#আমি_যে_কে_তোমার
(১৪ তম পর্ব)
আমান ক্রাচে ভর দিয়ে বন্ধ দরজাটার সামনে এসে একটু থমকে দাঁড়ায়। বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস নেয়। অনেক দ্বিধা দ্বন্দ্ব ঝেড়ে আমান আজ এই দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তবুও নক করতে যেয়ে থেমে যায়। আবার মনের সব শক্তি একত্র করে নিজেকে স্থির করে নক করে – ঠক, ঠক।
ভেতর থেকে ভারী কন্ঠের আওয়াজ শোনা যায়।
– কাম ইন। খোলাই আছে।
ক্রাচে আরেকটু ভর দিয়ে আরেক হাত দিয়ে একটু একটু করে দরজাটা খুলে টাইলসের ফ্লোরে ক্রাচের খ্যাস খ্যাস শব্দ তুলে ভেতরে ঢোকে। তখন শেষ বিকেল, সূর্য লাল হয়ে আস্ত যাবে। সেই স্বল্প আলোতে আমানের শরীরের ছায়া কেমন দীর্ঘ দেখায়। আমান তাকিয়ে দেখে দরজার ঠিক উল্টো দিকে বড় জানালার পাশে একটা কাঠের চেয়ারে যিনি বসে আছেন, তার হাতে একটি বই। বই খোলা কিন্তু উনার দৃষ্টি জানালার বাইরে। যেখানে বেশ কয়েকটি চারা আমগাছ লাগানো। তার পরে মূল ফটক আর ফটকের বাইরে ব্যস্ত রাস্তা।
যিনি বসে আছেন, উনার বয়স হঠাৎ করে বোঝা যায় না। ৬৫ থেকে ৭০ এর মধ্যে হতে পারে। ঋজু শরীর, মেদহীন। পরিপাটি পোষাক। কিন্তু চোখ জোড়ায় যেন রাজ্যের বিষন্নতা।
– আসো, বিছানায় বসো তাতে তোমার সুবিধা হবে।
নজর না ঘুরিয়েই কথাগুলো বললেন। আমান আস্তে আস্তে বিছানায় যেয়ে বসলো। সাবধানে ক্রাচটা রাখলো৷
– বহুদিন ধরেই এই সময়ের প্রতীক্ষায় ছিলাম। যেন কত যুগ ধরে, ভেবেছিলাম এই সময় বুঝি আসবে না। কিন্তু ভাগ্য ভালোই মনে হয়, জীবিত থাকতেই সেই সময়ের দেখা পেলাম!
– কেন প্রতীক্ষায় ছিলেন?
– মনের ভার কমাতে। তোমার মায়ের মৃত্যুর পরে তুমি খুব ভেঙে পড়েছিলে এবং সেটা সবাই জানে। সবাই তোমাকে সান্ত্বনা দিয়েছে, তোমার পাশে থেকেছে। কিন্তু আমি ভুগেছি অপরাধবোধে। শর্মিলী মানে তোমার মা কখনোই আমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করে নি। আমার প্রতি তার অনেক অভিমান ছিলো কিছুটা বুঝতাম। কিন্তু এভাবে অসময়ে না বলে চলে যেয়ে আমাকে যে এতো বড় শাস্তি দেবে তা বুঝি নি। অনুশোচনার আগুনে পুড়ে যাচ্ছি৷ আমি সেই থেকে শাস্তি পাচ্ছি না আমান, আমার মন সব সময় জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। আমি ২৪ ঘন্টা ধরেই তার কাছে ক্ষমা চাই।
– কিন্তু আমাকে তো কখনোই কিছু বলেন নি!
– তোমার চোখে আমার প্রতি কেমন যেন ঘৃণা দেখেছি, তোমার মায়ের মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী এমন কিছু দেখেছি! বাবা হিসেবে সব সহ্য করা যায়, কিন্তু সন্তানের ঘৃণা সহ্য করা যায় না।
– এজন্যই বুঝি হাসপাতালে আমাকে চুপিচুপি দেখতে যেতেন? আমি যখন অজ্ঞান অবস্থায় ছিলাম, হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাঁদতেন?
– তোমাকে এসব কে বললো?
– কে বললো সেটা বুঝি খুব জরুরী? বাইরে দাঁড়িয়ে এভাবে না কেঁদে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে পারেন না বাবা? আমার বুকের মধ্যেও তো মরুভূমি হয়ে আছে। মা নেই, আপনি থেকেও নেই! আমার জীবনই যে মরুভূমি হয়ে গেছে বাবা!
