আষাঢ়ে শ্রাবণের বর্ষণ পর্ব-৩১

0
1613

#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির

[পর্ব-৩১]

‘স্যরি। তখন রাগের বশে কি থেকে কি বলেছি জানি না। সকালে অনেক মন খারাপ ছিলো। তাই হুট করে রেগে গিয়েছি। এতটুকুই তো রাগ দেখিয়েছি আপনার সাথে। তাই বলে এভাবে ইগনোর করবেন? আমার কিন্তু অনেক খারাপ লাগছে।’

মলিন কন্ঠে কথা গুলো বললো দীবা। মন খারাপের কারণে ঠোঁট ভেঙ্গে আসছে তার। এই বুঝি কেঁদে দিবে। নিঃশব্দে মৃদু হাসলো আবরার। দীবার দিকে একটু এগিয়ে নিবিড় হলো। প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে আবরারের চোখের দিকে তাকালো দীবা। আবরার বিনা সংকোচে দীবার কোমড়ে দুই হাত রাখলো। ভড়কালো না দীবা। নির্লিপ্ত হয়ে আবরারের দিকেই তাকিয়ে রইলো। দীবার কোমড় শক্ত করে ধরে উপরে উঠিয়ে পাশে থাকা টেবিলে বসালো। দীবার একদম কাছাকাছি এসে মুখের উপর পরে থাকা চুল গুলো কানের পিছনে যত্ন সহকারে গুঁজে দিতে লাগলো। মৃদু গলায় বললো, ‘আমি জানি আমাদের বিয়েটা স্বাভাবিক ভাবে হয় নি। হঠাৎ অপরিচিত মেয়ের সাথে বিয়ে হওয়ায় নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারিনি। তাই তোমাকে ছেড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু এখন সবকিছু ঠিক করার চেষ্টা করছি আমি। চেষ্টা করছি তোমার মনে আমার জন্য জায়গা করে নিতে। বিশ্বাস করো আমার সবটুকু দিয়ে চাইবো তুমি শুধু আমাকে ভালোবাসো। সারাজীবন আমারই থাকো। কিন্তু তুমি যদি বারবার আমাকে এড়িয়ে চলো তাহলে গড প্রমিস আমি তৃতীয় বারের জন্য বাড়ি ছাড়বো। এই বাড়িমুখো আর কখনোই হবো না।’

এমন কথা শুনে চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করলো দীবা। কপাট রাগ দেখিয়ে বলে উঠলো, ‘আমি কি একবারো বলেছি যে আমি সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চাই না? আগে আগে একটু বেশি ভাবেন কেন?’

খুশিতে উষ্ঠধয় প্রসারিত হলো আবরারের। দীবার দিকে এগিয়ে একদম ঘনিষ্ঠ হলো। বাঁকা হেসে প্রত্যুত্তর করলো, ‘স্বাভাবিক করতে চাও?’

দীবা মাথা উপর নিচ দুলিয়ে ‘হ্যাঁ চাই’ জানালো। আবরার ঠোঁটে দুষ্টু হাসি রেখে বলে উঠলো, ‘তাহলে আসো আজ বাসরটা সেরে ফেলি। সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রধান ধাপ। আজকের ওয়েদার টা কোল্ড। তোমাকেও মারাক্তক হট লাগছে। বাসর করার জন্য একদম পারফেক্ট।’

চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে গেলো দীবার। আবরারের আকস্মিক কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলো। লজ্জায় গাল দুটো লাল হয়ে গেলো। দাঁতে দাঁত চেপে আবরারের বুকে মৃদু ধা:ক্কা দিয়ে একটু দূরে সরিয়ে দিলো। লজ্জায় সংকোচিত হয়ে অস্ফুটিত কন্ঠে বলে উঠলো, ‘অসভ্য লোক। এইজন্যই আপনার কাছে আসি না।’

দীবার প্রত্যুত্তর শুনে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো আবরার। হাসি তার থামছে না। তার এই হাসিতে মুগ্ধ হলো দীবা। কিন্তু প্রকাশ করলো না। উলটো আবরারের মুখ চেপে ধরলো যেন হাসির শব্দ থামে। চোখ দুটো বড় বড় করে কড়া গলায় বলে উঠলো, ‘চুপ। রাক্ষসের মতো হাসছেন কেন?’

