আয়ুর প্রহর পর্ব-০৬

0
2026

#আয়ুর_প্রহর
#পর্ব_০৬
#আয়িশা_নুর_তৃষ্ণা
____
মাঝারি সাইজের ড্রয়িংরুমে বসে আছে প্রহরের মা মিসেস সাবিনা,তার বাবা মাহতাব হোসেন। হঠাৎই সেখানে প্রণয় আসলো। উস্কো খুস্কো চুল।শার্টের বোতাম ও ঠিক নেই।প্রণয় এসেই ফ্রিজ থেকে একটা পানির বোতল নিয়ে ধপাস করে সোফায় বসে পড়লো।সোফায় বসে ঢকঢক করে পুরোটুকু পানি খেয়ে শেষ করলো।সাবিনা বেগম ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,

–“কি হয়েছে বাবা!তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন”?

–“কি হয়নি সেটা বলো।কি বাকি রেখেছো তোমরা‌।চোখের সামনে নিজের মেয়ের এমন পরিণতি দেখতে লজ্জা করলো না তোমাদের?চাইলেই বিয়েটা আটকাতে পারতে।তা না করে কি করেছো?ওকে ওখানে বিয়ে বসতে বাধ্য করেছো”।

–“শুনো প্রণয়।প্রহরিকা কে আমি আমার মেয়ে হিসেবে মানি না।আর ও আমাদের নিজের কেউ ও না।আর কতোবার বলবো এ কথা?”

মায়ের মুখে এমন কথা শুনে প্রণয় প্রায় রেগেই গেল। তবুও নিজেকে কিছুটা শান্ত রেখে বললো,

–“কিভাবে এমন কথা বলতে পারো মা।বনুই(প্রহরিকা) তোমার নিজের মেয়ে।ও আমার বোন।তুমি মানো বা না মানো ও তোমারই মেয়ে।সারা দুনিয়া উল্টে গেলেও এ ধুম্রসত্য কখনোই পাল্টে যাবে না মা।তা তুমিও জানো আমিও জানি।
কিন্তু তুমি ওর সাথে কাজটা একদমই ঠিক করোনি মা।”

প্রণয়ের কথা শুনে মিসেস সাবিনা ক্ষে’পে গেলেন,বললেন,
–“যা করেছি বেশ করেছি।ঝামেলা মুক্ত হয়েছি।এই মেয়েটা পরিবারের একটা আগাছা ছিল।তাকে উপরে ফেলেছি।”

প্রণয় শার্টের‌ বোতাম ঠিকঠাক করে লাগাতে লাগাতে বলল,

–“যেদিন তুমি ওর মূল্য বুঝবে না মা, সেদিন আফসোস করবে।তবে তুমি নাই মানো,আমি জানি ও মানি ও আমার বোন।ও আমার রক্ত।আর বাবা,তোমায় দেখে আমি অবাক হচ্ছি, যেখানে মেয়েরা বাবাদের রাজকন্যা থাকে,সেখানে তুমি বসে বসে রাজকন্যার জন্য গর্ত খোঁড়া দেখেছো আর সেই গর্ত থেকে তার পড়ে যাওয়া আটকাতে মুখ থেকে বিন্দুমাত্র শব্দ বের করোনি।অথচ তুমি চাইলেই পারতে বাবা।”

মাহতাব হোসেন ছেলের কথার উত্তরে কিছুই বলতে পারলেন না।উনি চুপ করে রইলেন।উনার কি বুক কম পোড়াচ্ছে নাকি।মেয়ে তো উনারই।উনি জানেন,উনি কিছু বললেই সমস্যাটা কিছু হলেও মিটে যেতো,বিয়েটা আটকানো যেতো। কিন্তু নিজের স্ত্রী কে বড্ড ভয় পান মাহতাব হোসেন।সাবিনা বেগম কখনোই প্রহর কে নিজের মেয়ে বলে মানেন না।আর এখন যদি মাহতাব সাহেব কিছু বলতেন,এই বিয়েটা আটকানো গেলেও সাবিনা বেগম স্বইচ্ছায় নিজ মেয়ের নামে কুৎসা রটাতেও দ্বিধাবোধ করতেন না।

