উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ৪৩
,
,
,
,
,
,
,
,
বাগানে হেঁটে হেঁটে তিহানের সাথে কথা বলছে নুসাইব। আজ তিহান নুসাইবের চাইতে নুসাইবের পরিবারের খবর নিচ্ছে বেশি। নুসাইব একপর্যায়ে বলে উঠলো,,”তোকে কিছু কথা জানানোর ছিলো তিহান।”
নুসাইবের কথায় তিহান থমথমে খেয়ে বললো,,” কি কথা?”
নুসাইব লম্বা শ্বাস টেনে বললো,,” আমার ওয়াইফ তৃধাকে নিয়ে। তৃধাকে নিয়ে এমন অনেক কথা আছে যা তোর অজানা।”
তিহান চুপ করে আছে। বুকের ভেতরটা কেমন অস্থির লাগছে।
তিহানের উত্তরের আশা না করে নুসাইব এক এক করে সব ঘটনা বলতে শুরু করল। তিহান নিঃশব্দে মোবাইল ফোন কানে চেপে রেখেছে। চোখ জোড়া বার বার ভিজে উঠছে।কোনরকম চোখ মুছে নিজেকে সামলে নিচ্ছে।
। তৃধার বিয়ের শুরু থেকে শেষের একেকটা ঘটনা শুনে শিউরে উঠছে তিহান। আফসোস, আক্ষেপ, অনূসূচনায় বুকটা জর্জরিত। রাগ অভিমান রেখে বোনের খোঁজ নিলে বোধহয় বোনটা এতো কষ্ট পেতো না।
সব শেষে নুসাইব বলে উঠলো,,” অপরাধবোধ এর কারণে ইচ্ছা থাকার সত্বেও নিজের পরিবারের কাছে যেতে পারছে না। আমাকেও কিছু বলছে না।জানিস খুব খারাপ লাগে যখন দেখি সে তার পরিবারের জন্য মন খারাপ করে থাকে, কষ্ট পায়। যদি কোনো দৈবিক ক্ষমতা থাকতো আমি নিজে তৃধার পরিবারটাকে নিয়ে আসতাম। কিন্তু কি করব বল তৃধার কথা ছাড়া কিছুই করা যাচ্ছে না”
তিহান মোবাইল ফোন দূরে সরিয়ে চোখ মুছে বলল,,”বুঝলাম। কিন্তু আজ হঠাৎ এইসব আমাকে বলছিস? এতো দিন তো বলিসনি। ”
,,” সঠিক সময়ের জন্য বলা হয়নি। আজকের দিনটা উপযুক্ত মনে হয়েছে এইজন্য বললাম।”
তিহান ছোট করে উত্তর দিলো,’ ওহ্ আচ্ছা।’
,,”ওহ্ আচ্ছা বলে কাজ হবে না। বাড়িতে আছিস ,ফ্রী আছিস ,কাজ নেই সুতরাং কাল সকালে আন্টি আংকেলকে নিয়ে চলে আয়। এরপর আমি বিজি হয়ে যাবো।”
নুসাইবের কথায় তিহানের চোখ জোড়া চকচক করে উঠলো। মনে হচ্ছে মেঘ না চাইতে বৃষ্টি।তিহান ব্যতিব্যস্ত গলায় বলল,,”ঠিক আছে সমস্যা নেই মা-বাবার সাথে কথা বলে দেখছি।”
,,” দেখছি বলে কোনো কথা নেই। কাল আসতেই হবে। মা অনেক খুশি হবে।”
,,”ঠিক আছে।”
তিহান চোখ মুখ মুছে উঠে দাঁড়ায়। খবরটা মা-বাবাকে জানাতে হবে।
মধ্যরাত হলেও মায়া জাহান আর মাহবুব ইসলাম এখনো ঘুমায়নি। দুজন মিলে পুরোনো এলবাম দেখছে। তিহান তৃধার ছোটবেলার ছবি। মায়া জাহান তৃধার ছবিতে হাত বুলিয়ে বললো,,”দেখনা মেয়েটা কতটুকু ছিলো,আর এখন কত বড় হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে এইতো সেই দিনের কথা। সময় কত দ্রুত চলে যায়।
মাহাবুব ইসলাম তৃধার ফোকলা দাঁতের ছবিতে আঙ্গুল ছুঁয়ে বললো,,” ছবিটা দেখো। মনে আছে, পাজি মেয়েটা চকলেট খেয়ে দাঁত গুলোর কি হাল করেছিল?”
,,” হ্যাঁ মনে আছে। তাও তো তুমি প্রতিদিন চকলেট নিয়ে আসতে। সব দোষ তোমার ছিল। এরপর ওর তিহানের।”
মাহাবুব ইসলাম গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বললো,,” এতো আদর, এতো স্নেহের মেয়ে আমার। কত বছর দেখিনা বলো!
কথার মাঝে তিহান দরজায় কড়া নাড়ে। মাহাবুব ইসলাম চশমা ঠিক করতে করতে বললো,, তিহান এসেছে।
মায়া জাহান ছবির এলবামটা বন্ধ করে বললো,,”তাড়াতাড়ি দরজা খোলো। হয়তো কোনো দরকার হবে।”
মাহাবুব ইসলাম দরজা খুলে দেখে তিহান দাঁড়িয়ে।
,,” কিরে বাবা?”
তিহান বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,,” বারোটা বাজে, এখনো ঘুমাওনি?”
মায়া জাহান ডেকে বলল,,” আয় বস।”
তিহান মায়ের সমীপে বসে বললো,,” নুসাইবের সাথে কথা হয়েছে একটু আগে। বলেছে কাল যেতে। তোমরা কি বলো!যাবে?”
মাহবুব সাহেব বললো,,” আমরা গেলে মেয়েটা অপ্রস্তুত হয়ে যাবে তিহান।যাওয়া উচিৎ হবে?”
,,” সমস্যা নেই। প্রয়োজনে বেশিক্ষণ থাকবো না। অন্তত মরার আগে মেয়েটাকে চোখের দেখা দেখে আসি।”
স্ত্রীর কথায় মাহাবুব ইসলাম নিজেও একমত কিন্তু এতো বছর পর মেয়েকে দেখে নিজেকে আটকে রাখতে পারবে কিনা সেটাই সন্দেহ।
অনেক ভেবে চিন্তে ঠিক করলেন একবার যাবে , গিয়ে দেখে আসবে।তাই বললেন,,” মেয়ের বাড়িতে যেতে হলে তো এমনি এমনি যাওয়া যায় না। একদিকে তিহানের বন্ধু অন্য দিকে মেয়ে জামাই। তাও আবার প্রথমবার ওই বাড়িতে যাবো। খালি হাতে যাওয়া যাবে না। অনেক কিছুই নিতে হবে। তিহান!
,,” জ্বী বাবা!”
,,” বাবার টেবিল থেকে খাতা কলম নিয়ে আয়। একটা লিস্ট করি।”
,,” তিহান মুচকি হেসে বলল,,” আনছি।”
মায়া জাহান এটা ওটা অনেক কিছুই মনে করিয়ে দিচ্ছেন। মাহাবুব ইসলাম লিখছে কম বিরক্ত হচ্ছে বেশি।
,,”আহ্ মায়া চুপ করো। আমাকে লিখতে দাও। সবতো একসাথে লেখা যায় না।”
,,” নতুন বেয়ানের বাড়িতে গেলে কি নিতে হয় সেটা মেয়েদের চেয়ে ভালো কেউ জানে না। আমি যা বলছি তা প্রথমে লিখ।”
,,”ওসব পরে ।আগে আমার মেয়েটার পছন্দের জিনিস নিতে হবে। তা না হলে মনে মনে ভাববে মা-বাবা পছন্দ ভুলে গেছে।”
দুজনের মিষ্টি বাকবিতন্ডা চলছে । তিহান ভেজা চোখে দেখছে দুজনকে। এই দৃশ্যর মত মুগ্ধ,তৃপ্তির দৃশ্য বোধহয় আর একটাও নেই।
________
রুমে আসতে আসতে প্রায় সাড়ে বারোটা। নুসাইব ভেবেছিল তৃধা বোধহয় ঘুমিয়েই পড়েছে। যদিও রুমে প্রবেশ করে দেখে তৃধা এখনো জেগে।
বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে তৃধা। মোবাইলের আলো জ্বালাচ্ছে নেভাচ্ছে। ভীষণ অন্যমনস্ক তৃধাকে দেখে নুসাইব আলতো হাতে দরজা আটকে বিছানায় বসে বললো,,” আমার কথা ভাবছো?”
