আসমানী পর্ব-১৫

0
221

#আসমানী
#পর্ব_১৫
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা

পাশের ঘরে বসে বিলাপ করছে শাহেদা বেগম।তার স্বামী আর মেয়ে তাকে স্বান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছে।কিন্তু নিজেদের দেওয়া স্বান্তনা নিজেদের কাছেই যেন
হাস্যকর লাগছে তাদের কাছে।নাহিদ একাই বের হয়ে
গেছে।শাহেদা বেগমকে নিয়ে যায় নি।একবার আসমানী এসে দেখে গেছে তাদের।কিন্তু মুখে কিছুই বলতে পারেনি।

নাতাশা আসমানীর রুমে এসে দেখে সে চুপচাপ শুয়ে আছে।আসমানীকে দেখে তার ভীষণ ভয় লাগছে।পুরো রুম অন্ধকার করে আসমানী চোখ খোলা রেখে শুয়ে আছে।বাইরের ঘর থেকে আলো এসে আসমানীকে দেখতে ভীষণ ভয়ংকর লাগছে।আলো আধারির খেলায় আসমানী যেন একটা রহস্য।নাতাশা কোনো কথা না বলে রুম থেকে বের হয়ে যায়।

নাতাশা চলে যেতেই আসমানী উঠে বসে।বেশ কিছুক্ষণ বিছানায় বসে থেকে বিছানা থেকে নেমে গিয়ে দরজার খিল এটে দেয়।তারপর চোখ মুখ ভীষণ শক্ত করে নিজের ফোন বের করে আগে একজনের লোকেশন বের করে।তারপর দ্রুত হাতে মোবাইলে একজন কে কিছু একটা টাইপ করে।

আসমানী বেশ কিছুক্ষণ আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকে।আড়াই বছর আগের আসমানীকে খোঁজার চেষ্টা করে আয়নার মধ্যে।নাহ,তাকে সে খুঁজে পায় না।কোথায় সেই আদুরে মেয়ে আসমানী?যে তার বাবার চোখের মনি ছিল?যে তার মায়ের সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী ছিল।যে তার ভাইয়ের আসমান ছিল।আর তার মিষ্টি বোনটার ডান হাত ছিল।কোথায় সেই আসমানী?যে আসমানীর সকালের নাস্তাটা তার ঘুম থেকে জাগার আগেই তৈরি থাকতো?যার এক বেলার রেস্টুরেন্টের খাবারের বিলই এখনকার এক সপ্তাহের খরচ।যে বরফকুচি আর গোলাপের পাপড়ি দিয়ে বাথটাবে গা ডুবিয়ে শুয়ে থাকতো?
কই?কিছুই তো নেই।বরং এখন আসমানী এখন পুরোদস্তুর গৃহিণী।সকাল বেলা উঠে তাকেই নাস্তা বানাতে হয়।শ্বশুর বাড়ির সবার খেয়াল রাখতে হয়।আর হোস্টেলের জীবন?সে তো ছিল আরও এক কালো অধ্যায়।সকালে একটা শিঙারা কিংবা পুরি,দুপুরে আলু ভর্তা আর ডাল ভাত।আর রাতে মাঝে মাঝে অভুক্ত।আসমানী নিজেই আয়নার সামনে গিয়ে আয়নায় থাকা আসমানীকে প্রশ্ন করে,”কেমন আছিস আসমানী?”

নিজের প্রশ্নটা যেন নিজের কাছেই বড্ড হাস্যকর লাগছে তার কাছে।আসমানী নিশ্চিন্ত মনে এসে শুয়ে পড়ে।এরপর হেডফোন ব্যবহার করে বেশ কয়েকটা পুরোনো গান শুনে।তারপর কি মনে হতেই আয়নার সামনে গিয়ে পাগলের মতো নাচতে থাকে।আসমানী বুঝতে পারে সে তার নিজের মধ্যে নেই।কিন্তু এইভাবে নাচতে তার খুব একটা খারাপ লাগছে না।তার পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে।সে গান গাইতে ভীষণ ভালোবাসতো।এখন নিশ্চয়ই গান গাওয়া যাবে না।পাশের রুমে সবাই ভীষণ দুশ্চিন্তা করছে।তাছাড়া বাড়ির বউ এই ভরা সাঝের সময় গান গাইলে সবাই কি ভাববে?

