আয়ুর প্রহর পর্ব-০২

0
2354

#আয়ুর_প্রহর
#পর্ব_২
#আয়িশা_নুর_তৃষ্ণা
___
মধ্যরাত হয়ে গিয়েছে।দূর থেকে ভেসে আসছে শিয়াল আর নেকড়ের করুণ চিৎকার।রাতভর তাদের করুণ চিৎকার কারো মনে করুণা জাগাতে না পারলেও মুহুর্তের মধ্যেই মানবমনে জাগিয়ে দিতে পারে ভীতির জোয়ার।তৈরি করে ফেলতে পারে অস্বস্তিকর পরিবেশ!
গাড়ির বদ্ধ গ্লাসের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বসে আছে প্রহর।সামনে উদ্দেশ্যহীন গন্তব্য তার।সে নিজেও জানে না কোথায় যাচ্ছে সে।তবে তার পাশের মানুষটার এ বিষয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।কারণ তার পাশের মানুষটা জানে তারা কোথায় যাচ্ছে।আর এ মানুষটার উপর ভরসা করেই প্রহর এতোদূরে চলে এসেছে।

আয়ুশ প্রহর কে সাথে নিয়ে তার গাড়ি করে বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল।আয়ুশের আলাদা ফ্ল্যাট থাকা সত্ত্বেও আয়ুশ বলেছে,সে তার বাবার টাকায় কেনা কোনো ফ্ল্যাটে উঠতে ইচ্ছুক নয়।নিজের অর্জিত উপার্জন থেকে আজকেই একটা বাসা ম্যানেজ করে সেই বাসায় উঠবে।কিন্তু এতোদূর এসে এই রাস্তায় এসে হঠাৎই গাড়ি’তে কি যেন প্রবলেম হয়েছে।তাই তারা এখানেই একটা রাস্তায় আটকে আছে। দুজনে প্রায় একঘন্টা বসে থাকার পর প্রহর আয়ুশকে উদ্দেশ্য করে বললো,
–“গাড়ি কি আর ঠিক হবে না?”

প্রহারের কথা শুনে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে গাড়ির কি প্রবলেম হয়েছে তা দেখতে মাথা গুঁজে দেখতে থাকা আয়ুশ বললো,
–“চেষ্টা করছি”!

প্রহর আরো কিছুক্ষণ বসে রইলো।সারাদিন জার্নি তারপর রেস্ট না নিয়ে আবার জার্নি এতো ধকল তার ছোট্ট শরীর সইতে পারলো না।সে ঝিমোতে লাগলো। হঠাৎই আয়ুশ চিৎকার করে বলে উঠলো,
–“ডিজগাস্টিং!লাকটাই খারাপ আমার।”
আয়ুশের হঠাৎ কথায় প্রহরের চোখের নিদ দূরীভুত হয়ে গেল।অবাক চোখে সে কিছুক্ষণ সামনে তাকিয়ে রইলো।তারপর আয়ুশকে উদ্দেশ্য করে বললো,
–“ভাগ্যকে কখনোই দোষ দিতে নেই। সৃষ্টিকর্তা যা করেন,সব আমাদের মঙ্গলের কথা বিবেচনা করেই করেন।ভাগ্যকে কখনো দোষ দিবেন না”।

প্রহরের মুখ থেকে এমন কথা শুনে আয়ুশ গাড়ির বাহির থেকে ভিতরে আসলো।গাড়ির দরজা লাগিয়ে গ্লাসে একটু ফাঁক রেখে প্রহর কে বললো,
–“ভাগ্যকে দোষ দিতে নেই?”
–“না”।
–“এখন এই বিষয়ে আর কথা বাড়ালাম না।”
এ কথা শুনে প্রহর হালকা মাথা ঝাঁকালো।সে ভাবতে লাগলো,এই মানুষটা আমায় সহ্য করছে কিভাবে?হয়তো উনার মনটা খুব ভালো।যাক, অবশেষে কেউ একজন তো আমার সাথে ভালো ব্যবহার করলো।

