আলগোছে আছো হৃদমাঝারে পর্ব-০৯ এবং শেষ পর্ব

0
89

#আলগোছে_আছো_হৃদমাঝারে
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_শেষ

“প্রতিদিন শহরের আনাচে-কানাচে থেকে মেয়েরা উধাও হয়ে যাচ্ছে। তাদের বিশ্রি ভাবে হ*ত্যা করা হচ্ছে। আজ অন্যের বোন, তো কাল আমার বোন। আজ অন্যের মেয়ে, কাল আপনার মেয়ে। এভাবে আর কতদিন চলবে? আর কতদিন আপনি মুখে তালা লাগিয়ে বসে থাকবেন, স্যার? আপনি তো সব জানেন? তাকে কেন এরেস্ট করছেন না, স্যার? তাকে কেন সবার সামনে নিয়ে আসছেন না? তার মানে কি এসবের পেছনে আপনার কোনো হাত আছে? কিসের ভয়ে আপনি চুপ আছেন? আজ আপনাকে সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।”
জাইহান উচ্চবাক্যে কথাগুলো বলে উঠল। আমির সাহেব কথাগুলো শুনেও উত্তেজিত হয়ে কিছু বললেন না। শান্ত বাক্যে বললেন,
“জাইহান, শান্ত হও। আমার কথা শুনো। কিছু সময় উত্তেজিত হয়ে সব সমস্যার সমাধান করা যায়। দাবা খেলতে জানো, নিশ্চয়ই? দাবা খেলাটা যেমন বুদ্ধির খেলা, তেমনি অপরাধী সনাক্ত করাও বুদ্ধিও কাজ। আমি চুপ করে আছি তার কারণ পুলিশের এস. আই এই অপরাধের সাথে যুক্ত। তাকে যদি সবার সামনে নিয়ে আসি তাহলে যে প্রধান অপরাধী সে সাবধান হয়ে যাবে। আমাদের কাজের ফলাফল আমার মেয়ে বা তোমার বোন পেতে পারে। তখন কি ঠিক হবে?”
জাইহানের বুকটা ধক করে উঠল। এভাবে তো ভাবেনি। তাহলে করবেটা কী? এভাবে তো চুপ থাকাও যায়না। জাইহান ভাবুক স্বরে প্রশ্ন করল,
“কিন্তু স্যার, এভাবে চুপ করে থাকলে আরো কত মেয়ের জীবন শেষ হবে ভাবতে পারছেন?”
আমির হোসেন সাহেব কিছু সেকেন্ড ভেবে উত্তর দিলেন,
“তোমাকে একটা অনুরোধ করব?”
জাইহান নির্দ্বিধায় বলল,
“আদেশ করুন।”
আমির হোসেন বললেন,
“আমার মেয়েকে তোমাদের বাসায় কিছুদিন আশ্রয় দিবে?”
জাইহান চকিতে তাকাল। চাঁদ হাতে পাওয়ার খুশিতে লাফিয়ে উঠতে মন চাইল। পরক্ষণেই মনের খুশি মনেই চেপে রাখল। চাঁদ তো এখনো ওর নয়। তারমানে সেই চাঁদের উপর ওর কোনো অধিকার নেই। জাইহান শান্ত বাক্যে জিজ্ঞেস করল,
“কিন্তু কেন, স্যার?”
আমির সাহেব চিন্তিত ভঙ্গিতে জবাব দিলেন,
“আমার বাড়ি আর আমার মেয়ে দুজনের উপরেই শত্রু পক্ষের নজর পড়েছে। আমি সারাদিন বাড়ির বাইরে থাকি। জায়রার মা ভীতু মানুষ। মেয়েটাকে নিয়ে আমি এক সেকেন্ড চিন্তা মুক্ত থাকতে পারিনা।”
জাইহান আচমকা প্রশ্ন করল,
“স্যার, যারা আপনার শত্রু তারা তো আমারো শত্রু। তাহলে আপনি বিশ্বাস রাখছেন কিভাবে যে, আপনার মেয়ে আমার কাছে নিরাপদে থাকবে?”
আমির সাহেবের মুখ হাসি ফুটল। বিশ্বাসী স্বরে বললেন,
“আমি নিজের পরে তোমাকে বেশি বিশ্বাস করি। তোমার ব্যক্তিত্ব আমার থেকেও স্ট্রং৷ তুমি অদম্য সাহসী সৈনিক। নিজের ও নিজের পরিবারের সুরক্ষা অবশ্যই নিশ্চিত করতে পারবে।”
জাইহান হাসল। বলল,
“আমি জানিনা কতটুকু পারব। তবে চেষ্টা করব। আপনি পাঠিয়ে দিবেন।”
আমির হোসেন সাহেব বেশ শান্ত গলায় বললেন,
“বেশিদিন কয়েকদিন রাখো৷ জায়রার ভিসা হয়ে গেলে কানাডা পাঠিয়ে দিব।”
কথাটা শুনেই জাইহানের মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেল। জায়রা চলে যাবে? বুকের ভেতরটা চিনচিন ব্যাথায় শিউরে উঠল। তবুও আলতো হেসে বলে উঠল ,
“ঠিক আছে।”



