আষাঢ়ে শ্রাবণের বর্ষণ পর্ব-১১+১২

0
2220

#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির

[পর্ব-১১1]

বিকেলে বাড়ির পিছনের লনের দিকে হাঁটছে অভ্র। এখানে এসেছে আজ কয়েকদিন হলো। কিন্তু বাড়ির আশেপাশে ঘুরে দেখা হয়নি তার। এখানে আসার পর থেকেই আরিয়ানের সাথে প্রতিদিন বাহিরে ঘুরাঘুরি করেছে। তবে আজ বিকেলে অবসর। বাহিরে ঘুরতে যাবে না তারা। তাই এই অবসর সময় কাটাতে বাড়ির পিছনের দিকে আসা। দুপুরে ঝুম বৃষ্টি হওয়ায় বাড়ির আনাচে কানাচে ভিজে টুইটুম্বুর হয়ে আছে। কাঠের তৈরিকৃত ব্যাঞ্চিগুলো ভিজে একাকার। লনের এক পাশে নিশিতা আর আয়েশা নিজেদের হাতে যত্ন সহকারে বিভিন্ন সবজি লাগিয়েছে। সেগুলোও বর্ষণে ভিজে আছে। যার সদ্য কচি পাতা থেকে টুপটুপ পানি ঝরছে। শীতল বাতাসে গাছের পাতা নড়বড়ে। কর্দমাক্ত মাটিতে হাঁটার সময় একটা ইটের টুকরো তে খোঁচট খেলো অভ্র। বিরক্ত হলো কিছুটা। ঝুকে ইটের ভাঙ্গা টুকরো টা হাতে নিয়ে দূরে ছুড়ে মারলো। তখুনি পাশ থেকে একটা মেএয়েলী কন্ঠস্বর ভেসে আসলো।

‘হেই ইউউউ!’

রিমির রাগান্বিত কণ্ঠ কর্ণগোচর হতেই অভ্র পিছে ফিরে তাকালো। রিমির অবস্থা দেখে বিস্মিত হলো বেশ। তবে ভীষণ হাসি পেলো তার। হাসি আটকাতে না পেরে তাৎক্ষনাৎ হুহা করে হেসে ফেললো। কারণ রিমির সাদা জামা কাদায় মাখামাখি অবস্থা। অভ্রকে এভাবে হাসতে দেখে রিমির রাগের মাত্রা আরো দ্বিগুণ হয়ে গেলো। ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠলো, ‘হাসছেন কেন আপনি?’

‘মাটির সাথে হাডুডু খেলে এসেছেন নাকি মিস সয়েল কুইন?’

রসিকতার ছলে বললো অভ্র। কিন্তু এতে রিমির রাগ আকাশ চুম্বী হলো। তার কণ্ঠস্বরে ক্রোধ প্রকাশ করে শুধালো, ‘হাউ ডেয়ার ইউ? আমাকে সয়েল বলার সাহস হয় কি করে আপনার? নিজে আমার গায়ে কাদা ভরিয়ে আবার বলছেন আমি হাডুডু খেলছি?’

তাৎক্ষনাৎ ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকে এলো অভ্রের। কপালে সরু ভাজ ফেলে জানতে চাইলো, ‘আমি ভরিয়েছি মানে?’

রিমি কন্ঠ ব্যাঙ্গ করে বললো, ‘এহেহে, ঢং করছেন এখন? ইট দিয়ে ঢিল কে মা*র*লো? ভূতে?’

এতোক্ষণে সম্পূর্ণ ঘটনা বুঝে আসলো অভ্রের। খেয়াল করে দেখলো কিছুক্ষণ আগে ছুঁড়ে ফেলা ইটের টুকরো টা রিমির পাশে পরে আছে। নিজের ভুল বুঝতে পারার পরেও অপরাধবোধ কাজ করলো না তার মনে। বরঞ্চ উলটো নিজের সাফাই গেয়ে বললো, ‘আমি ইটের টুকরো রাস্তার পাশে ফেলেছি। তুমি ওখানে কি করছিলে? তোমার সাবধানে থাকা উচিত ছিলো।’

রিমি কোমড়ে হাত রেখে ত্যাঁছড়া গলায় বললো, ‘দোষ করছেন আপনি আবার সাফাই গাইছেন? চোখ কি আকাশে ছিলো? পাশে একটা আস্তো জ্যান্ত মানুষ দাঁড়িয়ে ছিলো। দেখেন নাই?’

