আমি আছি পর্ব-৪৬+৪৭+৪৮

0
786

উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ৪৬
,
,
,
,
,
,
,
,

সময় বহমান নদীর মত। না কারো অপেক্ষা করে ,না কারো জন্য থেমে থাকে। তেমনি বাকি সবার মত নুসাইব-তৃধার সময় গুলোও বয়ে চলছে। তাদের সম্পর্ক খুব বেশি স্বভাবিক না হলেও, অস্বাভাবিক নয়। বিগত এক সপ্তাহে দুজনের মধ্যেকার জড়তা অনেকটাই কেটে গেছে। আগের মত দুজন দুজনকে এড়িয়ে চলে না। সময় নিয়ে ঘটা করে গল্পে মেতে ওঠে। দুজন দুজনের ছোট বেলা থেকে শুরু করে সংসার প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে গল্প করে। তারা দু’জনই সম্পর্কটাকে আর পাঁচটা স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের মত করার চেষ্টা করে চলেছে। এর মধ্যে নুসাইবের চেষ্টাটাই বেশি দেখা যায়। নিজের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রয়োজনে তৃধাকে জড়ানোর ব্যাপারটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে উঠেছে। সময়ে অসময়ে বিরক্ত হলেও এই অধিকার বোধ তৃধার বড্ড বেশি পছন্দের। আজকাল খুব বেশি অপ্রয়োজনীয় কাজেও তৃধাকে নুসাইবের প্রয়োজন হয়। হোক সেটা টাওয়েল এগিয়ে দেওয়া কিংবা জগ থেকে পানি গ্লাসে ঢেলে দেওয়া। সব ব্যপারে তৃধা নামটা মুখে না নিলে নুসাইবের দিনটাই যেন মাটি।

আজ ফজরের নামাজ শেষে নুসাইব চিলেকোঠার ঘরে গেলেও তৃধা গুটি গুটি পায়ে কিচেনের দিকে হাঁটা ধরলো। বাড়িতে সব মিলিয়ে মানুষ পাঁচ জন এদের জন্য ব্রেকফাস্ট তৈরি করা তেমন একটা কঠিন কাজ নয়। তৃধা ঠিক করলো আজ থেকে এই কাজটা সে করবে। যেই ভাবা সেই কাজ। কোমরে ওড়না পেঁচিয়ে লেগে পড়লো।

ফরিদা হক নামাজ শেষে কিছু সময় বিছানায় কাটান। কখনো তাজবী পড়েন আবার কখনো দোয়া দরুদ পাঠ করেন। আজকেও তার ব্যাতিক্রম হলো না। নাবীব শেখ ইতিমধ্যে নাক ডাকা শুরু করে দিয়েছেন। ফরিদা হক এতে ভীষণ ভাবে অভ্যস্ত হলেও মাঝে মাঝে একটু আধটু বিরক্ত হন। নাবীব শেখ রোজ মসজিদ থেকে ফিরে বিছানায় শুবেন,এর ঠিক মিনিট পাঁচেক পর তিনি নাক ডাকা শুরু করেন। এতে মাঝে মাঝে ফরিদা হক সূরার আয়াত গুলিয়ে ফেলে,আর বিরক্ত ব্যাপারটা তখনই আসে। যদিও বিরক্ত হওয়া উচিত নয় তিনি জানেন।
________

অন্যদিকে তমালের দিনকাল ব্যস্ততম। আজকাল পড়ালেখা নিয়ে তাকে গম্ভীর হতে দেখা যাচ্ছে। তমালের এই রূপ সচরাচর দেখা যায় না। মেসের সবাই তমালকে দেখে অবাক হলেও তমালের এতে তেমন একটা ফারাক পড়ছে বলে মনে হয় না। সে তার সেমিস্টার এক্সামের প্রিপারেশন নিচ্ছে। এই সাত সকালে তমালকে পড়ার টেবিলে দেখে ইয়াছির চোখ ছোট ছোট করে বেশ কিছু সময় তাকিয়ে থেকে টেবিলের উপর বসে পড়ল। তমাল বিরক্ত নিয়ে বললো,,”কি চাই?”

,”কি চাই মানে? তুই এতো পড়ছিস কেন সেটা বল? তোর টেনশনে মেসের কেউ ঘুমাতে পারছে না। বেটা , চোখ বন্ধ করলেই তোর জ্বর দেখছে সবাই। সমস্যা কি ?”

ইয়াছিরের কথা শুনে তমাল হাতে কলম ঘুরাতে ঘুরাতে বললো,,” বাবা বলেছে ফেইল করলে মতি মিয়ার দোকানে বসিয়ে দিবে। যদিও সেটা নিয়ে আপত্তি নেই। ঘটনা হচ্ছে যে ,আমার ভাইয়ের বন্ধু মানে আমার ভাবীর ভাই আর্মি মেজর। চিন্তা করে দেখ ভাই মাশাআল্লাহ বিজনেসম্যান, ভাইয়ের বন্ধু মেজর,আর আমি? চা দোকানদার? শেখ বাড়ির পুরুষ হিসেবে মান ইজ্জত সব যাবে। তার চেয়ে বড় কথা ছোট বোনের জামাই লেকচারার। প্রেশারে প্রেশার হাই হয়ে যাচ্ছে। যে করেই হোক ডাক্তার তো হতেই হবে।

ইয়াছির বেশ কিছু সময় চুপ করে থেকে বলল,,” তোদের পুরো গুষ্টিই মেধাবী দেখছি। খুঁজে খুঁজে আত্মীয়তাও ওদের সাথে হচ্ছে। একেই বলে কপাল। তুই কেন টেনশন নিচ্ছিস ভাই? তোর মাথা দেখলেই বুঝা যায় তুই বাংলার নিউটন। এই সেমিস্টারে প্রথম থাকবি শিওর।”

তমাল ভ্রু কুঁচকে বললো,,” চুল নিয়ে কিছু বলবি না। এই চুল হাজার নারীর দূর্বলতা। তুই জানিস এই চুলের জন্য কতজন পা*গল?”

