#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-২৬ ||
রাত জাগা অশ্রুসিক্ত চোখ ঢাকা পড়ে গেছে গাঢ় লাল কাজলে, লাল পাড়ের সাদা শাড়িতে স্পষ্ট যৌবনের আড়ালে বিধ্বস্ত হিয়া লুকায়িত, হাতের আলতা ও লাল চুড়ি মুছে দিয়েছে রাতের নোনজলের স্পর্শ, কপালে আটকে থাকা লাল টিপটি হৃদয়ের তোলপাড় বিলীন করে দিয়েছে, লাল ওষ্ঠরঞ্জন আড়াল করে রেখেছে মলিন ঠোঁট আর কাঁধের সাদা রঙের ম্যাসেঞ্জার ব্যাগটি ধোঁয়াশা করে দিয়েছে অরুণিকার আর্থিক অবস্থা।
ভার্সিটিতে ঢুকতেই অরুণিকা সবার দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু। প্রতিদিনের ইনফরমাল পোশাকে দেখতে দেখতে মেয়েটা সবার চোখের আড়ালই হয়ে গেছে। জীবনের এলোমেলো গতি তার চোখেমুখে এতোটা ছাপ ফেলেছে যে তার সৌন্দর্য হারিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আজ অরুণিকা নিজের জন্য সেজেছে। নিজের জন্য সাজলে একটা মেয়েকে যে এতো চমৎকার লাগতে পারে, তা অরুণিকাকে দেখলেই বোঝা যাবে।
ক্লাব সেক্রেটারি ইমান ব্যস্ত তার কাজে। ব্যস্ততার মাঝে হঠাৎ থমকে গেল সে। তার দৃষ্টি স্থির হলো অরুণিকাতেই৷ সে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে আছে এক জায়গায়। অরুণিকা এদিক-ওদিক কাকে যেন খুঁজছে। ইমানের দিকে চোখ পড়তেই অরুণিকা তার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। ইমানের শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। সে বুকে হাত রাখলো। ধকধক শব্দ হচ্ছে। হৃদস্পন্দন তীব্র হচ্ছে তার। ণিকা এতো সুন্দর হতে পারে? নিজেকেই প্রশ্ন করছে ইমান। অরুণিকা ইমানের সামনে এসে দাঁড়ালো।
ইমান হালকা হেসে বলল, “আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না।”
অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে তাকালো ইমানের দিকে। ইমান অরুণিকার চাহনি দেখে বলল, “অসম্ভব সুন্দর লাগছে!”
অরুণিকা ইমানের চোখে চোখ রাখলো। ইমান চোখ সরিয়ে নিয়ে আনমনে বলল, “ঘায়েল করবে মেয়েটা!”
অরুণিকা ইমানের ইতস্ততভাব দেখে মেলার দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বলল, “আমি স্টল ঘুরে দেখছি।”
ইমান টুশব্দও করলো না। মাথা নেড়ে অরুণিকাকে যেতে বলল। অরুণিকা চলে যেতেই জোরে শ্বাস ছাড়লো সে। কাউকে দেখে দমবন্ধ হয়ে যাওয়া, কথাটা বইয়ে অনেক বার পড়েছে সে। আজ তার সাথেই ঘটে গেল। ইমান ঠোঁট কামড়ে হাসলো। অরুণিকাকে নিয়ে মিষ্টি ভাবনা তার মনে ঘুরপাক খেতে লাগলো।
(***)
ভার্সিটির মাঠ জুড়ে স্টল বসেছে। খাবারের স্টলে তালের পিঠা, তরমুজের শরবত আর জামের ভর্তা। অরুণিকা টাকার অভাবে কিছুই খেতে পারছে না। নাক টেনে ঘ্রাণ নিয়ে সরে আসছে।
কয়েকটা স্টলে চারা বিক্রি হচ্ছে। অরুণিকা ঘুরতে ঘুরতে সেই স্টলে গেল। সাদা লজ্জাবতীর চারা দেখে চমকে উঠলো সে। অরুণিকার দিকে সাদা লজ্জাবতীর একটা ফুল এগিয়ে দিল স্টলে বসা একজন। অরুণিকা ফুঁ দিতেই পাপড়িগুলো মিলিয়ে গেলো হাওয়ায়। অরুণিকা মুগ্ধ হয়ে সেই পাপড়িদের মিলিয়ে যাওয়া দেখছে। আর এমন দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণ করে ফেললো তূর্য। অরুণিকা তূর্যকে দেখে মৃদু হাসল। তূর্য এগিয়ে এসে বলল,
“টুইংকেল টুইংকেল লিটল স্টার,
হাউ আই ওয়ান্ডার হোয়াট ইউ আর!
স্ট্যান্ডিং অন দা আর্থ ইন দা মিডস্ট অব দা ওয়ার্ল্ড,
লাইক আ ফেরি অন দা গ্রাউন্ড।”
অরুণিকা হেসে বলল, “রিদম মিলে নি।”
“ইটস ওকে। ইন্সট্যান্ট এইটুকু বানিয়েছি খারাপ কি?”
“অনেক ভালো হয়েছে।”
“তোকে সেই লাগছে, টুইংকেল।”
“থ্যাংক ইউ।”
তূর্য এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল, “ওপস, আমি তো ভার্সিটির স্যার। ভুলেই গেছি।”
অরুণিকা তূর্যের কথা শুনে হাসলো। এদিকে রুদবা দূরে দাঁড়িয়ে অরুণিকাকে তূর্যের সাথে হেসে হেসে কথা বলতে দেখে অবাক হলো। মনে মনে ভাবলো, “অরু বললো তূর্য স্যার ভালো না, প্লে বয়। তাহলে ও স্যারের সাথে কথা বলছে কেন? ওর তো উচিত উনার সাথে কথা না বলা!”
(***)
অরুণিকা স্টল থেকে বেরুতেই আহনাফের মুখোমুখি হলো। আহনাফ অরুণিকার দিকে তাকিয়ে রইলো সেকেন্ড খানিক। অরুণিকার চোখ-মুখ মুহূর্তেই ঘৃণায় লাল হয়ে গেল। সে রক্তচক্ষু নিয়ে আহনাফের দিকে তাকিয়ে রইলো। এরপর পাশ কেটে চলে যাবে ওমন সময় আহনাফ তার হাত ধরে এদিক-ওদিক তাকালো। অরুণিকা এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিতেই আহনাফ চাপা স্বরে বলল, “একটু এদিকে আয় না।”
অরুণিকা দাঁতে দাঁত পিষে বলল, “কেন? আবার কোথায় হাত দিতে চাচ্ছো?”
আহনাফ কিছুক্ষণ নির্বাক তাকিয়ে রইলো অরুণিকার দিকে। এরপর আশেপাশে না তাকিয়ে অরুণিকার হাত ধরে সোজা ডিপার্টমেন্টের দিকে চলে গেল। আহনাফের এমন আচরণ প্রায় অনেকের ধরা চোখেই পড়লো।
ইভান তাদের মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আহু, পাগল হয়ে গেলি না-কি? ভার্সিটির একটা রেপুটেশন আছে। তুই ওর হাত ধরে এভাবে খালি ডিপার্টমেন্টে নিয়ে যাচ্ছিস কেন? ডিনের কানে গেলে কি হবে বুঝতে পারছিস?”
