আমি আছি পর্ব-২+৩

0
1285

উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ২

দুইদিন ধরে রজব ছোট ছোট ব্যাপরে রে*গে যাচ্ছে। পান থেকে চুন খসলেই কেমন তেঁতে উঠছে। তৃধা সেই রাতের পর থেকে মিইয়ে গেছে। রজবের সাথে স্বভাবিক হতে পারছে না। অদৃশ্য দূরত্ব এসে পড়েছে দুইজনের মাঝে। স্বামীর ভালোবাসা নিয়ে বড়াই করতো তৃধা। এই দুইদিনে সেই সব ভে*ঙ্গে চুর*মা*র হয়ে গেছে । আর যাই হোক কোনো মেয়ে তার স্বামীর ভাগ অন্য কাউকে দিতে চায় না। তৃধাও তাই। স্বামীর ভালবাসা ভাগ হচ্ছে বুঝতে পেরে বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠছে! কাউকে কিছু বুঝতে না দিলেও নামাজের সেজদায় গিয়ে ঠিকই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁ*দে উঠছে।

রাজিয়া এই দুইদিন খেয়াল করেছে ভাবী তার আগের মতো নেই। সারাদিন কেমন মন মরা হয়ে থাকে। ভাইটাও দুইদিনে বেশ খিটখিটে হয়ে গেছে।

সাফিয়া খাতুন নামাজ শেষে তজবি হাতে নিয়ে ছেলের রুমের পাশে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। ভালো করে শোনার জন্য কান পাতলেন। তৃধা ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সাফিয়া খাতুন তজবি পড়া বেমালুম ভুলে গেলেন। ঘন ঘন পায়চারি করতে লাগলেন। তৃধা মোনাজাতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁ*দছে। তার সোনার সংসারটা ভাং*তে চলছে। দুহাত তুলে ফরিয়াদ করছে যাতে সংসারে সুখ আগের মত ফিরে আসে। রজবকে সে মাফ করে দিবে। শুধু সব আগের মতো হয়ে যাক।
নামাজের পাটি গুটিয়ে রুম থেকে বের হয় তৃধা। শ্বাশুড়িকে দরজার সামনে দেখে ঘাবড়ে গেল।

,,”আম্মা তুমি?”

সাফিয়া খাতুন তৃধার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, হ্যা রে তৃধা কি এমন দুঃখ তোর। কাঁ*দছিলি কেন? আমার কোনো কথায় ক*ষ্ট পেয়েছিস? রাজিয়া কিছু বলেছে?বলনা মা!

তৃধা মাথা নাড়ল।তাকে কেউ কিছু বলেনি।
সাফিয়া খাতুন চিন্তিত হয়ে বললো, রজব কিছু বলেছে? দুই দিন ধরে দেখছি কেমন খিট খিট করছে। কি হয়েছে?
তৃধা শ্বাশুড়ির মুখের দিকে তাকায়। এই মানুষটাকে ছেলের এমন কাজের কথা বললে নির্ঘাত অসুস্থ হয়ে পড়বে। নিজের ছেলের এমন কু*কীর্তির কথা শুনলে কোনো মা-ই ঠিক থাকবে না। তৃধা চায় না এমন একটা ভালো মানুষকে ক*ষ্ট দিতে। তাই জোর পূর্বক হেসে বলল, তোমার ছেলে কিছু বলেনি। আসলে আম্মুর কথা মনে পড়ছিল ত তাই ।

সাফিয়া খাতুন তৃধার মাথায় হাত রেখে বলল, একবার গিয়ে দেখে আয় । দুই বছর তো কম সময় নয়। হয়তো রাগ পড়ে গেছে। যাবি? আমিও যাবো তোর সাথে।
তৃধার চোখ জোড়া ভিজে উঠলো। রজবের সাথে বাড়ি ছাড়ার পর সেই বাড়ির কেউ মুখ তুলে চায়নি। না ভাই ,না বাবা ,না মা। বাবা বলেছে আজ থেকে তার জন্য তার মেয়ে ম*রে গেছে। মা বলেছে এমন মেয়ের মুখ দেখার চেয়ে ম*রে যাওয়া ভালো। ভাই মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। হয়তো সেও চায়না বোনের মুখ দেখতে। তৃধার আজো মনে পড়ে । চলে আসার একদিন পর কল দিয়ে যখন মা চিৎ*কার করে কেঁ*দে বলেছিল , তুই জিবনে সুখ দেখবি না তৃধা। তুই সুখ দেখবি না। মায়ের বুকে আ*গুন লাগিয়ে গিয়েছিস তুই সুখ দেখবি না। সেই কথা মনে পড়তে তৃধার বুকটা হু হু করে উঠলো। মায়ের কথা কি সত্যি হতে চলেছে?

চোখ মুছলো তৃধা।
,,”‌না মা। তাদের মেয়ে তাদের জন্য অনেক আগেই মরে গেছে। কেউ এখন সেই মেয়েটাকে দেখতে চাইবে না। ”

,,” এইসব কথা বলতে নেই । তখন রেগে বলেছে।”

,,” হয়তো। চলো খেয়ে নিবে। “/

দুপুরের খাওয়া শেষ করে এঁটো বাসন নিয়ে পুকুরে নামলো। সোহাগী হাত পাখায় বাতাস করতে করতে ঘাটকুলে এসে বসলো। তৃধাকে দেখে স্বামী সফিকের বলা কথা গুলো মনে পড়লো। সোহাগী দ্বিধা সংকোচের মধ্যে পড়ে গেছে। কি বলে শুরু করবে ভাবতে ভাবতে বললো, কিরে তৃধা দুই দিন তোকে কম দেখা যাচ্ছে। শরীর খারাপ !নাকি মন খারাপ?

