আষাঢ়ে শ্রাবণের বর্ষণ পর্ব-৫২

0
1107

#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির

[পর্ব-৫২]

ঘুম ভাঙ্গতেই ব্যস্ত হয়ে পরলো সবাই। চারপাশ হয়ে উঠলো কোলাহলময়। রঙবেরঙের ঝাড়বাতিতে আলোকিত চারপাশ। ভারি লেহেঙ্গা পরিহিত রাইমাকে ব্রাইডাল সাজে মোহনীয় লাগছে। চোখেমুখে তার প্রাণোচ্ছল হাসি। স্টেজের মাঝে রাজিবের সঙ্গে পাশাপাশি বসে আছে দুজন। দূর থেকে একে অপরকে পরিপূরক লাগছে। সবার মুখে শুধু ‘মাশাআল্লাহ’ ধ্বনি। বিবাহ সুন্দর ভাবে সম্পন্ন হলো। খুশি হলো সবাই। মন ভরে দোয়া করো রাজিব ও রাইমার জন্য।

বিয়েতে সকলে উপস্থিত থাকলেও শুধুমাত্র রাজ অনুপস্থিত ছিল। খুব দরকারি একটা কাজ থাকায় রাউজান দুই দিনের জন্য যেতে হয়েছে তাকে। যদিও সেখানে না গেলেও চলতো, তবুও রাজ ইচ্ছে করেই সেখানে গিয়ে বিয়ে অনুপস্থিত ছিল। সবাই ব্যাপার টা স্বাভাবিক ভাবে নিলো। কারণ তারা আগে থেকেই জানতো আর এতো এতো মানুষের ভিরে কমফোর্টেবল ফিল করে না। তাই সবাই এতোটাও গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু স্বাভাবিক নয় নুরা। সকলের মাঝে রাজের অভাববোধ করলো সে। ক্ষুণ্ণ ছিলো মন। কিন্তু নুরার এই বিষণ্ণবদন মনটাকে পুলকিত করতে রাজের ছোট একটা ম্যাসেজই যথেষ্ট ছিলো। যেখানে লিখা ছিলো রাজের না আসার কথা। যাওয়ার আগে নুরাকে জানিয়ে যাওয়ার ব্যাপার টা নুরার কাছে ভালো লাগলো। রাজের প্রতি কেমন অদ্ভুত অধিকার-বোধ কাজ করলো তার মনে।

বিয়ের কাজ সম্পূর্ণ ভাবে সম্পন্ন হবার এলো বিদায়ের পালা। রাইমাকে বিদায় জানানোর মতো মর্মান্তিক বেদনাময় মুহূর্তে সবাই কাতর। কান্নায় চোখ ফুলিয়ে ফেললো রাইমা। ছোট বোনদের জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। শান্ত্বনা দিচ্ছে সাবিত, আবরার ও আরিয়ান। নিশিতা ও আয়েশা মেয়েকে ভালোভাবে বুঝিয়ে শুনিয়ে দিলো। মেয়েকে বিদায় দিতে মন চাইছে না। তবুও বুকে কষ্ট লুকিয়ে হাসিমুখে বিদায় জানাতে হলো বাড়ির বড় মেয়েকে।

আকাশটা আজ মেঘলা। থোকায় থোকায় কালো মেঘেদের ভেলা ভাসছে। শীতল হাওয়া প্রভাহমান। ঝিঁ ঝিঁ পোকাদের কর্কষ ডাক আজ শূন্যময় লাগছে রাইমার রুমের বারান্দা থেকে। নিজের হাতে গুছিয়ে রাখা রুমটাকে বিদায় দিয়ে চলে যেতে হয়েছে অন্যত্র। এটাই সৃষ্টির শুরু থেকে হয়ে এসেছে এবং অনন্তকাল অব্দি চলবে। এই নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই নুরার। রাইমার চেহারাটা চোখে ভাসছে বারবার। একা একা লাগছে নিজেকে। রাইমার বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিরবে দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। তখুনি পাশে এসে দাঁড়ালো আরিয়ান। নুরার দিকে ত্যাঁছড়া চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘কাঁদছিস কেন?’