নিজের মেয়েটার জন্য বড্ড মায়া হয় মাহতাব হোসেনের।তিনি জানেন,প্রহরের এই “হঠাৎ বিয়ে”তে কোনো না কোনো দিক দিয়ে উনার স্ত্রী সাবিনা বেগমের হাত রয়েছে।

উনি চাইলেই পারতেন নিজের মেয়েকে এই হঠাৎ বিয়ে থেকে রক্ষা করতে। নিজের স্ত্রীর বিরুদ্ধে যেতে পারতেন তিনি।

কিন্তু মাহতাব হোসেন ব্যাবসায়ী মানুষ।অনেক মানুষের সাথে উঠাবসা করেন তিনি। মানুষ চিনেন বেশ ভালোভাবেই।তিনি আয়ুশ কে দেখেই বুঝেছেন,এমনিতে ছেলেটা কঠিন ব্যাক্তিত্বের হলেও সে খুব দ্বায়িত্ববান!তার মধ্যে মন বলে কিছু একটা আছে।যে মন শুষ্ক হয়ে আছে জলাভাবে।যে মনে খরা লেগে আছে বহুদিন।মাহতাব হোসেনের মেয়ে প্রহর ও প্রায় একই পথের। আয়ুশের মতো রাগী নয় সে।প্রহর শান্ত,সৌম্য । তবুও তার মধ্যে লুকানো অনেক কষ্ট রয়েছে,যা মাহতাব হোসেন বাবা হিসেবে কিছুটা হলেও বুঝেন।তিনি মনে করেন,মাইনাসে মাইনাসে যেমন প্লাস হয়,দুই দুঃখের আঁচল একসাথে হলে তারাও কিছুটা সুখের পরশ পেতে পারে।আয়ুশ কে দেখে ভালো ছেলে বলেই মনে হয়েছে তার।তাইতো চুপ করে সব দেখে গেলেন তিনি।

কিন্তু প্রহরের কষ্ট বুঝতে পারলেও নিজের স্ত্রীর ভয়ে মেয়েকে কাছে টানতে পারেননা তিনি।মায়ের কথাও রাখতে পারেননি তিনি।
একমাত্র মাহতাব হোসেনের মা করিমুন্নেসা বেগমই প্রহরকে আগলে রাখতেন।তিনি মারা গেছেন অনেক বছর হয়ে গেল।তিনি ছেলে মাহতাব কে দ্বায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন,প্রহরের মখেয়াল রাখতে!ভালোভাবে ওর দেখাশোনা করতে। কিন্তু এই কথাটিও সঠিকভাবে পালন করতে পারেননি মাহতাব হোসেন।এইগুলো ভাবলে নিজেকে বড্ড কাপুরুষ মনে হয় তার। হ্যাঁ….তিনি কাপুরুষই!সাথে তিনি একজন ব্যার্থ বাবা।

প্রণয়ের কথার জবাবে কিছুই বললেন না মাহতাব হোসেন।তিনি উঠে চলে যাচ্ছিলেন।তা দেখে প্রণয় বলে উঠলো,

–“তোমরা মা বাবা হয়েও অনুতপ্ত না হলে আমি ভাই হিসেবে বেশ অনুতপ্ত বনুই এর কাছে।আমি তার কাছে ক্ষমা চাইবো।ভাই হয়েও আমি কিছুই করতে পারিনি সেইদিন।আটকাতে পারিনি ওই বিয়েটা‌।তবে এখন ক্ষমা চাইবো ওর কাছে।”

মাহতাব সাহেব যেতে যেতে প্রণয়ের কথা শুনতে পেলেন। কিন্তু কিছুই বললেন না।ছেলে যা ভালো মনে করে করূক।উনার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু প্রণয়ের কথা শুনে সাবিনা বেগম বললেন,
–“লজ্জা লাগবে না ওইটুকু মেয়ের কাছে ক্ষমা চাইতে”!