আহনাফ ধমকের সুরে বলল, “সি ইজ মাই ওয়াইফ।”
অরুণিকা নিজের হাত ছাড়ানোর জন্য মোড়ামুড়ি করছে আর বলছে, “আমি তোমাকে হাসবেন্ড মনে করি না। তুমি একটা শয়তান। তুমি একটা জাহিল।”
ইভান অরুণিকার ঝাঁজালো কথা শুনে চাপা স্বরে বলল, “তোদের দুইটাকে আমার তো ইচ্ছা করছে আছাড় মারি এখন। শোন, তোদের নিজেদের ব্যক্তিগত ঝামেলা যদি এই প্রতিষ্ঠানের নাম খারাপ করে, আই সোয়ার তোদের দুই জনকে আমি রাস্টিকেট করে দিতে বলবো।”
আহনাফ ভাবলেশহীন কন্ঠে বলল, “বল গিয়ে। যা করার কর। আমাকে এখন বিরক্ত করিস না।”
অরুণিকা আর ইভান দু’জনই আহনাফের দিকে তাকালো। আর আহনাফ অরুণিকার দিকে তাকিয়ে এক গাল হেসে তাকে টেনে নিয়ে গেলো তার কেবিনে।
(***)
অরুণিকাকে চোখের সামনে বসিয়ে রেখেছে আহনাফ। অরুণিকা বিরক্ত মুখে বলল, “তুমি কিন্তু এখন সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছো!”
“সীমা ছাড়ানোর মতো কি করলাম আমি? বউয়ের দিকে তাকিয়ে আছি, ওটাতেই এতো সমস্যা?”
অরুণিকা পা ধাপিয়ে বলল, “আমি তোমার নামে কেইস করবো।”
আহনাফ স্মিত হেসে অরুণিকার দিকে ঝুঁকে বলল, “তোর কেইস করার মতো কোনো আইন এখনো সৃষ্টি হয় নি। বউয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলে কেইস করা যায় না।”
অরুণিকা হতাশ হলো। আহনাফ অরুণিকার কপালে আসা চুলগুলো ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিলো। অরুণিকা চোখ বন্ধ করলো সাথে সাথেই। আহনাফ তা দেখে মৃদু হাসলো। আর বলল, “ভয়ংকর!”
অরুণিকা সাথে সাথে চোখ খুলে তাকালো আহনাফের দিকে। আহনাফ মাতাল সুরে বলল, “ভয়ংকর সুন্দর লাগছে।”
অরুণিকা চোখ সরিয়ে নিলো। গা জ্বালা করছে তার৷ কাল আহনাফের আচরণের পর, ইচ্ছে করছে তাকে ধাক্কা মেরে দশতলা থেকে ফেলে দিতে।
আহনাফ হুট করে অরুণিকার গালে চুমু গেলো। অরুণিকা চোখ বড় বড় করে তাকাতেই আহনাফ তার অধরে অধর ছোঁয়ালো। অরুণিকা তাকে সরিয়ে দিতে যাবে, তখনই আহনাফ তার উন্মুক্ত উদরে হাত রাখলো। মুহূর্তেই অরুণিকার গা শিউরে উঠলো। সে তার বড় বড় নখ দিয়ে আহনাফের হাত খামচে ধরে বলল, “ছাড়ো আমাকে, নয়তো হাত ছিঁড়ে দেবো।”
আহনাফ অরুণিকার চোখের দিকে তাকিয়ে হাসলো। অদ্ভুত সেই হাসিটা! মনে হচ্ছে হাজারো কষ্ট লুকোনো সেই হাসিতে। অরুণিকা আহনাফের হাত ছেড়ে দিল। আহনাফ অরুণিকার চোখে চোখ রেখে বলল, “যেই সৌন্দর্যে তুই হৃদয় ঝলসে দিতে পারবি, তোকে আজ ঠিক তেমন সুন্দর লাগছে। অরু, তুই সত্যিই অনেক বড় হয়ে গেছিস।”
অরুণিকা শক্ত স্বরে বলল, “আমাকে যেতে দাও প্লিজ।”
“সত্যিই কি আমাকে আর ভালোবাসিস না?”
অরুণিকা আহনাফের দিকে তাকিয়ে রুক্ষ স্বরে বলল, “আমার ভালোবাসা তো তোমার লাগবে না। তাহলে কেন এই প্রশ্ন করছো? ভুলে গেছো, আমি তোমার ভাইয়ের খুনী!”
অরুণিকার কথা শুনে মুহূর্তেই আহনাফের চোখ-মুখ শক্ত হয়ে এলো। সে অরুণিকার হাত মুড়ে দিয়ে বলল, “তোকে তো আমি এতো সুন্দর করে বাঁচতে দেবো না, অরু।”
অরুণিকা স্তব্ধ হয়ে গেল। আহনাফের হিংস্র আচরণ দেখে ভাবতে লাগলো, “একটা মানুষ দ্বিমুখী আচরণ কীভাবে করতে পারে? আহনাফ কি মানসিকভাবে অসুস্থ?”
আহনাফ অরুণিকাকে চেয়ার থেকে উঠিয়ে তার কোমড় চেপে ধরে তাকে নিজের কাছে এনে বলল, “এতো সেজেছিস কেন আজ?”
অরুণিকার চোখ ভিজে উঠলো। সে করুন সুরে বলল, “তুমি যা ইচ্ছে করো, আল্লাহর দোহাই লাগে অন্তত আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দাও। আমার তোমার সাথে একটুখানিও থাকার ইচ্ছে নেই। ঘেন্না লাগে আমার তোমাকে। তোমার স্পর্শে গা ঘিনঘিন করে আমার।”
আহনাফ অরুণিকার কথা শুনে ছেড়ে দিলো তাকে। নিজের কপাল চেপে ধরে বলল, “আই এম সরি। আমি আমার কন্ট্রোলে ছিলাম না।”
অরুণিকা হতাশ কন্ঠে বললো, “তুমি কি সত্যিই পাগল হয়ে গেছো? তুমি আগে একটা সাইকায়াট্রিস্ট দেখাও। তোমার আচরণ স্বাভাবিক না। তুমি তোমার কন্ট্রোলে থাকো না। মাঝে মাঝে সুইট বিহেইভ করো, মাঝে মাঝে জানোয়ারের থেকেও জঘন্য হয়ে যাও। ডাবল পারসোনালিটি তোমার।”
আহনাফ অরুণিকার দু’হাত নিজের হাতে আবদ্ধ করে হাঁটু গেড়ে বসে বলল, “আমি সরি বলছি তো। আর রাগ তুলে দিস না আমার।”
“আবরারকে যে আমি মেরেছি, এই সত্যটা কি মিনিটে মিনিটে তোমার মস্তিষ্ক থেকে ডিলিট হয়ে যায়? হুট করে মনে পড়লে হিংস্রতা দেখাও, আবার হুট করে সব ভুলে নরম হয়ে যাও!”
অরুণিকা আহনাফের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দরজার কাছে যেতেই আহনাফ তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল, “তুই কাছে থাকলে আমার শান্তি লাগে, আবার মাঝে মাঝে মাথা খারাপ হয়ে যায়। তোকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে, আবার তোকে কষ্ট দিতেও ইচ্ছে করে। আমি এমন হয়ে গেছি কেন আমি নিজেও জানি না। হয়তো তুই আমাকে এমন বানিয়ে দিয়েছিস। আমাকে ধোঁকা না দিলে, আমি তো ভালোই থাকতাম। এখন অন্তত একটু আমার সামনে বসে থাক। আমি তোকে দেখি। অনেকদিন ঠিকভাবে থাকাতে পারি নি তোর দিকে। দেখিই না তোকে আজকাল। ছাদেও উঠিস না। কাল উঠেছিস, কিন্তু ইমান তোর পাশে ছিল। তাই একটু মেজাজ ঠিক ছিল না। কাল যা হয়েছে, তার জন্য সরি।”
অরুণিকা আহনাফের দিকে ফিরে বলল, “তুমি আমাকে বাজেভাবে স্পর্শ করে সরি বলছো? আহনাফ তোমাকে আমি সেকেন্ড চান্স দিয়েছি। আর তুমি আমাকে লাস্ট চান্সেই প্রমাণ করে দিয়েছো, তুমি আমাকে ভালোবাসো না। তাহলে আমি তোমাকে কেন ক্ষমা করবো? কোন যুক্তিতে ক্ষমা করবো? কেন বিশ্বাস করবো তোমাকে? যেই মানুষ আমাকে দুই দুইবার ঠকিয়েছে। ফ্যামিলির সামনে, তার বন্ধুদের সামনে আমার ক্যারেক্টর নীচে নামিয়ে দিয়েছে, সে আমাকে অন্তত ভালোবাসতে পারে না।”
আহনাফ অসহায় দৃষ্টিতে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে রইলো।অরুণিকাও নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। এরপর আর কিছু না বলে বেরিয়ে গেলো আহনাফের কেবিন রুম থেকে।
(***)
অরুণিকা ক্যাম্পাস থেকে বের হওয়ার পর আহনাফ তার সামনে এসে দাঁড়ালো। অরুণিকা আহনাফকে দেখে বলল, “তুমি পয়দা হওয়ার আগে চাচী মনে হয় পাউরুটির সাথে সুপার গ্লু লাগিয়ে খেয়েছিল!”
