ইতির সংসার পর্ব-২৫+২৬

0
240

#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#ইতির_সংসার
পর্ব ২৫

নার্স এসে নাঈমকে ওটির ভিতরে নিয়ে যায়। সেখানে একটা টেবিলে ডাক্তার ম্যাম বসা, অপর পাশে একটা খালি চেয়ার দেখিয়ে নাঈমকে বসতে বলেন। নাঈম উৎকন্ঠিত হয়ে জানতে চায় কেন ওকে ডেকেছে। ডাক্তার জানায় ইতির বাচ্চা মিসক্যারেজ হয়ে গেছে কিন্তু তার চেয়েও যেটা ভয়াবহ সেটা হল ইতির জরায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ব্লিডিং যদি বন্ধ না হয় তাহলে জরায়ু ফেলে দিতে হবে। ফলশ্রুতিতে ইতি আর কোনদিন মা হতে পারবেনা।

নাঈম ডুকরে কেঁদে উঠে ডাক্তারের কথা শুনে। পাগল পাগল লাগে ওর নিজেকে। কোনমতে শুধু বলে -“ইতিকে বাঁচিয়ে রাখতে যা করা লাগে করবেন আর সেটা ওকে আপনিই জানিয়ে দিবেন, আমার সাহস নাই ওকে এই সত্যটা বলার।”

ওটির বাইরে এসে নাঈম ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরে শিশুর মতো কাঁদতে থাকে। ইতির বাবা কিছু না বলে চলে যান মসজিদে। সিজদায় পড়ে রবের কাছে চাইতে থাকেন কন্যার মাতৃত্ব। ইতির মা পাথরের মতো হয়ে যান। অনুভূতি নাই শুধু নাজমা বেগমের।

অনেকক্ষণ পরে ইতিকে পোস্ট অপারেটিভে নেয়া হয়। আরো ডোনার যোগাড় করতে বলে কারণ এদিক দিয়ে র/ক্ত দেয়া হচ্ছে, ওদিক দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। ডাক্তার র/ক্ত বন্ধের জন্য সবরকমের ঔষধ দিয়েছেন। তারপরও কমছেনা কিছুতেই, এখন শুধুমাত্র আল্লাহ ভরসা।

নাঈম ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে ও সকল পরিচিতদের ফোন দিয়ে ১৮ জন ডোনার যোগাড় করে। কিন্তু এতোকিছুর পরেও ইতিকে ধীরে ধীরে নিস্তেজ হতে দেখে নাঈম ডাক্তারকে বলে দেয় -“যা করা লাগে করেন শুধু ইতিকে বাঁচান।”

নাঈমের থেকে বন্ড সই করে নিয়ে ইতিকে আবারও ওটিতে নেয়া হয়। এর মধ্যে খাদিজা বেগম রান্না করে এনে সবাইকে জোর করে খাওয়ান। নাঈমের কাঁদতে কাঁদতে গলা বসে গেছে। উনি নাঈমের পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন -“বাবা, যে কান্নাটা তুমি আমাদের সামনে কাঁদছ সেটা তুমি আল্লাহর কাছে কাঁদো প্লিজ। শুধুমাত্র উনিই পারেন মিরাকল ঘটাতে। আমাদের কি ক্ষমতা আছে বল?”

নাঈমের মধ্যে ভাবান্তর হয় এই কথায়। সে মসজিদে গিয়ে ওজু করে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে চোখের পানি ছেড়ে দেয় আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে। মনের যা কষ্ট সব জানিয়ে আল্লাহর কাছে স্ত্রীর সুস্থতা ও জীবন ভিক্ষা করে নাঈম। আল্লাহ সাড়া দেন ওর ডাকে। ব্লি/ডিং স্বাভাবিক হয়ে আসে হঠাৎই। স্বাভাবিক অবস্থা দেখে ডাক্তার আর জরায়ু ফেলে দেয়না। আবারও পোস্ট অপারেটিভে নেয়া হয় ইতিকে। ডাক্তার ইতিকে খুবই সাবধানে থাকতে হবে জানিয়ে দেন সবাইকে।

