ইট পাটকেল পর্ব-২৮+২৯

0
1004

#ইট_পাটকেল
#সানজিদা_বিনতে_সফি
#পর্ব_২৮

চৌধুরী গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রির বিলাসবহুল কেবিনে বসে আছে আশমিন। শান্ত মুখে পরাজয়ের ছাপ স্পষ্ট। তার সামনেই আমজাদ চৌধুরী বসে ছেলের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করছে।

— সব কিছু জেনেও এভাবে হাতে হাত রেখে বসে আছো কেন? ও তোমাকে আঘাত করবে আশমিন।বাবা হতে চলেছো তুমি।নিজেদের মধ্যে সবকিছু মিটিয়ে নাও।

আশমিন চোখ তুলে তাকালো আমজাদ চৌধুরীর দিকে। শান্ত গলায় বললো,

— ও আমাকে ঘৃণা করে আব্বু।যতটা ঘৃণা করলে একটা মানুষের হৃদয় ছিন্নভিন্ন করে দেয়া যায় ও আমাকে ঠিক ততটা ঘৃণা করে। আমি প্রতিটি মুহুর্ত তা অনুভব করতে পারি।

— তাহলে কি তুমি এভাবেই সব কিছু চলতে দিবে? রাগের বসে ও যদি নিজের কোন ক্ষতি করে ফেলে?বাচ্চার সাথে ও তো কিছু করে ফেলতে পারে।যে তোমাকে ঘৃণা করে সে তোমার বাচ্চাকে ও তো ঘৃণা করবে।বুঝতে পারছো আমি কি বলছি?(অস্থির হয়ে)

আমজাদ চৌধুরীর অস্থিরতা দেখে মুচকি হাসলো আশমিন। চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে শান্ত চোখে তাকালো তার বাবার দিকে।

— ভুল ভাবছো তুমি আব্বু।ও কখনো আমাদের সন্তানের কোন ক্ষতি করবে না। ও আমার একার সন্তান না।ও নূরের ও সন্তান।আমি হয়তো এখনো ওকে অনুভব করতে পারি নি।কিন্তু নূর প্রতি মুহুর্তে ওকে অনুভব করছে। একজন মা কখনো তার সন্তানের ক্ষতি চাইতে পারে না।আমার প্রতি যতই ঘৃণা থাকুক না কেন,নিজের সন্তান কে অবহেলা করবে না ও। আর আমার প্রতি ঘৃণা টা কি অযোক্তিক আব্বু?

আমজাদ চৌধুরী চুপ হয়ে গেলেন। নিজেকে তার খুব অসহায় মনে হচ্ছে। রাফসান শিকদার ভুল ছিল।সে ইচ্ছে করে কামিনীর স্বামী কে মারে নি। ওটা একটা দূর্ঘটনা ছিল। এক প্রতিশোধের জন্য কামিনী নূরের মা কেও মেরে ফেলেছে। এর পরেও সে থেমে থাকে নি।রাফসান চৌধুরী কে ও ছাড়েনি সে। নূরের মায়ের এখানে কোন দোষ ছিল না। সে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চেয়েছিল।কামিনী কে রাফসান শিকদারের কথা মেনে নিতে বলেছিল যাতে পরবর্তীতে রাফসান শিকদার কে বোঝানোর কিছুটা সময় পায়।কিন্তু বরাবর উগ্র মেজাজের কামিনী তাকেই আঘাত করে বসলো।পরিস্থিতি খারাপের দিকে একমাত্র কামিনী চৌধুরীর ঔদ্ধত্যের কারনে গিয়েছে। সে কামিনী কে বিয়ে করেছে তাকে আগলে রাখার জন্য। তার প্রখর ভালবাসা কামিনী বারবার উপেক্ষা করে গিয়েছে। কামিনী চৌধুরী যে তাকে ভালবাসে না তা কিন্তু না। কিন্তু তাদের মাঝে সারাজীবন দেয়াল হয়ে রয়ে গেলো তার প্রাক্তন। কামিনী চৌধুরীর প্রত্যেক টা অন্যায় জানার পর বারবার মুষড়ে পরেছেন।বাধা দিতে গিয়ে তার রোষানলে পড়তে হয়েছে।প্রচন্ড ভালবাসার কারণে আইনের হাতে তুলে দিতে পারেনি।আজ তার প্রখর ভালবাসা ই কাল হয়ে দাড়ালো। তার আবেগে ভেসে যাওয়ার কারনেই এতো গুলো জীবন নষ্ট হয়ে গেলো।