আহনাফ বাঁকা হেসে অরুণিকার কাঁধের ব্যাগটা টেনে নিয়ে নিল। অরুণিকা শক্ত স্বরে বলল, “ব্যাগ দাও আমার।”
আহনাফ শীতল কণ্ঠে বলল, “ইমান তোকে ব্যাগও গিফট করে?”
অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে বললো, “এটা ইমান গিফট করে নি। এটা ওর আম্মু দিয়েছিল। কক্সবাজার থেকে এনেছিল। আমাদের সাথে তাদের ভালো সম্পর্ক হয়ে গেছে, তাই আমাদের সবার জন্য গিফট এনেছে।”
“তুই আমার দেওয়া কিছু তো পড়িস না। হাতেও নিস না।”
অরুণিকা মলিন মুখে বলল, “তোমার দেওয়া আঘাত বয়ে বেড়াচ্ছি আমি। আর কিছু নেওয়ার ক্ষমতা নেই।”
আহনাফ ঠোঁট কামড়ে হাসলো। অরুণিকা আহনাফকে হাসতে দেখে বলল, “তুমি একটা রোবট। কোথায় কেমন রিয়েক্ট করতে হয়, সেটাও জানো না।”
আহনাফ বাঁকা হেসে হাতের ব্যাগটা পাশের ড্রেনে ছুঁড়ে মারলো। অরুণিকা ব্যস্ত কন্ঠে বললো, “ওখানে আমার ফোন আছে।”
এই বলে অরুণিকা ব্যস্ত হয়ে ড্রেন থেকে ব্যাগটা তুলে আনলো। অরুণিকার অস্থিরতা দেখে আহনাফ অরুণিকার কাঁধে হাত রাখলো। অরুণিকা এবার রাগী দৃষ্টিতে আহনাফের দিকে তাকালো। এরপর নিঃশব্দে ব্যাগটি থেকে ফোন বের করে নিলো। ভাগ্যিস ব্যাগটা মোটা ছিল, তাই ফোন অব্ধি ড্রেনের পানি পৌঁছায় নি। ব্যাগের যা অবস্থা, সেটা আর নিয়ে যাওয়ার হালে নেই। অরুণিকা পাশের ময়লার স্তূপে ব্যাগটি ছুঁড়ে মেরে আহনাফের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। আহনাফ বুকে হাত গুঁজে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে বলল, “কাল এর চেয়ে সুন্দর ব্যাগ কিনে আনবো তোর জন্য।”
অরুণিকা আহনাফের সাদা শার্টের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, “আমিও কাল সেই ব্যাগের দর্শন পাওয়ার অপেক্ষায় থাকবো।”
এরপর ইশারায় আহনাফকে নিজের কাছে ডাকলো অরুণিকা। আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে তার দিকে পা বাড়ালো। অরুণিকা দাঁত কেলিয়ে বলল, “কাল নিজের মধ্যে শিষ্টাচার ইনপুট করার পাশাপাশি একটা নতুন শার্টও কিনে নিও।”
এই বলে অরুণিকা আহনাফকে জোরে ধাক্কা দিতেই সে টাল সামলাতে না পেরে ড্রেনে গিয়ে পড়লো। অরুণিকা মুখ চেপে হেসে বলল, “যদি তোমাকেও তুলে সোজা ময়লার ডাস্টবিনে ছুঁড়ে দেওয়া যেতো, বড়োই শান্তি পেতাম!”
আহনাফ দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “অরু, ফাজিল মেয়ে, তোকে আমি….”
অরুণিকা দৌঁড়ে পালালো। এদিকে আহনাফ ড্রেন থেকে উঠে দেখলো আশেপাশের সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান আর তূর্য তখনই বের হলো ক্যাম্পাস থেকে। আহনাফের এই অবস্থা দেখে তূর্য শব্দ করে হাসলো। ইভান আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোর এই অবস্থা কীভাবে হলো?”
তূর্য বলল, “আমার টুইংকেলের রূপে মাতাল হয়ে এক্কেবারে ড্রেনে গিয়ে পড়লি! ভাই পড়লে একটু পুকুরে গিয়ে পড়তি। পরিষ্কার কোনো জায়গা পেলি না? ড্রেনেই কেন পড়তে হলো তোকে?”
আহনাফ চিৎকার করে বলল, “চুপ কর। আমার জন্য গাড়ি ঠিক কর। আমি আমার বাইকে উঠবো না।”
ইভান আহনাফের জন্য গাড়ি ঠিক করলো। এরপর দু’জনই মোটর সাইকেল নিয়ে আহনাফের পিছু পিছু এলো। বাসায় এসে ইমনকে আহনাফের মোটর সাইকেলের চাবি দিয়ে তূর্য বলল, “যা ওর বাইক ক্যাম্পাস থেকে নিয়ে আয়। ড্রেনে হাবুডুবু খেয়ে এসেছে, তবুও তার বাইক নীট এন্ড ক্লিন থাকা চায়।”
(***)
অনবরত ফ্যান ঘুরতে থাকায় অল্প সময়েই ফ্যানের পাখাতে ময়লা জমে গেছে। রুহানি গরমে হাঁসফাঁস করছে। পাখার দিকে তাকিয়ে ভাবলো, “ময়লা জমে বেশি ভারী হয়ে গেছে, তাই হয়তো ফ্যানটা ঘুরতে পারছে না।”
রুহানি কিছু একটা ভেবে এক বালতি পানি আর একটা ছেঁড়া কাপড় নিয়ে এলো। এরপর টেবিল টেনে ফ্যানের নিচে দাঁড় করালো। টেবিলে উঠেও ফ্যান তার নাগালের বাইরে। তাই টেবিলের উপর চেয়ার উঠিয়ে দিল। হাত ঝেড়ে রুহানি বলল, “এখন ফ্যানটা চকচকে তকতকে করে হিম শীতল হাওয়া খাবো। জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ, ফ্যান বাবু।”
এই বলে টেবিল থেকে লাফিয়ে নেমে বালতিটা টেবিলের উপর উঠালো। পরণের সেলোয়ারটা বেশি লম্বা হওয়ায় উঠতে নামতে ঝামেলা লাগছিল। তাই সেলোয়ার ভাঁজ করে হাঁটুর উপরে উঠালো সে। এরপর উঠে পড়লো ফ্যান মুছতে। এরই মধ্যে আরাফ তাকে পড়াতে এলো। আতকিয়া জাহান জানতেন না, মেয়ে তার ফ্যান মুছতে ব্যস্ত। তিনি আরাফকে দরজা খুলে দিয়ে সোজা নিজের ঘরে চলে গেলেন। আরাফ নীরবে রুহানির ঘরে ঢুকেই থমকে গেল। রুহানি পা উঁচিয়ে ফ্যান মুছছিল, তাই তার গেঞ্জির কিছু অংশ উপরে উঠে গেছে। আরাফ যদিও সেদিকে ভালোভাবে তাকায় নি, সে রুহানিকে এই অবস্থা দেখেই চোখ সরিয়ে নিয়েছে। এদিকে রুহানি কারো উপস্থিতিতে টের পেয়ে নিচে তাকিয়ে আরাফকে দেখে থতমত খেয়ে গেল। হুড়োহুড়ি করে চেয়ার থেকে নামতে গিয়ে বালতির সাথে পা আঁটকে বালতি সহ আরাফের গায়ের উপর এসে পড়লো। আরাফ সাথে সাথেই রুহানির কোমড় জড়িয়ে ধরলো। রুহানি চোখ খিঁচে রেখেছে। আরাফের পুরো গায়ে ফ্যান মুছা ময়লা পানি। আরাফ চোখ-মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। রুহানি চোখ খুলে আরাফকে তার সামনে দেখে লাফিয়ে পিছু যাবে ওমনই উলটে পড়া বালতির উপর পা পড়তেই পেছনের দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়তে গেল, কিন্তু আরাফ হাত ধরে রুহানিকে আবার নিজের দিকে টেনে আনলো। রুহানি হাঁ করে আরাফের দিকে তাকিয়ে রইলো। মিনমিনিয়ে বলল, “পুরোটাই সিনেমার মতো ছিল।”
আরাফ দাঁত কটমট করে বলল, “একে তো তুমি দিন-দুপুরে বানরের মতো ফ্যানের সাথে ঝুলছিলে, তারপর আবার আমার উপর পানি ঢেলে দিয়েছো?”
