আশার হাত বাড়ায় পর্ব-১২+১৩

0
211

#আশার_হাত_বাড়ায় |১২|
#ইশরাত_জাহান
🦋
এক এক করে কোর্ট থেকে বেড় হতে থাকে সবাই।ঠিক তখনই মিডিয়া এসে ঘেরাও করে রাখে ফারাজ ও অহনার দিকে।শ্রেয়া ও তার পরিবার ঘাবড়ে যায়।ফারাজের ইশারা পেয়ে শ্রেয়াকে নিজের পিছনে আড়াল করে অন্য জায়গা দিয়ে চলে যায় অর্পা।মিডিয়ার সামনে শ্রেয়া আসা মানে ফারাজকে এখন বিপাকে পড়া।কোম্পানির লোকজন এই বিষয়ে জেনে যাবে।তাই ফারাজ চায় না মিডিয়ার কোথাও শ্রেয়ার নাম আসুক। শ্রেয়াদের একটি গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে নিজেও ফ্রন্ট সিটে বসে অর্পা।মিরাজ গাড়ি স্টার্ট করবে ওমনি শ্রেয়ার নজরে আসে অহনার দিকে কিছু মহিলা এগিয়ে আসছে।অর্পাকে প্রশ্ন করে,”ওখানে কি হচ্ছে?”

অর্পা মৃদু হেসে বলে,”বড়ভাই কি ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নাকি?পরকীয়ার শাস্তি মেয়েদের আইনে না থাকুক নিজের তরফ থেকেও তো দেওয়া যায়।সেই ব্যাবস্থা চলছে।”

রিমলি আতঙ্কের সাথে বলে ওঠে,”আমি দেখতে চাই।গাড়ি চালাবেন না প্লিজ।যার জন্য আমার আপুর এই অবস্থা তার শাস্তি দেখতে ইচ্ছা করছে।”

মিরাজ গাড়ি চালালো না।মহিলা কমিটি থেকে কয়েকজন মহিলা এসে অহনার মুখে কালি মাখতে থাকে।দলবদ্ধ হয়ে বলে,”ব্যাভিচার নারী সমাজের ক্ষতি,ব্যাভিচার নারী সমাজের ক্ষতি।”

এ যেনো এখন মিছিল শুরু হয়েছে।হাত উচু করে অহনাকে নিয়ে স্লোগান চালিয়ে যাচ্ছে মহিলারা।হঠাৎ এক মহিলা এসে জুতার মালা পড়িয়ে দিয়ে বলে,”জালিম মায়েদের এর থেকেও বড় শাস্তির প্রয়োজন।কিন্তু সাধ্যের বাইরে করে আইন ভঙ্গ করতে চাই না।লজ্জা থাকলে এরপর থেকে নোংরা পথে চলবি না।”

অহনার মুখ এবার নিচু হয়ে গেলো।ফারাজ ঠোঁটে জিতে যাওয়া হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে।মিমির হাত ধরে দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখতে থাকে অহনার শাস্তি।এই সবকিছু ভিডিও করছে মিডিয়ার লোকজন।ফেইসবুকে লাইভ চলছে।নজর এড়ায় না জিনিয়া ও বাকি সদস্যের।অহনার মা অহি মুখে কাপড় গুঁজে কান্না করতে থাকেন।জিনিয়া এসে তার হাত ধরে দাড় করিয়ে বলে,”পার্টি তো আমরাও করি।ফ্রীডম তো আমাদেরও আছে।তোমার মেয়েকে আমার বৌমা করেছিলাম এই দিন দেখার জন্য?তোমার আর তোমার স্বামীর অনুরোধে বিয়ে হয়েছিলো ওদের।নাহলে আমরা তো ভালো ভালো ফ্যামিলি থেকে মেয়ে দেখতাম।আমার কপালটা আসলেই খারাপ।অযোগ্য বৌমা পেয়েছি।”

