আষাঢ়ের দোলনচাঁপা পর্ব-২৫

0
35

#আষাঢ়ের_দোলনচাঁপা
#পর্বঃ২৫
#Jhorna_Islam

“চাঁপাফুলললল?”
আষাঢ় নিজের গলার স্বর্ব শক্তি দিয়ে চিল্লিয়ে ডেকে উঠে দোলনকে। আষাঢ়ের হাতের ফোন টা হাত থেকে পরে গেছে অনেক আগেই। আষাঢ় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মস্তিষ্ক এখন পুরো ফাঁকা। আষাঢ় যেনো নড়াচড়া ও ভুলে গেছে। সে-তো মনে হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে বড় শ’ক খেয়েছে।

মেঘ আষাঢ়ের দিকে তাকিয়ে শব্দ করে কেঁদে উঠে। তোতলাতে তোতলাতে বলে,, আ-আষাঢ় বিশ্বাস করো আ-আমাকে। আ-আমি কি-কিছু করিনি আষাঢ়। আমি কিছু জ-জানি না। এসবে আমার কোনো হাত নেই। আমি এ-একদম নির্দোষ।তুমি আমাকে বিশ্বাস করো আষাঢ়। তুমিতো আমাকে চিনো আমিকি এ-সব করতে পারি তুমি বলো? আমি কিছু জানিনা হুট করে কি হয়ে গেছে। আমিতো দোলনকে দেখে রাখছিলাম কিন্তু কি করে কি হয়ে গেলো আমি জানি না। তুমি অন্তত আমাকে ভুল বুঝো না।

আষাঢ় কি কথা বলবে? সে দোলনের দিকে তাকিয়ে নিজেই রোবট হয়ে গেছে।

আর দোলন? সে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেঘের দিকে। একবারের জন্য ও আষাঢ়ের দিকে তাকায়নি।

আষাঢ় দোলনের দিকে তাকিয়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বোলায়।তার চাঁপাফুল হুইলচেয়ার ছেড়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। আষাঢ় কল্পনা ও করতে পারেনি তার দোলনকে এই মুহূর্তে এরকম ভাবে দেখবে এটা কল্পনাতেও ভাবেনি আষাঢ়।

মেঘ যখন আষাঢ়ের হাত ঝাঁকিয়ে বলছে সে কিছু করেনি একদম নির্দোষ,মেঘের ঝাঁকুনিতে আষাঢ়ের হুঁশ আসে।

এতক্ষন দোলন দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেও এখন আর পারছে না। দোলনের হাত পা আপনা আপনি অবশ হয়ে আসছে। মাথাটাও কেমন চক্কর দিয়ে উঠেছে। দোলন নিজের ভারসাম্য আর রাখতে না পেরে পরে যেতে নেয়।
আষাঢ় দোলনকে হেলতে দেখেই মেঘকে নিজের কাছ থেকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে এক প্রকার দৌড়ে এসে দোলনকে ধরে। দোলন নিজের চোখ বন্ধ করার আগে চোখ টিপটিপ করে আষাঢ়ের দিকে তাকায়। আষাঢ় দোলনের গালে আস্তে করে চ’ড় মেরে বলে,, একদম না চাঁপাফুল। চোখ বন্ধ করো না। খোলা রাখার চেষ্টা করো। নিজের মস্তিষ্ক সজাগ করো। সাহস যোগাও মনে এতো সময় যেভাবে নিজের শরীরে আর মনে সাহস নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলে এখনও চেষ্টা করো। তুমি ঠিক পারবে চেষ্টা করো চাঁপাফুল। দোলন এই দোলন? আষাঢ়ের কথা দোলনের কানে গেলো নাকি বোঝা গেলো না সে ততক্ষণে চোখ বন্ধ করে নিয়েছে।
দোলন নিজের জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।
আষাঢ় কোনো উপায় না পেয়ে দোলনকে কোলে তুলে রুমে চলে যায়। যাওয়ার আগে মেঘের দিকে এরকম ভাবে তাকায় যেনো আস্তো গি’লে খাবে।

মেঘ ফ্লোরে বসে আছে। তখন আষাঢ়ের ধাক্কায় নিচে পরে যায়। মেঘের সব পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে সে ধরা পরে গেছে। এখন ঐ দোলন সবকিছু আষাঢ় কে বলে দিবে।আষাঢ় কিছুতেই তাকে ছাড়বে না।আষাঢ় নিশ্চিত তাকে খু/ন করবে।আষাঢ়ের রাগ সম্পর্কে তার ভালো করেই ধারণা আছে। কেন যে ধৈর্য হারা হয়ে দোলন কে সিড়ি থেকে ফেলে দিতে গেলো।আরেকটু অপেক্ষা করে ভালো মতো প্লেন সাজিয়ে তারপর পদক্ষেপ নিতে হতো। মস্ত বড় ভুল হয়ে গেছে, এখন আম ও গেলো বস্তা ও গেলো। মাঝখান থেকে ঐ দোলন সুস্থ হয়ে গেলো।

