উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ৩৮
,
,
,
,
,
,
খাওয়া দাওয়া শেষ করে অনেকে চলে গেলেও বাকি যারা ছিল তারা অনুষ্ঠান শেষ হওয়া পর্যন্ত ছিল। এরপর একে একে তারাও বিদায় নিয়েছে আপাতত বাড়ির মানুষ বাদে কেউ নেই । এইদিকে সেতারা বেগম বেকে বসেছেন। তিনি এই বাড়িতে আর এক মূহুর্ত থাকবে না। ফরিদা হকও সাধলেন না । তমালকে পাঠিয়ে দুটো গাড়ি ঠিক করে দিলেন। এতে করে সেতারা বেগমের সাথে তার মেঝো বউ শেফালী আর একমাত্র মেয়ে রেবেকা রেগে আগুন। দুজন রাগে গজগজ করতে করতে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লো। সেতারা বেগম ব্যাগপত্র গুছিয়ে গাড়িতে উঠে বসলেন। শুভা ব্যাগ গুছিয়ে ঘর থেকে বের হওয়ার আগে তৃধার মাথায় হাত বুলিয়ে বেরোলেন।
সোয়েব শেখ তার দুই ছেলে আর মেয়ে জামাইকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। এই সংসারে পুরুষদের মধ্যে মনোমালিন্য না থাকলেও স্ত্রী জাতের মধ্যে দ্বন্দ্বের শেষ নেই। তারা পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করার জন্য সব সময় প্রস্তুত। সোয়েব শেখ এইসবে নেই। তিনি তার ছেলেদেরও এইসব থেকে দূরে রাখার পরামর্শ দেন।
___________
আয়নার সামনে বসে আছে তৃধা। নবনী চুল থেকে ক্লিপ খুলে দিচ্ছে। নুসাইব ফ্রেশ হয়ে বিছানায় বসে বললো ,,” পিচ্চি, দাদুরা চলে গেছে?
নবনী ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে ফেললো। সে জানে না গেছে কিনা। জানার কথাও না। সমুদ্ররা যাওয়ার পর যে রুমে ঢুকছে মাত্র বেরিয়ে ভাইয়ের রুমে এসেছে। এর মধ্যে প্রায় দুই ঘণ্টা রুমেই কাটিয়েছে। সমুদ্রের সাথে কথা বলতে বলতে সময়যে কতটা গড়িয়েছে তার হিসেব নেই। এর মধ্যে বাড়িতে কি ঘটেছে তাও জানে না
তৃধা নবনীর মুখে দিকে তাকিয়ে বলল,, চলে গেছে। বাড়িতে আপাতত কোনো মেহমান নেই।
,,” সত্যি চলে গেছে?”
নবনীর প্রশ্নে মাথা নাড়ালো তৃধা।
নুসাইব ভ্রু কুঁচকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,,” তোর জানার কথা। তুই তৃধাকে কেন জিজ্ঞেস করছিস? এতো সময় কোথায় ছিলি?
নবনী পড়েছে মহা ঝামেলায়। এইবার ভাইকে কি ভাবে বলবে সে তার হবু জামাইয়ের সাথে কথা বলছে।
নুসাইবের দিকে ঘুরে তাকালো তৃধা। নুসাইব তৃধার চেহারার দিকে তাকাতেই তৃধা চোখ রাঙিয়ে ইশারা করলো। নুসাইব প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। তৃধার ইশারা ধরতে পারছে না।তৃধা আবারো নবনীকে দেখিয়ে ইশারা করে ।
নুসাইব কি বুঝো কে জানে সে গলা খাকিয়ে বলে উঠলো,,” নবনী তুই তোর রুমে যা।”
হুট করে রুমে যেতে বলার কারণটা নবনী খুঁজল না । বরং প্রশ্ন থেকে বাঁচার জন্য রুম ছেড়ে পালালো।
তৃধা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে।
দরজা ভিড়িয়ে পুনরায় বিছানায় বসে বললো,, এইবার বলো এতক্ষণ কি ইশারা দিচ্ছো।
তৃধা হতভম্ব হয়ে মাথায় হাত দিয়ে বললো,, এইটা শোনার জন্য বের করে দিয়েছেন?
নুসাইব মাথা নেড়ে বললো,, হ্যাঁ।
তৃধা মাথায় হাত দিয়ে বললো,, “আমি কাকে বিয়ে করেছি। ইশারাও বুঝে না।”
নুসাইব ভ্রু কুটি করে বললো,, নুসাইব শেখকে বিয়ে করেছো আরকি। এখন বলো তখন কি ইশারা করছিলে?
তৃধা খোঁপা খুলতে খুলতে বলল,, নবনী এখন বড় হয়েছে। হুটহাট এমন প্রশ্ন করা কি ঠিক? বেচারি ভয়ে মুখটা এইটুকুন হয়ে আছে। ভেবেই পাচ্ছে না কি উত্তর দিবে।
-“এমন প্রশ্ন বলতে? ”
-” মেহমানদের খোঁজ নেওয়ার ব্যাপারে। নিশ্চয়ই এতোসময় সমুদ্রের সাথে কথা বলছিল। এখন সেতো আপনাকে বলতেও পারবে না এতো সময় কি করছিলো। আপনার তো বুঝা উচিৎ ছিলো। সেটা না করে উল্টো এমন ভাবে যেতে বললেন। না জানি এখন কি না কি ভাবছে।”
নুসাইব তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বললো,, ‘তোমরা আর তোমাদের ইশারা। এখন আমি কিভাবে জানবো ও কি করছিলো? তাছাড়া এতো সময় ধরে কিসের কথা?’
তৃধা হার মানলো। শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,,’আমিও কাকে কি বলছি। যে জিবনে একটা প্রেম পর্যন্ত করেনি তাকে লম্বা সময় মোবাইলে কি কথা হয় ,এইবার সেটা কিভাবে করে বুঝাই?’
তৃধার কথায় নুসাইব যেন সুযোগ পেলো। একপ্রকার রসিকতা করেই বললো,,’ প্রেমের দরকার নেই, এখন তুমি আছো। আমি অফিসে গেলে কল দিবো। দুজন ঘন্টা দুই কথা বলবো। তখন এমনিতেই বুঝে যাবো কষ্ট করে বুঝাতে হবে বলে মনে হয় না।’
নুসাইবের কথার পৃষ্ঠে বলার জন্য কথা খুঁজে পেলো না তৃধা। বরং নিজের কথায় নিজেই ফেঁসে চুপসে আছে। এমন কথার উত্তর দেওয়া না দেওয়া দুটোই কঠিন। মনে কিছু না বললেও তৃধা মনে বলে উঠলো,,’সুযোগের অভাবে এতো ভদ্র সভ্য তা না হলে সত্যি ধুরন্ধর লোক।”
তৃধার উত্তর শোনার অপেক্ষায় নুসাইব।
এমন সময় স্বশব্দে মোবাইল খানা বেজে ওঠে। তৃধা যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে।এই কলটা তার জন্য শুভ।নুসাইব ব্যতিব্যস্ত হয়ে মোবাইল ফোন হাতে নিলেও ‘মেজর’ নামটা দেখা মাত্র তার ব্যস্ততা যেন দ্বিগুন বেড়ে গেল। ফোন হাতে নিয়ে তড়িঘড়ি করে রুম ছেড়ে বেরোয়।
হসপিটালের করিডোরে পেতে রাখা চেয়ারে বসে আছে তিহান। ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে আছে সামনে।রাতে বাড়ি ফেরার কথা থাকলেও সেটা আর হয়নি। ব্যাগপত্র নিয়ে সোজা হসপিটালেই আসতে হয়েছে। সেই থেকে এখন পর্যন্ত একটা মিনিটের জন্য চোখজোড়া বন্ধ করতে পারেনি। ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে হতাশার নিঃশ্বাস ফেললো। নুসাইবের নাম্বার থেকে পঁচিশটা কল তার সাথে প্রায় দশটা মেসেজ পাঠানো হয়েছে। এই মুহূর্তে মেসেজ পড়ার মত মন মানসিকতা কোনোটাই তিহানের নেই। তাই সরাসরি কল করলো।
ফোন রিসিভ করার সাথে নুসাইব কঠিন কিছু গালি দিলেও তিহান চুপচাপ সবটা শুনে মৃদু হেসে বলল,, স্যরি রে নুসাইব। তোর বিশেষ দিনেটাতেও ব্যস্ত ছিলাম। সত্যি স্যরি।
তিহানের গলার আওয়াজ,কথার ধরনে থামলো নুসাইব। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে বললো,,” কি হয়েছে তোর? কোথায় তুই? তোর কথা এমন শোনাচ্ছে কেন?লোকেশন পাঠা আমি এক্ষুনি আসছি।”
তিহান জানে নুসাইব তার মায়ের কথা শুনলে এক মিনিটও দেরী করবে না। সব ছেড়েছুড়ে সত্যি সত্যি চলে আসবে। এমন একটা দিন বাড়ি ছেড়ে আসা মোটেও শোভনীয় নয়। এইভাবে আসা মানে সদ্য বিবাহিত মেয়েটাকে অপমান করা। তিহান চায় না যেচে একটা মেয়ের বিশেষ দিন নষ্ট করতে। তাই বলল,,’ শহর থেকে দূরে আছি। রাতে ঘুমাইনি তাই গলা এমন শোনাচ্ছে। চিন্তা করার কারণ নেই। ফ্রী হলেই তোদের বাড়িতে হানা দিবো। রাগ করে থাকিস না দোস্ত। সত্যি অনেক চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ভাগ্যে নেই কি করবো বল?’