কথাগুলো বলে কপাল চাপড়াতে থাকে জিনিয়া।সামনে অসহায় হয়ে দাড়িয়ে আছে অহনার মা।তার আরেক পরিচয় তিনি ফারাজের কাকি।অহনার বাবা ও ফারাজের বাবা দুই ভাই।তাদের ইচ্ছা ছিলো অহনা ও ফারাজকে বিয়ে দেওয়ার।অহনার ও ফারাজের মতামতে হয় এই বিয়ে।কিন্তু অহনা যে গোপনে এসব কাজ করে বসবে এটা কেউ বুঝতে পারেনি।লজ্জায় অহি এখন দাঁড়াতে পারছে না সেখানে।দৌড়ে চলে যায় নিজের ঘরে।শাশুড়ির অপমানে কোনো প্রকার প্রতিবাদ করল না অতসী।সে নিজের মতো দিব্যি গ্রিন টি নিয়ে ফেইসবুকে ভিডিও দেখছে।কে কি করল তার যায় আসে না।

ফারাজের সামনে একজন সাংবাদিক এসে প্রশ্ন করে।ফারাজ প্রত্যেক প্রশ্নের জবাব দিতে থাকে।তারপর সাইড কাটিয়ে চলে আসে নিজের গাড়ির দিকে।মিমি কান্না করছে।কিন্তু জোরে জোরে না। পাপার কষ্ট হবে তাই সে শুধু চোখের পানি ফেলে ফোফাতে থাকে।শ্রেয়ার চোখ শুধু মিমিতেই আবদ্ধ।মিমির কান্না করা চোখমুখ দেখে খারাপ লাগছে তার।তাই মিরাজকে বলে,”মিমিকে আমাদের সাথে রাখলে ভালো হতো।স্যার তো নিজের মতো ব্যাস্ত থাকবে।আমরা নাহয় মিমিকে নিয়ে রাখলাম।”

শ্রেয়ার কথাগুলো শুনে অর্পা চলে যায় ফারাজের কাছে।মিমিকে নিয়ে আসে।গাড়িতে উঠতেই মিমি বসে শ্রেয়ার পাশে।মিমির দুই চোখের পানি মুছে দেয় শ্রেয়া।এক হাত দিয়ে মিমিকে আকড়ে ধরে।মিমি শ্রেয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।তারপর মিষ্টি এক হাসি উপহার দেয়।

বাসায় এসে শ্রেয়ার ঘরগুলো খুঁটিতে দেখছেন সৃষ্টি বেগম।ঘর দেখতে দেখতে চিল্লিয়ে বলে ওঠে,”আমি তোর অফিসটা দেখব।দেখতে হবে না তুই কোথায় কাজ করিস।”

হেসে দেয় শ্রেয়া।মাকে জড়িয়ে বলে,”সব হবে মা।তুমি চিন্তা করো না।”

রিমলি এবার হামি দিয়ে বলে,”অনেক হয়েছে।এখন একটু ঘুমাবো।যে জার্নি গেলো আজ!”

রিমলির অলসতার ভঙ্গি দেখে হেসে দেয় সবাই।সৃষ্টি বেগম বিরক্ত হয়ে হাত ধরে টান দেয় রিমলির।বলেন,”দরজা জানলা খোলা আছে।তাড়াতাড়ি ওঠ।কোন জায়গায় কোন পুরুষ মানুষ থাকে বলা যায় না।”

“চিন্তা করো না তো মা।এদিকটায় তেমন কেউ আসে না।ড্রাইভার আংকেলের বউ অনেক ভালো।আমার অনেক খোঁজ খবর নেয়।তার মেয়ের জীবন দিয়ে সে অনেক কিছু বুঝেছে।এখন তাই আমাকে মেয়ের মতো আগলে রাখে।হুট হাট আমার এদিকে কোনো ছেলে মানুষ আসা বারণ।”
বলে ওঠে শ্রেয়া।সৃষ্টি বেগম শ্রেয়ার মুখে হাত রেখে বলেন,”তারপরও নিজেদের বিপদে আপদে তো নিজেদেরকেই বাঁচাতে হবে।আজকাল যে মেয়েরা রক্ষা পায় না। আর তোর যে বোন!সারাক্ষণ উড়ে বেড়ায়।কোন ছেলে যে আছে এ মেয়ের কপালে আল্লাহ ভালো জানে।”
মুখ ভেংচি দেয় রিমলি।সৃষ্টি বেগম আবার রাগ দেখান।হেসে দেয় শ্রেয়া ও অর্পা।

******
রনিকে জেলে ঢুকিয়ে নিজের স্থানে আসে শিহাব।এখন সে রিলাক্স আছে।কিছু একটা মনে পড়তেই কল করে ফারাজকে।ফারাজ কল রিসিভ করতেই শিহাব বলে,”আর ইউ ওকে ব্রো?মিমির কি অবস্থা এখন?”