রুহানি আরাফকে ছাড়তেই তার নিজের দিকে চোখ পড়লো। তড়িঘড়ি করে সেলোয়াড় নামিয়ে ঠোঁট কামড়ে নিচের দিকে তাকালো সে। আরাফ বলল, “আমি বাইরে দাঁড়াচ্ছি। তাড়াতাড়ি সব ঠিক করে নাও।”
আরাফ বেরুতেই রুহানি পুরো ঘর পরিষ্কার করে কাপড় পালটে এলো। মোটামুটি বিশ মিনিট আরাফ বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, আর আতকিয়া জাহানের রুমের দিকে তাকিয়ে ভাবছে, “এই মহিলা একটা পুরুষ মানুষকে ঘরে ঢুকিয়ে নিজের রুম বন্ধ করে বসে আছে, অদ্ভুত! একটা ছেলে এসেছে তার মেয়েকে পড়াতে, এই মহিলার তো কোনো পাত্তাই নেই! যেমন হাসবেন্ড, তেমনই ওয়াইফ। তাদের মেয়েটাও একটা ফাজিল। অরুকে এই জঘন্য পরিবেশ থেকে বের না করলে ওও মাথা খারাপ হয়ে যাবে।”
এদিকে রুহানি রুমের বাইরে মাথা বের করে উঁকিঝুঁকি দিয়ে আরাফকে খুঁজতে লাগল। সে খেয়াল করে নি আরাফ তার পাশেই দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। আরাফ রুহানির সামনে এসে দাঁড়াতেই সে চমকে উঠলো। আরাফ ভেতরে ঢুকে সোজা চেয়ার টেনে বসে পড়লো। রুহানিও চুপচাপ চেয়ার এসে বসলো। আরাফ বলল, “কালকের পড়া বের করো।”
রুহানি পড়া বের করতে করতে বলল, “স্যার আপনার গায়ে সব ময়লা পানি পড়েছিল।”
আরাফ চুপ করে আছে। রুহানি পুনরায় বলল, “স্যার, আপনার হাত-পা চুলকাচ্ছে না?”
আরাফ শীতল কণ্ঠে বলল, “পড়া বের করো৷ এখানে ভোগাস আলাপ করতে আসি নি আমি।”
রুহানি মুখ বাঁকালো আরাফের কথায়, যা আরাফের দৃষ্টি এড়ালো না। এদিকে রুহানি বইয়ের দিকে তাকিয়ে আনমনে ভাবতে লাগলো, “কি সিনেম্যাটিক ভাবেই স্যারের উপর ল্যান্ড করলাম! ওয়াও! ভাবতেই নায়িকা নায়িকা লাগছে নিজেকে।”
রুহানি এসব ভাবতে ভাবতেই আরাফের দিকে তাকালো। আরাফও এতোক্ষণ রুহানির দিকেই তাকিয়ে ছিল। কিন্তু তাদের চোখাচোখি হওয়ার আগেই আরাফ চোখ সরিয়ে নিল। এবার রুহানি আরাফের দিকে ভালোভাবে তাকালো। এতোদিন সে আরাফকে ভালোভাবে দেখে নি৷ আজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো। মনে মনে ভাবলো, “স্যার যদি আমার নায়ক হয়, তাহলে ভালোই হবে। স্যার দেখতে স্মার্ট আছে। চশমাও পড়ে। কি কিউট ফেইস!”
পরক্ষণেই ভাবলো, “আরেহ উনি তো ডাক্তার! আমার মতো ইন্টার ফেইল মেয়েকে তো উনি একটা ঠোকাও দেবে না। এজন্যই বোধহয় আমাকে পড়াতে আসলে মুখটা বাংলার পাঁচ বানিয়ে রাখে। ইশ! এই হ্যান্ডসাম স্যারের সামনে ভীষণ ইনসাল্ট হয়ে গেল আমার। উনি তো আমার ইন্টারের সব নম্বর জানে। কি বমিটাই না করলো সেই নম্বর দেখে! মাকে কে বললো এমন কিউট স্যার রাখার জন্য? রেপুটেশনটাই নষ্ট হয়ে গেল আমার!”
চলবে-
#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-২৭ ||
রুহানিকে পড়িয়ে বেরুনোর সময় অরুণিকার সাথে দেখা হয়ে গেল আরাফের৷ আরাফ মৃদু হাসতেই অরুণিকা মুখ ঘুরিয়ে নিল। দরজার কাছে এসে আবার দাঁড়িয়ে গেল আরাফ। শুকনো মুখে অরুণিকার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলো, “আমার উপর তোর খুব রাগ, তাই না?”
অরুণিকা চোখ ছোট করে বলল, “তুমি কি এমন করলে যে রাগ করবো?”
“এই যে তোর সাথে যা হচ্ছে আমি থামাতে পারছি না।”
অরুণিকা আরাফের দিকে ঝুঁকে চাপা স্বরে বলল, “চাইলে কিন্তু থামাতে পারবে।”
আরাফ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কীভাবে?”
“আহনাফ তো তোমার সাথেই থাকে। জাস্ট গৌ এন্ড কিল হিম।”
আরাফ অরুণিকার হাত শক্ত করে ধরে বলল, “কি বলছিস এসব?”
“দেখেছো? পারবে না। আমি জানতামই। যাই বলো, তোমার কাছে আহনাফ আমার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মানুষ।”
“তোরা দু’জনই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। ছেলেটা মানসিকভাবে ভেঙে গেছে। আবরারের মৃত্যুর পর তো শুধু কয়েক মাস ছিলি ওখানে। তুই তো দেখিস নি আহনাফকে আর। পাঁচ বছরে ও কেমন পরিবর্তন হয়েছে তুই জানিস না। ওর এই পরিবর্তনে সবাই অনেক চিন্তায় আছে। তোর কি মনে হয় আহু তোর সাথে যা করেছে সবটা সেন্সে থাকা অবস্থায় করেছে?”
