#আষাঢ়ে_প্রণয়_সন্ধি
#লেখিকা:#ইশা_আহমেদ
#পর্ব_১৯
রাঙা গোধুলি উপভোগ করছে সাজিয়া। তার পাশেই হাঁটছে নিশীথ। কিছুক্ষণ হলো তারা দু’জন ভার্সিটির এরিয়া থেকে বের হয়েছে। রাস্তায় কিনারা ঘেষে হাঁটছে দু’জন। শতশত লোক রিকশায় করে ঘুরে বেরাচ্ছে। কেউবা হাতে হাত রেখে হেঁটে যাচ্ছে। নিশীথ আশেপাশে তাকিয়ে ভাবছে কোথায় যাবে সে এখন সাজিয়াকে নিয়ে! নিশীথ কিছু একটা মনে করে মৃদু হাসে। সাজিয়া মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে। হঠাৎ হাতে কারো স্পর্শ পেলো সাজিয়া। নিশীথের দিকে তাকাতেই দেখলো নিশীথও চেয়ে আছে তার পানে। সাজিয়া চোখ নামিয়ে নেয়।নিশীথ মুচকি হেসে শক্ত করে চেপে ধরে সাজিয়ার হাত।
“আমরা কোথায় যাচ্ছি নিশীথ?”
“মেলায়! যাবে?”
সাজিয়া মাথা নাড়ায়। নিশীথ রিকশা ডেকে সাজিয়াকে নিয়ে চড়ে বসে রিকশায়। আজ আর নিশীথ দূরে সরে বসেনি। সাজিয়ার কাছ ঘেঁষে বসেছে। হুড তোলা রিকশায় চড়ে শহরের সৌন্দর্য উপভোগ করছে সাজিয়া।নিশীথও উপভোগ করছে সব কিছু। প্রিয় নারীকে নিয়ে শহর ঘুরে দেখার আনন্দ বলে বোঝানো সম্ভব নয়।মেলার গেটের সামনে এসে রিকশা থামলো। নিশীথ নেমে সাবধানে সাজিয়াকে নামালো। সাজিয়া মৃদু হাসলো। তার শাড়ি পড়ার অভ্যাস নেই ঠিকই তবে নিজেকে সামলাতে জানে সে। নিশীথের যত্ন দেখে মনে প্রশান্তির ঢেউ বয়ে গেলো।
নিশীথ ভাড়া মিটিয়ে সাজিয়ার হাতটি শক্ত করে ধরে পা বাড়ালো মেলার উদ্দেশ্যে।তখনই একটা দশ বারো বছরের মেয়ে এসে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,,
“ভাইজান এই বেলী ফুলডা নেন। আপার খোঁপায় পড়াইলে সুন্দর লাগবো”
নিশীথ মৃদু হেসে বেলী ফুলের গাজরাটা হাতে নিলো। পাঞ্জাবির পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে একশো টাকার একটা নোট মেয়েটিকে ধরিয়ে দিয়ে বলল,,,,
“ফেরত দেওয়ার প্রয়োজন নেই। বাকিটা রাখো তুমি”
মেয়েটি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ হেসে চলে গেলো। সাজিয়া মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে পর্যবেক্ষণ করছিলো সব। নিশীথ সাজিয়ার দিকে ঘুরে গাজরাটা খোপায় পড়িয়ে দেয়।সাজিয়া মুগ্ধ চোখে দেখছে মানুষটাকে। মানুষটা ভীষণ যত্নশীল। বিয়ের পর থেকে তার সব সুবিধা অসুবিধায় খেয়াল রাখে, কখন কি প্রয়োজন তা জানতে চায়। সুখী থাকার জন্য আর কি প্রয়োজন। একজন মনের মতো মানুষ থাকলে আর কিছুর প্রয়োজন নেই। দু’জন হাত শক্ত করে চেপে মেলায় প্রবেশ করলো।ঘুরলো দু’জন বেশ কিছুক্ষণ। এরপর চুড়ির দোকানে আসলো নিশীথ। সেখান থেকে এক সেট চুড়ি হাতে নিলো। সাজিয়াকে পরিয়ে দিয়ে বলল,,
“তোমার হাতে বেশ মানিয়েছে চুড়িগুলো”
সাজিয়া লাজুক হাসলো। নিশীথ দাম মিটিয়ে ফুসকার দোকানে আসলো। সে জানে সাজিয়া কখনোই নিজ থেকে কিছু বলবে না তাই নিজেই নিয়ে আসলো।দু প্লেট ফুসকা ওর্ডার দিলো।ফুসকা আসতেই দু’জন খাওয়া শুরু করলো। সাজিয়া আপন মনে খেয়ে চলেছে আর নিশীথ তা দেখছে।
–
ভার্সিটির পেছনের লেকের দিকটায় বসে আছে চিত্রা। আর তার থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে বসে আছে আষাঢ়। নিশীথ অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে সাজিয়াকে নিয়ে গিয়েছে। আষাঢ়কেও চিত্রা চলে যেতে বলেছিলো তবে সে যায়নি। যাবেই বা কেনো? সে তো এসেছেই চিত্রা নামক রমনীর সাথে কিছুটা সময় কাটানোর জন্য।চিত্রা লেকের পানির দিকে তাকিয়ে বলল,,,
“আষাঢ় সাহেব আপনি থেকে গেলেন যে?ওদের সাথে চলে যেতে পারতেন!”