ফারাজ বলে ওঠে,”মিমিকে নিয়ে মিরাজ আর অর্পা ঘুরে বেড়াচ্ছে।আমি একদম ঠিক আছি।”

“আজকে বাসায় আসো।মা তোমার জন্য রান্না করেছে।শুধু তুমি না মিমিকেও নিয়ে আসো।”

কপালে দুই আঙ্গুল স্লাইট করতে করতে ফারাজ বলে,”ওকে,এমনিতেও আজ বাসায় যাওয়ার মুড নেই।মামা মামীকে বলে দিস আসবো।”

বলেই কল কেটে দেয় ফারাজ।হেলান দেয় সোফায়।পুরুষ মানুষ বলেই নিজেকে স্ট্রং রেখেছে সব জায়গায়। হৃদয়হরণ যে তারও হয়েছে এটা বোঝার মতো কেউ নেই।টাকা থাকলেও মানসিক শান্তি তার ভিতর নেই।এই যে শ্রেয়া যার টাকা পয়সা না থাকলেও অনেক সাপোর্ট থেকেছে।এখন মন খুলে মুক্ত বাতাসে হাসিখুশি আছে। আর ফারাজ সে তো নিজের যোগ্যতায় যুদ্ধ করে জিতে গেলো।কিন্তু দিনশেষে সেও একা হয়ে গেলো।মিমিকে সাথে করে আনেনি কারণ এখন মিমির মধ্যে অহনার জন্য কষ্ট লুকিয়ে রাখা আছে।সেই কষ্ট কিছুটা লাঘব হবে যদি মিমি সবার সাথে আনন্দ করে।মেয়েকে নিয়ে খুব সিরিয়াস ফারাজ।কপালের উপর এক হাত রেখে নিজেকে নিজে বলে,”আমার দুনিয়া আমার মেয়ে আর আমার মেয়ের দুনিয়া আমি।আমার জীবনের এক অধ্যায় শেষ তো আজ থেকে নতুন অধ্যায় শুরু।আমার মেয়েকে নিয়ে নতুনভাবে বাঁচতে শিখবো আমি।”

*****
শ্রেয়া ও সৃষ্টি বেগম মিলে রান্না করছিলেন।রাতে খাবে সবাই।অর্পা মিমি ও রিমলি মিলে খেলা করছে।মিমি এখন আগের থেকে অনেক ভালো আছে।সবার সাথে হেসে খেলে কথা বলছে।ফারাজ তার গাড়ি নিয়ে এসেছে।মিরাজের গাড়ি দেখতে পেয়ে সেখানে নিজে গাড়ি থামিয়ে দেয়।শ্রেয়ার বাড়ির সামনে এসে দরজায় টোকা দেয়।যদিও দরজা খোলা ছিলো।সৃষ্টি বেগম প্রাকৃতিক বাতাস বেশি পছন্দ করেন।তাই দরজা খোলা রেখেছেন। ফারাজকে দেখে মিমি দৌড়ে যায়। ফারাজকে জড়িয়ে ধরে বলে,”আমরা এখনই চলে যাবো পাপা?”

মিমিকে জড়িয়ে ধরে ফারাজ বলে,”হ্যাঁ মা।তোমার শিহাব কাকু ফোন করেছিলো।আজকে আমাদের ওখানে যেতে বলেছে।”

সৃষ্টি বেগম এগিয়ে এসে বলেন,”রাতের খাবারটা খেয়ে যাও বাবা।”

“আমার মামা মামী আজ দাওয়াত দিয়ে রেখেছেন।আমি হ্যাঁ করেছি ওনাদের।তাই এখন সম্ভব না। পরে একদিন হবে।”

কথাগুলো বলে অর্পার দিকে তাকিয়ে ফারাজ বলে,”তুমি যাবে আমাদের সাথে নাকি মিরাজ আসবে?”