“তাহলে কি সেন্স মাটিতে ফেলে এসেছিল? না-কি ওর ভাই ওর সেন্স নিয়েই দশতলা থেকে পড়ে গিয়েছিলি।”
আরাফ উঁচু স্বরে বলল, “অরু, বেশি বলে ফেলছিস তুই।”
অরুণিকা উলটো রাগ দেখিয়ে বলল, “প্রথমত আবরারকে আমি মারি নি। তারপরও সেই অপবাদ নিয়ে বেঁচে আছি। দ্বিতীয়ত যার সাথে বিয়ে হয়েছে, তার মতো জঘন্য মানুষ আমি আমার জন্মে দ্বিতীয়টা দেখি নি। তুমি কি জানো আরাফ, আমি আমার সেই সো কল্ড হাসবেন্ডের চেয়ে বেশি সেইফ ফিল করি ইউনিভার্সিটির সিনিয়রের সাথে? নিজেই ভেবে দেখো, তোমার গুনধর সো কল্ড অসহায় ভাই, আমার জীবনে কেমন আবহ সৃষ্টি করে দিয়েছে যে আমি তার সাথেই কম্ফোর্ট না!”
আরাফ চুপ করে রইলো। সেকেন্ড খানিক পর জিজ্ঞেস করলো, “ডিভোর্স কি সত্যিই নিচ্ছিস?”
“ইয়েস। এটাই আমার ফাইনাল ডিসিশন। আমি আমার ডিসিশন সবাইকে জানিয়ে এসেছি। যদিও একটা মায়া ছিল তোমার ভাইয়ের প্রতি। পাঁচ বছর সেই মায়া নিয়েই বেঁচে ছিলাম। কিন্তু এখন আমার মন থেকে উঠে গেছে মানুষটা। তার আচরণে সে বিষিয়ে দিয়েছে নিজেকে। এখন আমি ওকে চাই না আর। মন থেকে ওর কাছে আসা, ওর স্পর্শ, ওর চোখাচোখি আমাকে কোনো সাড়া দেয় না। আমি মুভ অন করতে চাই, আরাফ। আমি চাই এমন কেউ আমার জীবনে আসুক, যাকে ভালোবাসলে আমার প্রেম, মায়া কোনোটাই অপাত্রে যাবে না। আমি চাই কেউ আমার যত্ন নিক। আমাকে ভালোবাসুক। আমার সত্য-মিথ্যা সব নিয়ে আমাকে ভালোবাসুক। ভালোবাসার মানুষ যদি খুনীও হয়ে থাকে, তবুও তাকে ভালোবাসা যায়। ভালোবাসার আকার সম্মানেই আসে। সে আমাকে ঘৃণা করে, করুক। তবুও আমি তাকে ধরে রাখতে চেয়েছি। কিন্তু সে তো ভালোবাসার আকারই দিতে জানে নি। তাহলে কোন অদৃশ্যতাকে বিশ্বাস করবো আমি? আর আহনাফ চৌধুরী তো আমাকে বিশ্বাসই করে না। যার ভিত্তিই দুর্বল, আকারই নেই, তবে এ কেমন ভালোবাসা মিস্টার চৌধুরীর?”
আরাফ আর কিছু বলতে পারলো না। সে দরজার বাইরে এসে দাঁড়াতেই চমকে উঠলো আহনাফকে দেখে। সে কোনো প্রতিক্রিয়া করতে যাবে তার আগেই আহনাফ ইশারায় তাকে চুপ থাকতে বলল। অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে আরাফের দিকে তাকিয়ে রইলো। আরাফ অরুণিকার দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ হেসে তার মাথায় হাত রেখে বলল, “তোর সুখ আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তুই যেখানে সুখী হবি, সেখানেই থাকবি।”
অরুণিকা স্মিত হেসে বলল, “আমার জন্য অন্তত তোমার ভাইকে অনুরোধ করে দেখো, আমার আশেপাশেও যাতে না আসে। ওকে দেখলেই আমার অশান্তি লাগে। মনে হয় মরে যাই। কেন বেঁচে আছি! বাবা-মা আমাকে কেন ফেলে গেল!”
আহনাফ দেয়ালে হেলান দিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসলো। সেই হাসিতে মারাত্মক যন্ত্রণা লুকিয়ে ছিল। আরাফ বুঝতে পেরে নিজেই দরজা টেনে দিয়ে বলল, “ভালোভাবে তালা লাগিয়ে দে।”
অরুণিকা মাথা নেড়ে দরজা বন্ধ করে দিল। আরাফ এবার আহনাফের দিকে তাকালো। আহনাফের চোখ ছলছল করছে। আরাফ তার কাঁধে হাত রেখে বলল, “এসবের জন্য কিন্তু তুই নিজেই দায়ী।”
আহনাফ জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালো। কেমন যেন মুহূর্তেই শুকিয়ে গেছে তার শরীরের সব জল! ঢুক গিলতেই কষ্ট হচ্ছে তার। গলায় কিছু আঁটকে গেছে মনে হচ্ছে। আরাফ তার হাত ধরে তাকে নিয়েই নামলো। আহনাফ আরাফের দিকে তাকিয়ে আছে। আরাফ বলল, “তুই আমাদের থেকে আলাদা হয়ে যেতে চাচ্ছিস, এজন্যই এই দুর্গতি এসেছে।”
আহনাফ মনে মনে বলল, “আমি তো অনেক আগেই আলাদা হয়ে গেছি। আমি এখন তোদের থেকে অনেক আলাদা। তোরা চাইলেও আমাকে আর ফেরাতে পারবি না। আমি নিজেও ফিরে আসতে চাই। কিন্তু কোনো শক্তি নেই ফেরার। অরু তো ঠিক বলেছে। তবে ভালোবাসা তো অনেক পরে আসছে। আমার নিজেরই কোনো ভিত্তি নেই, কোনো আকার নেই। পরিস্থিতির সাথে নিজের আকার ধারণ করছি শুধু।”
(***)
ফোন ভাইব্রেট হতেই অরুণিকা মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো ইমানের মেসেজ। অরুণিকা ইমানের ইনবক্সে ঢুকতেই দেখলো হিমালয়ের ইন্সটাগ্রাম একাউন্টের লিংক পাঠিয়েছে ইমান। মুহূর্তেই অরুণিকার পুরো শরীর জুড়ে উষ্ণতা ভীড় করলো। কাঁপা হাতে লিংকে ঢুকলো সে। চোখ বন্ধ করলো অরুণিকা। লোডিং হচ্ছে, আর থেমে থেমে তার বুকটা ধকধক করছে। একটু পর সাদা স্ক্রিনে ভেসে উঠলো একটি নাম। অরুণিকা তা দেখে ভ্রূ কুঁচাকালো। সত্যিই কি এটা হিমালয়ের অফিসিয়াল একাউন্ট? নাম ‘এ হি নাফ মালয়।’ এ কেমন নাম! অরুণিকা সাথে সাথেই মেসেজে লিখলো,
– এ হি নাফ মালয় নামের অর্থ কি?
অরুণিকা অপেক্ষা করলো সারাদিন, সারারাত। অপেক্ষা করলো এক সপ্তাহ। কিন্তু উত্তর এলো না। অরুণিকা হতাশ কন্ঠে বললো, “আমিও না! একজন যশস্বী মানুষ আমার মেসেজের রিপ্লাই দেবে কেন?”
