ইট পাটকেল পর্ব-১৮+১৯

0
1168

#ইট_পাটকেল
#সানজিদা_বিনতে_সফি
#পর্ব_১৮

নূর ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে আছে আশমিনের দিকে। আশমিনের সেদিকে কোন ধ্যান নেই। সে একমনে কনফারেন্স মিটিং করে যাচ্ছে। চোখে গোল কালো ফ্রেমের চশমা। ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি দেখে বোঝার উপায় নেই দু দিন আগে তার বুক সে ফুটো করে দিয়েছে।আশমেন আড় চোখে নূরের ভাবভঙ্গি দেখেও কিছু বললো না। কয়েক জায়গায় তার দলের লোক ঝামেলা পাকিয়েছে।সেগুলো দ্রুত সমাধান করা জরুরি। অথচ বউয়ের বদৌলতে সে হসপিটালের বাসিন্দা। মিনিট কয়েক পর মিটিং শেষ হলো। বুকের ব্যথা খুব একটা কমে নি।সারতে কয়েক দিন লাগবে।ল্যাপটপ টেবিল থেকে ল্যাপটপ নামিয়ে চশমা খুললে চোখের পাতায় ম্যাসাজ করলো আশমিন। নূর তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে। আশমিন নূরের অগোচরে হালকা হাসলো। গম্ভীর ভাব বজায় রেখে চোখ বন্ধ করে গা এলিয়ে দিয়ে বললো,

— আ’ম লুকিং সো হট,, না?

নূর বিরক্তিকর শব্দ করলো।মাঝে মাঝে মনে চায় একে আটলান্টিক মহাসাগরে রেখে আসতে।আস্তো খবিশ একটা।

— আংকেলর সাথে এসব কি শুরু করেছেন আপনি? বাবার সাথে এ কেমন ব্যবহার?ছিঃ। এ বয়সে এসে অযথা বিয়ে কেন করবে?কেমন ছেলে আপনি? মায়ের জন্য সতিন আনতে চাইছেন?আর আমার ননদ চাই মানে? দিন দিন এত অসভ্য হচ্ছেন কেন?আপনার জনগণ জানে আপনি একজন চুরান্ত অশ্লীল লোক?

নূরের বিরক্ত গলা শুনে ভ্রু কুচকে ফেললো আশমিন। চোখ ছোট ছোট করে নূরের দিকে তাকিয়ে বললো,

— তুই আমার বাবার স্ট্রংনেসের উপর আঙ্গুল তুলছো? এতো সাহস তোমার? আমার বাবা চাইলে এখনো ক্রিকেট টিম বানাতে পারবে। হি ইজ আ স্ট্রং ম্যান।

নূর দুই হাতে কান চেপে চিৎকার করে বললো,

— বন্ধ করুন আপনার অসভ্য কথা।নিজের দিকে তাকিয়ে দেখুন। সময় মতো বাচ্চা কাচ্চা হলে চার বাচ্চার বাবা হয়ে যেতেন। লজ্জা করে না এসব বলতে?

আশমিন নূরের পা থেকে মাথা পর্যন্ত স্ক্যান করে ঠোঁট কামড়ে হাসলো। নূরের দিকে তাকিয়ে চিন্তিত গলায় বলল,

— তা তো হতো। কিন্তু তুমি এতো ধকল নিতে পারতে কিনা বুঝতে পারছি না। আফটার অল আ’ম অলসো আ স্ট্রং ম্যান। বাট তুমি চাইলে আমি ট্রায় করতে পারি। কাম।

নূর হতভম্ব হয়ে বসে রইলো। মনে মনে কয়েক কোটি বার পন করলো এই লোকের সাথে আর কথা বলবে না। ছিঃ। কয়েক বছর আগে কতো ভালো ছিল।এমন অসভ্য কিভাবে হলো!

