আমি আছি পর্ব-১৭+১৮+১৯

0
964

উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ১৭

পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন , বড় আর বিভ*ৎস যদি কোনো শা*স্তি থাকে তবে সেটি হবে অনুসূচনা। শারীরিক ত্রুটি বিচ্যুতি ছাড়াই একটা মানুষকে তিল তিল করে শেষ করে দেয়। অনুসূচনা হৃদযন্ত্রের কর্মক্ষমতাকে ধীরে ধীরে নিঃশেষ করে দেয়। ক্রমেই দূর্বল হয় মনবল। মস্তিষ্কের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সৃষ্টি হয় অস্থিরতা। তবে এই অনূসূচনা কিংবা অপরাধ বোধে কেউই নির্দিষ্ট সময়ে ভোগে না। হয়তো জিবন কালের শেষ সীমান্তে এসে অনুসূচিত হয়, আবার কেউ কেউ খুবই অল্প সময়ে। সেই অনুসূচনা তাড়া করতে শুরু করলো রজবকে। পুকুর পাড়ে সান বাঁধানো ঘাটে বসে ভাবছে সেই দিনের কথা।
যখন সুমনার প্রতি অদ্ভুত এক মৌহ তৈরি হয়েছিলো তার। বেশি সময় ধরে নয়, বরং খুব অল্প সময়ে সব কিছু শুরু হয়। চাকরি পেতে না পেতেই নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছিলো রজব । ফিটফাট তৈরি হয়ে গন্তব্যে ছুটে চলা রোজকার নিয়ম ছিল তখন। নির্ধারিত জায়গা বাস থামলো তখন। কেউ উঠছে তো কেউ নামছে। এর মধ্যে সুমনা নামতে গিয়ে পড়ে যেতে নেয়। তৎক্ষণাৎ রজব সামলে নিলো তাকে। প্রাণ বাঁচানোয় কৃতজ্ঞতার শেষ নেই সুমনার। সেই দিনের ঠিক পরদিন আবারো দেখা তাদের। সুমনা মাঝপথ থেকে বাসে উঠলো ।রজব ভদ্রতার খাতিরে সিট ছেড়ে বসতে দিলো। সুমনা চোখে ইশারা করে শুকরিয়া জানালো । বিনিময়ে রজব মুচকি হেসে মাথা দোলায়। এইখানেই শেষ নয় ঠিক পরদিনই দুজনের পুনরায় দেখা। সেই একই ভাবে। তবে এইবার দুজন পাশাপাশি বসলো। অল্প স্বল্প আলাপচারিতায় শুরু হলো সব। নিজ নিজ কর্মক্ষেত্র থেকে শুরু করে জানজট পর্যন্ত কোনোটাই বাদ যায়নি। জ্যাম পড়ায় রাস্তায় থেমে থেমে চলছে গাড়ি।বার কয়েক সুমনার গায়ের সাথে ধাক্কা লাগলো রজবের। সুমনা সরে বসলো না। বরং সে তার জায়গায় অনড় রইলো। সুমনার স্বাচ্ছন্দ্যবোধ দেখে রজব মৌন রইলো।রোজ রোজ দেখা আর দীর্ঘ আলাপচারিতার জের ধরেই মৌহের সৃষ্টি। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে সম্পর্ক এগুলো। অবৈধ এক চাহিদা প্রগাঢ় হলো মাঝে। চাহিদায় লাগাম না টেনে বরং সর্বোচ্চ প্রশ্রয় দিলো। রজবের মনে হতে লাগল তৃধা নয়,তার জন্য সুমনাই যোগ্য। মৌহের নেশায় ধরলো তার। দিনক্ষণ ঠিক নেই হুট করে বিয়ের সিদ্ধান্ত।কে আছে কে নেই সেটার ধার ধারাল না কেউ। মূহুর্তে মনোবাসনা পূর্ণ করাই যেন প্রধান লক্ষ্য। কল্পনা করেই লম্বা শ্বাস ছাড়লো রজব। আজকাল সেই নেশা ধরছে না তার। আগে সংসারে অভাব থাকলেও কারো দারগ্ৰস্ত হতে হয়নি তাকে। তৃধা অল্পেও সব সামলে নিয়েছিল। কিন্তু এখন! এখনকার চিত্র ভিন্ন। আগে শুধু টাকার অভাব থাকলেও এখন বিলাসীতার অভাব চলছে। দৃষ্টি নন্দন জিনিসের অভাব। সেই অভাব পূরণ করতে করতে মানুষের কাছে হাত পাততেও দ্বিধা বোধ করেনি। লোকের কাছ থেকে ধার নিয়ে সুমনার মন রেখেছে।ঘর সাজানো থেকে শুরু করে সব করেছে। তাও সুমনার মধ্যে নেই নেই ব্যাপারটা রয়ে গেছে। এতো সব কিছুর মধ্যে রজব মনে মনে সুমনার সাথে তৃধার তুলনা করতে শুরু করলো। কার তুলনায় কে ভালো,কেউ উত্তম ,কে অধম ব্যপারটা সারাক্ষণই চলছে মাথায়। রজব গভীর নিঃশ্বাস ফেলে শূন্যে চোখ রাখলো।

এর মধ্যে সুমনা তড়িঘড়ি করে এলো। কন্ঠে চপলা ভাব রেখে বললো,,

‘দেখো দেখো দারুন না?’

রজব তাকালো সেই দিকে।

সুমনা মোবাইলে ছবি দেখাচ্ছে। কাপলদের জন্য দেওয়া পাঞ্জাবি আর শাড়ির ছবি।

সুমনা নাকি সুরে বলল,,
‘দেখো সবাই সবার প্রিয় মানুষকে উপহার দিচ্ছে। তুমি আমায় দিয়েছো কখনো?’

রজব সুমনার পুরো মুখে চোখ বুলোয়। চেহারায় কৃত্তিম সৌন্দর্য, মেকাপের আড়ালে ভাটা পড়েছে অকৃত্তিমতা।কে বলবে সে গ্ৰাম্য বধু?গায়ে জড়ানো দামি জামা যা সুমনা নিজে পছন্দ করে কিনেছে। তাও আবার নামি দামি শোরুম থেকে। দাম নিয়েছে গুনে গুনে আঠারোশ টাকা।রজব ভেবেছে হয়তো কোথাও বাইরে যাওয়ার জন্য কিনে রাখছে। পরে জানতে পারলো রেগুলার পরার জন্য। সেইদিন রজব লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে তৃধার কথা ভাবলো। রোজার ঈদ আর কোরবানির ঈদ মিলে তৃধার একটা শাড়ি ছিলো। কত সখ আহ্লাদ করে পরতো সেটা। আবার যত্ন করে তুলেও রাখতো। যদিও শাড়িটা খুব বেশি দামি ছিলো না। দাম দর করে একহাজার দিয়ে নিয়েছিলো।

সুমনা রজবের হাত ঝাঁকিয়ে বললো,,
‘কি দেখছো?কিছু বলছো না কেন?’

রজব যু*দ্ধে হেরে যাওয়া সৈনিকের মত করে মাথা নুইয়ে বলল,, ‘কিছু না।’

‘তাহলে কিনে দাও এইটা। একদিন তুমি আর আমি পরে ঘুরতে যাবো কোথাও।’

রজব ভাবছে অন্য কথা। মাসের আজ দশ তারিখ। বেতন পেয়েছে আজ নিয়ে চারদিন হলো, এর মধ্যে সবার পাওনা শোধ করতে করতে পকেটে কেবল হাজার পনেরোশ টাকা আছে। তাও কিছু পাওনাদার বিকেলে আসবে বলে কল দিয়ে রেখেছে। হতাশায় ছেয়ে গেলো চারপাশ। দুপুর গড়িয়ে গেছে, বিকেল হতে দেরী নেই।
সুমনার হাত ছাড়িয়ে বলল,, ‘গামছা আর লুঙ্গি নিয়ে আসো। গোসল সেরে খেয়েদেয়ে বেরুবো কাজ আছে।’

সুমনা চকিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,, রান্না করেছে কে? আমি রান্না টান্না করিনি। মাথা ব্যাথ্যা করছে। চুলোর জাল বড্ডো গরম ,ব্যাথ্যা বাড়বে।

সুমনার কথায় মাথায় বাজ পড়ার মত অবস্থা হলো।রান্না করেনি মানে? রান্না করেনি ব্যাপারটা ভাবতেই, রজবের রাগ হলো ভীষণ। তৃধা থাকতে এতো চিন্তা করতে হতো না। আজান দেওয়ার আগেই রান্না বান্না করে গোসল সেরে বসে থাকতো সে। ভাবতেই রাগে মাথার রগ ফে*টে পড়ার জোগাড়।তাও নিজেকে ভীষণ ভাবে সংবরণ করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,, মোবাইলে এইসব দেখার সময় মাথা ব্যাথ্যা হয় না? সামান্য ভাত ডাল রান্না করার বেলায় যত সমস্যা। সাপ্তাহে ঠিক করে দুইদিনও ঘরে ভাত খেতে পারি না। ঘরে থেকে করছো টা কি?