“ও এসে আমাকে নিয়ে যাবে।মামী কল করেছিলো।আমি যাবো না আজ।”

“আচ্ছা।আজ তাহলে আসি।”
মিমি হাত দিয়ে টাটা দেখিয়ে দিলো সবাইকে।শ্রেয়া নিজেও হাত দিয়ে টাটা দেখিয়ে বিদায় দিলো।

ফারাজ ও মিমি চলে যেতেই শ্রেয়ার ফোনে কল আসে।মিসেস তানহার কল এসেছে।শ্রেয়া রিসিভ করতেই বলে ওঠে,”তোমার ডিভোর্সের কাগজ রেডি। কাল এসে সই করে দিও।”

দীর্ঘশ্বাস নিয়ে শ্রেয়া বলে,”ওকে,আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।”

“ইটস মাই ডিউটি ডিয়ার।”

শ্রেয়ার কথা শুনে সৃষ্টি বেগম বলেন,”কি হয়েছে?”

“ডিভোর্সের কাগজ রেডি। কাল সই করে দিতে হবে।সবকিছু কত দ্রুত হয়ে গেলো।”

অর্পা এসে শ্রেয়ার পাশে দাড়িয়ে বলে,”সে যাই হোক।শেষ ভালো যার সব ভালো তার।”
বলেই শ্রেয়াকে জড়িয়ে ধরে অর্পা।সৃষ্টি বেগম কৃতজ্ঞতা জানায় অর্পাকে।সবাই আনন্দ করতে থাকে।মিরাজ আসার পর চলে যায় অর্পা।

সবাই চলে যাওয়ার পর এবার একটু ফোন হাতে নিলো রিমলি।উদ্দেশ্য তার গল্প পোস্ট করা।ভালোভাবে গল্প রিচেক দিয়ে পোস্ট করে দিলো ফেইসবুকে।সাথে সাথে একটি লাভ রিয়েক্ট আসে।রিমলি চেক করে দেখে আইডির নাম শিহাব হাসান।একটা ছবিও নেই আইডিতে।শুধু আছে ব্লার ছবি দেওয়া।আবার কিছু ছবি অন্ধকার রাস্তায় মুখ লুকিয়ে রাখা।বিড়বিড় করে রিমলি বলে ওঠে,”ফ্যাক আইডি নাকি বুঝব কিভাবে?ফেইসবুকে একটা ছবিও নেই।ছেলে মানুষ তাও আবার পুলিশ সে কি না পিক দেয় না আইডিতে।আবার মেয়েদের ম্যাসেজ করে!”

চলবে…?

#আশার_হাত_বাড়ায় |১৩|
#ইশরাত_জাহান
🦋
সকাল সকাল ব্যাগ ঘুছিয়ে বাড়ি থেকে বেড় হতে নেয় অহি।টেবিলে বসে খাবার খাচ্ছিলো ফারাজ সহ বাকি সদস্য।অহিকে এভাবে বেড় হতে দেখে ফারাজ উঠে দাড়ায়।এগিয়ে এসে অহিকে প্রশ্ন করে,”এত সকাল সকাল তুমি কোথায় যাচ্ছো কাকি?”

অহির চোখে পানি।পানিগুলো মুছে মাথা নত করে বলে,”পাপ করেছি আমি।এক পাপী মেয়েকে জন্ম দিয়ে।কোনো শিক্ষা দিতে পারিনি।আমি তোর জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছি।আমার মেয়েটার সাথে তোর বিয়েটা না দিলেই ভালো হতো।আমার মেয়েটা তোকে ঠকালো।যেখানে আমার মেয়ে তোদের এত বড় ক্ষতি করেছে মা হয়ে কোন মুখে থাকি তোদের সামনে?তাই চলে যাচ্ছি আমি।”

