আয়ুর প্রহর পর্ব-১০

0
1670

#আয়ুর_প্রহর
#পর্ব_১০
#আয়িশা_নুর_তৃষ্ণা
___
রোদ্রৌজ্জল সকাল। আশেপাশের কোলাহলে বুঝা যাচ্ছে সকাল বেশ ভালোভাবেই হয়েছে।
প্রহরের বানানো পরোটা আর ডিমভাজি দিয়েই সকালের নাস্তা সারলো তিনজন।
নাস্তা শেষ হতেই প্রণয়ের ফোনে একটা কথা আসলো।ফোন রেখে প্রহর আর আয়ুশের থেকে বিদায় নিয়ে প্রণয় তার মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গেল।

প্রণয় যাওয়ার কিছুক্ষণ পর আয়ুশ বললো,তারও একটা কাজ আছে।প্রহরকে সাবধানে থাকতে বলে আয়ুশ ও বেরিয়ে গেল।

ঘন্টা দুয়েক পর,
আয়ুশ ফিরে এসেছে।সাথে বাজার।মাছ,মাংস সহ আরো কিছু সবজি নিয়ে এসেছে সে।
মাছ মাংস কিনতে গিয়ে আরেকটা জিনিসের অনুপস্থিতি লক্ষ্য করলো সে।না, তাড়াতাড়িই একটা ফ্রিজ কেনা দরকার!

আয়ুশ বাজার থেকে ফিরে আসার পর প্রহর সবকিছু নিয়ে রান্নাঘরে যাওয়ামাত্রই আয়ুশের ডাক পড়লো।প্রহর আসলে তাকে আয়ুশের পাশে বসতে বললো।

তারপর নিজের প্যান্টের পকেট থেকে একটা ফোনের বক্স বের করলো।প্রহরের হাতে দিয়ে বললো,
“ এটা তোমার জন্য প্রহর!”
প্রহর ফোনের বক্সটা হাতে নিয়ে অবাক দৃষ্টিতে আয়ুশের দিকে তাকিয়ে রইলো।আয়ুশ আবার বললো,
–“এটা তোমার জন্য প্রহর!খুলে দেখো।আমি এখন ফ্রেশ হতে গেলাম।তুমি ফোন দেখো”।

প্রহর বলতেই যাচ্ছিলো,তার জন্য এতো টাকার ফোন আনার কোনো দরকার ছিল না। কিন্তু আয়ুশ প্রহরকে চুপ করতে বলে ফ্রেশ হতে চলে গেল।

প্রহরের সত্যিই খুব খারাপ লাগছে আয়ুশের জন্য।সে মনে মনে ভাবছে,

“সবকিছু আমার জন্যই হয়েছে।উনার জীবনে আসামাত্রই কত টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে। রুম গোছানোর জন্য উনার কত টাকা খরচ হয়েছে।এখন আবার কত টাকা দিয়ে দামী ফোন এনে দিয়েছে।”

প্রহর ভাবতে লাগলো,
যখন তারা সুপারমার্কেটে গৃহস্থালির যাবতীয় বিষয় কেনাকাটা করছিল,তখন তারা সব হিসেব কষলে আরো অনেক টাকার ঘাটতি দেখা যায়।তারপর আয়ুশ প্রহরকে সাথে নিয়ে আবার ব্যাংকে যায়।ওখান থেকে আবার টাকা নিয়ে এসে কেনাকাটা শেষ করে।
আজকে আবার বাজার করে নিয়ে আসলো।তারউপর এতো দামী ফোন।তার জন্যই এতো খরচ হয়েছে ভাবতেই লজ্জা লাগলো প্রহরের।

আয়ুশ একেবারে গোসল দিয়ে বের হলো।এসে কাপড় পাল্টে প্রহরের পাশে বসলো।তারপর প্রহরের হাত থেকে নতুন ফোনটা নিয়ে একটা সিম আর মেমোরি এনে ফোনে ভরলো।ফোনের কিছু সেটিংস ঠিক করে আয়ুশ নিজের নাম্বার উঠিয়ে নিজের ফোনে মিসড কল দিল।নিজের ফোনে প্রহরের নাম সেভ করলো।তারপর প্রহরের ফোনে নিজের নাম্বারটা আয়ুশ দিয়ে সেভ করতে গেলেই প্রহর না বলে উঠলো।