— বাসায় যাও আব্বু। সব কিছুর উর্ধ্বে আমি নূর কে ভালবাসি।ও আমাকে ঘৃণা করুক বা ভালবাসুক। আমার সাথেই ওকে থাকতে হবে। এই জীবনে ওর আমি থেকে মুক্তি নেই।

আমজাদ চৌধুরী মাথা নাড়িয়ে সায় জানালেন।কামিনী চৌধুরী ফিরে এসেছে কানাডা থেকে।আমজাদ চৌধুরী আমতা আমতা করে বললো,

— তোমার আম্মু যদি,,

আশমিন ঠান্ডা চোখে তাকালো আমজাদ চৌধুরীর দিকে। হিমশীতল গলায় বলল,

— নিজের বউ সামলে রেখো আব্বু।আমি মানুষ টা মোটেও সুবিধার নয়। প্রচন্ড স্বার্থপর মানুষ আমি।আমার স্বার্থে আঘাত লাগলে কেউ ছাড় পাবে না।

আমজাদ চৌধুরী ভয়ার্ত চোখে তাকালো আশমিনের দিকে। ছেলে কতটা সিরিয়াস তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আমজাদ চৌধুরী ঘাড় নেড়ে চলে গেলেন।

আশমিন উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সামনের দেয়ালের দিকে। সে কোন ভুল করে নি।সেদিক থেকে বিবেচনা করতে গেলে নূর ও কোন ভুল করছে না।তাহলে ভুলটা কার?বুকের ভিতর অস্থিরতা শুরু হয়ে গেলো আশমিনের।নিজের অস্থিরতা কমাতে তার বউ দরকার। অস্থির পায়ে অফিস থেকে বেরিয়ে গেল আশমিন। না জানি বউ তার বিরুদ্ধে কি ষড়যন্ত্র করছে।তাই বলে সে তো আর তাকে একা ছেড়ে দিতে পারেনা।

সাত মাসের পেট নিয়ে অফিসে এসেছে নূর। এই কয়েকমাসে তার বিশ্বস্ত কয়েকজন খু*ন হয়েছে।দুটো পোশাক কারখানায় আগুন লেগেছে।রাতের আধারে কেউ ইচ্ছাকৃত ভাবেই যে সব করেছে তা সে জানে। মেশিন সব পুড়ে গেলেও মাল সব অক্ষত ছিল। প্রতিদিনের মালামাল সবার অগোচরে নূর কারখানা থেকে সরিয়ে ফেলতো। কয়েক কোটি টাকার মাল বেচে গেলেও মেশিন গুলো আর বাচাতে পারে নি।ক্ষতির পরিমান টা তাই একটু কম হয়েছে। তাই প্রতিটি কারখানায় কড়া নজরদারির ব্যবস্থা করেছে নূর।নিজেই সব মনিটরিং করছে। আশমিন বাধা দিলেও আমলে নেয়নি। বাড়িতে থাকা এখন তার জন্য আরো বেশি অনিরাপদ। কামিনী চৌধুরী কখন কিভাবে তার ক্ষতি করে ফেলবে তার নিশ্চয়তা নেই।

— আসবো ম্যাম,,

নূর ল্যাপটপ থেকে চোখ তুলে তাকালো। অমি ক্লান্ত চোখে দাঁড়িয়ে আছে দরজায়।

— না। আসবে না। কতো বার ম্যাম বলতে নিষেধ করেছি?