তমালের কথায় ইয়াছির মুচকি হেসে বলল,,”তাহলে একটা দেখে প্রেম কর।”

,,”আস্তাগফিরুল্লাহ পড়। এইসব কথা আমার সামনে বলবি না। ভবিষ্যতের উপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। পরে ডাক্তার না হয়ে ওঝা , কবিরাজ হতে হবে। ওই সব বাদ দিয়ে বড় বড় চিন্তা কর। মহা পুরুষদের কথা ভাব,বিজ্ঞানীদের কথা চিন্তা কর, আবিষ্কারকদের কথা চিন্তা কর। ওরা যদি নারীতে আসক্ত থাকতো,প্রেম করতো ওদের কেউ চিনতো না। আরে সময়ই তো পেতো না। যাত্রা পথেই মেকাপের কথা বলতো আর নয় এক কেজি আলু ,পটল কিংবা একশত গ্ৰাম কাঁচা মরিচ আনতে বলতো। ভাগ্যিস এইসব ছিলো না বলেই আজ পৃথিবী এতো উন্নত। তোর দরকার হলে তুই প্রেম কেন প্রয়োজনে বিয়ে কর। আমি হব মহা পুরুষ আমি ওইসব আস্তাগফিরুল্লাহ মার্কা কাজে জড়াবো না।”

ইয়াছির দাঁতে দাঁত চেপে অনেক ধৈর্য্য নিয়ে তমালের কথা শুনে বললো,,” বেডি মানুষে যখন এতোই এল্যার্জি তখন ভাইকে বিয়ে করানোর জন্য এতো লাফালাফি করছিলি কেন?তাকেও রেখে দিতি।”

,,” অদ্ভুত!! আমি কখন বললাম এল্যার্জি? তাছাড়া আমার জন্য কি গোটা জাতি অবিবাহিত থাকবে? আমি ডাক্তার হবো, রোগী দেখবো। কেউ বিয়ে না করলে জনসংখ্যা বাড়বে না, তাছাড়া জনসংখ্যা না থাকলে রোগী আসবে কোথা থেকে? আমি কখনো লোকসান গুনতে রাজি নই। তোর মত গবেট এমন চিন্তা করতে পারে আমি নই। আমি পারলে ডাক্তারির পাশাপাশি একটা কাজি অফিসও খুলে বসতাম। বেকুব কোথাকার!”

ইয়াছির জানে তমালের সাথে আর যাই হোক কথায় পারা যাবে না। তাই হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বললো,,” শোন তোর মত পা*গলের সাথে আমার কথা বলাটাই ভুল হয়েছে। তুই দেখবি আমার বদদোয়াতে তোর প্রেম হবে। ওইদিন আমি তোকে খেল দেখাবো। ” দাঁড়ালো না ইয়াছির কথা গুলো বলেই দৌড়ে পালায়।

তমাল টেনশনে পড়ে গেছে। এই বদদোয়া যদি কোনো মতে লেগে যায়,তাহলে ডাক্তারি পড়া শেষ। এই বদদোয়ার চাইতে তো একটা স্কে*লি*টিন- বিয়ে করে ফেলা উত্তম। তমাল মোবাইল নিয়ে মায়ের নাম্বারে ডায়েল করলো। এই বদদোয়া থেকে বাঁচতে হলে মায়ের দোয়া দিয়ে বদদোয়াটা কাটাতে হবে। সেই জন্য কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে কল রিসিভ করার অপেক্ষায় আছে।

*
*
সাত সকালে নবনী মোবাইলে কানে চেপে চোখ বন্ধ করে আছে। হলে এসেছে এই নিয়ে চারদিন হলো। এর মধ্যে জীবনটা শেষ হওয়ার দশা । অপর প্রান্ত থেকে সমুদ্র হ্যালো হ্যালো করে চলছে। যদিও নবনীর সেই দিকে খেয়াল নেই।সে দিব্যি নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। সমুদ্র চশমা খুলে টেবিলের ওপর রেখে কল কেটে পুনরায় কল করলো। নবনী রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে কল রিসিভ করে নাকি কান্না করতে করতে বললো,,” এখন এমন করছেন বিয়ের পরতো মনে হয় চোখটাই বন্ধ করতে দিবেন না। সারাক্ষণ পড়ালেখা, পড়ালেখা করবেন। আরে একটুই তো ঘুমাচ্ছি,কেন এমন করছেন? এই জন্যই বুদ্ধিমতিরা বলে শিক্ষকের প্রেমে পড়ার চাইতে পুকুরে পড়া ভালো। আপনার প্রেমে পড়া মোটেও উচিত হয়নি,তার চেয়ে বড় ভুল বিয়ের সিদ্ধান্ত। এখন আমি ঘুমাতে পারি না। চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গেছে, চুল উঠে যাচ্ছে এরপর আমাকে কেউ বিয়েই করবে না।”

সমুদ্র মোবাইল কানে চেপে এক একটা কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছে। শেষের কথা গুলো শুনে হাঁসি চেপে রাখতে চেয়েও পারলো না। হেঁসে উঠে বললো,,”চোখে নিচে কালো দাগ, চুল উঠে যাচ্ছে, আরে যা যাচ্ছে আমার যাচ্ছে। তুমি কেন এতো চিন্তা করছো? তোমাকে বিয়ে করার জন্য এই সমুদ্র তো আছেই। এখন বললে এখন বিয়ে হবে। বিয়ে করবে?

সমুদ্রের কথা শুনে নবনী লাফিয়ে উঠে বসলো। চোখ কচলাতে কচলাতে বলল,,” হ্যাঁ! মানে?”

,,” চল বিয়ে করি। এখন ,এই মুহূর্তে, যেভাবে আছো ঠিক সেইভাবে।”

সমুদ্রের কথায় হতভম্ব নবনী।’যেভাবে আছো ঠিক সেইভাবে’ কথাটা শোনার পর নিজের দিকে তাকিয়ে আছে। পরনে টিশার্ট আর ট্রাউজার। এইভাবে বিয়ে?