এইদিকে আয়ুশ কতক্ষন গাড়ির স্টিয়ারিংয়ের উপর মাথা গুঁজে বসে রইলো। কিছুক্ষণের মধ্যে নেকড়ের আওয়াজ যেন বাড়তে লাগলো।এসব শুনে ভয়ে প্রহরের ঘাম ছুটে গিয়েছে। কিন্তু বেচারী ভয়ে কিছু বলতেও পারছে না।অনেক সাহস নিয়ে সে আলতো করে আয়ুশের মাথায় হাত রাখলো।কোমল হাতের স্পর্শ আয়ুশের মাথায় পড়া মাত্রই আয়ুশ মাথা তুলে প্রহরের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো।প্রহর কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

–“আমার ভয় করছে!”
–“তো আমি কি করবো!রাবিশ!!”
আয়ুশের ধমক শুনে প্রহর মিইয়ে গেল।তার সাথে কেউ কোনোদিন ভালো ব্যবহার করেনি আর করবেও না।“অযথাই এতো বাড়তি আশা করিস প্রহর”মনে মনে নিজেকে বকা দিয়ে ঠোঁটের কোণে মেকি হাসি ঝুলিয়ে অন্যদিকে তাকালো প্রহর।তার চোখ থেকে এক ফোঁটা জল টুপ করে গড়িয়ে পড়লো তার গালে।

এতোক্ষণে আয়ুশ খেয়াল করলো আশেপাশে নেকড়ের গর্জন বেশিই আসছে।তাই প্রহর ভয় পাচ্ছে।কিন্তু এখন তো সকাল না হওয়া অব্দি গাড়ি রেখে আর কোথাও যেতেও পারবে না।তাই প্রহরকে এখন কথায় ভুলিয়ে রাখতে হবে।নয়তো বেচারী ভয়ে এখানেই না বেহুঁশ হয়ে যায়!
আয়ুশ তার নিজস্ব গম্ভীর গলায় প্রহর’কে ডাকলো,
–“এইযে শুনুন!”
অন্যদিকে ফিরেই প্রহর ভাঙা গলায় উত্তর দিল–“জি,বলুন”!

প্রহরের ভেজা গলায় কথা শুনেই আয়ুশ বুঝতে পারলো তার ধমক দিয়ে কথা বলায় প্রহর কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু সেই বা কি করবে।এমনভাবে কথা বলা তো তার অভ্যাসই হয়ে গিয়েছে প্রায়। গুটিকয়েক মানুষ ছাড়া আর কারো সাথেই আয়ুশ তেমন ভালো করে কথা বলে না। তবুও আজ প্রথম দিনেই যে প্রহরের সাথে একটু হলেও ভালো ব্যাবহার করেছে,এইটাই তো অনেক।কিন্তু এ মেয়ে তো তা বুঝবে না।

এখন আয়ুশ বুঝতে পেরেছে,এই মেয়েটার সাথে রুডলী কথা বললে চলবে না।দেখেই অল্প বয়সের মনে হচ্ছে।এখন যদি ওর নিজস্ব ভঙ্গিমায় কথা বলে,তাহলে তো মেয়েটা কেঁদেই ফেলবে।তাই আয়ুশ খানিকক্ষণ দম নিয়ে মৃদুস্বরে প্রহরকে জিজ্ঞেস করলো,

–“আপনার নাম কি?”
–“প্রহরিকা!প্রহরিকা তানজুম”!
–“বাহ!বেশ সুন্দর নাম!সবাই কি বলে ডাকে আপনাকে?”
–“প্রহরিকা বলেই ডাকে”!
–“আমি আপনাকে প্রহর ডাকবো কেমন?প্রহর!”
আয়ুশের মুখে প্রহর ডাক শুনে প্রহর আয়ুশের দিকে তাকালো।প্রহরের উত্তর না পেয়ে আয়ুশ প্রহরের দিকে তাকাতেই দেখলো,প্রহরের দু চোখ ভর্তি পানি! আশ্চর্য!এ মেয়েটা কিছু বললেই কাঁদে কেন?