হঠাৎ আসমানীর ফোনে একটা মেসেজ এলে সে চেক করে দেখে, “মিশন ডান ম্যাম।”
আসমানী নিশ্চিন্ত মনে শুয়ে পড়ে।একটু পরেই নাতাশা রুমের সামনে এসে চিৎকার করে বলে,”ভাবী,নুসাইবাকে পাওয়া গেছে।ওর সাথে আরও অনেক মেয়েকে পাওয়া গেছে।ওকে নাকি কোন গ্যাংয়ের লোক কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছিল।টিভিতেই দেখাচ্ছে।এসো দেখবে এসো।তাড়াতাড়ি এসো।”

আসমানী অবশ্য এতো তাড়াহুড়ো করলো না।সে বেশ ধীরে ধীরে এগিয়ে দরজা খুলে তারপর বাইরে বের হয়ে নাবিলের রুমে গেল।সেখানে সবাই জড়ো হয়ে বসে টিভিতে এই নিউজটা দেখছে।অনেক মেয়েকেই পাওয়া গেছে।অনেকে নাকি অনেক দিন আগে থেকেই কিডন্যাপ হয়ে ছিল।সামনের মাসেই নাকি ওদের বাইরের দেশে পাচার করে দিত।কিন্তু দুঃখের বিষয় কোনো কিডন্যাপারকেই খুঁজে পাওয়া যায় নি সেখানে।সবাই নাকি আগেই পালিয়েছিল।
আসমানী নিউজটা শুনে মুচকি মুচকি হাসে।সে জানে এর জন্য তাকে জবাবদিহি দিতে হবে।হয়তো তাকে তার চাকরি থেকে বরখাস্তও করা হতে পারে।কিন্তু সে কোনোরুপ বিচলিত হয় না।তার কাজ যে প্রায় শেষ।সে নিজে হাতে বাকি কাজ সম্পন্ন করবে।

আসমানী তার শাশুড়ীকে বলে,”আম্মা,আমি আজকে চাচার বাসায় যাবো।আমাকে কি অনুমতি দিবেন যাওয়ার?”
ওর কথায় সবাই হকচকিয়ে যায়।ওর চাচার সাথে যে ওর সম্পর্ক ভালো নয়,সেটা তো সবাই জানে।ওর শাশুড়ী বলে,”কি জন্য যেতে চাচ্ছো মা?”
আসমানী মাথা নিচু করে বলে, “আসলে আজ আমার দাদার মৃত্যু বার্ষিকী।বাসায় কিছু মানুষ এসেছে।আমি সকালেই যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু রোজি আপুর বিয়ের জন্য যেতে পারিনি।আমি আমার বাবার দায়িত্ব পালন করতে চাই।”
নাসিরুদ্দিন সাহেব বলে,”কিন্তু ওরা যদি কিছু বলে তোমাকে?”
“কিছুই বলবে না বাবা।বাসায় আরও অনেকেই আছে।সবার সামনে আর কি ই বা বলবে?”
“আচ্ছা,বেশ।তাহলে আজকে যাও।নাবিল তোমাকে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে আসুক তবে?”
“আচ্ছ।”

নাবিল আসমানীকে বাসে উঠিয়ে দেওয়ার কিছু সময় পরে আসমানী বাস থামিয়ে বাস ভাড়া দিয়ে নেমে যায়।সামনে থাকা প্রাইভেট কারে উঠে বসে নতুন গন্তব্যে চলতে থাকে।
★★★

বেশ কয়েকজন কালো পোশাকধারী মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আসমানী।তাদের চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ।যেন পারলে চোখ দিয়েই আসমানীকে ভস্ম করে দিবে।কিন্তু আসমানী নির্বিকার হয়েই তাকিয়ে আছে তাদের দিকে।

তাদের মধ্যে থেকে একজন বলে,”আমরা তোমার কাছে কৃতজ্ঞ আসমানী।তুমি বেশ ভালোভাবেই আমাদের খবর দিতে পেরেছো।কিন্তু তুমি যা করলে সেটা মোটেও ঠিক করলে না।”

আরেকজন বলে,”তুমি কি বুঝতে পারছো আমাদের কথা?ওদের কাছে আরও অনেক মেয়ে বন্দী আছে।কোথায় কোথায় আছে আমরা কেউই সেটা জানি না।ওদের কাউকে তুমি কেন ধরতে দিলে না?তাহলেই তো আমাদের মিশন কমপ্লিট হয়ে যেতো।এইরকম অর্ডার কেন দিলে আসমানী?ওদের ছেড়ে দিলে কেন?”

আসমানী এবার নিজেই বিরক্ত হয়ে বেশ আয়েশী ভঙ্গিতে বসে বলে,”পা ব্যথা হয়ে গেছে আমার।কিছুক্ষনের জন্য বসলাম বস।কিছু মনে করবেন না প্লিজ।হ্যাঁ, তারপর কি যেন বলছিলেন?”