মোবাইল ফোনের অপর প্রান্তে থাকা সমুদ্র মিটমিট করে হাসছে। সে জানে নবনী এখন কি ভাবছে। নিশ্চয়ই কথা গুলো শুনে চমকে উঠে বসেছে।এই মুহূর্তে তাকে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব।
নবনীকে কল্পনা করে সমুদ্রের খুব হাসি পেলো। নাহ্ মেয়েটাকে আর দূরে রাখা যাবে না। এতো লম্বা সময় অপেক্ষার ধৈর্য্য তার নেই। ওই ঘুম কাতুরে চঞ্চল মেয়েটা যতক্ষন না পাশে ঘুমোচ্ছে ততক্ষন পর্যন্ত মনটা শান্ত হবে না। সময় এসেছে নবনী নামক চঞ্চল মেয়েটাকে সাজিয়ে ঘরে তোলার।

____________

ফরিদা হক ছেলের সাথে কথা শেষ করে রুম ছেড়ে বেরুলেন। কিচেন থেকে প্লেট বাটির শব্দ আসছে। তিনি দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকালেন। ঘড়িতে সময় কেবল ছয়টা। এইসময়টাতে কেউ কিচেনে থাকার কথা নয়, তাহলে? তিনি দেরি না করে কিচেনের দিকে এগিয়ে গেলেন।

রুটি সেঁকে হটপটে রেখে সবে আলু কাটা শুরু করেছে তৃধা। এর মধ্যে ফরিদা হক কিচেনে ঢুকে কপাল চাপড়ে বললো,,” হায় আল্লাহ!এইসব কি?তৃধা,, কিচেনে কি করছিস?”

তৃধা মুচকি হেসে বলল,,” কিচেন হাতিয়ে নিচ্ছি। বাড়ির বউ বলে কথা।”

ফরিদা হক ভাবুক হয়ে বললো,,” আমি সেতারা বেগম সাজি তাহলে?”

তৃধা শব্দ করে হেসে উঠে বলল,,” তোমার দ্বারা এইসব হবে না। চেষ্টা করে লাভ নেই।”
তৃধার হাত থেকে ছুরি নিয়ে আলু কাটতে কাটতে বললো,,” আয় দুই মা মেয়ে একসাথে কাজ করি।”

তৃধা চটজলদি ডিম সেদ্ধ দিয়ে বললো,,” মা কল করেছে। বলেছে তোমরা কবে যাবে সেটা বলতে।তার সাথে এটাও বলেছে তোমার চেনা পরিচিত কোনো মেয়ে থাকলে ভাইয়ার জন্য দেখতে।”

,,”সেটা বলতে হবে না। তিহান আমার ছেলের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। আমি আগ থেকেই ঠিক করেছি ওর জন্য পাত্রী দেখা শুরু করবো। তুই এক কাজ কর নুসাইবকে জিজ্ঞেস করে দেখ ছেলেটা কবে ফ্রী হবে। সেই হিসেবে একটা দিন ঠিক করে যাবো। আপা কাল আমাকেও কল করেছে। তোকে পাঠানোর কথা বলেছি , কিন্তু সরাসরি মানা করে দিয়েছে। বলেছে মেয়ে তার পরিবার নিয়ে যাওয়ার পর কিছুদিন এসে বেড়ালে বেড়াবে,এর আগে নয়। এইবার বল আমি কি করি?

তৃধা হেসে উঠে বলল,,” ঠিকই বলেছে। চলো একদিন সবাই মিলে যাই। নবনীকেও আসতে বলি। তমাল ভাইয়ের সামনে পরীক্ষা তাও একটা দিনের জন্য আসুক। তিন্নি আপু হলে খুব ভালো হতো তাইনা?”

,”সেটা ঠিক বলেছিস। কিন্তু মেয়েটা এখন এলে নবনীর বিয়ের সময় আসতে পারবে কিনা সন্দেহ। তা না হলে আমারো তো ইচ্ছে করে মেয়েটাকে দেখতে নাতিটাকে কোলে নিয়ে আদর করতে। সমস্যা নেই তিন্নি এলে ঘুরে আসবে।”

,”সেটাও ঠিক।”

,,” ফ্রাইপ্যানটা দে তো মা। ফ্রিজ থেকে কয়েকটা কাঁচা মরিচ দিস।”

,,” তুমি ঘরে যাও এইসব আমি করে ফেলব।”

,,”সেটা হচ্ছে না। ঘরে তোর বাবার নাক ডাকার শব্দে থাকা যাচ্ছে না। আমি এইখানেই ভালো আছি।”

তৃধা শব্দ করে হেসে উঠলো।

তৃধাকে হাসতে দেখে ফরিদা হক নিজেও হাসছে।
এমন সময় নুসাইব “তৃধা” বলে ডেকে উঠলো। তৃধা হকচকিয়ে গেলেও ফরিদা হক মুখ টিপে হেসে বলল,,”এই সময়টা আমারো ছিল। নুসাইবের বাবা এই ভাবেই হাঁকডাক শুরু করতো। আমি তখন লজ্জায় সিটিয়ে যেতাম। সবার সামনে এইভাবে ডাকলে লজ্জা তো লাগবেই। সে বুঝতোই না,বললে আরো বেশি বেশি ডাকতো। তবে যাই বলিস এই সময় গুলো সুন্দর। যা তাড়াতাড়ি, কি প্রয়োজন দেখ গিয়ে।”

তৃধার গালের দুপাশ লাল হয়ে গেছে। তড়িঘড়ি করে কিচেন থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল।

রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে নুসাইব। ঘামে ভেজা শরীরে টিশার্টটা লেপ্টে আছে। তার অপেক্ষমান চোখ জোড়া তৃধাকে খুঁজে চলেছে। প্রয়োজন নেই তবুও যেন খুব প্রয়োজন। নুসাইব জানে তৃধা এসে রাগবে খুব,তাতে কি? বউদের একটু আধটু রাগতে হয়। এমন রাগের জন্যই নারী সুন্দর। নুসাইবের মতে, বউটা রেগে থাকুক তাও সামনে থাকুক।

চলবে,,,

উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ৪৭
,
,
,
,
,
,
,
,
সন্ধ্যা করে ফিরলো নুসাইব। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখ কপালে উঠার মত অবস্থা। শ্বাশুড়ি বউমা একজন আরেকজনের কানের সাথে কান লাগিয়ে রেখেছে। দুজনের ভ্রু-ই কুঁচকানো। বাড়ানো কদম থামিয়ে ভালো করে দুজনকে পরখ করলো। একজন কারো সাথে কথা বলছে আরেকজন কথা শুনছে। নুসাইব বুঝে পায় না এইভাবে কথা শোনার কি আছে! ফোন লাইভ স্পিকারে দিলেই তো হয়। হাতশ হলো ,বউ আর মায়ের এই বোকামোতে হতাশ। দুজনকে বিরক্ত না করে নিঃশব্দে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল।