আবরার মুখ থেকে দীবার কোমল হাতটা সরিয়ে দিয়ে ঠোঁটে হাসি রেখেই শুধাল, ‘এইটুকুতেই অসভ্য বলে দিলে? আর যখন পুরোপুরিভাবে রোমান্টিক হয়ে যাবো তখন সামলাবে কি করে?’

‘সরুন তো নির্লজ লোক।’ বলেই লজ্জায় আবরারকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। টেবিল থেকে নেমে দৌড়ে চলে যেতে নিলেই আবরার দীবার হাত ধরে আটকে বললো, ‘কোথায় যাচ্ছো?’

দীবা চোখ পাকিয়ে উত্তর দিলো, ‘রুমে যাচ্ছি ঘুমাতে। আপনাকে আমার বিশ্বাস নেই।’

আবরার দীবার হাত ছাড়লো না। তাকে ইচ্ছে করে রাগাতে সিরিয়াস চোখে মুখে তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘আবারো ইগনোর করছো?’

হতভম্ব হয়ে গেলো দীবা। কিসের মাঝে কি কিসের কথা বললো এই লোক? সে কোথায় ইগনোর করছে? রাগ হলো কিছুটা। তাই বিরক্ত হয়ে আবরারের হাত ঝামটা মেরে ছাড়িয়ে বিছানার দিকে যেতে যেতে রাগে গিজগিজ করতে করতে বললো, ‘একেই বলে বেডা মানুষ। বললে এক লাইন, বুঝে চার লাইন।’

বিছানার কার্নিশ ঘেঁষে শুয়ে পরলো দীবা। নিচের ঠোঁট কামড়ে হেসে ফেললো আবরার। দরজা লাগিয়ে লাইট অফ করে বিছানায় আসলো। দীবাকে পিছন দিক দিয়ে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পরলো নিজেও। ঘাড়ে গভীর একটা চুমু দিয়ে বললো, ‘কাল কলেজ আছে তাই না? ঘুমিয়ে পরো জলদি।’

অন্ধকারেই মুচকি হাসলো দীবা। বিমুখিত হয়ে মৃদু গলায় জানালো, ‘গুড নাইট।’ অতঃপর ঘুমিয়ে গেলো আবরারকে জড়িয়ে ধরে।
.

রজনীর মধ্যভাগ! অন্ধকার নিস্তব্ধ পরিবেশ। চারপাশ থেকে ঝিঁ ঝিঁ পোকাদের কর্কষ ধ্বনি ভেসে আসছে। অম্বরে অর্ধ গোলাকৃতির চাঁদটা তার জ্যোৎস্নায় আলোকিত করেছে ধরনী। ঘড়ির কাটার টিকটিক শব্দ কানে স্পষ্ট বাজছে। মাথা তুলে দীবার ঘুমন্ত মুখশ্রীর দিকে তাকালো আবরার। আনমনে মুগ্ধ হয়ে হেসে দীবার কপালে ছোট করে একটা চুমু দিলো। অতি সাবধানে নিজেকে দীবার থেকে ছাড়িয়ে বিছানা থেকে নামলো। নিঃশব্দে রুমের বাহিরে গিয়ে দরজাটা ভিড়িয়ে দিলো। তারপর-ই পা বাড়ালো অভ্রের রুমের দিকে। দরজার কাছাকাছি এসে নক করার কিছুক্ষণ পরেই দরজা খুললো অভ্র। চেহারা তার মলিন। চুল গুলো উষ্কখুষ্ক হয়ে কপালে পরে আছে। প্রতিদিনকার হাসিটা আজ অদ্ভুত ভাবে গায়েব। অভ্রের চোখ দেখে আবরার অনায়াসে বুঝে গেলো ছেলেটা এখনো ঘুমায় নি। মন খারাপের কারণে যেকোনো মুহূর্তেই কেঁদে দিতে পারে। আবরার দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিরবে। অনুমিতি ব্যতিত রুমে প্রবেশ করে বললো, ‘এখনো ঘুমাও নি?’

