আষাঢ়ে প্রণয় সন্ধি পর্ব-৩০

0
385

#আষাঢ়ে_প্রণয়_সন্ধি
#লেখিকা:#ইশা_আহমেদ
#পর্ব_৩০

চিত্রা সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে বসার রুমে আসতেই দেখলো নিজের নানুকে। তার সাথে বসে আছে তার প্রিয় দু’জন মানুষ । নিশি এবং রাফিন যাদের সে এতোগুলো বছর এড়িয়ে চলেছে। নানা বাড়ি, খালা বাড়ি সব জায়গায় যাওয়া বন্ধ করেছিলো। চোখের সামনে পুরোনো সেই স্মৃতি গুলো ভেসে উঠতে লাগলো। চঞ্চল তিন ভাই বোনের খিল খিল হাসির আওয়াজে মুখরিত চারপাশ।

“চিত্রা নানুভাই। এই বুড়ি নানুর কাছে আসবি না। কতগুলো দিন দেখি না তোকে। আয় চিত্রা কাছে আয় নানুভাই”

চিত্রা স্মৃতির পাতা থেকে বের হলো। তার নানু জাহানারা বেগমের কাছে গিয়ে বসলো। চিত্রা হঠাৎ ঝাপটে ধরলো তার নানুকে। জাহানারা বেগম কেঁদে উঠলেন। মেয়ের কাছ থেকে সব শুনেছেন তিনি। আষাঢ় নামক পুরুষটিকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিয়েছেন তিনি মনে মনে। তার নাতির জীবনে আসার জন্য। তার নাতিকে ভালোবাসার জন্য। চিত্রা বলে উঠলো,,

“কি হলো নানু কাঁদছো কেনো? কেঁদো না তো। ভালো লাগে না আমার। এমনিতেও আসার কথা ছিলো আরো অনেক আগে আর তুমি এখন আসলে। নাকি আমার হবু বর দেখতে এসেছো বলো তো?”

চিত্রার কথা রুমে থাকা নিশি এবং রাফিন চমকে তাকিয়ে আছে চিত্রার দিকে। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এতো বছর পর এরকম কথা বলতে শুনলো তারা চিত্রাকে। নিশি আজ একটু সাহস পেলো। চিত্রার সাথে একা কথা বলার চেষ্টা করবে ভাবলো।
জাহানারা বেগম চোখ মুছে বললেন,,,
“তোর হবু বর দেখতেই এসেছি। পছন্দ হলে আমিই বিয়ে করে নিবো তাকে”

“আচ্ছা নিও এখন যাও বিশ্রাম করো অনেক পথ অতিক্রম করে আসলে তো“

জাহানারা বেগম নাতির কথায় সম্মতি দিয়ে চলে গেলেন বিশ্রাম নিতে। মরিয়ম সুলতানা ও তিনজনকে একা রেখে নিজের কাজে চলে গেলেন। নিশি ভয় পাচ্ছে। কথা বলার সাহস হচ্ছে না তার। কিন্তু আগে সংকোচ ছাড়াই সব কথা বলে দিতো। তবে এখনকার সময়ের সাথে আগেকার সময়ের কোনো মিল নেই। নিশি এখনও আফসোস করে কেনো সে সেদিন ওরকম একটা বোকামি করতে গিয়েছিলো। একটুর জন্য বেঁচে ফিরেছে। রাফিন কিছু সময় চুপ থেকে বলো উঠলো,,

“কেমন আছিস চিত্রা?”

চিত্রা চোখ তুলে তাকালো। রাফিন ছেলেটা আগের থেকে অনেক বড় হয়েছে। চোখে মুখে এখন সেই চঞ্চল হাসিটা নেই। তবে সেও কি তার মতো হয়ে গিয়েছে। ছেলেটার মাঝে অনেক পরিবর্তন দেখতে পেলো চিত্রা। এখন চোখে চশমাও লাগিয়েছে। অনেকগুলো বছর পর তাদের সাথে দেখা চিত্রার।রাফিন চিত্রাকে উত্তর দিতে না দেখে বলে,,

“কি রে কথা বলবি না? আমি এতোটাই পর হয়ে গিয়েছি যে এতো বছরে একবারও একটু খবর নিলি না। নিশির কথা না হয় বাদ দিলাম। আমি! আমি কি করেছিলাম যে তুই আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করেছিস?”