নুরা প্রত্যুত্তর করলো না। চোখের পানি মুছতেই আরিয়ান বিদ্রূপ মাখা কন্ঠে আবারো বলে উঠলো, ‘এমন ভান ধরছিস যেন তোরই বিয়ে গেছে। জামাই তোকে সাথে নিয়ে যায় নি তাই কেঁদে কেটে আমাদের বাড়ি ভাসাচ্ছিস।’

বিরক্ত হলো নুরা। অপ্রসন্ন চোখেমুখে আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘সমস্যা কি ভাই? দেখছো আমি কাঁদছি। কোথায় একটু শান্ত্বনা না দিবে তা না করে উলটো কথা শুনাচ্ছো?’

‘আরেকটু দেরি করে এখানে আসলেই শান্তি নিবাস বন্যায় ভেসে যেতো। আর তোকে কে যাবে শান্ত্বনা দিতে?’

নুরা এবার রেগে গিয়ে আরিয়ানের চুল খামচে ধরলো। ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠলো আরিয়ান। আর্তনাদ করে উঠলো, ‘এই এই বিলাই আমার চুল ছাড়। ভালো হচ্ছে না বলে দিচ্ছি নুরা। আমার চুল ছাড় বলছি।’

নুরা রাগে দাঁত চিবিয়ে বললো, ‘ছাড়বো না চুল। সময়ে অসময়ে ফালতু কথার গোডাউন খুলে বসো না? সব গুলা চুল ছিঁড়ে তোমার বেল মাথা দিয়ে আমি ফুটবল খেলবো।’

‘নুরার বাচ্চা আমার সুন্দর চুল গুলা ছাড় বলছি।’

‘ছাড়বো না।’

নুরাকে দেখার জন্যই রাইমার রুমে এসেছিলো আবরার। পুরো রুমে নুরাকে না পেয়ে বারান্দায় আসতেই হতভম্ব হয়ে গেলো। দুইজন কে এভাবে চুল ধরে টানাটানি করতে দেখে দূর থেকেই ধমকে উঠলো, ‘ঝ’গ’ড়া থামাবি তোরা?’

আবরারের কন্ঠ শুনেই চটজলদি আরিয়ানের চুল ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো নুরা। কোনো রকমে ঠোঁট টেনে বোকা বোকা হাসি দিলো একটা। আবরার তী’ক্ষ্ণ চোখে দুই ভাই বোন কে পর্যবেক্ষণ করে শুধাল, ‘এইগুলা কেমন ঝ’গ’ড়া? চুল ধরে একজন আরেকজন কে! সিরিয়াসলি নুরা?’

নুরা নিজেকে নির্দোষ প্রমান করার জন্য বলে উঠলো, ‘আরব ভাই এখানে আমার কোনো দোষ নেই। রাইমা আপি চলে গেছে তাই এমনিতেই মন খারাপ। তার উপর আবার এই আরুর বাচ্চা…. মানে আরিয়ান ভাইয়া আমাকে রাগাচ্ছে বারবার।’

শেষের কথাটা আরিয়ানের দিকে কটমট চোখে তাকিয়ে বললো। আরিয়ান তার শখের, আদরের চুল গুলোতে হাত বুলাতে বুলাতে ব্যাথায় কুঁকড়ে বললো, ‘তাই বলে ভাই আমার চুল টেনে ধরবে? এটা কেমন অসভ্যতামি বলো তো। আমার এখুনি একটা বিচার চাই। তোমার কাছেই নালিশ দিলাম।’

আবরার কপাল কুঁচকালো। এখানে আসলে কাকে কি বলা উচিত সেটা তার আদৌতে বুঝে আসলো না। তবে ছোট বোন হিসেবে বড় ভাইয়ের চুল ধরা অবশ্যই বেয়াদবি। তাই নুরাকে আরিয়ানের কাছে ক্ষমা চাইতে বললো। ইচ্ছে না থাকার পরেও ‘সরি’ বললো নুরা। আরিয়ান বেচারা এখনো চুলে হাত বুলাচ্ছে। আবরার দুইজনকে বুঝিয়ে শুনিয়ে যার যার রুমে পাঠিয়ে দিলো। অতঃপর নিজেও রুমে চলে আসলো। পুরো রুম অন্ধকারাচ্ছন্ন দেখে ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকালো সে। কিছুক্ষণ আগেও যখন রুমে এসেছিলো তখন লাইট অন করেই বাহিরে গিয়েছিল। তাহলে? দীবা এসেছে নিশ্চয়! আবরার লাইট অন করার জন্য সুইচবোর্ডের দিকে এগিয়ে যেতেই পিছন থেকে চুড়ির শব্দ কর্ণপাত হলো। আগত ব্যক্তিটা কে বুঝতে পেরে বাঁকা হেসে পিছু ফিরে তাকালো। অন্ধকারের মধ্যে মোমবাতির আলোতে দীবার মায়াবী মুখখানি চোখে পরলো তার। থমকে গেলো মুহূর্তেই! তাকিয়ে রইলো পলকহীনভাবে।