তৃধা হকচকিয়ে পাশ ফিরে তাকালো।
নুসাইব অবাক হয়ে বললো,, “ওমাই গড তৃধা তুমি সত্যি আমার কথা ভাবছিলে?”
তৃধা ভ্রু কুঁচকে বললো,,” মোটেও না।”
নুসাইব হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বললো,,” এমন ভাবে ভাবনায় হারালে ,আমি ভাবলাম আরো আমার কথা ভাবছো।”
,,” ঘুম আসছে না। ঘুম আসার উপায় বলুন।”
,,”শুয়ে পড়ো লাইট অফ করে দিচ্ছি,চোখ বন্ধ করলেই ঘুম আসবে।”
নুসাইবের কথা শুনে তৃধা দাঁতে দাঁত চেপে বললো,,” ধন্যবাদ আপনি না বললে জানতামই না।”
নুসাইব কান ধরে ছোট ছোট চোখ করে বললো,,” সরি সরি মজা করছিলাম।”
তৃধা মুখ ঘুরিয়ে নিল। সেটা দেখে নুসাইব বললো,,” দুমিনিট ওয়েট করো আমি আসছি।”
নুসাইব রুম ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো। তৃধা ভারী নিঃশ্বাস ফেলে দরজার দিকে তাকালো। না জানি লোকটা আবার কি নিয়ে আসে।
নুসাইব হাওয়ার গতিতে গিয়ে হাওয়ার গতিতে ফিরে এলো। তৃধা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে।
নুসাইবের হাতে আইসক্রিম বক্স আর দুটো চামচ। তৃধা বুঝে পায় না ঘুমের সাথে আইসক্রিমের কি সম্পর্ক।
আইসক্রিম বক্স তৃধার হাতে দিয়ে বলল,, শুনলাম আইসক্রিম মনখারাপের টনিক। তোমার মন খারাপ তৃধা। এইজন্য ঘুম আসছে না।চলো দুজন আইসক্রিম খাই। এতেও যদি ঘুম না আসে তখন চুলে বিলি কেটে দিবো।
তৃধা বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে। নুসাইব বিরক্ত হয়ে বলল,,”এইভাবে তাকানোর কি আছে? তুমি আমার ওয়াইফ, চুলে বিলি কাঁটা পাপ নয়।”
তৃধা আইসক্রিম বক্স খুলতে খুলতে বলল,,”আমি কখন বললাম পাপ?”
তৃধার বলা কথাটা শুনে নুসাইব মুখ টিপে হাসলো। অতঃপর তৃধার পাশ ঘেঁষে বসে।
________
সকাল হতেই তোড়জোড় শুরু হয়ে গেলো। এর মধ্যে তিন্নি কল করে। ফরিদা হক রিসিভ করে হড়বড়িয়ে বললো,,” তোর সাথে আম্মু পরে কথা বলবো। বাড়িতে মেহমান আছে । অনেক কাজ বাকি মা।”
নবনী দৌড়ে দৌড়ে মায়ের ফাই-ফরমাস খাটছে। সায়রা বানু কুটা বাছা করছে। তৃধা ঘুম থেকে উঠে নিচে নেমে হা হয়ে গেছে। বুঝলো না বাড়িতে কি হচ্ছে।
ওড়না ঠিক করতে করতে কিচেনে গিয়ে দেখে এলাহী কান্ড। তৃধা চারপাশে তাকিয়ে বললো,,” এতো কিছু এক সাথে? কেউ আসছে আম্মু?”
ফরিদা হক চিংড়ি মাছ উল্টে দিতে দিতে বলল,,” নুসাইবের বন্ধু তিহান আর তার পরিবার আসবে। এই প্রথম আসছে বাড়িতে। তুই এক কাজ কর মা। এখনো কেউ নাস্তা করেনি। সবার জন্য নাস্তা গুলো টেবিলে নিয়ে যা। খুব ক্ষিদে পেয়েছে।”
এই মুহূর্তে তৃধার কেমন রিয়েক্ট করা উচিৎ তৃধা নিজেও জানে না। তৃধা থম ধরে দাঁড়িয়ে আছে। চোখের পলক ফেলার ব্যাপারটাও যেন ভুলে বসেছে। নবনী তৃধাকে ঝাঁকিয়ে বললো,,” তৃধা আপুউউ!”
তৃধা চমকে উঠে বললো,,” হ্যাঁহ্!”
,,”কোথায় হারালে? চলো রুটি ,ভাজি এইসব টেবিলে নিয়ে যাই।”
,,” ওহ্ হ্যাঁ চলো।”
তৃধার বুকটা ভীষণ কাঁপছে। হাত-পা ঠান্ডা অসাড় হয়ে আসছে। নুসাইব মোবাইল ফোন দেখতে দেখতে নেমে আসে।
ফরিদা হক সায়রা বানুকে ডেকে বললো,,” সায়রা আজ তো বস এইখানে! এক সাথে বসে নাস্তা করলে আমাদের জাত যাবে না। ম*রার পর তোকে যেখানে কবর দিবে আমাকেও সেখানে দিবে। আল্লাহ তখন ভেদাভেদ করবে না। পা*প করলে যেই ঝাটা দিয়ে তোকে পেটাবে সেই ঝাটা দিয়ে আমাকেও পেটাবে। বস টেবিলে।”
নবনী হেসে বলল,,”আম্মু ঠিক কথা বলেছে। বস আন্টি।”
মা মেয়ের কথা শোনার পর আর না করতে পারলো না। অবশেষে সায়রা বানু টেবিলে নাস্তা করতে বসেছে।
তৃধা হাত কাঁপার জন্য রুটি ছিঁড়ে মুখে দিতে পারছে না। নুসাইব তৃধার হাত ধরে ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললো,,” কি ব্যাপার? তোমার হাত এতো ঠান্ডা কেন?”
,,”এমনিতেই। কিছু হয়নি।”
নুসাইব তৃধার কপালে হাত ছুঁইয়ে তাপমাত্রা চেক করে বললো,,” বললেই হলো? হাত কাঁপছে তোমার।”
ফরিদা হক হড়বড়িয়ে উঠে তৃধার কপালে হাত রেখে বলল,,”জ্বর তো নেই। হঠাৎ এমন হচ্ছে কেন?”
নুসাইব তৃধার বাঁ হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,,” এতো ঠান্ডা কেন?”
নবনী খাওয়া ছেড়ে বললো,,” তোমার শীত লাগছে?”