আশমিন নূরের দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে।নূর বুঝতে পেরে বিরক্ত হয়ে বললো,

— চোখ দিয়ে ইভটিজিং করা বন্ধ করুন।অস্বস্তি হচ্ছে আমার।

নূরের কথা শেষ হওয়ার আগেই কামিনী চৌধুরী আর লারা প্রবেশ করলো কেবিনে।আশমিনের মুখ কঠিন হয়ে গেলো। নূর বিরক্ত চোখে একবার তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে সুয়ে পরলো।

লারা আর কামিনী চৌধুরী এসে আশমিনের বেডের সামনের সোফায় বসলো। লারা ন্যাকা স্বরে বললো,

— এখন কেমন আছো বেবি?আমি কতটা ভয় পেয়েছি জানো?বাপির সাথে কানাডা গিয়েছিলাম তাই আসতে পারিনি।

আশমিন কিছু বললো না। চুপ করে নিজের ফোনে কিছু একটা করছে।

কামিনী চৌধুরী এবার মুখ খুললো, কর্কশ গলায় বলল,

,– এসব আমি কি শুনছি আশমিন।তুমি তোমার বাবা কে কি বলেছো? আমি তোমাকে জন্ম দিয়েছি।তুমি সন্তান হয়ে আমার সংসার ভাঙ্গতে চাইছো? আর এই মেয়েকে এখনো পুলিশে দাও নি কেন?সে তোমাকে প্রাণে মা*রার চেষ্টা করেছে।

লারা যেন একটা সুযোগ পেল নূর কে হেনস্তা করার।

— ঠিক বলেছেন আন্টি। একে তো এক্ষুনি পুলিশে দেওয়া দরকার। নির্লজ্জ মেয়ে।যাদের কাছে বড় হলো তাদের ছেলে কে ই মা*রতে চাইছে।আমি থানায় কল করছি। তুমি কিছু চিন্তা করো না বেবি।আমি এই মেয়েকে কঠিন শাস্তি দেয়ার ব্যবস্থা করবো।

আশমিন শান্ত চোখে তাকালো লারার দিকে। কামিনী চৌধুরী বিরক্ত মুখে বসে আছে। আশমিন আবার নিজের ফোনে মনোযোগ দিয়ে লারা কে বললো,

— আচ্ছা লারা,তোমাকে আমি কি বলে ডাকবো বলো তো? না মানে,তুমি তো কখন থেকে আমাকে বেবি বলে ডাকছো।আমার ও তো আদর করে কিছু একটা ডাকা উচিত।

লারা কল করা বাদ দিয়ে খুশিতে ডগমগ করতে লাগলো। আশমিনের পাশে বসে গদগদ গলায় বলল,

— হ্যা হ্যা, তুমি আমাকে বাবু বলে ডাকবে।আমার কতো দিনের সখ জানো?তুমি তো কখনো ডাকলেই না(অভিমানী গলায়)।

আশমিন বাকা হাসলো। জোড়ালো গলায় ডাকলো,

— বাহাদুর,,,

লারা এক লাফে উঠে পরলো।ভীত চোখে একবার দরজার দিকে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিললো।ওদিনের বিভিষিকাময় সময় গুলো ভাবতেই কপালে সুক্ষ্ম ঘাম দেখা দিল।

আশমিনের ডাকের কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বাহাদুর এসে উপস্থিত হলো। আশমিন মোবাইলে চোখ রেখেই দৃঢ় গলায় বলল,

— লারা বাবু কে নিয়ে যাও।আজকে সারা দিন তাকে সেরেলাক্স খাওয়াবে।আমার বাবু বলে কথা।কাজের যেন হেরফের না হয়।

লারা বাহাদুরের দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকালো। বাহাদুর ভাবলেশহীন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে।লারা এবার কেদেই দিল।কামিনী চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে ছটফট গলায় বলল,