রজবের কথায় রাগলো সুমনা। রেগে পেছন ফিরতেই চোখ পড়লো জমিলা আর সোহাগীর দিকে। দু’জনের হাতে এঁটো থালা বাসন। সুমনা ঘুরে রজবের দিকে তাকায়। তার চোখ জোড়া ভিজে উঠলেও রাগে দুচোখ দিয়ে আ*গু*ন ঝরছে। হয়তো এই রাগের কারণ জমিলা আর সোহাগী। স্বামীর বলা তিক্ত কথা শুনে ফেলেছে জায়েরা। সময় বুঝে নিশ্চয়ই কথা শোনাবে? সুমনা ধুপধাপ পা ফেলে ঘরের দিকে ছুটলো।

জমিলা আর সোহাগী এসেই অপ্রস্তুত হয়ে গেছে। দু’জনের চোখে দ্বিধা দ্বন্দ্ব ভাব। যাবে কি যাবে না ভেবেই দাঁড়িয়ে রইল। রজব ঘাট ছেড়ে একপাশে সরে দাঁড়ালো। সোহাগী জমিলাকে কুনুই দিয়ে গুঁতো মেরে ইশারা করলো। বড় জায়ের ইশারা পেতেই জমিলা এগোয়।

সোহাগী থালা বাসন রেখে গলা ঝেড়ে বললো,, সবাই সুখ বয়ে আনে না রজব। নারী হচ্ছে পুরুষের শান্তির জায়গা, যেখানে পুরুষ তার সকল ক্লান্তি ভুলে যায়। যার নীড়ে ফিরলে জাগতিক সকল সমস্যা তুচ্ছ মনে হয়। তবে এই নারী তোমার জন্য দুঃখ ব-ই কিছুই না। তুমি সুখ পায়ে ঠেলে দুঃখ কুড়িয়ে নিয়েছো ভাই। তিক্ত হলেও সত্য তোমার ঘর আর বাহির দুটোর মধ্যে পার্থক্য করা মুশকিল।

জমিলা তাচ্ছিল্য করে বললো,, তোমার সব আছে রজব। শুধু সুখ নেই। তৃধা নামক সুখের অভাবে তোমার সুখ নেই।

আজ রজব রাগলো না। ভাবীদের কথায় মাথা নোয়ালো। আসলেই তার সুখ নেই। হ্যাঁ তৃধা নামক সুখ নেই।
__________________

ফরিদা হক তৃধার চুল আঁচড়ে দিচ্ছেন। নবনী গালে হাত ঠেকিয়ে তৃধাকে দেখছে। প্রথম দিন যখন দেখেছিলো তখনকার চাইতে এখন বেশি সুন্দর লাগছে তাকে। গায়ের রং চকচক করছে। চেহারায় মলিনতা নেই এখন। হাসলেও দারুন লাগে। তৃধার চুল আঁচড়ে দিতে দিতে ফরিদা হক মুচকি হাসলো। ক্ষানিকের জন্য স্বার্থপর হয়ে গেছিলেন তিনি। কখন যে মাতৃস্নেহ, মায়া,মমতা ছেড়ে অসূয়া হয়ে উঠেছিলেন টেরই পেলেন না। গভীর নিঃশ্বাস ফেলে তৃধার চুলে হাত বুলিয়ে বললো, মাশাআল্লাহ তৃধা।

তৃধা মুচকি হাসলো।

নবনী তৃধার কোমর সমান চুল দেখে মুচকি হেসে মনে মনে বলে উঠলো,, চুলটাও বাদ যায়নি। মাশাআল্লাহ চুল সুন্দর ,সে সুন্দর,ব্যাক্তিত্ব সুন্দর,তার সাথে সুন্দর মন । খারাপ না ! ভাইয়ার সাথে দারুন মানাবে।

নবনীর হাঁসি হাঁসি মুখ দেখে তৃধা ইশারা সুধোয়,, কি?
নবনী মাথা নাড়ে, যার অর্থ কিছু না।

ফরিদা হক তৃধার চুলে খোঁপা করে দিয়ে বললেন,, নবনী আয়।

নবনী মাথা নেড়ে বললো,, উঁহু মা কাল শ্যাম্পু করেছি আজ তেল দিও না।

ফরিদা হক চোখ রাঙ্গায়।
নবনী নাকি সুরে বলল,ধ্যাত!

এর মধ্যে হাতে একটা প্যাকেট নিয়ে এলো তমাল। একপলক মায়ের দিকে আর তৃধার দিকে তাকিয়ে বললো,, তোমরা কখন থেকে বনমানুষকে মানুষ করার কাজ হাতে নিলে?
নবনী মুখের উপর থেকে চুল সরিয়ে তাকালো। পারলে এক্ষুনি গিলে ফেলে।

ফরিদা হক গম্ভীর গলায় বলল,, বাবু বেশি হচ্ছে কিন্তু।
তমাল মুচকি হাসলো। ফরিদা হক ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো, হাতে কি? আবার বাবার নাম করে দোকান তুলে আনিস নিতো? এইবার কিন্তু খুব বকবে।

তমাল ফ্লোরে বসে প্যাকেট খুলে আইসক্রিম বের করে বললো,, আগে খাও পরে বলছি।
নবনী ঝাঁপিয়ে পড়লো আইসক্রিমের উপর। তমাল যেন জানতো নবনী চাল। হাত সরিয়ে বললো,, সর! সর ! আগে বড়রা এরপর কচিকাঁচা পিচ্চিরা।

টাইয়ের নট ঢিলে করতে করতে সোফায় বসলো নুসাইব। বড্ডা ক্লান্ত সে। তমাল দিকবিদিক চিন্তা না করে নুসাইবের হাতে আইসক্রিম দিয়ে বললো,, খেয়ে দেখো ভাইয়া। ভালো লাগবে।

তৃধা আড় চোখে তাকালো। সকালে তমালের বলা কথাটা মনে পড়লো তার। নুসাইব আইসক্রিম হাতে নিয়ে ভ্রু গোটায়।

,, এই শীতের মধ্যে আইসক্রিম? তুই না হবু ডাক্তার? এইসব কি?

ভাইয়ের কথায় গলা ঝেড়ে বলল,, এক দুইদিন খেলে কিছু হবে না। খাও মজা লাগবে।
বিরক্ত হলো নুসাইব। তমাল এক এক করে তৃধা নবনী আর মায়ের হাতে আইসক্রিম ধরিয়ে দিলো।
তৃধা নবনী খাওয়া শুরু করলেও নুসাইব আর ফরিদা হক হাতে নিয়ে বসে আছে। নবনী দুজনের দিকে তাকাচ্ছে। যে খাবে না বলবে তার হাতেরটা সে নিয়ে নিবে।
তমাল ভ্রু কুঁচকে বললো,, তুই তোর ভাগেরটা শেষ কর। তারা এখন না খেতে চাইলে ফ্রিজে তালা বন্ধ করে রাখবো। প্রয়োজনে গরম কাল এলে খাবে। তাও তোকে দেওয়া হবে না।

তৃধা আইসক্রিম মুখে নিয়েই হাসছে। নুসাইব আড় চোখে তাকালো সেই দিকে। ফরিদা হকের চোখ এড়ালো না। ছেলের সেই চাহনি ধরা দিলো তার মমতাময়ী চোখে। তিনি মৃদু হাসলেন। কত অনুভূতি আবেগ মিশ্রিত অবাধ্য মন মুগ্ধকর চাহনি ছেলের। নিঃসন্দেহে এই চাহনি ভালোবাসার।

চলবে,,,

উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ১৮(ক)

নবনীর সাথে তৃধার সময় ভালোই যাচ্ছে। তিন্নিও বার বার কল দিয়ে দুজনের সাথে কথা বলেছে। পারলে এক্ষুনে উড়ে আসতো। যদিও তা কখনো সম্ভব নয়। তৃধা নবনী গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে।

রাত ফোহাতেই নুসাইব ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। আজো তার ব্যতিক্রম নয়, চিলোকোঠার ঘরে তার গুছানো জিম কর্নার। ফজর শেষে তমালকে টেনে হিচড়ে নিয়ে এলো উপরে। উদ্দেশ্য শরীর চর্চা। দুমিনিট না যেতেই ট্রেডমিলের উপর উপড় হয়ে শুয়ে পড়লো তমাল।সাথে করে নিয়ে আসা চাদরটা দিয়ে নিজেকে জড়িয়ে নিলো। বেচারা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। নসাইব ভীষণ বিরক্ত নিয়ে তমালের পশ্চাতে লাথি দিয়ে বলে উঠল,, গুড ফর নাথিং।
তমাল শুনলো না। শুনলে হয়তো বলতো ,’ ভবিষ্যৎ ডাক্তারের এতো বড় অপমান? এইটা মোটেও উচিৎ নয় ভাইয়া। অসুস্থ জাতির ভবিষ্য অন্ধকার হবে এই অপমানে।’

