আষাঢ়ে শ্রাবণের বর্ষণ পর্ব-৫৮

0
1272

#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির

[পর্ব-৫৮]

রাত্রীর দ্বিপ্রহর! স্বচ্ছন্দ আকাশে কালো মেঘ জেমেছে। অর্ধগোলকাকৃতি চাঁদটা আর দেখা যাচ্ছে না। কিয়ৎক্ষণ পরপর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বাতাসের মাত্রা প্রথমের তুলনায় দ্বিগুণ হয়ে এলো। এখুনি ধরনি কাঁপিয়ে বৃষ্টি আসবে। আবরার আর বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলো না। রুমে এসে বারান্দার দরজাটা লাগিয়ে বিছানার দিকে তাকালো। ঘুমন্ত দীবার মায়াবী মুখটা দেখে বিষণ্ণ মন মুহূর্তেই ভালো হয়ে গেলো। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে বিছানায় বসলো। দীবার মুখের উপর পরে থাকা চুল গুলো আলতো হাতে সরিয়ে দিলো। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে দীবার কথা গুলো আবারো ভাবতে লাগলো। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পরে উঠে দাঁড়ালো আবরার। দীবার গায়ে চাদড় টেনে দিয়ে চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
.

দরজায় টোকা পরার শব্দ কানে আসতেই ভ্রুঁ জোরা কুঁচকালো সাবিত। হাত ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো রাত প্রায় একটা বাজতে চললো। এতো রাতে আবার কার আগমন ঘটলো? ল্যাপটপ কোলে বসিয়ে বিছানার হেডসাইডে হেলান দিয়ে মনোযোগ দিয়ে কাজ করছিলো সাবিত। মাঝখানে মনোযোগের ব্যাঘাত ঘটায় বিরক্ত হলো বেশ। চোখমুখ কালো করে বিছানা থেকে নেমে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। দরজা খুলেই বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলো, ‘তোর আবার এখানে কি কাজ?’

‘ঘুমাচ্ছিলি নাকি?’ কথাটা বলে অনুমতি ব্যতিত রুমে ঢুকলো আবরার। এসেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। সাবিত রুমের দরজা লাগাতে লাগাতে বললো, ‘কি বলবি নাকি?’

আবরার সিলিংয়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে কোনো প্রকার ভণিতা না করে সরাসরি প্রশ্ন করলো, ‘রাজকে নিয়ে ভেবেছিস কিছু?’

সাবিত বিছানায় বসে ল্যাপটপ নিয়ে আবারো কাজে ব্যস্ত হয়ে জবাব দিলো, ‘ভাবার কি আছে এখানে।’

‘আমি রাজ আর নুরার সম্পর্ক মেনে নেওয়ার কথা বলছি। তোর কি মনে হয় রাজের সঙ্গে নুরার বিয়ে দেওয়া ঠিক হবে?’

সাবিত ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে আবরারের দিকে তাকালো। সাবলীল ভাবে নিজের মতামত পেশ করলো, ‘দেখ আবরার! তোর আর রাজের মাঝে কি ঝামেলা আমি জানি না। কি কারণে তোর রাজকে ভালো লাগে না তাও জানি না। কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে আমার চোখে রাজ অনেক ভালো ছেলে। নুরা যাকে ভালোবাসে তার সাথেই বিয়ে দেওয়া উচিত। আজ হোক কিংবা কাল নুরাকে কখনোই জোর করে বিয়ে দিতাম না। জীবনে ভালো থাকার জন্য অবশ্যই স্বামী স্ত্রী দুজনের মধ্যে ভালোবাসা থাকা দরকার। যেহেতু এখানে নুরা আর রাজ একে অপরকে ভালোবাসে। সেহেতু আমাদের রাজি না হওয়ার কোনো মানে হয় না।’

উঠে বসলো আবরার। ফ্লোরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ভাবলো কিছু একটা। সাবিত আড় চোখে আবরারের মতিগতি বুঝার চেষ্টা করছে। হঠাৎ মাঝরাতে এসে এই ব্যাপারে আলোচনা করছে কেন আবরার? কিছুটা অবাক হলেও প্রকাশ করলো না। আবরার একটু নড়েচড়ে বসে সাবিতকে সরাসরি প্রশ্ন করলো, ‘তার মানে তুই রাজি?’