— আন্টি আপনি কিছু বলুন। আপনার কথায় আমি এখানে এসেছি। আমাকে বাচান প্লিজ।

কামিনী চৌধুরী আশমিন কে ধমক দিয়ে বললো,

— এসব কি আচরণ আশমিন। তুমি ওর সাথে এমন করতে পারো না।

আশমিন সেদিকে ধ্যান না দিয়ে বাহাদুরের নাম ধরে ডাকলো,,

–বাহাদুর,,,

ব্যাস সাথে সাথে বাহাদুর লারা কে নিয়ে কেবিন ত্যাগ করলো। নূর বিরক্তিকর কপালে চোখ বন্ধ করে সুয়ে আছে।দুই দিনে এই সার্কাস দেখতে দেখতে সে অতিষ্ঠ। আজ ই সে বাসায় চলে যাবে।

কামিনী চৌধুরী রাগে গজগজ করতে লাগলো। এই ছেলে লাগাম ছাড়া হয়ে যাচ্ছে। তার সংসার ভাঙার কথা ভাবছে।মনে মনে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো সে। আমজাদ কখনোই তাকে ছেড়ে অন্য কারোর কথা ভাববে না।বিয়ে তো অনেক পরের কথা।আশমিন কে কয়েকবার বাচ্চা উপাধি দিল সে।এই খেলায় সে মহারথী। তার সাথে তার পেটের ছেলে এসেছে টক্কর দিতে। ব্যাপার টা হাস্যকর। তার হাতে এখনো মুখ্য চাল আছে। সেই এক চালেই সব কয়টা কুপকাত হয়ে যাবে।

আশমিন হয়তো কামিনী চৌধুরীর মনোভাব বুঝতে পারলো। চোখ বন্ধ করেই মলিন হাসলো সে। কেন তার মা এই ধ্বংসের খেলায় মেতে উঠল।সে এসব কিছু না করলে আজ তাদের জীবন টা কতই না সুখের হতো। টাকা আর ক্ষমতার লোভে অন্ধ হয়ে ঠিক ভুল সব ভুলে গেছে সে। মায়ের কষ্ট দেখলে সেও কি সহ্য করতে পারবে!মরণ যন্ত্রণায় প্রতিদিন কাতরে কাতরে মরবে।আল্লাহ! এ কোন পরিক্ষায় ফেললে আমাকে?

আশমিনের আর্তনাদ বুক চিরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। একটু পরেই হয়তো তার মা জীবনের সবচেয়ে বড় ধাক্কা টা খাবে।নিজেকে যতই শক্ত করতে চাইছে ততই ভিতর থেকে ভেঙে পরছে সে।কামিনী চৌধুরী ম্যাগাজিন পড়ায় মন দিয়েছে ততক্ষণে। আশমিন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার মুখের দিকে। এই তার জন্মদাত্রী। সে নিজে সন্তান হয়ে তার জীবনের সমস্ত সুখ কেড়ে নিয়েছে। কামিনী চৌধুরী যত লোভী হোক না কেন।সে আমজাদ চৌধুরী কে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। কিন্তু আশমিনের হাতে আর লোন উপায় নেই। গর্ত থেকে শত্রুকে বের করতে হলে কামিনী চৌধুরী কে উন্মাদ করতে হবে। উত্তেজিত হয়েই কামিনী চৌধুরী তার ফেলা ফাদে পা দিবে।

আশমিনের ভাবনার মাঝেই কেবিনে প্রবেশ করলো আমজাদ চৌধুরী।তার পাশেই বধু বেশে মায়া নামক মহিলা। কামিনী চৌধুরী এক পলক সেদিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। হতভম্ব হয়ে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো। প্রিয় মানুষের হাতে অন্য একটা মেয়ের হাত দেখে দুনিয়া দুলে উঠল তার।জ্ঞান হারিয়ে পরে যেতেই আগলে নিলো আশমিন। ছলছল চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বুকে চেপে ধরলো তাকে। আমজাদ চৌধুরী ফোলা ফোলা রক্তিম চোখে তাকালো আশমিনের দিকে। নূর ও হতভম্ব হয়ে বসে পরেছে। মাথা ঘুরছে তার।আশমিন সত্যি এমন কিছু করবে ভাবতে ও পারে নি সে।

