আষাঢ়ে শ্রাবণের বর্ষণ পর্ব-৫৩

0
904

#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির

[পর্ব-৫৩]

ডিরেক্টর মিঃ আজিজের কল আবরারের মোবাইলে বহুদিন পর আসলো। আগ্রাবাদ আসার পর থেকেই মিঃ আজিজের সঙ্গে যোগাযোগ খুব কমই হয়েছে আবরারের। এর আগেও অবশ্য কয়েকবার কল দিয়েছিলো আজিজ। কিন্তু আবরার তার ন্যাকামির উপর একটু বেশিই বিরক্ত ছিলো তাই কল রিসিভ করেনি। অভ্রকে দিয়ে কথা বলিয়ে রেখেছে। কিন্তু আজ ঘটলো অন্য কিছু। আজিজ কল দেওয়ার আগে ছোট একটা ম্যাসেজ দিলো। ম্যাসেজ টা দেখেই আবরারের আগ্রহ হলো কল রিসিভ করার। এবং হলোও তাই। কয়েকবার রিং হতেই আবরার কল রিসিভ করলো। মোবাইলের অপর পাশ ডিরেক্ট আজিজ এক গাল হাসলো। খুবই উল্লাসকর কন্ঠে বলে উঠলো, ‘এই ইয়াং বয়। কি অবস্থা তোমার?’

সব সময়ের মতো আবরারের ত্যাড়া প্রত্যুত্তর, ‘এযাবতকাল ভালোই ছিলো। এখন ততোক্ষণ পর্যন্ত ভালো যাবে যতোক্ষণ না আপনি কল দেওয়ার কারণ জানাচ্ছেন।’

মিঃ আজিজ কিছুটা নড়েচড়ে বসলো। হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করে বললো, ‘নতুন একটা রিলিক্স লিখেছি। আমি চাচ্ছি এটা আজ কালের মধ্যেই রেকর্ড করে ফেলতে।’

“আজ-কাল” শব্দটা শুনেই বিদ্রূপপূর্ণ হাসি দিলো আবরার। কূটস্থ করে বলে উঠলো, ‘আজ কালের মধ্যে রেকর্ড! সহজেই বলে ফেললেন। আপনি একবার করে দেখান তো।’

‘আমি জানি এটা অনেক টাফ। কিন্তু রিলিক্সটা এতোটাই সুন্দর যে বের হলে মিডিয়ায় ভালোই মার্কেট পাবে। আমি জানি তুমি ঢাকায় নেই। তবুও আমি চাচ্ছি তোমাকে দিয়েই করাতে। তুমি দ্রুত সম্ভব আগামীকাল ঢাকা ব্যাক করলো।’

আবরার উঠে দাঁড়ালো। আজিজের কথা শুনতে শুনতে বারান্দায় পা বাড়ালো। বৃষ্টি শেষে শুধু শীতল হাওয়া। বৃষ্টির পানিতে বারান্দা সহ বারান্দার সকল গাছ ভিজে আছে। আবরার সাবধানে পা বাড়িয়ে রেলিংয়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। আজিজের কথা শুনে পকেটে এক হাত রেখে বললো, ‘আগামীকাল কিছুতেই সম্ভব না।’

‘দেখো আবরার। গানটা বর্ষাকাল নিয়ে লিখেছি। বর্ষাকাল শেষ হয়ে আর মাত্র কয়েকদিন। আমি চাই বর্ষাকালের মাঝেই গানটা রেকর্ড করতে। ব্যাপার নিয়ে আমি একটু বেশিই এক্সাইটেড। প্লিজ না করবে না। আগামীকাল ঢাকা আসো। বাকি কথা নাহয় সামনাসামনি হবে।

আবরার ভাবলো কিছুক্ষণ। তারপর বললো, ‘ঠিক আছে। দেখা যাক। আগে রিলিক্সটা ইমেইল করুন। ভালো লাগলে ভেবে দেখবো।’

সন্তুষ্ট হলো আজিজ। এক গাল হেসে বললো, ‘আমি জানতাম ইয়াং বয় তুমি রাজি হবে। রিলিক্সটা পছন্দ হবেই তোমার। আজিজ হান্নানের কাজ বলে কথা। হাহা!’