অভ্র নিজেও ত্যাঁড়া ভাবে বললো, ‘চোখ সাথেই ছিলো। আর আমার কোনো দোষ নেই ওকে? মশার মতো শরির হলে দেখবো কিভাবে?’

‘কি বললেন? আমাকে মশার সাথে তুলনা করলেন? এতো বড় অপমান? আপনাকে তো আমি….’ অতিরিক্ত রাগের মাথায় উত্তেজিত হয়ে উঠলো রিমি। অস্থির হয়ে আশেপাশে তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজতে লাগলো। অভ্র চোখ ছোট ছোট করে রিমির মতিগতি বুঝার চেষ্টা করছে। কি করতে চাইছে মেয়েটা? সবজি গাছের পাশে ছোট একটা প্লাস্টিকের বল ছিলো যেখানে কাদা মাটি রাখা। রিমির এগিয়ে বল হাতে নিয়ে অভ্রের দিকে ছুঁড়ে মারলো তাৎক্ষনাৎ। মুহূর্তেই অভ্রের অবস্থা কাদা ভরে খারাপ হয়ে গেলো। আকস্মিক ঘটনায় অভ্র হতভম্ব হয়ে গেলো। কণ্ঠস্বরে বিস্ময় প্রকাশ করে বলে উঠলো, ‘এটা কি হলো?’

রিমি দাঁত কেলিয়ে হাসলো। কর্দমাক্ত পাতিলটা পাশে ফেলে দিয়ে বললো, ‘পাটকেল দিলাম!’

অভ্রের রাগ হলো প্রচুর। চোয়াল শক্ত করে ধমক দিয়ে বলে উঠলো, ‘হুয়াট দ্যা হেল! এমন বাচ্ছামো করার মানে কি?’

অভ্রের ধমক শুনে রিমি কিছুটা ভরকে গেলো। কিন্তু প্রকাশ না করলো না। উল্টো কড়া চোখে তাকিয়ে ব্যাঙ্গ্য করে বললো, ‘বেশ করেছি। এখন আপনাকেও সুন্দর লাগছে।’

অভ্র একবার নিজের দিকে তাকালো। সাদা শার্টটা কাদায় একদম মাখামাখি অবস্থা। সারা কাপড় থেকে কাদার দাগ উঠানো অনেক কষ্ট! আবার মাঝে মাঝে উঠেও না। যদি এই শার্টেরও না উঠে? ক্রোধান্বিত হলো অভ্র। প্রিয় শার্টের এমতাবস্থা দেখে রিমির দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে শক্ত গলায় বলে উঠলো, ‘শার্টের দাগ যদি না উঠেছে তাহলে তোমার বারোটা বাজাবো আমি।

রিমি বুড়ো আঙ্গুল টা দেখিয়ে দিয়ে ভেংচি কেটে বলল, ‘কচু করবা তুমি।’

চলেই গটগট পায়ে চলে যাবার জন্য পা বাঁড়ালো। অভ্র রাগে ক্ষোভে স্থির দাঁড়িয়ে রইলো। প্রচন্ড রাগ হচ্ছে তার। মেয়েটাকে একবার হাতের কাছে পেলে বুঝিয়ে দিবে মজা। রাগে ফুঁশ করে একটা নিশ্বাস ফেলে রিমির পিছু হাঁটতে লাগলো।

বিকেলের শেষভাগে অর্থাৎ সন্ধ্যা বেলায় শান্তি নিবাসে আড্ডার আসর বসে। কিন্তু আজ সেই হাসি শব্দ নেই আড্ডায়। কারণ পরিবারের ছোটরা এই আসরে অনুপস্থিত। রয়েছে শুধু বড়রা। নিশিতা একটা বড় কাথা নিয়েছে। সেই কাথা-ই সেলাই করছে নিশিতা, আয়েশা ও রোহানা। কাথা সেলাই করছে ও কথা বলছে। তাদেরই কথোপকথনের সঙ্গি হচ্ছে আবরার। সিঙ্গেল সোফায় হেলান দিয়ে বসে মা-চাচির কথা শুনছে, মাঝে মাঝে নিজেও কথা বলছে ও হাসাহাসি করছে।

রিমি নিজের গায়ে এমন কর্দমাক্ত অবস্থা দেখে নিজেরই ঘিনঘিন লাগছে তার। নিজেকে পরিষ্কার করার দ্রুত পা চালিয়ে বাড়ির ভিতরে আসলো। ড্রয়িংরুমের সোফায় তাদেরকে বসে থাকতে দেখে ধাতস্থ হলো রিমি। কিছুতেই নিজের এমন অবস্থা তাদের দেখানো যাবে না। নিশিতা দেখলে তো বকাবকি শুরু করবে। তাই চুপিচুপি পায়ের কদম ফেলে সিঁড়ির দিকে যেতে লাগলো। চোখ এড়ালো না আবরারের। সোফায় বসে থেকেই ডেকে উঠলো, ‘কিরে পেত্নী। শরিরের এই অবস্থা কেন তোর?’