মোমবাতি জ্বালিয়ে বারান্দার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে দীবা। ঠোঁটে তার মৃদু মুচকি হাসি। মোমবাতির আলোতে তার মুখশ্রী আলোকিত। গোলগাল চেহারায় মিষ্টি হাসিতে মুগ্ধ হলো আবরার। দীবা ধীর পায়ে আবরারের কাছে এগিয়ে আসলো। মোমবাতি টা দুজনেত সামনে ধরে আবরারের দিকে তাকালো। ঠোঁটে তার লাজুক হাসি। বারান্দার দরজা খোলা থাকায় বাহিরের এক দমকা শীতল হাওয়া মোমবাতি নিভিয়ে দিতে চাইলে আবরার আর দীবা দুইজনই দুই হাতের সাহায্যে মোমবাতি আড়াল করে নিলো। কাছাকাছি এলো দুজন। আবরার দীবার দিকে বিমুখিত চোখে তাকাল। মৃদু গলায় ঠোঁট নেড়ে শুধাল,

‘দু-তিনটে নক্ষত্রের আলো নিয়ে এসেছ তুমি, অন্ধকারে মোমবাতি করে যা এনেছ তা ঠুনকো। নক্ষত্রের আলো তোমার চোখে। যে চোখ ফিরিয়ে দিচ্ছে বর্ষার তীব্র আঘাত, শুধু ভিজে আছে আমাদের দুটি হাত। তোমায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখে, কাটিয়ে দেবো এই আঁধারের রাত।’

লাজুক হাসলো দীবা। লজ্জায় মাথা নত করে ফেললো। আবরার দীবার হাত থেকে মোমটা সরিয়ে পাশে থাকা কর্ণার টেবিলের উপরে রাখলো। তারপর পিছন থেকে দীবাকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে থুনতি রেখে চোখ বন্ধ করলো। ধীর গলায় বললো, ‘তোমার লাজুক হাসিতে আমি বারবার মুগ্ধ হই দীবা। এতো দেরি করে আমার জীবনে এলে কেন তুমি? আরেকটু আগে আসতে পারলে না?’

দীবা আবরারের হাতের উপর নিজের হাত রাখলো। জড়তাহীন কন্ঠে শুধাল, ‘আমরা প্রতিটা মানুষের সঙ্গে সঠিক সময়েই পরিচিত হই।’

আবরার দীবার সঙ্গে আরেকটু নিবিড় হলো। দীবার গালে নিজের নাক বুলিয়ে বললো, ‘তবুও আফসোস তো থেকেই যায়। আমার আগের জীবনের চেয়ে তোমাকে পাবার পরের জীবন একটু বেশিই সুন্দর দীবা। তোমার সঙ্গে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত আমার জন্য স্পেশাল।’

দীবা আবরারের দীকে ঘুরে দাঁড়াল। আবরারের কপালে আলতো ভাবে একটা চুমু দিল। মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বললো, ‘আর আমার জন্য আপনি একটু বেশিই স্পেশাল।’

খুশি হলো আবরার। দীবা কোলে তুলে নিয়ে কপালে কপাল ঠেকালো। অতঃপর দুষ্টু হেসে বললো, ‘লেট মি ফিল ইউ স্পেশাল।’
_______________________