“চিত্রা আপনি কি বোকা? ওদের নতুন বিয়ে হয়েছে আমি কিভাবে যেতাম?
“হু তাও এক কথা। আচ্ছা আষাঢ় সাহেব আপনি কি কাউকে ভালোবেসেছেন কখনো? প্রেম করেছেন জীবনে?”
আষাঢ় চমকে উঠে। চিত্রার থেকে এই সময়ে এমন প্রশ্ন সে আশা করেনি। চিত্রা বুঝলো বোধহয়। হাসলো সে তবে দৃষ্টি তার এখনো লেকের পানির দিকে। আষাঢ়ের দিকে ভুল করেও তাকাচ্ছে না সে। চিত্রা আষাঢ়কে উদ্দেশ্য করে বলে,,,
“কিছু মনে করবেন না আষাঢ় সাহেব। হুট করেই বলে ফেলেছি”
“আমি কিছু মনে করিনি। প্রেম এসেছে জীবনে। ভালোও বাডি আমি এক নারীকে। সেই আমার প্রথম ভালোবাসা তবে প্রথম প্রেম নয়। সে হবে আমার দ্বিতীয় প্রেম। তাকে পাওয়ার জন্য আমি দিন রাত ছটফট করে চলেছি”
“ভাগ্যে থাকলে পেয়ে যাবেন।”
“চিত্রা আমার সেদিনের উত্তরটা?”
“কোন উত্তর আষাঢ় সাহেব?”
“বন্ধু হওয়ার ব্যাপারটা? বিশ্বাস করে বন্ধুত্বের হাতটা বাড়ান আমি শেষ নিঃশ্বাস অব্দি বিশ্বাস ভাঙবো না”
চিত্রা কি মনে করে উত্তর দিলো,,,“ঠিক আছে বন্ধু আমরা। তবে আমি চাই আমাদের কথা খুব কমই যেনো হয়। গভীর বন্ধুত্ব করা আমার পক্ষে সম্ভব না”
“ঠিক আছে। আমার সমস্যা নেই চিত্রা। বন্ধুত্ব বিষয়টা অনেক সুন্দর।”
–
সমুদ্র নিজের রুমে বসে গেমস খেলছে। হঠাৎই তার মা সুমি বেগম রুমে প্রবেশ করলেন। সমুদ্র মাকে দেখলো তবে কথা বললো না। নিজের কাজে ব্যস্ত থাকলো। সুমি বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এই ছেলে ছোট থেকেই এমন। তিনি সমুদ্রকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,,
“সমুদ্র তুই এখন ফারাহকে নিয়ে ঘুরতে বের হবি। মেয়েটা রুমে একা বসে আছে। কতদিন পরে আসলো এখানে।”
“তো আমি কি করবো। ঘুরতে চাইলে তুমি নিয়ে যাও। আমার সময় নেই। অফিসের কাজ আছে। সেগুলো শেষ করতে হবে।”
“সমুদ্র তোর সাথে কিন্তু ফারাহর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। এটা ভুলে যাস না। মেয়েটা তোকে ভীষণ ভালোবাসে।”
“তোমরা জানো আমি ওকে পছন্দ করি নাহ তাহলে কেনো বারবার বলতে আসো? বিয়ে! আর বিয়ে ওকে কে করছে। আমায় দায় ঠেকেনি যে ওকে বিয়ে করতে হবে। ফালতু না বলে নিজের কাজে যাও। ওকে আমার আশেপাশে আসতে মানা করবে”
সুমি বেগম ভীষণ রেগে যান। সে ছেলের সাথে কথা না বলে বের হয়ে যায় রুম থেকে। ফারাহ পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনছিলো সব। রুমে এসে দরজা আটকে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে পরে। ঢুকরে কেঁদে উঠে। ভালোবাসার দহনে সে বাজে ভাবে পুড়ছে। ছেলেটা তাকে ভালোবাসে না কেন?ফারাহর ইচ্ছে করে সমুদ্রের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে,আমায় ভালো কেনো বাসো না। কত বার জিজ্ঞেস করেছে উত্তর পেয়েছে তোকে আমার পছন্দ না। ফারাহ চোখের পানি মুছে ঠিক করলো সে আজকের পর থেকে কখনোই সমুদ্রের সামনে আসবে না। বিয়ে টাও ভেঙে দিবে। আর নাহ। অনেক হয়েছে, আর কতো।