আমজাদ চৌধুরী এসে আশমিনের থেকে কামিনী চৌধুরী কে ছাড়িয়ে নিলো। নিজের বুকে আকড়ে ধরে শব্দ করে কেদে উঠলো। আশমিন শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভেঙে পড়লে চলবে না। এখনো অনেক পথ বাকি।

চলবে,,

#ইট_পাটকেল
#সানজিদা_বিনতে_সফি
#পর্ব_১৯

দিনের সূর্য ঢলে রাতের অন্ধকার নেমে এসেছে পৃথিবীর বুকে।কামিনী চৌধুরী প্রায় আট ঘন্টা অজ্ঞান হয়ে ছিল।ততক্ষণ আমজাদ চৌধুরী তার পাশে তার হাত আকড়ে ধরে বসে ছিল।কামিনী চৌধুরীর জ্ঞান ফিরতে দেখেই তাকে কেবিন থেকে বের করে দেয় আশমিন। কামিনী চৌধুরী চোখ খুলে নিজের পাশে শুধু আশমিন কে দেখে চোখ বন্ধ করে ফেললো। তার বিশ্বাস ই হচ্ছে না আমজাদ, তার ভালবাসা তাকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করেছে। আশমিন এক ধ্যানে তাকিয়ে রইলো কামিনী চৌধুরীর দিকে। মায়ের জন্য কষ্ট হচ্ছে তার। কিন্তু এছাড়া আর উপায় নেই।

— আমার সামনে থেকে চলে যাও আশমিন।তোমাকে আমার সহ্য হচ্ছে না।

কামিনী চৌধুরী ভাঙ্গা গলা শুনে বুক কেপে উঠলো আশমিনের। তার আম্মুর এমন গলা এর আগে আর কখনো শোনে নি সে।এক পলক সেদিকে তাকিয়ে বেড়িয়ে গেলো আশমিন।

আশমিন বেড়িয়ে যেতেই চিৎকার করে কেদে উঠলো কামিনী চৌধুরী। তার আর্তনাদে হসপিটালের পরিবেশ ভারি হয়ে উঠল।দরজার বাইরে আশমিন শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমজাদ চৌধুরী হাত পা ছড়িয়ে ফ্লোরে বসে আছে। আশমিন সেদিকে তাকিয়ে তপ্ত শ্বাস ছাড়লো। বুকের ব্যথা টা আবার বাড়ছে। তার পাশের কেবিনেই কামিনী চৌধুরী কে সিফট করা হয়েছে। আশমিন ধীর পায়ে নিজের কেবিনে প্রবেশ করতেই নূরের ঘৃণা ভরা দৃষ্টি দেখে মলিন হাসলো। নিজের বেডে গা এলিয়ে দিতেই মায়া নামক মহিলাটি এসে আশমিনের পাশে বসলো। আশমিন একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো।

— খারাপ লাগছে?

— নাহ।

আশমিনের গলা স্বাভাবিক। মায়া মুচকি হাসলো। আশমিনের মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত গলায় বললো,

— সব ঠিক হয়ে যাবে।

— হুম।

নূর তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে মায়া নামক মহিলার দিকে। নামের মতোই মহিলার মুখটা অসম্ভব মায়ার ভরা।কিন্তু নূরের ভালো লাগছে না। কামিনী চৌধুরী যেমন ই হোক না কেন নূর কখনো চায় নি তার সাথে এমন কিছু হোক। সে জানে ভালবাসার মানুষের সাথে অন্য কাউকে দেখা কতটা যন্ত্রণা দায়ক। সে চায় নি তার শত্রুর সাথেও এমন কিছু হোক।অথচ আশমিন নিজের ছেলে হয়ে তাকে সেই কষ্ট টা দিল।কামিনী চৌধুরীর কান্নার আওয়াজ এখনো শোনা যাচ্ছে। বুক কেপে উঠলো নূরের। আশমিন চোখ বন্ধ করে সুয়ে আছে। মায়া নামক মহিলা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। রাগে ঘৃণায় অসহ্য হয়ে উঠল নূর।