আমানের চোখ বেয়ে অঝোরে জল ঝরতে থাকে। আমানের পিতা রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার তার সব ইগো, অভিমান ভুলে গিয়ে দৌড়ে যেয়ে আমানকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরেন।
আমান বাবার গায়ের গন্ধ ভুলে গিয়েছিলো। আজ কতকাল পরে যেন আবার সেই গন্ধ খুঁজে পায়। অনেক অনেক বছর আগে আমান যখন ক্লাস থ্রি তে পড়ে, তখন ওর স্কুলের এক বাচ্চা ওকে খুব মারে। আমান খুব নরম ছিলো, মাইর খেয়ে চোখ মুখ ফুলায়ে বাসায় ফিরে আসে। সেই সময় ঘটনাক্রমে ওর বাবা বাসায় ছিলন। আমানকে ঠিক এইভাবে জড়িয়ে ধরেছিলেন আর মিলিটারি মেজাজে চিৎকার করে বলেছিলেন – কার এতো বড় সাহস আমার ছেলের গায়ে হাত দেয়? আমার ছেলেকে কাঁদায়!
আমানের মনে হলো বহু কাল পরে যেন বাবার সেই ভালোবাসা, আশ্রয় সে খুঁজে পেয়েছে।
মারিয়া মেয়েটার প্রতি কৃতজ্ঞতায় ওর মন ভরে যায়। সেদিন মাঠ থেকে ফিরিয়ে রুমে নিয়ে এসে মারিয়া বলে ছিলো
– আপনার বাসায় চলে যাওয়া উচিৎ।
– আমার বাসার কোন কিছুই তুমি জানো না।
কিছুটা বিরক্ত হয়ে আমান জবাব দেয়। আমানের পারিবারিক জীবন ওর দূর্বল জায়গা। এই বিষয়ে ও কারোর সাথেই কথা বলতে চায় না। কেউ অহেতুক আগ্রহ দেখালে আমান বিরক্ত হয়, বিব্রত হয়।
আমান তখন হুইল চেয়ার থেকে উঠে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিচ্ছিলো। মারিয়া ধীরে ধীরে কেবিনের জানালার কাছে যায়। খোলা জানালার দিকে মুখে করে বহু দূরে দৃষ্টি মেলে বলতে থাকে
– আপনার একজন বাবা আছেন যিনি আপনার অজ্ঞান মুহূর্তে হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদেন। আপনি ঘুমিয়ে থাকলে চুরি করে দেখে যান। আপনাদের মধ্যে কিসের এতো দ্বন্দ্ব, কিসের এতো কষ্ট জানি না। কিন্তু আপনার একজন বাবা আছেন যিনি আপনার জন্য লুকিয়ে হলেও কাঁদেন – এটাই আমার কাছে বিরাট ব্যাপার মনে হয়। আমি তো জানি কেউ না থাকার কষ্ট। আর এই হাসপাতালে দিনের পর দিন মানুষের জীবন দেখতে দেখতে বুঝে গিয়েছি – জীবন কত তুচ্ছ, অভিমান কতো বিলাসিতা!
মারিয়ার কথায় আমান কোন উত্তর দেয় না। মারিয়া চলে যায়। সারা রাত বহুত চিন্তা করে পরেরদিন রিলিজ নিয়ে বাসায় আসে। তারপর আজ এই মুহূর্তে বাবার বুকের মধ্যে মাথা দিয় কাঁদছে আমান, এক অপার্থিব শান্তি অনুভব করছে।
(চলবে)
#আমি_যে_কে_তোমার
(১৫ তম পর্ব)
আমানের সামনে ওর মামী শামীমা জামান রাগান্বিত অবস্থায় বসে আছেন। কিন্তু আমান ততোটা গুরুত্ব দিচ্ছে না। আমানের হাতে এডগান অ্যালান পো এর একটি অরিজিনাল হার্ডকাভার বুক। সেটা নিয়েই নাড়াচাড়া করছে। মামী কিছু বলছেন আমান বুঝতে পারছে কিন্তু তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না।
– আমান, আমি তোমাকে কিছু বলছি।
কিছুটা রাগান্বিত স্বরে শামীমা বলে উঠেন।
– জি মামী কি বলছেন ঠিক বুঝতে পারছি না!