আয়ুশ প্রহরের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো
“কি হয়েছে?”
প্রহর বললো,
-“আপনি আপনার ফোনে আমার ফোন নাম্বার কি দিয়ে সেভ করেছেন”
–“ কেন?”
–“ বলুন না!!
–“ পুরোটা বলবো না,তবে ওখানে প্রহর শব্দটা আছে।”
–“ প্রহর লিখলেন কেন,আমার নাম তো প্রহরিকা!”
–“ আমি তো আপনার নামটা ছোট্ট করে ডাকি ম্যাডাম তাই!”
–“ তাহলে আমিও আপনার নাম ছোট্ট করে লিখে সেভ করবো!”
–“ তো কি নামে সেভ করতে চান? ছোট্ট নামটা শুনি!”
–“ আয়ু!”
প্রহরের কথা শুনে আয়ুশ চকিত নয়নে প্রহরের দিকে তাকালো।প্রহর যে শব্দ দিয়ে তার নাম্বার সেভ করতে বলেছে,আদৌ কি প্রহরের আয়ু হতে পারবে সে!শ

আয়ুশ প্রহরের দিকে তাকিয়ে বললো,
–“শুধু আয়ু দিয়েই সেভ করবো?”
–“ হ্যাঁ ”
আয়ুশ ভ্রু নাচাতে নাচাতে বলল,
–“ আমি কিন্তু আমার ফোনে “আমার প্রহর” লিখে সেভ করেছি।”

আয়ুশের কথা শুনে প্রহর লাজুক হাসি দিয়ে লাজুক গলায় বললো,“তাহলে আমার ফোনেও “আমার আয়ু” লিখে সেভ করে দিন।” বলেই মুখে ওড়না চাপা দিয়ে দৌড়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল প্রহর।

আয়ুশ সেদিকে তাকিয়ে বললো,
তোমার ভোলাভালা হাসি,
আমার বুকের ভিতর ঝড়!
তুমি চলতি ট্রেনের হাওয়া,
আমি কাঁপি থরথর!

___
রাত্রিবেলা,
প্রহরের বাসায় আসার পর ওইদিন প্রণয় প্রহরের এখানেই থেকেছিল।সকালের খাবার খেয়েই প্রণয় বাসায় ফিরে গিয়েছিল। তাদের বাসা থেকে প্রহরের বাসার দুরত্ব তিন ঘন্টার হলেও জ্যামের কারণে তারা একটু আটকে গিয়েছিল।বাসায় গিয়ে প্রেমাকে নিয়ে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল।

সকালে নাস্তার পর প্রেমা ফোন দিয়েছিল প্রণয়কে।সে নাকি আর বাসায় থাকবে না।বাসায় তার মন টিকছে না।প্রহর আর আয়ুশকে এ কথা জানালে আয়ুশই বলে প্রেমাকে এখানে নিয়ে আসতে। আয়ুশ বলে,“তুমি আর প্রেমা তোমরা আমার নিজের ভাইবোনের মতো।যখন খুশি চলে আসবে।রুম তো আছেই।বোনকে যখন খুশি এসে দেখে যাবে।বোনের কাছে যতদিন খুশি থাকবে।”

আয়ুশের সম্মতি আছে শুনে আর বোনের আবদার রাখার জন্য প্রণয় প্রেমাকে নিয়ে আসতে চলে যায়।

বাজার থেকে মাছ-মাংস কেটে আনার কারণে প্রহরের জন্য রান্না করা একটু হলেও সহজ হয়। অবশ্য আয়ুশ এসেও প্রহরকে হেল্প করে। কিন্তু একসাথে এতোক্ষণ রান্নাবান্না করার পরও দুজনে রান্নায় মসলার পরিমাণ কেমন হয়েছে এটা ছাড়া আর একটু বাক্যালাপ ও করেনি।

সন্ধ্যাবেলায় প্রেমা আর প্রণয় এলো।প্রেমা ভিতরে ঢুকেই প্রহরকে জিজ্ঞেস করলো,
–“ কেমন আছিস প্রহু?”
দৌড়ে গিয়ে বোনকে জড়িয়ে ধরে প্রহর প্রায় কেঁদেই ফেললো।কতোদিন বাদে বোনকে দেখছে সে।

