেশি। কৌতুহলটাই ধ্বংসের মূল। ভালো থাকতে শুরু করলে নিষিদ্ধ চাওয়া মন মস্তিষ্কে দাপিয়ে বেড়ায়।সে মস্তিষ্ক দাপিয়ে বেড়ানো চাওয়াটাই যেন কাল হয়ে দাঁড়ায়। আজ নতুন নয় কৌতুহলে অধঃপতন যুগে যুগে দেখে আসছে মানুষ। তেমনি ছেলের অধঃপতন দেখে সাফিয়া খাতুনের বুকটা হু হু করে উঠলো। বাড়িটা ছেড়ে গিয়েছিল ঠিকই তবে আজ আপন মানুষ গুলোকে দেখতে এলো। তার সাথে নিজের বাদ বাকি জিনিস পত্রও গুছিয়ে নিতে।
শিমুল তার শ্বাশুড়িকে বাড়ির দরজায় রেখে বাজারের দিকে গেছে। রফিক বলেছে শিমুল এলেই যেন দেখা করে যায়।
প্রায় মাসখানেক পর সাফিয়া খাতুনকে দেখে জমিলা আর সোহাগী এগিয়ে এলো। ছোট্ট সিফাত দৌড়ে ফাতেমা খাতুনকে জানালো তার ছোট দাদী বাড়ি এসেছে। হড়বড়িয়ে বিছানা থেকে নামলেন তিনি। এতে পানেরবাটা ঝনঝন শব্দ করে নিচে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। চুনের কৌটার চুন নিছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে একাকার। তোয়াক্কা করলেন না, একবার পেছন ফিরে আবারো হাঁটা ধরলেন।
জমিলা আর সোহাগী তাদের চাচি শ্বাশুড়িকে একটু বেশি ভালোবাসে। সাফিয়া খাতুন নিজেও কখনো উচ্চবাচ্য করে কথা বলেননি। সোহাগী জড়িয়ে ধরে প্রায় কেঁদে দেওয়ার জোগাড়। জমিলা মুখ দিয়ে বড় বড় নিশ্বাস ফেলছে। তার কষ্ট হচ্ছে খুব। হবেই বা না কেন! তৃধা যেদিন গেছে ঠিক সেইদিনই শিমুল এসে রাজিয়া আর সাফিয়া খাতুনকে নিয়ে গেছে। এরপর আর দেখা হয়নি কারোর সাথে।
ফাতেমা খাতুন এসেই সোহাগীকে সরিয়ে নিজে সাফিয়া খাতুনকে জড়িয়ে ধরলেন। বছর সাত আগ পিছ করে দুইজন এই বাড়ির বউ হয়ে এসেছিলো। সংসারে সুখ দুঃখ দুজন মিলে ভাগ করে নিয়েছিলো। কখনো দু’কথা হয়নি দুইজনের মাঝে। সন্তান সন্ততি জন্ম দিয়ে মানুষ করেছে তারা। সেই আবার বছর পাঁচের ব্যাবধানে বিধবাও হলেন। সময় কম হয়নি, পনেরো বছর বয়সে ফাতেমা খাতুনের বিয়ে হয়। তার বিয়ের সাত বছর পর সাফিয়া বউ হয়ে আসে। তখন সাফিয়ার বয়স কেবল চৌদ্দ। সংসারটা হাতে ধরে শিখিয়েছিলো তাকে। পুরোনো সময় মনে করেই দুজন কেঁদে উঠলো। সাফিয়া বিলাপ করে বলে উঠলো,, আমার সংসারটা এমন কেন হলো আপা আমার সংসারটা এমন কেন হলো?
সাফিয়া খাতুনের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেন না ফাতেমা খাতুন।তবে জা-কে জড়িয়ে ধরে ঠিকই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। দাদিদের কান্না দেখে ছোট সিফাত কেঁদে উঠলো।
সাত সকালে উঠোনে হট্টগোল হচ্ছে দেখে ঘর ছেড়ে বেরোয় সুমনা।তার জন্য সাত সকাল হলেও এখন বেলা এগারোটা। পুরো একদিন শহর ঘুরে রাতে ফিরেছে দুজন। যদিও মান অভিমান ভাঙ্গাতে ভাঙ্গাতে প্রায় মধ্যরাত হয়ে গেছে। ঘুমোতে দেরি হওয়াতে উঠতেও দেরি হয়েছে। অবশ্য চেহারা দেখে বুঝা যাচ্ছে ঘুম ভালো হয়েছে।
উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকা শ্বাশুড়ি আর জেঠাতো জা-দের দেখে কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলেও মুখে প্রকাশ করলো না। ওড়না টেনে ঘোমটা দিয়ে সামনে এগোয়। সুমনাকে দেখে সোহাগী আর জমিলা সরে দাঁড়ায়। এই মেয়ের সাথে কথা বলাতো দুরের কথা পাশে দাঁড়াতেও তাদের রুচিতে বাধে।
সুমনা এগিয়ে এসে শ্বাশুড়িকে সালাম করতে নেয়। তৎক্ষণাৎ সরে দাঁড়ায় সাফিয়া খাতুন। তিনি তেজি গলায় বলে উঠলো,, থাক! সালাম করতে হবে না। আমার সাজানো সংসার গুড়িয়ে দিয়ে পায়ে হাত দিতে হবে না। তোমার এই গরু মেরে জুতা দান করাটা তোমার নিজের জন্য তোলা রাখো।
সুমনা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ফুঁসছে। ইচ্ছে করছে শ্বাশুড়িকে দুটো কথা শুনিয়ে দিতে। কিন্তু দ্বিতীয় দেখা হওয়াতে সেই ওবদি গেলো না। নিজেকে যথেষ্ট ঠান্ডা রেখে বলে উঠলো,, মা আপনি,,
পুরো কথা শেষ করার আগেই সুমনাকে থামিয়ে পুনরায় বলে উঠলো,, তোমার ওই মুখে আমাকে মা ডাকবে না। আমি আর যাই হই না কেন, অন্তত তোমার মত মেয়ের মা নই। তুমি একটা মেয়ের সংসার ভেঙ্গে তাকে গৃহত্যাগি করতে বাধ্য করেছো। তোমার মত মেয়ের মা আমি নই। মনে রাখবে আল্লাহ ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না। ওই মেয়ের প্রতিটা নিঃশ্বাস তোমার জন্য অভিশাপ হবে।
ফাতেমা খাতুন সাফিয়াকে থামিয়ে বললো ,, আহ্ থাম এইবার। বাদ দে ওসব। আয় ঘরে আয়।
,, না আপা । বসবো না। রাজিয়াকে একা রেখে এসেছি। মেয়েটা অসুস্থ। আমার জিনিস পত্র গুলো নিয়েই চলে যাবো।
ফাতেমা ভাঙ্গা গলায় বলল,, থাক একদিন আমার কাছে?