লোকটার হাসির শব্দটা আবরারের কাছে কর্কষ লাগলো। কান থেকে মোবাইল নামিয়ে কল কেটে দিলো। কয়েক সেকেন্ড পরেই ইমেইল আসলো। সেটাতে ক্লিংক করে রুমে যাবার জন্য পা বাড়াতেই থেমে গেলো আবরার। বাড়ির বাহিরে সামনের দিকে তাকালো। কালো রঙ্গের একটা গাড়ি থেকে নুরাকে ইউনিফর্ম পরে বেরুতে দেখলো সে। প্রথমে পাত্তা দিলো না। ভেবেছে কলেজ থেকেই ফিরেছে। কিন্তু নুরা বের হবার পরে গাড়ির ভিতরের মানুষটা দেখতেই হতবাক হয়ে গেলো আবরার। অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো দুজনের দিকে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো। রাজের সঙ্গে বাড়ি ফিরেছে নুরা? তবে কি রাজ দীবার পর নুরাকে টার্গেট করেছে? ভাবতেই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তার। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইলো কেবল। নুরা বাড়ির ভিতরে চলে আসতেই রাজ চলে গেলো। অতিরিক্ত রাগের কারণে আবরারের শরির কাঁপছে। দ্রুত রুমে আসলো নিচে যাবার জন্য। রুমে গিয়ে দেখলো দীবা নরমাল ড্রেস আপে তার রুমে এসেছে। আবারো অবাক হলো রাজ। তার মানে নুরার আগেই দীবা কলেজ থেকে ফিরেছে। কলেজ শেষে তিনজন এক সাথে ফিরেনি। নুরা আর রাজের ব্যাপারে তাহলে দীবা ও রিমি জানে। ভাবতেই দীবার প্রতি রাগ হলো আবরারের। তবে সবটা না জেনে হুট করে রাগ দেখানো অযুক্তিক। তাই রাগ দেখালো না। বহু কষ্টে নিজেকে স্বাভাবিক রাখলো।

দীবা আবরারের কাছে এসেই মিষ্টি একটা হাসি দিলো। আবরারের হাতের মোবাইলের দিকে নজর যেতেই বলে উঠলো, ‘কি করছিলেন মোবাইলে? দেখি?’

বারণ করলো না আবরার। চুপচাপ মোবাইলটা দীবার হাতে তুলে দিয়ে আলমারি খুললো ফাইল বের করার জন্য। আপাতত মনটাকে একটু ব্যস্ত রাখতে চাইছে সে। নাহলে কখন কি করে বসে তার গ্যারান্টি সে নিজেও দিতে পারবে না।

দীবা সম্পূর্ণ রিলিক্স টা পড়ে খুশিতে লাফিয়ে উঠলো। অতিরিক্ত এক্সাইটেড হয়ে বলে উঠলো, ‘এইইইই রিলিক্স টা অনেক সুন্দর। এটা আপনি গাইবেন?’

আবরার দীবার দিকে না তাকিয়েই ছোট করে উত্তর দিলো, ‘না।’

অবাক হলো দীবা। মোবাইলটা বিছানায় রেখে আবরারের দিকে এগিয়ে এসে বাহু ধরে আবরারকে নিজের দিকে ঘুরালো। অবাক কন্ঠে বললো, ‘না করছেন কেন? এতো সুন্দর একটা রিলিক্স। তাছাড়া আপনি খুব ভালো গাইতে পারেন। তাহলে?’

আবরার ফাইলটা বন্ধ করে বললো, ‘আগামীকাল ঢাকা ব্যাক করতে বলছে তারা। কিন্তু এটা সম্ভব না। তাই বারণ করে দিবো।’

‘আশ্চর্য তো আপনি। বাংলাদেশে কি গাড়ির অভাব পরেছে নাকি? আপনার নিজেরও তো কয়েকটা গাড়ি আছে। গাড়ি গুলো কি অকালে ম/রেছে? আগামীকাল গেলে কি এমন ক্ষতি হবে?’

‘কিছুই হবে না। আপাতত কোনো গান রেকর্ড করতে আমার ভালো লাগছে না।’

ফাইলটা সরিয়ে আবরার দুই হাত ধরলো দীবা। অনুনয় করে বলে উঠলো, ‘প্লিজ প্লিজ। এই গানটা আমার অনেক পছন্দ হয়েছে। না করবেন না প্লিজ। আমার জন্য হলেও রাজি হয়ে যান? প্লিজ….”