কিছু সময় আগে শেফালী বেগম ফরিদা হক-কে কল করেন। বেয়ানের কল দেখে তড়িঘড়ি করে রিসিভ করলেন । আলাপচারিতার এক পর্যায়ে শেফালী বেগম বিয়ের কথা বলে বসেন। ফরিদা হক তৃধাকে ইশারায় ডেকে পাশে বসায়। তিনি কথা বলছেন তৃধা কান পেতে শুনছেন। মাঝে মাঝে তৃধা তার শ্বাশুড়িকে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট গুলো মনে করিয়ে দিচ্ছে।

শেফালী বেগম আমতা আমতা করে বলল,, আপা আসলে বিয়ের কথা বলতাম না। কিন্তু এইভাবে তো ব্যাপারটা ফেলে রাখা যায় না। আমি চাইছি তাড়াতাড়ি যেন বিয়েটা হয়ে যায়। দুজনই বুঝদার থাকেও এক শহরে। আমি মা আমার চিন্তা হয় ছেলেকে নিয়ে। জানি আপনার তো আরো বেশি চিন্তা হয়। দুজন একসাথে থাকলে আমরা দুই মা-ই কিছুটা চিন্তা মুক্ত থাকতাম। অন্তত একজন আরেকজনের খেয়াল তো রাখতো।

ফরিদা হক তৃধার দিকে তাকালো। তৃধা সায় দিতেই তিনি বললেন,,” সেটা ঠিক বলেছেন। আমিও সেটাই ভাবছি।”

শেফালী বেগম কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল,,” আপা আমি চাইছি বিয়েটা একটু তাড়াতাড়িই হোক।”

তৃধা ফিসফিস করে বলল,,”আম্মু তুমি বলো একদিন সবাই মিলে বসে আলোচনা করতে। প্রয়োজনে কাল আসতে বলো। শুক্রবার আছে তোমার ছেলেও বাড়িতে থাকবে।”

ফরিদা হক তৃধার কথা মত বললো,,” আপা তাহলে এক কাজ করি । আমরা বসি একজায়গায়। দুই পরিবার মিলে আলাপ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেই। কাল ভাইকে নিয়ে আসুন একবার।”

শেফালী বেগম ফরিদা হকের কথা শুনে বললো,,”ঠিক আছে আপা। আমি আপনার ভাইয়ের সাথে কথা বলে জানাচ্ছি।”

শেফালী বেগম কল কাটতেই ফরিদা হক বললো,,” কাল আসুক তাহলে। রান্নাবান্নাও তো করতে হবে। ফ্রিজটা চেক করে দেখতে হবে।”

তৃধা বাঁধ সেধে বলল,,” তোমার ওসব না ভাবলেও চলবে। রান্নাঘর আমি সামলে নিবো। তুমি তিন্নি আপুকে কল দাও। আপু আসার ডেট জেনে এরপর তাদের সাথে কথা বলো।”

তৃধার কথায় যুক্তি আছে। তিন্নি প্রথম থেকেই বলছে সে দেশে আসার পর যেন নবনীর বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করা হয়। ফরিদা হক মোবাইল ফোন হাতে তুলে বললো,,” নুসাইব কই? কল দিয়েছিস?”

তৃধা চোরা চোখে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল,,”অফিসে মনে হয়। কল দেওয়ার কথা মনে ছিল না।”

ফরিদা হক কপাল চাপড়ে বললো,,” তাড়াতাড়ি মোবাইল নিয়ে আয়। কল দিয়ে দেখ কোথায় আছে। শ্বাশুড়ি হয়ে এই সব শেখাতে হচ্ছে আমায়। দৌড়ে যা।”

তৃধা তাড়াতাড়ি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো। এতক্ষণ মনে না থাকলেও এইবার চিন্তা হচ্ছে তার। মানুষটা সেই সকালে গেছে এখনো কোনো খবর নেই। অনেক বার তার কথা মনে পড়লেও কল দেওয়ার কথাটা বেমালুম ভুলে গেছে। নিজের কাছেই নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছে।
রুমের দরজা খুলে বিছানা থেকে মোবাইল নিতেই নুসাইব পেছন থেকে বলে উঠলো,,”এতক্ষণে খবর হয়েছে আপনার?”

আকস্মিক ঘটনায় চিৎকার দিয়ে উঠলো তৃধা। হাত থেকে মোবাইল পড়ে গেছে,ভয়ে চেহারার রংটাই বদলে গেছে ।
ভড়কে গেলো নুসাইব। তৃধাযে এতোটা ভয় পাবে সেটা নুসাইবের কল্পনাতেও ছিলো না। তৃধার চিৎকার শুনে ফরিদা হক মোবাইল ফেলে দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলো। সায়রা বানু কিচেন থেকে বেরিয়ে ছুটলো।
নুসাইব বোকার মত তাকিয়ে আছে। তৃধা অবিশ্বাস্য নজরে নুসাইবকে দেখছে। ভয়ে এখনো কলিজা কাঁপছে। ফরিদা হক হড়বড়িয়ে রুমে ঢুকে বললো,, “কি হয়েছে তৃধা?”

নুসাইব অপরাধী চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। ফরিদা হক ছেলেকে দেখে নিজেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। সায়রা বানু বাইরে দাঁড়িয়ে দেখছে সব। তৃধা বুকে হাত দিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,,” হঠাৎ করে ওনাকে দেখে ভয় পেয়ে গেছি।”

ফরিদা হক ছেলের বাহুতে চাপড় মেরে বললো,,” এমন সাঁড়া শব্দ বাদে কেউ ঘরে আসে? মেয়েটা তোকে কল দেওয়ার জন্য রুমে এসেছে। তুই তো ওকে হার্ট অ্যাটাক করিয়ে দিতি।”

নুসাইব অপরাধীর মত তৃধার দিকে তাকিয়ে বলল,,” আরে আমি কি এতো কিছু বলতে পারবো নাকি?আমি ভাবছিলাম হয়তো তোমরা টের পেয়েছো আমি এসেছি।”

ফরিদা হক দাঁতে দাঁত চেপে বললো,,” তোকে তো আসতে দেখলামই না। টের পাবো কখন?পুরো দোতলা জুড়ে কেউ নেই। এইভাবে নিঃশব্দে ঘরে এলে যে কারো কলিজা উল্টে যাবে।”

তৃধা নিজেকে ধাতস্থ করে বললো,,” সমস্যা নেই আম্মু। আমি ঠিক আছি। হঠাৎ গলা শুনে চমকে উঠেছিলাম।”

ফরিদা হক ছেলেকে বকতে বকতে বেরিয়ে পড়লেন। নুসাইব চিন্তিত গলায় সুধোয়,,” তুমি ঠিক আছো?”