সাবিত মাথা নাড়িয়ে স্পষ্ট বুঝালো সে রাজি। আবরার কিছু বললো না। ‘ঘুমা’ বলে সাবিতের রুমে থেকে বেরিয়ে গেলো। আবরার যেতেই সাবিত আবারো বিরক্ত হলো। পিছন থেকে চেঁচিয়ে উঠলো, ‘আশ্চর্য ভাই কাজ করতেছি। দরজাটা লাগিয়ে যা।’

কে শুনে কার কথা। আবরার দরজা খোলা রেখেই চলে গেলো। সাবিত মহা বিরক্ত ও রাগ নিয়ে উঠে গিয়ে দরজা লাগালো।
______________________

ক্যালেন্ডারের পাতায় শ্রাবণের বাইশতম দিন আজ। গতকাল রাতে ভারি বর্ষণের অবসান ঘটিয়ে মিষ্টি একটা ভোর আসলো। চারপাশে পাখি কিচিরমিচির করে ডাকছে। মৃদু শীতল বাতাস চারপাশে। বৃষ্টি আসার আগ মুহূর্তটা যেমন সুন্দর, ঠিক তেমনি বৃষ্টি শেষ হবার পরের মুহূর্তটাও মুগ্ধকর। বারান্দার ইজি চেয়ারে বসে সুন্দর ভোরটাকে উপভোগ করছে রোশান। প্রতিদিনকার রুটিনের মতোই দীবা আজও তাকে রঙ চা দিয়ে গেছে। চায়ের কাপে তৃপ্তা সহকারে ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছে আর স্নিগ্ধ ভোর উপভোগ করছে। তখুনি পিছন থেকে কারোর পায়ের শব্দ পেয়ে মাথা ঘুরিয়ে দেখলো রোশান। আবরারকে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে স্বাভাবিক ভাবে বললো, ‘দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো এখানে।’

আবরার এগিয়ে এসে রোশানের সামনে বেতের সোফায় বসলো। দুই হাতে কনুইয়ের ভর দিয়ে মাথাটা নিচু করে ভাবতে লাগলো। জড়তা কাজ করছে তার মনে। কিভাবে শুরু করবে বুঝতে পারছে না। আগে কখনো এমন গিল্টি ফিল হয়নি। বাবার প্রতি রাগ ক্ষোভ নিয়ে আস্তে ধীরে যে ঠিক কতোটা দূরে সরে গেছে সেটা এই মুহূর্তে টের পাচ্ছে আবরার। কিছুক্ষণ পরপর লম্বা একটা দম নিচ্ছে। নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না।

রোশান আবরারের দিকে বিজ্ঞ ব্যক্তিদের মতো করে তাকিয়ে থেকে চায়ের কাপে ছোট করে একটা চুমুক দিলো। কাপটা সামনের টি-টেবিলের উপর রেখে বললো, ‘যা বলতে চাও নির্দ্বিধায় বলতে পারো। আমি কিছু মনে করবো না।’

আবরার বাবার দিকে আড়ষ্টতার সঙ্গে তাকালো একবার। তারপর আবারো চোখের দৃষ্টি নত করে ইতস্তত করে বললো, ‘আসলে আব্বু.. মানে.. আমি… আপনাকে.. আব্..”