দাঁড়িয়ে পরলো রিমি। চোখমুখ বন্ধ করে খিঁচে বিড়বিড় করে বললো, ‘শিট গার্ল!’ মহা বিরক্তি ও অস্বস্তি নিয়ে পিছু ঘুরে দাঁড়ালো। আয়েশা জিজ্ঞেস করলো, ‘পরে গিয়েছিলি নাকি? ব্যাথা পেয়েছিস?’

রিমি মাথা এপাশ থেকে অপাশ নাড়িয়ে ‘না’ বুঝালো। তখুনি সদর দরজা দিয়ে ভিতরে অভ্র আসলো। রিমির মতো অভ্রের একই হাল দেখে বিস্মিত হলো সবাই। সবাইকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে দাঁড়িয়ে পরলো অভ্র। চোখেমুখে তার অসন্তুষ্টি স্পষ্ট ভাস্যমান। রিমি ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে অভ্রের দিকে। যতো যাই হোক, অভ্র বাড়ির মেহমান! আর মেহমানের সাথে এরূপ আচরণ করা অনুচিত। কিন্তু সে এমনই করেছে। এবার নিশ্চয় সবাই তার উপর ক্ষেপে যাবে। ভয়ে শুকনো ঢুক গিললো রিমি।

অভ্রের এমন অবস্থা দেখে রোহানা বিস্মিত হয়ে বলে উঠলো, ‘ওমা! তোমারও দেখছি একই অবস্থা। কি হয়েছে তোমাদের? গায়ে কাদা কেন?’

অভ্র রিমির দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল, ‘হাতিকে মশা বলে সম্মোধন করায় এই অবস্থা।’

রিমির মুখ সাথে সাথে হা হয়ে গেলো। তখন তাকে মশা বলেছে; আর এখন হাতি বলছে। রাগে শরির রিনরিনিয়ে উঠলো। দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে কিড়মিড়িয়ে অভ্রর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘মানে কি? তখন আমাকে মশা বলেছিলেন। আর এখন হাতি বলছেন?’

অভ্র বললো, ‘তো করবো টা কি? সত্ত্য কথা বলায় যেহেতু গায়ে কাদা ছুড়েছো। সেহেতু মিথ্যেই বলা শ্রেয়। ভুল কিছু বলেছিলাম? তোমাকে তো মশার সাথেও তুলনা করলে মশাকে অপমান করা হবে।’

রিমি অভ্রের দিকে এক হাত তুলে সবার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘দেখেছো আবার আমাকে মশা বলছে।’

দুজনের এমন কথোপকথন শুনে হতভম্ব হয়ে রইলো সবাই। অভ্রের এই হাল যে রিমি ইচ্ছাকৃত করেছে তা বুঝতে বাকি নেই কারোর। নিশিতা এতোক্ষণে মুখ খললো, ‘রিমি এটা কেমন অসভ্যতামি? বাড়ির মেহমানের সাথে কেমন ব্যবহার করা উচিত জানো না?’

নিশিতা অভ্রের পক্ষে কথা বলায় ভারি অবাক হলো রিমি। নিজেকে নির্দোষ প্রমান করতে বলে উঠলো, ‘আম্মু? উনি প্রথমে আমার জামায় কাদা ছুড়েছে। তারপর আমি দিয়েছি। এখানে আমার কোনো দোষ নেই।’

অভ্র রিমিকে বললো, ‘আমি ইচ্ছাকৃত ভাবে দেইনি। তুমি ইচ্ছে করে আমার শার্টে কাদা ভরিয়েছো।’

রিমি ঝাঁঝ মেশানো গলায় বললো, ‘পাশে আস্তো একটা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে আর আপনি দেখেন নি? ঢং মারছেন এখন? অবশ্যই আমাকে ইচ্ছে করে দিয়েছেন। তাই আমিও দিয়েছি। এখানে দোষ আপনার। নাহলে আমি দিতাম না।’