,, দম বন্ধ হয়ে যাবে আপা। এই বাড়িতে থাকলে কলিজা ফেটে মরে যাবো। ছেলের অপরাধের ভার নিতে নিতে মরে যাবো।
সোহাগী মুখে শাড়ির আঁচল চেপে কাঁদছে। জমিলা ঘন ঘন হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছছে।
এতো অপমানিত হতে হচ্ছে দেখে সুমনা আর দাঁড়ালো না। ধুপধাপ করে পা ফেলে ঘরে ঢুকলো। ঘরে ঢুকে খান্ত হয়নি রজবের কাছে খবর পৌঁছে দিয়েছে তার মা বাড়ি ফিরেছে।
সোহাগী ইশারা করতেই জমিলা তড়িঘড়ি করে ছুটলো রসাই ঘরে। সোহাগী সাফিয়া খাতুনকে নিয়ে জিনিস পত্র গোছাতে গেছে। যা লাগবে সে গুছিয়ে দিবে। বয়স্ক শরীর নিয়ে গোছগাছ পরিশ্রম হয়ে যাবে।
ঘরের পরিবেশ বদলে গেছে। নতুন খাট ,নতুন তোশক, বিছানার চাদরটাও নতুন। ঘরে টিভি আছে, নতুন ফ্রিজ নিয়েছে। তৃধা যাওয়ার পর সোহাগী এই প্রথম ঘরে ঢুকলো। সাফিয়া খাতুন অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,, দাম দিয়ে ঘর সাজিয়েছে।
সোহাগী হায়হুতাশ করে বললো,, হ্যাঁ চাচী সাজিয়েছে বটে। তবে যাকে রাজ প্রাসাদ থেকে এনেছিল তাকে অভাবে রেখে ,পথ থেকে তুলে আনা ময়লাকে প্রাসাদের রেখেছে।
সাফিয়া খাতুন আলগোছে চোখ মুছে নিলো। ঘর ঘর নেই। কেমন শূন্য লাগছে। দামি জিনিসে কি আর পূর্ন হয়?
গোছানো শেষে ঘর ছেড়ে বেরোয় সাফিয়া। ফাতেমা তাকে টেনে নিজ ঘরে আনলো। রুটি আর ডিম ভাজি দিয়ে চোখ রাঙানি দিয়ে বলল,, যাবি যখন তখন আর ধরে রাখবো না। আমার চোক্ষের সামনে বসে খেয়ে যাবি।
সাফিয়া খাতুন দ্বিমত করলো না। রুটি ছিঁড়ে মুখে পুরলো।
______
এইদিকে মা এসেছে শুনে ইচ্ছে থাকার সত্বেও রজব আসতে পারছে না। বলা যায় পাওনাদাররা টাকা দেওয়া ছাড়া ছাড়ছে না। এক মাসের কথা বলে প্রায় লাখ খানেক টাকা নিয়েছিল। নতুন বউয়ের ইচ্ছে পূরণের সেই টাকা খরচ করেই ঘর সাজানো হয়। এখন আর শোধ করতে পারছে না। মাস শেষে আয়ের চেয়ে ব্যায় বেশি হচ্ছে।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই শিমুল সিএনজি নিয়ে হাজির। বাড়ির সবাইকে সালাম দিয়ে কুশলাদি বিনিময় করে সিএনজিতে উঠতে যাবে এমন সময় রজব আসে।
ছেলেকে দেখে সাফিয়া খাতুন চটজলদি সিএনজিতে উঠে বসলো। শিমুলকে তাড়া দিয়ে যেতে বলে। রজব বার কয়েক মায়ের সাথে কথা বলার চেষ্টা চালিয়েছে। যদিও ফলাফল শূন্য।সাফিয়া খাতুন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এমন ছেলের মুখ দেখতেও নারাজ তিনি।
সাফিয়া খাতুন যেতেই সবাই যার যার মত করে ঘরে ঢুকে গেলো। কেউই ভালো খারাপ কিছুই বলেনি।এইটা নতুন নয়। তৃধা যাওয়ার পর থেকে রজব আর তার বউকে একঘরে করে দিয়েছে সবাই। এমনকি বাড়ির পাশের চার বাড়ির লোক পর্যন্ত কথা বলে না।
_________
সকালের নাস্তা শেষে তৃধাকে নিয়ে হাঁটতে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিলো ফরিদা হক। বাইরে যাবে না বরং বাগানেই হাঁটবে কিছুক্ষণ।গায়ে ছাই রঙা কাশ্মীরী শাল জড়িয়ে বাড়তি আরেকটা শাল তৃধার জন্য নিয়ে নিলো। সেই দিন দিবে দিবে করে একদম ভুলে বসেছে।
তৃধা ঘোমটা টেনে নুসাইবের দেওয়া সেই শালটাই গায়ে জড়িয়ে রুম ছেড়ে বেরুচ্ছে এমন সময় ফরিদা হকের আগমন।
ফরিদা হকের হাতে শাল দেখে তৃধা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,, আরেকটা শাল কার জন্যে?
ফরিদা হক তৃধার গায়ের শালটা দেখেই চিনলো এইটা নুসাইবের। তিনি হাতের শালটা এগিয়ে দিয়ে বললো,, তোমার জন্যে।
তৃধা মুচকি হেসে বলল,, সেইদিন না এইটা দিলে? আরেকটা কেন?
ফরিদা হক টেনশনে পড়ে গেলেন। তার স্পষ্ট মনে আছে তিনি এই শাল তার বড় ছেলেকে দিয়েছেন। কিন্তু তৃধা তো আর মিথ্যা বলছে না। তাই তৃধাকে জিজ্ঞেস করলো,, কখন?
,, পরশু বিকেলে। মনে নেই ছাদে পাঠিয়েছিলে?
ফরিদা হক ফট করে বলে উঠলো,, নুসাইব দিয়েছে নিশ্চয়ই?