অমি বোনের অভিমান দেখে মুচকি হাসলো। দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে চেয়ারে বসতে বসতে বললো,

— আপনি সব সময় আমার ম্যাম হয়েই থাকবেন। আমি এতেই কমফোর্ট ফিল করি।

নূর মুখ ফুলিয়ে নিশ্বাস ছাড়লো।

— আচ্ছা সেসব বাদ দাও।কাজ হয়ে গেছে?

— হুম।আশিয়ান এসেছিল। সব স্বিকার করেছে সে।

নূর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। চোখ বন্ধ করে গা এলিয়ে দিলো। শরীর টা ইদানীং খুব খারাপ যাচ্ছে। পা গুলো অসম্ভব ফুলে উঠেছে।রাতে ঘুম হয় না ভালো করে। আশমিন ও তার সাথে জেগে থাকে।তার মন ভালো করার চেষ্টা করে। নূর কিছু নিয়ে আবদার করে না আশমিনের কাছে। যা দরকার হয় নিজেই করে নেয়। এর জন্য আশমিনের অভিযোগের শেষ নেই।

— শরীর খারাপ লাগছে ম্যাম?

— নূর মাথা নেড়ে সায় জানালো। অমি অস্থির হয়ে নূরের কাছে গেলো। পাশের কেবিন থেকে লুবানাও ছুটে এসেছে।নূরের কেবিন আর লুবানার কেবিনের মাঝে গ্লাসের দেয়াল থাকায় লুবানা স্পষ্ট সব দেখতে পায়।

নূর অস্বাভাবিক ভাবে ঘামছে। লুবানা পানি এগিয়ে দিলো নূরের দিকে। এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিলেও নূরের অস্থিরতা কমছে না। অমি চিৎকার করে নূর কে বুকের সাথে চেপে ধরলো। অস্থির গলায় লুবানা কে বললো,,

— তারাতাড়ি ডাক্তার ডাকো লুবানা।

নূর জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে ততক্ষণে। অমি পাগলের মতো ডেকে চলেছে তাকে।

— নূর,,কি হয়েছে বোন।চোখ খোল।কোথায় খারাপ লাগছে আমাকে বল। আল্লহ! নূর চোখ খুলছেনা কেন? (অস্থির হয়ে)

— ডাক্তার চলে আসবে স্যার।আমি কল করে দিয়েছি।

লুবানা ভয়ে ঘেমে গিয়েছে।নূরের অবস্থা দেখে তার আত্মা কাপছে। আশমিন জানতে পারলে তাকে আর আস্তো রাখবে না।

— নূর!!

আশমিন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে নিস্তেজ নূরের দিকে। অমির কান্নারত চেহারা দেখে তার বুক কেপে উঠলো। দ্রুত পায়ে এসে নিজের বুকে আগলে নিলো নূরকে।

— কি হয়েছে নূরের? ও কথা বলছে না কেন?

আশমিনের রক্তিম চোখ দেখে দুজনেই কেপে উঠলো। আশমিন দেড়ি না করে নূর কে কোলে তুলে পাশের রুমে নিয়ে শুয়িয়ে দিলো। চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে দিয়ে ও যখন নূরের জ্ঞান ফিরলো না তখন শুরু হলো তার পাগলামি। ভয়ে তার বুক কাপছে। আশমিন জায়িন চৌধুরীর বুক কাপছে!

দুই মিনিটের মধ্যে ই ডাক্তার চলে এসেছে।আশমিন নূর কে এক মুহুর্তের জন্য ও ছাড়েনি। নূরের মাথা টা নিজের বুকের সাতগেই চেপে ধরে ছিল।ডাক্তার নূর কে চেকআপ করে বললো,

— অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার কারনে জ্ঞান হারিয়েছে। ঠিক ভাবে খাওয়া দাওয়া ও করে না হয়তো। শরীর খুব দুর্বল। রক্ত শূন্যতা ও থাকতে পারে। এই সময় এগুলো ভালো লক্ষণ নয়। বেশি বেশি পুষ্টিকর খাবার খাওয়াবেন। টেনশন ফ্রী রাখার চেষ্টা করবেন সব সময়। এমন চলতে থাকলে দুজনের জন্যই খুব রিস্ক হয়ে যাবে।