অভ্র অতিমাত্রায় স্বাভাবিক ভাবে রুমের দরজা লাগিয়ে ছোট করে উত্তর দিলো, ‘না।’

আবরার বিছানায় আয়েশী ভঙ্গিতে বসে ডাকলো অভ্রকে। অভ্র চুপচাপ এগিয়ে এসে আবরারের পাশে বসলো। দুই হাটুতে কনুইয়ের ভর দিয়ে কিছুটা ঝুকে এসে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে রইলো। আবরার কিভাবে কথার সূত্রপাত ঘটাবে বুঝতে পারছে না। তবুও শান্ত্বনা দিতে বললো, ‘অভ্র তুমি অনেক বড় হয়েছো। এমন ছেলেমানুষি তোমাকে দিয়ে মানায় না।’

অভ্র প্রত্যুত্তর করলো না। প্রথমের ন্যায় মেঝেতেই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। আবরার নিস্প্রভ কণ্ঠস্বরে আবারো বললো, ‘আঙ্কেলের হায়াত যতোদিন ছিলো ততোদিন উনি বেঁচে ছিলেন। যদিও হঠাৎ মৃ:ত্যু টা আমাদের এক্সপেকটেশন ছিলো না। কম চেষ্টা তো আর করা হয় নি। কতশত মানুষ ক্যান্সার থেকে মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু আঙ্কেল পায় নি। তকদিরে যা ছিলো তাই হয়েছে। আল্লাহ উনাকে জান্নাত নসিব করুক দোয়া করি।’

নিচের ঠোঁট কামড়ে মাথাটা উপর নিচ দুলালো অভ্র। অস্ফুটিত কন্ঠে বলে উঠলো, ‘সব আমার দোষ! আমি আব্বুর ভালো ট্রিটমেন্ট করাতে পারি নি। কেন ওইদিন আমি হস্পিটালে ছিলাম না? আব্বু নিশ্চয় এখনো আমার উপর রেগে আছে। মৃত্যুর সময় আমি উনার পাশে ছিলাম না। কতো খারাপ আমি।’

আবরার অভ্রের কাধে এক হাত রেখে বললো, ‘অভ্র? এতে তোমার কোনো হাত নেই। তুমি আমি সাত্তার সবাই অনেক চেষ্টা করেছি। আঙ্কেলের লাস্ট স্টেপ ছিলো। ওইদিন তো তুমি মেডিসিন আনতেই বাহিরে গিয়েছিলে। নিজেকে দোষারোপ করবে না প্লিজ। আঙ্কেলের জন্য দোয়া করো।’

অভ্র কান্না মিশ্রিত কন্ঠে শুধাল, ‘খুব ছোট বেলায় মাকে হারিয়েছি। তখন থেকে আব্বু পাশে ছিলেন। আর আজ দুই বছর হলো আব্বু নেই। অথচ দেখো আমি বিন্দাস আছি। সত্যি বলছি ভাই আব্বুকে ছাড়া থাকতে পারছি না আর। আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে।’

নিরবে দীর্ঘশ্বাস ফেললো আবরার। যথাসম্ভব শান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলো অভ্র কে।
.

অভ্র ও আবরারের সম্পূর্ণ কথোপকথন রুমের দরজার বাহির থেকে শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলো রিমি। প্রতিক্রিয়াহীন হয়ে পরেছে সে। বহু ভেবে চিন্তে অভ্রকে সরি বলতে এসেছিলো যেন আগামীকাল চলে না যায়। দরজার বাহির থেকে টোকা দেবার আগেই আবরারের কন্ঠস্বর কানে আসলো। এক এক করে দুজনের কথা গুলো শুনেই চোখ দিয়ে আপনাআপনি কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পরলো। বড্ড অপরাধবোধ কাজ করলো মনে। চুপচাপ নিজের রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিয়ে বিছানায় বসলো। কেঁদে ফেললো রিমি। কতোটা খারাপ সে? ছাদে তখন এভাবে কথা বলা উচিত হয় নি তার। নিজের অজান্তেই অভ্রকে কষ্ট দিয়েছে সে। নিজের প্রতি রাগ হলো প্রচুর। মারাক্তক রাগের কারণে আবারো কেঁদে উঠলো সে। অভ্রের কষ্টে তার নিজেরও কষ্ট লাগছে। ভীষণ কষ্ট! নিজের অজান্তেই মনের সুপ্ত কোণে অভ্রের জন্য বিশাল জায়গা করে দিয়েছে রিমি। আদৌ জানে না এই নতুন অনুভূতির নামকরণ কি করা হবে।
______________________