(***)
আজ স্পিকিং টেস্ট, এবং দুইটা কোর্সের প্রেজেন্টেশন। অরুণিকা তাই আজ কালো পাড়ের সাদা শাড়ি পরে এসেছে। সামনের চুলগুলো ক্লিপ দিয়ে আঁটকে রেখেছে সে। অরুণিকাকে দেখে ইমান দূর থেকে ইশারায় বুঝালো তাকে বেশ সুন্দর লাগছে। অরুণিকা ইমানের ইশারায় লাজুক হাসলো। আহনাফ ডিপার্টমেন্টের বারান্দায় দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখে ভেতরে ঢুকে পড়লো। এরপর আহনাফ ধীর পায়ে হেঁটে ক্লাসে ঢুকলো। চেয়ার টেনে বসে পড়লো সে। খুব শান্ত আর শীতল দৃষ্টিতে তাকালো ছাত্র-ছাত্রীদের। আহনাফের চাহনি দেখে ক্লাসে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে। এদিকে মিনিট খানিক পর অরুণিকা ক্লাসে ঢুকলো। আহনাফ তার দিকে সেকেন্ড খানিক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। অরুণিকা তাহসিনের পাশে গিয়ে বসলো। আহনাফ এবার সবাইকে স্পিকিং টেস্টের জন্য তৈরী হতে বললো। টেস্টের ধরণ ভিন্ন। প্রতিবার যেকোনো বিষয়ের উপর সবাইকে দশ বা পাঁচ মিনিট বলতে দেওয়া হয়। কিন্তু এবার আহনাফ প্রজেক্টর চালু করলো। শব্দহীন ভিডিও দেখালো প্রতিটি গ্রুপকে। ভিডিও দেখার পর সেই ভিডিওটির পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে সেই সম্পর্কে প্রতিটি শিক্ষার্থীকে আলাদাভাবে মতামত রাখতে হবে। প্রতিটি গ্রুপ তাদের স্পিকিং টেস্ট শেষ করে চলে গেল। অরুণিকা আর তাহসিনই ক্লাসে বসে ছিল। আহনাফ তাহসিনের টেস্ট আগে নিয়ে তাকে ছেড়ে দিল। অরুণিকা চুপচাপ বসে আছে বেঞ্চে। সে মনে মনে ভাবছে, আহনাফ তার সাথে আবার কিছু একটা করবে। নয়তো সবার শেষে কেন তাকে ডাকছে? তাহসিন বেরুতেই আহনাফ বলল, “অরুণিকা চৌধুরী, কাম।”
অরুণিকা আহনাফের সামনে এসে দাঁড়ালো। আহনাফ ল্যাপটপে একটা ভিডিও চালু করলো। অরুণিকা ভিডিওটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে আহনাফের দিকে তাকালো। আহনাফ শক্তমুখে তাকিয়ে আছে অরুণিকার দিকে। ভিডিওটা একটা সিসিটিভি ফুটেজ থেকে নেওয়া, যেখানে চৌদ্দ-পনেরো বছরের একটা মেয়ে আট-নয় বছরের ছেলেকে জোরে জোরে চড় মারছে। কখনো বা তার চুল টেনে দিচ্ছে। কখনো বা তাকে রুমে আঁটকে রেখে ভয় লাগাচ্ছে। আরেকটা ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে অল্প বয়সী এক ছেলে বহুতল ভবন থেকে নিচে পড়ে গেছে। মানুষজন তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে।
ভিডিও বন্ধ করলো আহনাফ, আর শীতল দৃষ্টিতে অরুণিকার দিকে তাকালো। অরুণিকা মাথা নিচু করে বলল, “ইয়েস, আই ওয়াজ দা গার্ল।”
“নাউ শেয়ার ইউর অপিনিয়ন আবাউট দিস ফুটেজ। মাই ফার্স্ট কুয়েশ্চন ইজ, হোয়াই ডিড ইউ ডু দ্যাট?”
অরুণিকা মাথা নামিয়ে বলল, “আই ওয়াজ চাইল্ড। আই গট এংগ্রি ফর হিজ ষ্টুপিড বিহেভিয়ার এন্ড দ্যাটস হোয়াই আই স্ল্যাপড হিম।”
“ডিড ইউ সেটিস্ফাই আফটার স্ল্যাপিং মাই ব্রাদার?”
“ইয়েস। আই ওয়াজ সেটিস্ফাইড। এট দ্যাট টাইম, আই ডিডেন্ট নৌ আবাউট হিজ ইলনেস।”
“লাস্ট কুয়েশ্চন। ডিড ইউ সেটিস্ফাই আফটার টেইকিং হিজ লাইফ?”
অরুণিকা শক্ত কন্ঠে জবাব দিল, “আই ডিডেন্ট কিল হিম।”
আহনাফ হাসলো। অরুণিকা আহনাফের দিকে ঝুঁকে এসে বলল, “আমি জানি, তুমি আমার কথা বিশ্বাস করবে না। কিন্তু এটাই সত্য, আহনাফ। আমি খুন করি নি তোমার ভাইকে। আবরারকে আমি ধাক্কা দেই নি। আর এটাও সত্য ও নিজে নিজে ছাদ থেকে পড়ে যায় নি। ওর খুন ঠিকই হয়েছে। তবে সেই মানুষটা আমি না। অন্য কেউ। আমি চিনি তাকে। আমি তাকে দেখেছি। ছাদে আমার চোখের সামনে সেই মানুষটা তোমার ভাইকে ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে চেয়েছিল। আমি আবরারকে বাঁচাতে গিয়েছিলাম। সেদিন সন্ধ্যায় আমাকে দেখে সেই মানুষটা পালিয়ে নিচে নেমে গিয়েছিল। আমি আবরারের কাছে গিয়েছি। কিন্তু আমার শক্তি দুর্বল ছিল। আমি ওকে ধরে রাখতে পারি নি। আমার হাত ফসকে ও নিচে পড়ে গিয়েছিল।”
আহনাফ উঠে দাঁড়িয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “মা নিজ চোখে দেখেছে তুমি আবরারকে ধাক্কা দিয়েছো।”
“তোমার মা ছাড়া আর কেউ যদি দেখে থাকতো, তাহলে আমি নিজেই এই কথা বিশ্বাস করে নিতাম।”
আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে তাকালো অরুণিকার দিকে। অরুণিকা ক্ষীণ হেসে বলল, “আই আম সরি, আমি টেস্ট কন্টিনিউ করতে পারি নি। কিন্তু যাওয়ার আগে একটা কথা বলবো। আমি তোমাকে সেই মানুষটার পরিচয় দিতে পারবো না। যেদিন তুমি অন্ধভাবে কাউকে বিশ্বাস করা বন্ধ করবে, যুক্তি দিয়ে চিন্তা করবে, আমি সেদিন তোমাকে যুক্তি দিয়ে সত্যটা বলবো। কিন্তু এখন যদি বলি, তোমার অন্ধত্ব আমার জীবন আরো অন্ধকারাচ্ছন্ন করে দেবে। নিজের জীবনের মায়া আছে দেখেই চুপ করে আছি। আবরারের মৃত্যুর মিথ্যে অপবাদ দিয়ে তোমরা আমার হৃদয়ে কতো টন পাথর চাপিয়ে দিয়েছো, তোমরা নিজেরাও জানো না। খুন না করেও খুনী হয়েছি আমি। ওই এলাকার সবাই জানে, একটা ষোলো বছর বয়সী মেয়ে, দশ বছরের মানসিক প্রতিবন্ধী ছেলেকে জেদের বশে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে। অথচ আমার জীবনটা সেই অপবাদে কতোটা পিছিয়ে গেছে, তা তোমরা কেউ বুঝবে না। যদি কখনো সত্য সামনে আসে, আমাকে কি সময়গুলো ফেরত দিতে পারবে, আহনাফ? আমার যেই রাত-দিন তোমাদের দেওয়া মিথ্যে অপবাদে অশ্রু মুছতে মুছতে কেঁটেছে, পারবে সেই রাত-দিন হাসিতে রূপান্তর করতে? পারবে না।”
অরুণিকার হাত ধরে আহনাফ জিজ্ঞেস করলো, “সত্য বলে দে, অরু। আমি বিশ্বাস করবো।”
“যদি বলি তোমার কাছের কেউ।”
আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। অরুণিকা বলল, “যদি বলি তোমার দাদা, বিশ্বাস করবে?”