ডাক্তার কিছু ঔষধ প্রেসক্রাইব করে দিলেন। অমি দ্রুত পায়ে চলে গেলো ঔষধ আনতে।আশমিন চুপ করে বসে আছে। রাগে তার মাথা ফেটে যাওয়ার অবস্থা। লুবানার দিকে অগ্নি চোখে তাকাতেই লুবানা কান্না করে দিলো।

— আমি খুব চেষ্টা করেছি স্যার।ম্যাম আমার কোন কথা ই শুনে না।আপনাকেও কিছু বলতে দেয় না।আমি কি করবো বলুন?

আশমিন কিছু বললো না। তার এখন কোন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। ডাক্তার সেলাইন দিবে নূর কে।ডাক্তার কে নূর মঞ্জিলে আসতে বলে আশমিন নূর কে কোলে নিয়ে বেরিয়ে গেল। লুবানা আর ডাক্তার ও তার পিছনে ছুটলো।

— ভাইয়া আপনি ঔষধ নিয়ে বাসায় চলে আসুন।আমরা ম্যাম কে নিয়ে বাসায় যাচ্ছি।

অমি আচ্ছা বলে কল কেটে দিলো। টেনশন হচ্ছে তার।তারাতাড়ি বাসায় পৌছাতে হবে।

চলবে,,

#ইট_পাটকেল
#সানজিদা_বিনতে_সফি
#পর্ব_২৯

শুভ্র পাঞ্জাবি ছেড়ে সাদা টি-শার্ট পরে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েছে আশমিন।চুল থেকে টপটপ করে পানি পরছে। শরীরের থেকে তার মনের ক্লান্তি বেশি।নূর গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে।আধঘন্টা আগে স্যালাইন শেষ হয়েছে।এতক্ষণ সে নূরের হাত ধরেই বসে ছিল। নূরের দিকে তাকালে তার নিজেকে অপরাধী মনে হয়। মাথা ভালো করে মুছে টাওয়াল বেলকনিতে দিয়ে এলো আশমিন। নূরের দিকে নির্মিশেষে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। যতই দেখুক না কেন,চোখের তৃষ্ণা মেটে না।নূরের ফোলা পেটের দিকে তাকিয়ে হালকা ঢোক গিললো আশমিন।তাকে পুড়িয়ে ছাই করার অস্ত্র এই ছোট্ট পেটে লুকিয়ে আছে। এখনি সে নিজের করুণ পরিস্থিতি অনুভব করতে পারছে।মনে মনে চিৎকার করে উঠলো আশমিন।তার এতো পরিশ্রমের ফল নিয়ে নূর বাহাদুরি করবে ভাবতেই মুখটা শুকিয়ে গেলো। এক পুকুর কষ্ট নিয়ে নিজেকেই গালাগালি করতে লাগলো, কি দরকার ছিল এতো মেহনত করার? হলো তো এবার! বউ তোমার মেহনত দিয়েই তোমার থোতা মুখ ভোতা করে দিবে।খুশি?

আহ! কি দিন আসলো। এই দিন দেখার জন্য ই সে অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে। আশমিন ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো নূরের দিকে। হালকা ঝুকে পেটে কয়েকটা চুমু খেয়ে ফিসফিস করে বললো,

— মায়ের কথায় কান দেয়ার কোন দরকার নেই। তোমার বাবা খুব ভালো মানুষ। ফুলের মতো পবিত্র। বাবার পক্ষে থাকবে সবসময়। তাহলে চকলেট আইসক্রিম পাবে। এটা আমাদের গোপন ডিল।কাউকে বলবে না। ইটস ভেরি কনফিডেনসিয়াল।