শেষের কথাটা দীবা অনুরোধ করে বললো। দীবার চোখের দিকে তাকাতেই থমকালো আবরার। স্মিতি হাসলো কেবল। দীবার সঙ্গে একটু নিবিড় হলো। কোমড় জড়িয়ে ধরে বললো, ‘ঠিক আছে বউ জান। এই গানটা আপনার জন্যই গাইবো।’

খুশি হলো দীবা। আবারো বললো, ‘সত্যি বলছেন তো?’

আবরার মাথা উপর নিচে নাড়িয়ে বললো, ‘সত্যি। কিন্তু তার বদলে আমি তোমার থেকে কি পাবো?’

আবরারের কাধে দুই হাত রেখে জানতে চাইলো কি লাগবে তার। বাঁকা হাসি দিলো আবরার। দীবার ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে ইশারা করলো। তার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে চোখ বড়বড় করে তাকালো দীবা। আবরারের গালে আলতোভাবে থা/প্প/ড় দিয়ে বলে উঠলো, ‘অসভ্য লোক।’

উচ্চস্বরে হেসে উঠলো আবরার। দীবার কোমড় টেনে নিজের নিজের একদম কাছে নিয়ে আসলো। লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেললো দীবা।
____________________

শান্তি নিবাস অতিক্রম করে কিছুটা দূরে যেতেই রাজের মোবাইল বেজে উঠলো। এই অবেলায় কল আসায় কিছুটা বিরক্ত হয়েছে সে। তবুও কে কল দিয়েছে দেখার জন্য মোবাইল হাতে নিলো। রাজিবের কল দেখে বিলম্ব করলো না। কল রিসিভ করে কানে দিয়ে বললো, ‘হ্যাঁ ভাই বলো।’

মোবাইলের অপর পাশ থেকে রাইমার কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো, ‘কোথায় আছেন আপনি? একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি আসেম ভাইয়া।’

রাইমার কথা শুনে একটু বেশিই অবাক হলো রাজ। ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকে অস্থির কন্ঠে কারণ জানতে চাইলো, ‘কেন ভাবি কিই হয়েছে? সব কিছু ঠিক আছে তো?’

রাইমা শান্ত গলায় ধীর কন্ঠে শুধাল, ‘তেমন কিছু না। আসলে বাবার চেস্ট পেইন হয়েছে। এখন শুয়ে আছে। বাবা আপনাকে দেখতে চাইছে। রাজিব ডক্টরকে এগিয়ে দিতে বাহিরে গেছে। আমার কাছে আপনার নাম্বার নেই তাই রাজিবের মোবাইল থেকেই কল দিলাম। যেখানেই থাকেন ভাইয়া একটু তাড়াতাড়ি আসার চেষ্টা করবেন।’

‘আমি কাছাকাছিই আছি। বেশিক্ষণ লাগবে না। আব্বুকে বলুন আমি আসছি।’

বলেই কল কেটে দিলো রাজ। দ্রুত গাড়ি চালিয়ে বাকি পথটুকু অতিক্রম করে বাড়ি আসলো। গাড়ি পার্ক না করেই তড়িঘড়ি করে গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকলো। দরজার কাছে এসে বিছানায় অসুস্থ বাবাকে শুয়ে থাকতে দেখে বুকটা ধক করে উঠলো তার। মলিন হয়ে এলো চোখমুখ। তাকে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার বাবা আফজাল তাকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকলো। ধীর পায়ের কদম ফেলে কাছে আসলো রাজ। রাইমা একটা চেয়ার এগিয়ে দিলে সেখানে বসলো সে। বাবার এক হাত ধরে নিচু কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, ‘এখন কেমন লাগছে আব্বু?’

মলিন হাসলেন আফজাল। রাজের শৈশবকাল মনে করে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠলেন, ‘জানো রাজ। তুমি যখন নতুন কথা শিখেছিলে। তখন আমরা আম কাঁঠালের দিনে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম। কালবৈশাখী ঝড়ে আম কুড়াতে গিয়ে মাথায় দুটো আম পরেছিলো। বাড়িতে আসার পর তুমি আমার হাত ধরে আজকের মতোই জিজ্ঞেস করেছিলে কেমন লাগছে আব্বু? আজ কথাটা অনেক স্পষ্ট ভাবে বললে। কিন্তু সেদিন তোতলে বলেছিলে। হাহা! বহুদিন পর সেইদিনের কথা মনে পড়ে গেলো।’

বাবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাসলো রাজ। আফজাল শব্দ করে লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর রাজের হাতটা শক্ত করে ধরে বললো, ‘তোমরা দুইজনই আমার হীরা মানিক। চোখের মনি। অনেক কষ্টে বড় করেছি। এবার তোমাদের সুখটা দেখে ম/র/তে পারলেই বাঁচি।’

‘আশ্চর্য আব্বু। এভাবে বলছো কেন?’

