#আমি_যে_কে_তোমার
(৩য় পর্ব)
আমানের মাথা গরম, থানার একটা রেজিস্ট্রারও ঠিকঠাক মেইনটেইন করা নেই। এটা নিয়ে ঝাড়ি দেয়ার জন্য বেল বাজাতে যাবে এমন সময় ওসি মাসুদ এনজিও এর লোক নিয়ে হাজির হয়।
আমান ব্যস্ত হয়ে পড়ে মারিয়ার বিষয় নিয়ে। থাকার ব্যবস্থার বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলে। পড়ালেখা নিয়েও দুই একটা কথা বলে, মারিয়াকে নিয়ে যেতে বলে।
মারিয়া এরই মধ্যে মুখ ধুয়ে কাপড় পাল্টে এসেছে৷ চেহারা পুরোই চেঞ্জ হয়ে গেছে৷ ক্লান্তির চিহ্ন অনেকটাই নেই। আরো কম বয়সী লাগছে। মারিয়ার চেহারায় একটা স্নিগ্ধতা আছে, নিষ্পাপ একটা ছায়া আছে। আমানের মায়া লাগে। পুলিশের মতো নীরস চাকরি করতে এসে মায়া থাকাই হয়তো ঠিক না। কিন্তু তবুও পুলিশের মধ্যেও কিছু মানুষের মনের মাঝে শুকিয়ে যাওয়া ছোট্ট নালার মতো মায়া বয়ে যায়।
মারিয়াকে এনজিও প্রতিনিধির কাছে দিয়ে সব ফর্মালিটি পূরণ করে। মেয়েটা চলে যায়, ওর সদ্য বিয়ে করা স্বামী তখনো জেলে বসে রয়েছে।
– এই লোকটার জন্য রিমান্ডের আবেদন করবেন। কোথা থেকে এসব মালামাল আনে জানা দরকার। বিয়ে করতে যেয়েও এই ব্যবসা ছাড়তে পারে নি, কি একটা অবস্থা।
– যে স্যার। হেরা পারে না এমন কিচ্ছু নাই।
থানার রেজিস্ট্রার বাদ দিয়ে আমান অন্যদিকে মনোযোগ দেয়াতে ওসি মাসুদ খুব খুশি হয়।
আমানের কেন যেন আর মন ভালো লাগে না। গাড়িতে উঠে পড়ে। ড্রাইভারকে সরাসরি বাসার দিকে যাওয়ার আদেশ দেয়।
মারিয়ার মনে হয় সবকিছু স্বপ্নের মতো দ্রুত ঘটে গেলো। ওর বিয়ে, পুলিশ আসা, ওদের থানায় আসা আবার এভাবে ছাড়া পাওয়া।
সেফহোমে যখন পৌঁছায় তখন রাত হয়ে গিয়েছে। সেফহোম খুব বেশি বড় না। আরো দশজন মেয়ে থাকার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু আছে মাত্র পাঁচজন। যে যার মতো আছে। এ এস পির রিকমেন্ডেশনে আসার কারণে মারিয়া মোটামুটি ভালো একটা রুম পেয়েছে।
বিছানায় শুয়ে আকাশ পাতাল ভাবতে থাকে মারিয়া। এরপর? কি হবে? কিভাবে কাটবে জীবন জানে না।
এসব নানান রকম ভাবতে ভাবতে রাত পার হয়। সকালে হঠাৎ করেই ঘুম ভাঙে। প্রথমে তো বুঝতেই পারে না, কোথায় আছে, কেন আছে। তারপর আস্তে আস্তে সব মনে পড়ে। এই সেভহোমের নিচেই ক্যান্টিন। সেখানে যায়, আহামরি খাবার না। কিন্তু জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই এই প্রথম মারিয়া কোন কাজ করা ছাড়াই খাবার খাচ্ছে৷ ঠিক বেলা দশটার দিকে মারিয়াকে অফিস রুমে ডাকে। ভয়ে ভয়ে সেদিকে যায়, থানার হাজতখানায় বসে থাকার সেই সময়টা মারিয়ার মন থেকে সহজে যাবে না।