আলিঙ্গনের সমাপ্তি টানলো প্রণয়ের কথায়,
–“ কান্নাকাটি পরে করিস।এখন ফ্রেশ হয়ে নে প্রেমা।”

প্রেমা আর প্রণয় ফ্রেশ হয়ে এলে প্রহর তাদের দু’জনকে খাবার সার্ভ করে দিল।

আয়ুশ সোফায় বসে চা খাচ্ছিলো।একটু রেস্ট নেওয়ার পরই প্রেমা আয়ুশের সাথে গিয়ে ভাব জমাতে শুরু করলো।
কথায় কথায় সে বায়না ধরলো সে রাতের বেলায় শহরটা ঘুরে দেখতে চায়।

প্রেমা এমনিতেই ভ্রমণপ্রেমী।রাতের শহর সে কবেই দেখেছে।অনেক ট্যুরে গিয়েছে।সাথে প্রণয় ও গিয়েছিল। কিন্তু প্রহরকে বাবা মা কখনোই যেতে দেননি।ও গেলে নাকি বেশি খরচ পড়বে।

কিন্তু প্রহরের খুব ইচ্ছে ছিল রাতের শহর দেখবে।প্রেমার থেকে শুনে শুনে সে নিজে কল্পনার জগতে বিচরণ করতো। কিন্তু কখনোই স্বচক্ষে রাতের শহর দেখার সৌভাগ্য তার হয়নি।রাতের শহরে হাঁটার আনন্দ সে কখনোই পায়নি।এতো এতো বছরে এই ছোট ছোট স্বপ্নগুলোও পূরণ হয়নি।

প্রেমা বোনের স্বপ্নগুলো পূরণ করতে না পেরে এতোদিন আফসোস করলেও যেন আজ প্রেমা একটা সুযোগ পেয়ে গেল।সে ভেবেছে আয়ুশকে কে রাজি করিয়ে সে প্রহরকে নিয়ে পিচঢালা রাস্তায় পাশাপাশি হাঁটবে।

প্রেমা আয়ুশকে বললো,
-“ প্লিজ দুলাব্রো না করবেন না।চলুন না প্রহুকে নিয়ে রাতের শহর দেখে আসি। হেঁটে আসি কিছুক্ষণ!”

প্রহর সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিল।প্রেমার কথা শুনে সে ভ্রু কুঁচকে বললো,

-“ তুই উনাকে দুলাব্রো ডাকছিস কেন ?”
“ তো কি হয়েছে।সবাই দুলাভাই জিজু ডাকে।আমার একটু অন্যরকম ডাকতে ইচ্ছে হলো।যদিও এটা এখন সবাই দুষ্টুমি করে ডাকে।তবে আমি সিরিয়াসলি ডাকবো।আর খারাপ কি!দুলা আর ব্রো অর্থ ভাই।দুলাব্রো মানে দুলাভাই।আর কিছু জানতে চাস?জানতে চাস না।একটু পরই দুলাব্রো আমাদের নিয়ে বাইরে যাবে!”
একনাগাড়ে কথা বলে থামলো প্রেমা।

প্রহর বললো,
“ এখনো স্বভাবটা যায়নি দেখছি!”
“ তো তোর বিয়ের পর কি আমার স্বভাবটা যাওয়ার শপথ নিয়েছিল নাকি।আর এটা আমার স্বভাব না।এটা আমার প্রতিভা!”

“প্রতিভা না ছাই!” বলতে বলতে এগিয়ে এসে প্রেমার পাশে বসলো প্রণয়।
প্রেমা প্রণয়কে মুখ ভেঙচিয়ে আয়ুশকে বললো,

“ চলো না দুলাব্রো।আজকে ঘুরে আসি।প্রহুর ও রাতের শহর দেখার খুব ইচ্ছে। পিচঢালা রাস্তায় হাঁটার খুব ইচ্ছে।”

আয়ুশ নিচের দিকে তাকিয়ে চা খেতে খেতে দুই বোনের কথা শুনছিল।প্রহরের নাম শুনে মাথা উঠিয়ে প্রহরের দিকে তাকালো আয়ুশ।আয়ুশের চোখে চোখ পড়তেই প্রহর অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নিল।আয়ুশ চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে প্রণয় ও প্রেমার দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বললো,
“তবে যাওয়া যাক!”

চলবে…..