আরেকটা চুমু খেয়ে বিজয়ী হাসি হাসলো আশমিন। ডিল করা শেষ। বউ টা ঝামেলা না পাকালেই হয়। এবার ঝামেলা মিটে গেলেই সে তওবা করে ফেলবে।এই জীবনে ডায়েরি নামক কোন বস্তু সে হাতে নিবে না।এতো বছরের গভীর সম্পর্ক থাকার পরেও বউয়ের কাছে ধরা খাইয়ে দিল। মীরজাফর।
নূরের পাশেই শুয়ে পরলো আশমিন।শরীর মন দুটো ই খুব ক্লান্ত। নূর কে বুকের সাথে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করলো। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়া জরুরি হয়ে গেছে।

রাত দশটায় পিটপিট করে চোখ খুললো নূর।মাথা টা ভার হয়ে আছে। কারো শক্ত বাহু বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আছে। কয়েক বার চোখের পাতা ঝাপটে ভালো করে তাকানোর চেষ্টা করলো নূর। হালকা ডিম লাইটের আলোতে আশমিনের মুখ দেখে ভ্রু কুচকে ফেললো। চারিদিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো সে কোথায় আছে। নূরের নড়াচড়ায় আশমিনের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। নূর কে আরেকটু শক্ত করে জরিয়ে ধরে ঘুম জড়ানো গলায় বলল,

— মোচড়ামুচড়ি করছো কেন? আমি কি তোমাকে চিমটি দিয়েছি?

— আমি এখানে এলাম কিভাবে(ভ্রু কুচকে)

— তোমার একমাত্র বরের কোলে চেপে। তোমার বর টা যে কি রোমান্টিক না। আহা! ভাবতেই তো হিংসা হয়।

নূর আশমিনের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। আশমিন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে বসলো।ইন্টারকম থেকে কল করে তাদের খাবার উপরে পাঠিয়ে দিতে বললো। এক কাপ কফি হলে ভালো হতো। মাথা টা ভার ভার লাগছে। বেড থেকে নেমে নিজের স্টাডি টেবিলের কাছে থাকা কফি মেকার থেকে কফি নিয়ে সোফায় বসতেই ওয়াশরুম থেকে নূর বেরিয়ে এলো। টাওয়ালে মুখ মুছতে মুছতে আশমিনের দিকে আড় চোখে তাকালো। আশমিন তার দিকেই তাকিয়ে আছে। নূর টাওয়াল নিয়ে বারান্দায় চলে গেলো। আশমিন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকিয়ে আছে।

আকাশে মেঘের ছড়াছড়ি। কালো মেঘের ফাকে ফাকে বিদ্যুতের ঝলক মাঝে মাঝে পরিবেশ কে আলোকিত করে তুলছে। আশমিনের বারান্দা টা নূরের বারান্দার মতো। বারান্দার পাশেই সুইমিংপুল। ছোট বেলায় বাবার সাথে এখানে কতো সাতার কেটেছে নূর।রাফসান শিকদার নিজে তাকে সাতার শিখিয়েছে। বাবার কথা মনে হতেই চোখ থেকে কয়েক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরলো।

— ভিতরে এসো নূর।খেতে হবে তোমার।মেডিসিন আছে।

রুম থেকে আশমিন ডাকছে। নূর নিজেকে সামলে ভিতরে গেলো। আশমিন টেবিলে খাবার সাজিয়ে ফেলেছে।
নূর মুচকি হেসে চেয়ার টেনে বসে পরলো। ব্যাঙ্গাত্মক গলায় বলল,

— এতো আদর করে খাবার খাওয়াচ্ছেন যে বড়।বিষ টিস মিশিয়ে দিন নি তো আবার?

আশমিনের হাত থেমে গেলো। শান্ত চোখে কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে রইলো নূরের দিকে। নূর খাওয়া শুরু করে দিয়েছে ততক্ষণে। আশমিনের বুক ভাড় হয়ে এলো। এতো অবিশ্বাস! হওয়ারই কথা। বিশ্বাস করার মতো কিছু করেনি সে।

— আমার বাবা কে কেন মারলেন মন্ত্রী সাহেব?