তৃধা মাথা দুলিয়ে বলল,, হ্যাঁ তিনিই দিয়েছেন। বলেছে না নিলে তোমার মন খারাপ হবে।
চলবে,,,
উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ১২
বেলা এগারোটায় তমালের দেখা।সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আছে ব্যাগ পত্র নিয়ে। একটা কাঁধে দুটো হাতে। তৃধা তমালকে দেখে মুচকি হেসে বলল,, আন্টি এতক্ষণ আপনার অপেক্ষা করছিলো। ব্যাগ গুলো আমাকে দিন।
তমাল নাকোচ করে বললো, না আপু ।জেন্টেলম্যানরা কখনো মেয়েদের হাতে ব্যাগপত্র তোলায় না। আমি কঠিন মাপের জেন্টেলম্যান।
তমাল আর নবনীর সাথে তৃধার ভাব হয়েছে আগেই। গতবার তমাল , নবনী তৃধার সাথেই বেশি সময় কাটিয়ে ছিলো। যদিও তৃধার পরিস্থিতি কিছুটা অন্যরকম ছিল। তাও দুজন মিলে তার মন ভালো রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। তমালের কথায় তৃধা মুচকি হাসলো। ফরিদা হক প্রায় হাজার দফা বলেছে ” জানো তৃধা আমার বাবুটা একদম পাগলাটে।” যদিও তৃধার তেমনটা মনে হয় না । তৃধার মতে তমালের মনের দরজা মুখের কাছাকাছি। যা মনে আসে তাই বলে দেয়। হোক সেটা উচিৎ কথা কিংবা অনউচিৎ । ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলার স্বভাব তার নেই।
সরে দাঁড়ালো তৃধা। তমাল নিজের ব্যাগ পত্র সোফার পাশে রেখে ধপ করে বসে পড়লো। তৃধা তড়িঘড়ি করে পানি এনে বললো,, এই নিন পানি।
তমাল বিরক্তে চোখ মুখ কুঁচকে বলে উঠলো,, আমাকে একদম আপনি করে বলবা না তৃধা আপু। নিজেকে কেমন বড় বড় মনে হয়।
তৃধা পানির গ্লাস তমালের হাতে দিয়ে বললো,, বড়ই হবেন।
তমাল পানির গ্লাসে চুমুক দেওয়ার আগে বলে উঠলো,, মোটেও না। তুমি আমার বড় আপু।
তমালের কথা শুনে তৃধা হিসেব করলো। ফরিদা হক চার ছেলেমেয়ে জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা নিয়ে সব ইতিহাস তৃধাকে বলে ফেলেছে। সেই হিসেবে তমালের বয়স বের করা খুব একটা কঠিন ব্যাপার নয়। তৃধার হিসেব শেষ হতেই বলে উঠলো,, গুনে গুনে দুই বছরের বড় ।
তমাল সোফা ছেড়ে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে বললো,, তুমি সম্পর্কে বড়। সম্পর্কের কাছে দুইতিন বছর ব্যাপারনা।
তমালের কথা শুনে তৃধা বোকার মত তাকিয়ে রইল। সম্পর্কে বড় ব্যাপারটা ঠিক হযম হলো না।
তৃধা সুধায়,, সম্পর্কে বড় মানে?
তমাল ব্যাগপত্র নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে বললো,, এইটা বড়দের কথা। তুমি খুব ছোট তৃধা আপু। যেদিন আমাকে নাম ধরে তুমি কিংবা তুই করে বলতে পারবে সেই দিন বলবো।
তমালের কথায় তৃধা ভ্রু জোড়া গুটিয়ে নিলো। তার সাথে ভাবনায় বিভোর হলো। একবার বলছে বড় একবার বলছে ছোট। আচ্ছা কোন সম্পর্কে বড়?
______
তমাল বাড়ি এসেছে এই খবর নবনী পর্যন্ত পৌঁছোতে সময় লাগেনি। খাবার টেবিলে বসা মাত্রই নবনী তমালের ফোনে কল করে বসলো। তমাল বিরক্ত হলেও শেষে রিসিভ করে।
ফোন রিসিভ করার পর থেকে অনবরত বকছে।তমাল কনফিউজড এই ভেবে,নবনী ফোন রিসিভ করার পর থেকে বকা শুরু করেছে, নাকি তার আগ থেকে বকছে ।
,, ভাইয়া তোর কত বড় সাহস তুই আমাকে না বলে বাড়ি গেলি। তোর কি একবারো মায়া হলো না?
তমাল উত্তরে বললো,, না।
নবনী রাগে গজগজ করে বললো,, এই এই তুই সত্যি আমার নিজ ভাই তো?
,, না। আম্মু তোকে পাড়ার মোড়ে থাকা ডাস্টবিন থেকে তুলে এনেছে। তখন তুই কেঁদে জয়নুল আংকেলের মেয়ে রুপসার ডায়পার খাচ্ছিলি।
তমালে সোজাসাপ্টা উত্তর
এইদিকে নাবীব শেখ আর ফরিদা হক বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসে ভাত বেড়ে খাচ্ছেন । হয়তো এমন ঝগড়া আগেও দেখেছে তারা। কিন্ত তৃধা আর সায়রা বানু বাকশক্তি হারিয়ে তমালের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তমাল মোবাইল লাউড স্পিকারে রেখে কথা বলছে আর খাচ্ছে। সায়রা বানু তমালকে ডাল দিতে নিয়ে বেমালুম ভুলে গেছে। তৃধা খালি প্লেটে তরকারি নিয়ে বসে আছে।
অপর প্রান্ত থেকে নবনী গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলো,, বেয়াদব ছেলে কোথাকার তোর কথা আমি বাবাকে বলবো। বাবা ঠিকই বলে তার ছেলে হাসপাতালে বদলে গেছে। ভালোটা গিয়ে ভাগ্যে পড়েছে অখাদ্য।
তমাল ভ্রু কুঁচকে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,, সত্যি বাবা?
