#আমি_যে_কে_তোমার
(সূচনা পর্ব)
থানার হাজতখানার নোংরা পরিবেশে লাল টুকটুকে বেনারসি পরা ভীষণ নিষ্পাপ দেখতে একটা মেয়ে হাঁটুর উপর মাথা রেখে বসে আছে। চোখের কোণা দিয়ে অশ্রু শুকিয়ে আছে। বোঝায় যায় বেশ কান্নাকাটি করেছে। মাথার উপরে সোনালী কাজ করা জরির পাতলা ওড়না। তার ফাঁক দিয়ে কয়েক গোছা এলোমেলো চুল বের হয়ে মেয়েটার মুখে কপালে লেপ্টে আছে। হাতে কাঁচের চুড়ি, নাকে নতুন পরা নাকফুল। নাক ফুটানো বোধ হয় অনেক আগেই। বহুদিন পরে নাকফুল পরানোতে জায়গাটা একটু লাল ফোলা ফোলা।
কপালে ইমিটেশনের টিকলি, কানেও ইমিটেশনের কানের দুল। গলায় শুধু সরু স্বর্ণের একটা চেইন।
হাজতখানায় দুইজন ছিঁচকে চোর, একজন ইয়াবা নিয়ে ধরা পড়া নেশাখোর আর ভাসুরের সাথে জমি জমা নিয়ে মারামারি করে মাথায় কোপ দেয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত এক মহিলা রয়েছে। পুরনো থানার ভবন। হাজতের ভেতরের মেঝের রঙ আসলেই কি ছিলো বোঝা যায় না। নানান রঙের ময়লায় কাদা গোলার মতো রঙ সেখানে। দেওয়ালে পানের রস, কষ, চুন, রক্তের দাগ, নানান আঁকিবুকি, মা বোন নিয়ে কয়েকটা বিশ্রী গালি আর কিছু অভাগার কষ্টের ইতিহাস লেখা।
বিশ্রী অন্ধকারাচ্ছন্ন হাজতখানা আর লাল টুকটুকে বেনারসি – অদ্ভুত কম্বিনেশন! মেয়েটার নাম মারিয়া। নতুন বউ। স্বামীর সাথে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় জায়গা হলো থানায়। কারণ ঐ এক কোণে বসে থাকা ইয়াবাখোর সাদ্দাম। ওর সাথেই তো মারিয়ার বিয়ে হয়েছে। বিয়ের গাড়িতে মানুষ শ্বশুরবাড়ি হতে উপহার নিয়ে যায় আর সাদ্দাম নিয়ে যাচ্ছিলো ইয়াবার বড় একটা চালান। বিয়ের গাড়ি, কেউ সন্দেহ করবে না। কিন্তু পুলিশের এক সোর্স থানায় খবর দেয়। এই সোর্স সাদ্দামের পুরাতন পার্টনার। টাকা পয়সার ভাগাভাগি নিয়ে ওদের মধ্যে গন্ডগোল হয়। সাদ্দাম তো ওকে মারধোর করেই তার উপরে এক চালান মাল দিয়ে পুলিশে ধরিয়ে দেয়। অনেকদিন জেল খেটে বের হয়েছে। এখন পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করে আর মনে জ্বলে প্রতিশোধের আগুন।
আজ একদম পারফেক্ট সময়ে সাদ্দামকে ধরিয়ে দিয়ে বহুদিন পরে পেট ভরে ভাত খেয়েছে দেশী মুরগীর ঝোল আর আলু দিয়ে। তারপর ভাত ঘুম।
মারিয়া অভাগিনী। পাঁচ বছর বয়সে মা হারা হয়েছে। সৎ মায়ের সংসারে গালাগালি খেয়ে মানুষ। তবুও দাদীর জন্য ইন্টার পর্যন্ত পড়তে পেরেছে। কিন্তু তার পরেই এই বিয়ে। সৎ মায়ের ভাই এই সম্বন্ধ আনে। পরিবারের আর কারো সাধ্য নেই সেই সম্বন্ধকে না করার।
হঠাৎ করেই মারিয়ার যেন ধ্যান ভঙ্গ হয়।
– এই মেয়ে এখানে কেন? কি সমস্যা?