নাঈমের অফিসের কর্তাব্যক্তিরা এসে দেখে যান ইতির অবস্থা। ডাক্তারের সাথে কথা বলে ওদের এমডি নাঈমের জন্য বিনাসুদে ঋণ মঞ্জুর করেন। চিকিৎসার জন্য যা লাগে করতে বলেন, সব টাকা অফিস থেকে পরিশোধ করা হবে। নাঈমের বেতন থেকে মাসে মাসে কেটে নেয়া হবে। নাঈমের ৭ দিনের ছুটিও মঞ্জুর করে যান এমডি।

নাঈম সারাক্ষণ ইতির হাত ধরে ইতির পাশে বসে থাকে। সেদিন পোস্ট অপারেটিভে আর কোন রোগী না থাকায় নাঈমকে ইতির সাথে থাকার অনুমতি দেন ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ। পরদিন সকালে ইতিকে কেবিনে শিফট করা হয়, তখনও ইতির জ্ঞান পুরোপুরি আসেনি। আধোঘুম আধোজাগরণেই কেঁদে উঠে ইতি।নাঈম ওর মাথায় হাত বুলিয়ে জানতে চায় কি হয়েছে?

ইতি বাচ্চার কথা জিজ্ঞেস করে। নাঈম উত্তর খুঁজে পায়না। অসহায়ের মতো তাকায় সবার দিকে। সবাই মাথা নিচু করে থাকে। খাদিজা বেগম এগিয়ে এসে বসেন ইতির পাশে। কপালে চুমু দিয়ে আদর করে বলেন -“মা জানো, আল্লাহ তোমার জন্য জান্নাতে ঘরের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তোমার বাবুটা তোমার জন্য জান্নাতে অপেক্ষা করছে মা। তুমি যদি কান্নাকাটি কর তাহলে ও জান্নাত থেকে দেখেই কষ্ট পাবে। তোমাকে ধৈর্য ধরতে হবে মা। আমি জানি ধৈর্য ধরা অনেক কঠিন কাজ, কিন্তু এটাও জানি আমাদের ইতিমনি অনেক শক্ত মেয়ে। কত কত ঝড় পাড়ি দিয়েছে আমাদের মেয়েটা। তুমি জানো যাদের বাবুকে আল্লাহ নিয়ে যায় আর তারা ধৈর্য ধরে থাকে তাদের জন্য আল্লাহ জান্নাতের ওয়াদা করেছেন। ধৈর্য ধর সোনা মা আমার।” বলে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নেন ইতিকে। ওর কান্না আটকানোর কাঁপন টের পান বুকের মধ্যে। ইতির মা, নাঈম বের হয়ে যায় কেবিন থেকে নিজেদের কান্না ইতিকে না দেখাতে।

নাঈম ধাতস্থ হয়ে এসে ইতির হাত ধরে বলে -“আমি শুধু আল্লাহর কাছে তোমাকেই ফিরে চেয়েছি ইতু। আল্লাহ আমার ডাক শুনেছেন। তোমাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন আমাদের কাছে। আর কিছু চাইনা। তুমি শান্ত হও ইতু প্লিজ। তুমি শান্ত হও।”

ইতি কিছুটা শান্ত হয়ে এলে দুপুরের ওষুধ খাওয়ানোর সময় হলে ইতির মা জাউ ভাত মাখিয়ে ইতিকে খাইয়ে দিতে যান। এক গ্রাস খাবার মুখে নিয়েই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে ইতি। ওর মা আদর করে দিয়ে কান্নার কারন জিজ্ঞেস করলে বলে -“এইযে তুমি কত সুন্দর তোমার সন্তানকে খাইয়ে দিচ্ছ। আমিতো পারবোনা মা। আল্লাহ আমাকে কেন এতো কষ্ট দিলেন মা? আমি কি পাপ করছি মা?”

