আলগোছে আছো হৃদমাঝারে পর্ব-০২

0
86

#আলগোছে_আছো_হৃদমাঝারে
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_দুই

নিজের হবু বরকে অন্য মেয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ অবস্থা এক বিছানায় দেখে মাথা ঘুরে যায় জায়রার। চক্ষু দুটো কোটর ছেড়ে বেড়িয়ে আসার উপক্রম। দরজায় ধাক্কা লাগতেই রিজভান ঘুরে তাকায় দরজার দিকে। জায়রাকে দেখেই ছিটকে মেয়েটাকে বুকের উপর থেকে ফেলে দিয়ে লাফিয়ে উঠে বসে পড়ল। মেয়েটা আচমকা এমন অবস্থা দেখে কিছু বুঝতে পারল না। জায়রাকে দেখে কিছুটা অবাকও হলো। রিজভান তড়িঘড়ি করে নেমে জায়রার কাছে দৌড়ে এলো। কম্পিত বাক্যে জিজ্ঞেস করল,
“তততততুমি? তুমি এখানে?”
বলতে না বলতেই রিজভানের গালে সজোরে দুটো থা’প্পড় দিয়ে বলে উঠল,
“ভুল সময় এসে পড়ার জন্য এটা আমার পক্ষ থেকে অনুতাপের উপহার।”
রিজভান গালে হাত দিয়ে জায়রার দিকে অগ্নী ঝরা আঁখি নিক্ষেপ করল। জায়রার চোখের কোন অশ্রুসিক্ত। রাগে ভেতরটা খা খা করছে। কাল সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি। রিজভানকে তো সত্যিকারের ভালোবাসে। রিজভানকে ছেড়ে দেওয়াটা জায়রার জন্য সহজ না। তাই সকাল সকাল রিজভানকে বুঝানোর জন্য এখানে এসে যে এহেন দৃশ্য দেখতে হবে জায়রা ভাবেনি। বুকটা ধুকপুক করছে। কাঁপছে শরীর। ঠোঁট দুটোও কাঁপছে৷ রিজভানের সাথে থাকা মেয়েটা আর কেউ নয় রিজভানেরই চাচাতো বোন নোভা। নোভা বিছানা থেকে নেমে জায়রার কাছে এসে খামখেয়ালি ভাবে বলে উঠল,
“সে আর আজ নতুন কী? তুমি সবসময় ভুল সময় এসে পড়ো, মাই ডিয়ার হবু ভাবি।”
জায়রা নোভার দিকে একবার অগ্নী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পরক্ষণেই ঘৃণায় দৃষ্টি নামিয়ে ফেলল। রিজভান নোভাকে ধমকে বলে উঠল,
“তুই এখন এখান থেকে যা।”
নোভা কিছু বলতে গেলেও রিজভান থামিয়ে দেয়। চোখের ইশারায় চলে যেতে বলে। নোভাও চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই জায়রা নোভার হাতটা খপ করে ধরে ফেলে। থমথমে স্বরে বলে,
“এক পাও নড়বে না।”
জায়রা এবার আরেকহাতে রিজভানের হাত ধরল। হাসিমুখে রিজভানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“চলো। আজ থেকে যেন তোমাদের আর লুকোচুরি করে নোংরামি করতে না হয়___সেই ব্যবস্থা করে দেই।”
বলেই সামনে হাঁটা শুরু করল। চেঁচিয়ে বাড়ির সবাইকে একসাথে ডাকা শুরু করল। ওদের দুজনকে হাত ধরে টেনে নিয়ে সোজা ড্রয়িং রুমে চলে আসল। জায়রার কণ্ঠস্বর শুনে সানজিদা বেগম দৌড়ে আসলেন। চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
“কি হয়েছে মা? এভাবে ডাকাডাকি করছিস যে? আর ওদের এভাবে ধরে রেখেছিস কেন? কি করেছে ওরা?”