তৃধার অভ্যাস ভোরে ঘুম থেকে ওঠা। পুরনো সব অভ্যাস বদলাতে চাইলেও তৃধা চায় এই অভ্যাসটা অপরিবর্তিত থাকুক। ভোর সুন্দর,ভোর শুভ্র,ভোর স্নিগ্ধ , ভোর প্রশান্তিময়। ফজর নামায শেষে বাড়ির বাইরে পা রাখলো তৃধা। প্রতিটা নিঃশ্বাস ধারালো ছরির মত ঠেকছে। নাক দিয়ে নিঃশ্বাস নিতে মুখ দিয়ে ফেললো। ধোঁয়া বের হচ্ছে দেখে বার কয়েক মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস ফেললো তৃধা। হঠাৎ নিজের বয়স আর স্থান অনুমান করে দমে গেল। বার কয়েক মনে মনে আওড়ালো,, “ছিঃ এতো বড় মেয়ের এই গুলো শোভা পায় না”।
বাহিরের আবহাওয়ায় দুমিনিট সুয়েটার ছাড়া থাকলে নির্ঘাত জমে মৃত্যু হবে। তাও তৃধা সাহস করে বের হয়। ভাগ্যিস সুয়েটার শাল দুটোই আছে। সদর দরজায় জুতো জোড়া রেখে খালি পায়ে বের হলো। গায়ে সোয়েটার তার উপর চাদর জড়ানো। খালি পা জোড়া ঘাসে ছোঁয়াতেই শিওরে উঠলো। ঘাসের উপর জমে থাকা শিশির বিন্দু বরফ গলা পানির মত ঠান্ডা। এক একটা বিন্দু পায়ের পাতা স্পর্শ করতেই কলিজায় কাঁপন ধরার জোগাড়। দাঁতে দাঁত লেগে শব্দ হচ্ছে, ঠোঁট জোড়া কম্পায়মান। তাও তৃধা হাসলো। এইভাবে কেউ দেখলে নিশ্চয়ই পাগল বলবে? বলবে দেখো এর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। সুয়েটার চাদর দিয়ে জুবুথুবু হয়ে খালি পায়ে হাঁটছে। নিশ্চয়ই মেয়েটার মাথার তার ছেড়া?
দুয়েক কদম চলার পর ঠান্ডা ভাবটা সয়ে গেলো। সময় নিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে চলছে। সূর্যোদয় না হলেও বাইরে সব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তৃধার হাতে ঘড়ি নেই থাকলে হয়তো বুঝতো সূর্য উঠেছে নাকি উঠেনি। উঠলেও হয়তো কুয়াশার চাদরে ঢেকে আছে। পাতায় জমে থাকা শিশির বিন্দু মুখের উপর পড়তেই ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিলো। সেটা উপেক্ষা করে আবারো হাঁটা শুরু করলো। পকেটে হাত গলিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকালো নুসাইব। উদ্দেশ্য বাইরে কিছু সময় হাঁটার হলেও সেই উদ্দেশ্যে ভাটা ফেলতে তৃধার উপস্থিতই যথেষ্ট ছিলো। তৃধা গাছের পত্রপল্লব ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে। কখনো শিশির বিন্দু হাতে মাখছে তো কখনো পাতা ঝেড়ে সেটা ফেলছে। লম্বা শ্বাস টেনে মুচকি হাসলো নুসাইব । অতঃপর তৃধার পায়ের দিকে তাকিয়ে নিজেও জুতো জোড়া খুলে রাখলো। পছন্দনীয় রমনী পাগলামী করছে। নুসাইব বাঁধ সাধার প্রয়োজন মনে করলো না,বরং তৃধার সাথে নিজেও পাগলামোতে নাম লিখালো।
তৃধা তখনো ঘুরে ঘুরে দেখছে চারপাশ। নুসাইব ছোট কদমে তৃধার সমীপে দাঁড়ায়। তৃধার অসতর্ক মন টের পেলো না। নুসাইব কন্ঠে কোমলতা এনে বললো,,, ঠান্ডা লাগছে না?
নুসাইবের আকস্মিক কথায় চমকে তাকালো তৃধা। নুসাইবের শান্ত দৃষ্টি পড়লো তৃধার চেহারার আদলে। ঠান্ডায় চেহারার আদল ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। শুকনো ঠোঁট জোড়া ঈষৎ ফাক ,চোখে রাজ্যের ভয়। অবাধ্য অগোছালো চুল কপোল ছুঁয়ে দিচ্ছে বারবার। সেই চুলের আড়ালে লুকানো কাঁটা দাগের অল্প দেখা। ভয়ে চমকে ওঠা চেহারার মায়া অসীম। সতর্ক হলো নুসাইব,এক পলকে এতো কিছু খেয়াল করা মোটেও উচিৎ নয়। আর কিছু ক্ষণ তাকালে নির্ঘাত ধরা পড়বে।
তৃধা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,,
‘ আপনি! আমি আরো ভয় পেয়ে গেছিলাম। ভাবলাম কি না কি।

নুসাইব রয়ে সয়ে উত্তর দিলো।
‘ এই বাড়িতে ভুত জীন নেই। ভয় পেয়ো না।’

‘জীন সব জায়গায় থাকে। আয়না থেকে শুরু করে ছাদ , গাছপালা ইভেন আপনার সাথেও আছে।’

‘ভয় দেখাচ্ছো?’

নুসাইবের কথায় তৃধা মুচকি হেসে বলল,
‘মোটেও না। যা সত্যি তাই বলছি। তাছাড়া আপনি ভয় পাবেন না।’

নুসাইব ছোট শ্বাস ফেলে বললো,’ ভয় না হয় পেলাম না। কিন্তু তুমি এই শীতের মধ্যে খালি পায়ে কি করছো। ঠান্ডা লাগছে না?

তৃধা নুসাইবের পায়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।

আড় চোখে দেখলো সেই হাসি। নিশ্চয়ই তার এই বোকার মত কথায় হাসছে মেয়েটা। ভাবছে হয়তো নিজের পায়ে জুতো নেই আবার অন্যকে বলছে।

নুসাইব গলা ঝেড়ে বললো,, হাসির কি হলো?

‘ আপনার পায়ের জুতো খুঁজছি। আপনার ঠান্ডা লাগছে না?’

এই ভয়টাই পাচ্ছিলো নুসাইব। ঠিকই তৃধা ঠাওর করলো।
‘ দেখলাম তোমার পায়ে জুতো নেই তাই আমিও জুতো জোড়া রেখে এলাম। একজন খালি পায়ে অন্যজনের পায়ে জুতো ব্যাপারটা ভালো দেখাবে না।

তৃধা ভাবুক হয়ে বললো,, এই জায়গায় তমাল ভাইয়া থাকলে কি বলতো বুলুন তো?

দ্বিধায় পড়লো নুসাইব। তার ধারণা নেই।

তৃধা তমালের মত গম্ভীর গলায় বললো,, ‘তোমার পায়ে জুতো নেই তাই আমার পায়েও নেই। দেখো তৃধা আপু আমি কঠিন মাপের জেন্টেলম্যান। জেন্টেলম্যানরা কখনো খালি পায়ের মেয়ে দেখলে জুতো পরে আসে না। ‘

তৃধার এহেন কথায় শব্দ করে হাসলো নুসাইব। তৃধা নিজেও হাসছে।

এক পর্যায়ে তৃধা বলে উঠলো,, দুই ভাইয়ের মধ্যে মিল আছে । শুধু তমাল প্রকাশ করে, আপনি অগোচরে রাখেন।

নুসাইব হাঁসি বজায় রেখে সুধোয়,, বুঝলে কি করে?

তৃধা সময় নিয়ে বলল,, এই শালটা আপনার তাই না?

থমকায় নুসাইব। কি বলবে বুঝতে পারছে না।

তৃধা লম্বা শ্বাস টেনে বললো,, হুম,শালটা আপনার ছিল। আমার ঠান্ডা লাগছে দেখে আপনি শালটা আমাকে দিলেন। যদিও বলে ছিলেন আন্টি পাঠিয়েছে।

তৎক্ষণাৎ নুসাইব বলে,, আমি দিয়েছি বললে নিতে?

তৃধা নিরুত্তর। আসলেই নুসাইব দিয়েছে বললে নিতো না। কেন নিতো না জানা নেই তবে নিতো না। হয়তো নুসাইব একজন পুরুষ তাই। তা না হলে তখন নুসাইবের সাথে অল্প পরিচয় সেই জন্য। কারনটা তৃধার জানা নেই,তবে অদৃশ্য একটা দেয়াল রয়েছে। যে দেয়াল থাকা আবশ্যক।

নুসাইব শান্ত চোখে তৃধার চিন্তিত চেহারার দিকে তাকিয়ে বলল,, নিতে না তৃধা।বরাবরই মানা করে দিতে। তুমি জানো নেওয়া উচিৎ নয়। সে সল্প পরিচিত পুরুষ তার থেকে কোনো কিছুই নেওয়া তোমার শোভা পায় না। লোকে কি বলবে, সামনের মানুষটা কি ভাববে তার পরিবার কোন চোখে দেখবে এইসব মিশ্র চিন্তায় পড়ে তুমি নিতে না। তুমি ওরকম মেয়েই নও। নিলে হয়তো আমারো মানুষ চেনার গুনটা আর গুন হয়ে থাকতো না। এতে সন্দেহ ধরে যেতো। আমিও চাইতাম না তুমি নাও। তাই যেভাবে দিলে নিবে সেভাব করেই বললাম।

তৃধা অবাক চোখে চায়।

নুসাইব থেমে শূন্যে দৃষ্টি রেখে পুনরায় বলে উঠল,,
‘হ্যাঁ আমি স্বভাবত একটু চাঁপা। আমি তমালের মত অতো খোলাখুলি কথা বলতে পারি না। আমি বলার আগে ভাবি ,কাজ করার আগে ভাবি। সব বিষয়ের ভালো মন্দ বিচার করে নেই। তখন ভেবেই মিথ্যেটা বললাম। জানি সত্যি বললে তুমি শালটা কখনোই নিতে না। তোমার তুমি আর আমাদের মাঝের অদৃশ্য দেয়াল বাঁধ সাধতো।