সবার ব্যস্ততা দেখে তৃধা বললো,,” তেমন কিছুই না। এমনিতেই হাত পা ঠান্ডা।”
,,” আম্মু তৃধাকে খাইয়ে দাও। হাত কাঁপছে ওর।”
নুসাইবের কথায় ফরিদা হক তৃধাকে খাইয়ে দিতে দিতে বলল,,”খারাপ লাগলে বলবি। নিজের ভেতর চেপে রাখবি না। আমি তোর মা আগে শ্বাশুড়ি পরে। ঘরের বউ একদিন কিচেনে না ঢুকলে কোনো সমস্যা হবে না।”
তৃধা বাধ্য মেয়ের মত বসে বসে মাথা নাড়ছে।
নুসাইব খাচ্ছে কম তৃধাকে দেখছে বেশি। নবনী ভাইয়ের কুঁচকে থাকা কপালের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। এর আগে ভাইকে কারো জন্য এতোটা চিন্তিত দেখেনি সে।”
*
*
*
ঘড়ির কাটা বরাবর বারোটায়।
নাবীব শেখ ব্যস্ত পায়ে পায়চারি করছে। এর মধ্যে একটা গাড়ি এসে গেইটের সামনে থামলো। নাবীব শেখ ইশারা করতেই দারোয়ান গেইট খুলে দেয়।
নুসাইব পকেটে হাত গলিয়ে বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। তিহান বের হতেই জড়িয়ে ধরলো তাকে। মায়া জাহান গাড়ি থেকে বেরিয়ে চারপাশ দেখছে। নুসাইব মুচকি হেসে পা ধরে সালাম করে বললো,,”আসতে সমস্যা হয়নি তো?”
মায়া জাহান নুসাইবের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,,” না বাবা,কোনো সমস্যা হয়নি।”
মাহাবুব ইসলাম নাবীব শেখের সাথে কোলাকুলি করে কুশলাদি বিনিময় করেন। নুসাইব পা ধরে সালাম করে বললো,,” ভেতরে আসুন।”
তিহান বাড়ির ভেতর ঢুকলেও তার নজর বোনকে খুঁজতে ব্যস্ত। মায়া জাহান চারপাশে তাকিয়ে বললো,,” নুসাইব তোমার মা কই?”
,,” কিচেনে,আমি এক্ষুনি ডেকে আনছি।”
ফরিদা হক আর নবনী এসে তাদের সাথে কুশলাদি বিনিময় করলেও তৃধা কিচেনে দাঁড়িয়ে আছে।
সায়রা বানু তৃধার হাত থেকে প্লেট বাটি নিয়ে বললো,,” যাও মা। না গেলে কি মনে করবে বলো?”
মায়া জাহানের সাথে কথা বলেছেন ফরিদা হক। নবনী মায়ের পাশে বসে তাদের গল্প শুনছে। মাহবুব ইসলাম নাবীব শেখের সাথে কথা বললেও তিনি মেয়েকে দেখার জন্য তৃষ্ণার্ত চোখে তাকাচ্ছে বারবার।
ফরিদা হক নুসাইবকে ডেকে বললো,,” নুসাইব, তৃধা কই? যা ওকে নিয়ে আয়।”
সায়রা বানু চেষ্টা করেও তৃধাকে বের করতে পারলেন না। তৃধা নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। হাত জোড়া কাঁপছে অনবরত।
নুসাইব কিচেনের দরজার দাঁড়িয়ে তৃধার হাতের দিকে এক পলক তাকিয়ে আলগোছে তৃধার হাত ধরে বলল চল দেখা করবে।
তৃধা কাঁপা গলায় বলল,,” না গেলে হয় না?”
নুসাইব মুচকি হেসে বলল,,” তুমি ভীষণ বোকা তৃধা। তোমার জায়গায় আমি হলে আরো আগেই দৌড়ে বের হতাম। ডানে বামে না তাকিয়ে মা-বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তাম। তুমি আসলেই বোকা।”
নুসাইবের কথা শোনা মাত্র চমকে তাকালো তৃধা। চোখে মুখে হাজার প্রশ্ন তার।
নুসাইব তৃধার চোখে চোখ রেখে মৃদু হেসে বলল,,” আমি জানি তুমি কি জিজ্ঞেস করবে। যা জিজ্ঞেস করবে তার জন্য সম্পূর্ণ জীবন পড়ে আছে। কালকের মত আজকের সময়টাও মিস করো না। দৌড়ে যাও। তোমার মা-বাবা,ভাই তোমার অপেক্ষা করছে।
চলবে,,,
উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ৪৪(১ম খন্ড)
,
,
,
,
,
,
,
,
নুসাইবের কথা শুনেও নড়লো না তৃধা। সদ্য ভিজে ওঠা দুচোখ জোড়ায় বিষাদ স্পষ্ট। দ্বিধা সংকোচ নিয়ে তাকিয়ে আছে নুসাইবের দিকে। কি করবে ,না করবে ভেবেই খেই হারাচ্ছে।
নুসাইব তৃধার অবস্থা বুঝতে পারছে। তৃধার চোখ যেন তার সকল সমস্যা বলে দিচ্ছে নুসাইবকে। নুসাইব লম্বা শ্বাস টেনে বললো,,” যতটা কঠিন ভাবছো ততটা কঠিন নয়। তুমি কি ভেবেছো ওরা এমনি এমনি এই বাড়িতে এসেছে? তোমার ভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্ক বহু পুরোনো। এর মধ্যে বলেও তিহানকে এই বাড়ির চৌকাঠ পর্যন্ত আনতে পারিনি। তোমার মা-বাবা তো অনেক দুরের কথা। সেখানে কাল রাতে দুইবার বলেছি মাত্র,এর মধ্যে রাজিও হয়ে গেছে। যাকে একশত বার বলেও রাজি করানো যায় না , সে শুধু মাত্র তোমাকে মানে তার কলিজার টুকরো বোনকে এক পলক দেখার জন্য এসেছে।
তৃধা মাথা নিচু করে চোখের জল ফেলছে। নুসাইব আলগোছে চোখ মুছে দিতে দিতে বললো,,” আমার সাথে চলো। আমি নিয়ে যাবো তোমাকে। কেউ কিছু বলবে না। সবাই জানে ওরা তোমার পরিবার। ইভেন সায়রা আন্টিও জানে। তাইনা আন্টি?
সায়রা বানু পেছন ফিরে বললো,,” তৃধা মা আমরা সবাই কাল রাত থেকেই জানি।”
তৃধা শব্দে করে কেঁদে উঠতেই নুসাইব তৃধার দু গালে হাত রেখে বলল,,” হুস!! একদম কাঁদবে না। তোমাকে কাঁদতে দেখলে তোমার ভাই আমার মুখ বরাবর ঘুসি মারবে। মেজর সাহেবের ঘুসি বুঝতেই পারছো? প্লিজ কেঁদো না। চোখের পানি বাঁচিয়ে রেখে ভাইয়ের কাছে চলো। ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলো।’
তৃধা হেঁচকি তোলা গলায় বলল,,” হুউ!”
নুসাইব মুচকি হেসে তৃধার হাত শক্ত করে ধরে বললো,,” চলো যাওয়া যাক।”
ফরিদা হক মুচকি হেসে বলল,, “এইতো আমার বউমা আসছে ।”
মায়া জাহান আর মাহাবুব ইসলাম ফিরে তাকালো মেয়ের দিকে। দুজনের চোখেই নোনা জল ভিড় করেছে। মাহাবুব ইসলাম খুব সাবধানে চোখ মুছে নিলেও মায়া জাহান মেয়ের দিকে নিঃপলক তাকিয়ে আছে। তিহান বোনকে দেখে উঠে দাঁড়ালেও একপলক দেখে অন্যত্র ফিরে গেলো।
তৃধা মা-বাবা, ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে নুসাইবের হাত শক্ত করে ধরলো। তৃধার চোখ জোড়া আবারো টলমল করছে। তৃধা সামনে আসতেই নুসাইব গলা ঝেড়ে তিহানের পায়ে পাড়া দিয়ে বলল,,” আজ কথা না বললে এরপর আর সুযোগ দিবো না।”
তিহান ভেজা চোখে নুসাইবের দিকে তাকালেও তার বলা কথাটা বোধগম্য হলো না। তৃধা ভাইয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় ডাকলো,,” ভাইয়া!”