জায়রা ওদের দুজনের হাত ছেড়ে দিল। শান্ত বাক্যে বলল,
“বাড়ির বাকিদের ডাকুন প্লিজ। আপনাদের বাড়ির ছেলেমেয়েদের কী সুন্দর শিক্ষা দিয়েছেন____সেটা নিজের চোখেই দেখুক সবাই।”
সানজিদা বেগম হলো রিজভানের মা। জায়রার কথা বুঝতে না পেরে তিনি একটু অবাক হলেন। এর মধ্যেই লিলি বেগম হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে আসতে বললেন,
“সকাল সকাল এত চেঁচামেচি কিসের শুনি?”
তার পিছু পিছু নুহাও আসল। নওরীন আর নওফেল একসাথে বেরিয়ে আসল। বাড়ির বড় দুজন এই মুহূর্তে বাইরে আছেন। সবাই একসাথে হয়ে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে ওদের তিনজনের দিকে তাকিয়ে আছে। নওরীন জায়রাকে দেখে হাসি মুখেই এগিয়ে এসে বলল,
“তুমি এত সকালে এখানে? সারপ্রাইজ বুঝি?”
জায়রা হাসল। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে উত্তরে বলে উঠল,
“হ্যাঁ! সারপ্রাইজ দিতে এসে নিজেই সারপ্রাইজ হয়ে গেছি।”
নওফেল সাথে সাথে প্রশ্ন করল,
“কী হয়েছে? পরিষ্কার করে বলো।”
নোভা মধ্যে কোনো ভয়, লজ্জা, সংকোচ কিছুই নেই। ভাবলেশহীন ভাবে বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। রিজভান কিছুটা ভয়ে মাথা নত করে আছে। সবাইকে কি উত্তর দিবে____সেটাই ভাবছে। জায়রার প্রতি রাগে শরীর বার বার জ্বলে উঠছে। জায়রা এবার তাচ্ছিল্যের স্বরে সবার উদ্দেশ্যে বলল,
“আপনাদের বাড়ির প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেমেয়েদের এক ঘরে থাকার নিয়ম আছে নাকি, আন্টি?”
সানজিদা বেগমের কপাল কুঁচকে এলো৷ লিলি বেগম গর্জে উঠে জিজ্ঞেস করল,
“এসব কী বলছো?”
জায়রা আগের ন্যায় বলল,
“ভুল বলছি না তো। যদি এই নিয়ম না থাকতো, তাহলে মিস্টার রিজভান তার ছোট বোন নোভার সাথে এক বিছানায় ঘনিষ্ঠ অবস্থায় কি করে থাকতে পারে?”
কথাটা শুনে সবাই বিস্ফোরিত চোখে তাকাল জায়রার দিকে। নওফেল সঙ্গে সঙ্গে অবাক পানে জিজ্ঞেস করল,
“কি বলছো তুমি?”
“আপনারা কি কানে কম শুনতে পান?”
জায়রার চেঁচিয়ে কথাটা বলতেই নওরীন জায়রার কাঁধে হাত রেখে শান্ত বাক্যে বলল,
“শান্ত হও। সবটা খুলে বলো। কী হয়েছে?”
জায়রা এবার শান্ত বাক্যেই নওরীনকে জিজ্ঞেস করল,
“আমার গর্ভে আপনাদের সন্তান জন্ম হবে এটা কী আপনারা চান?”
নওরীন আর নওফেল দুজনেই অবাক হলো৷ নওরীন সাথে সাথে বলল,
“কখনোই না। তোমার জীবন সবে শুরু। সামনে তোমার রঙিন ভবিষ্যৎ পড়ে আছে। আমরা এমন অন্যায় চাওয়া কী করে চাইবো?”
