আষাঢ়ে শ্রাবণের বর্ষণ পর্ব-৪৫

0
1338

#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির

[পর্ব-৪৫]

সারারাত নির্ঘুমে কাটিয়ে সকালে গভীর ঘুমে বিভোর হলো নুরা। চোখে তার হাজারটা রাজ্যের ঘুম এনে হানা দিলো। কোনো ভাবেই চোখ খুলতে পারছে না। তবুও রিমির ডাকাডাকিতে কোনো রকমে পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালো নুরা। মাথাটা ব্যাথায় ঝিমঝিম করছে। চোখ দুটো অসম্ভব লাল হয়ে আছে।

‘তোর চোখমুখ এমন দেখাচ্ছে কেন? এই নুরা উঠ না। কি হয়েছে তোর?’

রিমির এই কথা গুলো তার আদিখ্যেতা লাগলো। তাই কপাট রাগ দেখিয়ে বলে উঠলো, ‘ঘুম ভাঙ্গিয়ে এই প্রশ্ন গুলো করতে হবে তোর?’

‘এই জন্য ঘুম ভাঙ্গাই নি তো। একটু পরেই আগ্রাবাদ ফিরছি সবাই। তাই তোকে ডাকতে এলাম। কিন্তু তোর চেহারা কেমন জানি দেখাচ্ছে। তুই কি রাতে কেঁদেছিস? কি হয়েছে তোর? আমাদের থেকে কি লুকাচ্ছিস সত্যি করে বল নুরা।’

সোজা হয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করলো নুরা। বা হাত দিয়ে কপাল ঘেঁষে শুয়া থেকে উঠে বসলো। রিমির কথার কোনো প্রকার উত্তর না দিয়ে ভাবলেশহীন ভাবে চুপচাপ ব্যাগ থেকে কালো কুর্তি বের করে ওয়াশরুমে চলে গেলো। হতভম্ব হয়ে গেলো রিমি। কি হয়েছে নুরার? অন্যান্য দিনের তুলনায় বড্ড উদাসীন লাগছে তাকে। চোখমুখ লাল কেন তার? কেঁদেছে নুরা? কিন্তু কেন? মাথায় হাজারটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে রিমির। ঠোঁট কামড়ে বিছানায় বসে ভাবতে লাগলো। অনেকটা সময় অপেক্ষার পরে ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে আসলো নুরা। রিমিকে তার দিকে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে স্মিতি হেসে উঠলো সে। রিমির দিকে ভেজা টাওয়াল ছুড়ে দিয়ে বলে উঠলো, ‘আরে কিছু হয়নি আমার। রাতে মাথা ব্যাথা করেছিলো তাই একটু কেঁদেছি।’

অন্য সময় হলে টাওয়াল ছুড়ে মা’রায় রাগ দেখাতো রিমি। কিন্তু আজ দেখালো না। টাওয়াল টা তুলে চেয়ারে ছড়িয়ে দিতে দিতে বলল, ‘সত্যি বলছিস তো?’

নুরা ড্রেসিংটেবিলের কাছে গিয়ে ক্রিম হাতে নিয়ে জবাব দিলো, ‘একদম।’

মন বিশ্বাস করতে না চাইলেও বাধ্য হয়ে বিশ্বাস করলো রিমি। সন্দেহপ্রবন চোখে নুরার দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো। কিছু তো হয়েছে নুরার। দুই দিন যাবত নুরাকে উদাসীন লাগছে। মনে হচ্ছে নুরার প্রাণোচ্ছল হাসি, চঞ্চল স্বভাব হারিয়ে গেছে। কারণ টা জানতে হবে। কিন্তু কিভাবে?