তমাল ট্রেডমিল থেকে গড়িয়ে ফ্লোরে চলে গেছে। পিঠে বরফ লাগায় চমকে উঠে বসলো। বিরক্ত হয়ে ফ্লোরের দিকে তাকালো। ফ্লোর বরফের ন্যায় ঠান্ডা। তার দাঁত মুখ খিচে আসছে। ফ্লোর ছেড়ে হাই তুলতে তুলতে চিলেকোঠা থেকে বেরিয়ে চাদর জড়িয়ে ছাদের কোন ঘেঁষে দাঁড়ায়। আজ বোধহয় সূর্য উঠবে না। তমাল ভেবেই বিরক্ত। কুয়াশার কারনে সূর্য কেন অফ ডিউটিতে থাকবে সেটাই বুঝতে পারছে না। লম্বা হাই তুলে বাগানের দিকে তাকিয়ে চোক্ষু জোড়া খুলে পড়ার জোগাড়। ভাই তার সংসার তৈরির প্রচেষ্টা করছে। তমাল চোখ কচলে বিড় বিড় করে বলে উঠলো,, আমার গুনাগার চোখ জোড়া ভুল দেখছে নাতো? এই পাপী চোখে সব সময় এই গুলোই কেন ধরা দেয়?
তমাল হা হুতাশ করে কান‌ পাতলো। যদিও এতো এতো দূরত্বের কথা শোনা যাওয়া তো দূরের কথা মানুষ পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। তমাল আফসোসে জর্জরিত, এতো বড় ঘটনার শুরুটা দেখা হলো না।

চলবে।

উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ১৮(খ)

নুসাইবের কথায় অবাক চোখে তাকিয়ে আছে তৃধা। লোকটার প্রতি সুপ্ত এক ভালোলাগা ছুঁয়ে গেলো তৃধাকে। কল্পনাও করেনি নুসাইব তাকে নিয়ে এতো কিছু ভেবেছে।
তৃধাকে এতোটা চুপচাপ দেখে নজর ঘুরিয়ে তাকালো নুসাইব। তৃধার চোখ জোড়া তারই চেহারার আদলে দেখে খানিক হাসলো সে।

নুসাইবের চোখে চোখ পড়ায় খেই হারালো তৃধা। লজ্জায় কুঁকড়ে গেলো।ইস্ লোকটা দেখে ফেলেছে তাকে। কেমন নির্লজ্জের মত তাকিয়ে ছিলাম?
মনে মনে নিজেকে বেলাজা উপাধি দিতেও পিছপা হলো না। লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এমন হাড় কাঁপানো শীতের মাঝেও তার বেসামাল গরম লাগছে। এই মুহূর্তে কি বলবে খুঁজে পাচ্ছে না। ঈষৎ সাহস জুগিয়ে কথা ঘুরানোর জন্য বলে উঠলো,, নবনীর ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত নিলেন?

তৃধার এহেন প্রশ্নে চাঁপা হাসলো নুসাইব। মেয়েটা কথা ঘোরাতে চাইছে। ব্যাপারটা সে ঢের বুঝতে
পারছে। তৃধার চঞ্চল চোখ জোড়া প্রজাতির মত এপাতা ওপাতা ঘুরে বেড়াচ্ছে। নুসাইব বুঝে পায় না, এটা লজ্জা নাকি অস্বস্তি। তাও ট্রাউজারের পকেটে হাত গলিয়ে বলল,

‘ ব্যাপারটা নিয়ে ভাবাভাবির কিছু নেই। সোজাসুজি কথা বলবো। ওরা ওদের মধ্যে দিন তারিখ ঠিক করুক।’

‘ওহ্ আচ্ছা। ‘

নুসাইব আড়চোখে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,,এই ব্যাপারে শুনলাম সিনিয়র। কই সিনিয়র তো কিছুই বলছে না। শুধু “ওহ্ আচ্ছা” বলেই শেষ দিচ্ছে।

নুসাইবের কথায় তৃধা কপালে ভাঁজ ফেলে বললো,, খোঁচা মেরে কথা বলছেন?

নুসাইব মুচকি হাসে। আসলে সে খোঁচা মেরেই কথাটা বলছে। তৃধার এমন দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভরা চেহারা খানা দেখতে তার মোটেও ভালো লাগছে না। তাকে একটু খুঁচিয়ে যদি স্বাভাবিক করা যায়। কন্ঠে গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলল,, উঁহু মোটেও না। আমি ওরম লোকই নই।

‘ অবশ্যই খোঁচা মেরে কথা বলছেন। ওইদিনের কথাটা এখন বললেন। এইটা খোঁচা না? আমি কিন্তু মোটেও বাচ্চা মেয়ে না। গ্ৰামে ছিলাম দুই বছর। খোঁচা মেরে কথা বলার ধরন আমার মুখাস্ত।

নুসাইব তৃধার এহেন কথায় হেসে বলল,, ঠিক আছে। ভুল হয়ে গেছে।

তৃধা সামনে এগিয়ে যেতে যেতে বিড় বিড় করে বললো,, চাপা স্বভাবের নয় বরং আপনি আস্ত একটা বিটকেল স্বভাবের লোক।

কথাটা আস্তে হলেও নুসাইবের কানে স্পষ্ট শোনালো। না রাগা ,না কৌতুহল,না বিরক্ত বরং কথাটা জাদুকরী শোনালো। অদ্ভুত ভালোলাগা আবারো আকাশ ছুঁলো।

তমাল বোহু কষ্টে ভাইয়ের চেহারা ঠাওর করলো। ভাই তার দুই পাটির বত্রিশটা দাঁত বের করে আছে দেখেই পুনরায় চোখ কঁচলে তাকালো। উঁহু কোনো ভ্রম নয়, বরং কঠিন মাপের সত্য। ঘটনা এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তা না হলে কাহিনী বত্রিশ পাটি দাঁত পর্যন্ত থেকে যাবে। তমাল তার ঝাঁকড়া চুলে আঙুল চালিয়ে পুনরায় চাদর জড়ালো। আর কিছুক্ষণ থাকলে নিশ্চিত বরফ হয়ে যাবে। ভাইয়ের শরীরের প্রেমের আ*গুন জ্ব*লছে, সে এই মুহূর্তে জুতো ছাড়া কেন বরং শার্টলেছ ফ্রিজের ভেতর ঢুকে বসলেও বরফ হবে না। সেই জায়গায় তমালের প্রেমের আগুন তো দুরের কথা হালকা পাতলা কম্বলের মত ক্রাশও নেই।এই শীতে তার ম*রার চান্স একশো একশো। ভাবতেই তমালের পুরো গায়ে কাঁটা দিলো। দেরি না করে দরজার দিকে ছুটলো। এই মুহূর্তে কম্বল দরকার ,সেই কম্বলের উপর আরেকটা কম্বল দিলেও মন্দ হবে না।

_____

সকাল সাড়ে আটটায় ডায়নিং টেবিলে এসে বসলো সবাই। উদ্দেশ্য ব্রেকফাস্ট হলেও বাড়ির লোকজন উপস্থিত থাকা মানেই গোলটেবিল বৈঠক। নবনী টেবিলে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে। তৃধা বার কয়েক চেষ্টা করেও উঠাতে পারলো না। নুসাইব বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে অগোছালো চুল গুলো কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে আরো দুবার হাত বুলোয়। সম্পর্কে বোন হলেও ছোট বেলায় নিজের বাচ্চার মত করে লালন পালন করেছে তাকে। নবনীর দুমাস বয়স তখন ফরিদা হক আর নাবীব শেখ তমালকে নিয়েই হসপিটালে পড়ে ছিলো। নবনীর সম্পূর্ন দেখভাল নুসাইব আর তিন্নি করেছে।
তমাল আড়চোখে তাকিয়ে বলল,, এতো আদর দেখানোর কিছু নেই ভাইয়া। এইটা স্বাভাবিক ঘুম না। এইটা বিয়ের ঘুম।

নবনীর ঘুম ছুটে গেল। এই হুনুমানের জেরক্স কপিটার জন্য শান্তি নেই। নবনী চোখ রাঙ্গায়। বড় ভাই আর বাবা বসে আছে তাও এই গর্দভটা এইসব বলছে? নবনী পা দিয়ে খোঁচা মারলো তমালকে।
তমাল বুঝতে পেরেও পাত্তা দিলো না।

নাবীব শেখ চশমার উপর দিয়ে তমালকে দেখছে। কিছু কথা দাঁতে আশেপাশে ঘুরঘুর করলেও প্রেশার হাই হওয়ার ভয়ে বলছেন না। তৃধা আচম্বিত চোখে তমালের দিকে তাকিয়ে আছে। বিয়ের ঘুম? গ্ৰামে এমন কথা প্রচলিত থাকলেও শহরে হওয়ার কথা নয়। হলেও সেটা তমালের জানার কথা নয়।

ফরিদা হক রুটি আর ভাজি এনে টেবিলে বসলেন। সায়রা বানু চা আর ডিম সেদ্ধ এনে রাখলেন। ফরিদা হক ছেলের কথা শুনে বললো,, গ্ৰামের বুড়ো মহিলাদের মত কথা বলা কে শিখিয়েছে।

নুসাইব শান্ত গলায় বললো,, কেউ শেখায়নি আম্মু। তোমার ছেলে তার মেসের বাইরে পান দোকানে বসে দাদার বয়সী লোকদের সাথে আড্ডা দেয়। ওইখানেই শিখেছে। দুদিন দেখলাম মুচির দোকানে বসে গল্প করছে। আর কি কি শিখেছে আল্লাহ জানে।

,তমাল রুটি ছিঁড়ে মুখে দিয়ে চিবোচ্ছে। ভাই তাকে চোখে চোখে রাখছে কেন?সে কি ছোট বাচ্চা?