এবার তৃতীয় ব্যক্তিটি বলে,”তুমি এমনটা করেছো,নিশ্চয়ই তোমার আরও কোনো প্ল্যান আছে?”প্ল্যানটা আমাদের জানাও।”

আসমানী বেশ ভাবলেশহীন ভাবে বলে,”আমি এখনও কোনো প্ল্যান করতে পারিনি স্যার।আর প্ল্যান মাফিক আমার জীবনে কোনোকিছু হয়ও নি স্যার।চেয়েছিলাম একটা সাধারণ জীবন।পেলাম না।তারপর এলাম আপনাদের কাছে আমার বিচার নিয়ে।আপনারা আমাকে আপনাদের দলে যুক্ত করলেন।ভাবলাম আমার কাজ টা বুঝি করবেন।কিন্তু সেটা না করে আমাকে দিয়ে আরও অনেক কাজ করিয়ে নিয়েছেন।এরপর আমাকে এমন কাজ দিলেন যেটা করতে পারলে আমি আমার বিচার পাবো।আমি বাধ্য হয়ে করলাম।প্ল্যান ছিল শুধু তিন কবুল বলে বিয়ে করে ছেলেটাকে আমায় ছুঁতেও দিব না।কিন্তু বিয়ের পর তাকে আর তার পরিবারকে দেখে মনে হলো,আমি যেন আমার হারিয়ে যাওয়া পরিবারকে ফিরে পেয়েছি।তার পরদিন পুরো মহল্লার সামনে আমাদের আবার বিয়ে হলো।আর আমি একটু একটু করে তার আর তার পরিবারের ভালোবাসায় হারিয়ে গেলাম।একসময় নিজেও বুঝতে পারলাম,আমিও তাকে ভালোবাসি।ভেবেছিলাম এইবার হয়তো সুখে সংসার করতে পারবো।জানিনা,সামনে কি হবে আমার সাথে।কিংবা বলতে পারি কি হতে চলেছে।তাই আর কোনো প্ল্যানিং করছি না আমি।কারণ, যা হওয়ার তা হবেই।তবে হ্যাঁ, বড়জোর আর ১ মাসের মতো।আপনারা এর মধ্যেই তৈরি থাকবেন।আমার মেসেজের অপেক্ষায় থাকবেন।”
এইটুকু বলেই আসমানী পাগলের মতো হাসতে থাকে।তৃতীয় লোকটি বলে,”হাসছিস কেন আসমানী?”
আসমানী হাসতে হাসতে বলে,”আমার নিজেকে নিজের কেমন সেলিব্রিটি সেলিব্রিটি মনে হচ্ছে। আমার একটা মেসেজের অপেক্ষায় এইখানের সব লোক মোবাইল আর কম্পিউটারের সামনে বসে থাকবে।বিষয়টি মজার না?”
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তিনজন মানুষই হকচকিয়ে যায় ওর কথা শুনে।ওরা যে ওর সিনিয়র সেটা আসমানী ভালোভাবেই জানে।তবে এইরকম করার কোনো কারণ কেউ বুঝতে পারছে না।
আসমানী উঠে দাঁড়িয়ে বলে,”আমি বাসায় যাচ্ছি।এইখানে থাকতে ভালো লাগছে না মোটেও।আমি আজ বাসায় যাব।আমার বাসায়।”
আসমানী কারো উত্তরের অপেক্ষা না করেই দরজার দিকে এগুতে থাকে।হুট করে কি মনে হতেই পিছনে ফিরে তৃতীয় ব্যক্তিটিকে বলে,”আমাকে কি দিয়ে আসবে ভাইয়া?যদি তোমার কাজ না থাকে।আমি আসলে আমাদের বাড়িতে যাব।মানে আমার বাড়ি।মানে আমিই তো ঐ বাড়ির একমাত্র উত্তরাধিকারী এখন।আমার কোনো ভাই বোনও তো আর বেঁচে নেই।বাবা বাইরে আর কোনো বিয়েও করেনি।তার মানে সেখানেও কোনো সন্তান নেই।তার বউও নেই।আমার মাও নেই।তাহলে আমিই তো সবকিছুর দাবিদার এখন।তাইনা?নাকি আমি মেয়ে বলে আমার চাচাতো ভাই হিসেবে তুমিও আমার বাড়িতে ভাগ বসাবে?”

আসমানীর এইরকম অসংলগ্ন কথাবার্তা শুনে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আসমানীর মেজো চাচাতো ভাই আয়ুশ ভয় পেয়ে যায়।এইরকম তো নতুন না।তার চাচার মৃত্যুর পরেও আসমানী এইরকম কথা বলেছে।অনেক কষ্টে তাকে এই ট্রমা থেকে বের করতে পেরেছে তারা।আবার কি এমন আঘাত পেয়েছে সে যে আবার পাগলামি শুরু করেছে।আয়ুশের ভীষণ ভয় লাগছে।নিজের ভালোবাসাকে তো বিসর্জন দিয়েছে বহু আগেই।কিন্তু ভালোবাসার মানুষটির এইরকম অবস্থা কখনোই কামনা করেনা সে।সে ভালোবাসে আসমানীকে।কিন্তু এই নিষ্ঠুর সমাজ আর বাস্তবতা আসমানীকে তার থেকে শত ক্রোশ দূরে সরিয়ে দিয়েছে।তাতে তার কোনো আক্ষেপ নেই।সে চায় তার ভালোবাসার মানুষটা ভালো থাকুক।কিন্তু এইরকম কষ্টে সে বেঁচে থাকবে,সেটা সে কখনোই চায় না।কখনোই না। এই মেয়েটা কি একদিনের জন্যও শান্তি পাবে না?

চলবে…….