রিমির ভাবনার মাঝেই সম্পূর্ণ ভাবে তৈরি হয়ে গেলো নুরা। চোখে গাঢ় করে কাজল দিয়ে দিলো যেন চোখের নিচের কালি বুঝা না যায়। ঠোঁটে দিলো ডার্ক মেরুন ম্যাট কালার লিপস্টিক। চুল গুলো উন্মুক্ত, কোমড় ছুঁই ছুঁই। আয়নায় নিজেকে ভালো ভাবে একবার প্রখর করলো নুরা। লম্বা, সৌন্দর্য কোনো দিক দিয়ে তার কমতি নেই। তাহলে কেন রাজের ভালোবাসা পাবার যোগ্যতা তার মাঝে নেই? রাজ কেন তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হলো না? দীর্ঘশ্বাস ফেললো নুরা। ভালোবাসা কখনো সৌন্দর্যের কারণে হয় না। ভালোবাসা হয় ব্যক্তিত্বের কারণে। আর নুরা রাজের সৌন্দর্যে নয়, তার ব্যক্তিত্বের প্রেমে পরেছে। মানুষটার চোখের মায়ায় পরেছে।

রুমের দরজা খোলার শব্দে দুইজন নিজেদের চিন্তার রাজ্য থেকে বেড়িয়ে আসলো। দরজার দিকে ফিরে তাকাতেই দীবাকে হেলেদুলে ভিতরে আসতে দেখলো। নুরা মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে দীবার সৌন্দর্যের তারিফ করলো, ‘তোকে অনেক সুন্দর লাগছে। মাশাআল্লাহ!’

দীবা লাজুক লাজুক ভাব নিয়ে বলল, ‘থ্যাংকইউ!’

‘এই ওয়েট ওয়েট! তুই আমার টপস পড়েছিস কেন?’

চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে চেঁচিয়ে উঠলো রিমি। ঠোঁট বাঁকিয়ে ভেংচি কাটলো দীবা। ভাব নিয়ে চুল গুলো ঠিক করতে করতে বললো, ‘কারোর নাম লিখা ছিলো না।’

নুরা ঠোঁটে ঠোঁট টিপে মুচকি হাসলো। মনে মনে ভাবলো এই সাধারন একটা টপসের কারণে সাংঘাতিক একটা ঝগড়া বাধবে।সেদিন কানের দুল পরায় তাকে চু’ন্নি বলে সম্মোধন করেছিলো দীবা। আজ তাকেও চোর বলার সময় এসেছে। সুযোগ তো আর কেউ ছাড়ে না। নুরাও তাই। সুযোগ পেয়ে ইচ্ছে মতো দীবাকে পঁচানি দিলো, ‘ছিঃ দীবা। তোর জামাইয়ের কি এতোই টাকার অভাব? চুরি না করে আমাকে বলতি। তোকে বস্তা ভরে টপস দিতাম। তবুও কেন চুরি করতে গেলি? জামাইয়ের মানসম্মান সব খেয়ে ফেলছিস দেখছি।’

জামাইয়ের কথা তুলায় শরিরে রাগ রিনরিনিয়ে উঠলো দীবার। চোখমুখ শক্ত করে রাগ দেখিয়ে বলে উঠলো, ‘খবরদার জামাই নিয়ে কথা বলবি না।’

দীবার কথা শুনে ক্যাটক্যাটে শব্দ তুলে হেসে উঠলো নুরা ও রিমি। দীবাকে রাগাতে আর পচানি দিতে এক সঙ্গে বলল, ‘আহাঃ কি টান।’ বলেই আবারো উচ্চস্বরে হেসে উঠলো।

তাদের দুইজনের হাসিটা দীবার কাছে বিদঘুটে লাগলো। রাগে দাঁতে দাঁত খিঁচে বিছানা থেকে বালিশ তুলে দুজনের দিকে ছুড়ে মারলো। তখুনি রুমে আসলো সাবিত আর আবরার। তিনজনকে আবারো ঝগড়া করতে দেখে হতাশ হলো তারা। সাবিত দীবাকে থামাতে দীবার এক হাতের কব্জি ধরে বলে উঠলো , ‘তোরা কি একটু শান্তিতে থাকতে পারিস না? সারাদিন ঝগড়া আর ঝগড়া। তোদের শ্বশুর বাড়ি পাঠালে নির্ঘাত আমাদের সম্মানের কালা ভুনা হয়ে যাবে।’

‘আশ্চর্য ভাই এভাবে বলছো কেন? আমি কিছু করি নি। রিমি আর দীবাই ঝগড়া লেগেছে।’ নিজেকে নির্দোষ প্রমান করতে নুরা বলে উঠলো।