– না বোঝার কিছু নাই আমান। তুমি এতো বড় মাপের গোয়েন্দা আর আমার এই সরল বাংলা বোঝ না? এতোদিন তোমার বাবা ঝামেলা ছিলো, তোমার বাসার পরিবেশ ভালো ছিলো না – এসব বলেই তো বিয়ে করো নি। এখন তো মোটামুটি সেসব সমস্যা নেই। তোমার বাবাই বরং আমাকে ডেকে অনেক অনুতপ্ত হয়ে কথা বলেছেন আবার অনুরোধও করেছেন যেন তোমাকে বিয়ে করতে বলি। তোমার মামার সাথেও নিজের সব ইগো ভেঙে কথা বলেছে, কান্নাকাটি করেছেন। এখন তাহলে সমস্যা কি আমান?
– একটু কি দেরি হয়ে গেলো না মামি? এদিকে বয়স তো বসে নেই।
– দেখো কে কখন অনুতপ্ত হবে, নিজের ক্রুটি বুঝতে পারবে এটা বলা মুশকিল। তোমার বাবা তবুও অনুতপ্ত হয়েছেন অনেক মানুষ তো ‘আমিই ঠিক আছি’ এমন একটা অহং নিয়েই দুনিয়া ছাড়ে। আর উনি দীর্ঘদিন ধরেই নিজের ভেতরে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছিলেন। তোমারও তো উচিৎ ছিলো বাবার কাছে যাওয়া। সেই হিসেব করলে তো ইগোর সমস্যা তোমারও ছিলো। যাই বলো না কেন, উনি তোমার বাবা এটা কোন অবস্থাতেই ভোলা উচিৎ না! আমান আমি যতোদূর জানি তোমার বয়স ৩৩/৩৪, ৫০ বছর তো আর হয় নি। তাহলে মেয়ে পাবে না, এমন ভাবছো কেন? আমি তো মেয়ে ঠিকই করে ফেলেছি।
– কাকে?
চমকে উঠে হাতের বই রেখে সোজা হয়ে বসে আমান। মামা, মামী আর বাবা এক জোট হলে ঠেকানো মুশকিল। না জানি কাকে পছন্দ করলো!
– কেন ঐ ডাক্তার মেয়েটা। তোমাকে যে জান প্রাণ দিয়ে সেবা করলো!
– ওহ, মারিয়া!
– নাম মনে নেই। কিন্তু মেয়েটা বেশ মিষ্টি আর লক্ষী। আমার খুব পছন্দ হয়েছে।
– বিয়ের আগে সব মেয়েকেই এমন মিষ্টি আর লক্ষী মনে হয় মামী। আসল ঝামেলা হয় বিয়ের পরে। মারিয়া হয়তো কৃতজ্ঞতা বোধ থেকেই আমার জন্য করেছে। এখানে বিয়ের প্রস্তাব দেয়া বাড়াবাড়ি হবে মামি!
– তুমি না তুখোড় গোয়েন্দা আমান? কিন্তু তোমার মাথায় তো বুদ্ধি নাই। আসলে ছেলে মানুষের চোখে কম দেখে। তোমার প্রতি ওর এমন নিবেদিত প্রাণ আন্তরিকতা দেখেও বোঝ নি? ওর চোখ দেখেও কিছু বুঝতে পারো নি? কি আশ্চর্য!
– মামি, বয়সের গ্যাপটা বুঝতে পারছেন না? ও আমার থেকে অন্ততঃ ৮/৯ বছরের ছোট। এ্যাডজাস্ট করতে পারবে কিনা জানি না। কষ্ট হবে।
– আমি তো তোমার মামার ১০ বছরের ছোট। কই আমাদের তো প্রবলেম হয় না। আর নীলার কথাই চিন্তা করো। ক্লাসমেট বিয়ে করলো, কিন্তু টিকলো না তো।
শামীমা জামানের কন্ঠ রোধ হয়ে আসে। উনার আদরের বড় মেয়ে নীলা। প্রেম করে ক্লাসমেটকে বিয়ে করে। কিন্তু কিছুদিন পর থেকেই অশান্তি, গন্ডগোল। বাধ্য হয়ে ডিভোর্স। এখন মেয়েটা দেশের বাইরে। মাস্টার্সের একটা কোর্স করছে।
– এজন্যই বলছি আমান বয়সের গ্যাপ সমস্যা না। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসাই বড় কথা। বিয়েটা তো একটা জুয়া খেলার মতো। সুখি হবে কি হবে না, আগে থেকে বোঝা মুশকিল। ওর সাথে কথা বলে দেখো। তুমিও যে মেয়েটাকে পছন্দ করো, আমি বেশ বুঝতে পারি।
আমান চুপ করে থাকে। মামির কথা ভাবতে থাকে। মারিয়ার সাথে একটা খোলামেলা আলাপ দরকার। কিন্তু হঠাৎ করেই এই আলাপ করা কঠিন। কিছুদিন দেখা সাক্ষাৎ হলে একে অপরকে বুঝতে সুবিধা হতো।
আরো কিছুদিন পরে। আমান এখন সুস্থ। মারিয়া মাঝে মাঝেই ফোন দিয়ে শারীরিক অবস্থার খোঁজ নেয়। দুই এক মিনিট করে কথা বলে। একদিন আমান মেডিকেলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মারিয়াকে ম্যাসেজ দেয়- খুব বিজি?
