আমি মায়াবতী পর্ব-১০

0
419

#আমি_মায়াবতী
#পর্ব_১০
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা

মায়া
মা আমার। আমার মায়াবতী মা। তুমি এই চিঠিটি পড়ছো মানে আমি আর তোমার কাছে নেই। শুধু তোমার কাছেই নয়, পুরো দুনিয়াতেই নেই। আমি জানি তুমি ভালো নেই। আমাকে ছাড়া তুমি ভালো থাকতে পারো না। কারণ, তোমার দুনিয়া ছিল আমাকে ঘিরেই। আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি মা। আমি আশা করবো, তুমি তোমার নতুন পরিবারে ভালো আছো। শোনো মা, তুমি যেখানে গিয়েছো, সেখানে কেউ তোমাকে সহজে মেনে নিবে না। মেনে নেওয়ার কথাও নয়। তাদের জায়গায় আমরা থাকলেও আমরা সেটাই করতাম। কারণ, আমরা মানুষরা এমনই। বাবাকে ভীষণ খারাপ মনে হয় তাইনা মা? মনে হয় যে বাবা কেন শুধু এই পরিবারকেই গুরুত্ব দিয়েছে? কিন্তু বাবা কিন্তু মোটেও খারাপ না। বিশ্বাস হয় না? চলো তোমাকে একটা গল্প বলি।

এক জায়গায় ছিল এক রাজা। রাজা তার রানী আর রাজকুমার নিয়ে অনেক সুখে শান্তিতে বসবাস করছিল। রানীকে রাজা নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসতো। আর রাজকুমার? সে তো ছিল বাবার দুইচোখের মণি। কিন্তু সবদিন কি আর একরকম যায়?রাজকুমারের বয়স যখন সাত বছর, তখন তার মা বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায়। রাজা কিছুদিন পাগলের মতো থাকে। কিন্তু আর কতদিন? একসময় সে আবারও একটা রানী নিয়ে আসে। নতুন রানী রাজকুমারকে ভীষণ ভালোবাসতো। কিন্তু দিন যত যেতে লাগলো, সেও পরিবর্তন হতে লাগলো। তার নিজের যখন আরেকটা ছেলে হলো, তখন যেন রাজকুমারের কোনো কদরই ছিল না। রাজাও তখন তার নতুন রানী আর রাজকুমারকে নিয়ে ব্যস্ত। মা মরা রাজকুমারের দিকে খেয়াল রাখার সময় কই তার? এইভাবে ধীরে ধীরে রাজকুমার সবার অনাদরে, অবহেলায় বেড়ে উঠতে লাগলো। রাজার কাছে তখন তার থাকা আর না থাকা সমান। একসময় পরিস্থিতি এমন হলো যে রাজকুমার বাধ্য হয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে আসলো। ছোট্ট একটা কুঁড়েঘরে তার আশ্রয় জুটলো। এখন রাজকুমারটা নিজের সব কাজ নিজেই করে। আপন বলে দুনিয়ায় আর কেউ নেই তার। কিন্তু একসময় একজন আসলো। সে আরেক রাজকুমারী। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম তার। ভালোবেসে রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ি ছেড়ে সে চলে আসলো রাজকুমারের কুঁড়েঘরে। এতোদিন তো তবু রাজকুমার একাই ছিল। এখন তার প্রেয়সী তার কাছে। তাই সে বের হলো কাজের সন্ধানে। আরেক রাজ্যের রাজকুমারীর কাজে সে নিয়োগ হলো। রাজকুমারীর বড় বোন রাজকুমারকে প্রথম দেখাতেই ভালোবেসে ফেললো। ধীরে ধীরে তার ভালোবাসা বাড়তে লাগলো। রাজকুমারী বুঝলো, রাজকুমার তার জন্য নিষিদ্ধ। কিন্তু রাজকুমারীর মন তা বুঝলো না। তার যে রাজকুমারকেই চাই। যেকোনা মূল্যে তাকে চাইই চাই। তাই সে ছলনার আশ্রয় নিল। ছলে বলে কৌশলে নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিল রাজকুমারের কাছে। প্রথমে রাজকুমার নিজেকে দোষারোপ করলেও পরে বুঝতে পারে সেটা রাজকুমারীর প্রতারণা। সে রাজকুমারীকে বিষাক্ত সাপ বলে আক্ষায়িত করে।সে রাজকুমারীকে বিয়ে করলেও নির্বাসন দেয়। ততোদিনে রাজকুমারীর গর্ভে বেড়ে উঠছে রাজকুমারের সন্তান। একা একেলা রাজকুমারী নিজের গর্ভের সন্তানকে জন্ম দেয়। তাকে লালন পালন করে একা হাতে৷ জানো তো মায়া, সেই রাজকুমারীর সন্তান কে? সেই সন্তান হচ্ছো তুমি৷ বিষাক্ত সাপের কন্যা। কিন্তু আমি তোমাকে আমার মতো করে বড় করিনি। তুমি আমার মতো হবে না মা। আর এখন তুমি যেখানে গিয়েছো, সেখানে সবাই ভালো। অন্তত আমার চাইতে ভালো। আমি বিশ্বাস করি, ওরা তোনাকে খুব তাড়াতাড়ি আপন করে নিবে। কারণ, তুমি যে মায়া৷ আমার মায়াবতী রাজকন্যা। কেউ তোমাকে ভালো না বেসে থাকতেই পারবে না।