,”তোর ম*রার ভাগ্যে কখনো কিছুই থাকে না। তুই আসিসনি ঠিক আছে মানলাম। কিন্তু আংকেল আন্টি? ওনারা কই?”
তিহান সময় নিয়ে বললো,’ বাবা বাড়ীতে নেই। মা একা আসতে পারবে না। সব দিকেই ঝামেলা।’
,’ঠিক আছে সমস্যা নেই। তুই ফ্রী হয়ে কল দিস। সত্যি বলছি এরপর যদি না আসিস তোর সাথে সম্পর্ক শেষ।’
তিহান দূর্বল হাসলো। বললো,, ‘ঠিক আছে। কথা রইল।’
_________
এক ব্যস্তমত দিন শেষে রাত ফোহালো। ফরিদা হক নয়টা বাজার সাথে সাথে তাড়া দিয়ে সবাইকে ডাইনিং টেবিলে হাজির করায়। দুইদিন মেহমান নিয়ে প্রায় সবাই ব্যস্ত ছিলো। নাওয়া, খাওয়া, বিশ্রাম সব কিছুর তালমেল নষ্ট হওয়াতে তিনি আজ সবাইকে নয়টা বাজতে ডিনার করার জন্য তাড়া দিতে শুরু করলেন। কেউ দ্বিমত পোষণ করলো না। আসলেই ক্লান্ত সবাই। খাওয়া দাওয়া শেষ করে যে যার রুমে চলে গেছে।
তমাল ব্যাগ পত্র গুছিয়ে রেখেছে, কালকেই ফিরতে হবে তাকে। জামাকাপড় গুছালেও বই গুছায়নি। দুইদিনের জমিয়ে রাখা পড়ার ভার অনেক । সেই সুবাদে পড়তে বসে। মনোযোগ সহকারে বই নিয়ে বসলেও রাফি রিমান তাকে জ্বালিয়ে মা*রছে। প্রেম কাহিনী আর প্রেমিকা নিয়ে দুই বন্ধুর কৌতুহলের শেষ নেই। এক নাছোড়বান্দা থেকে বাঁচার জন্য মিথ্যা বললেও এই মিথ্যার কারনে আরো দুটো যুক্ত হয়েছে। এখন এই দুটোকে কে বোঝাবে তার মত ভবিষ্যৎ ডাক্তাররা প্রেম সংক্রান্ত ঝামেলায় জড়ায় না। এই ঝামেলায় জড়ালে ডাক্তার হতে হতে হাতুড়ি ডাক্তার হয়ে যাবে। সমস্যা রেখে ভালো জায়গায় অপারেশন করার দায়ে জেল খানায় রুটি বানাতে হবে। ভাবতেই শিউরে উঠলো তমাল। ক্ষনে ক্ষনে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে তার। উঁহু! তার মত ডাক্তারের জিবনে নারী থাকা পাপ। পাপ করার মত মানুষ তমাল নয়। নিজের দুগালে নিজে চাপড় দিয়ে তওবা করতে করতে খাতা কলম নিয়ে বসলো। আপাতত পড়ালেখায় মনোনিবেশ করতে হবে।
অন্যদিকে নবনী মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত। মোবাইল ফোনের অপর প্রান্তে থাকা মানুষটার যুদ্ধের ময়দানে হেরে যাওয়া সৈনিকের মত অবস্থা। নবনীর পড়ালেখা নিয়ে খামখেয়ালি ভাব দেখে রেগে ধমকালেও নবনীর পাল্টা ধমকের কাছে সত্যি হার মানতে হলো তাকে। সমুদ্র ভেবে পায় না তাকে নবনীর মত পুঁচকে মেয়ে ধমকাচ্ছে আর সেও ভয় পাচ্ছে। সমুদ্রকে ধমকানো তো দুরের কথা,যেখানে তার সামনে কেউ উচ্চবাচ্য করে না। সেখানে নবনী রিতিমত তাকে ধমকে চুপ করাচ্ছে। ভেবে হাসলো সমুদ্র। ভালোবাসা আসলেই অদ্ভুত ক্ষমতা রাখে।
______________
বিছানার এক প্রান্তে নুসাইব অন্য প্রান্তে তৃধা শুয়ে আছে। দুজনের চোখে ঘুম না থাকলেও ঘুমানোর চেষ্টা সাথে এই দম বন্ধ পরিস্থিতি থেকে বাঁচার উপায় দুজনই খুঁজছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে নুসাইব বলল,,” জানি তোমারো ঘুম আসছে না। চলো গল্প করি।”
তৃধা না তাকিয়ে বলল,,” কেমন গল্প?”
-‘এই ধর তুমি আমি প্রাসঙ্গিক। তোমার ছোট বেলা কিংবা আমার ছোটবেলা। কিংবা পছন্দ অপছন্দ।’
-‘ আপনার সম্পর্কে সবই জানি। বাকি আমি রইলাম। কি জানতে চান বলুন।’
নুসাইব ভেবে বললো,’ তোমার পরিবার নিয়ে ।যদি সমস্যা হয় বলার দরকার নেই।অন্য বিষয় নিয়েও কথা বলা যায়।’
তৃধা যেন জানতো নুসাইব কি নিয়ে প্রশ্ন করবে তাই বলে উঠলো,,’ আমাদের ছোট পরিবার। বাবা -মা আমি আর আমার ভাই। দাদা মারা গেছে প্রায় পাঁচ বছর আগে। এরপর দাদার দিকে কারো সাথে তেমন যোগাযোগ নেই। ওইদিকে তেমন কেউ নেই,যারা আছে তাদের সাথে সম্পর্ক রাখেনি।আমার বাবারা দুই ভাই । বাবা ছোট জন। দাদু মা*রা যাওয়ার পর দাদাকে নিয়ে ঝামেলা হয়। এরজন্য বাবা দাদাকে একেবারে আমাদের কাছে নিয়ে আসে। শেষ সময় গুলোতে আমাদের সাথেই ছিল। এরমধ্যে জেঠা জেঠি কেউ খবর নেয়নি দেখে বাবা ওদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। আপাতত বাবার দিক থেকে বাবাই আছে। মায়ের দিকে সবাই আছে। সবার সাথে সম্পর্কটা অনেক ভালো। আমাদের যাওয়ার একমাত্র জায়গা নানু বাড়ি।’
তৃধার বচন ভঙ্গিতে আলাদা একটা খুশি দেখা যাচ্ছে। নুসাইব মুচকি হেসে বলল,, বাবা -মায়ের সাথে সম্পর্ক কেমন ছিলো? ভাই , তোমার ভাই কি করে?