মারিয়ার এই রোস্টারে ডিউটি ছিলো না। হোস্টেলেই ছিলো। তড়িৎ উত্তর দেয় – না তো স্যার। ফ্রি আছি।
পরের ম্যাসেজ – পাশ দিয়েই যাচ্ছিলাম। এক কাপ চা কি একসাথে খেতে পারি?
মারিয়া চমকে উঠে। ও হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। আমানের মতো রোবট তাকে চা খাওয়ার নিমন্ত্রণ জানাচ্ছে! তড়িঘড়ি করেই উত্তর দেয় – জি অবশ্যই।
ওপাশ থেকে উত্তর – রেডি হয়ে আসো। মেইন গেইটে আছি। টেক ইয়োর টাইম।
মারিয়ার প্রথমেই মনে হয় – কি পরবো? একটা লাইট ইয়োলো রঙের থ্রি পিচ বের করে দ্রুত পরে ফেলে। চুলগুলো ছেড়েই রাখে। কপালে ম্যাচিং টিপ আর লিপস্টিক সাথে কাজল।
দ্রুত জুতোয় পা গলিয়ে নিচে নেমে যায়।
আমান ড্রাইভারকে আনে নি। অন্য কোন কাজ না, আসলে মারিয়ার সাথে দেখা করতে এসেছে। মারিয়াকে তো আমান পছন্দ করেই। দেখা সাক্ষাৎ করতেই আসা। কিন্তু সেটা বললে মারিয়া যদি হ্যাংলা ভাবে!
হালকা হলুদে মারিয়াকে যেন ফুলের মতোই সুন্দর লাগছে। মেয়েটাকে দেখে আমান হার্ট বিট মিস করে। নাহ, এই বয়সে এসেও এমন তোলপাড় আবেগ মানায় না – নিজেকে নিজেই শাসন করে আমান।
আমান পরেছে সাদা ফরমাল শার্ট, হাতা কিছুটা গুটিয়ে ভাঁজ করে রাখা। লম্বা হ্যান্ডসাম আমানকে মেডিকেল স্টুডেন্টরা বিশেষ করে হবু ডাক্তারনীরা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার লোভ সংবরণ করতে পারছে না।
– মারিয়া, কেমন আছো?
– জি স্যার ভালো আছি।
– গাড়িতে উঠো।
নীরবে কিছুক্ষণ ড্রাইভিং করলো আমান।
– আচ্ছা মারিয়া, আমি কি তোমার টিচার?
– না তো!
হঠাৎ এমন প্রশ্নে মারিয়া অবাক হয়।
– তুমি তো আমার অধীনে চাকরিও করো না, তাই না?
– না
– তাহলে স্যার কেন বলো?
– আচ্ছা বললাম না, তাহলে কি বলবো?
– আমার একটা নাম আছে, আমান।
মারিয়া আমানের কথা বলার স্টাইলে হেসে ফেলে। মারিয়া জানালার গ্লাস খুলে দিয়েছিলো। বাইরের বাতাসে ওর খোলা চুল উড়ে চোখে মুখে লেপ্টে যায়। হাত দিয়ে সেটাই সামলাতে সামলাতে হেসে ফেলে। আমান আড়চোখে এই অপার্থিব সুন্দর দৃশ্য দেখে আর ভাবে – মনের দ্বিধা সংকোচ দূর করে কি ভালো লাগার কথা জানিয়ে দেবে?
(চলবে)
#আমি_যে_কে_তোমার
(১৬ তম পর্ব)।
শহর ছাড়িয়ে হঠাৎ একটা নদী, কেমন যেন গ্রামীণ পরিবেশ৷ বাতাসটাই অন্য রকম। আকাশটাও বেশ নীল। সেখানে নদীর ধারে একটা বটগাছ। তার পাশেই কয়েকটা খাবারের দোকান আর চায়ের দোকান।
– তোমাকে চা খাওয়াতে চেয়েছি এজন্য এখানে আনলাম। ভালো কফি শপ ছেড়ে এখানে আসায় আবার মন খারাপ করো না!