মা আমার, আমাকে মাফ করে দিও। তোমাকে জন্ম দেওয়ার জন্য আমাকে মাফ করে দিও। আমার একটা ভুল কতগুলো মানুষের জীবন নষ্ট হয়েছে, এখন বুঝতে পারছি। আমি সবচেয়ে বেশি অপরাধী তোমার বাবা আর তোমার কাছে। মানুষটাকে আমি ১৭ বছর শান্তিতে থাকতে দিই নি। প্রতিনিয়ত সে জ্বলন্ত আগুনে পুড়ছে। তোমার বাবাকে বলো আমাকে ক্ষমা করে দিতে।

মায়াবতী মা আমার, আমাকে ক্ষমা করে দিও। নিজের খেয়াল রেখো। তোমার বাবার খেয়াল রেখো। কারো সাথে হিংসা করোনা মা। তারা যা পাচ্ছে, সেটা তাদের প্রাপ্য। আর তুমি যেটুকু পাবে, সেটুকু তোমারই প্রাপ্য।

ভালো থেকো, মায়াবতী মা আমার।
ইতি
তোমার দুর্ভাগ্যবতী মা।
আমি স্থানুর মতো বসে রইলাম ফ্লোর এ। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। আমার মাকে আমি দেখেছি সারাজীবনে এক ওয়াক্ত নামাজও সে কাজা করেনি। পরপুরুষদের সামনে যায়নি। সেই মায়ের অতীত নাকি এতোটা নোংরা। এটা কোন মায়ের কাহিনি পড়লাম আমি? আমি চোখ বন্ধ করে রইলাম। ভাবলাম এরপর চোখ খুলবো, আর দেখবো যে আমি স্বপ্ন দেখছি। কিন্তু অতীতকে তো আর পরিবর্তন করা যায় না। চোখ খুলেই দেখলাম চিঠিটি তখনও আমার হাতে। ইচ্ছে হলো চিৎকার করে কান্না করতে। কিন্তু পারলাম না। নিজের জন্মটা যেখানে পাপ, সেখানে কান্না কিভাবে আসবে? অল্প শোকে মানুষ যেমন কাতর হয়ে যায়, আর অধিক শোকে পাথর, আমার অবস্থাও হলো ঠিক সেইরকম।
★★★