আবরার পকেটে মোবাইল রাখতে রাখতে ঝগড়া লাগার কারণ জানতে চাইলেই রিমি গরগর করে দীবার নামে নালিশ করে বসলো, ‘তোমার ফকিন্নি বউ আমার টপস পরেছে কেন? বউ কে টাকা দিতে পারো না? মাইনষের জিনিস পরে ঘুরে শুধু।’

চোখ-ঠোঁট উলটে রিমির কথার ব্যঙ্গ্য করলো দীবা। হাতের ঘড়িটার দিকে ইশারা করে বললো, ‘তুই এখন কার ঘড়ি পড়ে আছিস? আমর টা। আমি কিছু বলেছি তোকে? বলি নাই। তুই পরেছিস তাই আমিও পরেছি। হিসাব সমান সমান।’

হতাশ হয়ে কপাল চাপড়ালো সাবিত। তিনজন একে অপরের সাথে জিনিসপত্র শেয়ার করবে আর ঝগড়া করবে। তিনজনের এই অসাধারণ বন্ডিং টা সুন্দর। ভাবতেই নিজেই আনমনে হেসে ফেললো সাবিত।

অপরদিকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় আবরার। তাদের এই অবস্থা দেখে বিস্ময়ের শেষ নেই তার মাঝে। যেখানে আবরারের ব্যবহারিক জিনিসপত্র অন্য কেউ ধরলে সে একদম পছন্দ করে না। সেখানে কিনা এই তিন মেয়ে কানের ঝুমকা থেকে শুরু করে জামাকাপড় পর্যন্ত একে অপরের সঙ্গে শেয়ার করে? ব্যাপারটা উইয়ার্ড লাগলো তার কাছে। তিনজনের দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে বলে উঠলো, ‘তোরা একজন আরেকজনের সঙ্গে সব কিছুই শেয়ার করিস?’

রিমি সামনের চুল গুলো পিছনে ঠেলে মিষ্টি মিষ্টি হাসি দিয়ে বললো, ‘শ্বশুর বাড়ি বাদে সবই শেয়ার করতে পারি। বেরুবে কখন? আমরা রেডি। আসো।’

রিমি কথাটা বলেই দীবার হাত ধরে ফুরফুরে মেজাজে বেড়িয়ে গেলো রুম থেকে। এবার আরো বিস্মিত হয়ে চেয়ে রইলো আবরার। এই মাত্র না ঝগড়া লেগেছে? এখন আবার হাত ধরে হেলেদুলে বাহিরে যাচ্ছে? তাকে এভাবে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে নুরা হাসলো। ঠোঁটে হাসি রেখেই আবরারের কাছে এসে আবরারের বাহু জড়িয়ে ধরে সামনের দিকে অগ্রসর হতে হতে বললো, ‘ওরা এমনই। আসো দেরি হয়ে যাবে।’

আবরারের বাহু ধরে বাড়ির নিচে হাসিখুশি মুখে নামলেও নিচে আসার পর নুরার সেই হাস্যউজ্জ্বল মুখটা একদম ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করলো। অতিরিক্ত উত্তেজনায় কলিজা তার ধুকধুক শব্দ তুলতে লাগলো। হার্টবিট ফাস্ট! নিশ্বাস নিতেও যেন কষ্ট হচ্ছে। না চাইতেও বারবার রাজের মলিন চেহারার দিকে চোখের দৃষ্টি পরছে। তবে কি সত্যিই রাজ চলে যাবে?

ফটিকছড়িতে এসেছিলো একটা মাইক্রো কার দিয়ে। কিন্তু আগ্রাবাদ ফেরার প্ল্যান করলো অন্য রকম ভাবে। বাড়ি ফেরার জন্য গাড়ি আনা হলো মোট চারটা। এটা অবশ্য প্ল্যান না। আবরার এক সাথে না গিয়ে দীবাকে নিয়ে পারসোনালি একা যাবার কথা বলেছে। তাই বাকিরাও নিজেদের গাড়ি দিয়ে যাবার চিন্তা করেছে।