–“কাঁদছেন কেন?এখন তো সুন্দর করেই কথা বললাম”!
–“আপনি আমায় প্রহর ডাকলেন তো!তাই!”
–“এটা আবার কেমন কথা,বুঝলাম না!”
–“আমার বাবা ছোটবেলায় আমায় প্রহর বলে ডাকতেন!”
–“এখন কি উনি বেঁচে নেই?”
–“না না!বেঁচে আছে আমার বাবা।তবে এখন আর আমায় প্রহর ডাকে না” বলেই ঢুকরে কেঁদে উঠলো প্রহর!

প্রহরের কথা শুনে তার সম্পর্কে জানার জন্য আয়ুশের কৌতুহল হচ্ছিল বটে। কিন্তু প্রহরের এই হঠাৎ হঠাৎ কান্না আয়ুশের সহ্য হচ্ছিল না।আয়ুশ কিছু বুঝতে না পেরে প্রায় ধমক দিতেই যাচ্ছিলো। কিন্তু তখনই নিজেকে সংযত করে প্রহরকে বললো,
–“এখন কান্না করবেন না প্রহর!রাত হয়েছে খুব। আশেপাশে কেমন শিয়াল-নেকড়ে ডাকছে শুনছেন?এসে ধরবে কিন্তু”!
বলেই নিজের জিভ কামড় দিল আয়ুশ।সে ভয় কমানোর উদ্দেশ্যে প্রহরের সাথে কথা বলছিল,এখন নিজেই ভয়ের কথা বলে ফেলল।নিজের এই আচরণে আয়ুশ নিজেই ভড়কে গিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টাতে কোনো কথা না পেয়ে বলে উঠলো,

–“বুঝলাম না প্রহর,হঠাৎই গাড়ির চাকা পাংচার হয়ে গেল কেন!”
–“সব আমার জন্য হয়েছে।”
–“এরকম বলছেন কেন”!
–“বলছি কেননা তার যথেষ্ট কারণ আছে।আজ পর্যন্ত আমি যেখানেই গিয়েছি কাউকে ভালো কিছু উপহার দিতে পারিনি।খারাপ কিছুই ঘটিয়েছি। দেখলেন না,আজকে আমার জন্যই আপনার জীবনের সাথে আমি জুড়ে গেলাম।যদি আজ আমি আপনাদের বাসায় যাওয়ার জন্য এতো বায়না না করতাম।মার খেয়েও বেহায়ার মতো না আসতে চাইতাম,তাহলে আজ আপনার সাথে আমার দেখাও হতো না।আপনার সাথে দেখা না হলে বিয়েও হতো না।আর বিয়ে না হলে আপনাকে বাসা থেকে বের হতে হতো না।এভাবে একটা অপয়া মেয়ের জন্য রাস্তায় গাড়িতে রাত কাটাতে হতো না।আসলে সব দোষ আমার,আমি একটা অপয়া।

একনাগাড়ে এতো কথা বলে প্রহর থামতে না থামতেই আয়ুশ ধমকে উঠলো প্রহরকে!বললো,
–“রাবিশ!এমন উল্টাপাল্টা কথা মাথায় ঢুকিয়েছে কে?”

নিজের কন্ট্রোল হারিয়ে আয়ুশ প্রহরকে আরো বকা দিতে লাগলো।আর ওইদিকে বেচারী প্রহর এতো ধমক খেয়ে নিরবে কান্না করতে লাগলো। আকস্মিক বিয়ে হওয়ায় বিয়েতে কাঁদতে পারেনি,তাই এখন কাঁদতে পেরে তার সব জমানো বেদনা যেন উপচে আসছে।আর সে আওয়াজ ছাড়া ফুঁপিয়ে কান্না করেই যাচ্ছে।যতক্ষণে আয়ুশের হুশ ফিরলো,ততক্ষণে প্রহর কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে।আয়ুশ প্রহরের মাথায় হাত দিয়ে গিয়েও হাত সরিয়ে নিল।ভাবলো, ঘুমন্ত অবস্থায় হঠাৎ স্পর্শ করাটা ঠিক হবে না।প্রহরে ঘুমিয়েছে দেখে আয়ুশ ও গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে হালকা নিঃশ্বাস ফেললো।

চলবে কি..?