শ্রাবণের আঠারো তম দিন। আকাশটা আজ ভীষণ ঘোলাটে। পরিবেশ শীতল। আবহাওয়াদপ্তর অফিসের খবর অনুযায়ী আজ সারাদিন শহরাঞ্চল ভারী বর্ষণে মুখরিত থাকবে। মুষলধারের বৃষ্টিতে মুখরিত হয়ে আছে আগ্রাবাদের পরিবেশ। সদ্য ফোটা সবুজ কচি পাতা গুলো বৃষ্টির পানিতে ভিজে টুইটুম্বুর। রাস্তাঘাট ভিজে একাকার। ধরনি কাপিয়ে বারবার গর্জে উঠলো আকাশ। ইষৎ কেঁপে উঠলো নুরা। টানাটানা নেত্রপল্লব তুলে আকাশের দিকে তাকালো। বড়বড় বৃষ্টির কিছু ছিটেফোঁটা ভিজিয়ে দিচ্ছে তাকে। তবুও সেদিকে ধ্যান নেই তার। কলেজের বারান্দার কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বর্ষণমুখর দিনটা উপভোগ করছে নুরা। চেহারা তার লাবণ্যময়। ঠোঁটে তার আমোদিত হাসি। চোখ বন্ধ করলেই রাজের মুচকি হাসির চেহারা ভেসে উঠছে। পুলকিত হচ্ছে তার মন।

‘বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি ভেজার কারণ কি মিস?’

চমকে উঠলো নুরা। হকচিকিত হয়ে পিছু ফিরে দেখলো। চমক দৃষ্টিতে একবার নিজের দিকে চোখ বুলালো। সাদা ইউনিফর্মের অনেকটা অংশই ভিজে গেছে প্রায়। নিজের এই অপকর্মের কারণে নিজের উপরেই বিরক্ত হলো সে। সামনে তাকিয়ে ঠোঁট টেনে কোনো রকমে একটা বোকা প্রকৃতির হাসি দিলো।

পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে রাজ। দৃষ্টি তার নুরার দিকে। রাইমার বিয়ের আগের দিন রাতে নুরার সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল তার। তারপর প্রায় দিন যাবত দেখা নেই। এই তিন দিন নুরাকে ভীষণ মিস করেছে রাজ। কারণটা তার জানা নেই। হুট করেই যেমন দীবার প্রতি ভালো লাগা তৈরি হয়েছিলো তার মনে। ঠিক তেমনিভাবে হুট করেই নুরার প্রতি আকাশ সমান ভালোবাসা সৃষ্টি হয়েছে তার মনে। তাই হয়তো অদ্ভুত ভাবেই নুরাকে ভীষণ মিস করেছিল। ব্যস্ততার কারণে কল দেওয়া হয়নি। আবার কল দেবার সুযোগ পেলেও অস্বস্তির কারণে কল দেয়নি। নুরার প্রতি নিজের এই অনুভূতি টা তার কাছে ভীষণ প্রিয় হয়ে উঠেছে। একটু নড়েচড়ে দাঁড়াল রাজ। নুরার দিকে তাকিয়ে আবারো বলে উঠলো, ‘এভাবে দাঁড়ানোর মানে কি? ড্রেসটা একদম নষ্ট করে ফেলেছো। সাদা কাপড় থেকে এই দাগ গুলো উঠবে?’

রাজের কথায় মোটেও পাত্তা দিলো না নুরা। নিজের মনের ভিতরে জমে থাকা সকল প্রশ্ন ও অভিমান গুলো অস্থির হয়ে বলে ফেললো, ‘কোথায় ছিলেন এতোদিন? জানেন কতোটা মিস করেছি আপনাকে। আপুর রিসিপশনের দিন ভেবেছিলাম থাকবেন। কিন্তু ওইদিনও আসেন নি। একটা কল অব্দি দেননি। খুব রাগ হয়েছে আমার।’

শেষের কথাটা কিছুটা অভিমান সহকারে বললো নুরা। রাজ থমকালো। নিচের ঠোঁট কামড়ে ডান পাশে তাকালো। দুজনের আশেপাশে কেউ নেই। তবে তাদের থেকে কিছুটা দূরত্বে কয়েকজন শিক্ষার্থী নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে। লম্বা একটা দম নিলো রাজ। নুরার অভিমানী চেহারার দিকে তাকালো। আলতোভাবে শুধাল, ‘এটা কলেজ নুরা। পারসোনাল কোনো কথা এখানে যেন না হয়। প্রফেশন লাইফ আর পারসোনাল লাইফ আলাদা। আমি জানি তুমি…”

রাজের কথা সম্পূর্ণ হতে দিলো না নুরা। অভিমান নিয়ে রাজকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো ক্লাস রুমে। রাগ হলো তার। অভিমান আগের তুলনায় দ্বিগুণ হলো। নিজেকে বড্ড বেহায়া মনে হলো। কেন এই কথা গুলো বলতে গেলো সে? রাগে ধপাস করে গিয়ে দীবার পাশে বসলো। তাকে এভাবে রেগে থাকতে দেখে অবাক হলো দীবা। জানতে চাইলো, ‘কিরে রেগে আছিস কেন?’