এই মুহূর্তে তমালের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া জরুরি মনে করছেন না নাবীব শেখ। তমালের সাথে কথা বললে লো প্রেশার থেকে সোজা প্রেশার হাই হয়ে যাবে। তাই তিনি খুবই মিহি গলায় ফরিদা হককে উদ্দেশ্য করে বললেন,, ফরিদা ডালটা আরেকটু দাও তো।
বাবার কাছ থেকে উত্তর না পেয়ে তমাল নবনীকে বললো,, সেবার দাদি বাবার চিল্লাচিল্লি দেখে বলেছিলো বাবার মাথার দুইটা স্ক্রু খুলে পড়ে গেছে। এইদিকে আম্মু সব সময় বলে আমার মাথার একটা স্ক্রু ঢিলা। চিন্তা করে দেখ স্ক্রুর ব্যাপারটা আমাদের মধ্যে বেশ কমন। আমি যে তার ছেলে এইজন্য ডিএনএ টেস্টেরও দরকার হবে না। যদিও খেয়াল করে দেখলে বুঝবি তোর সাথে কানো মিল নেই। বাকি আল্লাহ হাফেজ।
নবনী ওই পাশ থেকে সমানে চিল্লাচিল্লি করছে। তমালের সেটা শোনার টাইম নেই। সে খুব আলতো হাতে কল কেটে খাওয়া শুরু করলো। তৃধা তখনো অবাক চিত্তে তাকিয়ে রইল। সায়রা বানু ঝগড়ার পূর্বাভাস দেখে কিচেনের দিকে ছুটলো। তিনি পন করেছেন এই বাপ বেটা যখনই এক সাথ হবে তিনি লুকিয়ে থাকবেন।
এইদিকে ফরিদা হক মুখ টিপে হাসছে।নাবীব শেখ রাগে গজগজ করতে করতে বলল,,আম্মা বাড়ি এসে এসব বলেছে? তাও এই গর্দভের সামনে? ফরিদা তুমি তোমার এই বেয়াদব ছেলের মুখ সামলাতে বলো। বাপকে বলছে মাথার স্ক্রু ঢিলা।
তৃধা ভয়ে খাওয়া শুরু করলো। তার মনেই হচ্ছে এই মুহূর্ত হতে পারিবারিক কলহ শুরু হবে।
তমাল পানির গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললো,, ওয়েট! ঢিলা বলিনি।বলেছি স্ক্রু খুলে পড়ে গেছে। তাও এটা আমার মুখের কথা না বাবা। তোমার মায়ের মুখের কথা। ছিঃ ছিঃ আমি এইসব কিভাবে বলবো? আমিতো শুধু কপি পেস্ট করলাম।
নাবীব শেখ দাঁতে দাঁত চেপে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,, ফ_রি_দা!! তুমি তোমার স্টুপিড ইডিয়ট ছেলেটাকে কিছু বলবে?
ফরিদা হক দায়সারা ভাবে বলল,, খাওয়া শেষ করে রুমে গিয়ে আম্মাকে কল দাও। এইদিকটা আমি দেখছি।
নাবীব শেখ খাওয়া শেষে গজগজ করতে করতে উঠে চলে গেলেন।
এমন সময় তমালের ফোনে মেসেজ এলো,” আপু এই মাত্র হল ছেড়েছে “।
ফরিদা হক কিছু বলবে তার আগে তমাল তাকে থামিয়ে দিয়ে সেই নাম্বারে কল করলো। না কল যেতে দেরি হলো, না রিসিভ হতেও দেরি হলো।
অপর প্রান্তে থাকা মানুষটা কি বললো সেটা শোনা না গেলেও তমাল বেশ গম্ভীর গলায় বললো,, সমস্যা নেই। খেয়াল রাখ টিকেটের জন্য যেন বেশিক্ষন অপেক্ষা করতে না হয়। আর হ্যাঁ পাশে যদি কোনো ছেলে বসে,,,! আমি কিন্তু সোজা তোর সাথে দেখা করতে রাজশাহী চলে যাবো। বলেই কল কাটলো। অতঃপর সোজা হয়ে বসে বললো,, আম্মু তোমার জংলি মেয়েটা মাত্র হল ছেড়েছে। আসছে তান্ডব করতে।
ফরিদা হক মাথা চাপড়ে বলল,, তোর মুখে কুলুপ এঁটে রাখতে পারিস না? কি বাবা,কি বোন সবার সাথেই তোর চাপার জোর দেখাতে হবে? তৃধাকে দেখ কতো শান্ত।
তৃধা চমকে তাকায়। তমাল হেসে উঠে বললো,, হ্যাঁ একদম তোমার নুসাইব বাবুর মত।
,, তমাল!! আম্মু কিন্তু ভীষণ রেগে যাবো।
মায়ের এহেন কথায় চোখ ছোট করে মুচকি হাসলো তমাল। ফরিদা হক হাল ছাড়লেন। ছেলে ভালো করেই জানে এই হাসির উপর তার মা কতটা দূর্বল।সেই জন্য সুযোগ বুঝে এই ভাবেই হাসবে।
তিনি তমালের ঝাঁকড়া চুলে হাত ডুবিয়ে বললো,, কবে বড় হবি তুই?
তমাল মায়ের পেট জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো কখনোই হবো না। আমি তোমার সেই বাবুই থাকবো।
তৃধা নিঃপলক তাকি আছে মা ছেলের দিকে। এমন সুন্দর দৃশ্য দেখতেও ভাগ্য লাগে। যেখানে পুরো একটা পরিবার ভালোবাসায় পরিপূর্ণ।
_____
দুপুর গড়িয়ে বিকেল। ড্রয়িং রুমে মায়ের কোলে মাথা দিয়ে তৃধার সাথে গল্প করছে তমাল। গল্প কম তার বাকি ভাই বোনদের দোষ গুনের কথাই বেশি হচ্ছে। তার সাথে ফরিদা হক তো আছেই। যে তমালের করা কীর্তি গুলো দাড়ি(।)কমা(,) সহ তৃধাকে বলছে।
এইদিকে বোনের খবর নেওয়ার জন্য তমালকে এই নিয়ে চারবার কল করেছে নুসাইব। যদিও সে নিজে একেবারের জন্যে নবনীকে কল করেনি।নুসাইব জানে বড় হওয়ার সত্বে তাকে সবাই ভয় পায়। নবনী সবার থেকে বেশি ভীতু। তাকে এই মুহূর্তে কল করা মানে বিশাল বড় টেনশনে ফেলে দেওয়া । সেটা নুসাইব চাইছে না। আপাতত তমালকে কল দিয়ে পিচ্চিটর খবর নিচ্ছে।
ঘন্টায় চার চারটা কল দেখে তমাল বিরক্তে ভ্রু কুঁচকে বললো,, দেখেছো তৃধা আপু! ঘন্টায় চারবার কল করলো। আমার মত হবু ডাক্তার এতো কল এটেন্ড করা মানেই তো বয়রা হয়ে যাওয়া।
ফরিদা হক ছেলের কথা শুনে বলল,, সারাদিন যে মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকিস তখন? এতে সমস্যা হয়না নবাব সাহেবের। শুধু আমার ছেলেটা কল দিলেই সমস্যা? তিনি তৃধাকে উদ্দেশ্য করে বলল,, বুঝলে তৃধা আমার বড় ছেলেটা ভালো দেখে সবাই এমন করে।
ফরিদা হককের কথায় তৃধা মুচকি হাসলো।
তমাল মাথা উঁচু করে বলল,, দেখেছো আপু বৈষম্য করছে। কথায় কথায় আমার বড় ছেলেটা। কখনো আমাকে বলেছে আমার ছোট ছেলেটা?