তৃধা প্লেটে সাবান দিতে দিতে অন্যমনষ্ক হয়ে বললো,, কি জানি ভাবী হয়তো কপাল খারাপ।

তৃধার এমন কথায় চমকায় সোহাগী। ব্যাস্ত গলায় বললো, কি হয়েছেরে! হঠাৎ এমন কথা?
তৃধার ধ্যান ভাঙল। কি বলতে কি বলেছে বুঝতেই পারেনি। কোনোরকম কথা ঘুরিয়ে বললো, কিছুনা ভাবী, আসলে মন ভালো নেই। ওবাড়ির কথা মনে পড়ছিল।

সোহাগী হাত পাখা পাশে রেখে আক্ষেপ করে বললো, মা-বাবা কখনো খারাপ চায়না তৃধা। ছেলে মেয়ে হয়তো বুঝতে পারে না। যখন বুঝে তখন সময় থাকে না। তোর মা-বাবার কথা কি আর বলবো। তারা খারাপ চায়নি। কোনো মা-বাবা চায়না তার সন্তান অভাব অনটনে থাকুক,কষ্টে থাকুক। তাইতো তোকে এইখানে বিয়ে দিতে চায়নি। তুই বড়লোক বাপের মেয়ে হয়ে এমন ঘরে আসবি তারা কল্পনাও করেনি। রাগে ক্ষোভে দু চারটে কথা বলে ফেলেছে। মনে কিছু রাখিস না বোন।

তৃধা চোখ মুছে মাথা নাড়ায়। তারা আসলেই ভালো চেয়েছে। হয়তো বয়সের দোষে এমন পদক্ষেপ নিয়েছিল।

সোহাগী বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো, তোকে একটা কথা বলার ছিল। অনেক দিন বলবো বলবো করে বলা হয়না।

,” কি কথা ভাবী?”

সোহাগী ইতস্তত হয়ে বললো, রজবের কথা। তোর ভাসুর অনেক আগেই বলেছে আমাকে।

তৃধার বুকটা ধক করে উঠল। নিশ্চয়ই এমন কিছু যা শুনে বুকটা এফা*ড় ওফা*ড় হবে। তৃধা টেনে নিঃশ্বাস নেয়। ভারি বুকটায় নিঃশ্বাসটাও বোঝার মতো লাগছে।

সোহাগী তৃধার মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ হয়ে গেল। কম কষ্টেতো নেই মেয়েটা। এমন কিছু বললে নিজেকে সামলাবে কি করে? সোহাগী ঢোক গিলে নিলো। বলবে না কিছুই। কথা কাটাতে জোর পূর্বক হেসে উঠে বললো, রজবের চাকরিটা কি কম্পানির তরফ থেকে হয়েছে নাকি কম্পানির লোকের হয়ে কাজ করছে সেটা জিজ্ঞেস করতে বলেছে।কম্পানির হলে একটা ভবিষ্যৎ আছে।

সোহাগীর কথা শুনে তৃধা চোখ বুজে নিঃশ্বাস ফেললো। মনে হচ্ছে অনেক বড় পাথর বুকের উপর থেকে সরে গেছে।

,,” হ্যা ভাবী কম্পানির থেকে হয়েছে। কাজ ভালো হলে প্রমোশন দিবে।”

সোহাগী উঠে যেতে যেতে বললো, যাক শুনে খুশি হয়েছি। রাজিয়া কোথায়, চলে গেছে নাকি?

,,” না ভাবী আছে । কাল পরশু শিমুল ভাই আসবে। উনি এলে রাজিয়াকে নিয়ে যাবে।”

,,”ওহ্ আচ্ছা।”

__________

রাত করে ফেরে রজব। খাওয়া দাওয়া সেরে তবেই এসেছে। সাফিয়া খাতুন এনিয়ে বেশ রাগারাগী করে। রজব মাকে কিছু না বললেও তৃধাকে অনেক কথাই শুনাতে থাকে। তৃধা শেষে না পেরে বলে, আমি কিছু বলেছি? মা বলছে মাকে গিয়ে বলুন না। আমাকে কেন দোষারোপ করছেন?
তৃধার কথা রজবের গায়ে আ*গুন ধরিয়ে দেয়ার মতো কাজ করলো। রজব দেরী করলো না ,হাতের পাঁচটা আঙুল তৃধার গা*লে বসিয়ে দিলো। চু*লের মু*ঠি ধরে আরেক হাতে গা*ল চে*পে ধরে হিসহিসিয়ে বললো, ইদানিং মুখ বেশি চলছে মনে হচ্ছে? গলা নামিয়ে কথা বল। নয়তো গলার র*গ টেনে ছিঁ”ড়ে ফেলতে দেরি হবে না। আমার বিরুদ্ধে মাকে কান পড়া দিচ্ছিস এতে হচ্ছিলো না! এখন গলা উঁচিয়ে প্রমাণ করে দেখাচ্ছিস?
থা*প্প*ড়টা এতো জোরে মে*রে*ছে মনে হচ্ছে তৃধার গাল জ্ব*লে যাচ্ছে। তার সাথে চুল মু*ঠি আর গা*ল চে*পে ধরায় তৃধার প্রাণ পাখি উড়ে যাওয়ার জোগাড়। তৃধা শব্দ করলো না, নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছে শুধু। তৃধার চোখের পানি সামনের মানুষটার মন গলাতে পারলো না। রজব তৃধাকে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফে*লে তাচ্ছিল্য করে বলে উঠলো,, এখন আবার ন্যাকা কান্না হচ্ছে? যত্তসব।

সাফিয়া খাতুন দরজার পাশ থেকে সরে দাঁড়ালেন। তৃধার গলার আওয়াজ শুনে ছুটে এসেছিল। এমন কিছু শুনবে আশা করেনি। চোখ মুছে নিজের রুমের দিকে যেতে যেতে বললো,, কার নজর লাগলো খোদা! কার নজর লাগলো! আমার সোনার সংসারে কার নজর লাগলো!