অহির হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে ফারাজ বলে,”এভাবে পালিয়ে যাওয়ার কোনো মানে নেই।যে অন্যায় করেছে সে শাস্তি পাচ্ছে।তুমি কোনো অন্যায় করোনি।”

“কে বলেছে আমি অন্যায় করিনি?আমার তো প্রতিটি করা কাজই অন্যায়।প্রথম অন্যায় করেছি বামন হয়ে চাঁদে পা দেওয়া।মানে তোর কাকার মত বড়লোক কাউকে বিয়ে করা।”

কথাগুলো ফারাজের কাকা তিহানের দিকে তাকিয়ে বলেন।ফারাজের কাকাতো ভাই তুর্যর বয়স যখন ছয় তখন তার মা মারা যায়।ছেলেকে দেখাশোনা করার জন্য ফারাজের তিহান বিয়ে করে অহিকে।বিয়ের বছর কয়েক পর অহি হঠাৎ করেই মা হওয়ার অনুভূতি পায়।কিন্তু বাচ্চাটা নিয়ে আগ্রহী ছিলো না কেউ। তিহানের মতে তার ছেলের ভালোবাসা কমে যাবে।তূর্য নিজেও ক্ষিপ্ত হয়ে থাকতো।কিন্তু অহি অনুরোধ করে বাচ্চাটি নেয়।অহনার জন্মের পর ভালোভাবে যত্ন করতে পারেনা অহনাকে।তূর্য এসে এসে অহিকে নিজের সাথে ব্যাস্ত রাখতো। অহি যদি একটু বলত,”এখন অহনাকে খাওয়াতে হবে।”
ঠিক তখনই তিহান বাসায় আসলে নালিশ করে দিতো তূর্য।ছেলের প্রতি হওয়া অযত্ন উপলব্ধি করে অহিকে করেন নির্যাতন।আস্তে আস্তে অহনাকে ছেড়ে দিয়ে তুর্যর মন মতো হয়ে চলত অহি।অহনাকে না করেছে কখনও আদর না করেছে ঠিক মত শাসন।হুট হাট মাথা গরম থাকলে অহনাকে ধরে মারতো অহি।কখনও অহনাকে সামলাতে আসেনি কেউ।মেয়েটা যে রাগে দুঃখে নষ্ট পথে নিজের স্বাধীনতা বেচে নিয়েছিলো এটা শুধু অহি একাই বুঝতে পারছে।ফারাজ বা অন্য কাউকে বোঝালে কেউ বুঝতে চাইবে না অহনার এই নষ্ট পথে আসার সূচনা।তাই আজও মুখ বুজে চলে যেতে চান তিনি।অহনার পথচলাটা নাহয় তার জন্য ছিলো কিন্তু বিয়ের পর তো নিজেকে বদলাতে পারতো।ফারাজ তো তার সর্বস্ব দিয়ে অহনাকে ভালোবেসেছে।অহনার চাওয়া পাওয়া পূরণ করেছে।অহনা তখন তো নিজেকে সংযত করেনি।নিজের মর্জিতে চলা অহনার এই অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতে পারবে না অহি নিজেও।ফারাজ অহির ব্যাগ নিয়ে সিড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বলে,”তুমি কোথাও যাবে না।তুমি এই বাড়িতেই থাকবে।তুমি এই বাড়িতে বউ হয়ে এসেছো নিজ যোগ্যতায়।তোমার মেয়ের দোষ আমরা তোমাকে দিবো না।আর কেউ তোমাকে এই নিয়ে কিছু বলবে না।যদি বলে আমি তাকে দেখে নিবো।”

সকাল সকাল অফিসে এসে শ্রেয়া অবাক হয়ে দেখতে থাকে চারপাশ।ফুল দিয়ে সাজানো বিল্ডিংটা।খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে সবকিছু।অনেক সুন্দর দেখা যাচ্ছে।এনি এসে শ্রেয়াকে বলে,”কেমন আছো শেহনাজ?”

শ্রেয়া মৃদু হাসলো।এই নামটা তো শুধু সার্টিফিকেট অব্দি থাকে।এখন এনি তাকে এই নামে ডাকছে।শ্রেয়া উত্তরে জানিয়ে দেয়,”ভালো,আপনি?”