তৃধার ডাকে বিস্ময় নিয়ে তাকালো তিহান। মায়া জাহান, মাহাবুব ইসলাম তারা ভুত দেখার মত তাকাচ্ছে সবার দিকে। ফরিদা হক মুচকি হেসে বলল,,”আমার দ্বারা আর অভিনয় হচ্ছে না। মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে এসে মেয়ের সাথে কথা না বললে এমন বেয়াই বেয়ান আমার দরকার নেই। এমনিতেও আমি মেয়ে ফেরত দিচ্ছি না।”
নাবীব শেখ মাহাবুব ইসলামকে উদ্দেশ্য করে বললো,,” আরে ভাই আমরা এতোটাও খারাপ না। আমি হলে এতক্ষন সময় নিতাম না। মেয়ের সাথে কথা বলতে কিসের বাঁধা।
নুসাইব তিহানের পায়ে ধাক্কা দিয়ে বিরক্ত ভঙ্গিতে তাকাল।
তৃধা চোখের জল আটকে রাখতে অপারগ। ভাইয়ের হাত ধরে কান্নারত গলায় বলল,, “কথা বলবি না ভাইয়া?”
তিহান ঠোঁট কামড়ে কান্না চেপে রাখলেও বোনের পুরো মুখের আদলে চোখ বুলিয়ে তৎক্ষণাৎ জড়িয়ে ধরলো। দুই ভাই বোন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। নুসাইব মুচকি হেসে তাকিয়ে দেখছে দুজনকে। ছেলে মেয়ে দুটোকে একসাথে দেখে মায়া জাহান কাঁদছে। ফরিদা হক মায়া জাহানকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিতে দিতে বলল,,” আরে এতো কান্না কিসের? সব দুঃখ শেষ আজ। আর কান্নাকাটি নয়। মেয়ে, মেয়ে জামাই নিয়ে সোজা বাড়ি চলে যাবেন শেষ।”
মাহাবুব ইসলাম ভেজা চোখে ছেলেমেয়ে দুটোকে দেখছেন। এর মতো মনমুগ্ধকর দৃশ্য বোধহয় আর একটাও নেই। বিগত আড়াই বছরে এমন দৃশ্য কতবার যে স্বপ্ন দেখেছে তার হিসেব নেই। আজ মনে হয় সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপান্তরিত হয়েছে।
নবনী আর সায়রা বানু নিরব দর্শক। নবনী মোবাইলে ভিডিও রেকর্ড করে চলছে। তমাল পই পই করে বলেছে তাকে ভিডিও পাঠাতে। না পাঠালে চুল ছেঁড়ার জন্য সোজা চলে আসবে।
ভাই বোন দুটোর কেউই কান্না থামাতে রাজি নয়। তৃধা হাউমাউ করে কাঁদলেও তিহানের কান্না নিঃশব্দে। বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে কত চুমু আটছে তার হিসেব নেই। পারলে এই ছোট্ট পাখিটাকে বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখতো। এমন ভাবে লুকিয়ে রাখতো যাতে কেউ চাইলেও কষ্ট দিতে না পারে।
তৃধা তীব্র অপরাধবোধে ভুগছে। এতো কষ্ট দেওয়ার পরও ভাইয়ের স্নেহের কমতি নেই। ব্যাপারটাই যেন শেষ করছে তাকে।
নুসাইব দুইজনকে দেখে এতটুকু বুঝতে পেরেছে এদের ভাইবোনের কান্না আজকে আর থামার নয়। তাই গলা ঝেড়ে দুজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে বললো,,” দুজনের কান্না দেখে আমার নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছে। থামো এইবার।”
তিহান থামলেও তৃধার থামাথামি নেই। নুসাইব লম্বা শ্বাস টেনে বললো,,” থামো এইবার । বাবা মা আছে এখনো।”
তিহান বোনের চুল ঠিক করে দিতে দিতে বলল,,” আর কাঁদতে হবে না। চোখ ফুলে যাচ্ছে।”
তৃধা হেঁচকি তুলছে অনবরত। তিহান জানে বোন থামবে না। তৃধাকে মায়ের কাছে নিয়ে বললো,,”আর কাঁদিও না মা।দেখো কেমন গা কাঁপছে।”
মায়া জাহান চোখ মুছে মেয়ের সারা মুখে চুমু দিয়ে বলল,,”মোটেও কাঁদবি না। মা আছি এখন আর চিন্তা নেই।
তৃধা মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। মাকে জড়িয়ে ধরার অনুভুতি অপ্রকাশিতব্য। কোমল নরম মমতাময়ীর মমতার চাদরে নিজেকে যত জড়িয়ে নিতে ব্যস্ত তৃধা।
মায়া জাহান মেয়ের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,,” আগের সব কথা বাদ। অতীতের ছায়া বর্তমান, ভবিষ্যতে যেন না পড়ে মা। কোনো কিছু নিয়ে আফসোস করার দরকার নেই। মা সব ভুলে গেছি। মায়ের কিছু মনে নেই। আমার কাছে আমার মেয়ে সত্য,আর কিছুই না। ”
মায়া জাহানের কথায় মুগ্ধ সবাই।
মায়া জাহান মেয়ে থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে মাহাবুব ইসলামকে দেখিয়ে বললো,,” বাবার কাছে যা।”
মাহাবুব ইসলাম নিজের পাশে বসার জন্য মেয়েকে জায়গা করে দিলেন। তৃধা মাথা নিচু করে বাবার পাশে বসলেও বাবার দিকে তাকানোর সাহস তার নেই। মাহাবুব ইসলাম মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,,” বাবা একটুও রেগে নেই। বাবা তার ছোট মায়ের উপর বেশিক্ষণ রেগে থাকতেই পারে না।”
তৃধার চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। মাহাবুব ইসলাম মেয়ের চোখ মুছে দিয়ে বলল,,” মা-বাবা সন্তানের উপর বেশিক্ষণ রেগে থাকতে পারে না। সন্তান যত ভুল করুক না কেন, দিন শেষে মা-বাবার কাছে তাদের সন্তান আগে।”
তৃধা মুখ ফুঁপিয়ে কেঁদে বাবাকে শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরে বললো,,” সরি বাবা,সরি। ”
মাহাবুব ইসলাম মুচকি হেসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,,” ছিঃ ছিঃ সবাই দেখছে। কত বড় মেয়ে কাঁদছে। সবার সামনে আমার মাথা কাঁ*টা যাচ্ছে।”
মাহাবুব ইসলামের কথায় হাসছে সবাই। তৃধা নিজেও হেসে উঠলো।
__________
সাজানো টেবিলে বসে আছে সবাই। তৃধার চোখ মুখ থেকে হাঁসি যেন সরছেই না। সে বেশ খোশ মেজাজে সবাইকে নাস্তা এগিয়ে দিচ্ছে। ফরিদা হক,নাবীব শেখ, নবনী সবাই আপ্যায়নে ব্যস্ত । নুসাইব পকেটে হাত গলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একপাশে। তার দৃষ্টি জোড়া ব্যাক্তিগত রমনীর হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রীর আদলে আবদ্ধ। নুসাইব মুগ্ধ হচ্ছে তৃধাকে দেখে। হুট করে কেমন বদলে গেছে মেয়েটা। চেহারার আদলে থাকা বিষন্নতা কেটে স্নিগ্ধতায় ছেয়ে গেছে।