মায়ের কথা কানে পৌঁছাতে রাজিয়া জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে মা। কার নজরের কথা বলছো?

সাফিয়া খাতুন রাজিয়াকে সবটা খুলে বললো। রাজিয়া হুঙ্কার দিয়ে উঠলো,, তোমার ছেলে আগেও মানুষ ছিলো না মা,অ*মানুষ হয়েছে। দেখো গিয়ে আবার কোথায় কারো সাথে প্রেম জুড়ে দিয়ে এমন করছে । ভাবীর সাথে প্রেম থাকা অবস্থায় কম জায়গা মুখ মা*রেনি। এইবার এমন কিছু হলে আমি ছেড়ে কথা বলবো না। ভাবীকে নিয়ে সোজা চলে যাবো।

,,” কিচ্ছু ভালো লাগছেনা। তুই ঘুমিয়ে পড় ।আমি দুরাকাত নামাজ পড়ে ঘুমাবো। মন শান্তি লাগছে না।

_______

নারী ছলনাময়ী কথাটা ভুল নয়। ছলনা না করলে রাতের স্বামীর করা এমন ব্যাবহারের পর কোমরে কাপড় গুঁজে সেই স্বামীর মন রাখার জন্য হাত পু*ড়িয়ে রান্না করে না। সকালের নাস্তা সেরে রান্নায় লেগে পড়লো তৃধা। ঘরের মুরগি দুটোর মধ্যে একটা জ*বা*ই করে দিয়েছে। কৌটা ঝেড়ে দেখলো দুই পটের মতো পোলাউর চাল আছে। রান্নার জন্য সেটাই ধুয়ে নিলো।
রাজিয়া আচারের বয়াম থেকে আচার নিয়ে মুখে দিতে দিতে মাকে বললো, ,,মা এই মেয়ে কি দিয়ে গড়া? তোমার ছেলে কিভাবে এমন বউয়ের গা*য়ে হা*ত তোলে? তোমার বউমাকে দেখো! এখনো স্বামীর জন্য মোরগ পোলাও করছে। আমি হলে দা দিয়ে কো*পা*নোর জন্য ওত পেতে থাকতাম।

সাফিয়া মেয়ের মাথায় চা*টি মে*রে বললো, চুপ!যতসব অলক্ষনে কথা।

রান্না শেষ হলে ছোট বাটি করে একবাটি পোলাউ দুই টুকরো মুরগির মাংস নিয়ে সোহাগীর হাতে দিলো।

,,” এইগুলো আবার কেন নিয়ে এলি? ”

,,” শুনেছি সিফাতের পোলাউ অনেক পছন্দ। তাই এনেছি।”

সোহাগী তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বললো, নিজের জন্য রেখেছিস ?নাকি নিজের ভাগেরটা এনেছিস?

তৃধা মৃধু হাসলো।

তৃধার গালে পাঁচ আঙুলের আবছা দাগ দেখে সোহাগী বড় করে নিঃশ্বাস নিয়ে বললো, এতো ভালো হতে নেই তৃধা। ভালোটা সবার সয় না। একটু চালাক হ।
,

বাটি নিয়ে ঘরে ঢুকতেই চমকায় তৃধা। রজব এসেছে তার সাথে দাঁড়িয়ে আছে এক সুন্দরী মেয়ে।পরনে লাল টুকটুকে কাতান শাড়ি। সাজ আর ভেশভুসা বলছে আজ মেয়েটার বিয়ে। তৃধা চেনে এই মেয়েকে। এই মেয়ের ছবি দেখেছিলো রজবের ফোনে। রজব তার আ*পত্তিকর ছবি ছুঁয়ে দেখছিলো। করেছিল আ,পত্তিকর আলাপচারিতা। সব কিছু মাথার মধ্যে দলাপাকিয়ে যাচ্ছে। পুরো ব্যাপারটা বুঝতে তৃধার কয়েক মিনিট সময় লেগেছিল। তাও মন মানছে না।
রাজিয়া তৃধার মুখের দিকে তাকিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠে। সাফিয়া খাতুন ছেলের মুখা মুখি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,, কে এই মেয়ে রজব। এই ভেসে এইখানে কি করছে ?

রজবের নির্লিপ্ত উত্তর।
ওর নাম সুমনা। ও আমার স্ত্রী। আমরা বিয়ে করেছি।

সাফিয়া খাতুন গায়ের সর্ব শক্তি দিয়ে রজবের গালে চ*ড় মা*রলেন। চমকে উঠলো সদ্য বিবাহিতা বউটা। তার সাথে তৃধা আর রাজিয়া।

তৃধা গা কেঁপে পড়ে যেতে নেয়। রাজিয়া তাড়াতাড়ি তৃধাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে দাড় করায়। শব্দ করে কেঁদে উঠলো তৃধা। মনে হচ্ছে কলিজা ছিঁ*ড়ে যাচ্ছে। কেউ বার বার গলা চেপে ধরছে। এই বুঝি সংসারটা ভে*ঙে গেলো।

সাফিয়া খাতুন হুঙ্কার দিয়ে বললো,, অমানুষ! জা*নো*য়ার! কি বললি তুই?

রজব গালে হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছে। যেন সে জানতো এমন কিছুই হবে।

,,” ঘরে বউ রেখে বিয়ে করেছিস অনুমতি নিয়েছিলি? এক বউ থাকতে আরেক বিয়ে কি করে করলি তুই?”