— অমি,,,(চিৎকার করে)

হন্তদন্ত পায়ে দৌড়ে এলো অমি।আশমিন ও চোখ খুলে তাকিয়েছে।নূর আশমিনের দিকে ঘৃণা ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে অমি কে বললো,

— আমি এক্ষুনি বাসায় যাবো অমি। সব ব্যবস্থা করো। এক্ষুনি মানে এক্ষুনি।

আশমিন কিছু বললো না। অমি মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো। নূর বেড থেকে নেমে আশমিনের দিকে তাকালো। ঘৃণা নিয়ে বললো,,

— জানি না কেন আপনি এমনটা করলেন।কারণ যাই হোক না কেন। আমার আপনার প্রতি ঘৃণা হচ্ছে। আপনার দিকে তাকালে গা গুলিয়ে আসছে। আপনার মতো ছেলে যেন কারোর ঘরে না হয় সেই দোয়া করি।
আসছি।

নূর বেরিয়ে যেতেই চোখ খুললো আশমিন। মায়া কাতর চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। আশমিন সেদিকে তাকিয়ে হালকা হাসার চেষ্টা করলো।

আমজাদ চৌধুরী একই ভাবে বসে আছে। কামিনী চৌধুরী এতক্ষণ কাদলেও এখন একেবারে শান্ত হয়ে গেছে।ঝড় আসার আগে পরিবেশ যেভাবে শান্ত হয়ে যায় কামিনী চৌধুরী ও সেভাবে শান্ত হয়ে গেছে। বেড থেকে নেমে বেরিয়ে এলো কামিনী চৌধুরী। আমজাদ চৌধুরী দাঁড়িয়ে আছে তার কেবিনের দরজার সামনে। তার পিছনে মায়া নামক মহিলা দাঁড়িয়ে। কামিনী চৌধুরী ধীর পায়ে হেঁটে আমজাদ চৌধুরীর সামনে দাড়ালো। আমজাদ চৌধুরী তার দিকে তাকাচ্ছে না।নিচের দিকে তাকিয়ে আছে সে।

— আমি হয়তো খারাপ। তবে তোমাকে ভালোবাসার ক্ষেত্রে আমি সম্পুর্ন সৎ ছিলাম আমজাদ। নিজের সবটা দিয়ে ভালবেসেছি তোমাকে। তবে আজ কেন আমাকে এই দিন দেখতে হলো? আমাকে এভাবে ভাঙ্গলে আমজাদ! তুমি আজ সেই কামিনী চৌধুরী কে মেরে ফেলেছো যে তোমাকে নিজের থেকেও বেশি ভালবাসতো। আজ থেকে এই কামিনী চৌধুরীর না কোন স্বামী আছে আর না কোন ছেলে। তোমার নতুন বিবাহিত জীবন সুখের হোক।তুমি সবসময় ই আমার কাছে প্রিয়। তাই তোমার খারাপ চাইতে পারলাম না। ভালো থেকো।

কামিনী চৌধুরী উল্টো ঘুরে যেতে নিতেই আমজাদ চৌধুরী অস্থির হয়ে পথ আগলে ধরলো তার।ব্যগ্র গলায় বলল,

— কোথায় যাচ্ছো? তুমি অসুস্থ কামিনী। বাসায় চলো।রেস্ট নিতে হবে তোমার।

কামিনী চৌধুরী হাসলো। বিদ্রুপের গলায় বলল,

— দেখো কান্ড!অসুখ নিজেই বলে আমাকে সারাও। ভালো মজা করতে শিখেছো তো আমজাদ। যাই হোক, পথ ছাড়ো।ডিভোর্স লেটার সময় মতো পেয়ে যাবে।

আমজাদ চৌধুরী অবাক চোখে তাকালো কামিনী চৌধুরীর দিকে। চোখ দুটো ছলছল করছে তার।কাপা কাপা গলায় বললেন,

— ডিভোর্স!