তিহান নুসাইবের দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখে , বেচারা তার বোনের দিকেই তাকিয়ে আছে। যদিও বড় ভাই হিসেবে এইসব নোটিস করা অশোভনীয়, তাও বন্ধুর এমন অধঃপতন দেখে এইসবে নজর দিতে বাধ্য। তিহান গলা খাঁকিয়ে বললো,,” নুসাইব ! ওইখানে কি করছিস? এই দিকে আয়।”
তিহানের গলা শুনে ধ্যান ভাঙল নুসাইবের। তৎক্ষণাৎ চোখ সরিয়ে তিহানের পাশে বসে। তৃধা সরবতের গ্লাস এগিয়ে দেয় নুসাইবের দিকে।
তিহান নুসাইবের পাশে সরে গিয়ে ফিসফিস করে বলল,,”তোর বউ এর বড় ভাই হিসেবে এইসব বলা উচিৎ না হলেও, ভাই হিসেবে বোনের খেয়াল রাখা আমার গুরু দায়িত্ব। সরি, বাট একটু আগে যেভাবে তাকাচ্ছিলি এতে আমার বোনের মুখে ন*জ*র লেগে ব্রণ গজাবে। তাছাড়া আমি তোর বউয়ের বড় ভাই হই,,্আমাদের আদর আপ্যায়ন না করে ওইখানে দাঁড়িয়েছিলি কেন? দায়িত্ব জ্ঞানহীন ছেলে একটা।”
তিহানের কথা শুনে নুসাইব হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না। বন্ধুর বোন বিয়ে করে বিপাকে পড়েছে। নুসাইব জোর পূর্বক মুচকি হেসে ছোট করে বললো,,” দুঃখিত বড় ভাইয়া। এর পরেরবার থেকে আপনার বোনের দিকে তাকানোর আগে ব্রন না গজানোর ক্রিম কিনে নিবো। তাছাড়া আপনার মত ইউস লেছ বড় ভাইকে আপ্যায়ন করার মত আমার মত দায়িত্ব জ্ঞানহীন বোনের জামাই অতটাও ফ্রী নয়।
তিহান বিস্ময় নিয়ে তাকালো। নুসাইব সেই দিক থেকে নজর সরিয়ে শ্বশুর শ্বাশুড়িকে নাস্তা এগিয়ে দিচ্ছে।
চলবে,,
উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ৪৪(২য় খন্ড)
,
,
,
,
,
,
,
,
দুপুর পেরিয়ে বিকেল, বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা হলো। ফরিদা হক সহ বাড়ির প্রত্যেকে তিহানদের থেকে যাওয়ার জন্য সাধলেও মায়া জাহান বরাবরই না করে দেন। তার মতে এখনো অনেক আয়োজন বাকি আছে। ওইসব শেষ হলে প্রয়োজনে এসে থেকে যাবেন। আত্মীয়তার বন্ধন এখন আরো প্রগাঢ় হয়েছে। রোজ আসা যাওয়া লেগে থাকবে। তবে সেটা আজ নয়।
মায়া জাহানের কথা শুনে ফরিদা হক আরকথা বাড়ালেন না। আসলেই ঠিক, আত্মীয়তা যেহেতু আছে আসা যাওয়া লেগেই থাকবে। একসুন্দর মহিমান্বিত বিদায়ের পর ফরিদা হক তৃধাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলেন।মনে হচ্ছে বহু প্রতিক্ষিত কেউ।
নুসাইব দুর থেকে দেখছে দুজনকে। নাবীব শেখ ছেলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে মসজিদের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। সন্তান যখন পরিবারের সুখে সুখ দেখে তখন মা-বাবা বুঝতে পারে পরিবারে সুখ শব্দটা দীর্ঘায়িত হবে। এই মুহূর্তে নাবীব শেখ সেটাই উপলদ্ধি করলেন।
নবনী চকলেট প্যাকেট নিয়ে বসে আছে। তিহান আর মাহাবুব ইসলাম মেয়ের পছন্দের জিনিস আনায় কমতি রাখেনি। ফলশ্রুতিতে চকলেট থেকে শুরু করে তৃধার পছন্দের সব রকম খাবারই নিয়ে এসেছে।
নুসাইব বোনের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে উঠলো। পুরো বাচ্চা বেড়ালের মত চকলেট পুরো গালে লেপ্টে ফেলেছে। টিস্যু দিয়ে নবনীর মুখ মুছে দিতে দিতে বলল,,” সব একসাথে খেলে পেট ব্য*থা করবে। যা রেখে আয়।”
নবনী আড় চোখে তাকিয়ে গাল ফুলিয়ে বলল,,” প্লিজ ভাইয়া এরকম করো না। একটু খেলে কিচ্ছু হবে না।”
বোনের চুল ঠিক করে দিতে দিতে বলল,,” বেশি না কিন্তু।”
ফরিদা হক আর তৃধা দুই ভাই বোনের দিকে তাকিয়ে হাসছে। ফরিদা হক বললো,,” তিহান নুসাইবের মত তাই না?”
তৃধা বুক ফুলিয়ে নিঃশ্বাস নিয়ে বললো,,” একদম। মানুষ ভিন্ন হলেও বোনের প্রতি ভালোবাসা একবিন্দুও কম নয়। দুজনই একই রকমের।”
ফরিদা হক তৃধার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,,” সব বাদ। শা*স্তির কথা ভুলে গেলে চলবে না। তোর এখনো হিসাব কিতাব বাকি আছে।”
তৃধা মাথা নেড়ে বললো,,” ভুলবো না। শা*স্তি মাথা পেতে নিলাম।”
নুসাইব শ্বাশুড়ি বউকে উদ্দেশ্য করে বলল,,” দুজন মিলে এই বেড়ালটাকে আটকাও । আম্মু তোমার মেয়ের পে*ট খারাপ করবে শিওর। তৃধা! তুমি এক কাজ করো। চকলেট চিপস আরো কি কি এনেছে তোমার ওই রগচটা ভাই এইগুলো নিয়ে কোথাও লুকাও। খেতে চাইলে একটু একটু করে দিবে, সব একসাথে দিবে না খবরদার। এইসব খেয়ে পুরো রাত কাঁদবে।”
ফরিদা হক তড়িঘড়ি করে মেয়ের হাত থেকে চকলেটের প্যাকেট ছো মেরে নিয়ে নিলেন। চকলেটের প্যাকেট নেওয়ার কারনে নবনী গাল ফুলায়।
তৃধা নবনীকে ইশারা কিছু বলে, যেটা নুসাইব না বুঝলেও নবনী ঠিকই বুঝে নেয়। নবনী ফুলিয়ে রাখা মুখে হাসি ফুটে উঠলে নুসাইব আড় চোখে তৃধার দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে। যদিও মেয়েদের ইশারা ইঙ্গিত বুঝার ব্যাপারে সে বড্ড কাঁচা।
অন্যদিকে,
পরিবারের সাথে রাগ করে ভালো নেই তিন্নি। বিগত কয়েকদিন ধরে বাবা ছাড়া দেশে তেমন কারো সাথেই কথা বলেনি সে। তিন্নির শ্বশুর শ্বাশুড়ি থেকে শুরু করে সবাই তিন্নিকে বুঝিয়েছে। শেষে চিন্ময় নিজে বসে তিন্নিকে বুঝিয়ে বলেছে। চিন্ময়ের কথায় তিন্নি শান্ত হলেও বাড়ির কারো সাথেই তেমন যোগাযোগ রাখলো না। শেষে না পেরে মাকে কল করলো ,যদিও ব্যাস্ততার জন্য ফরিদা হক মেয়ের সাথে তেমন কথা বললো না। এতে করে তিন্নির মনটা আরো বেশি ভার হয়ে গেলো।