আবরার গালে এক হাত দিয়ে চুপচাপ দুজনের ঝগড়া দেখছে। অভ্র যে এভাবে ঝগড়া করতে পারে সেটা তার কল্পনার বাহিরে ছিলো। সবসময় পরিপাটি থাকা ছেলেটা আজ ঝগড়া করছে। ভাবতেই বিস্ময় লাগছে বেশ। নিশিতা মেয়ের কথা কানে নিলো না। বরঞ্চ ধমকে বলে উঠলো, ‘চুপ কর রিমি। বেয়াদবির একটা সীমা থাকে। অভ্র তোমার বড়। তার সাথে এমন আচরণ ঠিক হয়নি তোমার।’

রিমি নিজের সাফাই নিজেই গাইতে লাগলো, ‘কি ঠিক হয়নি। আমাকে বলছো কেন তুমি? এই লুজার আমাকে প্রথম দিয়েছে তাই আমি দিয়েছি।’

অভ্রকে লুজার বলে নিজেই ভ্যাবাচ্যাকা খেলো রিমি। থমথমে হয়ে গেলো মুখখানি। ইতস্তত করে অভ্রের দিকে তাকালো। তারপর চোখ ঘুরিয়ে অন্যদের দিকে তাকিয়ে দেখলো সবাই অবাক। নিজের উপর রাগ হলো তার। মুখ ফসকে কি বলে ফেলেছে সে? আড় চোখে আবারো অভ্রের দিকে তাকালো রিমি। অভ্র চোয়াল শক্ত করে রিমির দিকে এক পলক পাকিয়ে উপরে চলে গেলো। তখুনি নিশিতা ধমকে উঠলো, ‘এইসবের মানে কি রিমি? অভ্র বাড়ির মেহমান। তোমার ভাইয়ের সাথে কাজ করে সে। এভাবে অপমান করার সাহস পেলে কোথায়? আদর পেতে পেতে মাথায় চড়ে গেছো। অভ্রের কাছে মাফ চাইবে তুমি। বেশি কথা বললে চ:ড় লাগাবো গালে।’

অতিরিক্ত রেগে কথা গুলো বললো নিশিতা। তারপর কাথা ফেলে উঠে চলে গেলো বসার রুম থেকে। আবরার চুপচাপ উঠে দাঁড়াল। রিমির কাছে এসে বললো, ‘স্যরি বলে নিস।’ বলেই উপরে চলে গেলো।রিমি হতবাক হয়ে ফুঁশ করে একটা বিরক্তির নিশ্বাস ফেলে গটগট পায়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো।

রিমিকে কথাটা বলেই উপরে চলে আসলো আবরার। নিজের রুমের ভিতর ঢুকার সময় দাঁড়িয়ে পরলো সে। ঘাড় ঘুরিয়ে দীবার রুমের দিকে তাকালো একবার। তার রুমের পরের রুমটাই দীবার রুম। এইসময় দীবা কি করছে? দীবাকে দেখার ইচ্ছা পোষন করলো তার মন। তাই বিলম্ব না করে দীবার রুমের দিকে এগিয়ে আসলো। দরজায় হালকা ধাক্কা দিতেই দেখলো খোলা। তাই অতি সাবধানে দরজার এক পাশ খুলে ভিতরে তাকালো। দেখলো স্টাডি টেবিলের উপর দুই পা রেখে চেয়ারে হেলান শুয়ে আছে দীবা। হাতে তার পপকর্নের বাটি। টেবিলের উপর ল্যাপটপ রেখে ‘ইউর নেইম’ এনিমি লাগিয়ে এক মনে মুভি দেখছে আর পপকর্ন খাচ্ছে। অন্যদিকে বিন্দুমাত্র ধ্যান নেই তার। পিছন থেকে দেখলো আবরার। দীবার শুয়ে থাকার স্টাইল দেখে হাসি পেলো তার। বাচ্চা মেয়েটার প্রেমে সে এভাবে হাবুডুবু খাচ্ছে। ভাবা যায় এইসব? মৃদু হাসলো আবরার। কোনো প্রকার শব্দ না করেই দরজা লাগিয়ে দিলো সে।

হঠাৎ দীবার মস্তিষ্ক সজাগ হলো। টেবিল থেকে পা নামিয়ে দরজার দিকে তাকালো। কেউ এসেছিল নাকি? কোনো প্রকার সাড়াশব্দ পায়নি দীবা। তবুও তার সিক্স সেন্স বলছে এই মাত্র রুমে কেউ এসেছিলো। কিন্তু চুপিচুপি কে আসবে? কপালে সূক্ষ্ম চিন্তার ভাজ পরলো দীবার। দ্রুত পপকর্নের বাটি টেবিলে রেখে চেয়ার থেকে উঠে দরজার কাছে আসলো। দরজা খুলে বাহিরে এসে আশেপাশে তাকালো। না! কাউকে দেখতে পারছে না। তাহলে কে আসলো? নাকি মনের ভুল? সন্দেহ হলো দীবার। তার মন বলছে কেউ এসেছে। কিন্তু কে? উফফ! বিরক্ত হলো নিজের উপর। চুপচাপ দরজা লাগিয়ে দিয়ে টেবিলের কাছে গেলো আবার।