এই ঘর থেকে এমন চিৎকার চেঁচামেচি শুনে দৌড়ে এলো জমিলা,সোহাগী আর তার শ্বাশুড়ি। সফিক আর রফিক মাত্র বাড়িতে ঢুকছে। সবাই দৌড়ে চাচাদের ঘরের দিকে যাচ্ছে দেখে দুইজন দৌড়ে এলো।

সোহাগী তৃধাকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। জমিলা বিশ্বাস করতে পারছে না, রজব এমন কাজ করেছে।

রজব গলা উঁচিয়ে বললো, অনুমতি নেওয়ার কি আছে। ঘরের বউয়ের যেহেতু সমস্যা, ঠিক আছে দিয়ে দিলাম তালাক।

রজব পর পর তিন তালাক দিয়ে দিলো। তৃধা চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়ল। শেষ সব শেষ। তার সংসার ভেঙ্গে গেছে। তিল তিল করে গড়া সংসার ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। এক সমুদ্র ভালোবাসা এখন বিন্দু পরিমাণো নেই। সদ্য ফাঁকা হওয়া বুকটা থাবড়ে কাঁদছে তৃধা। এই পৃথিবীতে বুঝি আপন আর কেউ রইলো না। মাথা গুঁজার ঠায় বুঝি আর রইলো না।
তৃধার বিলাপে সবার চোখ ভিজে উঠলো।

সফিক এগিয়ে এসে স্বজোরে রজবের গালে চড় বসিয়ে দেয়।
রজব রাগী চোখে তাকায় সফিকের দিকে। সফিক কলার ধরে ঝাঁকিয়ে বললো, যেদিন তোকে স্বস্তা হোটেল থেকে এই মেয়ের সাথে বেরুতে দেখি। সেই দিনই বুঝেছিলাম তোর চরিত্রে দোষ আছে। তা না হলে এতো ভালো বউ রেখে কি ভাবে বাইরে নোংরামি করে বেড়াস?

তৃধা চোখ তুলে তাকালো। তাহলে কি সোহাগী ভাবী এতোদিন এই কথা বলতে চেয়ে চুপ করে গেছে? হ্যা! এই কথাটাই বার বার বলতে নিয়েও বলতে পারেনি, তা এখন বুঝতে পারছে তৃধা।

রজব হাত ঝাড়া দিয়ে সফিকের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, এতো ভালো হলে রেখে দাও।

রজবের কথা শুনে রফিক চড় বসিয়ে দিলো রজবের গালে।
,,”বেয়াদব! কার সাথে কি ভাবে কথা বলছিস তুই?”

সফিক নির্বাক। রজব এমন নোং*রা কথা বলবে তিনি কল্পনাও করেনি। রজবকে সব সময় নিজের ভাইয়ের মতো মনে করতো। সোহাগী হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। রাজিয়া দৌড়ে গিয়ে ভাইয়ের শার্টের কলার চেপে ধরে।
,,,দুঃচরিত্র কোথাকার। ন*ষ্ট ছেলে। আজ থেকে তুই আমার ভাই না। ম*রে গেছে সে। ম*রে গেছে।

জমিলা আর তার শ্বাশুড়ি ফাতেমা খাতুন মুখে হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছে। বলার মতো কিছুই পাচ্ছে না। শুধু অবাক হচ্ছে রজবের এমন অধঃপতন দেখে।

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা রাজিয়ার হাত থেকে রজবের কলার ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, বিয়েই তো করেছি অপরাধ তো করিনি। তোমরা সবাই এমন করছো কেন? কি দোষ আমাদের। কেন সবাই ওর গায়ে হাত তুলছো?

তৃধা উঠে দাঁড়ায়। চোখ জোড়া মুছে নিতেই আবারো ভরে উঠলো চোখ। মেয়েটার মুখামুখি হয়ে কান্নারত গলায় বলল,, অপরাধ করনি , শুধু একটা মেয়ের ঘর ভেঙে দিলে। একটা মেয়ের ভালোবাসা কেড়ে নিলে। সুখে সাজানো সংসার ভেঙ্গে দিলে। অপরাধ করনি বরং তোমরা আমায় নিঃস্ব করে দিলে ।নিঃস্ব করে দিলে। মুখ ঢেকে কেঁদে উঠলো তৃধা। এই জগৎ সংসারে তার যে আর কেউ রইলো না। কেউ রইলো না। জগৎ সংসার অন্ধকার হয়ে গেল। শূন্য হয়ে গেল।

এমন সময় সাফিয়া খাতুন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। রজব ধরতে গেলে রাজিয়া ধা*ক্কা মে*রে সরিয়ে দিয়ে বললো,, ছুবি না তুই।
জমিলা,সোহাগী আর ফাতেমা খাতুন মিলে সাফিয়াকে বিছানায় শুইয়ে দিলো।

তৃধা বুঝতে পারছে না কি করবে। স্বামী, সংসার , শ্বশুর বাড়ি কিছুই আর রইলো না। একটা শব্দ তিনবার উচ্চারিত হতে না হতেই সব‌ শেষ হয়ে গেলো। এই বাড়িটাও এখন তার না,না এই ঘর,না এই ঘরের মানুষ গুলো। সব কিছুর সাথে মাথা গোঁজার ঠাঁই টাও হারালো। তৃধা পা বাড়ায় রুমের দিকে।

রজব তৃধার সামনে দাঁড়িয়ে বললো, কোথায় যাচ্ছো তুমি? বের হয়ে যাও ঘর থেকে!

সোহাগী রেগে টেবিলের নিচ থেকে রামদা বের করে রজবের গ*লায় ধরে।
খবরদার রজব। যা করেছিস এতক্ষণ চুপ করে ছিলাম। এখন আর চুপ থাকবো না। দা দেখেছিস! গ*লা কে*টে রেখে দিবো।

রজবের নতুন বউ হাত ধরে টেনে বললো,, এই মহিলা পা*গল হয়ে গেছে। চলে এসো।

তৃধা সোহাগীর দিকে তাকিয়ে চোখে হাসলো। এই বাড়ির সবাই তার আপন হয়ে গেছে। শুধু যাকে সর্বস্ব দিয়ে আপন করতে চেয়েছে সে পর করে দিয়েছে।