তৃধা হেসে উঠে বলল,, এইটা ভুল কথা। আন্টি সব সময় বলে” আমার তমাল, আমার ছোট ছেলেটা”। আমার যতটুকু মনে পড়ে কখনো শুধু “তমাল” সম্বোধন করে কথা বলেননি তিনি। আমার তো মনে হচ্ছে আন্টি তার ছোট ছেলেকেই বেশি ভালোবাসে।
তমাল গুটিসুটি মেরে মায়ের কোলে পুনরায় মাথা রেখে বললো,, ঠিক আছে, ঠিক আছে মানলাম।
তমালের কথা শেষ হতে না হতেই পুনরায় নুসাইবের কল। তমাল চমকে উঠে বসে বললো,, দেখো দেখো আম্মু তোমার শান্ত স্বভাবের ছেলেটা অশান্ত হয়ে আবার কল দিচ্ছে। একে বলো হয়তো হেলিকপ্টার নয়তো প্রাইভেট প্লেন কিনে ফেলতে। কাজ টাজ নেই অফিসে মোবাইল নিয়ে বসে আছে।
নুসাইব দরজায় হেলান দিয়ে দাড়িয়ে তমালের দিকে তাকিয়ে আছে।সদর দরজা খোলা থাকায় বিনা শব্দেই এলো। এসে এমন কিছু শুনবে তা কল্পনাতেও ছিল না।তার পিঠ পিছে এই বাদরটা কম নাচানাচি করছে না। নুসাইব শান্ত শিতল গলায় বলে উঠলো,,, সেই জন্যই তোকে কল দিচ্ছি। কাজ থাকলে তোর মত “গুড ফর নাথিং’ কে কেউ কল করতো?
তৃধা চমকে তাকালো। ফরিদা হক হাঁসি আটকানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। তমালের চেহারা দেখার মত। কোনো দৈবিক ক্ষমতা থাকলে সে এক্ষুনি গায়েব হয়ে যেতো। যদিও সেই ক্ষমতা তার নেই। তবে সে চাইছে এই মুহূর্তে বেহুঁশ হয়ে যেতে। কোনো ভাবে বেহুঁশ হতে পারলেই বাঁচে।
নুসাইব তৃধার দিকে তাকিয়ে দেখে সে বার বার হাঁই তুলছে। চোখ ফিরিয়ে মাকে উদ্দেশ্য করে বলল,, কখন থেকে এইখানে বসে আছো? কয়টা বাজে খেয়াল আছে? বিকেলে একটু ঘুমিয়ে নিলেই পারো। সাথে তোমার এই বড় বাঁদরটাকেও নিয়ে যাও। ঘুমালে যদি চেহারা একটু ভালো হয়।
তমালের চোখ চিলের চোখ।তার ভাইয়ের চোখ কোন দিক থেকে কোন দিকে গেছে সেটা সে ভালোই লক্ষ্য করেছে। ঘুমানোর কথাটা যে কাকে উদ্দেশ্য করে বলছে সেটা বুঝতে বাকি নেই।
তমাল ফটাফট উঠে বসলো। যার অর্থ সে এক্ষুনি ভাইয়ের কথা অক্ষরে পালন করবে। বিনা বাক্যব্যয়ে তড়িঘড়ি করে দোতলায় চলে গেল।
ফরিদা হক ছেলেকে সুধোয়,, দুপুরে খাওয়া হয়েছে?
নুসাইব মাথা নেড়ে অসম্মতি দিয়ে বললো,, না।
ফরিদা হক ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে গেল। ছেলে না খেয়ে আছে।
,, অদ্ভুত তো। না খেয়ে এতক্ষণ কেন? আয় বস আম্মু খাবার বাড়ছি।
নুসাইব সোফায় বসে টাইয়ের নট ঢিলে করতে করতে বললো,, ঠিক আছে দাও।
ফরিদা হক উঠে যেতেই নুসাইব তৃধাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,, হাঁই তোলা কোনো সমাধান নয়।ঘুম আসলে ঘুমাতে হয়। বসে বসে ওই গেছো ইঁদুরটার সাথে গল্প না করে ঘুমিয়ে নিলেই হতো। যাও রুমে গিয়ে কিছুক্ষণ ঘুমাও।
তমালকে গেছো ইঁদুর বলায় তৃধার বেশ হাসি পেলেও এই মুহূর্তে হাসা নিষেধ। তাই বাধ্য মেয়ের মত উঠে পড়লো। আসলেই তার ঘুম পাচ্ছে। কিন্তু এইভাবে কারো কথার মাঝে উঠে পড়া নিছক বে*য়া*দবি দেখে এতক্ষণ বসে রইল।আর দাঁড়ালো না সোজা গেষ্ট রুমের দিকে রওনা দিলো।
তৃধা চোখের আড়াল হতেই সোফায় গা এলিয়ে চোখ বুঝলো নুসাইব। তমাল এতক্ষণ উপর থেকে লুকিয়ে নুসাইবের কথা শুনছে। তার ধারনাই ঠিক ভাই শান্ত হলেও প্রেমে খুব দ্রুতই পড়েছে।
নুসাইব চোখ খুলতেই তমালের এক ভ্রু উঁচিয়ে রাখা চিন্তিত চেহারা খানা দেখতে পেলো। সে গলা খাকিয়ে তমালের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে,, কি সমস্যা?