পুলিশের এস.আই হাসিব ইসলামের পদত্যাগের জন্য আন্দোলন হচ্ছে। কিন্তু তিনি নিজের জায়গায় অটল। কিছুতেই পদত্যাগ করবেন না। আলিফ মুখে মাস্ক দিয়ে পুলিশ স্টেশনে ঢুকে সোজা হাসিব সাহেবের কেবিনে ঢুকল। রুমে পরিচিত কাউকে দেখে হাসিব সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। ছেলের সামনে এসে হুংকার দিয়ে বলতে লাগলেন,
“তোর জন্য আজ আমার এই অবস্থা। তোর মতো ছেলেকে জন্ম দেওয়াই আমার ভুল।”
আলিফ কথাগুলো গায়ে মাখল না। মুখের মাস্কটা খুলে শান্ত বাক্যে বলল,
“ওহ বাবা, শান্ত হও। এই বয়সে এত উত্তেজিত হয়ে পড়লে হার্ট আট্যাক হয়ে যেতে পারে।”
এই মুহূর্তে ছেলের মুখের থেকে এমন কথা আশা করেননি তিনি। রাগে গা শিরশির করছে। আলিফ জানালা দিয়ে একবার বাইরে তাকিয়ে লোকজনের সমাগম দেখে ভাবুক স্বরে বলে উঠল,
“তোমাকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব, বাবা। এখান থেকে বাইরে বের হলে গণপিটুনিতেই তোমার জীবন দেওয়া লাগবে।”
হাসিব সাহেব ভয়ে ঢোক গিলল। কাঁপা-কাঁপি হাতে ফোন করে কল করলেন কাউকে। কয়েকবার রিং হতেই ওপাশ থেকে কল রিসিভ হতেই, হাসিব সাহেব কম্পিত বাক্যে বলে উঠলেন,
“স্যার, আমাকে বাঁচান। আমার সব হারাতে বসেছি আমি।”
ওপাশ থেকে লোকটা বেশ শান্ত স্বরে বলল,
“হাসিব, তোমাকে বাঁচাতে পারব৷ কিন্তু তোমার গদি বাঁচানো আমার পক্ষে সম্ভব না। দেশ এখন উত্তাল। ছাত্রসমাজ পুলিশের উপর ভয়ংকর রুপে ক্ষেপে আছে। নিজেকে বাঁচাতে চাইলে, পদত্যাগ করে সরে যাও। বাকিটা সামলে নিব।”
বলেই তিনি ফোন রেখে দিলেন। হাসিব সাহেব উপায়ন্তর না পেয়ে পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিলেন।পদত্যাগ পত্র জমা দিয়ে এক প্রকার পালিয়ে গেলেন।