তৃধা ফ্লোর থেকে মোবাইল উঠিয়ে বলল,, “হুম ঠিক আছি। মরতে মরতে বেঁচে গেছিলাম। আর অল্পের জন্য আপনি বিধবা হওয়া থেকে বেঁচে গেছেন।”

তৃধার কথা শুনে নুসাইব মুচকি হেসে বলল,,” বিধবা? ঠিক আছে।”

তৃধা মোবাইল ফোন নুসাইবের হাতে দিয়ে বলল,,”মনে হয় আমার জায়গায় মোবাইল মরে গেছে,দেখুন।”

নুসাইব অনেক কষ্টে হাসি চেপে রেখে মোবাইল দেখতে দেখতে বললো,,” প্রোটেক্টর ভেঙে গেছে। বাকি সব ঠিক আছে। অবশ্য বেঁচে থেকেও লাভ কি? এই মোবাইল থেকে আমার মোবাইলে কল যায় না।”

তৃধা ফিরে তাকালো। নুসাইব কল লগ দেখিয়ে বলল,,”আমি কল দিলেও রিসিভ হয়নি,আর তুমি তো একটা কলও দাওনি তৃধা।”

তৃধা ঠোঁট কামড়ে চিন্তিত চোখে তাকিয়ে আছে। আসলেই সে কখনো কল দেয়নি। নুসাইব দিলেও রিসিভ করতে পারেনি কখনো। মোবাইলটা রুমেই পড়ে থাকে সব সময়। তৃধা দ্বিধা সংকোচ নিয়ে বললো,,” আসলে মোবাইল রুমে থাকেতো এই জন্য কল এলেও বলতে পারি না। তাছাড়া আপনাকে কল দিবো দিবো চিন্তা করি কিন্তু কথা খুঁজে পাই না।এই জন্য কল দেওয়া হয় না।”

তৃধার সহজ স্বীকারোক্তি শুনে নুসাইব আলতো হেসে বলল,, “বুঝলাম কথা খুঁজে পাওনা। কিন্তু মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করলেও তো পারো, খেয়েছি কিনা, কোথায় আছি,কি করছি, কখন ফিরবো।”

নুসাইবের কথা শুনে তৃধার মায়া হলো ভীষণ। খারাপ লাগছে নুসাইবের জন্য। এতো ভালোবাসার পরও লোকটা অবহেলা কুড়াচ্ছে। নিজের কাছে নিজেকে ভীষণ ছোট মনে হচ্ছে। নুসাইব নামক লোকটা সমুদ্র সম ভালোবাসে তাকে। সেই ভালোবাসার বিনিময়ে তার এইটুকু চাওয়া দেখে মায়া হচ্ছে তার। তৃধা মলিন হেসে বললো,,” এতো ভালোবাসা আদৌ কি উচিৎ? আপনিতো দেখছি ভীষণ বোকা নুসাইব।”

তৃধার কথায় নুসাইব মুচকি হেসে তৃধার নাকে ডগায় আঙ্গুল ছুঁইয়ে বললো,,” আর তুমি এই বোকা লোকটার স্ত্রী। তোমার জন্য এক আকাশ ভালোবাসাও কম বুঝলে?”

নুসাইবের কথায় তৃধা বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিলো।শুভ্র শিতল বাতাসে আচ্ছাদিত হলো মন মস্তিষ্ক।এই বোকা লোকটাকে আজকাল বড্ড বেশি ভালো লাগে। মায়া পড়ে গেছে ভীষণ। নুসাইব ঠিকই বলেছিলো। থাকতে থাকতে মায়া জন্মে যাবে।তৃধা বুঝে পায় না, এইটা মায়া ,ভালোলাগা নাকি সব মিলিয়ে ভালোবাসা।

তৃধাকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে নুসাইব মনে মনে হাসলো। তৃধার চোখ ভিন্ন কথা বলছে। এমন মায়া মায়া চোখে তাকিয়ে থাকার ব্যাপারটা নুসাইবের কাছে স্পষ্ট। তৃধার চোখ জোড়ায় নিজের জন্য মায়া ভালোবাসা দুটোরই দেখা মিলছে। ব্যক্তিগত রমনির এমন মায়া দৃষ্টিতে নুসাইবের হৃৎপিণ্ড আন্দোলিত হচ্ছে বারংবার।

চোখে চোখ পড়ায় তৃধা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো।লম্বা শ্বাস টেনে বললো,,”হুম, এখন চলুন নাস্তা করে নিবেন। এরপর কথা আছে।”

,,” কি কথা?”

,, গুরুত্বপূর্ণ কথা। এখন নিচে চলুন।”

নুসাইব দেরি করলো না। তৃধার পেছন পেছন যেতে লাগলো।
__________

রাত দশটা। তৃধা নুসাইবের শার্ট প্যান্ট গুছিয়ে রাখছে। নুসাইব অফিসের ফাইল পত্র দেখছে। এর ফাঁকে ফাঁকে তৃধাকে দেখতেও ভুলছে না। এমন সময় তৃধার মোবাইল ফোন বেজে উঠল। তৃধা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। নাম্বারটা সেইভ করা নেই। তাছাড়া এই টা বাইরের নাম্বার, চেনার কথাও না।

নুসাইব ভ্রু কুঁচকে বললো,,” কে কল দিয়েছে?”

,,”চিনি না।”

,,”রিসিভ করে দেখো? পরিচিত কেউ হবে হয়তো।”

তৃধা কল রিসিভ করে মোবাইল কানে চেপে ধরলো।

নুসাইব উঠে দাঁড়ালো।

অপর প্রান্তের ব্যাক্তি হ্যালো বলতেই তৃধা কপাল কুঁচকে বলল,, “তিন্নি আপু?”

তিন্নি কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল,,” হুম,আমি।”

নুসাইব মৃদু হেসে পুনরায় বসে পড়লো।

তৃধা সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করল,,”কেমন আছো আপু?”

তিন্নি কন্ঠে গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললো,,” ভালো। তুমি কেমন আছো? ভাইয়া কই?”