ইতির মা মেয়ের চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলেন -“মামনি আল্লাহ যাকে ভালোবাসেন তাকে কষ্ট দু:খ দিয়ে দিয়ে খাঁটি করে নেন। দেখেন এসব কষ্টে তার আল্লাহর উপর ভরসা আছে কি না? নাকি তারা আল্লাহর উপর ভরসা হারিয়ে ফেলেন। আমার সোনামানিক এখন এসব নিয়ে মন খারাপ করিওনা প্লিজ। জানি এই কষ্টে স্বান্তনা দেয়ার মতো কোন কথা নাই কিন্তু একটা কথাই বলব আল্লাহর উপর ভরসা করে ধৈর্য ধর মা। আল্লাহই তোমাকে এই ধৈর্যের প্রতিদান দিবেন ইনশাআল্লাহ। দেখ মা, তোমার বিয়ের আগে যখন তোমার সব বান্ধবীরা একের পর এক রিলেশন করত তখন আমি তোমাকে বলেছিলাম ধৈর্য ধরে আল্লাহ তোমার জন্য যাকে নির্ধারণ করেছেন তার অপেক্ষা করতে কারণ আল্লাহ তার পাক কালামে বলেছেন আমি উত্তম নারীদের জন্য উত্তম পুরুষ আর অধম নারীদের জন্য অধম পুরুষ নির্ধারণ করেছি। দেখ আল্লাহ তোমার ধৈর্যের ফল হিসেবে নাঈমের মতো একজন স্বামী দিয়েছেন, যে তোমাকে এতো ভালোবাসে।”

-“ঐটা তো একটা ছাগলের বাচ্চা। সারাদিন ম্যা ম্যা করে। আমার কোন দিকটা সে বুঝল? আজ আমার এই অবস্থার জন্য দায়ী তো ওর মা আর বোন।” রাগে ফুঁসে ওঠে ইতি। ওর মা খাইয়ে দিয়ে ওষুধ খাইয়ে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে দেন।

বিকেলে ইতি ঘুম ভেঙে দেখে তুলি আর নাজমা বেগম বসে আছে সবার সাথে। তুলিকে দেখেই ইতি চিৎকার দিয়ে উঠে -“এই খু/নী কেন আসছে? আমার সন্তানকে এই খু/ন করছে। আমি বলছি তুলিই আমার সন্তানের খু/নী।” বলতে বলতে হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মতো হাঁপাতে থাকে।

নাঈম এসে ওকে ধরে বলে -“কি বলছ তুমি ইতি? কি হইছে আমাকে খুলে বল। আমি নিজেও জানতে চাই। আমি তোমাকে সুস্থ অবস্থায় রেখে কাজে গেলাম। এরমধ্যে কি ঘটল যে আমাদের সন্তানহারা হতে হল। তুলি তুই কি করছিস বল? না আগে ইতি তুমি বল।”

-“নাঈম তুমি সকালে যখন অফিসে যাও তখন কি ওয়াশরুমে পানি ছিল?” ইতির প্রশ্ন।

-“হ্যাঁ ছিল তো। আমি সকালে যাওয়ার আগে ট্যাং/ক ফুল করে রেখে গেছিলাম।” নাঈমের উত্তর।

-“আমি ১০টায় ঘুম থেকে উঠি। তখন এক ফোঁটা পানি ছিলনা। পানির মেশিন ছাড়তে যাই, দেখি মেশিন নষ্ট। তুলিকে বললাম ওর মায়ের ওয়াশরুম থেকে এক বালতি পানি এনে দিতে, দিলনা। জানোই তো ওখানে ড্রাম ভরে পানি রাখে। উল্টো আমাকে বলে আসছে জমিদার, আমার ঠ্যাকা তার টয়লেট যাওয়ার পানি এনে দেই। বলে কানে হেডফোন লাগিয়ে ঘরে যায়। তোমার মা বাসায় ছিলনা। বাবাও বাজারে গেছিলেন। আমি টিউবওয়েল থেকে পানি আনতে যাই। দেখি কলপাড়ে আধলা গুলো নড়তেছে। তারপরও সাবধানে ছোট এক বালতি পানি তুলে নিয়ে আসতে গেছি, পায়ের নিচের আধলা ডেবে গেল আর আমি তাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেলাম। আমার বাচ্চাটা চলে গেল। এতোদিন কিছু হলোনা আর তোমার বোন আসল তার পরদিনই এমন হল? কাকতালীয় বলতে চাও? আমার বাবু হবার খবরে সবাই খুশি কিন্তু তোমার মা বোনের মুখে কখনো খুশির লেশ দেখছ?” বলতে বলতে চিৎকার করে উঠে আর আবারও ফিনকি দিয়ে ব্লি/ডিং শুরু হয় ইতির।