“কিন্তু আপনার দেবর সেটা চায়।”
জায়রা কথাটা বলেই রিজভানের দিকে একবার ঘৃণা ভরা চোখে তাকাল। কালকের ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা সাথে আজকের ঘটনা সব খুলে বলল। কান্নাগুলোকে কিছুতেই আটকে রাখতে পারছে না। তবুও কাঁদছে না। নাহ! কাঁদবে কেন ও? কার জন্য কাঁদবে? এই নোংরা মানুষটার জন্য? ছিহ! কখনোই না। জায়রার এখন নিজের প্রতি রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে। কোন মোহে ডুবে ছিলো ও এতদিন? কোন মোহে ডুবে কালকের পর আবার আজ রিজভানের সাথে সম্পর্কে গড়তে এসেছিল? নওফেল সবটা শুনে রিজভানের গালে সজোরে থা’প্পড় বসিয়ে দেয়। রিজভানের কলার চেপে ধরে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“এই তোকে আমরা বলেছি জায়রাকে এমন প্রস্তাব দিতে? বল বলেছিলাম? তুই কি করে পারলি জায়রার মতো মেয়েকে এমন প্রস্তাব দিতে? আংকেল যদি একবার জানে তাহলে তোকে আজীবন কোথায় পঁচে গলে ম’রতে হবে আল্লাহ জানেন। তোকে তো আমার ভাই বলতেও লজ্জা করছে। কীভাবে পারলি মেয়েটাকে ঠকাতে? দুইদিন পর যে তোর বউ হবে তাকে তুই ঠকালি? ছিহ! ধিক্কার তোকে।”
লিলি বেগম হিংস বাঘিনীর মতো এগিয়ে আসলেন। নোভার চুলের মুঠি ধরে দুইটা থা’প্পড় বসিয়ে গলা চে’পে ধরলেন। বলতে লাগলেন,
“তোর মতো মেয়েকে মে’রে ফেলাই উচিত। অস*ভ্য, ই*তর মেয়ে। তোকে এই শিক্ষা দিয়েছি আমরা?”
সানজিদা বেগম ছেলের এসব কীর্তিকলাপ শুনে নিজেকে সামলে রাখতে পারলেন না৷ মাথা ঘুরে পড়ে যেতে নিলে নওরীন তড়িঘড়ি করে ধরে ফেললেন। সোফায় নিয়ে বসাতেই তিনি কান্নারত স্বরে বলতে লাগলেন,
“বউমা, বিয়ের সব আয়োজন করা শেষ। সবাইকে জানানো শেষ। আর এখন এসব? তোমার বাবাকে কি জবাব দিবো আমি? আমাদের মানসম্মান যে আর থাকলো না।”
জায়রা সানজিদ বেগমের দিকে এগিয়ে গেলো। তার পায়ের কাছে হাটু ভেঙে বসল। তার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
“আন্টি, আমাকে ক্ষমা করবেন৷ আমি আপনার ছেলেকে কিছুতেই নিজের জীবন সঙ্গি হিসেবে মেনে নিতে পারব না। আপনারা সবাই আমাকে অনেক ভালোবাসা দিয়েছেন তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু এই বিয়েটা করতে বলবেন না।”
সানজিদা বেগম জায়রার মাথায় হাত রেখে বলল,
“তোকে আমি এই বিয়ে করতে কখনোই বলব না৷ আমি একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের ক্ষতি চাইব এমন নিকৃষ্ট আমি নই রে, মা। তুই নিজের জীবনটা নিজের মতো গড়বি। আমার ছেলে কাচ পেয়ে হীরাকে পায়ে ঠেলেছে৷ যেদিন সেই কাচে ওর হাত কাটবে সেদিন বুঝবে।”
জায়রা প্রতিউত্তরে মুখে হাসি টানার চেষ্টা করে উঠে দাঁড়াল। রিজভানের মুখোমুখি হয়ে আঙ্গুল তুলে বলে উঠল,
“আমাকে ঠকানোর শাস্তি তুই পাবি। খুব শিঘ্রই আমি বউ সাজব। তবে তোর মতো নিকৃষ্ট পুরুষের জন্য না। কোনো এক শুদ্ধতম পুরুষের জন্য।”
বলেই এগিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই রিজভান জায়রার হাত চেপে ধরল। শাসিয়ে বলে উঠল,