চিত্রা চমকে উঠলো। ছেলেটার চোখে মুখে কেমন যন্ত্রণা দেখলো চিত্রা। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করলো। এরপর তাকালো রাফিনের দিকে। চিত্রা নিচু স্বরে বলল,,

“আমি জানি রাফিন এখানে আমার দোষ আছে আমি স্বীকার করছি। তবে আমি যেই বাজে পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গিয়েছিলাম তুই বল তারপর কি আদেও কোনো ছেলের সাথে আমি কথা বলতে পারতাম? এখন বলতে পারিস তারপর কি হলো! নেগেটিভ দিকগুলো আমাকে এমন ভাবে আঁকড়ে ধরেছিলো যে আমার ছেলেদের নাম শুনলেও গা গুলাতো। আষাঢ় সাহেব আমার সব নেগেটিভ ধারণাগুলোকে মাথা থেকে বের করেছে। দুঃখিত আমি এতোগুলো বছর তোদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ রাখার জন্য।”

রাফিন এবং নিশি দু’জনই খুব মনোরোগ দিয়ে শুনলো। রাফিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,,,
“বুঝলাম তবে দয়া করে এখন আর এমন করিস না”

নিশি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,,
“আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না চিত্রা? আমি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি। আমার সাথে কথা বলিস না কতগুলো বছর হয়ে গেলো। তোর মতো কাউকে পেলাম না এতোগুলো বছরে। তুই এবার তো কথা বল”

“এই সব পুরোনো কথা বাদ দে। এখন আমার বিয়ে নিয়ে কথা বলি। পুরোনো কথা মনে করলে দুঃখ ছাড়া কিছুই পাওয়া যাবে না। আর ক্ষমা আমি তোকে অনেক আগেই করে দিয়েছি”

নিশি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো।যাক অবশেষে এতোগুলো বছর পর। রাফিনের গম্ভীর মনোভাব কেটে গেলো। সে বেশ উৎকন্ঠা কন্ঠে বলে উঠলো,,
“তো জিজুকে দেখাবিনা? কেমন দেখতে সে দেখবো না আমরা?”

চিত্রা পরলো মহা বিপাকে এখন সে আষাঢ়কে কিভাবে দেখাবে এদের। তখনই চিত্রার মুঠোয় থাকা ফোনটি বেজে উঠলো। তিনজনই লাফিয়ে উঠলো। এই মুহুর্তে কেউই এটা আশা করেনি। চিত্রা কে ফোন করেছে তা না দেখেই রিসিভ করে ফেললো।
“চিত্রা কি করছেন? সকালে খেয়েছেন আপনি?”

চিত্রা চমকে ফোন কান থেকে নামালো। স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে আষাঢ় সাহেব নামটা। নিশি এসে চিত্রার একপাশে বসে পরলো। রাফিন উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করলো। চিত্রা দু’জনের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে ফোন কানে দিয়ে বলল,,
“ভাই বোনদের সঙ্গে বসে আছি। সকালে এখনো খাওয়া হয়নি! আপনি খেয়েছেন”

“আমি খেয়েছি। আপনিও আমার সাথে কথা বলা শেষ হলেই খেয়ে নিবেন। আপনাকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার জন্য কল করেছিলাম”

“জি বলুন”

“আসলে চিত্রা আমরা একে বারে বিয়ে করে নেই। একেবারে বিয়েটা হোক আংটি বদলের পরিবর্তে। এতে কি আপনার সমস্যা চিত্রা”

“আপনি আব্বুকে বলুন আষাঢ় তিনি যদি চান তবে আমার সমস্যা নেই। আব্বু বেশি ভালো বুঝবেন এসব ব্যাপারে”

“আচ্ছা ঠিক আছে আমি একটু পরে আম্মাকে পাঠাচ্ছি কথা বলার জন্য।”

নিশি ফোন কেড়ে নিয়ে বলে,,
“দুলাভাই কেমন আছেন? আমি আপনার শালিকা বলছি। শুনুন আপনাকে তো এখনো দেখিনি আমরা এক কাজ করুন কিছু বাহানা মেরে এখানে চলে আসুন। আপনাকে দেখবো আমরা”