নুসাইবের প্রশ্ন শুনে তৃধা চুপ করে রইলো।
তৃধার নিরবতা নুসাইবের কাছে চিৎকার স্বরূপ। অপরাধবোধ ঘিরে ধরলো নুসাইবকে। এইসময় এই প্রশ্ন করাটা মোটেও উচিৎ হয়নি। নুসাইব সময় নিয়ে বললো,, মন খারাপ করো না। একটা সময় আসবে যখন তুমি এই প্রশ্ন গুলোর উত্তর দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে। তাদের কথা বলার সময় চোখ মুখে হাসি ফুটে উঠবে। এই প্রশ্ন গুলোর উত্তরে সুখ থাকবে। ঘুমাও তৃধা ঘুমাও।
তৃধা চোখ বুঝলো। দু’চোখে জমে থাকা নোনাজল গড়িয়ে কান ওবদি পৌঁছালেও নড়লো না সে।হাত পা ছেড়ে দিয়ে স্থির হয়ে রইলো। এই মুহূর্তে ঘুম প্রয়োজন তার। খুব বেশি ঘুম প্রয়োজন।
নুসাইব আবছা আলোতে হাত বাড়িয়ে তৃধার মাথায় রাখলো। আলতো করে বিলি কাটতে কাটতে কোমল কন্ঠে বলে উঠলো,, ঘুমাও।
বিলি কাটতে থাকা হাতখানা মায়ার ঠেকলো। দ্বিধা সংকোচ এড়িয়ে সেই হাতের মালিকের দিকে ফিরে শোয় তৃধা। চোখের পাতা ভারী হলো,ঘুম জড়ানো কন্ঠে বিড়বিড় করে বলে উঠলো,, “বাড়ি যাবো।”
_________
সুমনার বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে আছে রজব। সুমনার মা-বাবা বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি তাকে। এই ছেলে তার মেয়ে নিয়ে পালিয়েছে,তার চেয়ে বড় কথা মেয়েটাকে সুখে না রেখে পাহাড় সমান কষ্ট দিয়েছে। তারা কিছুতে তাদের মেয়েকে দিবে না।রজব এরও আগ্ৰহ নেই, কিন্তু লোকের কথায় বউকে ফিরিয়ে নিতে এসেছে। প্রায় ঘন্টা খানেক দরজা দাঁড়িয়ে থেকে পুনরায় রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করলো। ক্ষিদায় পেটের নাড়িভুঁড়ি পেঁচিয়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে কিছু না খেলে হয়তো ম*রে যাবে। সময়ের ব্যবধানে বদলে গেছে সব। তৃধা থাকলে সময়টা অন্য রকম হতো। মায়ের মোবাইল থেকে শ’খানেক কল দিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার তাড়া দিতো।এতো সময় না খেয়ে থাকার কথা শুনে নিজেই অপরাধবোধে শেষ হয়ে যেতো। অথচ আজ? রজব গভীর নিঃশ্বাস ফেললো। সময়ের ব্যবধানে কিছুই বদলায়নি, বরং সে বদলে যেতে বাধ্য করেছে।
চলবে,,,।
উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ৩৯
,
,
,
,
,
,
,
মায়া জাহানের অবস্থা আগের চাইতে অনেকটাই ভালো। ডাক্তার তাকে বাড়ি গিয়ে রেষ্টে থাকার পরামর্শ দিয়েছে। মাহাবুব ইসলাম মায়া জাহানের ডিসচার্জ পেপার হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছেন। চারপাশে তাকিয়ে কোথাও ছেলেকে পাননি।কাল রাতের পর থেকে ছেলেটা একবারো চোখে পড়েনি। রাতে বাপ ছেলের মধ্যে অনেক কথা হয়েছে। মেয়ের অবস্থার কথা বলতে নিয়ে কতবার শিউরে উঠেছে তার ইয়াত্তা নেই। যদিও তিহান অনূভুতি শূন্য হয়ে শুনছিলো তখন।
এক মাত্র বোনের দুর্দশার কথা শুনে তিহান চুপচাপ থাকলেও মাহাবুব ইসলাম জানেন ছেলে ভেতরে ভেতরে ফেটে পড়ছেন। তিনি ভয় পাচ্ছেন, না জানি ছেলে আবার কোন কান্ড বাঁধিয়ে বসে।
_____
হকিস্টিক হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে তিহান। উঠোনে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে রজব। ব্যথায় চোখ মুখ খিচে চিৎকার করছে। রাগে তিহানে গা থরথর করে কাঁপছে। নিজেকে যথেষ্ট সংযত রাখার চেষ্টা করেও ব্যর্থ সে। এতো বছরের সফল ক্যারিয়ারে দাগ লাগার বিন্দু পরিমাণ ভয় করলো না। মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে রজবকে খু*ন করে ফেললে সব সমাধান হয়ে যেতো।
সোহাগী আর জমিলা ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। হুট করে একজন বাড়িতে ঢুকে বাড়ির ছেলেকে টেনে হিচড়ে বের করে এইভাবে পে*টা*চ্ছে,ব্যাপারটা সত্যিই ভয় পাওয়ার মত। সোহাগী আর জমিলা প্রথমে ভেবেছিলো ঋন পরিশোধ করার জন্য ব্যাংক থেকে কোনো লোক এসেছে। কিন্তু এইভাবে রজবকে মা*রছে দেখে তাদের ধারণা বদলে গেলো। পরক্ষনে দেখলো লোকটা প্রতি মারের সাথে তৃধার নাম নিচ্ছে তখন দুজনের হুঁশ ফেরে। তারা বুঝতে পারে লোকটা আর কেউ নয় বরং তৃধার ভাই। সিফাত ভয়ে তার মায়ের আঁচল তলে মুখ লুকিয়ে কাঁদছে। ফাতেমা খাতুন দৌড়ে গিয়ে তিহানের সামনে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে অনুনয়ের সুরে বলল,,” বাপ ছেলেটারে আর মা*রিস না। আর মা*র*লে ম*রে যাবে।”
তিহান ঠোঁট কামড়ে নিজেকে ধাতস্থ করে বললো,,” আপনি এর মত লোকের চিন্তা করছেন? এইদিকে আমার বোনটা আছে নাকি ম*রে গেছে সেই খবর নেই। আমার বোনটা কোথাও নেই। তিহার রেগে হকিস্টিক দিয়ে রজবের পায়ে আ*ঘা*ত করতে করতে চিৎকার করে বলে উঠলো,,” আমার ফুলের মত বোনকে বের করে দিয়েছিস? যখন বেরই করে দিবি , তখন বিয়ে করলি কেন? তোর বিয়ে করার শখ ছুটাচ্ছি। তোর মত জা*নো*য়া*রের বেঁ*চে থাকার অধিকার নেই।”
তিহানের কথা শুনে ফাতেমা খাতুন সহ সোহাগী, জমিলা সবাই হতবিহব্বল হয়ে পড়লো। “তৃধা কোথাও নেই” ব্যাপারটা যেন হজম হচ্ছে না।
ফাতেমা খাতুন তিহানের হাত ধরে কেঁদে উঠে বললো,, তৃধা নেই মানে? কি বলছো এইসব? কোথায় গেছে?
