#আমি_যে_কে_তোমার
(শেষ পর্ব)
সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা খালেদ হোসেন ভীষণ করিৎকর্মা অফিসার। ওর একটা মারাত্মক ধরণের গুণ হলো একদম ঠান্ডা মাথার মানুষ আর কোনো কিছুতেই অবাক হয় না। এই যেমন রাত দশটার সময় আমান মারিয়াকে নিয়ে উপস্থিত। এসেই বলেছে, কাজি ডেকে আনার জন্য, এই রাতেই ওরা বিয়ে করবে!
এই কথা শুনে যে কারো চোখ কপালে উঠতে পারে। কিন্তু খালিদের চোখ মুখে কোন ভাবান্তর হলো না। যেন রাতের বেলায় থানায় বিয়ে হওয়া কোনো ব্যাপারই না। এমন বিয়ের আয়োজন প্রতি রাতেই হয়!
না, থানায় বিয়ে নতুন কোনো ঘটনা না। মাঝে মধ্যে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়। কিন্তু আমানের মতো কোনো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার মফস্বলের থানায় বিয়ে হওয়া আশ্চর্যজনক ঘটনা বটে!
কিন্তু এতো ওসি খালেদ, ওর কাছে কিছুই আশ্চর্য না কিছুই অসম্ভব না। আমান যদি কাজীকে ডেকে আনতে না বলে আকাশের চাঁদ পেড়ে আনতে বলতো খালেদ একটু মাথা চুলকে বলতো – ‘স্যার, একটু কঠিন হবে তবে আমি বিষয়টা দেখছি!’
এখন এই কাজী ডাকা তো কোনই ব্যাপার না খালিদের কাছে। এস আই মুহিবকে আর কনস্টেবল রিমিকে সাথে নিয়ে বের হলো। মুহিব জানে প্রয়োজনে কাজী ব্যাটাকে পাজাকোলা করে তুলে নিয়ে আসবে খালেদ স্যার!
আধাঘন্টা পার হয়ে গিয়েছে, এরপর চল্লিশ মিনিট। ওসি খালেদের খবর নেই। থানায় থাকা অন্য পুলিশ সদস্যরা কিছুটা কানাঘুষা করছে। চরম বিব্রতবোধ করছে মারিয়া। যদিও সে ওসির রুমে বসে আছে। যেখানে আমান ছাড়া অন্য কেউ নেই। কিন্ত এখনো ঠিক বুঝতে পারছে না, কি হতে যাচ্ছে এবং এখানে এই মুহূর্তেই কেনো হতে যাচ্ছে!
আমানের কাছে যে কিছু জিজ্ঞাসা করবে সেই অবস্থা এখানে নেই। কারণ আমান সমানে রুমের এ মাথা ও মাথা পেছনে হাত বেঁধে হেঁটে চলেছে মনে হচ্ছে সারাদিন সে শারীরিক কসরত করতে ভুলে গিয়েছিলো, এখন হেঁটে হেঁটে সেটা পুষিয়ে নিচ্ছে!
আসলে ব্যাপারটা ঠিক তেমন না মোটেও। আমানের নিজেই কেনো যেন টেনশন লাগছে। ঝোঁকের মাথায় মারিয়াকে নিয়ে থানায় আসলো, এখন ব্যাপারটা ঠিক কেমন হলো বুঝতে পারছে না। মনের মধ্যে দুই রকম কথা চলছে। এক মন বলছে
– আমান কাজটা ঠিক হলো না। সার্ভিসে তোমার সুনাম আছে, এখন তো সবাই হাসাহাসি করবে!
অপর মন তখনই বলে উঠছে
– হাসাহাসি করলে করবে। নিজের মানসিক শান্তি নিজের কাছে। মারিয়াকে আর হারাতে চাই না। আফসোস নিয়ে, একাকীত্ব নিয়ে আর নিজের একজন মানুষের তীব্র অভাব নিয়ে বাঁচতে চাই না!
এভাবে নানান কথোপকথনে যখন প্রায় এক ঘন্টা হওয়ার পথে তখন মানুষজন নিয়ে বেশ হৈ চৈ করে ওসি খালেদ তার দলবল সহ ঢুকলো। কিন্তু ওদের কাজকর্ম দেখে আমান মারিয়ার চক্ষু চড়কগাছ!
ওসি খালেদ শুধু কাজীকেই সাথে আনে নাই। তার সাথে বিয়ের বাজার – শেরোয়ানী, শাড়ি, চুড়ি, ইমোটেশনের গহনা, কিছু ফুল, ফুলের মালা, মিষ্টি এমনকী কাচ্চির প্যাকেট নিয়ে হাজির৷
– কাহিনী কি খালেদ? এতো কিছু তো আনতে বলি নাই!