মেঘ একটু আগের কথা ভাবতে থাকে,,,, সুমাকে মিসেস রিমির কাছে পাঠিয়ে মেঘ দোলনের হুইলচেয়ার নিয়ে সিড়ির কাছে এসে দাঁড়ায়। এসব পরিকল্পনা ছিলো না হুট করেই মাথায় আসলো দোলনকে সিঁড়ি থেকে ফেলে দিয়ে মেঘ কেটে পরবে।সব দোষ সুমার উপর দিয়ে দিবে তার সাপোর্টে তো তার মামনি আছেই । যেই ভাবা সেই কাজ দোলনের হুইলচেয়ার ঘুরিয়ে যখনই ধাক্কা দিতে যাবে সেই মুহূর্তে দোলন তাকে ধরে দাঁড়িয়ে যায়। দোলনের বসে থাকা হুইলচেয়ারটা তখন দোলনের পরিবর্তে সিঁড়ি দিয়ে গড়াতে গড়াতে নিচে পরে ভেঙে চৌচির হয়ে যায়। সেই শব্দে আষাঢ় এসে হাজির হয়ে যায়।

মেঘ নিজের ভাবনা থেকে বের হয়ে উঠে দাঁড়ায়। পায়ে একটু ব্যাথা পেয়েছে কিন্তু সেই ব্যাথাকে এখন পাত্তা দিলে চলবে না। এই সামান্য ব্যাথাকে পাত্তা দিতে গেলে ভবিষ্যতে তাকে এর চেয়ে হাজার গুণ ব্যাথা সহ্য করতে হবে।
মেঘ উঠে দাঁড়িয়ে এক প্রকার দৌড়ে নিজের রুমে চলে যায়। নিজের রুমে গিয়ে মেঘের সকল জিনিসপত্র তাড়াহুড়ো করে ব্যাগে ভরতে থাকে। এই বাড়িতে আর এক মুহূর্ত ও থাকবে না নিজের জীবন বাঁচানো ফরজ। দশ মিনিটের মধ্যে সবকিছু গোছগাছ করে রুম থেকে বের হয়। একবার ভেবে নেয় মিসেস রিমি কে বলে যাবে, কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে ও ফিরে আসে উনাকে পরে ফোনে সবকিছু বলা যাবে। এখন মামনির কাছে গেলে হাজারটা প্রশ্ন করবে এমনও হতে পারে যেতেও না দিতে পারে, তাই মেঘ মিসেস রিমি কে না বলেই চলে যেতে থাকে।

নিজের ব্যাগটা নিয়ে আষাঢ়দের বাড়ির গেইটের কাছে আসতেই বাঁধা পায় মেঘ।

“কি ব্যাপার আপনার সাহস তো কম না। আপনি আমার সামনে এই লাঠি ধরে রেখেছেন কেনো?”

“আপনি কোথাও যেতে পারবেন না।”

“মানে? আমি কোথাও কেনো যেতে পারবো না? ”

“আপনার বাইরে যাওয়া নিষেধ ম্যাডাম।”

“আমার বাইরে যাওয়া থেকে কে আটকাবো তুই? তোর সাহস দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। একটা দুই পয়সার দারোয়ান হয়ে তুই আমার রাস্তা আঁটকে দাঁড়াস?

মেঘের এরূপ কথায় দারোয়ান রহিম বেশ অবাক হয় কষ্ট ও পায়।মানুষ কি করে নিজের বাবার বয়সী লোককে তুই করে বলতে পারে। তবুও নিজেকে সামলে বলে,, আপনাকে যেনো এই বাড়ি থেকে বের হতে না দেই তেমনই নির্দেষ আছে ম্যাডাম।

“কে দিলো এমন নির্দেষ?”

“ঐ যে স্যার,,, রহিম বাড়ির বারান্দার দিকে হাতের আঙ্গুল দিয়ে ইশারায় দেখায়।”

রহিমের হাতের বরাবর মেঘ বাড়ির বারান্দার দিকে তাকিয়ে শুকনো ঢুক গিলে। সেখানে আষাঢ় দুই হাত ভাজ করে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
আষাঢ় ফোন বের করে কল লাগায়।

মেঘ ফোনের রিংটোনের শব্দে কেঁপে ওঠে। কাঁপা কাঁপা হাতে নিজের ফোনটা উপরে ধরে বুঝতে আর বাকি নেই সয়ং আষাঢ় তাকে ফোন দিয়েছে।

মেঘ একবার ফোনের দিকে তো একবার আষাঢ়ের দিকে তাকায়। আষাঢ় চোখের ইশারায় ফোন রিসিভ করতে বলে।
মেঘ কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা রিসিভ করতেই আষাঢ় বলে,,,,”কাউকে কিছু না বলে চোরের মতো কোথায় যাচ্ছিস তুই? ”

“আ-আমি বাড়িতে যাচ্ছি। মা খুব অসুস্থ। ”

“খালামনি এতোটাই অসুস্থ যে ব্যাগপাট্টা গুছিয়ে আমাদের কিছু না বলে একা একা পালাচ্ছিস?”