“আমি অনেক ভালো।”

“আজ অফিসে কিছু আছে?”

“একচুয়ালি হ্যান্ডসাম তার লাইফের কঠিন এক সময় পার করেছে।এই সময়টার জন্য তাকে ব্রেভ জানানো উচিত।তাই আমরা ছোটখাটো অনুষ্ঠান করছি।জীবনের কঠিন কঠিন মুহূর্ত কতজন পারে সফলভাবে কাটিয়ে দিতে!”

“আসলেই তাই।স্যার অনেক সাহসী।”

“তুমিও কিন্তু কম না।তোমার ভিতরেও সাহস আছে।কিন্তু ওটাকে জাগ্রত করতে পারো না।”

“এবার থেকে করব।”

আলতো হাসে এনি।সবাই হাততালি দিতে থাকে।শব্দ পেয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখতে পেলো ফারাজ এসেছে।এনি এসে একটি ফুলের তোড়া দিয়ে ফারাজকে বলে,”হ্যাপি নিউ লাইফ হ্যান্ডসাম।”

ফারাজ ফুলগুলো নিয়ে বলে,”থ্যাংক ইউ এনি।”

বলেই নিজের কেবিনের দিকে যেতে নিবে এনি পথ আটকিয়ে বলে,”আরো একটি সারপ্রাইজ আছে তোমার জন্য।”

ভ্রু কুঁচকে ফারাজ বলে,”কি?”

“চলো আমাদের সাথে।”
বলেই ফারাজকে নিয়ে যায় ক্যান্টিনে।শ্রেয়াকে ইশারা করে বুঝিয়ে দেয় সেদিকে যেতে।শ্রেয়া এনির ইশারা পেয়ে ওদের পিছনে যেতে থাকে।ফারাজের সামনে একটি টেবিলে কেক রাখা আছে।এনি কেক কাটা ছুরি দিয়ে বলে,”তোমার নতুন জীবন আমরা নতুনভাবে পালন করছি।সব অশুভ দিনগুলো শেষ করে বাকি দিনগুলো শুভ করার জন্য এই মিষ্টি মুখ।ইউ নো দ্যাট।আমরা সবাই সবার আনন্দে শামিল থাকি।তাই তোমার এই দিনটিও আমরা একসাথে উদযাপন করব।না করবে না।”

ফারাজ হালকা হেসে ছুরিটি নিয়ে কেক কাটে।এনিকে খাইয়ে দেয়।তারপর এনি সবাইকে খাইয়ে দিতে থাকে।সবাই সবার মত আনন্দ করতে থাকে।এনি এসে শ্রেয়ার কাছে দাড়ায়।শ্রেয়াকে নিজের হাতে কেক খাইয়ে দিয়ে বলে,”শুভ হোক তোমার বাকি দিনগুলো মাই লেডি।”

এনির মুখের দিকে তাকিয়ে শ্রেয়া বলে ওঠে,”আপনি জানেন?”

“হ্যান্ডসাম আমার থেকে কিছুই লুকায় না। হ্যান্ডসামের অবর্তমানে আমি তো এই কোম্পানি দেখে রাখতাম।বলা যায় আমি সবার বেস্ট ফ্রেন্ড।জীবনের ভালো মন্দ অনেকের বিষয়ে আমি অবগত।তেমন হ্যান্ডসামের বিষয়ে আমি অবগত।সেখান থেকেই কাল তোমার ব্যাপারে জেনেছি।”

বলেই শ্রেয়ার মুখের কাছে কেক এগিয়ে দেয় এনি।শ্রেয়া নিলো কেক।টিস্যু দিয়ে হাত মুছতে মুছতে ফারাজ এগিয়ে আসে শ্রেয়া ও এনির দিকে।শ্রেয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে,”এখানের কাজ শেষ করে আমার কেবিনে আসবেন।”

“ওকে স্যার।”