তাড়াতাড়ি ডাক্তার আসেন, ইতিকে আবারও নেয়া হয় ওটিতে।

চলবে।

#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#ইতির_সংসার
পর্ব ২৬

ডাক্তার ওটি থেকে বেরিয়ে নাঈমের কাঁধে হাত রেখে বলেন -“সরি আমরা কোনভাবেই ব্লি/ডিং বন্ধ করতে পারিনি। বাধ্য হয়ে ইতির জরায়ু ফেলে দিতে হয়েছে। কিন্তু যেহেতু প্রচুর র/ক্ত গেছে সেহেতু ওর হিমোগ্লোবিন লেভেল অনেক কম। জরুরি ভিত্তিতে অন্তত দুই ব্যাগ দিতে হবে।”

-“ইতির সাথে দেখা করতে পারব?” জানতে চায় নাঈম।

-“হ্যাঁ, একটু পরে ওকে আবারও পোস্ট অপারেটিভে দেয়া হবে। তবে সাবধান, ইতি যেন আর উত্তেজিত না হয় সেটা খেয়াল রাখতে হবে। তাড়াতাড়ি ডোনার যোগাড় করুন প্লিজ।” বলে ডাক্তার চলে যায়।

নাঈম যায় ডোনার খুঁজতে। এদিকে ইতির কেবিনে আরেক ঝড় উঠেছে। খাদিজা বেগম নাঈমকে কল দিয়ে ডোনার যোগাড় করার কথা শুনে বলেন -“আমি তোমার আংকেলকে জানিয়ে দিচ্ছি। উনার কলিগদের কয়জন আছে রেগুলার ডোনেট করে। তুমি এখানে আসো, জরুরি কথা আছে।” ফোন রেখে তুলিকে বলেন -“একটু আগে আমাকে যা যা বলেছ সব নাঈমের সামনে বলবে তুমি নিজমুখে নইলে আমি যা রেকর্ড করেছি তা মুরাদের কাছে পাঠিয়ে দেব।”

নাঈম কেবিনে ফিরে আসে। খাদিজা বেগম তুলির হাত ধরে নাঈমের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলেন -“এখন বল সেদিন যা যা হয়েছিল। মিথ্যে বললে আমার শুধুমাত্র দুইটা আংগুলের স্পর্শ লাগবে সেটা তুমি জানো।”

তুলি মাথা নিচু করে বলে -“সেদিন তুমি অফিসে যাওয়ার পরে ট্যাপ ছেড়ে সব পানি বের করে দেই। মেশিনের মধ্যে একটা প্লাস্টিকের বোতলের ক্যাপ ফেলে দেই, রোটরে গিয়ে আটকে যায়, পানি তোলা যায়না। কলপাড়ের আধলাগুলোও আমি নড়বড়ে করে পানি ঢেলে দিছিলাম। সবকিছুই করছি মার সামনে দাঁড়িয়ে, মার পরামর্শে। তোমার বাবু হলে তুমি যদি মা-বাবাকে না দেখ সেইজন্য মা বলছে তোমার বাবু হওয়া যাবেনা। ”

-“উফ আমি আর সহ্য করতে পারছিনা। থাম তুই থাম। তুই কি সেই তুলি যাকে আমি সন্তানের মতো ভালোবাসি। যার সুখের জন্য আমি দিনরাত খেটে গেছি। তোকে যে পরামর্শ দিয়েছে সে কি আমার সেই মা যাকে আমি আমার আয়ের সমস্ত টাকা হাতে তুলে দিয়েছি, কোনদিন শখ করে নিজের জন্য কিছু কেনা তো দূরে থাক ইতিকেও পর্যন্ত কিছু দেইনি। আমি এ মুখ কাকে দেখাবো? আমার মা-বোন আমার সন্তানের খু/নী। এ কেমন মায়ের পেটে আমি জন্ম নিয়েছি আল্লাহ। এসব শোনার আগে তুমি আমাকে উঠিয়ে নিলা না কেন আল্লাহ। আর তো সহ্য করতে পারছিনা আমি। তোরা দুজন আর কখনো আমার সামনে আসবিনা। আমার সন্তানের হত্যাকারীদের মুখও আমি দেখতে চাইনা।” হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে নাঈম।