তৃধা নুসাইবের দিকে তাকিয়ে বলল,,আছি আলহামদুলিল্লাহ ভালো। উনি এইতো আছে। কথা বলবে আপু?”

,,” না। তোমার সাথে কথা বলার জন্য কল দিয়েছি। তোমার কি পছন্দ?”

তৃধা বুঝে পায় না কি বলবে। নুসাইবকে ইশারায় ডাকলো। চশমা খুলে রেখে উঠে এলো নুসাইব। তৃধা ফিসফিস করে বলল,,” আমার কি পছন্দ জিজ্ঞেস করছে। এবার কি বলবো?”

নুসাইব মুখ টিপে হেসে বলল,,” কি পছন্দ সেটাই বলো।”
,,” কিছুই না। কি বলবো?”

নুসাইব তৃধার মাথায় হাত রেখে বলল,, “আমি দেখছি, মোবাইল দাও।”

নুসাইব মোবাইল নিয়ে তিন্নিকে উদ্দেশ্য করে বলল,,” যাকে জিজ্ঞেস করছিস সে নিজেও জানে না তার কি পছন্দ। তুই বরং আসার সময় চকলেট নিয়ে আসিস।”

তিন্নি হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বললো,,” নবনীও একই কথা বলেছে। ঠিক আছে তাহলে। পরে কথা হবে। তিন্নি কল কেটে দিয়েছে।

নুসাইব হেঁসে তাকালো তৃধার দিকে। তৃধার কপাল এখনো কুঁচকানো। তা দেখে বললো ,,” এইভাবে কপাল কুঁচকে রাখবে না।”

নুসাইবের কথা শোনা মাত্র আরো বেশি কুঁচকে নিয়ে প্রশ্ন করলো” কেন? কি হয়েছে?”

তৃধার এহেন কাজে হাসলো নুসাইব। অতঃপর গভীর চোখে তাকিয়ে বলল,,” ভীষণ আদুরে লাগে এই জন্য।”

চলবে,,,,

উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ৪৮
,
,
,
,
,
,
,
,
স্বামীর প্রয়োজনীয় সব কিছু গুছিয়ে রুম ছাড়লো তৃধা। ফরিদা হক আর সায়রা বানু ব্রেকফাস্ট তৈরি করতে ব্যস্ত।
এই ফাঁকে তৃধা ফ্রিজ থেকে মাছ মাংস বের করে ভিজিয়ে রাখলো । প্রয়োজনীয় সব কিছু হাতের কাছে গুছিয়ে রেখে, প্রত্যেকটা আইটেমের জন্য বাটা মশলা গুলো আলাদা করে নিলো। মেহমানদের জন্য প্লেট বাটি সব নামিয়ে নিলো। ফরিদা হক ঠায় দাঁড়িয়ে তৃধার কাজ দেখছে। ইতি মধ্যে কিচেনটাকেও নিজের মত করে গুছিয়ে নিয়েছে। সায়রা বানু নিজেও আচম্বিত চোখে তাকিয়ে আছে। এতো সুন্দর করে গুছিয়ে কাজ করতে আগে কখনো কাউকে দেখেনি। তৃধার কাজে মুগ্ধ তিনি। সায়রা বানু টেবিলে নাস্তা দিয়ে পুনরায় ফিরলেন। তৃধা দুজনকে দেখে তাড়া দিয়ে বললো,,” তোমরা যাও আমি সব গুছিয়ে নিয়েছি বেশি সময় লাগবে না। খালা তুমি ড্রয়িং রুমটা গুছিয়ে দিও। আর আম্মু তুমি সবাইকে নিয়ে নাস্তাটা সেরে ফেলো।”

,,” তুইও চল! একা একা খেতে ভালো লাগবে না।”

,,”আমিও আসছি তোমরা যাও আগে। বাবা কোথায় ডাক দাও।”

ফরিদা হক দেরি করলেন না। তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেলেন।

ওয়াশ রুম থেকে বের হতেই নুসাইবের চোখ মুখে হাসি ফুটে উঠল। টাওয়েল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বিছানার দিকে তাকিয়ে শব্দ করে হেসে নিজে নিজে বলে উঠলো,,” বদ অভ্যাস করে ফেলছো তৃধা। এমন গুছানো স্বভাবের লোকটাকে না বিগড়ালে তোমার শান্তি হচ্ছে না? কি করি বলতো?”

বিছানায় সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে রাখা নুসাইবের পরিধেয় পোষাক সমেত প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। তৃধা নিজে পছন্দ করে রেখে গেছে। টাই, ঘড়ি,ওয়ালেট, ব্রোঞ্জ থেকে শুরু করে পারফিউম সবই সাজিয়ে রাখা। তার পাশে ফাইল দুটো রেখে গেছে। নুসাইব তৈরি হচ্ছে কিন্তু তার চেহারা থেকে হাসি রেখা সরছেই না। পছন্দনীয় রমনী দিন দিন তার বদঅভ্যাসে পরিনত হচ্ছে। বদঅভ্যাস যা সহজে বদলানো যায় না। নুসাইব টাই বাঁধতে বাঁধতে বিড়বিড় করে বলে উঠলো,,”এই বদঅভ্যাসে শাস্তি কি দেওয়া যায়? হুম ,তোমার আর বাপের বাড়ি বেড়াতে যাওয়া হবে না। গেলেও আর থাকা হচ্ছে না। সকালে গেলেও বিকেলে ফিরতে হবে। প্রয়োজনে ওই মেজরের সাথে যু**দ্ধ হবে। তাও তোমার নিস্তার নেই বধুয়া।”

তৈরি হয়ে নিচে নেমে এলো নুসাইব। ফরিদা হক বসে আছে। তিনি খাচ্ছে কম কিচেনের দরজার দিকে তাকাচ্ছে বেশি। নাবীব শেখ রুটি ছিঁড়ে মুখে পুরে নিজের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছে।নুসাইব গলা ঝেড়ে বললো,,” আম্মু তৃধা কই? খেয়েছে কিছু?”