‘এমনি।’

নুরার সংক্ষিপ্ত উত্তর শুনে দীবা আর কথা বাড়ালো না। নিজের মতো করে অংক সমাধান করতে লাগলো।
.

নুরার এমন আচরণ দেখে বিস্মিত হলো তার। মৃদু শব্দ তুলে হেসে ফেললো তাৎক্ষনাৎ। নুরার অভিমান মিশ্রিত মায়াবী মুখখানি তার কাছে ভীষণ কিউট লাগলো। এক রাশ মুগ্ধতা ছুলো তার মনে। মাথার পিছনের চুল গুলো এক হাতে চুলকে অফিস কক্ষের দিকে পা বাড়ালো।
____________________

ভারী বর্ষণের মাত্রা কমে এলো। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ফোটাতে মুখরিত আগ্রাবাদ শহর। আকাশটা এখনো ঘন কালো মেঘেদের মাঝে লুকানো। শীতল বাতাস তো বর্ষাকালের সঙ্গি। কলেজ ছুটি হতেই কোলাহলময় হয়ে উঠলো আগ্রাবাদ মহিলা কলেজ। শিক্ষার্থীরা ছাতা মাথায় নিয়ে দ্রুত পা চালাচ্ছে যার যার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। দুর্ভাগ্যবশত নুরা ছাতা আনতে ভুলে যাওয়ায় রিমির ছাতার নিচে জায়গা নিয়েছে। আর দীবার একা-ই একটা ছাতা হাতে নিয়ে কলেজের বাহিরে আসলো। তিনজন পাশাপাশি নিজেদের গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। দীবা গাড়ির দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতে গিয়েও রাজকে তাদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে দাঁড়িয়ে পরলো। বিস্মিত হলো দীবা ও রিমি। রাজ তাদের দিকে এগিয়ে এসেই বলে উঠলো, ‘আব্ তোমরা যদি কিছু মনে না করো তাহলে নুরা আমার সাথে যাক?’

ঠোঁট টিপে মুচকি হাসলো দীবা। রিমির দিকে তাকিয়ে ভ্রুঁ জোড়া নাচালো। রিমিও রাজের অগোচরে হাসলো। দুজনের হাসি রাজের চোখ এড়ালো না। অপ্রস্তুত হয়ে গেলো সে। এর আগে কখনো এমন অপ্রীতিকর পরিস্থিতির স্বীকার হয়নি। হুট করে এভাবে কথাটা বলে অস্বস্তিতে পরেছে সে। নুরা চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বারণ করে বলে ফেললো, ‘আমাদের গাড়ি আছে। আমরা এক সাথেই যাবো।’

দুজনের মাঝে যে কোনো কারণে ঝগড়া হয়েছে এবং নুরা রাজের উপর ভীষণ ভাবে ক্ষেপে আছে তা বুঝতে বাকি নেই দীবা ও রিমির। নুরাকে বারণ করতে দেখে দীবা বললো, ‘তোকে আমাদের সাথে নিবো বলেছি আমরা?’

রিমি কিছুটা রসিকতার ছলে বলে উঠলো, ‘বৃষ্টিময় দিন, আকাশ মেঘে ঢাকা, সাথে টক ঝাল মিষ্টি অভিমান। একদম জমে ক্ষীর জান। তুই বরং স্যারের সঙ্গেই যা।’

কথাটা বলেই দীবা রিমি গাড়িতে উঠে বসলো। নুরা বসার আগেই তড়িঘড়ি করে গাড়ির দরজা লাগিয়ে ফেললো। হতভম্ব হয়ে গেলো নুরা। রাগে গাড়িতে আলতোভাবে একটা লা;থি দিয়ে ঝাঁঝালো গলায় বললো, ‘কুত্তি দুইটা। ভালো করলি না কাজটা।’

গাড়ির ভিতর থেকেই দুইজন দাঁত কেলিয়ে হাসলো। রিমি কাচ নামিয়ে মাথাটা একটু বের করে বললো, ‘বেষ্ট অফ লাক বেবি।’

চলে গেলো দুজন। রাগে ফুশছে নুরা। দাঁত কিড়মিড় করে ওদের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। রাজ পিছন থেকে ধীর গলায় বললো, ‘সামনের কালো গাড়িটা আমার। এবার চলো?’