ভোরের আলো ফুটতে এখনো বাকি। চারপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার না হলেও ছিমছাম আবছা আলোতে পরিপূর্ণ। রাতের অর্ধ গোলাকৃতির চাঁদটা আকাশে মিলিয়ে গেছে। মুয়াজ্জিনদের ডাকে অনেকে ইতিমধ্যে মসজিদে পারি জমিয়েছে জামায়াতে সালাত আদায় করার জন্য। সারারাত নির্ঘুমে কাটিয়েছে রিমি। শেষ রাতে একটু চোখ লেগেছে তবুও আজানের ধ্বনিতে উঠে পরলো। চটজলদি নামাজ পরে বিছানায় বসে গড়িমসি খাচ্ছে প্রায়। অভ্র চলে যাবে এই একটা কথা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে শুধু। কিভাবে সরি বলবে, কিভাবে তার যাওয়া আটকাবে তাই ভাবছে। বহু চিন্তাভাবনা, পরিকল্পনার পর অভ্রের রুমে যাওয়ার জন্য মনস্থির করলো। গায়ে ওড়নাটা জড়িয়ে অভ্রের রুমের সামনে আসলো। দরজায় টোকা দিতে গিয়ে খেয়াল করলো দরজাটা হালকা ভিড়ানো। ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকালো রিমি। সন্দেহ তার ঠিক-ই হলো। অভ্র খুব সকালেই ঘুম থেকে উঠে যায়। ঘুমায় তো দেরিতে ; তাহলে এতো তাড়াতাড়ি উঠে কিভাবে? নিশ্চয় এলিয়েন। নাহলে কখনোই সম্ভব হতো না। ভাবতে ভাবতে রুমের ভিতরে উঁকি দিলো। খুবই সাবধানতার সাথে উঁকি দেওয়া অবস্থায় চোখ দুটো পুরো রুম জোরে বিচক্ষণ করালো। তখুনি ঘটে গেলো এক আকস্মিক ঘটনা। যার জন্য একদমই প্রস্তুত ছিলো না রিমি। যখন পূর্ণ মনোযোগ সহকারে রুমের ভিতরটা দেখতে ব্যস্ত ; তখুনি কেউ পিছন থেকে তাকে ধাক্কা দিয়ে রুমের ভিতরে ঢুকিয়ে দিলো। হকচকিয়ে গেলো রিমি। প্রকাণ্ড রকমের ভয়ের কারণে ভড়কে গিয়ে বুকে ফু দিলো। কে দিয়েছে ধাক্কা দেখার জন্য পিছু ফিরে তাকাতেই অভ্রকে নজরে আসলো তার। দুই হাত পকেটে ঢুকিয়ে নিরবে রুমে ঢুকে দরজাটা পা দিয়ে ভিড়িয়ে দিলো অভ্র। দরজা লাগিয়ে দেওয়ায় চমকে উঠলো রিমি। হতভম্ব হয়ে কিছু বলে উঠার আগেই অভ্র প্রশ্ন করে বসলো, ‘এখানে কি করছিলে?’

রিমি কিছুটা ইতস্তত করে শুধাল, ‘কাজেই এসেছি।’

পকেটে হাত রেখেই সটান হয়ে দাঁড়ালো অভ্র। ভ্রুঁ জোড়া কিঞ্চিৎ বাঁকা করে বললো, ‘আমার রুমের সামনে তোমার কিসের কাজ?’