চলমান…

#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির

[পর্ব-১২]

রাতের আবহাওয়া শীতল। প্রবল বাতাস বইছে বাহিরে। ঝুম বৃষ্টি নেই তবু পরিবেশ কেমন গুমট বেধে আছে। ‘শান্তিনিবাসে চলছে নিরবতা। যে যার আপন কাজে নিজ কক্ষে অবস্থান করছে। ঘুমানোর সময় এখন। কিন্তু আবরার বারান্দায় বসে আছে। বিষণ্ণবদন তার মন। কারণটা দীবাকে দেখতে না পারা। সন্ধ্যার পর থেকে রাত অব্ধি আবরার ড্রয়িংরুমে বসে ছিলো। কারণ টা শুধু মাত্র দীবাকে একপলক দেখার আশায়। আবরার নিজেও জানে না সে দীবাকে দেখার জন্য এতো ব্যাকুল হয়ে আছে কেন। প্রথমদিন থেকে আজ অব্ধি যতবার দীবাকে দেখেছে ততোবার মুগ্ধ হয়েছে। মনের সুপ্ত কোণে কিছু একটা অনুভব হয়েছে তার। প্রতিদিন সন্ধ্যায় দীবা চা বানাতে রান্না ঘরে আসে। আর আবরার? সোফায় বসে থেকে দীবাকে পর্যবেক্ষণ করে। যতোক্ষন পর্যন্ত দীবা চা বানাতে রান্না ঘরে থাকে ততোক্ষণ আবরার সেখানে বিভিন্ন বাহানা দেখিয়ে বসে থাকে। দীবা যেতেই সেও চলে যায়। কিন্তু আজ রাতে দীবা নিচে আসেনি। দীবাকে দেখার আশায় অস্থির হয়ে ছিলো আবরারের মন। রাত্রি গভীর হয়েছে। খাওয়া দাওয়াও সম্পন্ন হয়েছে সবার। কিন্তু দীবা নিচে নামে নি। আয়েশা সবাইকে জানায় দীবার মাইগ্রেনের ব্যাথা উঠায় সন্ধ্যার পর খাবার খেয়ে মেডিসিন নিয়ে ঘুমিয়ে গেছে। আশাহত হলো আবরার। ক্ষুন্ন মনে নিজ কক্ষে চলে আসলো সে। বারান্দায় বসে দীবাকে নিয়ে ভাবতে লাগলো আবরার। এখন অপেক্ষা সকালের।
_________________

‘হেই বস, হুয়াট আর ইউ ডুয়িং হেয়ার?’

রবিন্দ্রনাথের ‘নৌকাডুবি’ বইটা দিয়ে আরিয়ানের পিঠে হাল্কা বাড়ি দিয়ে বললো রাইমা। আরিয়ান ঘাড় কাত করে রাইমা কে দেখে মিষ্টি একটা হাসি দিলো। রাইমা এগিয়ে আরিয়ানের পাশে বসেই প্রশ্ন ছুঁড়লো, ‘মন খারাপ তোমার? এতো রাতে এখানে কি করছো?’

‘তেমন কিছু না। এমনি বসে ছিলাম।’

রাতের পরিষ্কার আকাশ। সাদা মেঘ আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছে। চাঁদটা হয়তো কোথাও উকি দিয়ে আছে কিন্তু ‘শান্তিনিবাস’এর ছাদ থেকে তার প্রদর্শন করা যাচ্ছে না। সেই দুপুরে ভারি বর্ষণের পর আগ্রাবাদে আর বৃষ্টি হয়নি। তাই পরিষ্কার আকাশে শীতল বাতাস প্রভাহমান। ছাদে ইটের তৈরিকৃত ব্যাঞ্চির উপর বসে আছে তারা দুজন। আরিয়ানের হাতে ক্লাসিক হাই গ্লোস অরেঞ্জ কালার গিটার। উষ্ঠধয় কামড়ে ধরে চুপচাপ গিটারের তার পর্যবেক্ষণ করছে সে। সোডিয়ামের কৃতিম আলোতে ছাদের এক পাশ আলোকিত হয়ে আছে। সেই আলোতে রাইমা আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আরু ভাই? একটা জিনিস খেয়াল করেছো??’