চোখে মুখে পানি দিতে জ্ঞান ফেরে সাফিয়ার। জেগে উঠতেই তৃধাকে খুঁজতে লাগলো।
তৃধা রজবের সাথে আসার সময় মায়ের একটা শাড়ি নিয়ে এসেছিলো। সেই শাড়িটা দুই বছর খুব যত্ন করে রেখেছিল। ভাজ ভাঙ্গেনি,না কখনো পরেছে। পরলে যদি মায়ের গায়ের মা মা গন্ধটা চলে যায়!
সেই শাড়িখানা বুকে জড়িয়ে বেরিয়ে এলো । সাফিয়া উঠে তৃধাকে বুকে জড়িয়ে হুহু করে কেঁদে ওঠে।
,,” মারে মাফ করে দিস এই অভাগিকে। এই অভাগীর গর্ভে এমন জা*নো*য়ার জন্ম নিবে জানলে তখনই বি*ষ খেয়ে ফেলতাম।

তৃধা সাফিয়াকে ছাড়িয়ে তার কপালে চুমু এঁকে বললো, তুমি অভাগী নও মা।আমি অভাগী। মাফ করে দিও। যদি কখনো কোনো ভুল করি।

কারো চোখের পানি বাঁধ মানছে না। সবার কান্নার রোল পড়ে গেছে। বিরক্ত রজব আর তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রী সুমনা।

বাড়ি ছেড়ে এক কাপড়ে বেরোয় তৃধা। সবাই যেতে বাধাঁ দিলেও থামেনি সে। বাড়ি পেরিয়ে রাস্তা ওবদি যেতেই রফিক আর সফিক বাঁধ সাধলো। তৃধার ভেজা চোখে হাজারটা অভিযোগ দেখে দুই ভাই থমকে দাঁড়ায়। আটকে রাখতে চেয়েও পারলো না। শেষে তৃধার হাতে পাঁচহাজার টাকা গুঁজে দেয় সফিক। তৃধা ফিরিয়ে দিতে নিলে সফিক তৃধার মাথায় হাত বুলিয়ে স্নেহ মাখা গলায় বলল,, ভাই কিছু দিলে তা রাখতে হয়।
রফিক এখনো বেতন পায়নি। তাই বাজার খরচের জন্য রাখা শেষ দুহাজার টাকা তৃধার হাতে তুলে দেয়। একটা মাস নাহয় কষ্ট করবে। তবুও আক্ষেপ থাকবে না।
তৃধার কলিজা ছিঁ*ড়ে যাওয়ার জোগাড়। চোখ ফেটে অশ্রুকনা গড়িয়ে পড়ছে। এতো গুলো ভালো মানুষের ভিড়ে একজন খা*রা*প মানুষ তার জিবনটা বি*ষিয়ে দিয়েছে। ভাবতেই তৃধা মুখ চেপে ফুঁপিয়ে কেঁ*দে উঠলো। রফিক তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বললো,, ওবাড়ি যাবি? চল এগিয়ে দেই।
তৃধা কান্না জড়ানো গলায় বলল,, আমি যেতে পারব।
তৃধা জানে ওই বাড়ি যাবে না বলার পর দুইজন তাকে একা ছাড়বেনা। তাই কোনো রকম মিথ্যা বলে বেরিয়ে এলো। ঝাপসা চোখে শূন্যে তাকিয়ে এলোমেলো পায়ে হেঁটে যাচ্ছে তৃধা। না গন্তব্যের ঠিক না উদ্দেশ্য। বুকটা বেশ ভারী ঠেকছে।কান্না গুলো দলা পাকিয়ে গলায় ফাঁ*স তৈরি করছে। মনে হচ্ছে ম*রলেই শান্তি। পৃথিবীতে কে আছে তার ? কার কাছে যাবে?কার জন্য বাঁচবে? যাকে গোটা পৃথিবী ভেবে ছিলো সে তো তাকে তার উচ্ছিষ্ট ও ভাবেনি।এই অনূভুতিটাই তো বি*ষাক্ত।

চলবে,,,,।

উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ৩

ফরিদা হক বিষন্ন মন নিয়ে সোফায় বসে আছেন। কথা বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই বললেই চলে। ইচ্ছে না থাকার সত্ত্বেও কিছু কথা না বললেই নয়। গলা খাকিয়ে ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলেন,, আজ না অফিস নেই? তা স্যার এখন কোথায় যাওয়া হচ্ছে? তাও বিকেল করে।

পানির গ্লাস রেখে মুচকি আসলো নুসাইব।মায়ের কথায় অভিমান স্পষ্ট।
ফরিদা হক পুনরায় বলে উঠলো,,, চার চারটা ছেলে মেয়ে থাকার সত্বেও মা ঘরে একা পঁ*চে ম*রছে। লোকে শুনলে ই*জ্জত যাবে।

নুসাইবের মুখে হাসির রেখা চওড়া হয়ে ফুটে উঠল। সে জানে তার মা একটু পর ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বিয়ের প্রসঙ্গে আসবে। তার আগে নুসাইব বলে উঠলো,, এইসব অলুক্ষনে কথা বলবে না ।আলহামদুলিল্লাহ আমার আম্মু এখনো বেঁচে আছে। একা নেই বাবাও আছে। চার চারটা ছেলে মেয়ে বড় হয়েছে আম্মু। কেউ সংসার ,কেউ পড়ালেখা তো কেউ কর্মস্থল নিয়ে ব্যাস্ত।
ফরিদা হক চট জলদি বলে উঠলো,, আমি কখন বললাম সবাই আমাকে ঘিরে বসে থাক? একটা মেয়ে বিয়ে দিয়েছি শেষ। আরেকটা পড়ছে তাও মানলাম। কিন্তু বড় ছেলে? এতো বড় ছেলে থাকার সত্বেও ঘরে একটা বউ নেই। আমার সাজানো সংসার বিরান হয়ে আছে। তোর জন্য ছোট ছেলেটার সিরিয়াল আসছে না।

‘আহ্হা আম্মু!!’