ফারাজ চলে যেতেই কিছুক্ষণ নাচ গান করতে থাকে অফিস কলিগরা মিলে।তারপর যে যার কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে।শ্রেয়া এসে ফারাজের কেবিনে নক করে।ফারাজ বলে,”কাম ইন।”

থাই গ্লাসের দরজা খুলে শ্রেয়া ভিতরে আসে।চেয়ারে বসতেই ফারাজ কিছু ফাইল দিয়ে বলে,”আমরা কাল বাইরে মিটিং করব।মিটিংটি লাঞ্চ টাইমের আগে হবে।ওখানে বাইরের থেকে লোকজন আসবে।আপনাকে এই ফাইল দেখে সবকিছু বুঝে নিতে হবে।আমি যখন যেই ফাইল চাইবো তখন সেই ফাইল দিবেন।ওদের সামনে আমি সবকিছু প্রেজেন্ট করব।আপনি শুধু বিষয়গুলো ফলো করবেন।নেক্সট থেকে আপনাকে এগুলো প্রেজেন্ট করতে হবে।”

শ্রেয়া ফাইলগুলো নিয়ে বলে,”ওকে স্যার আমি সবকিছু ফলো করব।”

“ওকে তাহলে আপনি এগুলো চেক করতে থাকুন।প্রয়োজন হলে ডেকে নিবো।”

“শিওর স্যার।”
বলেই উঠে দাড়ায় শ্রেয়া।নিজের কেবিনে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে ফারাজ পিছন থেকে বলে,”শুনুন।”

শ্রেয়া ঘুরে দাড়ালো।ফারাজ বলে,”ব্যাক্তিগত জীবন নিয়ে কাউকে কিছু জানানোর প্রয়োজন নেই।এনি শুধু জানে।কিন্তু আপাতত এই বিষয়ে আর কেউ জানলে অনেক কিছু ফেস করতে হবে।আপনাকে সহ আমি আমার মেয়েকে নিয়ে এই বিষয় নিয়ে আলোচনায় আসতে চাই না।”

শ্রেয়া মাথা নাড়ালো।যদিও সে কাউকে কিছু বলত না।কিন্তু মেয়ে মানুষ তো কথা চেপে রাখতে পারে না।তাই শ্রেয়াকে এলার্ট করে দিলো ফারাজ।শ্রেয়াকে ইশারা করতেই চলে যায় শ্রেয়া।ল্যাপটপ ওপেন করে নিজের কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে ফারাজ।শ্রেয়া এসে তার কেবিনে বসে ফাইলগুলো চেক করে।

চোখ পিটপিট করে চারপাশে তাকিয়ে অচেনা জায়গা পেয়ে সাথে সাথে বিছানা থেকে উঠে পড়ে অহনা।ভালোভাবে চারপাশে তাকিয়ে দেখতে থাকে।নিজের হাতে থাকা ব্যাগটি খুঁজতে থাকে।ঠিক তখনই হুইল চেয়ারে করে একজন মহিলা এসে বলে,”কিছু খুজছো মা?”

অহনা দেখলো মহিলাটিকে।বিরক্ত লাগছে তার সবকিছু।চোখমুখ কুঁচকে বলে,”আমার ব্যাগ।”

“ওটা আমি আলমারিতে রেখেছি।”

“ওহ।”

“তোমার নাম কি?এত রাতে বাড়ির বাইরে কি করছিলে?”

অহনা রাগ দেখিয়ে বলে,”আমি যাই করি না কেনো আপনাকে কেনো বলব?”

মহিলাটি একটু ক্ষিপ্ত হলো।প্রশ্ন করলো,”বাবা মা কিছু শেখায় নি তোমাকে?এগুলো কেমন ব্যাবহার?”

