#আষাঢ়ে_প্রণয়_সন্ধি
#লেখিকা:#ইশা_আহমেদ
#পর্ব_২১
ক্লান্ত শহরতলীর মানুষ ফিরছে নিজ নীড়ে।শহরতলীতে বৃষ্টির তেজ বেড়েছে। প্রকৃতিকে ভিজিয়ে দিচ্ছে বৃষ্টির সচ্ছ ফোঁটাগুলো।অঝোর ধারায় ঝরে যাচ্ছে। থামা থামির কোনো নাম নেই। চিত্রা রিকশায় মাথা নুইয়ে বসে আছে।বৃষ্টির ফোঁটা এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে তার পা জোড়া। তার মনের অবস্থা তেমন ভালো নয়। আষাঢ়ের বলা প্রতিটা কথা এখনো তার কানে বাজছে। লোকটাকে কষ্ট পেতে দেখতেও তার ভালো লাগছে না। তবে গ্রহণ করাও যে সম্ভব নয়। মাথা ব্যাথা চড়া দিয়ে উঠছে তার। রিকশা থেকে নেমে পড়ে সে। ভাড়া দেওয়ার দরকার হয়নি কারণ আষাঢ় রিকশা ঠিক করেই ভাড়া দিয়ে দিয়েছে।অপর পাশে তাকাতেই চিরচেনা সেই মুখ দেখে থমকালো। আজ কতগুলো বছর পর দেখছে সে ওই লোকটিকে।
চিত্রা দ্রুত গেটের ভেতরে প্রবেশ করলো।কিছুক্ষণ দাড়িয়ে নিজেকে বোঝালো সব। হুট করে অতীতের লোকটা সামনে চলে আসায় কিছুটা ভয় পেয়েছিলো। তবে নিজেকে শক্ত করলো। আষাঢ়ের কথা মাথায় আসতেই চিত্রা আবার কেমন যেনো হয়ে গেলো। শক্ত মুখশ্রীতে মলিনতা ভর করলো।
চিত্রা কোনো মতে পা টেনে টেনে সিড়ি বেয়ে দোতলায় আসলো।শরীর দূর্বল হয়ে পরেছে তার।মোটেই চলছে না। কলিংবেল বাজিয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। মরিয়ম সুলতানা দরজা খুলে মেয়েকে আধ ভেজা অবস্থায় দেখে বিচলিত হলেন। মেয়ের এমন অবস্থা কিভাবে হলো এ নিয়ে চিন্তায় পরে গেলেন। চিত্রা রুমে প্রবেশ করে।মরিয়ম সুলতানা বিচলিত কন্ঠ শুধালেন,,,
“চিত্রা তোর এই অবস্থা কেনো?বৃষ্টিতে কেনো ভিজেছিস।”
“আম্মা আমি ভীষণ ক্লান্ত এখন কথা বলতে চাইছি না। রিকশা থেকে নামার সময় ভিজে গিয়েছি।”
চিত্রা এলোমেলো পায়ে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে গেলো।মরিয়ম সুলতানা চিন্তিত হয়ে নিজের রুমে ছুটলো। মেয়ের হাবভাব সুবিধা জনক লাগছে না। তার এমন মনে হয়েছিস সেই কত বছর আগে। আবার আজও তেমন মনে হচ্ছে। চিত্রা দরজা আটকে ওয়াশরুমে ঢুকে পরলো। শাওয়ার অন করে বসে পরলো তার নিচে। নাহিয়ান! এই নামটা এবং মানুষটার সাথে জড়িয়ে আছে তার জঘন্য স্মৃতি। লোকটাকে আজ নিজ বাড়ির সামনে দেখে চিত্রার হুশ উড়ে গিয়েছে।
“কেনো কেনো আবার লোকটা আসলো এই শহরে। কেনো দেখা হলো আমার ওই জঘন্য লোকটির সাথে। আমার বাড়ির সামনেই বা কি তার”
মরিয়ম সুলতানা নিজের রুমে এসে দেখলেন আরমান সাহেব শুয়ে আছেন। দ্রুত কাছে এসে বললেন,,
“আরমান তুমি কি ঘুমিয়ে গিয়েছো,?”
আরমান সাহেব প্রিয়তমা স্ত্রীর কন্ঠ শুনে চোখ খুলে তাকালেন। স্ত্রীকে চিন্তিত দেখে উঠে বসলেন।চশমা চোখে দিয়ে মরিয়ম সুলতানার দিকে তাকিয়ে বললেন,,
“কি হয়েছে মরিয়ম তোমাকে চিন্তিত লাগছে কেনো?”