জাহিশ দৌড়ে জাইহানের কেবিনে ঢুকল। জাইহান সব কাজ গুছিয়ে বের হওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল। জাহিশকে এমন হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে ঢুকতে দেখে জাইহান ভড়কে গেল। অবাকপানে জিজ্ঞেস করল,
“কি হয়েছে, ভাই?”
জাহিশ হাঁপাতে শুরু করল। কাঁপা-কাঁপি স্বরে বলে উঠল,
“ভাই, মায়রা!”
জাইহানের আত্মা কেঁপে উঠল। জাহিশের সামনে এগিয়ে গেল। দুই বাহু চেপে জিজ্ঞেস করল,
“মায়রা! কি হয়েছে, মায়রার? ঠিক আছে ও? কথা বল, ভাই।”
জাহিশ কেঁপে উঠল। ফুঁপিয়ে কান্না করে দিল বাচ্চাদের মতো। জাইহানের কণ্ঠস্বর দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। তবুও কোনোরকমে থেমে থেমে জিজ্ঞেস করল,
“ভাই! মায়রা! কোথায়?”
জাহিশ এবার কান্নারত বাক্যেই বলে উঠল,
“মায়রাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, ভাই।”
জাইহান থেমে গেল। এক পা পিছিয়ে গেল। মাথার উপর যেন আকাশটা ভেঙে পড়ল। দুই ভাইয়ের নয়নের মনি মায়রা। মায়রার কিছু হয়ে গেলে, ওরা বাঁচবে কিভাবে? জাইহানের বুকটা কাঁপছে। শরীর কাঁপছে। শক্তপোক্ত মানুষটার দেহ নুয়ে পড়ছে। কথা বলার শক্তি পাচ্ছে না। কী হবে এবার? সব কি তাহলে শেষ হয়ে যাবে? মায়রাকেও কি লিলির মতো জীবন দিতে হবে? নাহ! ভাবতে পারছে না জাইহান। মাথাটা ঘুরতে শুরু করল…



চারিদিক নিস্তব্ধ৷ মায়রার হাত, পা, চোখ, মুখ শক্ত করে বাঁধা। দম আটকে আসছে। শ্বাস নেওয়ার জন্য ছটফট করছে। কি হবে? কি হবে? ভয়ে বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করছে। হঠাৎ করে একজন পুরুষের শক্ত বাক্যে কানে আসল,
“মেয়েটা কোথায়?”
মায়রার কেন যেন এই স্বর বড্ড চেনা লাগছে। কোথায় যেন শুনেছে! খুব পরিচিত। কিন্তু কে এই ব্যক্তি? আর পরিচিত কেউ এখানে আসবে কিভাবে? লোকটা প্রশ্নের উত্তরে অন্যজন বলল,
“স্যার, মেয়েটা রমিজ উদ্দিন কলেজের ছাত্রী।”
লোকটা কিছু বলল না। ভেতরে ঢুকে বিধ্বস্ত মেয়েটাকে দেখে বুক কেঁপে উঠল। জোরে শব্দ করতে গিয়েও থেমে গেল। কয়েক পা পিছিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে এলো রুম থেকে। ছেলে দুটো হঠাৎ এমন কান্ড দেখে ভয় পেল। কি হলো রহস্য উদঘাটন করার জন্য লোকটার পিছু পিছু বাইরে বেরিয়ে আসল। ছেলে দুটো আসতেই লোকটা দুই হাতে ওদের দুজনের কলার চেপে ধরল। হংকার ছেড়ে বলল,
“আমার মেয়েকে তুলে আনার সাহস তোদের কে দিয়েছে? ও আমার মেয়ে মায়রা। মুয়াজ চৌধুরীর একমাত্র কলিজার টুকরা। আর তোরা ওর গায়ে হাত দিয়েছিস? তোদের হাত কেটে আমি কুকুর দিয়ে খাওয়াব।”
ছেলে দুটো অবাকের শেষ সীমানায়। যে মানুষটা এতগুলো মেয়ের জীবন নষ্টের পেছনে দায়ী, সেই মানুষটার মেয়ের গায়ে হাত দেওয়ায় এতটা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে? কিভাবে? লজ্জা করছে না? তার ছেলে দুজন দেশের বন্ধু আর তিনি দেশের শত্রু? জাইহান যেদিন জানতে পারবে এসব কিছুর পেছনে ওর বাবা দায়ী তাহলে কি করবে? কিভাবে সহ্য করবে আপন মানুষের এত ভয়ংকর রুপ? কিভাবে? কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে জীবন? মানুষ দুমুখো সাপের থেকেও বিশ্রি…

#প্রথম_রিচ্ছেদের_সমাপ্তি

[বিশেষ নোটঃ- আমি প্রায় ১০দিন হলো ভীষণ অসুস্থ। ১০দিনে তিনবার হসপিটাল ঘোরা শেষ। তবুও সুস্থ হওয়ার নাম নেই। তাই বাধ্য হয়ে মাঝ পথে সমাপ্তি টানতে হলো। প্রথমেই বলেছিলাম গল্পটা দীর্ঘ হবে আমি আমার কথা রাখব। সুস্থ হয়ে ফিরব। ইন শা আল্লাহ। দোয়ায় রাখবেন আমাকে।]