প্রণয় মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“সবকিছুর আগে ও আমার বোন হয় মা।নিজের বোনের সঙ্গে হওয়া অন্যায় তো আটকাতে পারলাম না।ওইটুকু মেয়ের তো বিয়েই তো আটকাতে পারলাম না।যেখানে ষড়যন্ত্রের সাথে নিজের মা ই যুক্ত সেখানে আমি কি করতাম বলো।এখন তো মাফ চাইতে পারলে অন্তত নিজেকে কিছুটা হালকা লাগবে।

প্রণয়ের মুখে ষড়যন্ত্রের কথা শুনে সাবিনা বেগম ঘাবড়ে গেলেন।বললেন,

–“ষড়যন্ত্র মানে?কি বলছো তুমি প্রণয়!সবাই দেখেছে কিভাবে বিয়েটা হয়েছে।যাইহোক আমি এখন বুঝতে পারছি তোমার এতো রিয়েক্টের কারণ!অনিতা নামের মেয়েটাকে পাওনি দেখেই তো!তাই না? চিন্তা করো না,অনিতার থেকে ভালো মেয়ে আমি তোমায় এনে দিবো।তুমি এতো উত্তেজিত হয়ো না প্রণয়!”

মায়ের কথা শুনে প্রণয় বললো,

–“এখানে প্রথমত কথা হলো,আমি জানি বিয়েটা একটা প্ল্যান মোতাবেক তোমরা দিয়েছো।আর তোমার সাথে বনুইয়ের হাসবেন্ডের মায়ের(আয়ুশের সৎ মা)ও হাত আছে।তাই এ বিষয়ে আমাকে কিছু বোঝাতে এসো না।আমি যথেষ্ট বড় হয়েছি।আমি দেখেছি তোমাদের আলাদা কথা বলতে,এরপর প্রহরকে উপরে পাঠাতেও দেখেছি।

আর দ্বিতীয়ত;অনিতাকেই আমি বিয়ে করবোই।ও ব্যাতীত অন্য কাউকে আমি আমার জীবনে চাই না মা।যেকোনো মূল্যে আমি তাকে নিজের করে নিবো এটা আমি জানি।
ওই ঘটনার কারণে ওর সাথে আমার এংগেজমেন্ট হয়নি এই নিয়ে তোমাদের প্রতি আমার কোনো ক্ষোভ নেই।আমার শুধু আফসোস হচ্ছে এই ভেবে আমার বোনটার জন্য আমি কিছু করতে পারলাম না।”

প্রণয়ের কথা শুনে সাবিনা বেগম মুখ দিয়ে “চ” বাচক শব্দ করলেন।তারপর বললেন,

–“তো তুমি এখন কি করতে চাচ্ছো প্রণয়!”
–“আমি আমার বোনের কাছে যাবো,তার কাছে ক্ষমা চাইবো”!

সাবিনা বেগম ব্যাঙ্গাত্বক স্বরে আচ্ছা বলে বললেন,

–“তা ওকে কোথায় পাবে তুমি?ওদের বাসা থেকে বের করে দেওয়ার পর তো ও ওর হাসবেন্ডের সাথে চলে গিয়েছে।অনিতার মা বলল,ওরা নাকি অনিতার বাবার কোনো ফ্ল্যাটেই যায়নি।ওরা কোথায় আছে তারা কেউ জানেন না।”

প্রণয় তার মায়ের কথা শুনে বিন্দুমাত্র হতাশ হলো না।সে বললো,

“কোনো না কোনো তো উপায় আছেই ওদের বের করার।এতো তাড়াতাড়ি তো আর ওরা দেশের বাইরে যেতে পারবে না।এই দেশেই আছে তারা।আমার বোনকে আমি যেকোনো মূল্যে খুঁজে বের করবোই মা।ওর কাছে আমায় ক্ষমা চাইতে হবে।তাছাড়া ও এখন কেমন আছে,কোথায় আছে তা জানাটাও জরুরী।আমার কিছু জিনিসপত্র নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই বের হচ্ছি।আর দেরী করবো না।গেলাম আমি!”

বলেই ব্যাগ গুছানোর জন্য নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো প্রণয়।সাবিনা বেগম নিশ্চিন্ত মনে রিমোট হাতে নিয়ে টিভি অন করে টিভি দেখতে লাগলেন।

চলবে……..