‘চুপ!একদম আম্মু বলবি না! বয়স তো কম হয়নি এইবারতো বিয়ের দরকার।’

‘কিসের বয়স! মায়ের কাছে সব ছেলেমেয়েই বাচ্চা। ‘

‘রাখ তোর বাচ্চা। আমি বাচ্চা বললেই-কি বয়স থেমে যাবে? বাপ ডাক শোনার বয়সে শুনছিস না। যখন দাদা ডাক শোনার বয়স হবে তখন বাপ ডাক শুনতে চাইছিস?’

নুসাইব ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে। যার অর্থ সে হার মানলো। মায়ের যুক্তির সাথে পেরে উঠা দায়।

ফরিদা হক নিঃশ্বাস ফেলে পুনরায় বলে উঠলো,, বাচ্চা সহ পাড়া প্রতিবেশীও কনফিউজড হয়ে যাবে,বাপ ডাকবে না দাদা? কিছুই বুঝা যাবে না।

‘ঠিক আছে বুঝলাম। সময় হোক তখন করবো।’

‘মনে হয় না এই বছর তোর সময় হবে। যা করার আমাকে করতে হবে।’

মায়ের কথার প্রতি উত্তরে কিছু বললো না নুসাইব। তবে ব্যাস্ত গলায় বাবার কথা জিজ্ঞেস করতেই হকচকিয়ে গেল ফরিদা হক।
ব্যাপারটা নুসাইবের দৃষ্টি না এড়ালেও বিষয়টা নিয়ে আর ঘাটালো না তাকে।

ফরিদা হক ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে বলল,, তোর বাপ ছোট নেই। ঘরে বসে থাকলে রোগী হয়ে যাবে, বের করে দিয়েছি। তুই এতো কথা জিজ্ঞেস না করে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়। তোর আবার দেরী হয়ে যাবে।

নুসাইব বুঝতে পারছে তার মা বাবা মিলে তার পেছনে কোনো না কোনো খিচুড়ি পাকাচ্ছে। সেই খিচুড়ি বিয়ে প্রাসঙ্গিক তাও বুঝতে পারছে। সব বুঝলেও এই ব্যাপারে বিশেষ কোনো মতামত নেই তার। একটা বয়সে মা বাবা ছেলে সন্তানের জন্য এমন উদ্বিগ্ন হবে এইটা স্বাভাবিক। নুসাইব বুঝেও না বুঝার মত করে বললো,, ঠিক আছে আম্মু। আমি বেরহলাম। আমার ফিরতে দুইদিন সময় লাগবে। কাজ শেষ হলে তাড়াতাড়ি চলে আসবো।

‘দুই দিন? শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছিস নাকি? ভিতরে ভিতরে বিয়ে টিয়ে করে ফেলিস নিতো?

হতাশা ভরা নিঃশ্বাস ফেললো নুসাইব। মা তার সব ব্যাপারেই বিয়ে দেখছে।
‘বিয়ে করলে লুকাতাম না। ব্যাবসায়ের কাজ আম্মু।’

‘বিজনেস ট্রিপ! তাহলে ঠিক আছে। আল্লাহর নাম নিয়ে ঘর থেকে বেরহ। আর হ্যা অবশ্যই লোকেশন শেয়ার দিয়ে যাবি। পৌঁছে কল দিবি। খাওয়া দাওয়া ঠিক মত করবি। আর,,’

‘ আহ্ মাআআ!এতো কিছু এখন বললে মনে থাকবে না। তুমি বরং কল দিয়ে মনে করিয়ে দিও। ‘

‘ হ্যা। আল্লাহর কাছে আমানত রাখলাম। ‘

নুসাইব মৃধু হেসে বেরিয়ে পড়লো। সব যাত্রায় মা তাকে ‘আল্লাহর কাছে আমানত রাখলাম” বলেই বিদায় দেয়।
,
,
,
প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে। ব্যাস্ত শহর আরো বেশি ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে। দোকানিরা বিক্রি করতে ব্যাস্ত ,তো খোদ্দের কিনতে ব্যাস্ত। কেউ কেউ বাড়ি ফেরার তাড়া নিয়ে ছুটছে, আবার কেউ সবে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়েছে মাত্র। সবাইকে সবার গন্তব্যে পৌঁছে দিতে যানবাহনেরা উদ্যত। এর মাঝে গ্ৰাম থেকে ছেড়ে আসা বাসটা মাত্র থামলো। যাত্রীরা হড়বড়িয়ে নামছে,সবারই বাড়ি ফেরার তাড়া। সবার মাঝে ব্যাতিব্যাস্ত ভাব থাকলেও তাড়া নেই তৃধার। বুকে জড়িয়ে রাখা কাপড়ের পুটলিটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে শূন্যে চোখ রাখলো। না চাইতেও জিবনের হিসেব কষে যাচ্ছে।
তৃধা নামছে না দেখে বাস কনট্রাকটার জোরে আওয়াজ করে বলে উঠল,,’ নামেন!এই গাড়ি আর যাইবো না,এইখানেই যাত্রা শেষ‌।’

তৃধা ঘোমটা টেনে ধীরপায়ে সামনে এসে চুপচাপ নেমে পড়লো। সবাই সবার ঠিকানায় ছুটছে শুধু তার ঠিকানা নেই। চেনা পরিচিত শহর আজ ভীষণ অচেনা ঠেকছে। দু’বছরে শহর খুব একটা বদলায়নি,না বদলেছে মানুষ। শুধু মাত্র তার জিবনের গতিপথ বদলেছে বলেই বাকি সব অচেনা লাগছে।
বাস থেকে নেমে একপাশে সরে দাঁড়ালো। উদ্দেশ্যহীন জিবন আর উদ্দেশ্যহীন পথ নিয়ে দ্বিধায় পড়ে আছে। চার পাশে একাকীত্বে, অসহায়ত্বে ঘিরে ফেলেছে।পাপ না হলে হয়তো আত্মহত্যাটাই বেঁছে নিতো। চোখের কোণে অশ্রু কনা জামা হচ্ছে।কিছু সময় পর হয়তো গড়িয়ে পড়বে।