আশমিন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নূরের দিকে। নূর নিজের মতো খেয়ে যাচ্ছে। আশমিন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

— দরকার ছিল।সে আমার বাবার খু*নি।আমি সহ্য করতে পারিনি নূর। তাকে মারতেই আমি বাংলাদেশ এসেছিলাম। রাজনীতি তে জরিয়ে যাওয়া আমার পূর্ব পরিকল্পনা ছিল। ঠিক ভুল বিচার করার অবস্থায় ছিলাম না নূর।বিশ্বাস করো আমাকে।

আশমিনের কাতর গলা শুনে হাসলো নূর। ঘাড় নেড়ে কয়েক বিশ্বাস শব্দটা কে আওরালো।

— আপনি কি বিশ্বাসের যোগ্য মন্ত্রী সাহেব? আপনার পুরো পরিবার বিষাক্ত সাপের মতো। যত্ন করে বুকে আগলে রাখলেও বুকে কামড়ে দিতে এক বার ও ভাবে না। তা আমাকে কবে মারবেন? আমি ই তো এই পরিবারের শেষ সদস্য। একজনের মৃত্যুর বদলা কতোবার নিলেন মন্ত্রী সাহেব। আমার মা কে মারলেন।আমাকে অত্যাচার করলেন। ভালবাসার অভিনন্দন করলেন।আমার বাবা কে মারলেন। আচ্ছা আমি যদি প্রতিশোধ নিতে যাই তখন কি হবে মন্ত্রী সাহেব?

আশমিন অনুভূতিহীন চোখে তাকিয়ে আছে নূরের দিকে। নূর নিজের খাওয়া শেষ করে উঠে গেলো। আশমিন থম মেরে বসে আছে। সে তো এটা ও বলতে পারবে না যে রাগের বসে সে রাফসান শিকদার কে খু*ন করেছে।সে যা করেছে সব ঠান্ডা মাথায় করেছে। তবে নূর কে সে ভালবেসেই বিয়ে করেছে।সেখানে বিন্দুমাত্র অভিনয় ছিল না। আশমিন জানতো না কামিনী চৌধুরী নূরের মা কে খু*ন করেছে।নূরের উপর হওয়া অত্যাচার সম্পর্কে ও তার কোন ধারণা ছিল না।এসব কিছু সে নূর চলে যাওয়ার পরে জেনেছে। কিন্তু তখন আর তার হাতে কিছুই করার ছিল না।

নূর নিজের ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে।আশমিন আগের মতোই খাবার সামনে বসে আছে। একবার ও খাবার মুখে দেয়নি সে। আশমিন ধীর পায়ে উঠে স্টাডি টেবিলের প্রয়াত থেকে নিজের গান বের করলো। এলোমেলো পায়ে এসে নূরের দিকে গান এগিয়ে ফিয়ে ধীর গলায় বলল,

— তুমি ও তোমার বাবার খু*নি কে মেরে ফেলো নূর। নিজের প্রতিশোধ নিয়ে নাও।

নূর শব্দ করে হেসে ফেললো। আশমিনের হাত থেকে গান নিয়ে তার মুখোমুখি দাড়ালো।

— মারবো কেন মন্ত্রী সাহেব? আমি তো আপনাকে বাচিয়ে রাখবো। বলেছিলাম না,আমাকে ধোকা দিলে আমি আপনাকে পৃথিবীতেই জাহান্নাম ঘুরিয়ে আনবো। আমি তো আপনাকে ভালবাসি বলেন। ভালবাসার মানুষ কে মে*রে ফেলা যায় বুঝি?