তমাল কিছুনা বলে একবারে সামনে একবার পেছনে গিয়ে তৃতীয় বারের সময় নিজের রুম খুঁজে পেলো। তমালের কান্ডে নুসাইব শব্দ করে হেসে উঠলো।
ছেলে হাসি দেখে ফরিদা হক চপলা কন্ঠে বলে উঠলো,, কি ব্যাপার? আমার বড় বাচ্চাটা হঠাৎ এতো খুশি।
নুসাইব হাঁসি মুখে বলে,, আম্মু তমালটা শুধু হাতে পায়ে আর বয়সেই বড় হয়েছে। এখনো সেই চঞ্চলে বাচ্চা স্বভাব রয়ে গেছে।
ফরিদা হক নুসাইবের কথায় তাল মিলিয়ে বলল,, হ্যাঁ সেটাইতো দেখতে পাচ্ছি। তবে যাই বলিস,তমাল পুরাই তোর বাবার মত। তোর বাবা বুড়ো হলেও তার স্বভাব এখনো সেই যুবক থাকা অবস্থায় যেমন ছিল তেমনই আছে। দেখলে বুঝতি বাপ বেটা সারাক্ষণ কেমন ঝগড়া করে। তামাল পুরাই তার কপি।
_______
সন্ধ্যায় আসা মোবাইল কল আর মেসেজ দেখে তমালের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। গেইটের সামনে বারবার পায়চারি করছে। দারোয়ান বার কয়েক জিজ্ঞেস করলেও তমাল কিছু বলেনি। সে মৌন রয়েছে। তমাল তার কোঁকড়ানো চুলে বার বার হাত চালিয়ে নিচ্ছে। চেহারা কঠিন করে দিকবিদিক হাঁটছে। সময়ের সাথে হাঁটার গতিও বাড়ছে।
চলবে,,,,
উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ১৩
তমাল সোফায় বসে অনবরত পা নেড়ে যাচ্ছে। নবনী তখন খাওয়া দাওয়ায় ব্যাস্ত। তৃধা সবে মাগরিবের নামাজ সেরে ডায়নিং টেবিলে বসলো।
নবনীর খাওয়া শেষ হতেই সায়রা বানু এক কাপ চা এনে দিতেই নবনী নাকোচ করে বলে উঠলো,, খালা এখন আর চা খাবো না। কিছুক্ষণ ঘুমাবো, খুব টায়ার্ড লাগছে।
খালা চায়ের কাপ সামনে থেকে সরাতে নিলেই তমাল বলে উঠলো,, খালা ওকে চা দাও। নবনী তুই এখন চা খাবি। খেয়ে রুমে যা কথা আছে।
নবনী ভ্রু কুঁচকে বললো,, আরে!! কথা থাকলে বলবি সমস্যা কি। কথা শেষ হলেই ঘুমাবো। তবে এখন চা খাবো না।
তমাল পা নাড়া বন্ধ করে শক্ত পোক্ত গলায় বলল,, তখন মাথা ধরে যাবে। যা বলছি তাই কর।
নবনী মুখ বাঁকিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। এইদিকে তৃধার যেন কিছু একটা খটকা লাগছে। এই বাড়িতে আসার পর তমালকে যতবার দেখছে তার সাথে এখন যাকে দেখছে সেই তমালের মিল নেই। এখন দেখা তমালের মুখাবয়বের কঠোরতার সাথে তার সেই চঞ্চলে বাউন্ডুলে তমালের কোনো মিল নেই। চোখ মুখ শক্ত করে বসে আছে। মোবাইল দেখছে আর পা নাড়ছে, মনে হচ্ছে কারো অপেক্ষায় আছে।
নবনী চা শেষে উঠবে এমন সময় তমাল তৃধাকে ডেকে বললো,, তৃধা আপু তুমি ওর সাথে যাও । আমি আসছি।
তৃধা বিনা বাক্যব্যয়ে মাথা নেড়ে উঠে পড়লো। এইদিকে সায়রা বানু চায়ের ট্রে হাতে নিয়ে তমালকে দেখছে। মনে হচ্ছে যেন এই তমালিকে তিনি খুব ভালো করেই চেনে। তৃধা সায়রা বানু থেকে চোখ সরিয়ে নবনীর সাথে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল।
তমাল মোবাইলের কাজ সেরে পকেটে রেখে নিজেও উঠে পড়লো।
নাবীব শেখ বাড়িতে নেই। তিনি বিকেলেই বেরিয়েছে। ফরিদা হক কল করে বলেছে তাড়াতাড়ি যেন বাড়ি চলে আসে। বাড়িতে তার ছেলে মেয়ে মিলে কি যেন খিচুড়ি পাকাচ্ছে।
মোবাইল চেক করে নুসাইবের ভ্রু জুগল কুঁচকে এলো। রাগে পুরো শরীর জ্বলছে তাও ছবিখানা বার কয়েক দেখে মনে করার চেষ্টা চালাচ্ছে ছবিতে থাকা মানুষটাকে কোথাও যেন দেখেছে।
নবনী বিছানায় দুহাতে মেলে শুয়ে পড়লো। যদিও তৃধা তখনো দাঁড়িয়ে। নবনী বিছানায় হাত দিয়ে ইশারা করে বললো,, বসোনা আপু, দাঁড়িয়ে আছো কেন?
তৃধা ধীরে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,, তমাল ভাইয়াকে কেমন গম্ভীর লাগছেনা? মনে হচ্ছে কোনো সিরিয়াস ব্যাপার আছে। আমার তো ভয় করছে।
নবনী টেনে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল তুমি ওই পাগলটার কথা নিয়ে চিন্তিত? আরে আপু ওইটা একটা নমুনা। বাদ দাও বসো।
তৃধা বসলো কিন্তু চিন্তা শেষ হলো না। বাড়িটাকেও আজ থমথমে মনে হচ্ছে। এই থমথমে পরিবেশ তার কেন জানি চেনা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এমন কিছু আগেও ঘটেছে।
দরজা দুবার নক করে ঠেলে ঢুকলো তমাল। নবনী হাই তুলতে তুলতে বললো,, হুম ভাইয়া কি বলবি বল।
নবনীর কথা শেষ হতে না হতেই তমাল কাঠ কাঠ গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ল,, ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে কার গাড়িতে উঠেছিলি? তোর পরিচিত? কিভাবে পরিচয়? কখন থেকে? তোর কি হয়?
তমালের হটাৎ করা প্রশ্নে থমথমে খেয়ে গেল নবনী। এক মূহুর্তের জন্য মনে হলো হৃৎপিণ্ডের রক্ত সঞ্চালন হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেছে।কেউ যেন কলিজা খা*ম*চে ধরেছে। তমাল এমন প্রশ্ন করবে নবনীর কল্পনাতেও ছিল না। নবনী যেন কথা বলার শক্তি হারিয়েছে। ঠিক কি বলবে সেটা খুঁজে পাচ্ছে না। খুঁজে পেলেও গলায় চে*পে যাচ্ছে।
তমালের করা প্রশ্ন শুনে তৃধার পুরনো সেই দিনের কথা মনে হতে লাগলো । হ্যাঁ এই প্রশ্ন গুলো তার পরিচিত। এমন প্রশ্ন তাকেও করা হয়েছিল। নবনীর মত থমথমে চেহারা তাঁরও হয়েছিল। কি উত্তর দিবে সেই খেই হারিয়েছিল।
তমালের ভরাট কন্ঠ পুনরায় কানে বাজতেই তৃধা অতীত ছেড়ে বেরিয়ে এলো।
,, কথা বলছিস না কেন? কার গাড়িতে উঠেছিলি?