বিশ্রী নোংরা পরিবেশ, দাগী আসামী, কারো কারো গা ঘিন ঘিন করা তাকানো – এসবের কথা মনে হলে প্রতি মুহূর্তে আতংক লাগে।
অফিসে গেলে ওর ভর্তির ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলো। ওর পড়াশোনা কত দূর কি, শুনতে চাইলো। সব কথা শেষ করে মারিয়া ফিরে আসলো আবার সেই নিজের বরাদ্দ করা ঘরে৷ চুপচাপ শুয়ে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে রইলো। জানে না ওর ভবিষ্যৎ কি।
একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং চলছে, এর মাঝেই আমানের পারসোনাল মোবাইলটা ভাইব্রেট করে উঠলো। এনজিও কর্মকর্তার নাম্বার। কি মনে করে এনজিও অফিসারকে এই নাম্বার দিয়েছিলো তা জানে না। থানায় দেখা মেয়েটার কোন বিষয়ে কথা বলবে কিনা কি জানি! – মনে মনে ভাবে আমান। কিন্তু এখন ফোন রিসিভ করা যাবে না। ফোনটা কেটে দেয়, পরে ব্যাক করবে।
মিটিং শেষ হতে হতে রাত প্রায় নয়টা। দেশের যুবসমাজের সামগ্রিক চিত্র খুব খারাপ। নানান রকম মাদকে দেশ ভরে গেছে। চারিত্রিক অধ:পতন হচ্ছে নানা ভাবে। এই কারণে বেড়ে গেছে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রেপের মতো ঘটনা। এসবই ছিলো আজকের মিটিং এর বিষয়বস্তু। আমানের খালি মনে হয়, পারিবারিক শিক্ষাটা ঠিকমতো হচ্ছে না। সন্তান যাই বলে, যাই আবদার করে বাবা মা তাই শোনে, এটা বখে যাওয়ার অন্যতম কারণ। এর সাথে স্কুল কলেজের পড়াশোনা থেকেই তেমন কিছু শিখতে পারছে না। এদিকে আবার হাত বাড়ালেই নেশা দ্রব্য। অল্পতেই হতাশ হয়ে যাওয়া কিশোর এবং যুব সমাজ নির্দ্বিধায় এই নেশাকেই বেছে নিচ্ছে।
মিটিং শেষ করে আমান ফোন দেয় এনজিও অফিসারকে। সে খুব গদ গদ কন্ঠে জানায় – থানা থেকে উদ্বার হওয়া মারিয়া মেয়েটা খুব মেধাবী। বাড়ির সকল প্রতিকূল পরিবেশ সত্ত্বেও এস এস সি এবং এইচ এস সি তে বিজ্ঞান বিভাগে এ প্লাস। মেয়েটা তো পড়তে চায়, কিন্তু এই এন জিওদের সেই ধরণের কোন ফান্ড নেই।
আমানের বুকটা যেন জ্বলে উঠে। মায়ের কথা মনে পড়ে। এসব মেয়েদের নিয়েই উনি কাজ করতেন। আল্লাহ যে কেন এতো দ্রুত মৃত্যু দিলেন, তা বুঝতে পারে না। আমান মায়ের মৃত্যুর পরেও তার ভালো কাজগুলো ধরে রেখেছে। মায়ের নামেই ফাউন্ডেশন – শর্মিলী আহসান ফাউন্ডেশন। সেখান থেকেই মারিয়ার বৃত্তি চালু করার ব্যবস্থা করে। পড়ুক পেয়েটা, নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখুক।
বাড়ি ফিরতে হবে আমানের। ঠিক এই সময়টাই ওর কাছে ভালোই লাগে না। মনে হয়, বাড়ি না ফিরতে পারলেই যেন বেশি ভালো হতো! সেখানে কেউই নেই, কোনো মায়া নেই, ভালোবাসা নেই। আছে শুধু এক রাশ শূন্যতা আর একাকিত্ব।
(চলবে)