এক বোন মন খারাপ করে থাকলেও তমাল পুরো মেস জুড়ে হই হই শুরু করে দিয়েছে। ব্যাপারটা কারো বোধগম্য না হলেও কেউ তেমন একটা মাথা ঘামালো না। তমাল স্বভাব সুলভ এমন। তার দুঃখ তেমন একটা দেখা না গেলেও বাড়ি থেকে কল কিংবা মেসেজ যাওয়ার পর সুখটা সবাই দেখে। নবনীর পাঠানো ভিড়িও দেখার পর থেকেই তমাল এমন হই হই শুরু করেছে। তমালের কাছে পরিবার মানেই সুখ। পরিবারের ছোট ছোট ব্যাপার গুলো তমাল খুব বেশি উপভোগ করে। সে যতই ডান পিঠে বাউন্ডুলে হোক না কেন, দিন শেষে পরিবার ছাড়া আপন কেউ নেই।
_______________
সাফিয়া খাতুন ছেলের শিয়রে বসে আছে। রাজিয়া ভাইয়ের জন্য ভাত তরকারি বেড়ে এনেছে। শিমুলের রজবকে ধরে বসালো। রজব শরীরের ব্যাথ্যায় চোখ মুখ কুঁচকে ফেলেছে। সাফিয়া খাতুন ছেলের অবস্থা দেখে হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বললো,,” তোর বউটা তো একটা বারের জন্যেও এলো না। না হাসপাতালে এসেছে ,না বাড়িতে এসেছে। শিমুল নিজে গিয়ে খবর দিয়েছে।”
রাজিয়া মাকে ইশারা করে চুপ থাকতে বললেও সাফিয়া খাতুন সেই ইশারার তোয়াক্কা করলেন না। তিনি পুনরায় বলে উঠলো,,” ওর জায়গায় তৃধা থাকলে এতক্ষণে পা*গল হয়ে ছুটতো।আর যাই বলিস মেয়েটা তোকে বড্ড ভালোবাসতো। কিন্তু সুমনা মেয়েটা! স্বা*র্থপর, লো*ভী , পর*শ্রী*কাতর । এই মেয়ে তোকে ভালোবাসেনি বাপ।”
রজবের চোখ থেকে অনবরত পানি গড়িয়ে পড়ছে। মায়ের কথা মিথ্যা নয়। তৃধা তাকে সব কিছুর উর্ধ্বে গিয়ে ভালোবাসলেও, সুমনা মোহে পড়ে এসেছে। সুমনা আসলেই স্বা*র্থপর, লো*ভী তারচেয়ে বেশি পর*শ্রীকাতর। হীরা ফেলে কাঁচকে আপন করেছিলো। সেই কাঁচ তাকে শুধু ক্ষ*ত*বি*ক্ষ*তই করেছে। তৃধাকে পুরো দমে হারানোর পর রজব তৃধার মূল্যটা বুঝতে পারছে এখন। ক্ষনিকের মৌহ তাকে কতটা ধ্বং*সের দিকে ঠেলে দিয়েছে সেটা সে ছাড়া কেউ বুঝতে পারছেনা। ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছে সে।
________________
মায়া জাহান আর মাহাবুব ইসলামের চেহারা দেখার মত। দুজনের চেহারা থেকে হাঁসি যেন সরছেই না। দুজন মিলে বেয়াই বেয়ান দাওয়াত দেওয়ার নানান রকম পরিকল্পনা করছেন। এর মধ্যে মায়া জাহান মোবাইল নিয়ে নিজের ভাই বোনদের কলও করে ফেলেছেন। সোফায় পা গুটিয়ে বসে মেয়ে,মেয়ে জামাই সংক্রান্ত বিস্তারিত ভাই বোনকে বলছে। তার সাথে মেয়ের বিয়ের ব্যাপারটাও জানাতে ভুললেন না। মাহাবুব ইসলাম স্ত্রীর পাশে বসে সেসব কথা শুনছেন।
তিহান সোফায় বসে মা-বাবাকে দেখছে। কে বলবে কাল পর্যন্ত তারা অসুস্থ আর চিন্তত ছিল ! এখন তাদের দুজনের চেহারার আলাদা খুশি দেখা যাচ্ছে। দেখে বুঝার উপায় নেই দুদিন আগেও কতটা অখুশি ছিলো। মনে হচ্ছে তাদের মত সুখী বোধহয় আর কেউ নেই। তিহান অগোচরে কয়েকটা ছবি তুলে রাখলো।
________
ডিনার শেষে করে বসলো না নুসাইব। হড়বড়িয়ে রুমে ঢুকে ল্যাপটপ নিয়ে বসে। আজকের পুরো দিনের ইম্পর্ট্যান্ট কাজ গুলো কাল রাতে ক্যান্সেল করেদিলেও কাজ গুলো সে ছাড়া কেউ করতেও পারবে না। এরমধ্যে অফিসে হওয়া ঝামেলা নিয়ে রুমেল বার কয়েক মেসেজ করলেও নুসাইব সেটা দেখতে পায়নি। যার কারনে ম্যানেজার সাহেব রুমেলের উপর চওড়াও হয়। যদিও ব্যাপারটা কিছু সময় আগেই জানতে পারে। ম্যানেজারের উপর সম্পূর্ণ রূপে হাল ছাড়লো নুসাইব। এইবার ওনাকে কাজ থেকে অব্যাহতি না দিলেই নয়। নানান রকম চিন্তা মাথায় নিয়ে মেইল গুলো চেক করছে।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে শ্বাশুড়ির হাত হাত মিলিয়ে গোছগাছ করছে তৃধা। নবনী কাজে হাত দিলেও তাকে কাজ করতে দেয়া হয়নি। তৃধার মতে কাজ করার জন্য অনেক সময় আছে। এই সময়টা পড়ালেখার পাশাপাশি জিবনটা উপভোগ করা কিংবা ব্যাক্তিগত মানুষের সাথে মিষ্টি আলাপচারিতা করার। সে চায় না নবনী সময়টা সংসারের কাজে ব্যায় করুক। সে নিজেও বাড়িতে থাকাকালীন কখনো কাজে হাত দেয়নি। তেমনি নবনীরও কাজের দরকার নেই। বাকি জিবন ভালো খারাপ যেভাবেই কাটুক না কেন, তৃধা চায় নবনীর স্মৃতিতে বাবার বাড়িটা যেন রাজপ্রাসাদ হয়ে থাকুক। যেখানে সে ছোট রাজকুমারী। যাকে আবদারে,স্নেহে , ভালোবাসায় সবাই মাথায় তুলে রাখে।
হাতের কাজ সেরে যে যার রুমে চলে গেলেও তৃধার যেন একটু বেশিই তাড়া ছিল। হাত ভর্তি চকলেট আর দুটো চিপসের প্যাকেট নিয়ে একপ্রকার দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলো। নুসাইব তার কাজে ভীষণ ব্যস্ত। তৃধা দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলে ঢুকলো রুমে। নুসাইব চশমার উপর দিয়ে তৃধার দিকে তাকায়। তৃধা রিতিমত হাঁপাচ্ছে। নুসাইব ভ্রু কুঁচকে বললো,,” ভুত দেখেছিলে?”
তৃধা উত্তর করলো না। দরজা আটকে চকলেট গুলো ল্যাম্পশেডের পাশে রেখে চিপসের প্যাকেট দুটো নিয়ে বললো,,” কাজগুলো কি বেশি ইম্পর্ট্যান্ট? মানে এই মূহুর্তে না করলে অনেক সমস্যা হবে?”
তৃধার কন্ঠে অস্থিরতা বিরাজ করছে। ভীষণ কৌতুহলী চোখ জোড়া উত্তরের আশায় চেয়ে আছে।
তা দেখে মুচকি হাসলো নুসাইব। এই উৎকণ্ঠা কৌতুহলী রমনী এখন তার ব্যক্তিগত । যার উপস্থিতিতে সকল প্রকার জরুরি কাজও ফিকে পড়ে। নুসাইব চশমা খুলে রেখে বললো,,” কাজটা গুরুত্বপূর্ণ হলেও তোমার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নয়। ”
নুসাইবের কথা শোনা মাত্র চঞ্চল পায়ে এগিয়ে এলো তৃধা। নুসাইব কিছু বুঝার আগেই হাত টেনে ধরে বললো,,” তাহলে উঠুন ,কথা আছে। খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা।”
তৃধার হাতে নিজের হাত দেখে মৃদু হেসে বলল,,” ঠিক আছে। কোথায় যেতে হবে বলো?”