তিহান বড়ই শক্ত পোক্ত মানুষ। সে ভাংবে তবুও মচকাবে না এমন ব্যাক্তিত্ব তার। কান্না শব্দটার সাথে তেমন পরিচিত না হলেও আজ যেন বাঁধ ভেঙে চোখ ভিজে উঠছে । কম্পায়মান বুকে হাত রেখে নিজেকে শান্ত করার তীব্র প্রচেষ্টা যেন ব্যর্থ হলো। চোখ ভিজে উঠলেও কন্ঠে কাঠিন্য ভাব রেখে বললো,, ‘এই বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার পর তৃধা বাড়ি ফেরেনি। আছে নাকি ম*রে গেছে সেটা আদৌ জানি না।’
তিহানের কথায় জমিলা চোখের পানি ছেড়ে দিলো। সোহাগী হাত মুঠ করে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করেও পেরে উঠলো না। ডুকরে ডুকরে কাঁদতে শুরু করল। তিহানের কথায় ফাতেমা খাতুনের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। তিনি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। এমন অনর্থ হওয়ার কথা ছিলো না।
রজবের হুঁশ নেই। দুদিন ধরে খাওয়া দাওয়ার ঠিক নেই এর মধ্যে এতো আ*ঘা*তের কারণে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। তিহান আলগোছে চোখ মুছে জমিলা আর সোহাগীর দিকে তাকিয়ে বলল,, জ্ঞান ফিরলে বলে দিবেন আমি আবার আসবো। যদি জানতে পারি আমার বোনের কোনো ক্ষ*তি হয়েছে, সেইদিন এই উঠোনের মাঝে আমি নিজ হাতে ক*বর* খুড়বো। খোদার কসম আমি সত্যি একে মে*রে ক*ব*র দিয়ে যাবো। তিহান দাঁড়ালো না হনহনিয়ে হেঁটে বাইকে উঠে চলে গেলো।
এইদিকে খবর পেয়ে গ্ৰামের মানুষজন জড় হতে শুরু করলো। কেউ আফসোস করলেও বাকিরা নানা কথা শুনিয়ে যাচ্ছে।
রজব নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। ফাতেমা খাতুন রজবের অবস্থা দেখে মাথার পাশে বসে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পানি আনতে বললেন। সোহাগী, জমিলা যতই রেগে থাকুক না কেন , কখনো কারো মৃত্যু কামনা করে না। জমিলা পানির জন্য গেলে সোহাগী স্বামী আর দেবরকে ফোন করে আসতে বলে।
ফাতেমা খাতুন বিলাপ করে কাঁদছে । একদিকে রজব, যাকে সে নিজ ছেলের মত লালন পালন করছে ।অন্য দিকে তৃধা নিজ থেকে এসে মমতা কুড়িয়ে নিয়ে তাকে মা ডেকেছে। তিনি বুঝতে পারছেন না কি করবে। সন্তানের খারাপ কোনো মা চায়না। তেমনি ফাতেমা খাতুন চান না রজব কিংবা তৃধা কারো ক্ষতি হোক।
অন্যদিকে রাজিয়ার স্বামী শিমুল খবর পেয়ে তৎক্ষণাৎ গাড়িতে উঠে পড়ে। লোকটা খারাপ হলেও মনুষ্যত্ব বড় জিনিস। শিমুল মনুষ্যত্বের টানে ছুটছে।
_________
সাত সকালে সবার থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লো তমাল। নবনী তখনো পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে। তৃধা তার শ্বাশুড়ি ফরিদা হকের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে কিচেন সামলাতে ব্যস্ত। প্রথমে ফরিদা হক মানা করলেও পরে তৃধার জোরাজুরিতে রাজি হয়ে যান। সায়রা বানু এঁটো প্লেট বাটি পরিষ্কার করতে করতে মুচকি মুচকি হাসছে। সায়রার হাসির কারনটা ফরিদা হককের কাছে স্পষ্ট। তিনিও কাজের ফাঁকে ফাঁকে তৃপ্ত চোখে তাকিয়ে তৃধাকে দেখছেন । তার কাছে সবটাই স্বপ্ন মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে চোখ মেললে সব আগের মত হয়ে যাবে। যদি এইটা স্বপ্ন হয় তবে তিনি জেগে উঠতে চান না। লম্বা শ্বাস টেনে তৃধার হাত থেকে খুন্তি নিয়ে বললো,,’ আমি বুড়ো হলে তখন কিচেনটা তোর। এখন যা তো ,আর থাকতে হবে না। তোর বাবাকে আর নবনীকে ডেকে নিয়ে আয়। অনেক বেলা হয়ে যাচ্ছে।’
তৃধা বাবা শব্দটা শুনে প্রথমে থমকালেও পরক্ষনে ঠিকই মনে পড়ে বাবা কাকে বলছে। সময় কত দ্রুত বদলায়, যাদের এতো দিন আংকেল আন্টি বলে ডাকতো তাদের এখন আম্মু আর বাবা বলে ডাকতে হয়। ফরিদা হককের আদেশ অমান্য করলো না ,বরং টাওয়েলে হাত মুছে বেরিয়ে পড়লো।
*
*
নবনী বিরশ মুখে বসে আছে। ঘুম ভালো হয়নি তার। চোখের পাতা ভারী হয়ে আছে। ফরিদা হক মেয়ের দিকে তাকিয়ে বেজায় বিরক্ত। নবনীর মাথায় টোকা দিয়ে বললো,, পুরো রাত কি চোর পাহারা দিয়েছিস? রাতে ঘুমাসনি?
নাবীব শেখ মেয়ের পাতে পরোটা তুলে দিয়ে বললো,,” আগে খেয়ে নে । এর পর না হয় আবার ঘুমাবি।”
তৃধা মুচকি হেসে তাকিয়ে আছে। তার বাবাও ঠিক এমনটাই বলতো। বলতো ,,” আগে খেয়ে নে মা পরে নাহয় আবার ঘুম দিবি”। কথাটা শুনে তৃধা বেজায় রাগতো। কর্কশ গলায় বলতো,” ব্রেকফাস্টের পর ঘুম আসে না”। সেই সোনালী দিন গুলোর কথা ভেবে গভীর নিঃশ্বাস ফেললো। সব বাবারাই বোধহয় এমন হয়।মেয়েরা বাবার অতি আদরের সন্তান। মেয়েদের প্রতি বাবাদের স্নেহ প্রবল । বাবা ডাক শোনার পর থেকে মেয়েদের প্রতি বাবাদের একটা আলাদা দূর্বলতা তৈরী হয়। স্নেহ মায়া মমতায় জড়িয়ে রাখতে চান সব সময়। দুহাতের আঁজলে রেখে খুব যত্ন করে বড় করেন। পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন, মেয়ের খোঁজ নেওয়ার কথা ভুলে না। ছেলেদের ব্যাপারে বাবার স্নেহ হয় ভিন্ন ধরনের। ছেলেদের আদিখ্যেতা আবদার সবটাই যেন শাসন তলে চাপা পড়ে। আড়ালে, লোকচক্ষুর অন্তরালে, নিভৃতে খোঁজ খবর নিলেও সামনাসামনি সেটার দেখা মেলে না।
তৃধার মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকা নুসাইবের দৃষ্টি এড়ালো না। নিশ্চয়ই বাড়ির কথা ভাবছে তৃধা। নুসাইবের ভীষণ মায়া হলো। দুটো পরোটা তৃধার প্লেটে তুলে দিয়ে বললো,,’ শেষ করো।’
নুসাইবের কাজে কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও সবার দিকে তাকিয়ে পরক্ষণে নিজেকে সামলে নেয়। কেউ ব্যাপারটা বোধহয় খেয়াল করেনি। যে যার যার মত করে খাচ্ছে।
ব্যাপারটা ফরিদা হক, নাবীব শেখ দুজনেরই চোখে পড়ে। এমন একটা সময় তারাও পার করেছে ,এই সময়টা জিবনের সবচেয়ে সুন্দর আর মধুর সময়। এমন একটা সময় তারা অস্বস্তিতে পার না করুক এই জন্য দেখেও না দেখার মত করে খাচ্ছে।
ফরিদা নিরবতা ভেঙ্গে বললো,,’ নুসাইব,কোথাও যাওয়ার প্ল্যান আছে?’