কিছুটা বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলো রাজ। আফজাল কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললো, ‘রাজিবের জন্য চিন্তা নেই। কারণ তার জন্য আমি যোগ্য মেয়েই এনেছি। এবার তোমার বিয়ে দিতে পারলে চিন্তা মুক্ত হতাম আমি। ইদানীং শরিরটাও ভালো যাচ্ছে না। আমি চাই খুব শীঘ্রই তোমার বিয়ে দিতে। যদি তোমার কোনো পছন্দ থেকে থাকে তাহলে নির্দিধায় আমাকে বলতে পারো। আমরা মেনে নিবো। যদি না থাকে তাহলে বলো আমরা মেয়ে দেখবো।’

স্তব্ধ হয়ে গেল রাজ। বিস্ময়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে সে। এই মুহূর্তে এমন একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে সেটা তার কল্পনার বাহিরে ছিলো। কান দুটো তার বেজে উঠলো। আফজালের প্রশ্নের জবাবটা তার কাছে নেই। তাই বেশি না ভেবে সরাসরি বলে ফেললো, ‘এই ব্যাপারে পরেও আলাপ করা যাবে। যদি কেউ থাকে তাহলে তোমাকে জানাবো। আর ডক্টর কি মেডিসিন দিয়েছে?’

রাইমা উত্তর দিলো, ‘প্রেসক্রিপশন রাজিব নিয়ে গেছে। মেডিসিন নিয়ে আসবে।’

রাজ বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘ভাই আসলে প্রেসক্রিপশন টা আমাকে কষ্ট করে দেখাবেন একটু।’

রাইমা বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। রাজ আফজালের উদ্দেশ্যে বলল, ‘একটু বিশ্রাম নাও আব্বু। এইসব অহেতুক ব্যাপারে তোমাকে টেনশন করতে হবে না। ঘুমাও একটু।’

এইটুকু বলেই রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো রাজ। দীর্ঘশ্বাস ফেললো রাজের মা। চিন্তিত চেহারায় উদগ্রীব হয়ে বলে উঠলো, ‘ছেলেটার যে কি হয়েছে। এমনিতেও কথা কম বলে। তার উপর ইদানীং একটু বেশিই চুপচাপ থাকছে।’

আফজাল কথা বাড়ালো না। চুপচাপ চোখ বন্ধ করলো ঘুমানোর জন্য। রাইমা তার গায়ে কাথা টেনে দিয়ে এসির পাওয়ার কমিয়ে দিয়ে চুপচাপ রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো।
_____________________

পুরোটা দিন আকাশটা কালো মেঘে ঢাকা থাকার কারণে সূর্যের দেখা মেলেনি। তবুও সূর্য তার সময় মোতাবেক সন্ধ্যায় পশ্চিমাকাশে ডুব দিয়েছে। ধরনি করেছে অন্ধকারাচ্ছন্ন। ভারি বর্ষণের মাত্রা কমে এসে ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে চারপাশ মুখরিত। পড়ার টেবিলে বসে খাতায় কলম চালাচ্ছে নুরা।কিন্তু মনোযোগ ধরে রাখতে পারেনি। মোবাইলের কর্কষ ধ্বনি বেজে উঠলো। নুরা বিরক্ত না হয়ে মোবাইল হাতে নিলো। রাজের কল দেখে অবাক হলো ভীষণ। হঠাৎ কল দিল কেন লোকটা? সাতপাঁচ না ভেবে রিসিভ করে কানে দিতেই রাজের মোলায়েম কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো, ‘হ্যালো নুরা?’

লম্বা একটা নিশ্বাস নিলো নুরা। নিজেকে স্বাভাবিক করে জবাব দিলো, ‘জি?’

‘ব্যস্ত? কল দিয়ে বিরক্ত করলাম নাকি।’

‘নাহ। বিরক্ত হইনি।’

‘আসলে একটা জরুরি কথা ছিলো তোমার সাথে।’

এইটুকু বলে থামলো রাজ। প্রশ্নটা ঠিক কিভাবে করবে সেটা বুঝতে পারছে না। এতোক্ষণ বসে বসে মস্তিষ্কে সব প্রশ্ন সাজিয়ে নিলেও নুরার কণ্ঠস্বর শুনে সব আবারো গুলিয়ে গেছে। অস্বস্তিদায়ক অনুভূতির জন্য নিজেই নিজের উপর বিরক্ত হলো রাজ। তবুও নিজেকে সংযত রেখে বলেই ফেললো, ‘ভালোবাসো আমায়?’