ফরিদা হক ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,,” কই আবার! কিচেনে। খাওয়া দাওয়া রেখে মেহমানের জন্য রান্নাবান্না করছে। মাশাআল্লাহ, নুসাইব এতো গুছিয়ে কাজ করে যে কি বলবো। আমার তো মনে হচ্ছে ওর থেকে সব পুনরায় শিখতে হবে।”

মায়ের মুখে স্ত্রীর প্রশংসা শুনে বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিলো নুসাইব।ভালো লাগা রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে তার। বউটা আসলেই ভীষণ লক্ষ্মী।

নাবীব শেখ ভ্রু গুটিয়ে টিপ্পনী কেটে বললো,,” শিখতে তো হবেই। তুমি কাজ পারো নাকি? আমি আর আমার সন্তানরা কোনো রকম খেয়ে পড়ে বেঁচে আছি। দেখে দেখে শেখো তৃধা থেকে।”

স্বামীর কথায় ফরিদা হকের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। তিনি দাঁতে দাঁত চেপে বললো,,” কোনো রকম খেয়ে পড়ে বেঁচে আছো? ওহে্ আচ্ছা। এখন কিছুই বলবো না। সময় আমারও আসবে। তখন না খাইয়ে রাখবো।”

নুসাইব ঘড়িতে সময় দেখে তৃধাকে ডেকে উঠে। তৃধা হাতের কাজ ফেলে বেরিয়ে এলো। ঘামে পুরো মুখ ভিজে আছে। গালের দুপাশ আর নাক লাল হয়ে গেছে। নুসাইব শান্ত চোখে তাকিয়ে দেখছে তৃধাকে। একদম বউ বউ অবতার তৃধার। যদিও শাড়িটার অভাবে সবটা পূর্নতা পাচ্ছে না। তাও কম সুন্দর লাগছে না বউটাকে।

চেয়ার টেনে নুসাইবের পাশে বসতেই নুসাইব শাসনের সুরে বলে উঠলো,,” ব্রেকফাস্ট না করে খালি পেটে এতো কিসের কাজ তোমার। নিজেকে দেখেছো? নবনী থেকে তোমাকে ছোট মনে হয়।”

নুসাইবের কথায় ফরিদা হক আর নাবীব শেখ একমত। তৃধাকে আসলেই পিচ্চি লাগে। শুকিয়ে গেছে অনেক।

তৃধা বাচ্চা বেড়ালের মত চুপচাপ কথা শুনছে। ফরিদা হক নুসাইবকে উদ্দেশ্য করে বলল,,” দুপুরের ভাত খাওয়া দেখলে অবাক হয়ে যাবি। ওর চেয়ে বেশিতো ছোট বাচ্চারা খায়। এখন নাস্তার পর আর কিছুই মুখে তুলবে না। ঘরে ফল টল রেখে লাভ নেই। মেয়েটা ওসব ধরেও দেখে না।”

নুসাইব কপালে ভাঁজ ফেলে তৃধার দিকে তাকিয়ে বলল,,” খাও। একদম খাওয়া দাওয়ার অনিয়ম করবে না।”

তৃধা মাথা নেড়ে খাওয়া শুরু করলো। এই পরিবারের কারো শাসনে তৃধা মন খারাপ করে না। বরং এদের শাসন তার ভীষণ পছন্দ। এই শাসন তাকে বুঝিয়ে দেয় সে এই পরিবারের একজন সদস্য। যাকে তারা একটু বেশিই আপন করে নিয়েছে।

খাওয়া শেষে ফরিদা হক উঠে কাজে লেগে পড়লেন। নাবীব শেখ ও বসে নেই। ফরিদা হকের দেওয়া লিষ্ট নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। তৃধা শব্দহীন ভাবে খাচ্ছে। নুসাইব তৃধার দিকে তাকিয়ে বলল,,” রাগ করলে?”

নুসাইবের কথায় তৃধা খাওয়া বন্ধ করে তাকায়।নুসাইব পুনরায় জিজ্ঞেস করল,,” রাগ করেছো?”

তৃধা মৃধু হাসলো। বললো,,” রাগ করবো কেন?”

,,”বকাঝকা করলাম তাই।”

,,” ভালোর জন্যই তো বললেন। রাগ করব কেন?”

নুসাইব মুচকি হেসে বলল,,”আমি চললাম। অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

তৃধা তড়িঘড়ি করে জিজ্ঞেস করল,,” মিটিংটা কি বেশি জরুরী? সমুদ্রের মা-বাবা আসবে। থাকলে ভালো হতো না?”

,,” জরুরী না হলে যেতাম না। তাছাড়া তুমিতো আছোই আমার অবর্তমানে, সামলে নিও।”

,,”লাঞ্চ টাইমে তো আসবেন?”

নুসাইব কয়েক সেকেন্ড থেমে বললো,,” বলতে পারছি না। না আসার সম্ভাবনা বেশি। বাইরে থেকে খেয়ে নিবো।”

তৃধার কিছুটা মনক্ষুণ্ণ হলো। এতো এতো রান্না করবে কিন্তু এই মানুষটার খাওয়া হবে না।বিয়ের পর এই প্রথম এতো সব নিজ হাতে করছে।

স্ত্রীর মন খারাপ দেখে নুসাইবারে ভালো, খারাপ দুটোই লাগছে। কারো জন্য খারাপলাগা, ভালোগা ব্যাপার গুলোই ভালোবাসার সৃষ্টি করে। তৃধার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ব্যতিক্রম নয়। নুসাইব জানে এই রমনী তাকে পছন্দ করে ,মায়া করে। জড়তার কারণে তা এখনো অপ্রকাশিত। নুসাইব মুচকি হেসে তৃধার মাথায় হাত রেখে বলল,,” আমি বেরুচ্ছি আল্লাহ হাফেজ।”

নুসাইবের এই ব্যাপারটা তৃধা সবচেয়ে বেশি পছন্দ। আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় কথা বলা। যা তৃধার মনে উষ্ণতা ছড়িয়ে দেয়। তখন তৃধার মনে হয় নুসাইব নামক মানুষটা আস্ত একটা ভালোবাসা। যাকে আঁকড়ে ধরে একটা জিবন অনায়াসে পার করে দেওয়া যায়। এই মুহূর্তে তৃধার ঠিক তেমনটাই মনে হচ্ছে। তৃধা চোখে ঠোঁটে হাঁসি ফুটিয়ে বললো,,” সাবধানে যাবেন। পৌঁছে একটা মেসেজ দিবেন,ফি-আমানিল্লাহ।”

নুসাইব মাথা নেড়ে বেরিয়ে পড়লো।আজ মনে হচ্ছে এই শহরে সবচেয়ে সুখী যদি কেউ থাকে সেটা সে নিজে। তৃধার বলা কয়েকটা কথায় যেন নুসাইবের পুরো পৃথিবী খুশিতে ভরে উঠল। ভালোবাসা সুন্দর। আসলেই ভালোবাসা ভীষণ সুন্দর।