নুসাইব বিভ্রান্ত চোখে তাকিয়ে বললো,,’ কোথাও বলতে?’
নাবীব শেখ বললো,,’ নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে। এখন সময় জিবনটা উপভোগ করার। তৃধাকে নিয়ে কোথাও যাও। গিয়ে ঘুরেটুরে আসো। আসার পর থেকে দূরে কোথাও যাওয়া হয়নি। মেয়েটাকে নিয়ে দুই চারদিন কোথায় গিয়ে ঘুরে আসো। মন ভালো হবে।
,,’ তোর বাবা ঠিক বলেছে। কাজের জন্য পুরো জিবন পড়ে আছে। কাজ পরেও করা যাবে। তোর বাবাকে দেখ , টাকা কামাই করতে করতে বয়স পেরিয়ে গেছে। এখন কোথাও যাওয়ার বয়সটাও নেই। তার সাথে সাথে আমিও ঘর বন্দী। ‘
নাবীব শেখের চোখ কপালে। এতো বড় মিথ্যা! তিনি অবিশ্বাস্য নজরে তাকিয়ে বলল,, ফরি তুমি এতো বড় কথা বললে? বিয়ের পর কোথাও নেইনি? সিলেট ঘুরিয়ে এনেছি। চট্রগ্রামের কোনো জায়গা বাদ নেই। রাজশাহী শহরটাও ঘুরা শেষ। তাও বলছো আমি তোমাকে ঘর বন্দী করে রেখেছি?
তৃধা নবনী তাকিয়ে আছে। ঘটনার রেশ কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছে বুঝা দায়। নুসাইব নিজের মত করে খাচ্ছে।
ফরিদা হক বললো,,” সিলেট নিয়েছিলে তখন নুসাইব পেটে। অসুস্থ অবস্থায় ঘুরতে নিয়ে গেছো। চট্টগ্রাম যখন গেছি তখন আমার নুসাইবের বয়স কেবল এক বছর। এরপর রাজশাহী যখন গেছি তখন নুসাইব আড়াই বছরের। আমি ছেলে সামলাবো নাকি ঘুরবো?
তৃধা নুসাইবের দিকে সরে বসে ফিসফিসিয়ে বললো,,” ওনাদের সুন্দর সময় নষ্ট করে দুনিয়াতে এসেছেন। আপনার জন্য আন্টির ঘুরতেও পারেনি।আপনিতো দেখছি মহা ঝামেলা।’
নুসাইব তৃধার কথা শুনে তৃধার মত করে ফিসফিসিয়ে বললো,,’ চিন্তা করে দেখো এই মহা ঝামেলাটাই তোমার কপালে জুটেছে। আর তুমি তার মাকে আন্টি ডাকছো।ভেরী ব্যাড তৃধা।’
বিষম খেলো তৃধা। নুসাইব থেকে এমন উত্তর আশা করেনি সে।
নাবীব শেখ কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,,’তখন কি আমি তোমার খেয়াল রাখিনি? ছেলেকে সামলাইনি? ফরি তুমি এইভাবে বলতে পারলে?
নবনী কপাল কুঁচকে বললো,, থামবে তোমরা? ভাইকে নিয়ে আলোচনা না করে তোমরা তোমাদের ইতিহাস খুলে বসেছো।
ফরিদা হক ,নাবীব শেখ দুজনেই শান্ত হয়ে বসলো।
নুসাইব দুজনকে উদ্দেশ্য করে বলল,,’এই সপ্তাহ কাজের চাপ বেশী। পরের সপ্তাহে যাবো চিন্তা করছি।
,’ তোর বাবাকে বল কাজ গুলো দেখতে। তুই কালকেই তৃধাকে নিয়ে বের হ। ‘
,’ বাবা সামলানোর মত হলে দেয়া যেতো। তবে হ্যাঁ কালকের দিনটা ফ্রি আছে। এখন একদিনে তো আর শহরের বাইরে যাওয়া যাবে না।’
নবনী হতাশ হলো। পড়ালেখা আর কাজ ছাড়া ভাইয়ের মাথা শূন্য। বউকে সময় দেওয়ার ব্যাপারে বুদ্ধি হাঁটুর নিচে। অন্য কেউ হলে দুঘন্টা সময় নিয়ে হলেও ফুচকা ডেটে যেতো । নবনী জোর দিয়ে বললো,,” শহরের বাইরে যাওয়ার দরকার নেই। কাল বরং ভাবীকে নিয়ে এই শহর ঘুরবে। পরের সপ্তাহে বাইরে যাওয়া যাবে। ঠিক বলেছি না আম্মু?”
ফরিদা হক মাথা নেড়ে বললো,’অবশ্যই। আমি আবার জল্লাদ শ্বাশুড়ি না যে বউকে আটকে রাখবো। নবনী তোকে তৈরি করে দিবে তৃধা। সন্ধ্যার আগে দুজনকে বাড়ির দরজায় যেন না দেখি।’
ফরিদা হককের কথায় তৃধা হাসলো। নুসাইব কথার ফাঁকে তৃধাকে একপলক দেখে নিলো।
নবনী মাথা নেড়ে বললো,, “ভাইয়া কালকে কোনো প্রকার কাজ রেখো না।”
নুসাইব ঘড়ি দেখে উঠে পড়লো।
নবনী, তৃধা আর সায়রা বানু তিনজন মিলে কিচেনে কাজ করছে। তৃধা রান্না করছে সায়রা বানু সব এগিয়ে দিচ্ছে, এইদিকে নবনী মনযোগ সহকারে তৃধার রান্না দেখছে। আজ দ্বিতীয়বার শখ করে কিছু শিখতে চাইছে। যদিও ব্যাপারটা ঘটেছে সমুদ্রের জন্য। সমুদ্র ভোজন রসিক।
ফরিদা হককের আজ ছুটি। সংসারিক কাজ থেকে ছুটি দিয়েছে তৃধা নবনী। নাবীব শেখ বই পাতা উল্টোপাল্টা করতে করতে বললো,, কি ব্যাপার? তোমার কাজ নেই?
,’ না , নেই। মেয়ে দুটো রান্না ঘরে ঢুকেছে। তৃধার উপর ভরসা করলেও নবনীর উপর একটুও ভরসা নেই। হাত পা কে*টে পু*ড়ে একাকার করবে। সাথে তৃধারও কাটবে। মনে আছে একবার শখ করেছিল? দুই সেলাই লেগেছে।’
,’ তুমি খামোখা চিন্তা করছো ফরি। তৃধা আছে সামলে নিবে। ক’দিন পর শ্বশুর বাড়ি যাবে । সেখানে তো রান্নাবান্না করতে হবে নাকি? শিখুক ,শেখা থাকলে উপকারে আসবে।’
,’ও বাড়ি নিয়ে চিন্তা নেই। সমুদ্রের মা যথেষ্ট ভালো। মেয়ে না পারলে শিখিয়ে পড়িয়ে নেওয়ার মত মন মানসিকতা তার আছে।’
,’তাহলে আর চিন্তা কি! বসে থাকো। ওরা ওদের মত কাজ করুক। আচ্ছা শোনো, চলো আমি আর তুমি ছাঁদ থেকে ঘুরে আসি। অনেক দিন হলো ওঠা হয় না। গাছ পালা গুলো আছে নাকি ম*রে গেছে কিজানে।’
,’ হুম চলো তাহলে। ডাক্তার বলেছে ন’ দশ মিনিট রোদে হাঁটতে ,এক কাজে দুই কাজ হবে।’
__________
বাড়ি পৌঁছানোর পর থেকে মায়ের হাত ধরে বসে আছে তিহান। মাহাবুব ইসলাম মা ছেলেকে একসাথে দেখে বেরিয়ে পড়লেন। মা ছেলের এমন অনেক কথা থাকে যা বাবারা জানে না। মেয়েদের প্রতি যেমন বাবাদের আলাদা টান থাকে, তেমনি ছেলেদের প্রতি মায়েদের আলাদা টান থাকে। মায়ের গচ্ছিত টাকা কিংবা আদর দুটোই পুত্র সন্তানের ভাগে পড়ে বেশি। তেমনি করে বাবার আদর,স্নেহ কিংবা গচ্ছিত অর্থ সবই কন্যা সন্তানের ভাগে পড়ে বেশি। মাহাবুব ইসলাম বাইরে বের হলেন।
মায়া জাহান হাত বাড়িয়ে ছেলে দু’গাল ছুঁয়ে বললো,’ এতো চিন্তা কিসের? একদম চিন্তা করবি না। মা ভালো আছি। ‘
তিহান মলিন হেসে মাকে জড়িয়ে ধরলো। মায়া জাহান ছেলের পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,’ তৃধার জন্য চিন্তা হচ্ছে? চিন্তা করিস না। মায়ের দোয়া বিফলে যায় না। দেখবি তোর বোন সুস্থ আছে ভালো আছে। বড্ডো বেশি অভিমানি মেয়েটা,দেখবি ঠিকই ফিরে আসছে। তাছাড়া তার ভাইতো আছেই , বোনকে ঠিকই খুঁজে বের করবে। ভেঙ্গে পড়লে চলবেনা বাবা। শক্ত হতে হবে। তুই ভেঙে পড়লে মায়ের কি হবে বল?’