আষাঢ় নিঃশব্দে হেসে বলে,,
“আপনারা বরং আসুন আমাদের বাসায়। না হয় বিয়ের দিন দেখবেন একেবারে। না হয় চিত্রার কাছ থেকে ছবি দেখে নিবেন। রাখছি ভালো থাকবেন”

আষাঢ় কল কেটে দিলো। চিত্রা হাসছে। নিশির মুখটা চুপসে গিয়েছে। সে ভেবেছিলো আষাঢ় আসবে তবে উল্টো হলো সব। ফোন হাতে নিয়ে চিত্রার দিকে তাকিয়ে আসছে। চিত্রা এবার শব্দ করে হেসে ফেললো। রাফিন হাসছে সাথে লাউড স্পিকারে দেওয়া ছিলো যার কারণে আষাঢ়ের কথাগুলো সবাই শুনেছে। নিশি মুখ ভেংচি দিয়ে বলে,,

“তুই ও যেমন কাঠখোট্টা তোর বর ও তেমন। কি রে ভাই! বললাম একটু দেখবো আর সে আমাকে মুখের উপর অপমান করে দিলো”

চিত্রা হাসি থামিয়ে বলে,,“সে তোর আর পাঁচটা দুলাভাই এর মতো নাহ। সে আলাদা। এর জন্যই তাকে আমি বেছে নিয়েছি।”

রাফিন বলে,,“আমি খুব খুশি হয়েছি চিত্রা তুই নিজের জীবনে কাউকে সুযোগ দিয়েছিস বলে। অতীত আঁকড়ে ধরে থাকিসনি বলে”

তিনজন গল্প করা শুরু করলো। কতগুলো বছর পর তিন ভাই বোন আবারও এক হয়েছে। এর থেকে বেশি আর কি চাই। তিনজন সেই ছোটবেলার মতো হাসাহাসি করছে। মরিয়ম সুলতানা আড়াল থেকে দেখলেন সব। এটা ভেবে খুশি হলেন তিনজন আবারও এক হয়েছে। অতঃপর খেতে ডাকলেন।

বেলী বেগম এসেছেন বিয়ের কথাবার্তা বলতে। বসার ঘরে সবাই বসে আছেন। জাহানারা বেগম ও আছেন তাদের মধ্যে। আরমান সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বেলী বেগম বলেন,,

“ভাই আসলে চাইছিলাম কি আংটিবদলের পরিবর্তে বিয়েটা একেবারে হয়ে গেলে তো সমস্যা নেই না?”

আরমান সাহেব কিছুক্ষণ ভেবে বলেন,,
“না আপা সমস্যা নেই তবে আমার মেয়ের কিছু ইচ্ছে ছিলো”

“জি ভাই বলুন কি ইচ্ছে?”

“বিয়েতে যেনো খুব অল্প কিছু মানুষ থাকে এবং খুব সাদামাটা ভাবে বিয়ে করতে চাইছে চিত্রা”

বেলী বেগম হেসে বলেন,,
“এতে আমার কোনো সমস্যা নেই। আমাদের বাড়ির কেউ আসবে না বিয়েতে। আমার আর আষাঢ়ের আব্বুর প্রেমের বিয়ে ছিলো তো তাই তারা মেনে নেয়নি। তাই সেসব ঝামেলা নেই।তাহলে ভাই বিয়েটা কি সামনের শুক্রবার ঠিক করা হচ্ছে?”

“হ্যাঁ আপা এতে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। তাহলে আগামী শুক্রবারই বিয়েটা হচ্ছে”

এরপর সবাই আরো টুকটাক কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পরলো। বিয়ে নিয়ে কথা বলছে সবাই। জাহানারা বেগমের ভীষণ পছন্দ হয়েছে বেলী বেগমকে। তিনি অবশ্য এখনো আষাঢ়কে দেখেনি। তবে মেয়ের মুখে আষাঢ়ের অনেক প্রশংসা শুনেছে। তার থেকে বড় কথা ছেলেটাকে তার নাতি পছন্দ করে। এতেই শান্তি।

#চলবে~