সবাই একত্রে নিচে নামতেই প্রথমে আবরার দীবার হাত ধরে গাড়িতে বসিয়ে নিজেও উঠে গাড়ি স্টার্ট দিলো। সু-সু শব্দ তুলে গাড়ি মুহূর্তেই সুবিশাল রাজবাড়ি পেড়িয়ে বেড়িয়ে গেলো। তারপর সাবিতের থেকে বিদায় নিয়ে রাজিব ও রাজ দুইজন গাড়িতে উঠলো। রাজ বসলো ড্রাইভিং সিটে। রাজিবকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে সে যাবে ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে নুরা। ব্যথিত চোখে রাজের দিকে তাকিয়ে আছে। মন বলছে শুধু একটা বার, শুধুমাত্র একটা বার রাজ যেন তার দিকে তাকায়। তার মনের কথা গুলো, চোখের দৃষ্টি যেন রাজ বুঝতে পারে। অন্তর কাঁপছে নুরার। তবুও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না।

গাড়ি স্টার্ট দিলো রাজ। দুই হাতে স্টোরিয়ারিং ধরে লম্বা একটা দম নিলো। কি মনে হতেই চোখ ঘুরিয়ে বাহিরে তাকালো। গাড়ির জানালার বরাবর নুরাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মৃদু একটা হাসি দিলো। হাত উঠিয়ে বাই জানালো নুরাকে। প্রত্যুত্তরে নুরাও স্মিতি হেসে হাত নাড়িয়ে বাই জানালো। অতঃপর বিলম্ব না করে গাড়ি চালাতে শুরু করলো। রাজের গাড়িটা চোখের আড়াল হতেই মলিন হলো নুরার মুখশ্রী। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপচাপ এক পাশে দাঁড়িয়ে রইলো।

অভ্র আগ্রাবাদ আসার পর থেকেই বেশিরভাগ সময় আরিয়ানের সঙ্গে কাটায়। সময়ের সময়সীমাঅনুযায়ী দুইজন প্রায় সমবয়সীর পর্যায়ে পরে। তাই দুজনের বন্ডিং টাও বেশ জমানো। তাই দুইজন এক সঙ্গে বাড়ি ফিরবে। সাবিতের সঙ্গে যাবে রাইমা। নুরাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাইমা নুরার হাত ধরে গাড়ির কাছে এনে বললো, ‘মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আমার সাথে আয় তুই।’

নুরা কিছু বললো না। বাধ্য মেয়ের মতো রাইমার পাশে বসলো। সাবিতও ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলো। অভ্র আর আরিয়ানের মধ্যে কে গাড়ি চালাবে তা নিয়ে কিছুটা বাধলো। সমাধানে আসার জন্য রক, পেপার ও সিজার খেললো। প্রথম তিনবার ধরার পর অভ্র হারলো। আরিয়ান ফুরফুরে মেজাজে ড্রাইভিং সিটে বসলো। অভ্র রিমিকে আনমনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ডাক দিল। অভ্রের ডাকে হকচকিয়ে গেলো রিমি। নুরাকে নিয়ে শত চিন্তার জগত থেকে বেড়িয়ে এলো সে। রিমিকে অন্যমনস্ক হতে দেখে ভ্রুঁ কুঁচকালো অভ্র। কারণ জানতে চাইলো, ‘তোমাকে অন্যরকম লাগছে আজ। কি হয়েছে রিমি?’

প্রত্যুত্তর করলো না রিমি। শুধুমাত্র মাথা নাড়িয়ে ”কিছু না” বুঝিয়ে চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসলো। হতবাক অভ্র। রিমিকে এর আগে কখনো এতো নিশ্চুপ দেখেনি সে। আজ হুট করে কি এমন হলো যে রিমি এতো চুপচাপ? চিন্তিত হলেও প্রকাশ করলো না। চুপচাপ আরিয়ানের পাশের সিটে বসলো। সিট বেল্ট লাগাতে লাগাতে লুকিং মিররে রিমির অন্যমনস্ক মুখখানির দিকে আবারো তাকালো অভ্র। রিমির এই অন্যমনস্কের কারণ না জানা অব্ধি তার মনেও শান্তি নেই। বাড়ি ফিরে জানা যাবে ভেবে শান্ত্বনা দিল নিজেকে।
_____________________