মায়ের কথা শুনে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল মাকে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,,’ তোমার কিছু হবে না মা। চিন্তা করো না ,আমি তৃধাকে খুঁজে নিয়ে আসবো। আজকাল মানুষের খোঁজ করা কঠিন ব্যাপার নয়।’
মায়া জাহান ছেলের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,,’ মন খারাপ হলে আমার সাথে কথা বলবি। একা একা দম ধরে বসে থাকবি না। অনেক বেলা হয়েছে খেয়েছিস কিছু?’
তিহান গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বললো,’ এখনো খাইনি। খালা রেডি করছে । তুমি শুয়ে থাকো আমি যাচ্ছি। উঠবে না কিন্তু।’
,’ঠিক আছে , তাড়াতাড়ি যা ।’
রুম ছেড়ে বেরোয় তিহান। মা’কে চিন্তা মুক্ত রাখতে কথা গুলো বললেও করা এতো সহজ নয়। হারিয়ে যাওয়া মানুষের খোঁজ সহজ হলেও যে নিজ থেকে নিখোঁজ হয় তার খোঁজ করা বড় কঠিন। তাছাড়া তিহান জানে না তৃধা আদৌ বেঁচে আছি কিনা।
____________
পরদিন নাস্তা শেষ করে তৃধা নুসাইব বেরোয়। নবনী জোর পূর্বক তৃধাকে শাড়ি পড়িয়ে দিয়েছে। এতে নুসাইব ভেতরে ভেতরে বেজায় খুশি হলেও মুখে একটা শব্দও করলো না। কালো রঙের তাঁতের শাড়ির সাথে ম্যাচিং চুড়ি,ঝুমকো তে তৃধাকে বেশ লাগছে। নুসাইব একপলক তাকিয়ে বললো,,’ খোঁপায় ফুল নেই এই জন্য অপূর্ণ লাগছে।’
নুসাইবের কথায় তৃধা মন খারাপ করে বললো,, বাজে লাগছে তাইনা? আমি বলেও ছিলাম সাজবো না। নবনী জোর করে সাজালো।’
নুসাইব মুচকি হেসে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললো,’ মোটেও বাজে লাগছে না। খুব সুন্দর লাগছে। সামনে ফুলের দোকান আছে। ফুল কিনে নিবো। খোঁপায় গুঁজে দিলে একদম বউ বউ লাগবে।’
নুসাইবের কথায় কিছুটা লজ্জা পেলেও মৃধু হাসলো। এখন তৃধা বুঝতে পারে নুসাইব সম্পর্কটা স্বাভাবিক করতে চাইছে। আসলেই সম্পর্কটা আট দশটা সম্পর্কের মত হওয়া উচিত। তৃধা জানে অতীত ভুলে যাওয়া সহজ না হলেও মনে রাখাটা জরুরি নয়। অতীতে যে আছে সে তাকে ছাড়া ভালো আছে। তৃধা এখন নিজ থেকে চায় ভালো থাকতে। সেই ভালো থাকাটা নুসাইব নামক লোকটাকে ঘিরে হলে মন্দ হবে না।
নুসাইবের দিকে তাকিয়ে কথা গুলো ভাবছে তৃধা। নুসাইব বুঝতে পারে তৃধা তার দিকে তাকিয়ে আছে। ব্যাপারটা নুসাইবের কাছে কতটা আনন্দদায়ক সেটা বলে বুঝানো আদৌ সম্ভব নয়। নুসাইব সামনে চোখ টিকিয়ে রাখতে পারলো না। তৃধার চোখে চোখ রেখে বলল,’ মায়ায় পড়লে নাকি?’
তৃধা মৃদু হেসে বলল,’ কি মনে হয়?
নুসাইব ভাবুক হয়ে বললো,’ মনে হচ্ছে আমার উপর ধীরে ধীরে মায়া হচ্ছে তোমার।’
নুসাইবের কথা আর কথার ধরনে শব্দ করে হাসলো তৃধা। অতঃপর বলে উঠলো,’পড়লেও গুনাহ নেই। ব্যাক্তিগত মানুষের মায়ায় পড়াই যায়।
চলবে,,,
উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ৪০
,
,
,
,
,
,
,
,
তৃধার বলা কথাটা শোনার পর থেকে নুসাইবের চেহারা থেকে হাসি যেন সরছেই না। মনে হচ্ছে তার থেকে সুখি এই ভুবনে কেউ নেই।
নুসাইব তৃধাকে নিয়ে ঘুরা ঘুরি বাদ দিয়ে শপিংমলে ঢুকলো । তা দেখে তৃধা বেজায় বিরক্ত। তৃধার মতে এই লোকটা টাকা উড়ানো ছাড়া কিছুই পারে না। নুসাইব তৃধার কপাল কুঁচকানো দেখে বললো,,’ বিরক্ত লাগছে?’
তৃধা মাথা নেড়ে বললো,’ আপনি শপিং করার জন্যে এসেছেন?’
,’ না। প্রয়োজনীয় একটা জিনিস কেনা বাকি ছিলো। কেনা হলেই বের হবো।’
প্রয়োজন শুনে তৃধা আর কথা বাড়ালো না। নুসাইবের পেছন পেছন হাঁটছে আর চারদিকে তাকিয়ে দেখছে। একটা সময় এই জায়গাটা তার ভীষণ প্রিয় ছিলো। হাতে সময় পেলেই চলে আসতো এইখানে। ফুড জোন থেকে শুরু করে লাইব্রেরী পর্যন্ত জায়গাটায় কতবার হেঁটেছে তার ইয়াত্তা নেই।
নুসাইব পেছন ফিরে তৃধাকে দেখলো। তৃধা আপন মনে হেঁটে হেঁটে চারপাশ দেখছে। তার থেকে বড় কথা এমন অনেকেই আছে যারা তৃধাকে দেখছে। নুসাইব আজ বুঝতে পারছে গোটা বাংলাদেশের মানুষ কেন বলে ‘শাড়িতেই নারী’। শাড়ি নারীর সৌন্দর্য বর্ধন করে। শাড়ি নিয়ে এতো এতো উক্তি শুনে নুসাইব প্রচন্ড বিরক্ত হলেও আজ মনে হচ্ছে ওই উক্তি গুলো আসলেই বাস্তব। শাড়িতে একটা মেয়েকে কতটা আকর্ষণীয়, কতটা মায়াবী লাগে সেটা হয়তো মেয়েরা জানে না। নুসাইব চারপাশে তাকিয়ে বেজায় বিরক্ত হলো। আশ্চর্য ! সবাই আমার বউটাকেই কেন দেখছে। মনে মনে বলে তৃধার হাত চেপে ধরে বলল,, ‘এতো আস্তে কেউ হাঁটে? আমি না দেখলে নিশ্চিত হারিয়ে যেতে।’
তৃধা বুঝতে পারছেনা এইখানে হারিয়ে যাওয়ার কি আছে?এইটাতো মেলা নয় যে খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে। নুসাইবের ধরে রাখা হাতের দিকে তাকিয়ে শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেললো তৃধা। মনে হচ্ছে স্কুল পড়ুয়া বাচ্চাকে রাস্তা পার করানোর জন্য নিচ্ছে।
ফোনের শোরুমে দাঁড়িয়ে আছে নুসাইব। বিচক্ষণতার সাথে দুইটা মোবাইলের ফিচার গুলো চেক করে দেখছে। তৃধা নুসাইবের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। একটা মোবাইল ফোন আছে আরেকটার কি দরকার সেটা তৃধার মাথায় ধরলো না। মানুষ একটা চালিয়ে কুল পায়না দুটো দিয়ে কি করবে?