–প-পালাবো ক-কেনো?সত্যিই মা খুব অসুস্থ।
দারোয়ান কে বলো আমকে যেনো যেতে দেয়।

“যাবিইতো এতো তাড়া কিসের? ” তোকে ভালো মতো আপ্যায়ন করবো তারপর বিদায় দিবো ভিতরে আয়।”

-আ-আমি কি-কিছু করিনি আষাঢ় আমাকে যেতে দাও। আমার এখানে থাকতে ভালো লাগছে না।

–আমি কি বলেছি তুই কিছু করেছিস? এটা এমন হয়ে গেলো না যে চোরের মন পুলিশ পুলিশ? আর তোর এখানে ভালো লাগছে না সিরিয়াসলি? এখানেইতো সারাজীবন থাকতে চেয়েছিলি।এখন তাহলে মত বদলালি কেনো? চুপচাপ ভিতরে আয়।

–আমি বাড়ি যাবো।

–মনে হয় একা আসতে পারবি না। সুমাকে কি পাঠাবো সুন্দর করে তোর ঘাড় ধরে আনার জন্য? তুই বললে এখনই পাঠাচ্ছি।

আ-আমি আসছি।

আষাঢ় ঠোঁট বাঁকা করে হেসে ভিতরে চলে যায়।
মেঘ কোনো উপায় না পেয়ে কাঁপা কাঁপা পায়ে ভিতরে প্রবেশ করে। মনে মনে বলে,, আজ তুই শেষ মেঘ আজ তুই শেষ। কেউ আজ তোকে বাঁচাতে পারবে না।

*******
বর্তমানে আষাঢ়দের ড্রয়িংরুমে সকলেই উপস্থিত। আষাঢ় সকলকে ডেকেছে। মেঘের বাবা মা ও সেখানে আছে । দোলনের খালামনি আর সুমনকে ও ডাকা হয়েছে।
সকলেই উপস্থিত আছে শুধু আষাঢ়ের বাবা আর যিনি ডেকেছে তিনিই এখনও আসেনি। আষাঢ়ের জন্যই সকলে অপেক্ষা করছে। মেঘ এক কোণায় দাঁড়িয়ে আল্লাহ আল্লাহ করছে ভিতরটা মরুভূমির মতো শুকিয়ে চৌচির হয়ে গেছে তার।

কিছু মুহূর্ত পরেই আষাঢ় সিড়ি দিয়ে নেমে আসতে থাকে। আষাঢ় একা না তার সাথে দোলন ও আছে। দোলনও আষাঢ়ের সাথে নামছে যদিও আষাঢ় দুই হাতে আগলে ধরে নামাচ্ছে দোলনকে। দোলন আস্তে ধীরে কাঁপা কাঁপা পায়ে হেঁটে হেঁটে আসছে।

দোলনকে এরকম দেখে সকলেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। কেউই এতক্ষন জানতো না দোলনের জ্ঞান ফিরেছে। সকলেই বেশ অবাক হয়ে যায়। হা করে তাকিয়ে আছে দোলনের দিকে।
দোলন নিচে নেমেই নিজের খালামনির দিকে তাকিয়ে কেঁদে দেয়। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,,, খালামনি?

মিসেস খেয়া দৌড়ে দোলনের কাছে এসে দোলনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে। পুরো মুখে চুমু খেতে খেতে বলে,,তুই ভালো হয়ে গেছিস মা? তুই আমাকে খালামনি ডেকেছিস? মিসেস খেয়া খুবই ইমোশনাল হয়ে যায়। সুমন ও এগিয়ে এসে দোলনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।

এরমধ্যে আষাঢ়ের বাবা এসে উপস্থিত হয়। সকলের দিকে একবার করে তাকিয়ে বলে বাহ্ এখানে দেখা যায় মিলনমেলা চলছে।
কারো পরিচিত কন্ঠ শুনে মিসেস খেয়া পিছনে ঘুরে তাকায়। বহু বছর পর তিনি এই কন্ঠ শুনতে পাচ্ছেন।

মি.শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে চোখ আপনা-আপনি বড় হয়ে যায় । অন্য দিকে মি.শ্রাবণ ও মিসেস খেয়ার দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। বহু বছর পর কোনো কিছুর সম্মুখীন হতে যাচ্ছেন।

#চলবে,,,,?