শান্তিনিবাস এতোদিন প্রাণ হারা ছিলো। নিরব নিস্তর বাড়িটিকে আবারো প্রাণোচ্ছল করতে ফিরে এলো তারা। ছেলেমেয়েদের ফিরে আসায় খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলো নিশিতা আয়েশা ও রোহানা। এই কয়েকটা দিনই তাদের জন্য মাসের সমান লেগেছে। কোনো রকমে নিজেদের কলিজাদের ছেড়ে থেকেছে। আজ ফিরে আসছে সবাই। তাই খুশি কারোর মাঝে কমতি নেই। সকালেই ঘুম থেকে উঠে নিজেদের হাতে রান্না করলো নানান রকমের সুস্বাদু সব খাবার। সকালের মধ্যেই রান্নাবান্না শেষ করে ঘড়ি দেখছিলো সবাই ফিরবে কখন। অবশেষে অপেক্ষার প্রহর শেষে দুপুরের আগেই ফিরলো সবাই। আবারো হাস্যউজ্জ্বল হলো শান্তিনিবাস। নিরব নিস্তর পরিবেশ ভেঙ্গে এখন কোলাহলপূর্ণ হলো বাড়ি। সবাইকে আদরের সঙ্গে ড্রয়িংরুমে আনলো তারা।

ড্রয়িংরুমে সকলের উপস্থিত থাকলেও দীবার অনুপস্থিতি ঠিকই টের পেলো রোহানা। এতোদিন বাদে মেয়েকে দেখার জন্য মনটা তার ছটফট করছে। সবার সাথে দীবাকে দেখতে না পেয়ে চিন্তিত হয়ে সাবিতকে প্রশ্ন করে উঠলো, ‘দীবা কোথায় বাবা? তোমরা সবাই এখানে দীবা কোথায়?’

সাবিত রোহানাকে শান্ত্বনা দিয়ে বললো, ‘চিন্তা করবেন না। আবরারের সঙ্গে দীবা আছে। চলে আসবে একটু পর।’

কিছুটা চিন্তা মুক্ত হলো রোহানা। তবুও মেয়ের চিন্তা থেকে বেরুতে পারলো না। যতোক্ষণ না মেয়েকে দুচোখের সামনে দেখবে ততোক্ষণ পর্যন্ত নিজেকে শান্ত করতে পারবে না।

রাইমা গলা ঝেড়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। সবাই তার দিকে তাকাতেই বললো, ‘মহা খুশির খবর নিয়ে এসেছি তোমাদের জন্য।’

আয়েশা বললো, ‘ভণিতা না করে বলে ফেল কি?’

রাইমা মিষ্টি করে একটা হাসি দিয়ে বললো, ‘দীবা আর আরব ভাইয়ের সম্পর্ক একদম স্বাভাবিক হয়ে গেছে।’

কথাটা শুনে খুশি হলো নিশিতা। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে বললো, ‘অবশেষে সব ঠিক হলো। অনেক টেনশনে ছিলাম তাদের জন্য।’

সবার এই আনন্দময় মুহূর্তের প্রতি মোটেও আগ্রহ পেলো না নুরা। চুপচাপ সিঁড়ি বেয়ে নিজের রুমে চলে আসলো। দরজা লাগিয়ে বিছানায় শুয়ে পরলো। সিলিংয়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকালো। নিষ্প্রভ তার চোখের এই দৃষ্টি। গাড়িত রাজের মৃদু হাসি দেওয়ার চেহারাটা ভেসে উঠলো চোখের সামনে। চোখের কার্নিশ বেয়ে এক ফোটা তপ্ত জল পরলো। ধীরে ধীরে চোখ দুটো বন্ধ করলো। ক্লান্তিকর চোখ দুটো একটু স্বস্তি পেতেই ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালো।
____________________

বাড়ির ভিতরে ঢুকে গাড়ি থামালো আবরার। গাড়ি থামাতেই দীবা চটজলদি গাড়ি থেকে নেমে গেলো। পিছনের সিট থেকে নিজের ব্যাগটা নিয়ে কাধে দিলো। আবরার গাড়ি থেকে নেমে দীবার উদ্দেশ্যে বললো, ‘কোন রুমে যাবে এখন?’