আহনাফ চেঁচিয়ে বলল, “মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোর?”
“যদি বলি তোমার দাদি, বিশ্বাস করবে?”
আহনাফ শীতল কণ্ঠে বলল, “উল্টাপাল্টা কথা বলবি না। আবরার সবার জান ছিল।”
“যদি বলি তোমার বাবা, বিশ্বাস করবে?”
অরুণিকার হাত মুড়ে দিয়ে আহনাফ বলল, “নিজের অপরাধ অন্য কারো উপর চাপিয়ে দিতে চাচ্ছিস?”
“যদি বলি তোমার মা, বিশ্বাস করবে?”
আহনাফ এবার অরুণিকার গাল চেপে ধরে বলল, “অন্তত বিশ্বাস হওয়ার মতো কিছু তো বলতে পারতি!”
অরুণিকা ক্ষীণ হেসে বলল, “জানতাম।”
সে এবার আহনাফের হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, “কাউকে ভালোবাসা অনেক কঠিন, আহনাফ। তোমার জন্য মায়া হয় আমার। এতো মায়া হয় যে আমি মনে প্রাণে চাই তুমি আমাকে খুনী ভেবেই বেঁচে থাকো। যতো সহজে আমাকে খুনী ভেবে ফেলেছো, ঠিক ততোটা সহজে আসল খুনীকে মেনে নিতে পারবে না তুমি। অনেক কষ্ট হবে তোমার। সহ্য করতে পারবে না তুমি সেই কষ্ট। তোমার পৃথিবী ঘিরে তোমার দাদা-দাদী, তোমার বাবা-মা। আমি ক্ষণিকের অতিথি। আমাকে ছেড়ে দিলে, অন্য কেউ সেই স্থান দখল করে নেবে। খুব শীঘ্রই তুমি অন্য কারো হতে পারবে। এবার না হয় তুমি তোমার পরিবারের পছন্দেই বিয়ে করে নিও।দেখে নিও, তুমি সুখী হবে। তোমার সংসার ঠিকবে। চৌধুরী ম্যানশন কতোটা ভয়ংকর, তা আমি ছাড়া আর কে ভালো জানে?”
আহনাফ অরুণিকার কাছে আসতে যাবে, অরুণিকা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “মুক্তি দাও আমাকে, তুমি নিজেও মুক্তি পাবে।”
এই বলে বেরিয়ে পড়লো অরুণিকা। আহনাফ ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লো। মাথাটা ভারী ভারী লাগছে তার। ভাবতে লাগলো, “অরু যদি সত্য বলে, তাহলে মা মিথ্যে বলছে। কিন্তু কেন? মা কাকে বাঁচাতে চাচ্ছে? বাবাকে? দাদাকে? না-কি দাদীকে? এজন্যই কি বাবা কেইস করে নি অরুর বিরুদ্ধে? বাবাই মেরেছিল আবরারকে? না, না, অসম্ভব। বাবা তো আমার চেয়ে বেশি ভালোবাসতো আবরারকে। তাহলে কি দাদা? কিন্তু উনি তো প্রায়ই আবরারের সাথে থাকতো। আবরারের সাথে সময় কাটাতে ভালোই লাগতো দাদার। তাহলে কে? মা! দাদী? কখনোই না। ওদের পক্ষে এই কাজ করা সম্ভবই না। মা তো রাত-দিন জেগে থাকতো আবরারের জন্য। আবরার অসুস্থ হলে মাকে কতো বার কাঁদতে দেখেছি। আমার জন্য তো মাকে এতোটা অস্থির হতে দেখি নি আমি! আর দাদী? আবরার একবার সিঁড়ি থেকে পড়ে যেতেই, পুরো বাড়ি মাথায় তুলেছিলো দাদী। তাহলে অরু এই কথা কেন বললো? অরু কি ইচ্ছে করে কথা ঘোরাচ্ছে?”
(***)
প্রথম সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ। ভার্সিটি থেকে দু’সপ্তাহের ছুটি পেয়েছে অরুণিকা। শুয়ে-বসে দিন কাটছে তার। আজও প্রতিদিনের মতো বারান্দায় বসে ছিল। তখনই নোটিফিকেশনের শব্দ শুনে অলস হাতে ফোন নিলো। নোটিফিকেশনে হিমালয়ের একাউন্ট থেকে মেসেজ এসেছে দেখে ধড়ফড় করে রুমে ঢুকে ফ্যান চালু করে বিছানায় পা গুটিয়ে বসে পড়লো সে। মেসেজটি পড়লো অরুণিকা। সেখানে লেখা,
“খুব সাধারণ প্রশ্ন।”
অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে ভাবতে লাগলো, এখন কি লিখবে সে? অনেক ভাবাভাবির পর লিখলো,
“জানার আগ্রহ ছিল। কারণ এ হি নাফ আলয় নামটা রহস্যময়। আপনার লেখা পড়েছি। খুব রহস্য নিয়েই লিখেন। বেশ ভালো লাগে পড়তে।”
অরুণিকা অপেক্ষা করতে লাগলো। প্রায় এক ঘন্টা পর উত্তর এলো।
“অনেক দীর্ঘ উত্তর সেই প্রশ্নের। দীর্ঘ করা কি শ্রেয় হবে?”
অরুণিকা ফোনের কাছেই ছিল। উত্তর এলে তৎক্ষণাৎ ফিরতি লিখতে বসলো সে, আবার না কখন অনলাইন থেকে চলে যায়!
“দীর্ঘ করলেও সমস্যা নেই।”
এইটুকু লিখে অরুণিকা মুখ চেপে হেসে বলল, “মনে হচ্ছে ফ্লার্ট করছি! সমস্যা নেই, ইনিই আমার একমাত্র সেলেব্রিটি লেখক ক্রাশ। একটুখানি ফ্লার্ট তো করাই যাই।”
প্রতিত্তোর এলো মিনিট খানিক পর।
“নাফ নদীর নাম শুনেছেন?”
অরুণিকা ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ছিল। খুব তাড়াতাড়ি উত্তর আসায় সে বেশ খুশি হলো। লিখলো,
“হ্যাঁ, শুনেছি।”
“নাফ নদী যেমন দু’টি দেশকে পৃথক করেছে, ঠিক তেমনি আমি সেই হিমালয়, যাকে পৃথক করেছে একটি সীমান্ত।”
অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে লিখলো, “বুঝলাম না।”
“আমি একজন বিভক্ত মানুষ।”
“কেন?”
“আমাকে কি আপনি কখনো দেখেছেন?”
“না। আপনাকে তো বোধহয় কেউই দেখে নি।”
“সেটাই বুঝিয়েছি। আমার দু’টি ভিন্ন মানুষ। এক আমি লুকায়িত, অন্য আমি প্রকাশিত। মাঝে একটি অদেখা নাফ নদী। অর্থাৎ সীমান্ত। তাই এমন নামকরণ।”
“বেশ গভীর চিন্তাভাবনা আপনার।”
অরুণিকার মেসেজটি হিমালয় দেখেও কোনো উত্তর দিলো না। উত্তর না আসায় বেশ অস্থির হয়ে পড়লো অরুণিকা। এমন অস্থির কেন লাগছে তার? ফোনটা পাশে রেখে শুয়ে আছে সে। কিছু সময় পর আবার ফোনের নোটিফিকেশনের শব্দ হলো। অরুণিকা তড়িঘড়ি করে ফোন হাতে নিতেই দেখলো, হিমালয়ের মেসেজ এসেছে। সে লিখেছে,
“লেখালেখির সুবাধে একটু বেশি চিন্তা করে ফেলি বোধহয়।”
অরুণিকা লিখলো, “আপনার নতুন কোনো বই আসবে না?”