নাঈমের বাবা ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। খাদিজা বেগম তুলিকে নিয়ে বাইরে গিয়ে বলেন -“এমন একটা খু/নী মেয়েকে আমার ছেলে বিয়ে করল? জানিনা কবে তুমি আমাদেরও খুন কর। আমি আর তোমাকে আমার বাসায় নেবনা। মুরাদ দেশে ফিরুক, ওকে সব খুলে বলি। তারপর দেখি ও কি সিদ্ধান্ত নেয়। তবে হ্যাঁ তোমার হাতখরচ আমি বন্ধ করে দেব আপাতত। এর চেয়ে বেশি শা/স্তি এই মুহুর্তে দেবনা শুধুমাত্র তুমি নাঈমের বোন এটা ভেবে। এখন যাও লোক দেখানো ভিজিটর সাজতে হবে না। বাসায় চলে যাও তোমার মায়ের কাছে। মায়ের পরামর্শে এতো কিছু করলা একটাবারেও ভাবলানা এসব আমি তোমার সাথে করলে তুমি কি করতে?”

তুলি বাসায় গিয়ে ওর মাকে সব খুলে বলে। শুনেই রেগে যায় নাজমা বেগম। -“মুখ দেখবেনা বললেই হল? জন্ম দিল কে? পেলেপুষে বড় করল কে? এখন পরের একটা মেয়ের জন্য বলে আমার মুখ দেখবেনা। বললেই হল। আসুক আজ বাসায়।” রাগে গজগজ করতে থাকে।

নাঈম শান্ত হয়ে ওর বাবার হাত ধরে বলে -“আব্বা আমি আর তোমাদের সাথে থাকতে চাচ্ছিনা। ইতিকে নিয়ে আলাদা থাকব। তার মানে এই না যে তোমাদের কোন খরচ দেবনা, সবই দেব কিন্তু একসাথে থাকব না। তোমার স্ত্রীর হাতে আমি আর নগদ টাকাও দিবনা। মাসের জন্য যা যা লাগে সব বাজার করে দেব, টাকা দেব তোমার হাতে। তুমি তোমার মতো করে চালাবে। প্লিজ বাবা আমাকে ক্ষমা কর। যে বাসায় আমার সন্তান খু/ন হয় সেই বাসায় আমি আর ফিরে যাবোনা।”

ইতির মায়ের হাত ধরে বলে নাঈম -“আপনাকে কখনো মা ডাকিনি, কারণ আমি যাকে মা ডাকতাম সে মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল যে ছেলেদের কখনো শাশুড়িকে মা ডাকতে নেই। আজ আমি আমার এই অপরাধের জন্য ক্ষমা চাচ্ছি মা। ইতিকে রিলিজের পরে আপনার বাসায় নিয়ে যান। আমি যত দ্রুত পারি একটা বাসা দেখে ইতিকে নিয়ে উঠব। এই কয়দিন ও আপনার বাসায় থাকুক। আমি কয়েকদিন কোন বন্ধুর মেসে থাকব, সমস্যা নাই।”

-“কেন মেসে থাকবা বাবা? এইমাত্র তুমি আমাকে মা ডাকলে, আমি থাকতে তুমি কেন মেসে থাকবা? ইতি তোমাকে থাকতে দিবে বল? কোন কথা নাই বাবা, তোমরা দুজনেই আমার কাছে থাকবা।” আত্নবিশ্বাস নিয়ে বলেন ইতির মা। নাঈম উনার কথার ধরনে রাজি হয়ে যায়।

ইতির স্কুলের সবাই খবর পেয়ে ছুটির পরে দেখতে আসে ইতিকে। ওর এক জুনিয়র কলিগ রিয়া বলে -“আপু তোমার আশংকাই সত্য হল দেখছি। জানেন ভাইয়া, ইতিপু প্রায়ই বলত আমার বাচ্চাকে ওরা বাঁচতে দিবেনা। আপনার মা নাকি বলত ছোল পেটত নিয়াই এতো খুশি হলে চলেনা, আগে কোলত নেয়া লাগে। ইশ ইতিপু তুমি কেন আগেই মায়ের বাড়ি গেলেনা বলত? এখন কষ্ট কার হচ্ছে বলত? তোমার শাশুড়ী যে রিনা খান সেটা তো প্রথম দেখেই বলছি। তুমি জন্য এতোকিছু সহ্য করছ, আমি করতাম না বাবা।”