তৃধা অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে। ফরিদা হক তাড়া দিয়ে বললো,, বাদ দাও। শান্তি মত ব্রেকফাস্ট সেরে যে যার কাজে যাও।

সবাই খাওয়া শুরু করলেও তমাল নবনীকে ইশারা করলো। নবনী ইশারার কিছুই বুঝলো না। বরং ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,’ কি?’
তমাল রাগে দুঃখে চুল ছেড়ার জোগাড়। কোনো কুক্ষনে এমন ব্রেনলেছ পিসটা তার বোন রূপে পয়দা হয়েছে আল্লাহ জানে। হাল ছাড়লো সে। গলা ঝেড়ে গম্ভীর গলায় ডাকলো,, বাবা,,।

নাবীব শেখ ছেলের ডাক উপেক্ষা করলেন না বরং রুটি ছিঁড়ে ভাজি সমেত মুখে পুরে বললো,’ জ্বী মহারাজ বলুন!’
তমাল চোখ মুখ কুঁচকে বললো,’ দিলেতো সব বিগড়ে? এখন আর বলবো না।

নুসাইবের খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে বাবা আর ভাইকে দেখছে। চাইলেও তৃধার দিকে তাকাতে পারছে না। তৃধার পাশে নবনী বসা। সেটাই প্রধান সমস্যা। তাছাড়া চোখে চোখ পড়া মানেই বিপদ। কয়েক সেকেন্ডে হাজার অপ্রকাশিত অনুভূতি ব্যক্ত করবে এই বেহায়া চোখ। ভালোবাসার মানুষের চোখে চোখ রাখা যায় না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সেট প্রকাশিত হচ্ছে।

নাবীব শেখ গলা ঝেড়ে বললো,, কেন কি হলো?

তমাল ভাব নিয়ে বলল,, মহারাজরা যারতার সাথে কথা বলে না। সেখানে তুমিতো সামান্য প্রজা। তোমার এপয়েন্টমেন্ট লাগবে।

নাবীব শেখের রাগ তরতর করে বাড়তে লাগলো। তিনি দাঁতে দাঁত চেপে বললো,, ফ,,রি,,দা,, তুমি এই বেয়াদবকে কিছু বলবে?

ফরিদা হক মুখ টিপে হাসছে। নবনী মুখের সামনে হাত রেখে হাঁসি চাপিয়ে যাচ্ছে। তৃধার কাশতে কাশতে শেষ। নুসাইব বিরক্ত হলেও তার চেহারায় ব্যাতিব্যাস্ত ভাব। সে উঠে তড়িঘড়ি করে পানি ঢেলে তৃধার হাতে দিয়ে বলল,, আস্তে খাও।

নুসাইবের বিন্দু পরিমাণ খবর নেই কয়েক জোড়া চোখ তার দিকে তাক করা। কোনো জোড়া অবাক, তো কোনো জোড়া হাসছে,আবার কোনো কোনো চোখ জোড়া আদর লুটোচ্ছে।

তমাল গলা ঝেড়ে বললো,, বাবা চায়ের কাপটা দাও তো। নাবীব শেখের ধ্যান ভাঙল তিনি মুচকি হেসে তমালের দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে মিটমিট করে হাসছে।
,,,,,,,

নাস্তা শেষে হাতে ছাই রঙা ফাইলটা নিয়ে নামলো নুসাইব। তমাল নবনী আর তৃধা বসে বসে ছক্কা খেলছে। ভাইকে বেরুতে দেখে তমাল বলে উঠলো,,
, ভাইয়া কিছু টাকা দিয়ে যাও। বিকেলে বেরহব।

,নুসাইব বিনা বাক্যব্যয়ে মানিব্যাগ থেকে একহাজার টাকার একটা নোট বের করে দিলো তাকে।
তমাল ভ্রু কুঁচকে বললো,, এইগুলো তো ভাড়াতেই শেষ হয়ে যাবে। শপিং করতে যাবো। আরো দাও।

তমালের কথা শুনে বললো,, এতো শপিং দিয়ে কি করবি?
তমাল মুচকি হেসে বলল,, শুধু আমার জন্য না। তৃধা আর নবনীকে দেখিয়ে বললো। ওই দুইটাও আছে। কিছু কেনাকাটা হবে সাথে একটু ঘুরেও আসবো। এই বাড়িতে আসার পর থেকে আপু একটা বারের জন্যও বের হয়নি। ভাবলাম ঘুরে আসি।

নবনী মুচকি হাসলেও তৃধা মাথা নিচু করে রেখেছে। তার শপিংএর দরকার নেই। এই বাড়িতে আসার পর ফরিদা হক তাকে যাবতিয় সব কিছুই কিনে দিয়েছে। বাকি যা ছিলো তা নবনী এনে দিয়েছে। আপাতত আর কিছু কেনার বাকি নেই।
তৃধা কিছু বলবে তার আগে নুসাইব এক হাজার টাকার দশটা কচকচে নোট বের করে তমালের হাতে দিলো। তমাল অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। এই দিকে নবনীর চোখ খুলে পড়ার জোগাড়।
কাল উঠিয়েছিলো এক দরকারে আপাতত সেটা বাদ দিলো। তমাল টাকা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। তার অবাকতার সীমানা শেষ। নুসাইব তাকে আরো বেশি অবাক করে দিয়ে বললো,, এগুলোয় হবে?নাকি আরো লাগবে? আপাতত ক্যাশ নেই, কার্ড আছে দিবো?

তমাল মাথা নেড়ে বললো,, আর লাগবে না।
নবনী হাঁ হয়ে গেছে। ভাই তার এতো দিলদরিয়া হলো কখন। বিনা ইন্টারোগেশনেই এতো এতো টাকা লুটাচ্ছে? নবনী তৃধার ঘাড়ে মাথা রেখে মনে মনে বলে উঠলো,, তোমাকে হাত ছাড়া করা যাবে না।তোমাকেই লাগবে রমনী।

নুসাইব ঘড়ি দেখতে দেখতে বললো,, আমি বের হলাম। যখন বের হবি আমাকে জিনিয়ে দিস। প্রয়োজন পড়লে আমি গিয়ে দিয়ে আসবো।

দাঁড়ালো না নুসাইব। ব্যাস্ত পায়ে বেরিয়ে গেলো। রেখে গেলো দুই জোড়া আচম্বিত চোখের মালিক। যারা খনে খনে অবাক হচ্ছে। তমাল কচকচে টাকা গুলো গুনে দুই পাটি দাঁত বের করে বিড়বিড়িয়ে বললো,, যেই প্রেমে খরচ হয়,সেই প্রেম আমার জন্য নিষিদ্ধ। উঁহু তমাল তোর প্রেমে পড়া নিষেধ।
________

কিচেনে ফরিদা আর সায়রা বানু রান্নার কাজ করছে। সায়রা বানু পেঁয়াজ কাটতে কাটতে বললো,, আপা কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি?

ফরিদা হক কিচেন টাওয়েল হাত মুছতে মুছতে বলল,, হ্যাঁ বল। একটা কেন বরং হাজারটা বল।

সায়রা পেঁয়াজ হাতে নিয়ে বলল,, নুসাইব বাবার সাথে তৃধাকে বেশ মানায়। দুজনকে একসাথে দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। তোমার কি মতামত আপা?

ফরিদা হক মুচকি হেসে বলল,, আমারো তাই মনে হয়। তৃধাকে আমার প্রথম দিন থেকেই মনে ধরেছে। মেয়েটাও দারুন মিষ্টি। যেমন রূপ তেমনি গুন। সবচেয়ে বড় কথা একটা সংসারকে এক সুতোয় বেঁধে রাখতে পারবে। কিন্তু,,

,’কিন্তু কি? ‘

,, ‘তৃধা রাজি হবে?’

সায়রা পেঁয়াজ কুচি করতে করতে বললো,,’ বলেই দেখো একবার। মেয়েটা ভালো, তোমার কথা অমান্য করবে না।

সায়রার কথা ফরিদা হকের মনে ধরলো। তিনি ভাবছেন, কি ভাবে বললে তৃধা তার ছেলের বউ হবে? সরাসরি বললে, নাকি নাবীবকে দিয়ে বলাবে?

চলবে,,

উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ১৯

তিনটা বাজতে না বাজতেই তাড়া দিতে শুরু করলো নবনী। তৃধার হাতে শপিং ব্যাগ ধরিয়ে ঠেলে পাঠালো ঘরে । তৃধাও আর অমত করলো না। ব্যাগ হাতে রুমে ঢুকলো। রুমে থাকা আলমিরা জুড়ে তৃধার জামা কাপড়। তৃধা সেই কাপড়ের ভিড়ে শপিং ব্যাগটাও রাখলো। আলমিরা ভর্তি জামা কাপড় সব ফরিদা হকের দেওয়া। এই বাড়িতে যখন এসেছে ছিলো তখন তৃধার পরনে একটা পুরোনো থ্রিপিস ,হাতে মায়ের সেই শাড়ি সমেত পুঁটলি। তৃধা মায়ের শাড়ি বাঁধা পুঁটলিটা হাতে নিয়ে নেড়ে ছেড়ে দেখলো। মায়ের স্পর্শ লেগে আছে এই শাড়িখানা জুড়ে।কি করে ভাজ খুলতো সে? হঠাৎ করে তৃধার মনে পড়লো টাকার কথা। ওবাড়ি ছেড়ে আসার সময় রফিক ভাই সফিক ভাই দুজনই তাকে টাকা দিয়েছিলো।সেই টাকা গুলোর কথা বেমালুম ভুলে গেছে। সাত হাজার থেকে মাত্র তিনশো টাকা খরচ হয়েছিলো। বাদবাকি সব পুঁটলিতে রাখা। তৃধা সেই টাকা গুলো হাতে নিয়ে পুলোকিত হলো। যাক হাতে কিছু টাকা আছে। খরচ করা যাবে‌। যেই ভাবা সেই কাজ ফরিদা হকের কিনে দেওয়া হ্যান্ড ব্যাগ খানা বের করে তাতে টাকা রাখলো। ব্যাগটা ফরিদা হক যেভাবে কিনে দিয়েছে এখনো সেই ভাবেই আছে। কোথাও যাওয়াও হয়নি, তাই ব্যাবহার করাও হয়নি।

নবনী তৈরি হয়ে তৃধার ঘরে এসে দেখে তৃধা এখানো আলমিরা খুলে দাড়িয়ে আছে। নবনী বেজায় রেগে বলল,, তুমি এখন দাঁড়িয়ে আছো? তৈরিই হওনি? উফ তৃধা আপু তোমাকে নিয়ে কি করি বলো তো?
আলমিরা থেকে শপিং ব্যাগটা হাতে তুলে নিয়ে বললো,, রাখার জন্য নয়,পরার জন্য দিয়েছি। তাড়াতাড়ি পরে আসো।

” এইটা কখন কিনলে?