“আমাকে সবার সামনে এভাবে হেনস্তা করার জন্য তোমার জীবন আমি নরক করে দিব, মাইন্ড ইট।”
নওফেল কথাটা শুনে সাথে সাথে রিজভানের দিকে ঘু’ষি উঠাতেই জায়রা থামিয়ে দিল। রিজভানের উদ্দেশ্যে বলল,
“তোর মতো কাপুরুষের থেকে এটাই আশা করা যায়। ভুলে যাস না আমি কে? কি আমার পরিচয়? মেয়ে মানুষ হলো আগুন। সেই আগুনের সাথে খেলতে গেলে জ্বলে পুড়ে ম’রতে হয়।”
বলেই রিজভানের থেকে হাতটা হেঁচকা টানে ছাড়িয়ে নিয়ে করুন স্বরে বলে উঠল,
“তুমি আমাকে ভালোবাসোনি রিজভান। কোনোদিন ভালোবাসোনি। আমাকে ভালো না বাসার আফসোস একদিন তোমাকে কুরে কুরে খাবে।”
আর এক পাও দাঁড়াল না। দৌড়ে বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে। আজ থেকে ভালোবাসা শব্দটার উপর এক আকাশসম ঘৃণা জন্মালো।



“স্যার, শহরের আনাচে-কানাচে ইদানীং বড্ড বেশি ধর্ষণের স্বীকার হচ্ছে মেয়েরা। আমরা কেনো এই সমস্যারটার কোনো সমাধান করছি না? আজ হয়তো আমার প্রতিবেশী, আমার দেশের কেউ ধর্ষণ হচ্ছে কাল যে আপনার মেয়ে, বউ, বোন ধর্ষণ হবে না তার কী গ্যারান্টি?”
কথাগুলো শুনেই আমির হোসেন কিছুটা রাগান্বিত চোখে তাকালো জাইহানের দিকে। জাইহান সে দৃষ্টিতে ভয় না পেয়ে বরং আগের ন্যায় শক্ত বাক্যে বলল,
“আপনার পরিবারকে উদাহরণ স্বরুপ ব্যবহার করায় আপনার রাগ হচ্ছে আমি বুঝতে পারছি৷ তাহলে ভাবুন স্যার, যদি বাস্তবে এমন হয় তাহলে কি হবে?”
আমির হোসেনের মুখে এবার কিছুটা চিন্তার ছাপ পড়ল। তিনি শান্ত বাক্যে জাইহানকে বলল,
“আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারছি কিন্তু জাইহান উপর মহল থেকে আমাকে এই কাজের জন্য তদন্ত করার পারমিশন দেওয়া হয়নি।”
জাইহান হাসল। তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
”স্যার, আপমা বোধহয় ভুলে যাচ্ছি আমরা দেশপ্রেমিক। আমাদের কাজ হলো দেশের শান্তি বজায় রাখা। দেশকে সুরুক্ষা প্রধান করা। আমরা কি এই শপথ নিয়েছিলাম, স্যার? আমার চারপাশে আমার মা, বোনরা ভালো নেই। অন্তত এই মুহূর্তে আমি চুপ করে থাকতে পারব না। যদি দুইদিনের মধ্যে ডিপার্টমেন্ট থেকে কোনোরকম তদন্ত করা না হয় তাহলে আমি নিজ থেকে এই সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজব। তারপর প্রেস, মিডিয়া সবাই যখন জানবে। তখন কিন্তু আঙ্গুল আপনার দিকেও উঠবে। দেশবাসীকে উত্তর দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হন, স্যার।”
বলেই জাইহান বেরিয়ে গেলো। আমির হোসেন মুগ্ধ হয়ে জাইহানের সাহসী বাক্যগুলো শুনল। ছেলেটার ভেতর অসীম সাহস। মনে মনে বলে উঠলেন,
“এতগুলো বছর যেই কাজটা আমি করতে পারিনি, সেই কাজটা তুমি করতে পারবে জাইহান। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই দূর্নীতি, ক্ষমিতার অপব্যবহার করে, যে বা যারা ভালোর মুখোশ পড়ে আছে, তাদের মুখোশ খোলার সময় এসে গেছে।”

#চলবে