তৃধা হাত টেনে বারান্দার দিকে যেতে যেতে বলল,,”আপাতত বারান্দায়। যা যা জিজ্ঞেস করবো সোজা উত্তর দিবেন কিন্তু। ”
আজ প্রথম বউয়ের মধ্যে বউ বউ আচরণ দেখলো নুসাইব। ব্যাপারটা যে কতটা সুখকর তা বুঝানো দায়।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে তৃধা নুসাইব। তৃধা একটা চিপসের প্যাকেট ছিঁড়ে নুসাইবের হাতে দিয়ে অন্যটা নিজের জন্য ছিঁড়ল। নুসাইব নিরবে অবলোকন করছে সব। তৃধা চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস টেনে বললো,,”এইবার বলুনতো, আমি যে আপনার বন্ধুর বোন সেটা জানলেন কখন? জেনেছেন যখন আমাকে বলেননি কেন? নিশ্চয়ই প্রথম দিন থেকেই জানতেন? বন্ধুর বোন যেহেতু অবশ্যই চিনতেন প্রথম থেকে। চিনতেন না বলুন? এতো দিন চুপ করেই বা ছিলেন কেন? বলুন! বলুন!
তৃধার প্রশ্ন শুনে মুখ টিপে হাসছে নুসাইব। তৃধা বেজায় বিরক্ত হয়ে নুসাইবের পে*টে গুঁ*তো মে*রে বললো,,” সব দোষ এই পেটের। তাড়াতাড়ি বলুন কি কি লুকিয়েছেন?”
পে*টে গুঁ*তো দেওয়ার ব্যাপারটা বিষম খেলো নুসাইব। তৃধার দ্বারা এমন কাজ হবে সেটা তার কল্পনাতেও ছিলো না।
তৃধা কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে। নুসাইবের মুখাভঙ্গিতে তার তেমন একটা ফারাক পড়লো বলে মনে হচ্ছে না। সে তার প্রশ্নের উত্তরের আশায় আছে।
নুসাইব পেট থেকে হাত সরিয়ে বললো,,” না বললে মনে হয় মা*র*পি*ট শুরু করে দিবে? ডেঞ্জারাস ব্যাপার-স্যাপার তো।”
নুসাইবের কথায় তৃধার টনক নড়লো। তৎক্ষণাৎ লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো।ইদানিং নুসাইবের সাথে সম্পর্কটা অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে। যার দরুন কাজটা অজান্তেই করে ফেলেছে।
বউয়ের লজ্জা পাওয়ার ব্যাপারটা বরাবরই নুসাইবের ভীষণ পছন্দের। তৃধা থেকে চোখ সরিয়ে বললো,,” মনে আছে রেস্টুরেন্টের কথা? ওইখানেই সম্পূর্ণ নিশ্চিত হই তুমি আর তিহান দুজন ভাই-বোন। যদিও ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় প্রথম থেকেই জানান দিচ্ছিলো তুমি আমার খুব পরিচিত।
চলবে,,
উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ৪৫
,
,
,
,
,
,
,
,
নুসাইবের কথা শুনে তৃধা হা করে তাকিয়ে আছে। রেস্টুরেন্টে দেখে কিভাবে বুঝলো সেটাইতো মাথায় ধরছে না। যেখানে দুজনের মধ্যে কোনো কথাই হয়নি। তৃধা মাথা নেড়ে বলল,,” এইভাবে নয় । শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বলুন। রেস্টুরেন্টে কিভাবে বুঝলেন আগে সেটা বলুন।”
নুসাইব চিপস খেতে খেতে বলল,,” আমি বিজনেসম্যান প্রফিট ছাড়া এক পাও নড়ি না। সেখানে তোমাকে এতো গুলো কথা বলবো? আগে বলো কি দিবে?”
নুসাইবের কথা শুনে তৃধার চোখ জোড়া বেরিয়ে আসার উপক্রম। দুটো কথা কি বলবে এর জন্য প্রফিট চাইছে? নিজেকে ধাতস্থ করে বুদ্ধি খাটিয়ে গলা ঝেড়ে বলে উঠলো,,” তেমন হলে আমার তো উচিৎ প্রতি কাজে প্রফিট খোঁজা। সকালে নাস্তা এগিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে অফিসে যাওয়ার জন্য জামা কাপড় বের করে দেওয়া, বিছানা গোছানো, এখন আবার আপনার এঁটো প্লেট ধুয়ে এসেছি, শার্ট দুটো আয়রন করে দিয়েছি, ওইযে ড্রেসিং টেবিল দেখছেন ওইটাও গুছিয়েছি। এই যে দাঁড়িয়ে আছেন এইটাও ঝাড়ু দিয়েছি, চিপসের প্যাকেট পর্যন্ত খুলে দিয়েছি এতো কিছু করেছি তাহলে আমার প্রফিট কই? আমিতো বিজনেসম্যান এর ওয়াইফ। প্রফিট ছাড়া এক পাও নড়া উচিৎ নয়। তাড়াতাড়ি দিন কি দিবেন?
তৃধার লম্বা লিষ্ট দেখে নুসাইব অবাক চিত্তে তাকিয়ে আছে।এতো এতো হিসেব নুসাইব নিজেও জানে না।
তৃধা হাত পেতে বললো,,” কি হলো? প্রফিট কই?”
তৃধাকে হাত পাততে দেখে নুসাইব দুটো চিপস তৃধার হাতে দিয়ে বলে,,”ডিয়ার ওয়াইফি ওসবের প্রফিট ভালোবাসা। সময় হোক সুদ সমেত দেওয়া হবে।”
নুসাইবের কথা শুনে আড় চোখে তাকালো তৃধা। এই লোকের কথার মারপ্যাঁচের সাথে পেরে উঠা দায়। যাই বলা হোক না কেন, ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কাবু করেই ফেলবে।
আলো আঁধারের লুকোচুরি খেলায় তৃধা নিজেকে লুকাতে ব্যস্ত। নুসাইব মাথা চুলকে মুচকি হেসে বলল,, ঠিক আছে বলছি শোনো, রেস্টুরেন্টে তোমরা একজন আরেকজনকে দেখে কিভাবে তাকিয়ে ছিলে মনে আছে? জানি মনে আছে। তবে কত সময় ধরে তাকিয়ে ছিলে সেই খেয়াল নেই। ভাই বোনকে দেখে স্তব্ধ,বোন ভাইকে দেখে। দুজন শব্দহীন হলেও তোমাদের দুজনের চোখ দেখলে যে কেউই বুঝে ফেলতো। তোমার ঠোঁট কাঁপছিলো, চোখের পাতা কাঁপছিল, টেনে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলে তার সাথে ভিজে উঠেছিল চোখ। তৃধা আমি তোমাকে না চিনে থাকলেও বিগত মাস গুলোতে খুব চিনে ফেলেছি। তোমার চোখ দেখে অনেক কিছুই বুঝে ফেলার ক্ষমতা আমার আছে এখন। আর তোমার ভাই? ওকে তো আরো বেশি করে চিনি। অবিশ্বাস্য নজরে তোমার দিকে তাকিয়ে ছিল। মনে হচ্ছে কত শত বছর তোমাকে দেখেনি। তার চেয়ে মজার ব্যাপার মেজর সাহেবের হাত কাঁপছে। আমার খুব অবাক লেগেছিলো তখন, যখন তোমরা একজন আরেকজনের সাথে কথা বলোনি। একজন আরেকজনকে ধরে কেঁদে ফেলোনি। কেন বলতো?