নতজাত হলো রিমি। দুই হাতে ওড়নার একাংশ টেনে আঙ্গুলে মুচড়াতে লাগলো। মাথা নিচু করে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে অপরাধীর মতো বলে উঠলো, ‘আই’ম সরি। ছাদে ওভাবে বলা উচিত হয় নি আমার। প্রথম থেকেই আপনার সাথে আমার ঝগড়া হয়েছে। ভেবেছিলাম তখনো হবে। তাই কি হুট করে বলে ফেললাম। আপনি আমার কথায় কষ্ট পাবেন জানলে কখনোই ওভাবে বলতাম না।’

অভ্র চোখ ছোট ছোট করে রিমির আপাতমস্তষ্ক ভালো ভাবে দেখে নিলো। মনে মনে হাসলো সে এই ভেবে যে রিমি তাকে সরি বলতে এসেছে। যদিও সে রিমির উপর একটুও রেগে নেই। ভাবতেই অভ্র নিচের ঠোঁট কামড়ে রিমির অগোচরে নিরবে আলতো ভাবে হাসলো। অনেকক্ষণ যাবত অভ্রকে চুপ থাকতে দেখে টানা টানা চোখ দুটো তুলে তাকালো রিমি। অভ্র কি তাহলে তাকে ক্ষমা করে নি? এইসব ভেবে ক্ষুন্ন হলো মন। অভ্রের দিকে এক কদম এগিয়ে এসে অস্থির কন্ঠে বলে উঠলো, ‘ট্রাস্ট মি অভ্র, আমি আপনাকে কষ্ট দিতে চাই নি। প্লিজ আমার উপর রেগে থাকবেন না। সরি বলছি তো। আর কখনো ঝগড়া করবো না। কিছু তো বলেন। মাফ করেন নি? কান ধরবো তাহলে?’

কথাটা বলেই দুই হাতে কান ধরলো রিমি। আবারো অনুনয় স্বরে বলে উঠলো, ‘সরি বললাম তো। প্লিজ অভ্র আর রেগে থাকবেন না।’

একের পর এক বিস্মিত হচ্ছে অভ্র। প্রথম বিস্মিত হলো রিমিকে এখানে সরি বলতে আসতে দেখে। দ্বিতীয় বিস্মিত হলো তার নাম ধরে সম্মোধন করতে দেখে। তৃতীয় বারের মতো বিস্মিত হলো বাচ্চাদের মতো কান ধরতে দেখে। হাসি পেলেও হাসলো না অভ্র। রিমির অনুরোধের কারণে প্রত্যুত্তরে বললো, ‘ঠিক আছে। কানে ধরতে হবে না।’

রিমির মলিন চেহারায় খুশির ঝিলিক ফুটে উঠলো। উল্লাসিত হয়ে হাসি দিলো একটা। খুশি মনে বলে উঠলো, ‘মাফ করেছেন আমাকে? তার মানে আপনি আর যাচ্ছেন না? ওয়াও! দ্যাট’স গ্রেট।’

রিমির কথা শুনে একটা ভ্রুঁ বাঁকা করলো অভ্র। বললো, ‘যাচ্ছি না মানে? কে বলেছে তোমাকে?’

রিমি বললো, ‘প্লিজ অভ্র ভাই আর কয়েকটা দিন থেকে যান। রাইমা আপুর বিয়েতে অনেক মজা হবে। আপনি থাকলে আরো মজা হবে। প্লিজ থেকে যান। আমার জন্য হলেও থেকে যান।’

অভ্র প্রথমের তুলনায় কন্ঠ কিছুটা ত্যাঁছড়া করে বললো, ‘আমি চলে গেলে তোমার কি?’

বারবার অনুরোধ করার পরেও অভ্রের কাছে এমন প্রশ্ন শুনে ক্ষুব্ধ হলো রিমি। রাগ হলো কিছুটা। অস্থিরতার কারণে রাগ দমাতে না পেরে ঝাঁঝালো গলায় উত্তর দিয়ে উঠলো, ‘আমার কি মানে? আমারই অনেক কিছু। তুমি চলে যাবে কেন? তোমাকে থেকে যেতেই হবে। তুমি চলে গেলে আমি কার সাথে ঝগড়া করবো? কাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখবো? যাবে না তুমি। আমার পাশেই থেকে যাবে। কারণ আমার তোমাকে ভালো লাগে। তাই তুমি না থাকলে এই বিয়েতে আমি এঞ্জয় করতে পারবো না। আমি বলেছি মানে তুমি যাচ্ছো না। এটাই ফাইনাল।’

এক টানা এতো গুলো কথা বলতে বলতে হাঁপিয়ে উঠলো রিমি। জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগলো। রাগের বশে কি থেকে কি বললো জানা নেই তার। তবুও সেদিকে কোনো ভ্রুঁক্ষেপ নেই। অভ্র হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো রিমির দিকে। সব কিছু হজম হলেও রিমির বলা ভালো লাগার কথাটা ঠিক হলো না। কিছুটা নাবুঝের মতো জানতে চাইলো, ‘কি বললে তুমি? কাকে ভালো লাগে?’