কটমট চোখে একবার রাজের দিকে তাকালো নুরা। তারপর গটগট পায়ের কদম ফেলে গাড়িতে গিয়ে উঠে বসলো। ফুশ করে একখান নিশ্বাস ফেললো রাজ। এক হাতে মাথা চুলকে মিনমিন গলায় বললো, ‘এই মেয়ে রাগলে কিউট লাগে। কাঁদলেও কিউট লাগে। কিন্তু এবার রাগ ভাঙ্গাবো কি করে?’
_____________________

আজ সকাল থেকেই আকাশটা মেঘলা। থেমে থেমে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। সকাল থেকে ক্লাস চলাকালীন সময় মুষলধারের বৃষ্টিতে মুখরিত ছিল শহর। তারপর কলেজ ছুটির সময় ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। দীর্ঘসময় বৃষ্টিপাত হবার পর এখন আকাশটা স্বচ্ছ নীল। থোকায় থোকায় সাদা কালো মেঘেদের ভেলা ভাসছে। সাথে কনকনে শীতল বাতাস। গাড়ির জানালার কাচ নামিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে নুরা। আজ সে একটাও কথা বলবে না। ওই আকাশটার সমান অভিমান জমেছে মনে। যা সহজে ভাঙ্গবার নয়।

গাড়ি চালানোর মাঝেও ফাঁকে ফাঁকে নুরার দিকে মলিন চোখে তাকাচ্ছে রাজ। অসহায় লাগছে তার নিজেকে। হুট করেই মনে হচ্ছে পিএইসডি করার আগে তাকে মেয়েদের রাগ কিভাবে ভাঙ্গাতে হয় তার উপর একবার স্টাডি করা উচিত। সেই কখন থেকে ভাবছে। কিন্তু আসলে কি বলবে সেটা মাথায় আসছে না। আফসোস হচ্ছে তার। এতো বছর দীবার পিছনে পরে না থেকে চার পাচঁটা প্রেম করলেও পারতো। তাহলে অনন্ত মেয়েদের মন বুঝার মতো বিশাল বড় অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারতো। ভেবেই লম্বা একটা নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করে নিলো রাজ। গাড়িটা স্টোরিয়ারিংটা বামে ঘুরিয়ে বলল, ‘নতুন একটা প্রজেক্ট পেয়েছি নুরা।’

হতবাক নুরা। অবাক চোখে রাজের দিকে তাকালো। ভারি আশ্চর্য হয়ে বলে উঠলো, ‘মানে আমার রাগ না ভাঙ্গিয়ে আপনি বিসনেজ নিয়ে ডিসকাস করবেন?’

হতভম্ব হয়ে গেলো রাজ। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হুট করেই গাড়ির ব্রেক কষলো। নুরার দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে মলিন কন্ঠে শুধালো, ‘আসলে কিভাবে কথা শুরু করবো বুঝতে পারছি না।’

কিছুটা বিরক্ত হলো নুরা। হতাশার নিশ্বাস ফেলে সিটে হেলান দিলো। অন্যদিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে উঠলো, ‘বাহ্, সবই শিখলো কিন্তু প্রেমটা ভালো ভাবে শিখলো না। এটাও আমাকে শিখাতে হবে।’

এক হাতে গাড়ির স্টোরিয়ারিং শক্ত করে ধরলো রাজ। উপর হাতে নুরার সিট ধরে একটু এগিয়ে নুরার দিকে ঝুকে আসলো। নুরার চোখে চোখ রেখে মৃদু গলায় বললো, ‘সবই তো নিজে থেকে শিখলাম। এবার প্রেমটা নাহয় তুমিই শিখাও।’

রাজের শান্ত কণ্ঠস্বর শুনে থমকালো নুরা। অস্থির হয়ে উঠলো মন। অপ্রস্তুত হয়ে রাজের থেকে চোখ সরিয়ে ফেললো। তবে নিজেকে শান্ত রেখে স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিলো, ‘আগে ভাবুন আমি কি কি কারণে রাগ করেছি।’

রাজ ঠোঁট কামড়ে কয়েক সেকেন্ড ভাবলো। তারপর বললো, ‘রাউজান গিয়ে কল দেইনি তাই!’

‘আর?’