— তো! তুমি কি ভেবেছিলে?সতিন নিয়ে সংসার করবো আমিজ?(তাচ্ছিল্যের হেসে)।আমি শিকদার বংশের মেয়ে কামিনী শিকদার। ভাগাভাগি আমার ধাতে নেই। যতদিন শুধু আমার হয়ে ছিলে আমি ও শুধু তোমার ছিলাম। আজ যখন ভাগ হয়েছো তখন পুরো তুমি টাকেই দান করে দিলাম।

আমজাদ চৌধুরী অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো কামিনী চৌধুরীর দিকে। কামিনী চৌধুরী একবার মায়ার দিকে তাকিয়ে গটগট করে বেড়িয়ে গেলো।

আশমিন ও আজ বাড়ি ফিরে যাবে।এভাবে সময় নষ্ট করার মতো সময় তার হাতে নেই। সানভি সমস্ত ফর্মালিটি পুরোন করে এসেছে।আশমিন কেবিন থেকে বেরিয়ে আমজাদ চৌধুরীর পাশে এসে দাড়ালো।

— এখানেই থাকাতে চাও?

আমজাদ চৌধুরী কটমট চোখে তাকালো আশমিনের দিকে। আশমিন হালকা কেশে চোখ সরিয়ে নিলো। মায়ার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,

— গাড়ি তে গিয়ে বসুন আন্টি। আমি আব্বুকে নিয়ে আসছি।

মায়া আন্টি মুচকি হেসে চলে গেলো। আশমিন তার বাবার কাছে গিয়ে হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বললো,

— আজ তোমার দ্বিতীয় বাসর রাত উপলক্ষে আমার পক্ষ থেকে ছোট একটা উপহার।যেভাবে দুর্বল হয়ে যাচ্ছো মনে হয় না তোমাকে দিয়ে কিনা হবে।তখন এটা কাজে লাগবে।রুমে যাওয়ার আগে খেয়ে নিয়।

আমজাদ চৌধুরী বাকরুদ্ধ হয়ে দাড়িয়ে রইলেন।রেগে ছেলের গালে চটাস করে একটা চর মারতেও ভুলে গেলেন।সানভি নিজের বুকে হালকা চাপড় মেরে মনে মনে আহাজারি করতে লাগলো। এরকম একটা ছেলে তার ঘরে হলে সে বনবাসে চলে যাবে বলে প্রতিজ্ঞা করে ফেললো।

আশমিন ততক্ষণে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে গেছে।গাড়ি তে বসে মায়া আন্টির সাথে কিছু কথা বলে ফোনে বিজি হয়ে গেলো আশমিন। আমজাদ চৌধুরী হনহন করে এসে গাড়ি তে বসলো।রাগে ফোসফাস করে আশমিন কে বললো,

— তোমার জন্য শেষ বয়সে এসে আমি ডিভোর্স নিতে পারবো না। যা করার তারাতাড়ি করো।

আশমিন অবাক হওয়ার ভান করে বললো,

— তুমি ডিভোর্সি হলে কি রাস্তায় মেয়েরা তোমাকে হেনস্তা করবে নাকি?আর বউ তো একটা জোগাড় করে দিলাম।আর কি চাই?