“আমি তো তোমার আপনজন। তাইনা? আমাকে বলোনি কেন এতোদিন কিছু?” নির্লিপ্ত গলায় প্রশ্ন করলো সাগরিকা।
“মায়ার মা মায়ার দিব্যি দিয়েছিল আমাকে। আমাকে বলেছিল সে বেঁচে থাকতে যেন তোমাকে কিছু না জানাই। তাই তোমাকে কিছুই বলতে পারিনি।”
“আমরা সব কিছু ভুলে যাবো রিজভী। সব কিছুই।ভাববো যে এইরকম কিছুই হয়নি। সবকিছুই আমাদের কল্পনা ভাববো।”
” শুধু আমাদের ঘর আলো করে মায়া একটা বাস্তব সত্য।”
সাগরিকা মাথা নিচু করে ফেলে। নিচু স্বরে বলে,” আমার ওকে মেনে নিতে সময় লাগবে। কিন্তু ও যেহেতু তোমারই অংশ, আমি ওকে আজ না হয় কাল মেনে নিবই। আর সাবিহার এই ব্যবহার করাটাই স্বাভাবিক। তার উপর তুমি আবার মায়াকে ওর স্কুলেই ভর্তি করে দিয়েছো। ওকে তোমার সময় দেওয়া উচিত ছিল মায়াকে মেনে নেওয়ার জন্য।”
“আজ না হয় কাল, সবাই সত্যটা জানতোই। তাই আমি সাবিহাকে আগে থেকেই প্রস্তুত করছি।”
” তবুও তুমি ভুল করেছো। আগে যদি ও মায়াকে মেনে নিত, তবে বাইরের মানুষ যাই বলুক না কেন, ও পাত্তা দিত না। কিন্তু এখন বাইরের মানুষের রাগটা ও মায়ার উপরেই ঝাড়ছে। মায়ারও সাবিহার প্রতি খারাপ একটা ধারণা জন্মাচ্ছে। ”
রিজভী কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলে,” হয়তো তুমি ঠিক৷ কিন্তু এখন কিছুই করার নেই। সামনে মায়ার পরীক্ষা। এখন ওকে আর স্কুল চেঞ্জ করাতে পারবো না আমি।”
দুজন আবারও নিরব হয়ে যায়। কারো মুখে কোনো কথা নেই। নিরবতা ভেঙে রিজভীই বলে,”আমি গত ১৮ বছর ধরে তোমার সাথে সংসার করছি। কিন্তু শান্তি পেয়েছি শুধু একটা বছর। বাকি ১৭ টা বছর আমি ভয়ে ভয়ে কাটিয়েছি সাগরিকা। আমার একটা সকাল ও আমি তোমার সাথে মনখুলে কাটাতে পারিনি। সকালে ঘুম ভেঙে তোমার মুখের রিয়্যাকশন বোঝার চেষ্টা করেছি। অফিস টাইমে তুমি কল দিলে তোমার গলার স্বরে আশংকা খুঁজেছি। বাসায় ফেরার পর তুমি দরজা খুলে দিলে ভেবেছি এই বুঝি তুমি সব জেনে গেছো। আমার ১৮ বছরের সংসার জীবনের ১৭ বছর কেটেছে আতংকে। আমি তোমাদের যত্ন করেছি,ভালোবেসেছি অনিশ্চিতভাবে। আমি প্রতিদিন রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে ভাবতাম আজকের রাতের পর সকালের সূর্যোদয়টা কি আমার পক্ষে হবে? নাকি বিপক্ষে? আমি ভেবেছি আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলবো। বাচ্চাদের হারিয়ে ফেলবো। সবটা সময় আমি আমাদের জীবন আর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয়ে থেকেছি। তুমি জানো না, আমি কি কষ্টগুলোই না করেছি এতো বছর ধরে। সাগরিকা,আমাকে মাফ করবে? আমার ভুলের জন্য? আমরা আবার আগের মতো করে সব শুরু করবো।আমি জানি, তুমি মায়াকে একদিন না একদিন মেনে নিবেই। আমি জানি, ওর মায়ের করা খারাপ কাজের জন্যই এতোকিছু। কিন্তু দিনশেষে ও আমারও মেয়ে। ওকে মেনে নিয়ে আবার সবকিছু শুরু করতে পারবে?”
” তোমার অনেক আগেই বলা উচিত ছিল এইসব। তাহলে এতোগুলো দিন তোমাকে কষ্ট করতে হতো না।”
“বাবা।”
সাগরিকা আর রিজভী দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে তাদের সামনে মায়া দাঁড়িয়ে আছে। দুজনেই একটু হকচকিয়ে যায়। মায়া তাদের সামনে এসে দাঁড়ায়।সাগরিকার হাত ধরে বলে,” আম্মা, আমার মাকে ক্ষমা করে দিয়েন আম্মা। সে মৃত মানুষ। তাকে ক্ষমা করে দিয়েন। তারউপর কোনো অভিযোগ রাইখেন না আম্মা। সে তার ভুলের শাস্তি ১৭ বছর ধরে পেয়েছে।”
মায়া তার বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,” আমার মাকে ক্ষমা করে দিও বাবা। সে তোমাকে অনেক ভালোবাসতো। ভুল সময়ে ভুল মানুষকে ভালোবেসে সে তোমার যতোটা না ক্ষতি করেছে, তার চাইতেও বেশি ক্ষতি করেছে তার নিজের। তুমি ঠিকই বলেছিলে বাবা, মেয়ে হয়ে আমি তাকে ক্ষমা করলেও, নারী হয়ে করতে পারবো না।”
মায়ার কি হলো হঠাৎ সে জানে না। তার বাবার পায়ের কাছে বসে তার পা জড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলে,” আমার মাকে ক্ষমা করে দিও বাবা। ক্ষমা করে দিও। ”

চলবে….