আরিয়ান গিটারের দিকে তাকিয়ে থেকেই ছোট করে বললো, ‘কি?’

রাইমা একটু নড়েচড়ে বসলো। তারপর আরিয়ানের দিকে ঘুরে বসে বললো, ‘আরব ভাইয়া মনে হয় দীবার প্রতি একটু উইক।’

রাইমার কথা শুনে তাচ্ছিল্য ভাবে হেসে উঠলো আরিয়ান। ত্যাঁছড়া চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘এমন কিছু জীবনেও সম্ভব না।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ এমন কিছু ঘটেছে বলেই সম্ভব। আমি এই কয়েকদিন খেয়াল করেছি। আরব ভাই দীবার দিকে কেমন চোরা চোখে তাকায়।’

আরিয়ানের চেহারায় এবার বিরক্ত আসলো। কণ্ঠস্বরে ক্রোধ প্রকাশ করে আবরারের উদ্দেশ্যে বললো, ‘এরে তো ইচ্ছে করে ধরে কিছুক্ষণ কে*লা*নি দেই। দীবা তার লিগ্যাল ওয়াইফ, তাহলে মেনে নিতে সম*স্যা কোথায়? ওই তো এমন ভাব দেখাই যেন রানী ভিক্টোরিয়ার নাতি তার জন্য পাগল। রেডিকিউলাস!’

‘প্রথমে হয়তো ভালো লাগতো না কিন্তু এখন ভালো লাগে।’

আরিয়ান জড়তাহীন ভাবে বলে উঠলো, ‘হ্যা, বললেই হলো। এতো দিন প্রত্যাখ্যান করে এখন যদি বলে আই এক্সেপ্টেড হার তো পঁচা পুকুরে চু*বা*বো।’

রাইমা বললো, ‘পারবে তো না শুধু শুধু ফা*পর নিও না।’

আরিয়ান আর কিছু বললো না। চুপচাপ বসে রইলো। কিছুক্ষণ পর রাইমা গান গাওয়ার জন্য অনুরোধ করলো তাকে। তখন আরিয়ান গিটারের তারে টুংটাং সুর তুলে গাইতে লাগলো…

‘সেদিন ভোরে, বুকের গভীরে
শুনেছি জমে থাকা নীল বেদনারা ডাকে
এই শহরে ইটের পাহাড়ে,
ছিলনা কেউ যে দেওয়ার প্রেরণা
যন্ত্রে বাঁধা মন, ছিল ক্লান্ত অসহায়
অর্থে কেনা সুখ, ম্রিয়মাণ দুঃখের ছায়ায়
যন্ত্রে বাঁধা মন, ছিল ক্লান্ত অসহায়
অর্থে কেনা সুখ, ম্রিয়মাণ দুঃখের ছায়ায়

আর নয় সময় উদ্দেশ্যহীন মিছিলে
তুমি সেই পূর্ণতা আমার অনুভবে
আর নয় আঁধার, তুমি স্বপ্নে ডেকে নিলে
ভরে মন অন্তহীন রঙ্গিন এক উৎসবে।
_______________

বর্ষাকাল মানেই দিনরাত বৃষ্টি। ভারী বর্ষণ প্রকৃতিকে করে তুলে শান্ত, মনোরম। অম্বরে চলতে থাকে মেঘ আর সূর্যের লুকোচুরি খেলা। আড়ম্বরের ধ্বনিতে কম্পিত হয় পরিবেশ। শেষ রাতে ভাড়ি বর্ষণের পর সকালে পরিষ্কার অম্বর কিন্তু মেঘাচ্ছন্ন। পিচ ঢালা রাস্তা ভিজে একাকার। বর্ষায় ফোটা ফুল গুলো তার রঙিন সজীবতা ছড়িয়ে মুখরিত করেছে পরিবেশ। সদ্য ফোটা কচি পাতা গুলো অসম্ভব সুন্দর লাগছে। বারান্দায় উঁকি দিয়ে আকাশ ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করে ব্যাগ কাধে নিয়ে বের হলো দীবা। ড্রয়িংরুমে এসে দেখলো প্রায় সকলে উপস্থিত শুধু মাত্র রোশান, হোসেন আর সাবিত ছাড়া। আয়েশা, নিশিতা আর দীবার মা এক সাথে উপরের রুমে কাজ করছে। বাকিরা সোফায় বসে মোবাইল টিপতে ব্যস্ত। তিন জন নিচে নামার পর আরিয়ান উঠে দাঁড়ালো। মোবাইল পকেটে রেখে বলে উঠলো, ‘গাড়িতে গিয়ে বস। আমি আসছি।’

তাৎক্ষনাৎ আবরার সোফায় বসা থেকে দাঁড়িয়ে পরলো। সবার দৃষ্টি তার উপর আসার পর বললো, ‘তুই থাক আমি দিয়ে আসি।’

আরিয়ান ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকে প্রশ্ন করলো, ‘তুমি দিয়ে আসবে মানে?’