আমজাদ চৌধুরী উত্তর দিতে ভুলে গেলেন।রাগ গিলে ফেলে চোখ বন্ধ করে মাথা সিটে এলিয়ে দিলেন। সানভি ড্রাইভ করতে করতে আমজাদ চৌধুরীর দিকে অসহায় চোখে একবার তাকালো।আহা! বেচারা।

নূর বাসায় আসার কয়েক ঘন্টা পরেই আশমিন বাসায় এসে উপস্থিত হলো। আমজাদ চৌধুরীর সমস্ত জিনিস নতুন রুমে সিফট করা হয়ে গেছে এর মধ্যে। আশমিন আড় চোখে আমজাদ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে সানভি কে বললো,

— এই রুমটা ফুল দিয়ে সাজিয়ে দাও সান।বাবার বাসরে জেন কোন ত্রুটি না থাকে।আগের বার না জানি কিভাবে কি হয়েছে।আমি থাকলে সব পার্ফেক্ট হতো। এবার তাই সব পার্ফেক্টলি করবে।

আমজাদ চৌধুরী সহ সবাই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। আগের বার থাকলে পার্ফেক্ট হতো মানে!

কামিনী চৌধুরী নিজের রুমে বসে সব শুনে মুচকি হাসলো। বিরবির করে বললো,

— তুমি আমার পেট থেকে হয়েছো।আমি তোমার পেট থেকে হই নি। লেট’স দ্যা গেইম বিগেইন বেট্যা।

আশমিন সরাসরি নূরের রুমে ঢুকলো। নূর শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছে মাত্র।আশমিন কে দেখে যথারীতি বিরক্ত হলো। বাড়িতে এসেও শান্তি নেই। ঠিক এসে হাজির হয়েছে।

— এখানে কি চাই?

— বউ চাই।কাছে এসো।

— বের হন।

নূরের কথাকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে আশমিন নূর কে জরিয়ে ধরলো। নূর কি নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বললো,,

— বাবা দ্বিতীয় বাসর করে ফেলছে।আর আমার এখনো একটা ও হলো না। এটা মেনে নেয়া যায় বলো?তাই আজ বাসর করতে এসেছি।বাবা তোমাকে ননদ দেয়ার আগে আমি তাকে নাতি দয়ে চমকে দিবো। নাহলে নাক কাটা যাবে যে! এতো হ্যান্ডসাম লুক বৃথা হয়ে যাবে বউ।

নূর ক্লান্ত চোখে তাকালো আশমিনের দিকে। আশমিন কে আর কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না। তার এখন ঘুম দরকার।নূর হালকা হেসে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো আশমিনের কাছ থেকে। এক গ্লাস পানি আশমিনের দিকে এগিয়ে দিয়ে শান্ত গলায় বললো,

— পানি খেয়ে নিন।তারপর ঠান্ডা মাথায় কথা বলবো আমরা।

আশমিন ভ্রু কুচকে তাকালো নূরের দিকে। মনে সন্দেহ হলেও মুখে কিছু বললো না। চুপচাপ খেয়ে নিলো পানি। পানি খাওয়ার সাথে সাথে নূর কে কাছে টেনে নিয়ে আদর করতে ব্যস্ত হয়ে পরলো।কয়েক মিনিট যাওয়ার পরেও যখন আশমিন ঘুমিয়ে পরলো না তখন নূর অস্থির হয়ে পরলো আশমিনের কাছ থেকে ছোটার জন্য। নূরের সারা গায়ে নিজের দেয়া চিহ্ন একে দিয়েই বিজয়ের হাসি হাসলো আশমিন। ব্যথায় চোখ থেকে পানি পরছে নূরের।আশমিন বাকা হেসে উঠে দাড়ালো।
নূরের চোখের পানি মুছে দিয়ে দুঃখী দুঃখী গলায় বলল,

— বাবা ছেলের একসাথে বাসর করা টা ভালো দেখায় না।আমরা বরং পরে একসময় ট্রায় করবো হুম।ওহ!তোমার পানির গ্লাসটা আমি সরিয়ে ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখেছিলাম।মন চাইলে খেতে পারো।

নূর কটমট চোখে তাকালো আশমিনের দিকে। আশমিন নূরের লাল হয়ে ফুলে উঠা ঠোঁটে চুমু খেয়ে শিষ বাজাতে বাজাতে চলে গেলো।

চলবে,,,