“শুনো আমার মনে হচ্ছে চিত্রা ঠিক নেই। একটু আগে বাড়ি ফিরেছে। চোখ মুখের অবস্থা মোটেও ভালো নাহ। কিছুক্ষণ পর গিয়ে একটু দেখো না মেয়েটা ঠিক আছে কি না। ওকে তো এতো বছরে এরকম দেখিনি। তবে কি আমার মেয়ের জীবনে সেই কালো অতীত ফিরে আসছে?”
আরমান সাহেবের কপালে চিন্তার ভাজ পরলো। যে অতীত তার মেয়েকে এমন করেছে সে অতীত সে কখনোই আর তার মেয়েকে ছুঁতে দিবে না। এতো বছর একটু একটু করে এই চিত্রাকে গড়ে তুলেছেন তিনি। সে জানে তার মেয়ে ভেঙে পরবে না। তার মেয়ে যে সেই দুর্বল চিত্রা না। এ চিত্রা নিজেকে সব কঠিন পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। অতি সহজে ভেঙে পরে নাহ।সে স্ত্রীকে শান্তনা দিয়ে বললেন,,
“আমি কিছুক্ষণ পর খোঁজ নিবো। ওকে এখন একা থাকতে দেওয়ায় শ্রেয়। তুমি চিন্তা করো না। আমার মেয়েকে আমি যথেষ্ট শক্ত ভাবে গড়ে তুলেছি। ওর কাছে আবেগের কোনো মূল্য নেই। নিজেকে শক্ত রাখতে পারবে।”
মরিয়ম সুলতানা মানলেন। তবে চিন্তা যাচ্ছে না মাথা থেকে। তার একমাত্র মেয়ে চিত্রা। সেই কয়েক বছর আগের স্মৃতি মনে হলেই ভয় হয়। সে বার কি পাগলামিই না করেছিলো তার মেয়ে।যদিও এখন তা নিয়ে কোনো ভয় নেই।
–
আষাঢ় নিজ বাড়িতে প্রবেশ করলো ভেজা অবস্থায়। বেলী বেগম ছেলের অবস্থা দেখে দ্রুত গামছা এনে মাথা মুছে দিলেন। আষাঢ়ের দিকে তাকাতে আটকে উঠলেন তিনি। এলোমেলো চুল,মলিন চেহারা দেখে থমকে গেলেন। ছেলের এমন অবস্থা আগে কখনো দেখেননি তিনি। আষাঢ় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।বেলী বেগম আষাঢ়কে সোফায় বসিয়ে বললেন,,,
“কি হয়েছে আষাঢ়। তোমার এই অবস্থা কেনো বাপ?”
আষাঢ় জড়িয়ে ধরলো মাকে। তার কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। চিত্রাকে না পাওয়ার ভয় ঝেঁকে ধরেছে তাকে। আষাঢ় কম্পিত কণ্ঠে শুধালো,,,“আম্মা আমি যূি চিত্রাকে না পাই। আমি আজ ওকে নিজের মনের কথা জানিয়েছিলাম তবে ও আমায় গ্রহন করেনি আম্মা। আমার কষ্ট হচ্ছে ভীষণ”
বেলী বেগম বুঝলেন ছেলের যন্ত্রণা। সে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,,,“আষাঢ় অবশ্যই তোমাকে নিজের অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে। আমার মনে হয় তার অতীত আছে। না হয় কেউ কখনোই এরকম হয় না”
“হ্যাঁ আম্মা ও আমায় বলেছে ওর অতীত আছে। তবে ওর অতীতে যাই থাকুক না কেনো আমার এতে সমস্যা নেই আম্মা। আমার শুধু ওকে লাগবে”
“আষাঢ় তাহলে সর্ব প্রথম তোমায় তাড অতীত সম্পর্কে অবগত হতে হবে। মেয়েটার অতীত সম্পর্কে জেনে অতঃপর তোমায় কিছু করতে হবে”
“আম্মা আমি এখন ওর অতীত কিভাবে জানবো?”
“তোমার উচিত আরমান ভাই এর সাথে কথা বলা। তার কাছ থেকে জানা উচিত চিত্রার অতীতে কি হয়েছিল তা জানা এরপর বুঝে শুনে মেয়েটাকে মানাতে হবে”
আষাঢ় মাথা নাড়িয়ে বলে,,,“তাহলে কি আমার এখন আরমান আঙ্কেলের সাথে কথা বলা প্রয়োজন?”
