#আষাঢ়ে_প্রণয়_সন্ধি
#লেখিকা:#ইশা_আহমেদ
#পর্ব_১৭
তপ্ত দুপুর।শহর তলীর মানুষ ব্যস্ত সময় পার করছে।সাজিয়া রান্না শেষ করে মাত্র গোসলে ঢুকেছে। নিশীথকে রুমের কোথাও দেখেনি সাজিয়া। জান্নাত ইসলামের সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। রান্না দু’জন মিলেই সেরেছে। জান্নাত ইসলাম মহিলাটি বেশ ভালো এবং বন্ধুত্বপূর্ণ। বিয়ের পর দিন থেকেই খুব সুন্দর করে সাজিয়াকে বুঝিয়ে দেন সব কিছু। সাজিয়া মুগ্ধ হয় মহিলার কাজে। গোসল সেরে শাড়ি পরে বের হয় সাজিয়া। গামছা বারান্দায় নেড়ে রুমে আসতেই নিশীথকে চোখে পরে তার। মৃদু হাসে সে। নিশীথের সাথে তার সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে। তার বন্ধু।খুব ভালো বন্ধু দু’জন। দু’জন দু’জনকে জানার চেষ্টা করছে,বোঝার চেষ্টা করে চলেছে।
এই যে তারা দু’জন রাত হলে এক সাথে বসে খায়,চন্দ্রবিলাশ করে।গল্প করে অনেক। নিশীথ সাজিয়াকে দেখে একটু চমকায়। এই রূপ সে প্রথম দেখছে তা নয়। আগেও দু একবার দেখেছে। তবে আজ একটু অস্বস্তি হচ্ছে। ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছে সাজিয়ার ভেজা চুলগুলো। কি মুশকিলে পরলো সে। এতো গাঢ় অনুভূতি কখনো হয়নি তার। আজই প্রথম হচ্ছে। সে ধীর পায়ে হেঁটে সাজিয়ার পেছনে এসে দাঁড়ায়। সাজিয়া আয়নায় নিশীথকে দেখে চমকে উঠে। নিশীথ চুলের দিকে তাকিয়ে বলল,
“সাজিয়া আমার এক অদ্ভুত সুপ্ত বাসনা ঝেঁকে ধরেছে। এমন অনুভূতি আমার আগে কখনো হয়নি। তোমাকে ছুঁয়ে দেখার বাসনা জেগেছে। যদিও তা অন্যায় তবে কি হচ্ছে আমার ভেতর তোমায় ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছে প্রবল হচ্ছে”
সাজিয়া হতভম্ব হয়ে গিয়েছে। এমন কথা কেনো বললো নিশীথ তাকে। শিউরে ওঠে সে। শরীর কাঁপছে। বিগত কয়েক দিনে তো নিশীথ এমন নিষিদ্ধ আবদার করেনি তবে আজ কেনো। যদিও সাজিয়া জানে নিজের বৈধ নারীকে দেখলে পুরুষের নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে কষ্ট তবুও এমন আবদার যেনো তার জন্য বিরাট অস্বস্তিকর।
“নিশীথ আপনি কি বলছেন এসব?”
নিশীথের ঘোর কাটলো। সে পেছন ফিরে গেলো দ্রুত। সাজিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,“সাজিয়া এ রূপে আমার সামনে এসো না দয়া করে। আমিও পুরুষ নিজের বৈধ নারীকে এমন রূপে দেখার পর নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা আমার নেই। তুমি এখন থেকে সালোয়ার কামিজ পরো। না হয় আমি ভুল কিছু করে বসবো”
“আমি বুঝেছি। আপনি চাইলে আমায় জড়িয়ে ধরতে পারেন”
সাজিয়ার একটু অস্বস্তি হচ্ছিল বলতে তবে নিশীথের দিকটাও ভেবেছে সে। তারও বড্ড লোভ জেগেছে নিশীথের শক্ত পোক্ত বুকে মাথা রাখার।তাই বলেই দিলো নিজের ব্যক্তিগত পুরুষটিকে কথাটি। নিশীথ সামনে ঘুরে জড়িয়ে ধরলো তার প্রিয় নারীকে। সাজিয়াও পরম শান্তিতে সে বুকে মাথা রাখলো।বেশ কিছুক্ষণ কাটলো সেভাবে দু’জনেরই বেশ ভালো লাগছে। নিশীথ হুট করে ছেড়ে দিলো তাকে।
“আমি হয়তো তোমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছি সাজিয়া”
নিশীথের কন্ঠে কিছু একটা ছিলো হয়তো। সাজিয়া দূরে সরে আসে। নিশীথের দিকে তাকাতেই দেখলো লোকটি তার দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখে চোখ পরলো। লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলো সে ছুটে বের হয়ে গেলো রুম থেকে। নিশীথ মুচকি হেসে বিড়বিড় করে শুধালো,,,
“রাঙা বউ আমার। তোমার লজ্জায় রাঙা হতে দেখলে আমার ভালো, অপূর্ব ভালো।”
দুপুরে খাবার খেতে বসেছে পরিবারের তিন সদস্য। জান্নাত ইসলাম ছেলে মেয়েদের মনোভাব দেখে কিছু আন্দাজ করলেন। তারা সম্পর্ক উন্নতি করতে চাইছে। এটাই অনেক। সাজিয়ার লজ্জায় রাঙা মুখটি দেখে অতীতের বেশ কিছু কথা মনে পরলো তার। যদিও সেই লোকটি নেই অনেক বছর হলো। বিয়ের প্রথম প্রথম কি দুষ্টমিটাই না করতো লোকটা। নিজ স্বামীর কথা মনে পরতেই মনটা বিষন্নটায় ছেয়ে গেলো।কোনো মতে খেয়ে উঠে গেলেন তিনি। সাজিয়ার নিশীথের দিকে তাকাতেও লজ্জা লাগছে। এ কোন পরিস্থিতি পরলো সে।
“সাজিয়া তোমার কি অস্বস্থি হচ্ছে?”