থানার পরিবেশ নিমিষেই কেমন চঞ্চল হয়ে উঠে। এক হাবিলদার হাজতখানার পাশে ঝিমাচ্ছিলো। দুপুরে ভাত একটু বেশিই খাওয়া হয়ে গেছে, এজন্য ঘুমই তাড়াতে পারছিলো না।
হাবিলদারের চোখের ঘুম উধাও। ওসি তো সন্ধ্যার আগে থানাতেই আসে না। সে শার্ট গায়ে জড়াতে জড়াতে হাজির। বিড় বিড় করে বলতে থাকে – নতুন নতুন চাকরিতে আইছে, গরমে বাঁচা যাবে না! কয়দিন থাকো তখন একবারে পানির লাহান ঠান্ডা হয়ে যাবা৷
দুই চোরে কানাঘুঁষা করে।
– হইছে টা কি?
– অগোর উপ্রের স্যার আইছে।
– তুই এতোডা জানোস ক্যামনে?
– আইতে যাইতে জানা হই গেছে।
ফিচ ফিচ করে চাপা হাসাহাসি করে।
– স্যার এই মেয়ের বিয়ে হইছে ঐ ব্যাডার লগে। কিন্তুক ব্যাডা তো নেশা করে। রাত দিন হয় গাঞ্জা, না হয় বাবা খায়া পড়ে থাকে। হিরুইনের নেশাও আছে। আজ কাইল আবার প্যাথোডিনও ধরছে। খায় তো খায় আবার ব্যবসাও শুরু করছে। বিয়ার গাড়িতে কইরা মাল নিয়া যাইতেছিলো, ধরা খাইছে।
– হুম, কিন্তু মেয়েটা কি করলো?
– মাইয়াডা কিছু করে নাই। একই প্রাইভেটে ছিলো স্বামীর লগে এখানে আনা হইছে৷ মাল তো পাওয়া গ্যাছে গাড়ি থেকে।
– হুম। কিন্তু মেয়ে তো আর এসব খায় না, ব্যবসাও করে না তাহলে ধরে রেখেছেন কেন?
মারিয়া চোখ তুলে এই স্যারকে ভালো করে দেখার চেষ্টা করে। নেমপ্লেটে লেখা – আমান। লম্বা, সুদর্শন, কিন্তু চেহারা কিছুটা তামাটে হয়ে আছে আর অসুস্থ হলে যেমন রোগা দেখায়, তেমন রোগা রোগা লাগছে। চেহারায় একটা দৃঢ়তা আছে আর চোখ দুটোর দৃষ্টি এমন যেন ভেতর পর্যন্ত পড়তে পারবে।
– স্যার, মাইয়াডার কেউ আসে না। ফুন দিয়েও কাজ হয় নি। মুচলেকা, বন্ড কিছু তো একটা নেয়া লাগে।
– কেন? আপনি যখন মোটামুটি নিশ্চিত যে সে কোন অন্যায়ের সাথে জড়িত না তাকে কেন বন্ড দিতে হবে? যান ছেড়ে দেন।
– কিন্তুক স্যার যাইবোডা কই? অর বাপ মায়ে ফুন ধরে না।
যেন বিরাট জব্দ করতে পেরেছে এমনভাবে তাকিয়ে কথা বলে অফিসার ইন চার্জ মাসুদ হোসেন। তার কন্ঠের মধ্যে এমন মজা করে বলার ভাব বুঝতে পেরে কটমট চোখে তাকায় এ এস পি আমান আহসান।
ভীষণ ঠান্ডা গলায় বলে
– আগে হাজতখানা থেকে বের করেন। বাকিটা আমি বুঝবো।
(চলবে)