থমকে গেলো রোশান। বিস্ময়কর চোখেমুখে আবরারের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘কি বললে তুমি? আবার বলো তো।’

চোখ তুলে তাকালো আবরার। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো। জড়তা কাটিয়ে নরম গলায় বলেই ফেললো, ‘আব্বু আই’ম সরি।’

এতো বছর পর ছেলের কাছ থেকে আব্বু ডাক শুনে আবেগময় হয়ে গেলো রোশান। চোখ দুটো লাল হয়ে এলো। চোখের চশমা খুলে আবেগে ডুকরে কেঁদে উঠলো রোশান। হতবাক হয়ে গেলো আবরার। অস্থির হয়ে রোশানের সামনে হাটু গেড়ে বসে রোশানের এক হাত ধরে বলে উঠলো, ‘আব্বু কান্না করছো কেন? আব্বু? আমি সত্যি অনেক সরি। এতোদিন তোমার থেকে দূরে থেকে তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। আর কখনোই তোমাকে কষ্ট দিবো না। প্রমিস।’

রোশান এক হাতে চোখের পানি মুছে আবরার কে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে উঠলো। বাবার কান্নার কারণ বুঝলো আবরার। নিজেও জড়িয়ে ধরলো বাবাকে। চোখে পানি চলে আসলো তার। কিন্তু কাঁদলো না। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বাবাকে জড়িয়ে ধরেউ শান্ত করার চেষ্টা করলো।
.
বারান্দা থেকে কান্নার শব্দ পেয়ে অস্থির হয়ে ছুটে আসলো নিশিতা। বারান্দার দরজার কাছে এসে বাবা ছেলেকে এমতাবস্থায় দেখে নিজেও আবেগপ্রবণ হয়ে গেলো নিশিতা। শাড়ির আঁচল টেনে চোখের পানি মুছলো। দূর থেকেই বাবা ছেলের রাগ অভিমান মুছার দৃশ্য দেখলো। রিমির টপ শার্টের বোতাম ছিঁড়ে যাওয়ায় মায়ের কাছে এসেছিলো লাগাতে। কিন্তু বারান্দায় এমন দৃশ্য দেখে প্রচণ্ড খুশি হলো রিমি। নিশিতা কে জড়িয়ে ধরে ভাইকে দেখতে লাগলো। অভিমান ভাঙ্গার এতো সুন্দর একটা মুহূর্ত ক্যামেরা বন্দি না করলেই নয়। তাই রিমি দ্রুতই কয়েকটা ছবিটা তুলে মুহূর্তটাকে ক্যামেরা বন্দি করে ফেললো
___________________

শ্রাবণের তেইশতম দিন। গতকাল রাতেও মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সকালের আকাশটা একদম স্বচ্ছ নীল। কোথাও কোনো বিষণ্ণ কালো মেঘের ছায়া নেই। শুভ দিনের সূচনা যদি স্নিগ্ধ সুন্দর দিন দিয়ে শুরু হয়, তাহলে বোধহয় বাকি জীবনটাও ঠিক এমনি সুন্দর যাবে। যদিও ফিউচারে কি হবে সেটা কারোরই জানা নেই।

শান্তি নিবাসের সামনে গাড়ি থামালো ড্রাইভার। কাঁপা কাঁপা অসুস্থ শরির নিয়ে গাড়ি থেকে নামলো আফজাল। সঙ্গে পুরো পরিবার। আফজাল কে নামতে দেখেই রোশান হাস্যউজ্জ্বল চেহারায় এগিয়ে আসলো। খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে জড়িয়ে ধরলো প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে। সেইদিনের ঘটনার জন্য প্রথমেই মাফ চেয়ে নিলো। আফজাল পুরনো দিনের কথা মনে করে আজকের দিনটা খারাপ করতে চায় না। তাই প্রথমেই বারণ করলো যেন আগের কথা মনে না করে। সব ভুলে গিয়ে সুন্দর করে আরেকটা নতুন সম্পর্কে যেন এগিয়ে চলে। হাসলো রোশান। সম্মতি দিলো আফজালের কথায়। রাজ গাড়ি থেকে নেমে আফজালের হাত ধরলো। অপর পাশে রোশান। দুইজন খুবই সাবধানতার সঙ্গে আফজাল কে নিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকলো।