আশমিন স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো। যাক, এ যাত্রায় বেচে গেছে।তবে বাঘিনী যে মনে মনে কোন ভয়ংকর ছক কষছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। দোষ না করেও সব দোষ নিজের ঘাড়ে নিতে হচ্ছে । ম আর মাত্র কয়েকটা মাস।একবার নূরের মায়ের সঠিক ঠিকানা জানতে পারলে কামিনী চৌধুরী কে কবরে বসে বরের সাথে লুডু খেলার ব্যবস্থা করে দিবে। জ্বালিয়ে খেলো।

আশমিন নিজের জান হাতে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। তার সন্তান পৃথিবীতে আসার আগেই সব ঠিক করতে হবে। নূর কে এসবে জরানো যাবে না কোনভাবেই। কামিনী চৌধুরী কে বোঝাতে হবে সব কিছু তার প্ল্যান মতো ই হচ্ছে।

দরজার সামনে আশমিন কে চিন্তিত মুখে দাড়িয়ে থাকতে দেখে আমজাদ চৌধুরী কপাল কুচকে ফেললো।

— রুম থেকে বের করে দিয়েছে?(ভ্রু কুচকে)

— আমি তোমার একটা বউ কে খু*ন করতে চাইছি।তাই আগে ভাগেই আরেকটার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। বউয়ের মতো আমার হাড় না জ্বালিয়ে বলে দাও মামুনি কে তোমার বউ কোথায় আটকে রেখেছে?

আমজাদ চৌধুরী আকাশ থেকে পরলো।অবাক গলায় বলল,

— নূরের মা বেচে আছে?

— একদম ঢঙ করবে না। সব জানো তুমি। ব্ল্যাকমেইল করে আমাকে নূর থেকে দূরে সরিয়ে দেয়েছে। এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বউয়ের কাছে অপরাধীর মতো দাড়াতে হচ্ছে। মেন্টাল স্ট্রেস নিতে নিতে যদি আমার বউয়ের কিছু হয় তাহলে তোমার বউ কে আমি ভয়ংকর মৃ*ত্যু দিবো। সে মা কেন মানুষ হওয়ার ও যোগ্য নয়।মেন্টালি সিক সে। মামা কে সে নিজের হাতে মেরেছে আব্বু। তার পরেও কেন এতো ষড়যন্ত্র? আমাদের কে একটু শান্তি তে বাচতে কেন দিচ্ছে না? তার পার্টনার কে সহ তাকে জ্যান্ত যদি না জ্বালিয়েছি আমার নাম ও আশমিন জায়িন চৌধুরী না।

আমজাদ চৌধুরীর মন টা কামিনী চৌধুরীর প্রতি বিষাক্ত অনুভূতি তে ভরে গেলো। কামিনী কি পারতো না সব ভুলে তাকে নিয়ে সুখের একটা সংসার সাজাতে। রাফসান শিকদার কে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে দিলে আজ এই দিন দেখতে হতো না। সব কিছু বিষিয়ে দিয়েছে সে।

গার্ড ছাড়া গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পরেছে আশমিন।সেবার কানাডা গিয়ে তন্নতন্ন করে খুজেছে নূরের মা নাফিজা শিকদার কে। ফলাফল শূন্য। কামিনী চৌধুরীর উপর বাজ পাখির মতো নজর রেখেছে সে।আশিয়ান ডুবাই গিয়ে বসে আছে। এই বজ্জাত কে হাতে পেলে আস্তো রাখবেনা সে।সানভি বিরস মুখে বসে আছে আশমিনের পাশে।আশমিন কে বের হতে দেখে সে ও পিছু নিয়েছে।

— শোন সান,বিয়ে করলেই হুট করে বাবা হওয়ার চিন্তা মাথায় আনবে না।এটা একটা ভুল সিদ্ধান্ত।সব সময় পরিশ্রম সৌভাগ্যের চাবিকাঠি হয় না। কখনো কখনো বাশ ও হয়ে যায়। ইউ শুড ইউজড প্রোটেকশন। আমি বিয়ের আগেই তোমাকে দিয়ে দিবো। আচ্ছা বাদ দাও।তোমার বিয়ে ই করার দরকার নেই। বুঝেছো?

সানভি দুঃখী দুঃখী চেহারা করে মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। এমনি চলতে থাকলে তার বিয়ে করার স্বাদ এমনিতেই মিটে যাবে।

চলবে