তৃধা নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।
নুসাইব লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বললো,,” তখন আমি ইচ্ছে করেই মেলায় হারানোর ব্যপারটা বলেছিলাম। আমি জানতাম রিয়েক্ট করবে। ঠিকই রিয়েক্ট করলে। দুজন চমকে উঠে নজর লুকালে।আমি অতোটা বোকা নই তৃধা যতটা তুমি। আমাকে চেনার এখনো অনেক বাকি। তুমি কি ভেবেছিলে, আমি জানি না তুমি কেন তোমার ভাইয়ের সাথে কথা বলোনি? আমার জন্য বলনি। আমি কি ভাববো সেটা ভেবে বলনি। তিহানের সম্পর্কে আমার ধারনা যেন পাল্টে না যায় সেই ভয়ে কথা বলনি। আমি সব জানি।”
তৃধা বিষ্ময় নিয়ে তাকালো । আসলেই তাই। এইসব ভেবেই কথা বলেনি। তাছাড়া জড়তাও ছিল।
,,”শোনো তৃধা, সব কিছুর উর্ধ্বে পরিবার হয় । একটা মেয়েকে তার বন্ধু, বান্ধবী, আত্মীয়-স্বজন, স্বামী,সবাই পরিত্যাগ করতে পারলেও তার বাবা-মা পারে না। তার ভাই-বোন পারে না। যে পরিবার তাকে ছোট থেকে বড় করেছে তারা দূরে ঠেলে দিতে পারে না। আল্লাহ না করুক, আমি তোমাকে অবহেলা করলেও তোমার পরিবার কখনোই করবে না। অন্তত আমি সেটা মনে করি। ভবিষ্যতে যদি কখনো,, আল্লাহ না করুক কখনও যদি আমার বোনের শ্বশুরবাড়ির লোক বলে তাদের বাড়িতে আমার বোনের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। আমি এক সেকেন্ড দেরি করবো না, সোজা গিয়ে আমার বোনদের নিয়ে আসবো। বাকি জিবন নিজের কাছে রেখে দিবো। এই বেলায় তিহান ঠিক আমার মতই। রাগ অভিমান যত কিছুই থাকুক না কেন সে তোমার ভাই। তুমি কি করে ভাবলে তিহান তোমার ভাই জানার পর আমার অবজেকশন থাকবে। আমার কাছে যেমন পরিবার আগে , তোমার কাছেও পরিবারটা সবার আগে হওয়া উচিত।রইলো আমার আর তিহানের সম্পর্ক। আমাদের সম্পর্ক এতোটাও ঠুনকো নয় যতটা তুমি ভাবছো। আমাদের বন্ধুত্ব কখনো পরিবার পরিজন দেখে হয়নি।আমি আগেই বলেছি তোমার অতীত আমার কাছে ম্যটার করে না। সেটা হোক তোমার ক্ষেত্রে কিংবা তোমার ভাইয়ের ক্ষেত্রে।
তৃধা স্তব্ধ চোখে নুসাইবের দিকে তাকিয়ে আছে।তার কাছে বলার মত কোনো কথা নেই।
নুসাইব তৃধার চোখে চোখ রেখে বলল,,”তোমার হাসবেন্ড এতোটাও অধম নয়।”
,,”হুম।”
তৃধার বলা ‘হুম’ শব্দে হাসলো নুসাইব। গলা ঝেড়ে বললো,, সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে তোমার চেহারা। প্রথম থেকেই মনে হচ্ছিল তুমি আমার পরিচিত, তোমাকে আমি কোথাও তো দেখেছি। যদিও স্পষ্ট মনে পড়েনি কখনো। মনে না পড়ার কারনে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেলাম। এরপর আবার বিয়ের দিন যখন তুমি তোমার মা-বাবার নাম বললে তখন খটকা লাগে। কিন্তু কি জানতো! লোকে বলে প্রেমে পড়লে অতিশয় বুদ্ধিমানও বোকা হয়ে যায়। আমার বেলাতেও সেটা হয়েছে। তুমি মেয়ের দিকে তাকালে আমার সব এলোমেলো হয়ে যায়। বুদ্ধি সব লোপ পায়। ভয়ংকর রকমের বোকা বনে যাই। সেই জন্যইতো নাম জানার পরও মাথা ঘামাইনি। সব শেষে রেস্টুরেন্টে তোমাদের ভাই বোনের কান্ড দেখে সবটা ক্রিস্টেল ক্লিয়ার হয়ে যায়। রাতে সবটা প্ল্যান করি। তিহানের সাথে কথা বলার পর বাড়ির সবাইকে জানাই। এরপর তো দেখলেই কি হলো। অবশ্য আরো আগে জানলে ব্যাপারটা অন্য রকম হতো। তোমার দিন গুলো আরো ভালো কাটতো। মন ভালো থাকতো। সে যাই হোক এখন বলো তোমার অনূভুতি কেমন?
তৃধা আধভেজা চোখে তাকিয়ে আছে নুসাইবের দিকে। অনড় দৃষ্টি জোড়া নুসাইবকে দেখতে ব্যাস্ত। হঠাৎ কি হলো কে জানে! কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলে উঠলো,,” আপনাকে একবার জড়িয়ে ধরা যাবে?”
তৃধার কথায় থমকায় নুসাইব। প্রিয় মানুষের আদুরে আবদারে সিক্ত সে। একান্ত ব্যক্তিগত রমনিকে প্রশস্ত বুকে ঠায় দেয়ার ভীষণ তাড়া নিয়ে হাত দুটো প্রশারিত করে মুচকি হেসে নিজেই জড়িয়ে ধরলো।
নুসাইবের বাহুডোরে আবদ্ধ তৃধা নিরবে চোখের জল ফেলছে। হেঁচকি ওঠা তৃধার মাথায় ঠোঁট ছুঁইয়ে আদুরে গলায় বলল,,” তোমার সাথে আমার কখনই দেখা হয়নি। তোমরা মেয়েরা মেয়ে বান্ধবীর কাছে ভাই নিয়ে গল্প করলেও আমরা ছেলেরা বোন প্রাসঙ্গিক কোনো কথা বন্ধুর কাছে শেয়ার করি না। সে যত ভালো বন্ধুই হোক না কেন। ইভেন বোনের ছবি পর্যন্ত দেখানো পছন্দ করি না। তোমার বাড়ির রাস্তায় কতবার গিয়েছি তার হিসেব নেই। তবে তোমায় কখনো সামনাসামনি দেখিনি। দেখার আগ্রহটাও ছিলোনা। আমার মত তিহানও ছিলো। আমার বোনদের সাথে তার কখনো দেখা হয়েছিল বলে মনে হয় না। কিন্তু আমি তোমায় ছবিতে দেখি। না চাইতেও তোমার ভাইয়ের ওয়ালেট ধরতে হয় আমায়। সেখানে নয় কি দশ বছর বয়সী একটা মেয়ের ছবি দেখতে পাই। মেয়েটা চকলেট হাতে নিয়ে মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। ওইদিন তিহান তোমার ছবিটা দেখতে দেখতে কি বলেছিল জানো? “এইটা আমার ছোট পুতুল।”
তৃধা হেঁচকি ওঠা গলায় বলল,,” আমি তখন ছোট ছিলাম, ওই চেহারা মনে থাকার কথা নয়।”
নুসাইব মুচকি হেসে বলল,,” শোনো মেয়ে , তোমার বয়স বেড়েছে, লম্বা হয়েছো একটু এছাড়া তুমি তুমিই আছো। চেহারা বদলায়নি একটুও।”
চলবে,,,,