,’স্যার এর মধ্যে দুটো কালার আছে। ব্লাক এন্ড সিলভার।’
নুসাইব দুটো ফোন হাতে নিয়ে তৃধার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,,’ কোনটা পছন্দ?’
তৃধা বিভ্রান্ত চোখে তাকিয়ে আছে।
নুসাইব নিজের মোবাইল ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল,,’ সিলভারটা দিন।’
সেলসম্যান কৌতুহল দমিয়ে রাখতে না পেরে জিজ্ঞেস করল,,’ ম্যাম কি আপনার গার্লফ্রেন্ড?’
সেলসম্যানের প্রশ্নে তৃধার দিকে তাকালো নুসাইব।
সেলসম্যান অপরাধবোধ নিয়ে বললো,, সরি স্যার।
নুসাইব মুচকি হেসে বলল,,’ ইটস্ ওকে। বাট আপনার ম্যাম আমার গার্লফ্রেন্ডের মত ওয়াইফ।’
নুসাইবের কথা শুনে তৃধা বিস্ময় নিয়ে তাকলেও,সেলসম্যান মুচকি হেসে বলল,’ শুভকামনা স্যার।’
মোবাইল ফোন কেনার পর বেরিয়ে এলো দুজন। তৃধা আড়চোখে তাকিয়ে সুধোয়,’ গার্লফ্রেন্ডের মত ওয়াইফ কেমন হয়?’
নুসাইব মুচকি হাসলো। পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আলগোছে তৃধার হাত ধরে বললো,,’ এমন হয়। ঠিক তোমার মত।’
তৃধা মাথা নোয়ালো। হুটহাট কথার তোপে ফেলছে নুসাইব। একটা সামলে উঠতে না উঠতেই আরেকটা। তৃধাকে লজ্জা পেতে দেখে নুসাইব মুখ টিপে হাসছে।
ফুলের দোকানে দাঁড়িয়ে আছে দুজন। নুসাইব দুরকমের ফুল নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ে গেছে।
বেলী নাকি গোলাপ কোনটা নিবে সেটা নিয়েই বিপাকে পড়ে গেছে।
তৃধার কথা বলার সুযোগ নেই। তাকে দোকানে পেতে রাখা কাঠের বেঞ্চিতে বসিয়ে রাখা হয়েছে। তৃধা কপালে ভাঁজ ফেলে তাকিয়ে আছে।
নুসাইব বেশ কিছুক্ষণ গবেষণা করার পর বললো,,”শোনো তৃধা , বিয়ের একবছর গোলাপ নিবো। লাল গোলাপ বউ বউ লাগবে। বেলী ফুল হাতে পরার জন্য নেওয়া গেলেও প্রথম একবছরের জন্য গোলাপ খোঁপায় গুঁজবে। এরপর বেলী ফুল নিবো। বাচ্চাকাচ্চা সামলাতে গেলে গোলাপ ফুল খোঁপায় টিকবে না। তখন বেলী ফুল একমাত্র ভরসা।
নুসাইবের কথায় ফুল দোকানী গোলাপের মালা গাঁথতে গাঁথতে মুখ টিপে হাসছে। তৃধা লজ্জায় ম*র ম*র অবস্থা। নুসাইবের কথার চাইতে দোকানদারকে লুকিয়েচুরিয়ে হাসতে দেখে লজ্জা লাগছে বেশি। তৃধা বুঝে পায় না এতো গম্ভীর ভদ্র ছেলেটা হঠাৎ এমন ঠোঁটকাটা হলো কখন? তৃধা পারলে এক্ষুনি হাওয়ায় মিলিয়ে যেতো।
নুসাইবের এইসবে কিছু যায় আসেনা। সে বেছে বেছে সবচেয়ে তাজা বেলী ফুলের মালাটা নিয়ে তৃধার সমীপে বসলো। মালাটা হাতে পরিয়ে দিতে দিতে তৃধার চেহারার আদলে তাকিয়ে বলল,, তোমার গাল লাল কেন? গরম লাগছে?
তৃধা দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠে,,’ উঁহু! সরম লাগছে। বলার আগে চারপাশ দেখে নিবেন না? দোকানদারকে দেখুন, দুপাটি দাঁত বের করে রেখেছে। নিশ্চয়ই আপনাকে পা*গল ভাবছে!
নুসাইব ভ্রু কুঁচকে দোকানদারের দিকে তাকিয়ে বলল,,”অদ্ভুত ! ওরতো শিখতে হবে এইগুলো। দেখো ভালো করে ওর বিয়ের বয়স ঘনিয়ে এসেছে। হতে পারে বিয়ে করে দুই চারটা ছেলে মেয়েও আছে। এখনকার জেনারেশন অনেক এগিয়ে। আমার মত জিবন যুদ্ধে পিছিয়ে নেই।”
তৃধা হতভম্ব হয়ে গেছে নুসাইবের কথায়। তৃধা তৎক্ষণাৎ হাত বাড়িয়ে নুসাইবের কপাল চেক করে বললো,’ নাহ জ্বর নেই। তাহলে এমন লাগামহীন এলোমেলো কথা বলছেন কেন? তমাল ভাই যাওয়ার সময় ঠোঁট কাঁটা স্বভাবটা আপনাকে দিয়ে গেলো নাতো?’
নুসাইব উঠে দাঁড়ালো। দোকানদারকে এক পলক দেখে বললো,, নিতান্তই স্বভাবিক কথা তাও যদি লাগামহীন মনে হয় তবে সেটা জেনেটিক্যালি পেয়েছি। বউ ছিলো না দেখে এতো দিন লুকিয়ে রেখেছিলাম।
দোকানী গোলাপের মালাটা নুসাইবের হাতে দিয়ে বললো,, আর কিছু লাগবে?
নুসাইব তৃধাকে জিজ্ঞেস করলো,,’ তোমার কিছু লাগবে?’