তৃধার কাছ থেকে কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে এক ভদ্র লোক। ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত,বয়স আনুমানিক ষাট কি পঁয়ষুট্টি । তিনি মোবাইল ফোন কানে রেখে বেশ হেঁসে হেঁসে কথা বলছে। কখনো হাত নেড়ে তো কখনো গা দুলিয়ে হেঁসে। তৃধা টলমল চোখে সেই দিকে চেয়ে রয়। ভাবছে, এই শহরে সবাই কতই না সুখি, সবার আপন মানুষ আছে। নিশ্চয়ই লোকটারো আছে! হয়তো ওনারো বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় বসে আছে তার স্ত্রী সন্তান। বুক ফুলিয়ে শ্বাস নেয় তৃধা। তাও যেন কষ্টের ভার কমছে না, বরং সময়ের সাথে সাথে বাড়ছে।
নাবিব শেখ ফোন কানে নিয়ে তার স্ত্রী ফরিদা হকের সঙ্গে কথা বলছেন। তার ফিরতে দেরী দেখে ফরিদা হক বেঁকে বসেছেন। সেই রাগ ভাঙাতেই হাসিঠাট্টা। ফোনে কথা বলতে বলতে সামনে পা বাড়ায়। তিনি বেখেয়ালে থাকায় হয়তো বাইকটাকে খেয়াল করে উঠতে পারেনি। ব্যাপারটা তৃধা খেয়াল কোরে এক সেকেন্ডও দেরী করলো না। এক প্রকার ছুটে গিয়ে নাবীব শেখকে টেনে সরিয়ে নেয়। বাইক চালক লোকটার হঠাৎ আগমনে হকচকিয়ে ব্রেক কষতেই ছিটকে রাস্তার পাশে পড়লো। এই দিকে তৃধা নাবীব শেখকে সরানোর সময় হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আকস্মিক ঘটনায় নাবীব শেখ সহ সবাই হতভম্ব। তৃধা কপাল চেপে ধরে দাঁড়াল। চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হচ্ছে, হয়তো কেটে গেছে। ফুটপাতে বসা দোকানী গুলো তড়িঘড়ি করে উঠে মটর বাইক চালককে উঠায়। বাইক চালক ব্যাথ্যার চাইতে ভয় পেয়ে গেছে খুব।নেহাত বাইকের গতি কম ছিলো।তার বিশেষ কোনো ক্ষতি না হলেও হাঁটু আর হাতে চামড়া কিছুটা উঠে গেছে।তিনি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এসে নাবিব শেখের সামনে দাঁড়িয়ে কম্পিত গলায় বলল,, আংকেল আপনি ঠিক আছেন ? কোথাও লাগেনিতো?
নাবিব শেখ টলমল চোখে তৃধা আর বাইক চালকের দিকে তাকিয়ে বলল,, আমি ঠিক আছি বাবা। কিন্তু তোমরা,,
আশ পাশের লোকজনের মধ্যে অনেকে দুঃখ প্রকাশ করছে, আবার অনেকেই নাবিব শেখকে দোষারপ করছে।
বাইক চালক সবাইকে থামিয়ে বলে উঠলো,, উনি মুরব্বি মানুষ। বাইকটাকে ঠিক খেয়াল করেনি।আমার সমস্যা নেই, আপনারা চিন্তা করবেন না,বেশি ব্যাথা পাইনি।

তৃধার কপাল চুঁইয়ে র*ক্ত পড়ছে। কপাল থেকে হাত নামিয়ে র*ক্তে ভেজা হাতটা দেখে ওড়নায় মুছে ফেলে। যেন তার কিছুই হয়নি। চেহারার আদলটাও ভীষণ স্বাভাবিক।

বাইক চালক নাবিব শেখ থেকে বিদায় নিয়ে সরে আসে। ধীর পায়ে বাইক উঠিয়ে,বাইকটা স্ট্যান্ড করে রাখলো। মনে মনে খোদার কাছে শুকরিয়া আদায় করলেও তার নিজের চেয়েও বাইকের খোসে যাওয়া রংটার জন্য খারাপ লাগছে বেশি। অবশ্য প্রতিটি বাইকারের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা নিতান্তই স্বাভাবিক। তারা নিজের চাইতে বাইকের মায়াটাই বেশি করে।

ভীড় কমে এলে তৃধা ওড়নার কোনো দিয়ে কপাল মুছে বেরিয়ে আসে। ভীড় ঠেলে বেরিয়ে আসা কিছু মানুষ তৃধার জন্য হা হুতাশ করছে। তৃধার শান্ত দৃষ্টি দেখে নাবিব শেখ তৃধার পাশে দাড়ায়। তৃধা তখন অনূভুতিহীনের মত রাস্তায় ছুটে চলা গাড়ি গুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। নাবিব শেখ তৃধার কপাল দেখে ব্যাথ্যাতুর গলায় জিজ্ঞেস করলো,, ব্যাথ্যা করছে মা?
ফিরে তাকালো তৃধা , মা শব্দটা তৃধার ভীষণ আপন ঠেকলো। চাপা নিঃশ্বাস ফেলে বললো,, না।

‘ কি বলছো! অনেটাই কেটে গেছে। আমার সাথে হসপিটালে চলো।’

তৃধা চাঁপা হেসে ওড়না দিয়ে পুনরায় কপাল মুছতে মুছতে বললো,, তার দরকার হবেনা আংকেল। আমি ঠিক আছি। আপনি বরং বাড়ি চলে যান। আপনার পরিবার হয়তো চিন্তা করছে।’