আফজালের পরিবারের লোকদের আসার খবর কেবল-ই কিছুক্ষণ আগে পেয়েছে তারা। সকালে হঠাৎ আবরার এসে বললো আফজাল তার পরিবার নিয়ে আসবে। যা আয়োজন করার এখুনি করে নিতে। এমন অদ্ভুত আলাপ শুনে প্রথমে বিস্মিত হলেও খুশিতে আত্মহারা হয়ে আয়োজন করতে লাগলো নিশিতা, আয়েশা ও রোহানা। এই আলাপ কি আর বড়দের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে? কথায় কথায় টের পেয়ে গেলো রিমি। দীবাকে নিয়ে নুরার রুমে গোপন বৈঠক বসালো। হঠাৎ করে আরব ভাইয়ের হলোটা কি? কালকের আগের দিনেও নুরাকে কলেজে যেতে দেয় নি। অথচ আজ বিয়ের আলাপ করতে রাজ স্যারের পরিবারের সবাইকে আমন্ত্রণ করলো? আশ্চর্য হয়ে আছে তারা।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ করে পরিবারের বড়রা মিলে পাশাপাশি বসে কথায় মশগুল হলো। আবরারও তাদের পাশে বসা। খুব বেশি কথা না বললেও ফাঁকেফাঁকে অল্পসল্প করে এটা ওটা বলে সবার কথার সম্মতি দিচ্ছে। তাকে সবার সঙ্গে বসে কথা বলতে দেখে আশ্চর্য বাড়ির লোকেরা। হুট করে হলো কি এই ছেলের?

এক হাতে শাড়ি অপর হাত কোমড়ে রেখে রাগী চেহারায় দাঁড়িয়ে আছে আয়েশা। মায়ের এমন চেহারা দেখে ভয়ে কাচুমুচু হয়ে বিছানাএ উপরে বসে আছে নুরা। কিছুতেই নিচে নামবে না সে। আড় চোখে আবারো মায়ের দিকে তাকালো। ভয়ে ভয়ে শুকনো ঢোক গিললো।

আয়েশা অধৈর্য হয়ে হাত থেকে শাড়িটা বিছানায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘এই মেয়ে আমার কলিজাটা আস্তো রাখলো না। আমি গেলাম!’

চলে গেলো আয়েশা। সে যেতেই নিশিতা চোখ পাকিয়ে তাকালো নুরার দিকে। কিছুটা শাসনের স্বরে বলে উঠলো, ‘তুই শাড়ি পরবি নাকি থা’প্প’ড় লাগাবো লাগে?’

নুরার অবস্থা এবার নাজেহাল। কাঁদুকাঁদু চেহারায় তাকিয়ে বললো, ‘প্লিজ বড়মা আমি শাড়ি পরবো না। আমার অনেক লজ্জা লাগছে।’

শব্দ করে বিদ্রূপাত্মক হাসি দিলো রিমি। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলে উঠলো, ‘বড়দের সামনে বিয়ে করবো বিয়ে করবো বলে চেঁচানো নির্লজ্জ মেয়েটা আজকে শাড়ি পরতে লজ্জা পাচ্ছে। ভাবতে পারছিস দীবা?’

দীবাও সঙ্গ দিলো নুরার। দাঁত কেলিয়ে বললো, ‘লজ্জাশরম তো দুইদিন আগেই খেয়ে ফেলছিস। এখন আর ঢং করতে হবে না। তাড়াতাড়ি শাড়ি পর সাজাবো আমরা।’

নুরা আবারো কাঁদুকাঁদু গলায় বললো, ‘আমি শাড়ি পরবো না।’

নিশিতা নিজেও অধৈর্য হয়ে ধমক দিয়ে বলে উঠলো, ‘তাহলে কি পরবি?’