আবরার আরিয়ানের কথায় ভ্যাবাচ্যাকা খেলো। কিছুটা ইতস্ততবোধ করে বললো, ‘তুই অভ্রকে নিয়ে বাহিরে যা। আমি ওদের কলেজে দিয়ে তোদের সাথে জয়েন করবো।’

উপস্থিত সকলে বিস্ময়ের শেষ পর্যায়ে প্রায়। রাইমা ঠোঁট টিপে হাসলো। তারপর ভ্রুঁ উঁচিয়ে আরিয়ানের উদ্দেশ্যে ইশারা করলো সে। অর্থাৎ সে ঠিকই বলেছিল; আরব ভাই দীবার প্রতি দুর্বল। আরিয়ান চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আবরারকে বললো, ‘তোমাকে কষ্ট করে যেতে হবে না। আমিই যাচ্ছি!’

‘আরে কোনো কষ্ট হবে না। এই সুযোগে না হয় আগ্রাবাদ কলেজটা দেখে নিবো। তোরা যা আমি ওদের নিয়ে যাচ্ছি।’ বলেই দীবার দিকে এক পলক তাকিয়ে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে গেলো আবরার। বেশ অস্বস্তিতে পরেছিল সে। দীবা এই মুহূর্তে শুধু মাত্র নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে।

অপরদিকে সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে থেকে রিমির হাতে চিমটি কাটলো নুরা। ফিশফিশ করে বললো, ‘বোইন দেখছোস আমি কইছিলাম না? আরব মিয়া দীবার প্রেমে পরছে।’

রিমি সন্দিহান দৃষ্টি ফেলে বলল, ‘হু বইন। আমিও দেখছি।’

আবরার যেতেই আরিয়ান আহাম্মকের মতো বলে উঠলো, ‘এটা কি হলো?’

অভ্র শব্দ করে হেসে উঠলো। অতঃপর আরিয়ানের কাধে চাপড় দিয়ে বললো, ‘অনেক কিছু। আসো আমরা যাই।’

আরিয়ান মৃদু হেসে মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলো। তারপর দীবাদের যেতে হলে বলে নিজেও বের হলো অভ্রের সাথে। দীবা অসহায়ত্ব মুখে রাইমার দিকে তাকাতেই রাইমা দাঁত বের করে বললো, ‘যাও যাও!’

গাল ফুলিয়ে বাড়ি থেকে বের হলো দীবা।মনে মনে আবরারের চৌদ্দ গোষ্টি উদ্ধার করতে লাগলো দীবা। বাহিরে এসে দেখলো আবরার গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আবরারকে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ধাতস্থ হলো দীবা। গাড়ির মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকলে সে ভিতরে গিয়ে বসবে কি করে? সরছে না কেন লোকটা? বিরক্ত হলো কিছুটা। গাড়ির দিকে এগিয়ে যাবে কি যাবে না তা নিয়ে ইতস্ততবোধ করতে লাগলো। দীবাকে দেখেই আবরারের মুখে পরিপূর্ণ হাসি ফুটে উঠলো। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাতের ইশারায় তাকে কাছে ডাকলো। কপালে সরু ভাজ ফেলে তাকালো দীবা। ইদানীং আবরারের ব্যবহারের পরিবর্তন তার মোটেও ভালো টিকছে না। আসলে চাইছে কি ব্যাটায়?

ইশারায় কাছে ডাকার পরেও দীবাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবরার কিছুটা বিরক্ত হলো। হাল্কা ধ*মকের স্বরে বলে উঠলো, ‘কি ব্যাপার আসছো না কেন?’