নবনী ঠোঁট জোড়া ভয়ে তির তির করে কাঁপছে। হয়তো উত্তরটাই পাচ্ছে না।
এমন সময় রুমে প্রবেশ করলো নুসাইব তার পেছন পেছন গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এলো ফরিদা হক।
নুসাইব পকেটে হাত গলিয়ে দাঁড়ালো।
তৃধা একপাশে সরে ফরিদা হকের কাছ ঘেঁষে দাঁড়ায়। বড় ভাইকে দেখে নবনীর হাত পা ঠান্ডা হয়ে অসাড় হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে শরীরের সব রক্ত বরফে পরিনত হচ্ছে।
ফরিদা হক তমালের রক্তিম চেহারা দেখে জিজ্ঞেস করলো,, কি হয়েছে বাবু ? এতো রেগে আছিস কেন? কি করেছে নবনী?
তমাল রাগে হাত মুঠ করে গলা উঁচিয়ে বলে উঠলো,, কি করেনি সেটা বলো আম্মু? দিন দুপুরে কার সাথে ঘুরছে, কার সাথে চলছে জিজ্ঞেস করো। হল থেকে কার গাড়িতে চড়ে বাড়ি এসেছে জিজ্ঞেস করো তোমার মেয়েকে।
ফরিদা হক আচম্বিত নয়নে নবনীর দিকে তাকালো।
নবনী ভাইয়ের চি*ৎকারে জড়োসড়ো প্রায়।
ফরিদা হককের মুখাবয়ব কঠিন হলো। তিনি শক্ত পোক্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো,, কি হলো নবনী। ভাই কি বলছে উত্তর দে?
তৃধার কলিজা শুকিয়ে চৌচির। নুসাইবের চোক্ষু দৃষ্টি তীরের মত । সেই চোখ দিয়ে বোনের গতিবিধি লক্ষ্য করছে। নুসাইবের চোখে চোখ রাখার সাহস নবনীর নেই। তার দৃষ্টি বিছানা চাদরেই সীমাবদ্ধ।
তমাল নবনী থেকে উত্তর না পেয়ে বলল, ওকে ফাইন। তুই যখন কিছু বলবি না বলে ঠিক করেছিস। তাহলে কাল তাকে ধরে নিয়ে আসি। সে বলবে সত্যিটা। বিশ্বাস কর নবনী দুই ঘণ্টা সময় লাগবে না তাকে ধরে নিয়ে আসতে। তুই কি চাস ধরে নিয়ে আসি?
তমালের কথা শুনে নবনীর কলিজায় মো*চড় দিয়ে উঠলো। নবনী তৎক্ষণাৎ বলে উঠলো, না।
তমাল চি*ৎকার করে বলে উঠলো,, তাহলে বলিস না কেন? মাথা খারাপ করিস না নবনী। জানে মে*রে ফেলবো।
নবনী শব্দ করে কেঁদে উঠলো। ভাইয়ের কথা মিথ্যা নয়। সে চাইলে এক্ষুনি সবটা বের করতে পারে।
নুসাইব শান্ত গলায় ডাকলো,, তমাল! শান্ত হ।
,, কি ভাবে শান্ত হবো ভাইয়া? কম তো আদর করিনা তাও কেন এতো বিগড়ে গেলো। বিশ্বাস না হলে জিজ্ঞেস করো। কখনো সন্ধ্যায় বেরহলে গাড়ি পেতে দেরি হয়েছিলো কিনা? হলে কখনো সমস্যা হয়েছিলো কিনা? রাস্তায় বের হওয়ার পর কখনো কেউ কিছু বলেছে কিনা? আমি আমার বোনকে অন্য শহরে পাঠাচ্ছি এমনি এমনিতো আর পাঠায়নি। চব্বিশ ঘন্টা ওকে দেখার মত লোক সেখানে আছে। আমি চাইলে আরো আগেই এইসব বের করতে পারতাম, কিন্তু কি বলোতো,সে বড় হয়েছে তার আলাদা একটা প্রাইভেসি আছে। আমিও চাইনা কোনো ছেলে তাকে চব্বিশ ঘন্টা চোখে চোখে রাখুক। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এইটাই সবচেয়ে বড় ভুল।
ফরিদা হককের পুরো শরীর থর থর করে কাঁপছে। তৃধা তার অবস্থার গতিবেগ দেখে ধরে ডিভানের উপর বাসায়।
নুসাইব জানে তমাল নবনীর ঠিক কতটা খেয়াল রেখেছে। হাতে কলমে পড়িয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ালো। চান্স পাওয়ার পর নবনীর চাইতে তমালই বেশি খুশি ছিল।তমাল নিজেই দায়িত্ব নিয়ে নবনীকে ভর্তি করানোর জন্য তোড়জোড় শুরু করে। নাবীব শেখ প্রথমে অমত করলেও নুসাইব ঠিকই অনুমতি দিয়েছিল। নবনীর সুবিধা অসুবিধা সবটা তমাল নিজেই দেখেছিলো। আজ নবনীর করা কাজে কষ্ট পাচ্ছেও বেশি তমাল।
যৌবনের প্রথম প্রেম নবনীর। কোনো পুরুষকে ভালো লাগা থেকে শুরু করে তার প্রতি বিন্দু বিন্দু আবেগ অনুভূতি জমিয়ে ভালোবাসা হলো।
এখন পরিবার জেনে গেছে,মেনে নিবে না, তাকে ছাড়তে হবে, তাকে দেখার অনুমতি নেই, কথা বলার অনুমতি নেই, তাকে নিয়ে ভাবার অনুমতি নেই, শেষ অন্তরালে সজ্জিত ছোট ভালোবাসার ময় ঘরটাও ভাঙ্গতে হবে তার। ভাবতেই পুরো শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠলো নবনীর। উহু সে পারবে না। তাকে ছাড়া তার চলবে না। দিন নয়, মাস নয়, বছর নয় বরং তাকে ছাড়া এক মূহুর্ত চলবে না। তাকে ঘীরে অনূভুতি গুলো ভুলতে পারবে না। ভালোবাসায় মোড়ানো আলাপচারিতা কি করে ভুলবে সে। দিন রাত তার খেয়াল রাখা ব্যাক্তিটাকে কি আধো ভুলার মত। পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটার সেই মূহুর্ত গুলো ভুলবে কি ভাবে সে?