নুরা কিছুটা উল্লাসকর কন্ঠে বলে উঠলো, ‘ ‘গত ঈদে যে লাল পাকিস্তানি সারারা কিনেছিলাম? ওটা পরি?’

আধঘণ্টা ধরে বুঝানো পরেও যখন এই মেয়ে শাড়ি পরবে না বলছে তখন আর জোরাজুরি করেও লাভ হবে না। তাই নিশিতা বাধ্য হয়ে সম্মতি দিলো। রিমি ও দীবার কাছে দায়িত্ব দিয়ে চলে গেলো। রিমি দীবা দায়িত্ব সহকারে নুরাকে সারারা পরিয়ে সাজিয়ে দিতে লাগলো।

সময় ঘনিয়ে আসলো। রোশানের কথামতো নুরাকে নিয়ে নিচে নামলো নিশিতা ও রিমি। লাল রঙ্গের সারারতে সুন্দর লাগছে নুরাকে। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার সময় সে দিকে তাকালো রাজ। নুরা ঘোমটা অবস্থায় দেখে মুগ্ধ হলো সে। পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। সঙ্গে বাসার বড়রা উপস্থিত থাকায় মন ভরে বেশিক্ষণ দেখতে পারলো না। চোখ ফিরিয়ে মেঝেতে তাকালো। আলতোভাবে একটা মুচকি হাসি দিলো রাজ।।

নুরাকে এনে পাশে বসানো হয়েছে। লজ্জায় নুরা পারে না মাটির নিচে চলে যেতে। আশ্চর্য তার এতো লজ্জা লাগছে কেন? রাজের মা নুরার পাশে বসে নুরার হাতে স্বর্ণের চুড়ি পরিয়ে দিলো। গলায় ও কানে নিজের পছন্দের জুয়েলারি গুলো পরিয়ে দিলো। নুরার গালে এক হাত রেখে মন ভরে দোয়া করলো। অবশেষে একটা কাপল ডায়মন্ডের আংটির বক্স বের করলো। সেখান থেকে একটা আংটি নিয়ে রাজকে দিয়ে নুরাকে পরিয়ে দিতে বললো। রাজ আংটিটা নিয়ে নুরার বাম হাত ধরে অনামিকা আঙ্গুলে পরিয়ে দিলো। অন্য আংটিটা নুরাকে দিলে নুরাও রাজের আঙ্গুলে পরিয়ে দিলো। সবাই খুশিতে হাত দিলো। একে অপরকে মিষ্টি খাইয়ে দিলো। পিছন থেকে রিমি ও দীবা নুরাকে জরিয়ে ধরে শুভেচ্ছা জানালো। নুরা এখনো লজ্জায় লাল হয়ে আছে। চোখ তুলে একবারো রাজের দিকে তাকায় নি।

আংটি পড়ানো শেষে নুরাকে উপরে যেতে বললে দীবা ও রিমি মিলে উপরে চলে গেলো। এবারের পর্ব হচ্ছে বিয়ের সময়, দিনতারিখ ঠিক করার। আবরার ও সাবিত তার বোনের বিয়ে বড় করেই দিতে চেয়েছে। কিন্তু রাজ সেটা মানলো না। সে ছোট করে পরিবারের লোকদের নিয়েই আয়োজন করতে চেয়েছে। সে এতো বড় অনুষ্ঠানে নিজেকে কিছুতেই কমফোর্টেবল না। বিয়েটা যেহেতু তার মাতামাতি নিশ্চয় তাকে নিয়েই হবে। সবার সামনে তাকেই উপস্থিত থাকতে হবে। বিরাট অস্বস্তিকর ব্যাপারস্যাপার। রাজ কিছুতেই বড় অনুষ্ঠানে রাজি না। রাজ কেমন প্রকৃতির ছেলে সেটা তার বাড়ির সবাই জানে। তাই এক পর্যায়ে রাজের পরিবার মানলো। নুরার পরিবারের সবাইকে বুঝালো রাজের অস্বস্তির কারণ। প্রথমে মানতে না চাইলেও অবশেষে মেনে নিতেই হলো সবার। বিয়ের দিনতারিখ ঠিক করা হলো শ্রাবণ মাসের শেষ দিন।