, রাতে অর্ডার করেছি দুইটা। একটা তোমার একটা আমার।

নবনীর পরনে সবুজ রঙের লং থ্রিপিস ,তৃধার জন্য নীল রঙ্গের কেনা হয়েছে। ডিজাইন একই হলেও রং ভিন্ন। তৃধা হাত বুলিয়ে বললো,, সুন্দর।

নবনী ডান চোখের ভ্রু উঁচিয়ে বলল, দেখতে হবেনা কার পছন্দের রং! তাড়াতাড়ি করে পরে আসো। তোমাকে আজ আমার হাতের জাদু দেখাবো।

তৃধা বুঝে পায় না কিসের জাদু। নবনী এক প্রকার জোর করে বাথরুমে পাঠালো। এই মেয়েকে জোর না করলেই নয়।

তৈরি হয়ে বেরুলো দুজন। ফরিদা হক তিন্নির সাথে ভিডিও কলে কথা বলছে। তমাল হেসে গাড়ির চাবি ঘুরাতে ঘুরাতে বলল,, চলো যাওয়া যাক। আম্মু আমরা বেরুচ্ছি।

ফরিদা হক একপলক তৃধাকে দেখে ক্যামরা ঘুরিয়ে তিন্নিকে দেখালো। তিন্নি অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। তৃধাকে আসলেই সুন্দর লাগছে। মেয়েটা আসলেই মায়ায় মোড়ানো। একটু যত্নের অভাবে হয়তো সৌন্দর্যে ভাটা পড়েছিলো।

পরনে নীল রঙ্গের লং থ্রিপিস ওড়না খানা আঁটসাঁট করে দেওয়া। কোমর সমান চুল গুলো সিঁথি করে একপাশে বেনী করে রাখা। চেহারায় কৃত্তিমতার ছোয়া না থাকলেও নবনী এক প্রকার জোর করেই মাসকারা আর লিপস্টিক দিয়ে দিয়েছে।

নবনী মুচকি হেসে তৃধাকে কুনুই দিয়ে খোঁচা মেরে বলে,,,দেখেছো সুন্দর লাগছে। বেশি না আম্মুর চোখ দেখো। চকচক করছে।

কপোলে দোল খাওয়া চুল গুলো আলগোছে কানের পেছনে গুঁজলো ।লজ্জা লাগছে তার। এতো সাজগোজ আধেয় কি তার মত মেয়ের সাজে? উঁহু মোটেও না। তাও সে সেজেছে, ব্যাপারটাই বেশি লজ্জায় ফেলছে তাকে।

তিন্নি তাড়া দিয়ে বললো,, যা তোরা ঘুরে আয়। ভালো লাগবে। প্রয়োজনে ডিনার বাইরে করে নিস।আম্মু ভাইকে ওদের সাথে পাঠিও তমালটা কোনো কাজের না। দিনকাল ভালো না তার উপর দুটো মেয়ে যাচ্ছে।

ফরিদা হক মুচকি হেসে বলল,, বলা লাগবে না। এমনিতে যাবে ওদের সাথে।

এর মধ্যে নবনী তৃধাকে নিয়ে বেরোয়।
______

ফাইল পত্রের স্তুপের মাঝে বসে আছে নুসাইব। চেহারায় স্পষ্ট বিরক্ত ভাব ফুটে উঠেছে। আজকেই এতো গুলো ফাইল চেক করতে হবে? ভাবতেই তিক্ত হয়ে উঠলো চারপাশ। এই নিয়ে দশ নাম্বার ফাইল হাতে নিলো। এই প্রোজেক্টে শুরু থেকেই ঘাপলা দেখছে। আজো ব্যাতিক্রম নয়। এতো এতো সমস্যা নিয়ে এগোনোর মানেই হয় না। তাও দুটো পাতা পরখ করে নিলো ভালো করে। এতোটা সময় বিরক্ত লাগলেও এইবার রা*গে পুরো শরীর জ্ব*লে উঠলো। তৎক্ষণাৎ ইন্টারকামে কল করে ম্যানেজার কে আসতে বললো।

ম্যানেজার করিম সাহেবের রূহ কম্পায়মান। সচরাচর এইভাবে তার ডাক পড়ে না। দরকার হলে স্যার তার পিএকে পাঠায়। এমন ডাক যখন যখন এসেছে তখন তখন অফিসে তান্ডব হয়েছে। নিজের কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে হম্বিতম্বি শুরু করে দিলো। প্রত্যেকটা প্রোজেক্ট টিম লিডার দের আঙ্গুল উঁচিয়ে শাসিয়ে গেছে,’ আজ যদি স্যার কিছু বলে সবার খবর আছে।’
চাপা গুঞ্জন, থমথমে পরিবেশ। সবাই ভয়ে জুবুথুবু প্রায়। পেন্ডিংএ রাখা কাজ গুলো সেরে ফেলতে উদ্যত। রুমেল চশমা ঠেলে ঠিক করে করিম সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল,’ সাবধানের মার নেই। পুরোনো পাপ গুলো মনে করুন। জিজ্ঞেস করলেই যেন ফটাফট বলে দিতে পারেন।

করিম সাহেবের চোখ মুখ কুঁচকে তাকালো। স্যারের পিএ না হলে এই ছেলেকে থাটিয়ে দুইটা চ*ড় মেরে দিতো। বড্ডো বাড় বেড়েছে। স্যারকে বলি এই ছোকরাকে মাথায় তোলার কি আছে? পার্ট টাইমার বলে ফুল টাইম রেখে গায়ে চর্বি জমিয়ে ফেলেছে।

রুমেল মৃদু হাসলো। মনে হচ্ছে করিম সাহেবের না বলা কথা সব অচিরেই পড়ে শেষ করে ফেলেছে।

রুমেলের হাসি ম্যানেজারের গায়ে আ*গুন ধরিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিলো।গনগনিয়ে হেঁটে পেরুলেন তার ডেস্ক। এর মুখ দর্শন করাও পাপ।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করে বড় করে নিঃশ্বাস ফেললেন। বয়স বেশি না ,চল্লিশ হবে কাজের তেমন চাপ নেই দেখে খেয়ে দেয়ে ভুঁড়ি বার করে ফেলেছে। আপাতত দেখতে পঞ্চাশ উর্ধ্ব মনে হয়।

দরজায় কড়া নাড়তেই রাশ ভারি গলায় আওয়াজ এলো,, আসুন।

ঈষৎ কেঁপে উঠলো ম্যানেজার। ধীর পায়ে দরজা ঠেলে ঢুকলো।
তীব্র মাথা ব্যাথা চশমা পরতে বাধ্য করলো নুসাইবকে। ম্যানেজারকে দেখে চশমা খুলে সোজা হয়ে বসলো।

ম্যানেজার গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বললো,, ‘জ্বী স্যার বলুন। ‘

টেবিলের উপর শব্দ করে ফাইল ফেলে বললো,, প্রজেক্ট কে হ্যান্ডেল করছে করিম সাহেব?খবর রেখেছেন?

ম্যানেজার ফাইল দেখে বললো,, স্যার কি সমস্যা। আমাকে বলুন আমি ঠিক করছি।

‘প্রোজেক্ট ডিটেইলস পড়ে দেখেছেন?’

‘জ্বী স্যার’

নুসাইব বাজখাঁই গলায় বলল,, আপনি পড়ার পর এই ফাইল টেবিল ঘুরে আমি পর্যন্ত এলো কি করে? একটা ফাইলের ভেতর এতো ফল্ট দেখার পর আপনি সিগনিচার দিলেন কি করে?