রিমি অভ্রের দিকে দু-কদম এগিয়ে একদম কাছাকাছি আসলো। দুজনের দূরত্ব কেবল এক হাত মাত্র। চোখে চোখ রাখলো রিমি। প্রথমের মতোই কন্ঠে ঝাঁঝ মিশিয়ে শুধাল, ‘আমার তোমাকে অনেক ভালো লাগে। অন্যসব মেয়েদের মতো এতো লজ্জা টজ্জা আমার নেই। তোমাকে পছন্দ করি তাই ডিরেক্ট বলে দিলাম। এখন তুমি এখানে থাকবে ব্যাস। রাইমার আপুর বিয়ের পর নাহয় ঢাকা ব্যাক করো। আর হ্যাঁ, আমার এক্সাম শেষে বিয়ে করে নিবো দুজন। তারপর কিছুদিন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা চলে যাবো। হানিমুনের জন্য যাবো সুইজারল্যান্ড আর নিউজিল্যান্ড।’

এতো এতো পরিকল্পনা শুনে এখনো হতভম্ব অভ্র। রিমির কথাবার্তা সব তার তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। বিস্মিত হয়ে রিমির কপালে এক হাত রেখে ছুঁয়ে দিয়ে বললো, ‘জ্বর উঠেছে তোমার?’

‘আমি একদম সুস্থ আছি।’

‘যা বলছো সব ভেবে বলছো তো?’

‘একদম!’

রিমির সহজ সরল স্বীকারুক্তি দেখে মৃদু হাসলো অভ্র। প্রথম থেকেই রিমির প্রতি তার একটা সফট কর্নার ছিলো। এখন সেই ছোট অনুভূতি টা আরো প্রগাঢ় হলো। ভালো লাগলো মনে। একটু ভাব নিতে দুই হাতে নিজের এলোমেলো চুল গুলো ঠিক করতে করতে বললো, ‘ঠিক আছে। আমি ভেবে দেখবো। তুমি এখন যেতে পারো।’

‘ভেবে দেখবো’ কথাটা গায়ে লাগলো রিমির। প্রপোজাল রিজেক্টেড! রাগ হলো প্রচুর। নিজের জেদ বজায় রাখতে রাগে গিজগিজ করতে করতে বলে উঠলো, ‘কি ভেবে দেখবে? আমি কি তোমাকে ভাবার জন্য বলেছি? আমার তোমাকে ভালো লাগে মানে এখন থেকে আমরা রিলেশনশিপে আছি। এখানে তোমার সম্মতি থাকুক আর না থাকুক তাতে আমার কিছু যায় আসে না।’

এইটুকু বলে রিমি অভ্রের একদম কাছে আসলো। এক হাত উঠিয়ে তুড়ি বাজিয়ে ভীতিপ্রদর্শন করে বললো, ‘তুমি আমার মানে সারাজীবন আমারই থাকবে। কথাটা মনে রেখো।’

বলেই অভ্রকে আলতো হাতে ধা:ক্কা দিয়ে সরিয়ে গটগট পায়ে বেড়িয়ে গেলো রুম থেকে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আছে অভ্র। এটা কি মেয়ে? নাকি কোনো প্রশাসক? এভাবে কেউ প্রপোজ করে? মেয়ে মানুষ মানে লজ্জায় লাল নীল হবে। তা না করে এই মেয়ে উল্টো আমাকেই লজ্জায় ফেলে দিলো। সাংঘাতিক একটা মেয়ের প্রেমে পরেছিস তুই অভ্র। সাংঘাতিক!

চলমান…