– কি যে বলেন! জায়গাটা খুব সুন্দর। শহরের কাছেই এমন দারুণ জায়গা আছে জানতামই না।
আমান গাড়িটা পার্ক করে চায়ের দোকানে এসে বসে। আমানের সাথে মারিয়াও এসে বসে। এখানে একটা বাঁশের বেঞ্চ মতো আছে৷ প্লাস্টিকের চেয়ারও আছে৷ তবে ইচ্ছা করেই ওরা বাঁশের বেঞ্চে বসেছে।
– ও মামা আপনার স্পেশাল চা দেন, দুই কাপ।
– জ্বে স্যার, দিতাছি।
– আপনি বুঝি প্রায়ই এখানে আসেন?
মারিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে আশপাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে জিজ্ঞাসা করে৷
– প্রায় আসার তো সুযোগ পাই না। কিন্তু যখন কিছু ভালো লাগে না, মন শান্ত করতে এখানে আসি। তবে কোনো মেয়েকে নিয়ে আজই প্রথম আসলাম।
– আজ বুঝি মন খারাপ?
– নাহ, আজ বরং মন ভালো। কোনো মেয়েকে নিয়ে আসতে পারলাম! তাও আবার ডাক্তার মেয়ে, পথে ঘাটে অসুস্থ হলে, অসুবিধে হলে কোনো চিন্তা নেই।
এটা বলে নিজের রসিকতায় নিজেই হো হো করে হাসতে থাকে আমান। মারিয়া লজ্জা পেয়ে যায়৷
– আচ্ছা মারিয়া, জীবন নিয়ে তোমার ভাবনা কি? এই ধরো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা?
কিছুক্ষণ নদী আবহাওয়া এসব হাবিজাবি বিষয়ে কথা বলার পরে সদ্য তৈরি হওয়া ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপে একটু চুমুক দিয়ে আমান জিজ্ঞাসা করে।
মারিয়া একটু চমকে উঠে। ওর যেন জিহ্বা পুড়ে যায়। আমান তাকে শুধু শুধু বেড়াতে নিয়ে যাবে না, এমনটা মারিয়া বোঝে। যদিও আমান মারিয়াকে এখানে আনায় মারিয়া অবাকই হয়েছে৷ কারণ আমানের এক্সিডেন্টের পরে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকে আমানের আচার আচরণ, ভাবভঙ্গি বলে দেয়, আমান নিজেকে আড়ালে রাখতে চায়। মারিয়ার থেকে দূরে থাকতে চায়৷
– কোন চিন্তা নেই। যেভাবে যাচ্ছে যেতে থাক। ইন্টার্নী শেষ হলে কয়েকটা ডিপ্লোমা কোর্স করবো ভাবছি। তাতোদিনে সনদও রেডি হয়ে যাবে। দূরে মফস্বলের কোন ক্লিনিকে যোগ দেবো – এই তো৷
– সে কী মারিয়া? তুমি এফ সি পি এস করবে না? কিংবা বিসিএস দেবে না?
– না স্যার, সরি স্যার বললে মাইন্ড করেন।
একটু হাসলো মারিয়া। তারপরে আবার বলা শুরু করলো-
এফসিপিএস করার জন্য দীর্ঘ সময় দরকার আবার বিসিএস এর জন্যেও একই কথা। তার জন্য তো পায়ের তলায় শক্ত মাটি প্রয়োজন। ইন্টার্নী শেষ হলে হোস্টেল ছেড়ে দিতে হবে। তারপরে তো আরেক জীবনযুদ্ধ শুরু হবে – এই কথাটুকু বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মারিয়া৷
মারিয়ার হাতের চা অনেকটাই ঠান্ডা হয়ে গেছে। এক চুমুকে খেয়ে ফেলে।
– আপনার জীবনের ট্রমার বিষয়ে আমি কিছুটা জানি। আপনার মায়ের হঠাৎ মৃত্যু আপনি মেনে নিতে পারেন নি। আপনার বাবা যেমন নিজেকে এই ব্যাপারে দায়ী মনে করেছেন ঠিক তেমনি আপনিও আপনার বাবাকেও দায়ী মনে করেছেন। আপনাদের মধ্যে দূরত্ব হয়েছে, অভিমান হয়েছে। কিন্তু দেখুন তবুও আপনাকে আমার অনেক ভাগ্যবান মনে হয়। আপনার একজন বাবা আছেন যিনি আপনার জন্য লুকিয়ে হলেও কাঁদেন। আর আমার ভাগ্য দেখেন!আমার বাবা থেকেও নেই, আমার এই পৃথিবীতে আপন বলতে কেউই নেই! সবাই যখন ঈদে বাড়ি যায়, আমি তখন একা হোস্টেলের পুরাতন দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকি। হোস্টেলের দুধহীন অতিরিক্ত চিনি দেয়া সেমাই খাই আর ভাবি তবুও তো এটুকু পাচ্ছি! সেদিন যদি থানা থেকে বের হতে না পারতাম!