ভ্রুঁ কুঁচকে চোখ দুটো ত্যাড়া করে পিছু ফিরে আবরারের দিকে তাকালো দীবা। প্রশ্ন করার মতো আর কিছু পেলো না? কোন রুমে যাবো এটা আবার কেমন প্রশ্ন? মনে মনে কিছুটা বিরক্ত হলেও প্রকাশ করলো না, ‘আমার রুমেই। কেন?’

‘এখন থেকে আমার রুমে থাকবে। আমি কমলা দাদীকে বলে দিবো। উনি তোমার জিনিসপত্র আমার রুমে শিফট করে দিবে।’

‘দরকার নেই। আমি আমার রুমেই থাকবো।’

আবরার সব কিছু সহ্য করতে পারে। কিন্তু তার কথার বিরুদ্ধে “না” শব্দটা সে মোটেও সহ্য করতে পারে না। দীবা মুখের উপরে না করায় চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। রাগ ভিতরে ভিতরে সংযত রেখে কাটকাট গলায় বললো, ‘আমি বলেছি মানে এখন থেকে আমার রুমেই থাকবে।’

দীবার এক রোখা প্রত্যুত্তর, ‘আমি থাকবো না মানে না।’

আবারো দীবার থেকে সরাসরি না শব্দটা শুনে ধমকে উঠলো আবরার, ‘দীবা?’

ইষৎ কেঁপে উঠলো দীবা। বিস্মিত চোখে আবরারের দিকে তাকালো। আবরার তাকে ধমক দিয়েছে ভেবে খারাপ লাগলো ভীষণ। চোখে পানির বিন্দু বিন্দু কণা জমে চিকচিক করতে লাগলো। নাক টেনে কাদু কাদু গলায় বললো, ‘আপনি অনেক খারাপ। মাথায় যা আসে তাই বলে ফেলেন। আমাদের সম্পর্কের কথা এখনো কেউ জানে না। হুট করে কিভাবে আমি রুম চেঞ্জ করে ফেলবো? অন্যরা কি ভাববে ভেবেছেন? এইসব কিছুই ভাবেন না আপনি। হুটহাট ডিসিশন নেওয়ার অভ্যাস আপনার।’

ফুঁশ করে লম্বা একটা নিশ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করলো আবরার। জিভ দিয়ে উষ্ঠধয় ভিজিয়ে দীবার কাছে আসলো। আলতো হাতে দীবার দুই গাল ধরে বললো, ‘হোপ বোকা মেয়ে। এখানে কান্না করার কি আছে? তুমি আমার বউ। এটা পরিবারের সবাই জানে। তাহলে কে কি ভাববে?’

নাক টানলো দীবা। ঠোঁট উল্টে ইনোসেন্ট চেহারায় বললো, ‘সবাই জানে না।’

মৃদু শব্দে হাসলো আবরার। দীবার কপালে গভীর একটা চুমু দিয়ে বললো, ‘সবাই জানবে তুমি আবরার জুহায়ের’এর বউ। সবাই জানবে।’

বউ শব্দটা শুনে লজ্জা পেলো দীবা। উন্মুক্ত বাগানে দীবার কপালে চুমু খাওয়ায় লজ্জায় গাল লাল হয়ে এলো। তাকে এভাবে লজ্জা পেতে দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসলো আবরার। দীবার কানের কাছে নিজের মুখ নিয়ে নেশালো গলায় বললো, ‘লজ্জা পেলে তোমাকে মারাত্মক লাগে দীবা। ইশ!’

আবরারের বাহুতে দুই হাতে ধা’ক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলো। চোখ পাকিয়ে কপাট রাগ দেখিয়ে বললো, ‘অসভ্য লোক। সুযোগ পেলেই আজেবাজে কথা বলা শুরু করে। এতো নির্লজ্জ একটা মানুষ আমার কপালে পরলো। ধ্যাৎ!’

বলেই গটগট পায়ে বাড়ির ভিতরে চলে গেলো দীবা। পিছন থেকে উচ্চস্বরে আবরারের হাসির শব্দ কানে আসলো শুধু।’

চলমান….