সমুদ্রের মা-বাবা দুপুর করেই এলো। খাওয়া দাওয়া শেষ করে আলোচনায় বসলো তারা। তৃধা মোবাইল হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে কিচেনে। তার এখনো খাওয়া হয়নি। ফরিদা হক আর সায়রা বানু বারবার বলেও খাওয়াতে পারলেন না। তারা হাল ছাড়লেন। শেষে সায়রা বানু নিজেও খেয়ে নিলেন। তৃধা দ্বিধা সংকোচ নিয়ে মেসেজ টাইপ করছে, আবার ডিলিট করছে। এরপর সাহস করে কল দিয়ে বসলো।

কনফারেন্স রুমে বসে আছে নুসাইব। লাঞ্চ ব্রেক পেরুলেও মিটিং শেষ হয়নি। নুসাইব ঠিক সময়ে আসলেও যারা আসার কথা তারা জ্যামের কারনে প্রায় আড়াই ঘণ্টা লেইট করে এসেছে। প্রথমে মেজাজ খারাপ হলেও পরক্ষনে এই কথা জানতে পেরে আর কিছুই বললো না।
এইদিকে রুমেলের পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে। পারলে সামনে বসা সাদা চামড়ার মানুষ চারটাকে এক্ষুনি খে*য়ে ফেলতো। কিন্তু পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিলো। এদের দোষ নেই, দোষ সব যানজটের। ইংরেজ গুলো থোড়াই না জানে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকলেও গাড়ি নয় দশ হাত ছাড়া সামনে এগোবে না।
নুসাইব ওনাদের সাথে প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা করছে। এর মধ্যে মোবাইলখানা ভাইব্রেট করে উঠলো। একটা সময় ছিলো যখন নুসাইব কনফারেন্স রুমে মোবাইল এলাউ করতো না। কিন্তু যেদিন থেকে তৃধার জন্য মোবাইল কেনা হয়েছে সেইদিন থেকে নিজেই নিয়ম ভেঙে মোবাইল নিয়ে এসেছে। মিটিংএর মাঝে মাঝে মোবাইল ফোন চেক করার ব্যাপারটা প্রায় সবারই চোখে পড়েছে। যদিও আজ পর্যন্ত কল মেসেজ কোনোটাই আসেনি। আজ হঠাৎ মোবাইলের ভাইব্রেশনে চমকে উঠলো রুমেল। নুসাইব তাড়াহুড়ো করলো না। বরং ধীরে সুস্থে মোবাইলটা হাতে তুলে নিয়ে নামটা পড়লো। রুমেল পেছন থেকে উঁকি দিয়ে ‘ Wifey’ লেখা দেখে মুখ টিপে হাসলো।

নুসাইব সবার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,, sorry, my wife is calling. l need to answer.

এর মধ্যে একজন হেসে বলল, yes, of course.

নুসাইব হড়বড়িয়ে কনফারেন্স রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।
অন্যদিকে তৃধার কপালে ঘাম চিকচিক করছে। কল দেওয়ার উচিত হয়েছে কি হয়নি ভাবতে ভাবতে নুসাইব কল রিসিভ করে নিলো।

ওপাশ থেকে হ্যালো বলতেই তৃধার বুকটা ধক করে উঠল। নুসাইব উৎকণ্ঠা হয়ে জিজ্ঞেস করল,,” তৃধা শুনছো?”

তৃধা নিজেকে ধাতস্থ করে মাথা নেড়ে বললো,,” হুম শুনছি।”
তৃধার কথায় নিঃশব্দে হাসলো নুসাইব। দুজনের মধ্যে কিছু সময়ের নিরবতা চললো। তৃধা সেই নিরবতা ভেঙ্গে বলে উঠলো,,” দুইটা বেজে গেছে, আপনি আসবেন না? লাঞ্চ করেছেন?”

তৃধার প্রশ্নে কাঁচের দেয়ালে পিঠ ঠেকালো নুসাইব। ঠোঁট জোড়া প্রশস্ত করে হাসলো। অতঃপর রয়েসয়ে বলে উঠলো,,” না করিনি। দেরী হবে। তুমি খেয়েছো? দুইটাতো বেজে গেছে।”

তৃধা থেমে থেমে বললো,,” না। এখনো খাওয়া হয়নি। আন্টি , আংকেলে খাওয়া শেষ হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। ফিরতে কি বেশি দেরি হবে?”

,,” তুমি খেয়ে নাও। আমার ফিরতে দেরী হবে। হয়তো ডিনার একসাথে করবো।”

তৃধা ছোট করে বললো,”ওহ্।”

নুসাইব গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বললো,,” কিছু লাগলে বলো। আমি নিয়ে আসবো।”
তৃধা ফটাফট বললো,,” কিছু লাগবে না। সবই আছে।”
নুসাইব শব্দ করে হেসে বললো,,” ঠিক আছে। তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও রাখছি।”

তৃধা মুচকি হেসে বলল,” হুম। আপনিও।”

তৃধার কথায় নুসাইব কল কেটে হাঁসি মুখে কনফারেন্স রুমে ঢুকলো।

তৃধা মুচকি হেসে মোবাইল ফোন রেখে প্লেটে খাবার বেড়ে নিলো। হুট করে চারপাশে সব কিছুতে কেমন ভালো লাগা ছেয়ে গেছে। অদ্ভুত এক প্রশান্তি বয়ে চলেছে মন মস্তিষ্ক জুড়ে। হয়তো এইটাই সেই মায়া , ভালোবাসা যেটার কথা নুসাইব বলেছিল। তৃধা লাজুক হেসে কিচেন তাকের উপর বসে পড়লো। পা দুলিয়ে হেলেদুলে খাচ্ছে। সায়রা বানু প্লেট নিয়ে কিচেনে ঢুকতে গিয়ে থামলো। তৃধাকে দেখে মৃধু হেসে সেখান থেকে সরে গেলো।

বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করা হলো। ঠিক পনেরো দিন পর বিয়ে। সবার কাজ ,ছুটি ,পরীক্ষা, পড়ালেখা সবদিক দেখে বিচার বিবেচনা করে দিন নির্ধারণ করেছে।

চলবে,,,,,