অহনা কোনো উত্তর করলো না।মনে মনে বলতে থাকে,”বাবা মা আমাকে কিছু শেখানোর সময় পেলে তো শিখবো।”

মহিলাটি অহনার কাছে এগিয়ে এসে বলে,”হাত মুখ ধুয়ে এসো।মুখে কালি লেগে আছে।ওই রাতে আমার ড্রাইভার তোমাকে নিয়ে এসেছিলো এখানে।তুমি নাকি রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলে।হঠাৎ ধাক্কা লাগে আমার গাড়ির সাথে।”

মুখে কালি লেগে আছে শুনতেই অহনার মনে পড়ে গেলো কালকের কথা।মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে আসে তার।মহিলাটি বলেন,”এভাবে মন খারাপ করে কিছু ভাবতে হবে না। যাও ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে নিবে।তারপর নাহয় নিজের বাড়িতে যাবে।”

নিজের বাড়ির কথা শুনতেই অহনা বলে ওঠে,”আমার কোনো বাড়ি নেই।”

মহিলাটি অহনার জামা কাপড় দেখে বলে,”এত দামী জামা পরা মেয়েটি বলছে তার কোনো বাড়ি নেই।হাতে তো ছিলো দামী একটি ব্যাগ।”

অহনা কথা না বাড়িয়ে চলে যায় ওয়াশরুমে।কথা বাড়াতে চায় না সে।নিজের ইচ্ছার বাইরে এখন কারো পরোয়া করে না অহনা।অহনা ভিতরে যেতেই মহিলাটির ফোনে কল আসে।রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ওনার ছেলে বলে,”আমি পৌঁছে গেছি মা।শুনলাম আমাদের গাড়ির সাথে কেউ অ্যাকসিডেন্ট করেছে।”

মহিলাটির নাম নাজমা আর তার ছেলে নিবিড়।মিসেস নাজমা বলেন,”হ্যাঁ বাবু। কাল রাতে তোকে এয়ারপোর্টে দিয়ে আসার পথে নাকি অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে।টেনশন নেই মেয়েটি এখন ভালো আছে।সিরিয়াস কিছু হয়নি।”

মায়ের কথায় স্বস্তি পায় নিবিড়।বলে ওঠে,”আচ্ছা মা।নিজের খেয়াল রেখো।সময়মত ঔষধ খেয়ে নিও।আমি এখন কাজে যাবো।”

“আচ্ছা বাবু তুইও নিজের খেয়াল রাখবি।”
বলেই কথা শেষ করে দুজনে।

শ্রেয়া এসেছে মিসেস তানহার কাছে।সাথে এসেছে সৃষ্টি বেগম, রিমলি ও অর্পা।মিসেস তানহাকে উদ্দেশ্য করে শ্রেয়া বলে,”রনির মা কোথায়?”

মুচকি হাসলেন মিসেস তানহা।শাশুড়িকে আজ মা না ডেকে স্বামীর মা সম্মোধন করছে।অবশ্য ওরা যেটা করেছে তাতে মন বিষিয়ে যাওয়ার কথা।শ্রেয়া তো সেখানে কিছু না করেই ছার দিয়েছে।কিছু কাগজ বেড় করে সামনে রেখে মিসেস তানহা বলেন,”আসবেন উনি একটু পর।তোমার পাওনা টাকা নিয়েই আসবে।নাহলে যে তার বিরুদ্ধে তুমি অ্যাকশন নিবে।”
কথাগুলো বলে হেসে দেয় মিসেস তানহা।শ্রেয়া নিজেও এবার মুখ বুজে মিষ্টি হাসি উপহার দেয়।অপেক্ষা করছে রুবিনার আসার। এখান থেকে কাজ শেষ করে আবার অফিসে যেতে হবে তাকে। লাঞ্চ টাইমে এসেছে ডিভোর্সের কাজ শেষ করতে।

হাতমুখ ধুয়ে বাইরে বেড় হয় অহনা। অহনার মুখের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকেন নাজমা।অহনা নিজের মতো মুখ মুছতে ব্যাস্ত।হুইল চেয়ার ঘুরিয়ে নাজমা বলেন,”নিচে চলো কিছু খেয়ে নিবে।”

অহনা কিছু বলে না।আসলেই তার এখন খুদা লেগেছে।দুপুর হয়ে এসেছে এখন। কাল রাত থেকেই না খাওয়া সে।নাজমা এখন সার্জেন্টকে ডাকতেই সে এসে নাজমাকে নিয়ে নিচে যায়।পিছু পিছু হটতে থাকে অহনা।

চলবে…?