“আজ থেকে তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা না হয় হৃদয়ের গহীনে যত্ন করে তুলে রাখা থাক। আর জ্বালাবো না তোমায়। ভালো থেকে প্রিয় ভালোবাসা”
–
গভীর রাত। নিস্তব্দতা বিরাজ করছে শহরজুড়ে।চিত্রা অন্ধকার রুমে শুয়ে আছে। সে জানে আজ আষাঢ় যার কথা গুলো বলেছে সেই মেয়েটি সে। তবে চিত্রা না জানার অভিনয় করে গিয়েছে। সেই বিষাদময় অতীতের পিছু আজও ছাড়াতে পারলো না সে। মনে পড়ে গেলো তার সেই বিষাক্ত অতীত। বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। বাইরে মৃদু হাওয়া বইছে। চুলগুলো আলগোছে খোঁপা করা। গায়ে ওড়না জড়ানো।টুলে বসে পরলো সে। চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখছে সে।
“আমার থমকে যাওয়া আকাশে আর কোনো ঘনকালো মেঘ প্রবেশ না করুক। আমায় বাজে ভাবে শেষ না করুক। ভালোবাসার অনুভূতি যে ভীষণ তীব্র। আমি চায় না জড়াতে।”
কিছুক্ষণ থেমে আবারও বিরবির করে বলল,,,“আষাঢ় সাহেব অতি ভালো একজন মানুষ তবে আমার জন্য নয়। তিনি ভালো কাউকে ডিজার্ব করেন”
প্রহর উঁকি দিলো বোনের রুমে। রুমে না পেয়ে বারান্দায় চলে আসলো। চিত্রাকে একা অন্ধকারে বসে থাকতে দেখে সে এগিয়ে এসে ফ্লোরে বসে তার কোলে মাথা রাখলো। চিত্রা হতভম্ব হলো। প্রহর এতো রাত পর্যন্ত জেগে আছে দেখে ভীষণ অবাক হলো। তার ভাইটা হুট করে বড় হয়ে গেলো। যে আগে ছিলো কাঁধ পর্যন্ত আর এখন সে তার গলা পর্যন্ত। সময় এভাবেই বয়ে যায়। সময় কখনো কারো জন্য থামেনি আর না কখনো থামবে। সে নিজ গতিতে এগিয়ে যাবে।বেশ শক্ত গলায় শুধালো,,,
“প্রহর ঘুমাসনি কেনো এখনো? এতো রাত অব্দি জেগে কেনো?কাল স্কুল আছে না।উঠ যা ঘুমিয়ে পর”
প্রহর আগের ন্যায় সেভাবে থেকে বলল,,“আপু এমন কঠোর কেনো তুমি?বুঝার পর থেকেই দেখি সব সময় শক্ত গলায় ধমক দয়ও। একটু মিষ্টি কথাও তো বলতে পারো নাকি”
“প্রহর এখন এসব কথা না বলে ঘুমাতে যা”
প্রহর ঘুম জড়ানো আদুরে গলায় বলল,, “একটু থাকি। আমি না তোমায় অনেক ভালোবাসি। তোমার সাথে থাকতে আমার ভালো লাগে।”
চিত্রা কথা বাড়ালো না। এই ছেলে কখনোই এখন যাবে না। হাজার বললেও নড়বে না। চিত্রা মৃদু হেসে প্রহরের চুলে ভাজে হাত বুলাতে থাকলো। প্রহর শান্তিতে মাথা রাখলো বোনের কোলে। সে ভীষণ ভালোবাসে তার বোনকে ভীষণ মানে ভীষণ।
#চলবে~