রাজের থেকে হুট করে এমন অদ্ভুত প্রশ্ন শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেলো নুরা। কান থেকে মোবাইল নামিয়ে মোবাইলের স্কিনে একবার তাকালো। তারপর আবারো কানে দিয়ে বিস্মিত কন্ঠে পাল্টা প্রশ্ন করে উঠলো, ‘হুট করে এমন প্রশ্ন?’

‘উত্তর দাও প্লিজ। আই’ম সিরিয়াস।’ অস্থির হয়ে বললো রাজ। নিশ্বাস ক্রমশ ভারি হয়ে আসছে তার। বুকটা ধুকধুক করছে। হতবাক হয়ে গেলো নুরা। কোনো রকমে উত্তর দিলো, ‘হ্যাঁ ভালোবাসি। কিন্তু হঠাৎ এই কথা কেন?’

‘বিয়ে করবে আমায়?’

অবাক হয়ে গেলো নুরার। হৃদযন্ত্রটা ঢিপঢিপ করতে লাগলো। চোখের পলক পরা মুহূর্তেই বন্ধ হয়ে গেছে যেন। পরপর কয়েকবারই বিস্মিত হয়েছে সে। কিন্তু এখন সব চেয়ে বেশি। তাই প্রতিক্রিয়াহীন হয়ে পরেছে একদম।

নুরাকে বেশ কিছুক্ষণ যাবত চুপ থাকতে দেখে অস্থির হয়ে উঠলো রাজের মন। কলিজা কাঁপতে লাগলো। তাহলে কি রাজি না? নাকি নিরবতা সম্মতির লক্ষণ? কোনটা ধরে নিবে সে? অতিরিক্ত অস্থিরতার কারণে হার্টবিট ফাস্ট হয়ে গেলো তার। ঘেমে এলো কিছুটা। কপালে জমলো বিন্দু বিন্দু ঘামের কণা। বাম হাতের উলটো পিঠ দিয়ে ঠোঁটের উপরে থাকা ঘাম গুলো মুছে নিলো। অস্থির মনে আবারো উত্তর চাইলো, ‘নুরা? শুনতে পারছো? বিয়ে করবে আমায়?’

নুরা এখনো নিশ্চুপ। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। অতিরিক্ত বিস্মিত হবার কারণে এখনো বাকহারা সে। এতোদিন যাকে পাগলের মতো ভালোবেসেছে আজ সেই ব্যক্তিটার কাছে বিয়ের কথা শুনছে। অবাক নুরা। চোখে পানি চলে আসলো। ঠোঁট কামড়ে পানি আটকানোর চেষ্টা করতে লাগলো।

অস্থিরতা ধরে রাখতে না পেরে উঠে দাঁড়ালো রাজ। উত্তেজনার কারণে গলা শুকিয়্র কাঠ হয়ে গেছে। বিছানা থেকে একটু এগিয়ে স্টাডি টেবিল থেকে পানির বোতল হাতে নিয়ে ঢকঢক করে অর্ধেক বোতল পানি শেষ করে নিলো। টেবিলের সামনে থাকা চেয়ার টেনে বসে আবারো বলে উঠলো, ‘চুপ থেকো না প্লিজ। জাস্ট টেল মি দ্যাট ইউ ওয়ান্ট টু মেরি মি নুরা।’

চোখ বন্ধ করে ফেললো নুরা। লম্বা একটা নিশ্বাস নিয়ে মুচকি হাসলো নুরা। কিছুটা লাজুক কন্ঠে মিনমিন গলায় আলতোভাবে শুধাল, ‘ইয়েজ, আই ওয়ান্ট।’

এতোক্ষণে স্বস্তি পেলো রাজ। সকল প্রকার উত্তেজনা নিমিষেই গায়েব হয়ে গেলো। ঠোঁটে ফুটে এলো প্রাপ্তির হাসি। কিছুক্ষণ নিরব থেকে আমোদিত মনে বললো, ‘ওকে! গুড নাইট।’