“হ্যাঁ তুমি তার কাছ থেকে জেনে নিও। এখন ফ্রেশ হয়ে আসো আমি খাবার দিচ্ছি।”
আষাঢ় উঠে নিজের রুমে আসে। শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে নিজেকে নিজে বলে সে চিত্রার অতীত জানবে ভয়ংকর কিছু হলেও তার চিত্রাকেই চাই। চিত্রাকে ছাড়া সে থাকতে পারবে না। বেঁচে থাকার জন্য হলেও চিত্রাকে তার দরকার। নারীটিকে সে অসম্ভব ভালোবাসে। সে কখনো ভাবেনি কোনো দিন কাউকে এতোটা ভালোবাসবে। যার জন্য এমন অবস্থা হবে তার। ভালোবাসে সে তার চিত্রারানীকে! ভীষণ রকম।
–
চিত্রার রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আরমান সাহেব। দরজায় ঠকঠক শব্দ হতেই চিত্রা দরজা খুলে দেয়। বাবাকে দেখে ভেতরে
আসতে বলে সে। আরমান রহমান ভেতরে প্রবেশ করে বিছানায় বসেন।চিত্রাও বিছানায় এসে বসে। আরমান রহমান দেখেন মেয়ের চুল ভেজা। পানি পরছে। উঠে গামছা নিয়ে আসেন। মেয়ের পেছনে বসে সযত্নে চুল মুছে দেন। চিত্রা কিঞ্চিৎ অবাক হলো। আজ কত বছর পর তার আব্বু এভাবে তার চুল মুছে দিচ্ছে। সেই ছোটবেলায় এমন চুল মুছে দিতো।
“আম্মা তোমার কি মন খারাপ। কিছু হয়েছে কি?”
“মন খারাপ নয় আব্বু তবে আজ সেই জঘন্য মানুষটাকে দেখেছি তাও আমাদের বাড়ির সামনে”
“তোমার কি কষ্ট হচ্ছিলো আম্মা?”
“নাহ আব্বু আমার ঘৃণা হচ্ছিল। আর মনে হচ্ছিল এতো বাজে একটা লোককে আমি ভালোবেসে ছিলাম। এতো অবুঝ ছিলাম আমি।”
আরমান রহমান হাসলেন।অতঃপর বললেন,,,“আমি জানি আমার আম্মাজান এতো সহজে ভেঙে পরবে না। আর ওই কারণে আমার আম্মা জানের মন ও খারাপ নয়। তবে কারণ টা কি আম্মা?”
চিত্রার একটু অস্বস্তি হয়। আষাঢ়ের কথা বলবে কি বলবে না ভাবে। অতঃপর কিছুক্ষণ ভেবে সিদ্ধান্ত নেয় বলবে সে। তাই বাবার দিকে ফিরে বলে,,,
“আব্বু আজ একটা অনাকাঙ্খিত ঘটনা না না অনাকাঙ্খিত না আসলে আমি আগেই বুঝতে পেরেছিলাম তার মনোভাব। লোকটাকে আমার যথেষ্ট ভালো মনে হয়েছে বিধায় বন্ধুত্ব করেছিলাম তবে সে আমায় আজ নিজের মনের অনুভূতির কথা জানিয়েছে”
“তুমি কি আষাঢ়ের কথা বলছো আম্মা?”
চিত্রা বিষ্মিত চোখে তাকায় তার আব্বুর দিকে। সে বুঝে উঠতে পারলো না আরমান সাহেব কি করে এ কথা জানলেন। তার তো এ কথা জানার প্রশ্নই উঠে না। আরমান সাহেব মেয়ের মনোভাব বুঝতে পেরে বলেন,,,
“তুমি ভুলে গিয়েছো সেদিন তুমি বলেছিলে আষাঢ়কে নিজের বন্ধু বানিয়েছো। আমি সেদিন সত্যি অনেক অবাক হয়েছিলাম। তবে কিছু বলেনি। এতো বছরে তুমি ওই একটা ছেলের সাথেই বন্ধুত্ব করেছো। তাই বুঝলাম মানুষটি আষাঢ়।”
“আব্বু আমি না করে দিয়েছি তাকে।”
“আষাঢ় ছেলেটা ভালো আম্মা। তুমি ভেবে দেখতে পারো। আমার বিশ্বাস সে তোমায় আগলে রাখবে এবং কখনো তোমার অসম্মান করবে না”
#চলবে~