সাজিয়া মাথা নাড়ায়। নিশীথ হেসে শুধায়,,,“আমি দুঃখিত তখনকার বিষয়ের জন্য। নিজেকে স্বাভাবিক করো। আড আজ তুমি বের হচ্ছো আমার সাথে”
“আজ!কোথায় যাবো আজ আমরা?”
“প্রথমে তুমি চিত্রার সাথে তোমাদের ভার্সিটির অনুষ্ঠানে যাবে। অতঃপর আমি আষাঢ়কে নিয়ে সেখানে যাবো। সেখান থেকে আমি তুমি ঘুরতে বের হবো বুঝেছো?”
সাজিয়া বিষয়টি বুঝতে পেরে মাথা নাড়ায়। নিশীথ চাইছিলো আষাঢ় এবং চিত্রাকে এক সাথে কিছু সময় কাটাতে দিতে। অবশ্য তারা দু’জন ও এতে সময় কাটাতে পারবে। খাওয়া শেষ হতেই নিশীথ উঠে চলে গেলো। সাজিয়া নিজের খাওয়া শেষ করে সব গোছানো শুরু করলো। তার ভেতরে নিশীথ আবারও এসে হাজির। নিশীথ এসে সাজিয়ার হাতে হাতে সব গুছিয়ে দিলো। যদিও সাজিয়া বারণ করেছিলো তবে নিশীথ শুনেনি। উত্তরে বলেছে ‘আমি আমার বন্ধুকে সাহায্য করছি তোমার করি’।সাজিয়া আর কিছু বলতে পারিনি।
–
খাওয়া শেষ করে মাত্র রুমে এসে বসেছে চিত্রা। আলমারি থেকে একটা লাল মেরুন রঙা শাড়ি বের করলো। শাড়িতে আবার সাদা রঙের কিছু ডিজাইন করা আছে।দেখতে বেশ সুন্দর। সে এক সময় এসবে অনেক আগ্রহী ছিলো তবে সেই চঞ্চল চিত্রাকে সে অনেক আগেই নিজ হাতে দাফন করেছে হৃদয়ের গহীনে। এখনকার চিত্রা কঠোর,শক্ত,রাগচটা। চিত্রার ফোন বেজে উঠলো। মুঠোফোনটি চোখের সামনে ধরতেই সাজিয়া নামটা জ্বলজ্বল করে উঠলো।
“হ্যালো চিত্রা কেমন আছিস?”
“ভালোই আছি তুই কেমন আছিস?”
“নিশীথ এবং আম্মু আমাকে খারাপ থাকতে দিলো কোথায়। তারা প্রচুর ভালো চিত্রা। সব পুরুষ খারাপ নয় চিত্রা। তোরও এবার একজন যোগ্য ব্যক্তিকে বিশ্বাস করে দেখা উচিত।”
“সবাই কি আর তোর নিশীথ সাহেবের মতো সাজিয়া। নিশীথ সাহেব হাজারে একজন যাকে পাওয়া দুষ্কর। তাকে ভালোবেসে আগলে রাখিস। হয়তো সে বিশ্বাস ভাঙবে না। আমাট মতো অবস্থা যেনো তোর না হয়।”
সাজিয়া কিছুটা রাগি কন্ঠে শুধালো,,,“তোর অতীত না টানলে হয় না। বাজে মানুষদের কেনো মনে রাখিস। ওসব কথা ভুলে যা চিত্রা”
“আমি ভুলতে পারি না সাজিয়া। স্বপ্নেও আমায় তাড়া করে বেড়ায় সেই অতীত। আমার পিছু ছাড়ছে না। কি করবো আমি”
সাজিয়া সাহস যুগিয়ে বলল,,,“তোর কি একবার মনে হয় না কাউকে সুযোগ দেওয়া উচিত। আষ….আষাঢ় ভাইয়াকে একবার সুযোগ দিয়েই দেখ না। বিশ্বাস সব পুরুষ ভাঙে না। কিছু পুরুষ তা যত্নে আগলে রাখে”
“সে হয়তো একজন ভালো ব্যক্তি। তবে আমার পক্ষে এতোটাও সহজ নয় নতুন করে কাউকে বিশ্বাস করা”
“হু জানি আমি। তবে চেষ্টা করে দেখতে পারিস”
“বাদ দে তাড়াতাড়ি চলে আসিস। ভার্সিটিতে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে নিশীথ সাহেব তোকে?”