নুরা প্রত্যুত্তর করার আগেই কল কেটে দিলো রাজ। খুশিতে বিছানায় গিয়ে দুই হাত দুই দিকে ছড়িয়ে ধপাস করে শুয়ে পরলো। ঠোঁটে তার এখনো আমোদিত হাসি। সিলিংয়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকালো। নুরার মিষ্টি চেহারা মনে আসতেই আরো পুলকিত হলো তার মন।
_____________________

সকালের নাস্তা রাইমা ও তার শাশুড়ি মিলে তৈরি করে নিলো। টেবিলে খাবার সার্ভ করেই রাইমা এক এক করে সবাইকে ডেকে আসলো। রাজিব ও রাজিবের বাবা আফজাল টেবিলে উপস্থিত হলো যথাসময়। কিন্তু আসলো না রাজ। তার অনুপস্থিতি দেখে আফজাল জিজ্ঞেস করলো, ‘রাজ কোথায়? ডাকো নি তাকে?’

রাইমা প্লেটে পরোটা দিতে দিতে উত্তর দিল, ‘জি বাবা ডেকছি। বললো আসছে।’

নাস্তায় মনোযোগ দিলো সবাই। সবার খানাদানা প্রায় অর্ধেক হয়ে যেতেই সেখানে উপস্থির হলো রাজ। চেয়ার টেনে বসলো না। বরং এক পাশে দাঁড়িয়ে বাবার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো, ‘বাবা তোমার সাথে জরুরি কথা আছে।’

আফজাল খেতে খেতে জবাব দিলো, ‘ঠিক আছে।আগে নাস্তা করো তারপর কথা বলবো।’

‘না। আমি এখুনি বলতে চাই।’

একরোখা রাজের দৃঢ় কণ্ঠস্বর। বাধ্য হয়ে আফজাল জানতে চাইলো। রাজ কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করলো। বুকে সাহস জমিয়ে জড়তা একপাশে রেখে বলেই ফেললো, ‘কাল জানতে চেয়েছিলে না আমি কাউকে পছন্দ করি কিনা?’

আফজাল মাথা নাড়িয়ে বললো, ‘হ্যাঁ। মেয়ে ও তার খানদানি ভালো হলে আমরা তার সাথেই তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করবো। এবার বলো কাকে পছন্দ করো তুমি?’

‘আব্বু আমি নুরাকে বিয়ে করতে চাই।’

রাজের শান্তস্বর শুনে উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে গেলো। চমকে উঠলো রাইমা। হাত থেকে তরকারির চামচ পরে গেলো তাৎক্ষনাৎ। বিস্মিত চোখেমুখে তাকিয়ে রইলো রাজের দিকে। রাজিব অবাক কন্ঠে জানতে চাইলো, ‘কোন নুরার কথা বলছিস তুই?’

জড়তাহীন গলায় উত্তর দিল রাজ, ‘ভাবির ছোট বোন নুরা।’

আফজাল বিজ্ঞ ব্যক্তিদের মতো ভ্রুঁ বাঁকা করে বলে উঠলো, ‘এটা কি শুধুই এক পাক্ষিক। নাকি নুরারও সম্মতি আছে?’

রাজ দৃঢ়তার সঙ্গে বললো, ‘অবশ্যই তার সম্মতি আছে এখানে। তোমার কি মনে হয় আমি জোর করে তাকে বিয়ে করবো?’

রাজিব ফের প্রশ্ন করলো, ‘নুরা তো তোর স্টুডেন্ট। কবে থেকে সম্পর্ক তোদের?’

রাজিবের দিকে শান্ত চোখে তাকালো রাজ। তার প্রশ্ন সম্পূর্ন উপেক্ষা করে আফজাল কে বললো, ‘আব্বু তুমি জানতে চেয়েছিলে তাই জানিয়েছি। বিয়ে করলে আমি নুরাকেই করবো। বাকিটা তোমার ইচ্ছা।’

কথাটা বলেই সোজা বাসা থেকে বেড়িয়ে গেলো রাজ। এতোকিছু বলার পরেও সবার সামনে খাওয়া সম্ভব না। তার থেকে ভালো বাহিরেই নাস্তা করে নেওয়া। টেবিলে উপস্থিত থাকা সকলেই বিস্মিত। একে অপরের দিকে অবাক চোখে তাকালো। আফজাল নিশ্চুপ। নিরবে নাস্তা খেতে লাগলো। মনে মনে সব পরিকল্পনা সাজাতে লাগলো সে।

চলমান…