-“এই চুপ রিয়া। কি শুরু করলি? ইতিকে দেখতে আসছিস, ওর শরীরের ভালো মন্দ জিজ্ঞেস কর। অযথা পুরনো কথা তুলে কি লাভ? পাগলি মেয়ে একটা। চুপ কর।” থামিয়ে দেয় একজন।

নাঈম রিয়ার পাশে গিয়ে বলে -“চলেন আপু চা খেতে খেতে আলাপ করি, সবার জন্য চাও নিয়ে আসি।” ইতিকে বলে একটা ফ্ল্যাক্স নিয়ে রিয়াসহ ক্যানটিনে গিয়ে বসে দুই কাপ চায়ের অর্ডার দেয় নাঈম। তারপর জিজ্ঞেস করে -“ইতি কি কি বলেছিল আমাকেও একটু বলবেন প্লিজ। আমার জানা দরকার যে আমার অনুপস্থিতিতে কি কি হয় ইতির সাথে?”

রিয়া প্রথমে ভয় পেয়ে যায়। সব শুনে যদি নাঈম রেগে যায় ইতির উপর এই ভয়ে প্রথমে কিছু বলতে চায়না। কিন্তু নাঈমের বারংবার অনুরোধে বলতে শুরু করে -“ভাইয়া আপনি না থাকলে আন্টি সারাক্ষণ ইতিপুকে শাপশাপান্ত করে। বলে বাচ্চা পেটে আসলেই হয়না, সবাইই বাচ্চার মুখ দেখতে পারেনা। জীবনেও বাচ্চার মুখ দেখবেনা। আমার ছেলে কত সুন্দর আমার হাতের মুঠোয় ছিল সেই ছেলেকে বশ করছে। ছেলেকে আমার পর করে দিছে। সারাক্ষণ ইতিপুকে ডাই/নি করে বলত। ইতিপু মাঝে মাঝে বেশি বকাঝকা করলে স্কুলে মনমরা হয়ে থাকলে আমরা খুব করে ধরলে এসব বলে কান্না করে নিজেকে হালকা করত। আমরা সবাই বলছি মায়ের বাড়ি চলে যেতে। কিন্তু আপনি আপুকে ছাড়া কষ্ট পাবেন বলে যায়নি। কিন্তু সেদিন নাকি খুব বেশি চিল্লাপাল্লা করছে তাই আপু খুব কান্নাকাটি করে বলছিল আমার বাচ্চাকে ওরা বাঁচতে দিবেনা। তখন জাহানারা আপু ইতিপুর মাকে কল দিয়ে বলে উনাকে নিয়ে যেতে। আমরাও অনেক বুঝিয়ে রাজি করাই মায়ের বাড়ি যেতে। কিন্তু যা ভয় করছিল ইতিপু তা তো হয়েই গেল। সরি টু সে নাঈম ভাইয়া আপনি ইতিপুকে অনেক ভালোবাসেন সন্দেহ নাই কিন্তু বিয়ের পর থেকে আপুকে নিরাপত্তা দিতে পারেন নাই। এমনকি প্রেগ্ন্যাসির সময় তার কত কিছু খেতে ইচ্ছে করত, সেগুলোও খেয়াল রাখেননি। ইতিপুকে আমি চিনি ছোট থেকেই। ও নিজে থেকে কখনোই কাউকে কিছু বলে না। বের করে নিতে হয়। আমরা প্রতিদিন জিজ্ঞেস করতাম কি খেতে ইচ্ছে করছে, একেকদিন একেকজন বানিয়ে এনে আপুকে খাওয়াতাম। আমার কথায় কিছু মনে করবেন না ভাইয়া। এরপর আরো ভালো করে খেয়াল রাখবেন প্লিজ।”

সব শুনে নাঈমের মাথা আরো হেঁট হয়ে যায়। কিছুক্ষণ চুপ থেকে চায়ের ফ্ল্যাক্স রিয়ার হাতে দিয়ে বলে -“তুমি কেবিনে যাও, আমি আসছি।”

-“কই যান নাঈম ভাইয়া?” জিজ্ঞেস করে রিয়া।

উত্তর না দিয়ে চলে যায় নাঈম। কিন্তু কোথায়?
চলবে।
©️সৈয়দা রাজিয়া বিল্লাহ