,,” না।”
,’ লাগবে না। আপনি বরং টাকাটা রাখুন।’
দোকানী টাকা নিয়ে যেতেই নুসাইব তৃধার খোঁপায় গোলাপের মালাটা মুড়িয়ে দিয়ে বলল,,’ চেক করতো হয়েছে কি না।’
তৃধা মুচকি হেসে খোঁপায় মোড়ানো মালাটা ধরে বললো,,’ এতো ভালোবাসা ভালো নয় নুসাইব সাহেব। পরে বদলে গেলে কষ্ট হয়। জানেন?সব চেয়ে সুখের মূহূর্ত গুলোই পরে কষ্টের কারণ হয়।’
তৃধার কথা শুনে নুসাইব কোমলমতি গলায় বলল,’আমি আমার বাবার মতো তৃধা। বদলে গিয়ে গায়ের চামড়া ঝুলে যাবে, চোখে ছানি পড়বে , সোজা থেকে কুঁজো হয়ে লাঠি ভর দিবো তাও তোমাকে কষ্ট দেওয়ার মত বদলাবো না। ভরসা রাখো। ‘
নুসাইবের আদুরে কথায় তৃধা মুচকি হেসে বললো,,’ মায়ায় ফেলছেন? বড্ড চালাক আপনি। মন গলানোর সব কায়দা কানুন ঠিকই জানেন দেখছি।’
এই প্রথম তৃধার কথায় লজ্জা পেলো নুসাইব। মাথা চুলকে অন্য দিকে তাকিয়ে হাসলো।
*
*
তৃধাকে নিয়ে শহর ভ্রমনে নেমেছে নুসাইব। রুমেলকে দিয়ে গাড়ি পাঠিয়ে হুড খোলা রিকশায় ঘুরে বেড়াচ্ছে দুজন। দুজন দুজনের চেনা পরিচিত জায়গা নিয়ে গল্প করছে বেশ। মাঝে মাঝে রিকশা থামিয়ে নেমে পড়ছে আবার । রাস্তার পাশে খাবারের দোকান থেকে ভেলপুরি ফুচকা খাওয়ার কম্পিটিশনটাও বাদ যায়নি। তৃধা নুসাইবকে দেখে বুঝার উপায় নেই তাদের সম্পর্কটা কেমন। মনে হচ্ছে শহর জুড়ে এক জোড়া সুখ পাখি ঘুরে বেড়াচ্ছে।
_________
রজবকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সফিক আর রফিক মিলে হসপিটালে এনেছে। খবর শুনে সাফিয়া খাতুন আর রাজিয়া হসপিটালে এসেছে। সাফিয়া খাতুন শক্ত হয়ে বসে আছে। রাজিয়া মুখে ওড়না চেপে কাঁদছে। মাকে অনূভুতি শূন্য হয়ে বসে থাকতে দেখে রাজিয়া একটুও অবাক হলো না। রজবের অবস্থা দেখে সাফিয়া খাতুন কাঁদলেও তৃধার কথা শুনে ছেলের শোক ভুলে বসেছেন। রজব যেমন তার নিজের সন্তান,তৃধাও তেমন তার মায়ের সন্তান। রজব বেঁচে আছে কিন্তু তৃধা বেঁচে আছে কিনা ম*রে গেছে সেই খবর আদৌ কেউ জানে না। ছেলের ব্যথায় মা ব্যথিত হলেও মেয়েটার মায়ের কথা ভেবে সেই কষ্ট ব্যাথা সবই যেন গায়ের হয়ে গেছে। তার ছেলেটা তো চোখের সামনে আছে। মায়ের মনকে বুঝ দেওয়া যাবে। কিন্তু তৃধার মা নিজের মনকে কি দিয়ে বুঝাবে? সাফিয়া খাতুন যতবার কথাটা ভাবছেন ততবারই তার বুকটা কেঁপে উঠছে। মায়ের মন একজন মা ছাড়া কেউ বুঝে না।
শিমুল হসপিটালে ঢুকে বউ আর শ্বাশুড়িকে দেখে এগিয়ে গেলো। রাজিয়া কাঁদতে কাঁদতে সবটা বলছে। শিমুল সব শোনার পর রাজিয়ার পাশে বসে বললো,, ‘রাজিয়া, তৃধা ভাবীর কিছু হয়নি। বরং বেঁচে আছে, ভালো আছে, সুখে আছে।’
শিমুলের কথা শুনে এগিয়ে এলো সাফিয়া খাতুন। রাজিয়া হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বললো,’ বেঁচে আছে? কোথায় আছে? তুমি কিভাবে জানলে?’
সাফিয়া খাতুন জানার জন্য আগ্ৰহ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
শিমুল সেই দিনের ঘটে যাওয়া পুরো ঘটনা খুলে বললো।
রাজিয়া আর সাফিয়া খাতুন সব শুনে অবাক হলেও দুজনই মনে মনে বেশ খুশি।
শিমুল বললো,,’ আমি ভেবেছিলাম ওনার মা-বাবা হয়তো ওনাকে আবার বিয়ে দিয়েছে। তাই কিছু জিজ্ঞেস করিনি। তাছাড়া জিজ্ঞেস করার মত সম্পর্কটাও ছিলোনা। উনি ভালো আছে এইটা দেখেই খুশি হয়ে যাই।’
সাফিয়া খাতুন বলল,’ ভালো করেছো। মেয়েটা একটু সুখ দেখুক। ওর মত মেয়ের কপালে আরো আগেই সুখ লেখা থাকার কথা ছিলো। সুখে থাকুক মেয়েটা।’
রাজিয়া নিরব হয়ে গেল। তৃধার সাথে আর কখনো দেখা হবেনা ভাবতেই বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে। যেখানে থাকুক,ভালো থাকুক।
_________
ভর দুপুর
গ্রীষ্মের দাবদাহে অতিষ্ঠ শহর।
রিকশা থেকে নেমে রেস্টুরেন্টে ঢুকলো দুজন। লাঞ্চের জন্য এই রেস্টুরেন্টটাই বেষ্ট। তাইতো একঘন্টা জ্যাম সহ্য করে তৃধাকে নিয়ে এইখানে এসেছে।নুসাইবের শার্ট ঘামে ভিজে গেছে প্রায়। তৃধা শাড়ির আঁচলে কপাল মুছতে মুছতে বললো,, ‘পেটে জায়গা নেই। খামোখা এসেছেন, শুধু শুধু খাবার, টাকা সব নষ্ট হবে।
নুসাইব সোফায় পিঠ ঠেকিয়ে বললো,,” ঝাল ঝাল ফুচকা, ভেলপুরি, ঝালমুড়ি খাওয়ার জন্য তোমাদের মেয়েদের আলাদা পেট আছে নাকি? ওইসব খাওয়ার সময় তো ঠিকই জায়গা থাকে। ভালো কিছু খেতে বললেই যতসব জায়গার অভাব পড়ে।সব বাদ দিয়ে লাঞ্চ শেষ করবে। টাকা গেলে যাক।’
তৃধা হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বললো,’ ওইগুলো তো মনে যায় পেটে না। পেট তো একটাই।’
নুসাইব হেঁসে উঠল। বললো,’ নবনী আর তুমি দুটোই একরকম। তুমি বসো আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।’
নুসাইব উঠবে এমন সময় মোবাইল ফোন বেজে উঠল।নুসাইব মুচকি হেসে ফোন রিসিভ করে অপর প্রান্তের ব্যক্তিকে বলে উঠলো,,’ বাইক নিয়ে বের হ। একসাথে লাঞ্চ হবে। সাথে আমার ওয়াইফের সাথেও দেখা হয়ে যাবে।’
তিহান ক্লান্ত গলায় বলল,” নিউলি ম্যারেড কাপলের ফাস্ট ডেট নষ্ট করার নিয়ত নেই। অন্যদিন দেখা হবে। একটা দরকারে কল দিয়েছি। ফ্রি হলে কল দিস।’
নুসাইব নাছোড়বান্দা সে বললো,’ সেটা হচ্ছে না। এখন ফ্রি আছি। দরকারি কথা আর লাঞ্চ শেষ হলে এমনিতেই তোকে বাড়ি পাঠিয়ে দিবো। আমি আবার কাবাবে হাড্ডি পছন্দ করি না। দশ মিনিট সময় দিলাম পাঁচ মিনিটে আয়। ঠিকানা আগেরটাই। আল্লাহ হাফেজ।’ তিহানকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে কেটে দিলো।
তিহান জানে নুসাইব নাছোড়বান্দা।তাই আর না করলো না। বাইকের চাবি আর ছোট একটা গিফ্ট বক্স নিয়ে চেনা পরিচিত জায়গাটার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো।
তৃধা বোকার মত তাকিয়ে আছে।
নুসাইব মোবাইল তৃধার হাতে দিয়ে বললো,, মোবাইল দেখো। আমি রেষ্টরুমে যাচ্ছি।
চলবে,,