তৃধার কথার তোয়াক্কা করলো না। মোবাইল বের করে কল দেয়ার মিনিট পাঁচেক পর একটা গাড়ি এসে হাজির হলো সামনে। ড্রাইভার হড়বড়িয়ে গাড়ি থেকে নেমে একপ্রকার তড়িঘড়ি করেই দরজা খুলে দিলো। তৃধা কিছু বলবে তার আগেই নাবিব শেখ ভারী গলায় তৃধাকে গাড়িতে উঠতে বলে। তৃধা না করলো না। কপালের ব্যাধ্যাটা পুরো মাথায় ছড়িয়ে পড়ছে দেখে বসে পড়লো।

হসপিটাল অনেক দূর না হলেও তৃধার কপাল দেখে নাবিব শেখ ব্যাথ্যাতুর গলায় ড্রাইভারকে বলে উঠলো,, মোবারক আর কত দূর? পথ শেষ হচ্ছে না কেন? মেয়েটার কপালতো র*ক্তে ভে*সে যাচ্ছে।

‘বেশি সময় লাগবে না স্যার। এইতো চলে এসেছি।’

‘চলে এসেছি বলে বলে অনেক তো হলো। তাড়াতাড়ি করো।’
কথা বলতে বলতে পাঞ্জাবীর পকেট থেকে রুমাল বের করে যত্ন সহকারে তৃধার কপালে চেপে ধরল।
তৃধা অবাক চোখে তাকালো। তিনি সেই তাকানো উপেক্ষা করে বলে উঠলো,’ বারবার হাত দিয়ে মুছবে না ইনফেকশন হয়ে যাবে।’

হসপিটালে পৌঁছাতেই তৃধাকে ইমার্জেন্সি রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। একজন ডাক্তার তৃধাকে বিচক্ষণতার সাথে দেখলো , অতঃপর তৃধার আর নাবিব শেখের দিকে তাকিয়ে বলল,, শেখ! তোর মেয়ের চেহারা এতোটা বদলে গেলো কিভাবে? নাকি বয়স হতে হতে আমার চোখ চলে যাচ্ছে?
তৃধা দুইজনের দিকে পর পর তাকালো। দুইজনকেই সম বয়সী মনে হচ্ছে। দুজনের চেহারায় বয়সের ছাপ স্পষ্ট। তৃধার বুঝতে বাকি নেই তারা পূর্ব পরিচিত।

নাবিব শেখ ডাক্তারের কথায় বিরক্ত হয়ে বলল,, মুখ বন্ধ রেখে কাজ কর। কতটা র*ক্ত বেরিয়ে গেছে হিসেব আছে? ডাক্তার হলেও তোর বাঁচাল স্বভাবটা গেলো না।
ডাক্তার জাকের তৃধার কপাল ওয়াশ করতে করতে মৃধু হাসলেন। এর মধ্যে নাবিব শেখ পুরো কাহিনী বলে ফেললেন।
তৃধার কপালের কাঁটা জায়গাটা চিনচিনিয়ে ব্যাথা করছে। সেই ব্যাথ্যায় চোখ ভিজে উঠছে। তা দেখে ডাক্তার জাকের টিস্যু নিয়ে তৃধার হাতে দেয়।

নাবিব শেখ উতলা কন্ঠে বলে উঠলো,’সেলাই লাগবে ‘?

‘ হুম লাগবে। দুটো সেলাই না দিলেই নয়। অল্পোতো আর কাটেনি।’
তৃধা তখনো চুপচাপ বসে আছে। মনেই হচ্ছে না তাকে নিয়ে কথা হচ্ছে। নাবিব শেখ বেশ ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে বলে উঠলো,’ সেলাইয়ের দরকার নেই। এমন কিছু কর যাতে দাগ না পড়ে। ‘
ডাক্তার জাকের তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে তৃধার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সব দাগ যে অসৌন্দর্যের কারন হয় এমন না, কিছু দাগ আছে যা জিবন আর চেহারা দুটোরই সৌন্দর্য বাড়ায়।’

কথা খানা তৃধার দারুন পছন্দ হলেও এর সাথে তৃধার জিবনের কোনো মিল নেই।
তৃধার কপোল বেয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো।তার জিবনে লাগা দাগ গুলো দাগ-ই রয়ে গেলো। সেই দাগ গুলো সৌন্দর্যের চেয়ে দ*গদগে ঘা এর সৃষ্টি করছে বেশি। যা ক*ষ্ট ব-ই কিছুই দিচ্ছে না।

মাথায় ব্যান্ডেজ করা শেষ হলে নাবিব শেখ ডাক্তার জাকের থেকে বিদায় নিয়ে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে পড়ে। বাইরে অন্ধকার হয়ে পড়েছে। একটা লম্বা রাত তৃধার অপেক্ষায়।তৃধা আশপাশে তাকিয়ে একটা লম্বা রাত কল্পনা করে নিলো। যেই রাত অনিশ্চয়তা আর অসহায়ত্বে পরিপূর্ণ। বুকের ব্যাথ্যাটা ক্রমাগত ভয়ে পরিনত হতে থাকলো।

নাবিব শেখ গাড়ির দরজা খুলে বললো,, বসে পড় মা, তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে তবেই ফিরবো। তোমার বাড়ির লোকজন হয়তো তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছে। আমার কারনে সবাইকে টেনশনে পড়তে হলো। তাড়াতাড়ি করো!

নাবিব শেখের কথায় তৃধা ব্যাথ্যাতুর হেসে বলে উঠলো ,,,, এই পৃথিবীতে সবার অপেক্ষমান মানুষ থাকে না আংকেল, সবার আপনেরা পথ চেয়ে বসে নেই। ভাগ্যবান মানুষের জন্য তার আপনজনেরা অপেক্ষমাণ থাকে। তবে দূর্ভাগ্যবসত আমি সেই ভাগ্যবান কিংবা ভাগ্যবতীর তালিকায় নেই।

চলবে,,,,,