দীবা এক চুলও নড়লো না। স্থির দাঁড়িয়ে ইতস্ততবোধ করতে লাগলো। ভয়ে শুকনো ঢুক গিললো সে।

‘বাই এনি চান্স তুমি কি কোলে তুলে আনার জন্য দাঁড়িয়ে আছো?’ আবরার ভ্রুঁ নাচিয়ে প্রশ্ন করে উঠলো। দীবার মুখ আপনা আপনি ফাঁক হয়ে গেলো। গাড়ির দিকে এগিয়ে এসে ঝাঁঝালো গলায় বললো, ‘আশ্চর্য মানুষ তো আপনি। উলটা পালটা কথা বলেন কেন সবসময়?’

আবরার বুঝতে না পারার ভান ধরে বললো, ‘উলটা পালটা কথা কখন বললাম?’

দীবা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠলো, ‘এইযে এখন বললেন। ওইদিনও বলেছিলেন কোলে তোলার কথা। আজও বললেন। এইসব উলটা পালটা কথা না?’

আবরার পকেটে দুই হাত গুঁজে প্রত্যত্তর করলো, ‘ভালো কথায় না শুনলে কি করবো?’

‘হ্যাঁ ভাই, এই ছেড়ি কখনো সোজা কথা শুনে না। মাঝে মাঝে ত্যাড়া কথা বলবেন কাজে দিবে।’

দাঁত কেলিয়ে বললো নুরা রিমি। ডিঙ্গিয়ে ডিঙ্গিয়ে গাড়ির কাছে এসে দাঁড়ালো দুজন। দুজনের কথা শুনে আবরার অল্প শব্দে হেসে উঠলো। দীবার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বললো, ‘তাই করতে হবে।’

হতাশ হলো দীবা। এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে বেশ অস্বস্তি লাগছে তার। তিন ভাই বোনের দিকে বিরক্তি মাখা চোখে তাকিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। মনে মনে আবরারকে গা:লি শুনাতে ভুললো না। রাগে, বিরক্তিতে মুখখানি কালো করে গাল ফুলিয়ে বসে রইলো। রিমি ও নুরা দীবার দুই পাশে বসলো। আবরার গাড়িতে বসে সামনের আয়নাটা ভালো ভাবে দীবার দিকে স্থির করলো। আয়নাতে দীবার গাল ফুলানো মুখটা দেখে আলতো ভাবে হাসলো। তারপর চোখে সানগ্লাস পরে গাড়ি স্টার্ট দিলো। পুরোটা রাস্তা ড্রাইভিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে দীবাকে যতোটুকু পেরেছে দেখেছে আবরার। মেয়েটাকে সারাদিন দেখলেও বিরক্ত আসবে না। এতো কিউট কেন দীবা? আগে জানলে এই তিন মাস অপচয় করতো না আবরার।

কলেজের সামনে গাড়ি থামালে তিনজন নেমে পরলো। দীবা গাড়ি থেকে নেমে আবরারের দিকে ভুলেও তাকালো না। চুপচাপ গটগট পায়ের কদম ফেলে কলেজের ভিতরে চলে গেলো। তাকে এভাবে চলে যেতে দেখে আহাম্মকের মতো তাকিয়ে রইলো রিমি নুরা। আবরার গাড়ির কাচ নামিয়ে তাকিয়ে রইলো দীবার চলে যাওয়ার দিকে। তারপর রিমি ও নুরার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো, ‘তোদের বান্ধুবির কি ম্যানারস বলতে কিছু নেই? কলেজে পৌঁছে দিলাম অথচ ধন্যবাদ জানানো তো দূরে থাক; ফিরেও তাকালো না?’

রিমি ঠোঁট কামড়ে হাসি আটকানোর প্রয়াস করলো। নুরা কিছুটা ঠাট্টার ছলে উত্তর দিলো, ‘চিন্তা করো না বস! ম্যানারস আমি শিখিয়ে দিবো।’

আবরার চোখমুখ কুঁচকে বিড়বিড় করে কিছুটা একটা বললো। তারপর গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে গেলো। আবরার যেতেই শব্দ করে হেসে উঠলো রিমি নুরা। তাদের হাসির শব্দ শুনে আশেপাশের কয়েকজন শিক্ষার্থী ও পথযাত্রী অদ্ভুত চোখে তাকালো। কিন্তু সেই দিকে ধ্যান নেই তাদের। নুরা উল্লাসিত হয়ে ঠোঁটে হাসি রেখেই রিমির বাহু ধরে বললো, ‘ইয়ার! দুইজনের প্রেম কাহিনী শুরু।’

রিমি বললো, ‘আই উইশ, আরব ভাই আর দীবা যেন একে অপরকে ভালোবাসে।’

অতঃপর কথা বলতে বলতে ক্লাসে আসলো দুজন।

চলমান..