– স্যার, বিয়ের জন্য এটুকু না করলে হয় না!
– কিন্তু এসব পাইলা কই?
– স্যার, দোকানদারদের ঘুম থেকে টাইনা তুইল্যা আনছি আর কাচ্চি তো স্টেশনের হোটেলে রাত দিন ২৪ ঘন্টা পাওয়া যায়!
মুহিব খুব উৎসাহের সাথে তাদের এই বীরত্ব সূচক অভিযানের বর্ণনা দেয়!
আমান আর মারিয়া পুরাই থ! ওরা বিয়ে করতে এসে এদের সারপ্রাইজ দেবে কি, ওদের কর্মকান্ডে উল্টো নিজেরাই পুরো শকে চলে গিয়েছে!
ওসি খালেদ কনস্টেবল রিমিকে চোখের ইশারাই কি যেন বলতেই সে প্যাকেট খুলে শাড়ি এবং তার সাথে প্রয়োজনীয় কাপড়ের ব্যাগ আলাদা করে বাকিটা আমানের হাতে দেয়।
– স্যার, আপনি সেকেন্ড অফিসারের রুমে গেলে ম্যাডাম এখানে রেডি হতে পারতো।
বিনীতভাবে খালিদ আমানকে বলে। আমান দ্রুত ধাতস্থ রুম থেকে বের হয়ে আসে।
আরো মিনিট বিশেক পরে রিমি ওসির দরজা খুলে সবাইকে আসতে বলে। এদিকে আমান শেরোয়ানী পাগড়ি পরে রেডি। ওসির রুমে ঢুকে মারিয়ার দিকে তাকাতেই আমান যেন ধাক্কা খায়। মেরুন রঙের বিয়ের শাড়িতে, চুড়িতে আর হালকা মেকাপে মারিয়াকে পুরো অপ্সরীর মতো লাগছে।
কাজী সাহেবের ঘুম চলে আসছিলো। মুহিবের ধাক্কায় ধড়মড় করে ঠেলে উঠে হালকা নীলচে রঙের কাবিনের রেজিস্টার বের করে পুরো প্রফেশনালদের মতো পড়তে শুরু করলে ওসি থামিয়ে দেয়। সে নিজেই আজ মারিয়ার উকিল বাপ হবে। ওদিকে ছেলেপক্ষে এস আই মুহিব। মুহিব তো উত্তেজনায় ছটফট করছে।
দশ মিনিটের মধ্যে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ। আমান মারিয়া রোবটের মতো করে কবুল বলে। যেন বলা হলেই, বিয়ের কাজ শেষ হলেই বাঁচে! সবাই খুব ঘটা করে মোনাজাত করে বিয়ের মিষ্টি ইচ্ছে করেই কাড়াকাড়ি করে খায়৷ এমনকী হাজতখানায় থাকা দু চারজন হাজতীও মিষ্টি খাওয়া থেকে বঞ্চিত হয় না।
বিয়ের আমেজ ষোল আনা পূর্ণ করতে কাচ্চিও খায় সবাই মিলে কয়েকটি টেবিল এক করে বড় ডাইনিং টেবিল বানিয়ে। ফটো সেশান কেন বাদ থাকবে। হট্টগোল করেই কিভাবে কেটে যায় প্রায় দেড় দুই ঘন্টা।
ওসি খালেদ এস আই মুহিবসহ আরো কয়েকজন এসে আমান মারিয়াকে আমানের কোয়ার্টারে এগিয়ে দিয়ে যায়।
– স্যার, আমাদের জীবনে আনন্দ কম। সব মানুষ যখন ঈদে কিংবা পূজায় আনন্দ করে, তখনও আমাদের দায়িত্ব পালন করতে হয়৷ আপনাকে ধন্যবাদ আমাদের এক টুকরো খুশির মুহূর্ত উপহার দেয়ার জন্য। আপনাদের প্রতি আমাদের অশেষ শুভকামনা।
আবেগহীন ওসি খালেদ বেশ আবেগ নিয়েই কথাগুলো বলে। আমানের ভীষণ রকম মন ছুঁয়ে যায়। সব প্রটোকল, হিসাব নিকাশ ভেঙে খালেদকে জড়িয়ে ধরে। অন্যদের চোখে তখন জল।
মারিয়া যখন আমানের সাথে ওর বাসায় ঢোকে, তখন রাত দুইটা ছুঁই ছুঁই। আমান ওর মোবাইলের দিকে তাকিয়ে হাসে৷ ওর এসপি স্যার শুভেচ্ছা জানিয়ে ম্যাসেজ দিয়েছেন আর আগামী কয়েকদিন ছুটি নেয়ার কথা বলেছেন। আমান জানে এটা খালেদের কাজ। ছেলেটা কিভাবে যেন সব ম্যানেজ করে ফেলে।
মারিয়ার ঠিক কেমন লাগছে তা বুঝে উঠতে পারছে না। কিন্তু এটুকু বোঝে, পুরো একটা ঘোরের মধ্যে, স্বপ্নের মধ্যে আছে মারিয়া।