ম্যানেজার দর দর করে ঘামছে । তিনি কোনো রকম বলে উঠলো,, স্যার আসলে টিম লিডার,,,

ম্যানেজারকে বলতে না দিয়ে শান্ত শিতল গলায় বলে উঠলো,,, আর কতো করিম সাহেব? আর কত অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাবেন? আমিতো তাদের ভুল দেখছি না। ভুলতো সব আপনার। প্রত্যেকটা টিমের সফলতার ক্রেডিট নিজের করে নেওয়ার বেলায় তো পিছপা হতে দেখি না। আগ বাড়িয়ে নিজের কন্ট্রিবিউশনের গল্প শোনান, এখন কেন ভুলের দায় নিচ্ছেন না? ওরা রাত জেগে ,ওভার টাইম করে প্রত্যেকটা প্রোজেক্ট সাবমিট করে। কতটা পরিশ্রম করে, ডু ইউ হ্যাভ এনি আইডিয়া? ইউ লিটরলি হ্যাভ নো আইডিয়া এভাউট ইট। আপনার কাজ শুধু বসে রিভিউ করা, সেই কাজটা পর্যন্ত আপনাকে দিয়ে হচ্ছে না। কাজের প্রতি অসম্মান, অন্যের হাড় ভাঙ্গা শ্রমের প্রতি অসম্মান। এতোটা সাহস দেয় কে আপনাকে? বাবা দায়িত্বরত নেই ম্যানেজার সাহেব, সাবধানে পা ফেলুন,বুঝে শুনে কাজ করুন। আমি তার ছেলে হলেও তার মত ক্ষমা করে মহৎ হওয়ার গুনটা পাইনি। কাজের কদর করতে না পারলে দরজা খোলা আছে।

ম্যানেজার কপালের ঘাম মুছে বেরিয়ে যেতে নয়। পেছন থেকে নুসাইব বলে উঠলো,, ফাইল নিয়ে যান।
ফটাফট ফাইল নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।
রুমেল চশমার কাঁচ মুছতে মুছতে মুচকি মুচকি হাসছে। ম্যানেজার অপমানে চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। তার উপর এই ছোকরার হাঁসি। তিনি রাগে হনহনিয়ে নিজের কেবিনে চলে গেলেন।

নুসাইবের মেজাজ তুঙ্গে। রাগে মাথা ব্যাথ্যাটা তরতর করে বাড়ছে। কপালে আঙ্গুল ঠেকিয়ে পুনরায় চশমা চোখে দিয়ে ফাইল পত্র ঘেঁটে দেখছে। রাগে পুরো শরীর জ্ব*লছে তার। কাজ নিয়ে হেলাফেলা বরাবরই অপছন্দ। তার মধ্যে এতোটা ভুল মেনে নেওয়ার মত না। ব্যাবসার দায়ভার নিতে আরো কয়েকবছর দেরি করলে না জানি কি হয়ে যেতো। হয়তো বাড়ি ঘর নিলামে উঠতো। ভাবতেই আরো বেশি রাগ লাগছে।

তমাল ড্রাইভিং সিটে বসে ভাইকে মেসেজ করলো। যেখানে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা ” তৃধা আপুর জন্য একটা ড্রেস পছন্দ হয়েছে ভাইয়া। টাকার অভাবে নেওয়া যাচ্ছে না। তোমার ছোট কাঠবিড়ালী সব টাকা মেকআপ কিনতে কিনতে খরচ করে ফেলেছে। এই দিকে তৃধা আপুকেও জোর করে কিছু কিনে দিতে পারছি না। বিপদ সাংঘাতিক বিপদ। ঠিকানা পাঠাচ্ছি তাড়াতাড়ি আসো।”

মেসেজ পড়া মাত্র উঠে দাঁড়ালো। আপাতত ফাইল দেখার ব্যাপারটাকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে বেরুলো।

রুমেল নুসাইবের তাড়াহুড়ো ভাব দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো। নুসাইব ব্যাস্ত ভঙ্গিতে বলল,, রুমেল বাসায় জরুরি কোনো কাজ আছে?

রুমেল মাথা নেড়ে বললো,, না স্যার নেই।

‘ পড়া , টিউশন কোনোটা আছে?’

‘ না স্যার আজ জরুরি কিছুই নেই। ‘

‘ আমি বেরুচ্ছি তাহলে। পেছনে সবটা সামলে নিও। ফাইল গুলো বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিও। আর হ্যাঁ করিম সাহেবের সাথে অযথা কথা বলার দরকার নেই। আপাতত তার থেকে দুরে থেকো।

রুমেল মাথা নেড়ে বললো,’ সমস্যা নাই স্যার। আপনি টেনশন ফ্রী হয়ে যান। আমি সবটা সামলে নিবো।

নুসাইব হড়বড়িয়ে বেরুলো। দাঁড়ানোর সময় নেই। পারলে এক্ষুনি তমালের দেওয়া ঠিকানায় উড়ে চলে যায়।

এইদিকে তমাল বেশ ফুরফুরে মেজাজে গাড়ি ড্রাইভ করছে। মনে হচ্ছে দাবা খেলায় মোক্ষম চাল চেলেছে। বিপক্ষ দলের অবস্থা শোচনীয়।

এইদিকে নবনী বক বক করেই যাচ্ছে।নবনী যেখানে অনবরত কথা বলছে , সেখানে তৃধা নিরব শ্রোতা।
তমাল বিরক্ত প্রায়,তার বোনটা এতো বাঁচাল স্বভাবের! তৃধা আপুকে কথা পর্যন্ত বলতে দিচ্ছে না।
তমাল গলা ঝেড়ে বললো,, মুখটা বন্ধ করনা। সামনের জনকেও বলতে দে। নাকি তোর ওই লেকচারার তোকে এইসব শেখায়নি?

তমালে কথায় প্রথমে বিরক্ত হলেও পরে বিস্মিত চোখে তাকালো নবনী। তৃধাও বুঝতে পারলো না নবনীর লেকচারার বলতে কি বুঝিয়েছে। নবনীই বা এতো অবাক হলো কেন।

নবনী চোরা চোখে তাকিয়ে বললো,, তুই এসব কি বলছিস?

তমাল হাওয়ায় মাছি তাড়ানোর মত করে বললো,, তোর না জানলেও চলবে।

______

শপিং মলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে নুসাইব। তমাল ফোন ধরছে না।এর মধ্যে দু’বার মলের ভেতর গিয়ে খোঁজার চেষ্টাও করেছে। যদিও এতো বড় মলের মধ্যে খোঁজার চেষ্টা বৃথা।

তমাল গাড়ি নিয়ে সোজা মলের সামনে এসে থামলো। নুসাইবের ভ্রু কুঁচকে গেলো। তমাল তার সাথে এতো বড় মিথ্যা বলেছে ভাবতেই নুসাইবের রাগ হয়। একেতো মাথা ব্যাথা তার উপর এই মিথ্যা। ভাবতেই আরো বেশি মাথা ধরে গেলো।তমাল গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়। নবনী হড়বড়িয়ে নামলেও তৃধা দ্বিধা সংকোচ নিয়ে নামলো। নবনী চুল বাঁধার সময় সামনের কিছু চুল বের করে রেখেছিলো। এতে নাকি তৃধাকে আরো বেশি মায়া লাগে। সেই অবাধ্য চুল গুলো কানের পেছনে গুঁজে সামনে তাকালো।
কপালে ভাঁজ ফেলে একজোড়া চোখ অধির আগ্রহের সহিত গাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। তৃধাকে দেখা মাত্র সেই চোখ জোড়ার মালিকের কপাল সিথিল হলো। ব্যাস্ত চোখ শান্ত হয়ে এলো।
তমাল মুচকি হেসে নজর ফেরায়। নবনী চোখ জোড়া ভাইয়ের দিকে তাক করা। এমন দৃষ্টি তার খুব চেনা। এই দৃষ্টি মুগ্ধতার,এই দৃষ্টি মায়ার,এই দৃষ্টি ভালোবাসার। নবনী হাসলো খানিকটা। তমাল নবনীর মাথায় টোকা দিয়ে ইশারায় ডাকে। নবনী বুঝলো সেই ইশারা। তমালের সাথে ঝগড়ার ভান করে পিছু ছুটলো।
তৃধার নজরে পড়লো সেই দৃষ্টি । সে নবনীর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে এগোয়। নুসাইব তখনো ঠায় দাঁড়িয়ে। প্রিয় রঙে আচ্ছাদিত তার প্রিয় রমনী। না তাকিয়ে উপায় আছে? তৃধাকে অনন্য লাগছে আজ। লজ্জায়,দ্বিধায় মিলে চেহারার মায়া দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এতোটা গুছিয়ে সাজিয়ে কল্পনা করেনি তৃধাকে। যত্ন আর আদরে মিলে কল্পনায় থাকে এই মেয়ে।

নুসাইবের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বলে উঠলো,, আপনি যাবেন না?