‘আর কলেজে ওই কথাটা বলেছি তাই।’

আর কিছু বললো না নুরা। অভিমানে মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকালো। মৃদু শব্দ তুলে হেসে ফেললো রাজ। পিছিয়ে এসে নিজের সিটে হেলান দিয়ে বসে বলতে লাগলো, ‘আসলে আব্বুর অনেক বড় একটা প্রজেক্ট এসেছে। সেটাকে সামলাতে একটু বেশিই ব্যস্ত হয়ে পরেছিলাম। তাছাড়া যখন ফ্রি হতাম তখন অনেক রাত। ভেবেছিলাম হয়তো ঘুমিয়ে গেছো তাই কল দেইনি।’

‘তাই বলে ছোট একটা ম্যাসেজও দিতে পারেন নি? জানেন আপনার প্রতি খুব রাগ হয়েছিল আমার।’

নুরার কোমলায়ন কন্ঠের অভিযোগ শুনে ব্যথিত হলো রাজ। ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুধাল, ‘এমন আর হবে না। সরি!’

অভিমান ভাঙ্গলো না নুরার। মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকেই তাকিয়ে রইলো। চোখের কার্নিশে অভিমানজনিত পানি জমে এলো তার। ঠোঁট কামড়ে নিঃশব্দে হাসলো রাজ। নুরার দিকে ফিরে শান্ত গলায় বলে উঠলো, ‘যদি বলি ভালোবাসি। তাহলেও কি রাগ ভাঙ্গবে না?’

কয়েক সেকেন্ডের জন্য হৃদযন্ত্রটা থেমে গেলো নুরার। নিশ্বাস ভারি হয়ে আসলো। বিস্মিত চোখে রাজের দিকে চটজলদি ফিরে তাকালো। তার এমন বিস্ময়াদি চেহারা দেখে আবারো হাসলো রাজ। এগিয়ে এসে নুরার এক পাশে রেখে ঝুকে বসলো রাজ। নুরার কপালে পরে থাকা ছোট ছোট বেবি হেয়ার গুলো কানের পিছনে গুঁজে দিয়ে বললো, ‘ট্রাস্ট মি নুরা, আমি নিজেও খুব মিস করেছি তোমাকে। অদ্ভুত ভাবেই তোমার অভাব অনুভব করেছে হৃদয়। ইচ্ছে করছিল কাজ ফেলে ছুটে আসি তোমার কাছে। তোমার এই টানা টানা চোখে আবারো চোখ রাখতে। আগে কখনো এই অনুভূতির স্বীকার হয়নি আমি। তোমার কথা মাথায় আসতেই নতুন নতুন অনুভূতি সৃষ্টি হয় মনে। আর এই অনুভূতি গুলোই আমাকে মানসিক প্রশান্তি দেয়।’

নিশ্চুপ নুরা। মুহূর্তেই মনে একরাশ ভালো লাগা কাজ করলো। রাজ এতোটা কাছে থাকায় লজ্জাভূতি হলো সে। গাল লাল হয়ে এলো। লজ্জায় দৃষ্টি নত করে ফেললো। নুরার লজ্জামাখা মুখ দেখে মুগ্ধ হলো রাজ। নুরার দিকে এগিয়ে আরেকটু নিবিড় হলো। ভড়কে গেলো নুরা। অস্থির হয়ে চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেললো। থামলো না রাজ। নুরার কোমল গোলাপি ঠোঁট জোড়ার দিকে এগুতে লাগলো। নিশ্বাস ভারি হয়ে এলো দুজনের। নুরার একদম কাছাকাছি যেতেই থেমে গেলো রাজ। কিছু একটা মনে পরতেই চটজলদি দূরে সরে এলো। নিজের এমন কান্ডে নিজেই প্রকাণ্ড রকমের বিস্মিত হলো। নিচের ঠোঁট কামড়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো নিরবে। রাজের অগোচরে মুচকি হাসলো নুরা। প্রথমে মতো আবারো বাহিরে চোখ রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। পুরো রাস্তা একবারো নুরার দিকে অস্বস্তির কারণে তাকায় নি রাজ। নিজের বেহায়াপনায় নিজেরই লজ্জা লাগছিলো। ইশ, বিয়ের আগেই এটা কি করতে যাচ্ছিলো সে? ভাবতেই অশ্রাব্য ভাষায় নিজেকে গালি দিতে চাইলো তার মন।

চলমান….