আমান খুব গোছানো মানুষ। ওর ঘরে ঢুকে একটুও বোঝার উপায় নেই যে আমান একা থাকে। সুন্দর করে টান টান করে পাতা বিছানায় বসে মারিয়া। আসলে আমানই মারিয়ার হাত ধরে বসিয়ে দেয়৷ ফ্রিজ খুলে ঠান্ডা পানি বের করে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় থাকা পানির সাথে মিশিয়ে এক গ্লাস পানি মারিয়ার হাতে দেয়।
– ওয়েলকাম টু আউয়ার হোম মারিয়া। এখন থেকে এই ঘর, এই আমি সবকিছুই তোমার৷ আর তুমিই আমার একমাত্র জগৎ।
মারিয়ার তৃষ্ণা লেগেছিলো ভীষণ রকম। ওদের জোরাজুরিতে একটু মিষ্টি খেলেও আর কিছুই খায় নি। ঢক ঢক করে সবটুকু পানি খেয়ে ফেলে। এরপর পানির গ্লাস আমান নিজের হাতে নিয়ে খুব নরম স্বরে এই কথাগুলো বলতেই মারিয়া যেন কেঁপে উঠে। ওর চোখ বেয়ে নিজের অজান্তেই অশ্রু ঝরতে থাকে। এ যে মারিয়ার আজীবনের স্বপ্ন। আমানকে ছাড়া যে মারিয়া নিজের জীবন ভাবতেই পারে না কিন্তু আমান যেন মারিয়ার ভীষণ সুন্দর কিন্তু নিষিদ্ধ স্বপ্ন ছিলো। আজ বাস্তব হলেও মারিয়ার বিশ্বাস হচ্ছে না।
মারিয়ার অবস্থা দেখে ওর সামনে আমান দুই হাঁটু মুড়ে বসে। মারিয়ার হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে নেয়।
– তুমি অনেক কেঁদেছো মারিয়া। কখনো পরিস্থিতির চাপে পড়ে। আবার কখনো আমার জন্যও। আমি চাই না তুমি আর কাঁদো। আমি তোমার হাসির কারণ হতে চাই মারিয়া। এই অশ্রু যেন শেষ অশ্রু হয়েই ঝরে।
আরো নরম করে শীতের দিনের শেষ বিকেলের মিঠে রোদের মতোই আমান কথাগুলো বলে মারিয়ার উদ্দেশ্যে। মারিয়ার হাতের পাতায় আলতো চুম্বন করে আমান। মারিয়া যেন কিছুটা কেঁপে উঠে।
মারিয়ার হাত ধরে আমানের বড় ব্যালকনিতে নিয়ে যায়। এখানে কয়েকটি টবে ফুল গাছ লাগানো আছে। বেলি আর হাসনাহেনার গন্ধে পুরো ব্যালকনি মাতোয়ারা হয়ে । মফস্বলের নীরব নিস্তব্ধ রাত। কোথাও কোনো শব্দ নেই। দক্ষিণের ঝিরিঝিরি বাতাস আর ঝিঁ ঝিঁ পোকার একটানা ডাক শোনা যাচ্ছে।
আজ আকাশে চাঁদ নেই কিন্তু পরিস্কার আকাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে লক্ষ লক্ষ তারা। মিটিমিটি করে জ্বলছে নিভছে যেন। কত হাজার তারাবাতি যেন জ্বলছে আমান মারিয়ার বিয়ে উপলক্ষে।
আমান মারিয়াকে নিয়ে দেয়াল ঘেঁষে বসে থাকে। আমান মারিয়াকে আলতো করে আলিঙ্গনের মতো করে ধরে আছে। কেউ কোনো কথা বলছে না। মারিয়া আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়।
– আমার খুব ইচ্ছে ছিলো এমন একটা রাতে তোমাকে নিয়ে ঠিক এভাবে বসে থাকার৷
বেশ কিছুক্ষণ পরে আমান বলে উঠে৷
– আমার তো এখনো স্বপ্ন মনে হচ্ছে!
– বাস্তবতা স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর মারিয়া৷ তুমি সব ভুলে শুধু এই মুহূর্তগুলো উপভোগ করো।
মারিয়া কথা বলে না। মাথাটা আমানের কাঁধে রাখে, আমানের হাতের মধ্যে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখে৷ সত্যি এই সময়টা সমস্ত ইন্দ্রীয় দিয়ে উপভোগ করতে চায় মারিয়া, আজীবনের সুখ স্মৃতি হিসেবে রাখতে চায়।
(শেষ)