ধ্যান ভাঙল নুসাইবের। এলোমেলো চোখে পুনরায় তাকালো তৃধার দিকে। হঠাৎ এক অবাধ্য ইচ্ছের উদয় হলো। তৃধার কানের কাছে ফিসফিস করে বলতে ইচ্ছে হলো,,’ আমার রঙে নিজেকে না রাঙ্গালেও পারতে।দেখো কেমন মায়া লাগছে তোমায়। কি করে সামলাই নিজেকে?’
যদিও সেই অবাধ্য ইচ্ছেকে জলাঞ্জলি দিয়ে বলল,, হ্যাঁ চলো।

গুটি গুটি পায়ে সামনে এগোয় তৃধা। তার দুকদম পেছনে নুসাইব। চারদিকে কি ঘটছে না ঘটছে সেই দিকে তার নজর নেই। সে আকাশ রূপি এক রমনীতে ব্যাস্ত।খুব সাধারণ একটা মেয়ে যাকে রূপে বিচার করে ভালোবাসেনি নুসাইব। যদিও তৃধা যথেষ্ট রূপবতী। হঠাৎ করে নুসাইবের মনে প্রশ্ন জাগলো,,তাহলে কিসের ভিত্তিতে ভালোবাসলো তৃধাকে? নিজেকে নিজে জিজ্ঞেস করে থমকালো, উত্তর খোঁজা দায়। ভালোবাসা কোনো কিছুর উপর ভিত্তি করে হয় না। ভালোবাসা ভালোবাসাই হয়। তার কাছে তৃধা মানেই মায়া,তৃধা মানেই ভালোবাসা। এই মেয়ের উপস্থিতিটাই ভালোবাসার জন্য যথেষ্ট। তাকে ভালোবাসতে আলাদা কারন লাগবে না। কখন যে বিন্দু বিন্দু করে জমিয়ে এই ভালোবাসা সিন্ধু হলো টেরই পেলো না।

তমাল আর নবনী মল ঘুরে ঘুরে দেখছে। তৃধার পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটছে নুসাইব। নবনী বেশ কিছু ড্রেস পছন্দ করে রাখলো। তার সাথে ম্যাচিং করে জুয়েলারি। তমাল ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলল,, দাঁড়িয়ে থাকবে? নাকি তৃধা আপুর জন্য পছন্দ করে কিছু কিনবে। ওই দিকে তাকিয়ে দেখো ওই জংলি সব কিনে ফেলছে।

নুসাইব বোনের দিকে তাকিয়ে দেখে। নবনী সব গুলো ড্রেস দুটো করে নিচ্ছে। মৃদু হেসে তমালকে ইশারায় দেখালো। তমালের মুখ চুপসে গেছে। ভাইটা জন্মের আনরোমান্টিক।
তৃধা ঘুরে ঘুরে শাড়ি দেখছে। তার সাথে কিছু হুডিতে চোখ বুলালো। দুটো শাড়ি তার বেশ মনে ধরলো,একটা কালো অন্যটা কলাপাতা রঙের।শাড়ির দাম দেখে টাকা হিসেব করে হুডি দেখা শুরু করলো। সাদা রঙের একটা হুডি দেখা মাত্র নুসাইবকে খুঁজলো। শাড়ির কর্নারে কপাল কুঁচকে শাড়ি দেখছে সে। তৃধা মুচকি হেসে হুডিটা ধরে দেখলো। তমালের জন্য একটা চেক শার্ট পছন্দ করলো। তৃধার মতে তমালকে চেক শার্টে মানাবে বেশি। যদিও চেক শার্টে তমালকে কখনো দেখা যায়নি। সে বরাবরই টিশার্ট, পোলো শার্ট পরে অভ্যস্ত। আবারো টাকার হিসেব কষে দেখলো। এগুলো কেনার পর হাতে একহাজার টাকা থাকে। তৃধার খুব ইচ্ছে ছিলো তিন্নির জন্য শাড়ি আর নাবীব শেখের জন্য একটা পাঞ্জাবি কেনার। কিন্তু অতো টাকা তার কাছে নেই। মন খারাপ হলো খুব। পছন্দ করা জিনিস গুলোর দিকে আরেকবার তাকালো। এই শপের মধ্যে সবচেয়ে কম প্রাইসের জিনিস গুলোর মধ্য থেকে পছন্দ করেছে সে। আধেও কি এই জিনিস গুলো তাদের পছন্দ হবে? বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিলো।
তৃধার দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভরা চেহারা দেখে সেল্সম্যান জিজ্ঞেস করলো,, ম্যাম এইগুলো প্যাক করে দিবো? যদি পছন্দ না হয় আরো দেখতে পারেন।

তৃধা মাথা নেড়ে বললো,, না না, এইগুলোই প্যাক করে দেন। বিলটা আমি দিবো। ওনাদের দিতে দিয়েন না।

‘ ওকে ম্যাম’
লম্বা শ্বাস টেনে চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখছে। দু’বছর আগে এইখানে একটা লাইব্রেরী ছিলো। নতুন পুরাতন মিলে বইয়ের সমাহার। দুটো বই কিনতে এলে ঘন্টা পার করে দিতো। পুরোনো বইয়ে চোখ বুলিয়ে দু এক পাতা পড়ে লেখকদের অটোগ্ৰাফ খুঁজতো। লাইব্রেরীর মালিক তৃধার এহেন কাজে অবাক হলেও কিছু বলতেন না। বরং মাঝে তিনিও খুঁজে দেখতেন। যদি পেতেন সেটা যত্ন করে তৃধার জন্য রেখে দিতেন। শেষ যখন এসেছিল তখনো খুজেছিলো। দেড়ঘন্টা খুঁজে একখানা বই হাতে লাগলো। হুমায়ূন আহমেদের লেখা” মেঘ বলেছে যাবো যাবো” বইয়ের মলাট উল্টাতেই চোখে পড়লো। চকচক করে উঠলো চোখ।তৃধার চোখ মুখ দেখে লাইব্রেরীর মালিক প্রগাঢ় হেসে বলল,, অবশেষে পেলে তাহলে?
সেই দিন তৃধা বই কেনেনি। বরং লাইব্রেরীর মালিক চকচকে রঙিন পেপার মুড়িয়ে ওই বই তৃধাকে উপহার দিলো। বই মুখো তৃধার খুশির সীমানা ছিলো না। ভেবে গভীর নিঃশ্বাস ফেললো।কতটা বদলে গেছে সব। এখন এই জায়গায় কোনো লাইব্রেরী নেই। বরং অসংখ্য বাতিতে সজ্জিত দোকানখানায় দামি দামি কাপড় ভাজ করে রাখা। আগে প্রয়োজন কিংবা শখ করে কিনতে আসতো। এখন মানুষ এই দোকানে প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে, কিংবা বিলাসিতা করে আসে। চওড়া দামে কিনে নেয় জামা কাপড়।
______

কাউন্টারে বিল পে করার সময় বাঁধ সাধলো নুসাইব। তমাল এগিয়ে এলো।তৃধা বিল দিচ্ছে দেখেই তার মেজাজ খারাপ হলো। ভাইয়ের মাথায় মগজ নেই নাকি?
তৃধা দুই ভাইয়ের চেহারা দেখে কাউন্টারে বসা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল,, এক মিনিট প্লিজ।

মেয়েটা মুচকি হেসে বলল, অবশ্যই ম্যাম।

তৃধা নুসাইব আর তমালের দিকে তাকিয়ে বলল,, এইগুলো আমি পে করবো।

নুসাইব কিছু বলবে তার আগেই তৃধা বলে উঠলো,, চিন্তা করবেন না টাকা আছে আমার কাছে। বলেছিলাম না, সে আপন না হলেও তার বাড়ির এমন কেউ নেই যারা আমাকে আপন ভাবেনি। এই গুলো সেই আপন মানুষেরা দিয়েছিলো।

তমাল বলতে নিয়েও চুপসে গেলো। এরপর আর কিছুই বলার থাকে না।

নবনী দু হাত ভর্তি জিনিস এনে কাউন্টারে রাখলো। তার খবর নেই এইখানে কি হয়েছে বা হচ্ছে । তমাল হতাশা ভরা দৃষ্টিতে বোনকে দেখছে। এমন লোভী মেয়ে জন্মেও দেখেনি। তৃধা ব্যাগ গুলো সাইডে রেখে বিল পে করলো। নুসাইব নবনীর দুহাত ভর্তি জিনিস দেখে তাকালো। নবনী মুচকি হেসে বলল,, সব আমার না। আধা তৃধা আপুর জন্য আধা আমার জন্য। ব্যাস এই টুকু কথা ,এর পর নুসাইব আর কিছু বলতে পারলো না।
তমাল ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো। লোকে বলে ভালোবাসা চালাক মানুষকে বোকা বানায়। এই কথার সত্যতার প্রমাণের জন্য বেশি দূর যেতে হবে না। বরং প্রমাণ তার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একমাত্র বড় ভাই। তা না হলে তৃধা আপুর কথা বলে বলে ছোট বোন তাকে লুট করছে সেটা ধরতে পারলো না কেন?

শপিং ব্যাগের ঢের নিয়ে হাঁটছে তমাল। তৃধা বার বার নেওয়ার কথা বলেছে। তমাল বরাবরই নিজেকে জেন্টেলম্যান দাবি করে ব্যাগপত্র নিয়ে হাঁটা ধরলো। এই দিকে নবনী তমালকে রত্তি ভর বিশ্বাস করে না। নবনীর মতে তমাল শপিং ব্যাগ গুলো আছাড় দিয়ে দিয়ে রাখবে। এতে করে জামা কাপড় বেঁচে গেলেও তার সখের ঝুমকো গুলো ভেঙ্গে চুরমার হবে। সে তার জুয়েলারির প্যাকেট সমেত গাড়ির দিকে ছুটলো।
তৃধা নুসাইব পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। মানুষজন আসা যাওয়া করছে। তৃধার গায়ের সাথে লেগে পার হচ্ছে কেউ। নুসাইব তৃধাকে আড় করে দাঁড়ালো। দুজন টুকটাক কথা বলছে। আলোচনার টপিক লাইব্রেরী দেখে তৃধাও তার লাইব্রেরীর গল্প বলছে। তৃধার হাঁসি মুখ, নুসাইবের আড় চোখে তাকানো, মৃদু হেসে জবাব দেওয়া কিংবা আগ্ৰহ নিয়ে তৃধার কথা শুনতে চাওয়া কোনোটাই একজনের নজর এড়ালো না। একজোড়া চোখ ঘুরে ঘুরে দুজনকে দেখছে। সেই দৃষ্টি জোড়ায় না আছে সুখ না আছে দুঃখ।

চলবে ,,