অতঃপর সন্ধ্যে নামার আগেই আলোচনার সমাপ্তি ঘটালো সবাই। একে অপরের থেকে বিদায় নিয়ে বেরুলো বাড়ি থেকে। শান্তি নিবাসের সামনেই গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিলো ড্রাইভার। সবাই বিদায় নিয়ে ধীরেসুস্থে গাড়িতে উঠলো। রাজ সামনের সিটে বসার জন্য গাড়ির দরজা খুললো। বসার আগে মাথা তুলে বাড়ির দুতলায় তাকালে আবরারকে সেখানে দেখতে পেলো। বিনিময়ে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে মুচকি একটা হাসি উপহার দিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। গাড়ি চোখের আড়াল হতেই আবরার নিজেও মৃদু হাসি দিলো একটা। মনে করলো গতকাল রাতের কথা।

দীবাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আগ্রাবাদ থেকে দূরে ফাঁকা একটা জায়গায় গেছে আবরার। জায়গাটা বালুর স্তুব দিয়ে চারপাশ ভরাট করে রাখা হয়েছে। দূরে একটা চায়ের দোকান দেখতে পেলো আবরার। সেখানে বোধহয় ফুচকা, ঝালমুড়ি বিক্রি করা হয়। আকাশ মেঘলা। বৃষ্টি আসবে আসবে অবস্থা। বাতাসের মাত্রা তুলনামূলকের চেয়ে একটু বেশি। তাই বোধহয় এতো সুন্দর জায়গাটা জনমানবশূন্য হয়ে পরেছে। অনেকটা সময় অপেক্ষা করার পর সেখানে উপস্থিত হলো রাজ। গাড়ি একপাশে থামিয়ে আবরারের পাশে এসে বসলো। দুইজনই বালু মাটির উপরে থাকা ইটের উপরে বসে আছে। নিশ্চুপ দুজন। চুপচাপ বসে আকাশের মেঘেদের ডাক কর্ণপাত করছে।

‘তুমি কি নুরাকে সত্যি ভালোবাসো?’

হঠাৎ আবরারের প্রশ্ন শুনে আলতোভাবে হাসলো রাজ। সে এমন সব প্রশ্নের সম্মুখ হবার জন্য পূর্বপ্রস্তুতি নিয়েই এসেছে। জবাব দিলো, ‘কোনো সন্দেহ আছে?’

‘অবশ্যই আছে। কিছুদিন আগে ফটিকছড়িতে থাকতে আমায় বলেছিলে দীবার কাছাকাছি আসতে যা করার সব করবে। তাহলে এবার বলো সন্দেহ থাকবে না কেন আমার?’

আবরারের কাটকাট গলার কথা শুনে স্থির হলো রাজ। চোখ তুলে সামনে তাকিয়ে বললো, ‘তখন পরিস্থিতিটা ভিন্ন ছিলো। দীবা যে তোমার স্ত্রী সেটা সময়ের সঙ্গে মেনে নিয়েছি। আমি কোনো ইমম্যেচিউর বাচ্চা না যে কারোর জিনিস পছন্দ হয়ে কান্নাকাটি করে নিজের করে নিবো।’