নবনী পাগল প্রায়। নিজের চুল নিজে খামচে ধরে আকুতি স্বরে বলল,, ভাইয়া প্লিজ ভাইয়া।
তুধার চোখ জোড়া জলে সিক্ত। নবনী আর তার মধ্যে পার্থক্য নেই। নবনীর মাঝে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে আঁতকে উঠলো । নবনীর ভেতর হওয়া অনূভুতি উপলদ্বী করছে তৃধা।
ফরিদা হক তৃধার হাত চেপে ধরে বসে আছে। তার খারাপ লাগছে। এই অশান্তি মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে।
নাবীব শেখ বাড়ি এসেছেন ঠিকই কিন্তু নবনীর ঘরে ঢোকেনি। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে সবটা শুনছে। এই বয়স আবেগ অনুভূতির বয়স। বয়সটা তার নিজেরও ছিল। ফরিদার পেছন পেছন কম ঘোরেনি । শেষ বিয়ে করেই দম নিয়েছে। কিন্তু আজ কালকার ভালোবাসার বিশ্বাস নেই। মেয়েটার কপাল তৃধার মত হবে নাতো? তিনি ভয় পাচ্ছেন। ভীষণ ভয় পাচ্ছেন।
দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে হাজার চিন্তা ভাবনা করলেও ঘরে প্রবেশ করলো না। বাবার চোখে মেয়ের জন্য যতটুকু স্নেহ, মায়া, ভালোবাসা আছে তা অক্ষুন্ন থাকুক। তিনি চায় আজকের পরেও নবনী তাকে দেখে আহ্লাদ করুক, আবদার জুড়ে দিক। এই মূহুর্তে নবনীর ঘরে ঢুকলে সে তার বাবার কাছে ছোট হয়ে যাবে। এতোটাই ছোট হবে চোখে চোখ রেখে আবদার তো দুরে থাক , কথা ওবদি বলতে পারবে কিনা সন্দেহ।
নুসাইব নবনীর সেই আকুতি ভরা কন্ঠ উপেক্ষা করে বললো,, কত দিনের রিলেশন?
তমাল ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললো,, জিজ্ঞেস করছো কেন?
নুসাইব তমালের দিকে তাকাতেই তমাল চুপ হয়ে গেল।
নবনী হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে বলল,, পাঁচ মাস।
নুসাইব বুক ফুলিয়ে গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,, পাঁচ মাস কম সময় নয় নবনী। চিন্তা করলে বেশিও নয়। কেউ পাঁচ মাসে এতোটা আপন হয়ে গেল কিভাবে। যার জন্য তুই আমাদের কথাই ভুলে গেলি? ঠিক আছে মানলাম এই বয়সটা ভুল করার বয়স। ওকে ফাইন, এই নিয়ে কেউ আর কথা বলবে না। তবে হ্যাঁ এই নিয়ে তোকেও যেন আর কথা বলতে না দেখি। যা হয়েছে হয়েছে। এইসব বাদ আজ থেকে। মনোযোগ অন্য কোথাও না দিয়ে পড়ালেখায় মনোযোগ দে। আমি চাই না অন্তত এই মূহুর্তে পড়ালেখার কোনো প্রকার ক্ষতি হোক।
নবনী হেঁচকি ওঠা গলায় বলল,, ভাইয়া প্লিজ এরকম করো না। আমি পারবো না। প্লিজ ভাইয়া বুঝার চেষ্টা করো। প্লিজ ভাইয়া, প্লিজ,, ভাইয়া একবার আমার দিকটা চিন্তা ক,,,
নুসাইব রেগে চিৎকার করে বলে উঠলো,, নো মোর ওয়ার্ডস্ নবনী!! আদার ওয়াইজ পড়ালেখাটাও বন্ধ করে দিতে হবে। আমাকে এতোটাও কঠোর হতে বাধ্য করিস না। আমার স্নেহকে দূর্বলতা ভাবার কোনো কারন নেই। আমি যা বলছি তাই হবে। এর বাইরে আর কোনো কথা নয়। বুঝতে পেরেছিস?
নুসাইবের চিৎকারে কেঁপে উঠলো তৃধা । ফরিদা হক নিজেই চমকে উঠেছে। তার শান্ত ছেলেটাকে আগে এমন রাগতে দেখেনি।
নবনী শক্ত হয়ে গেলো। চোখের পানি মুছে ঠোঁট কামড়ে বসে রইল।নবনী বুঝতে পারে আর যাই হোক তার ভাইয়েরা তার এই সম্পর্ক মেনে নিবে না। তাছাড়া এই মূহুর্তে তাদের কিছু বুঝানোও যাবে না। এই মূহুর্ত কেন হয়তো এই জীবনেও না। নবনী ঠিক করে নিয়েছে সে যে করেই হোক পালাবে। আপাতত তাদের সব কথা মেনে নিবে।
তৃধা নবনীর চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু উপলব্ধি করতে পারলো। নবনী ঠিক নেই, একটু ঠিক নেই। মুখাবয়ব শক্ত করে বসে আছে মেয়েটা। এই অনূভুতিহীনতাই ভুল সিদ্ধান্তের প্রথম ধাপ। যেমনটা তৃধা নিজেই নিয়ে ছিলো। নবনীর মাথায় এই মুহূর্তে কি চলছে তা তৃধার কাছে স্পষ্ট।
এমন সময় নবনীর মোবাইল ফোন শব্দ করে বেজে উঠলো।
তমাল শান্ত শিতল গলায় বলল,, মোবাইল দে।
নবনী ডুকরে কেঁদে উঠে বললো,, প্লিজ আমি তোমাদের সব কথা শুনবো। তাও মোবাইল নিও না। আমি সত্যি বলছি আজকের পর থেকে আর কোনো যোগাযোগ রাখবো না। ইভেন কথাও বলবো না। প্লিজ ভাইয়া মোবাইল নিও না।
ফরিদা হক আলগোছে চোখ মুছলেন। মেয়েটাকে এমন দেখে তার কলিজা পু*ড়ছে।
তৃধা নবনীর চোখের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলে উঠলো,, কোনো প্রকার ভুল সিদ্ধান্ত নিও না নবনী। এই পরিবেশ, এই পরিস্থিতি সবটাই আমার চেনা। তার চেয়ে বেশি চেনা তোমার এই সহজ স্বীকারোক্তি। তোমার নেওয়া সিদ্ধান্ত তোমাকেই ধ্বংস করবে,যেমন আমার নেওয়া সিদ্ধান্ত আমাকে করেছে। বিশ্বাস করো, মানুষটা ভুল হলে আমার মত মাঝ সমুদ্রে এসে পড়বে।
তৃধার বলা কথায় চমকে উঠলো নবনী।
চলবে,,,
(ভুল গুলো শুধরে দিবেন। )