“হুম আম্মু বা নিশীথ কেউই আমাকে মানা করেনি পড়াশোনা করতে। তারা বলেছেন আমি যেনো পড়াশোনা শেষ করি। দুজনই খুব সাপোর্ট করে আমাকে চিত্রা। আমার এখন আফসোস নেই কিছুতেই। দুজন অসম্ভব ভালো মানুষ আমার জীবনে এসেছেন।আমি সুখী চিত্রা।”
“আমি খুশি হয়েছি সাজিয়া। দ্রুত চলে আসিস”
চিত্রা টুং করে কল কেটে দিলো। সাজিয়ার কথাটা মাথায় ঘুরঘুর করছে। আষাঢ় নিসন্দেহে একজন ভালো মানুষ তবে বিশ্বাস চিত্রা এখনো করে উঠতে পারছে না। দ্বিতীয়বার বিশ্বাস ভাঙলে সে নিজেকে ঠিক রাখতে পারবে না। নিজেকে অনেক কষ্ট করে এমন বানিয়েছে। আবারও কারো কাছে নিজের দুর্বলতা দেখিয়ে নিজেকে দুর্বল করার ইচ্ছে বা শক্তি তার নেই। প্রেম তো তার জীবনেও এসেছিলো। সেই বাজে অনুভূতির কথা সে জানাতে চায় না কাউকে। অতীত মনে করতে চায় না সে। সেই দিনগুলোর কথা মনে আসলেই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে চিত্রার। ভয়ানক সেই দিনগুলি। যদিও সে বের হয়ে এসেছে সে সব থেকে।তবুও ভয়টা এখনো হৃদয়ের গহীনে রয়ে গিয়েছে।
–
চিত্রা তৈরি হওয়ার জন্য একটা শাড়ি বের করলো। আজ বহু বছর পর তার শাড়ি পরে ঘুরতে যেতে ইচ্ছে করছে। নিজেকে রাঙাতে ইচ্ছে করছে। মেরুন রঙা শাড়িটা গায়ে জড়ালো চিত্রা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে নিজেকে। সেলোয়ার-কামিজ সে তো প্রতিদিনই পরে তবে আজ বহু বছর পর গায়ে শাড়ি জড়িয়েছে।একসময় এগুলোর জন্য সে পা*গ*ল ছিলো। সেসব মনে পরতেই মাথা যন্ত্রণা করলো চিত্রার। মাথা চেপে ধরে বিছানায় বসে পরলো। আরমান সাহেব মেয়েকে কিছু কথা বলতে আসছিলেন। চিত্রার রুম থেকে মৃদু চিৎকারের শব্দে তিনি দ্রুত প্রবেশ করেন রুমে।
মেয়েকে আজ এতো বছর পর এরূপে দেখে একটু বিষ্মিত হলেন। দ্রুত এগিয়ে আসলেন মেয়ের কাছে। পাশে বসতেই চিত্রা আব্বুকে দেখলো ঝাপটে ধরলো সে নিজের আব্বুকে। আরমান সাহেব মেয়েকে শান্ত করার চেষ্টা চালালেন।চিত্রা বেশ কিছুক্ষণ পর একটু শান্ত হলো।আরমান সাহেব নরম কন্ঠ শুধালেন,,,
“আম্মা তোমার কি হয়েছে?মাথা যন্ত্রণা করছে? ওষুধ খেয়েছো তুমি? শান্ত হওয়ার চেষ্টা করো। কিছু হয়নি।”
“আব্বু আমার আগের সব কথা মনে পরেছে। অতীত আমায় এখনো কষ্ট দেয় আব্বু। আমি কি করে এর থেকে মুক্তি পাবো বলো তো। আমি পারছি না আর”
“কিছু হয়নি আম্মা তুমি এসব মনে করো না। তুমি শাড়িই বা কেনো পরতে গেলো।”
“আমি চাইছিলাম আগের স্মৃতি গুলো ভুলতে। আজ অনেক বছর পর শাড়ি পড়লাম আব্বু। আজ খুব ইচ্ছে করছিলো কেনো জানি শাড়ি পরতে তাই পরলাম।”
“ এখন ঠিক আছো আম্মা”
চিত্রা মাথা নাড়ায়। আরমান সাহেব মেয়েকে শান্ত করে রুম ত্যাগ করেন। কি বলতে এসেছিলেন তা বলা হলো না আর। চিত্রা আজ আপন মনে সাজলো। বেশ লাগছে তাকে। মরিয়ম সুলতানা পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে মেয়ের সৌন্দর্য দেখলেন চোখ ভরে। তার মেয়েকে আজ একটু স্বাভাবিক লাগছে। আঁচলে মুখ চেপে কেঁদে উঠলেন তিনি।অনেক গুলো বছর পর মেয়েটাকে এমন দেখছেন। মনের ভেতর শান্তি লাগছে।
#চলবে~