অল্প শব্দ তুলে হাসলো আবরার। প্রতিক্রিয়া দেখালো না। রাজ কিছুক্ষণ নিরব থেকে আবারো স্মৃতিচারণ করে বলতে লাগলো, ‘আমি অনেক চুপচাপ স্বভাবের। কখনো বন্ধুদের আড্ডা দেওয়া, স্কুলকলেজ ফাঁকি দেওয়া, বড় বড় কোনো অকেশনে উপস্থিত থাকা এইসব আমার দ্বারা হতো না। আমি একা একা থাকতে পছন্দ করতাম। একদিন ফ্রেন্ডের জোরাজুরিতে রাউজানের বৈশাখী মেলায় গেলাম। সেখানে শাড়ি পরা এক মেয়ের দেখা পেলাম। খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলাম মেয়েটা আমাদের এলাকাতেই থাকে। পাগলামি বেড়ে গেলো। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম সবসময়। ভেবেছিলাম এটা হয়তো আবেগ সময়ের সাথে চলে যাবে। কিন্তু দিন যতো গেলো, সেই অনুভূতি দিনদিন গভীর হলো। গ্র‍্যাজুয়েট শেষে আব্বু ইউকে যেতে বলেছিলো কিন্তু আমি যাই নি। বহু কষ্টে মেয়েটার কলেজের সহকারী শিক্ষক হয়ে নিয়োগ দিলাম। ক্লাস করানোর ফাঁকেফাঁকে তাকে দেখতাম। সামনে এইসএসসি পরিক্ষা! ভেবেছিলাম পরিক্ষা শেষেই পরিবারিক ভাবে বিয়ে করবো। মেয়েটা কে হালাল ভাবে আমার করবো। হঠাৎ আব্বুর কাছ থেকে যখন জানতে পেরেছিলাম সে আর আমার নেই। তখুনি দুনিয়াটা সেখানেই থমকে গিয়েছিল আমার। মেনে নিতে কষ্ট হয়েছিল। কেঁদেছিলাম সেদিন। প্রচুর কেঁদেছিলাম! জীবনে খুব বেশি কিছু চাইনি আমি। শুধু তাকেই চেয়েছিলাম। লুকিয়ে ভালোবেসেছিলাম। আর এটাই ছিলো আমার সব চেয়ে বড় ভুল। আমি যদি আগেই তাকে জানিয়ে দিতাম তাহলে এতো কষ্ট আমাকে সহ্য করতে হতো না।’

এইটুকু বলে থামলো রাজ। কথা গুলো বলতে কষ্ট হয়েছে ভীষণ। বারবার আটকে আসছিলো কণ্ঠস্বর। তবুও কষ্টে জর্জরিত হয়ে এতোটুকু বলে করলো। এরই মাঝে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পরা শুরু করেছে। বৃষ্টির শীতল ফোটা ভিজিয়ে দিলো দুজনকে। বৃষ্টির পানি মাথার চুল থেকে ঝরে চিবুক বেয়ে পরছে। ঠোঁটে ঠোঁট চিপে চোখ বন্ধ করে নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করলো। কথায় আছে পুরুষ মানুষের কাঁদতে নেই। তাই হয়তো অসময়ের বৃষ্টিটা বোধহয় অসহায় রাজের সঙ্গ দিলো। লাল হয়ে আসা চোখের পানি গুলো বৃষ্টির পানির সঙ্গে মুছে নিলো। কিন্তু পাশে বসে থাকা আবরারের নজর এড়ালো না। রাজ ঠিক কতটা কষ্টস্বীকার করে কথাগুলো বলছে সেটা অনুভব করতে পারছে আবরার। অদ্ভুত ব্যাপার হলো অন্যান্য দিনের মতো আজ রাগ হচ্ছে না তার। হবেই বা কেন? এখানে রাজের কোনো দোষ নেই। ভালোবাসার ক্ষেত্রে প্রতিটা মানুষই স্বাধীন। প্রত্যেক মানুষই ভালোবাসার অধিকার আছে। রাজও নাহয় দীবাকে ভালোবেসেছিলো। কিন্তু পরিস্থিতি ও তকদিরের খাতিরে আজ দীবা তার স্ত্রী।

চলমান…