মারিয়া থেমে যায়। ওর কন্ঠ ভেজা ভেজা। আমানের খুব মন খারাপ হয়। জীবনের এদিকটা ভেবে দেখাই হয় নি। আমরা জীবনে কী পাই নি সেটা নিয়েই এতো বেশি ভাবি যে কি পেয়েছি সেটা নিয়ে একদমই ভাবি না!
– মারিয়া, জীবনে তো একজন সঙ্গীর প্রয়োজন। এই বিষয়ে কিছু ভাবো নি?
– সবই এখন হিসেব করে হয় – প্রেম বিয়ে সম্পর্ক। আমার তিন কূলে কেউ নেই, এখনো ক্যারিয়ার গড়ে উঠে নি। আমার মতো এম বি বি এস পাশ করা ডাক্তার শত শত। আমাকে কে বিয়ে করবে বলেন? বড়জোর টাইম পাস হতে পারে। আর বেশি কিছু নয়। আবার আগের একটা বিয়ের কলংক লেগে আছে৷
– কিন্তু আগের বিয়ের ক্ষেত্রে তোমার তো কোনো দোষ নেই!
– সেটা না হয় আপনি জানেন। আর তো কেউই জানে না।
– আমি জানি বলেই যদি আমিই তোমাকে আমার সঙ্গী হিসেবে পাশে থাকার প্রস্তাব দিই? রাজী হবে?
মারিয়া ভীষণ রকম চমকে উঠলো। ঠিক এভাবে সরাসরি বলাটা প্রত্যাশা করে নি। চুপ করে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকলো। মাথার মধ্যে তখন নানান কথার তোলপাড়।
– দেখো মারিয়া, আমি পুলিশ এতো লুকোছাপা পারি না। তোমাকে পছন্দ করি, তোমার নিষ্পাপ চেহারা, আন্তরিকতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। ভাববে যে আমি সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করছি, বয়স্ক একজন হয়ে অল্প বয়সী মেয়েকে জীবনসঙ্গী হওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছি৷ এটা ভেবেই আমি এতো দিন কিছুই বলি নি, বরং দূরে থাকারই চেষ্টা করেছি। পরে ভেবে দেখলাম তুমি আমাকে গ্রহণ করো বা না করো সেটা ভিন্ন বিষয় কিন্তু আমার ভালোলাগাটা জানাতে না পারলে আজীবন আফসোস থাকবে।
আমান একসাথে অনেক কথা বলেই থামলো। বেলা প্রায় শেষের দিকে। শেষ বিকেলের কণে দেখা আলো পড়ছে মারিয়ার মুখে। মারিয়াকে ভীষণ মায়াবী লাগছে। কিন্তু মারিয়া চিন্তিত।
– আপনি যেকোন মেয়ের জন্য আরাধ্য। এমন কিছু বয়স আপনার হয় নি। কিন্তু আমি তো জীবনে বাস্তবতা দেখি, আপনার সামাজিক মান মর্যাদা আর আমার পারিবারিক অবস্থান, মান মর্যাদা এক না। এখন ব্যাপারটা কিছু মনে না হলেও ভবিষ্যতে এটা বড় আকার ধারণ করতে পারে। আবার আপনার বাবাও ভীষণ অভিজাত্য নিয়ে চলেন। সব মিলায়ে প্রস্তাবটা কতোটা বাস্তবসম্মত বুঝতে পারছি না!
মারিয়া যে আমানকে এভাবে বলে ফিরিয়ে দিতে পারে আমান কস্মিনকালেও ভাবে নি। মারিয়াকে গাড়িতে উঠতে বলে বের হয়ে যায়৷ আমানের মাথায় তখন নানান
রকম চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে!
(চলবে)