“লিখছি। অদ্ভুত একটা বই লিখছি। যেই বইয়ের নাম এখনো ভাবতে পারছি না। বইটিতে দু’একটা গল্প থাকবে।”
“আমি আপনার সব বই পড়েছি। ইচ্ছে করছে যেটা লিখছেন, সেটাও পড়ে ফেলি।”
এবারও অরুণিকার মেসেজ দেখার পরও হিমালয়ের কাছ থেকে কোনো উত্তর এলো না। সে কি বেশি বলে ফেলেছে? ক্ষমা চেয়ে নেবে কি? এসব ভাবতে ভাবতেই একদিন কেটে গেল অরুণিকার। পরদিন রাতে উত্তর এলো হিমালয়ের। সে কিছু ছবি পাঠিয়েছে। অরুণিকা ছবিগুলো দেখে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেল। হিমালয় তার নতুন গল্পের কিছু অংশ পাঠিয়েছে। অরুণিকা পড়তে লাগলো।
অন্তুর খুব শখ ভ্রমণ করার। একদা সে তার বাল্য বান্ধবী ইরাকে নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিল সমুদ্র পাড়ে। ইরা আবেগী। আগে কখনো সমুদ্রে দেখে নি সে। সেদিন কি চমৎকার সৌন্দর্যই না দেখছিল সে! আবেগে ভেসেই গেল মেয়েটি৷ মিথ্যেমিথ্যি না, সত্যিই পা ফসকে সমুদ্রের স্রোতের ধাক্কায় ভেসে যাচ্ছিল। অন্তু উন্মাদের মতো ছুটে গিয়েছিল তার দিকে। বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, “মোর প্রিয় ইরা, আমার বুকে হাত রেখে দেখ, তোকে হারানোর ভয়ে আমার হৃদস্পন্দন তীব্র হয়ে এসেছিল। দুঃসাহসের মাত্রা ছাড়িয়ে সাত সমুদ্র পার করে ফেলতে যাচ্ছিলাম।”
ইরা মুগ্ধ চোখে তাকালো অন্তুর দিকে। মেয়েটির চোখে নোনা জল, অথচ পুরো শরীর জুড়ে তার নোনাজল লেপ্টে আছে। এমনকি তারা দু’জনই ভাসছে নোনাজলের সাগরে। মৃত্যু মাথায় নিয়ে অন্তু চুমু খেলো ইরার সেই নোনাজলে সিক্ত ললাটে।
অরুণিকা এইটুকু পড়ে লিখলো, “সুন্দর তো!”
হিমালয় লিখলো, “অন্তু কি মারাত্মক বাড়াবাড়ি করে ফেললো?”
“মোটেও না। প্রিয় মানুষকে বাঁচানোর জন্য সাত সমুদ্রই যদি পার করার সাহস না থাকে, তাহলে সে কেমন প্রেমিক!”
“বাস্তবে প্রেমিকেরা কি সাত সমুদ্র পার করতে পারে?”
“তা হয়তো পারে না।”
“পারে না বলেই তো ভালোবাসা কল্পনাতেই সুন্দর।”
“ভালোবাসা কল্পনাতে সুন্দর। কিন্তু বাস্তবে আরো সুন্দর হয়, যদি সেই ভালোবাসায় আকার দেওয়ার ইচ্ছে থাকে।”
“খুব তো ভালোবাসাতে ডুবে আছেন মনে হচ্ছে।”
অরুণিকা হিমালয়ের প্রশ্নে বেশ লজ্জা পেলো। কোনো উত্তর দিলো না। ফোন হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে রইলো। মিনিট খানিক পর হিমালয় লিখলো,
“ভালোবাসায় ডুবে যাওয়া ভালো না। তবুও একটা ক্ষুদ্র পরীক্ষা করে বুঝে নিতে পারেন, ডুবে আছেন, না-কি ডুবতে দেরী আছে, না-কি ডোবার কোনো সম্ভাবনায় নেই।”
অরুণিকা মেসেজটি পড়ে উত্তরে লিখলো, “কেমন পরীক্ষা?”
“চোখ বন্ধ করে ভাবুন, অন্তু নামের কেউ আছে আপনার আশেপাশে। আপনি ভীষণ বিপদে পড়েছেন। আপনি হয়তো তার ইরা। সে আপনাকে সেই বিপদ থেকে বাঁচানোর জন্য নিজেই ছুটে এসেছে। যদি এমন পুরুষ আপনার জীবনে অনেক থাকে, অথচ চোখ বন্ধ করতেই আপনি শুধু একজনকেই অনুভব করলেন, তবে আপনি ডুবে গেছেন। যদি এমন পুরুষ একজনই থেকে থাকে যে আপনাকে এমন স্মৃতি দিয়েছে, তবে তার সংস্পর্শে এলে আপনার ডুবতে খুব বেশি দেরী নেই। আর যদি না থাকে, তবে আপতত কোনো সম্ভাবনা নেই।”
অরুণিকা চোখ বন্ধ করলো। মিনিট খানিক বন্ধ চোখে ভাবতে লাগলো বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত মনে গেঁথে যাওয়া এমন মুহূর্ত আছে কি-না! ভাবতে ভাবতেই মস্তিষ্ক তাকে নিয়ে গেল ছ’বছর আগের এক বিকেলে। মাত্রই নতুন চৌধুরী ম্যানশনে উঠেছিল তারা। মাস দু’য়েক হয়েছে। সেই বিকেলে সবাই এক দাওয়াতে গিয়েছিল। অরুণিকার বার্ষিক পরীক্ষা। সে যায় নি। বাসায় বসে পড়ছে। হঠাৎ টেবিল ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো। অরুণিকা ভয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো অদ্ভুত ভাবে কাঁপছে ঘর। দুলছে তার মাথা। অরুণিকা চিৎকার করে কাঁদছে। হঠাৎ সে খেয়াল করলো, দরজায় জোড়ে জোড়ে ধাক্কা দিচ্ছে কেউ একজন। অরুণিকা দৌঁড়ে দরজা খুলে দিতেই আহনাফ ভেতরে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো। অরুণিকা শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো আহনাফকে। আহনাফ তাকে কোলে উঠিয়ে টেবিলের নিচে গিয়ে বসে পড়লো। অরুণিকা অশ্রুসিক্ত চোখে আহনাফের দিকে তাকিয়ে রইলো। আহনাফ তার চোখ মুছে দিয়ে বলল, “অরু, তুই উপরে আছিস মনে পড়তেই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কি মারাত্মক ভূমিকম্প হলো রে! ভয় পেয়েছিস?”
অরুণিকা আহনাফের হাত নিজের বুকের উপর রেখে বলল, “দেখো, আমার বুকটা কেমন ধকধক করছে!”
আহনাফ অরুণিকার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, “আমারটা শুনলে তো মরেই যাবি। তোর কিছু হয়ে গেলে আমি কি করতাম?”
অরুণিকা সেই বিকেলেই প্রথম আহনাফের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকালো। আহনাফের সাথে তার দীর্ঘ ঝামেলার ইতি সেই বিকেলেই টেনেছিল অরুণিকা। মেয়েদের অভিমান আর রাগ ভাঙানোর একমাত্র ঔষধ যত্ন। এতোদিন আহনাফ জোরাজোরি করে অরুণিকার মনে ক্ষোভ বাড়িয়েছিল শুধু। আর আজ একটুখানি যত্ন, অরুণিকার সব ক্ষোভ জমে পানি করে দিয়েছে। বিয়ের দিন থেকে সেই বিকেল অব্ধি আহনাফের সব ভুল অরুণিকা সেই টেবিলের নিচে বসেই মাফ করে দিয়েছিল।
অতীতের স্মৃতি থেকে বেরিয়ে এলো অরুণিকা। তার চোখে অশ্রু ভীড় করেছে। ফোন পাশে রেখে আয়নার সামনে নিজেকে দাঁড় করালো সে। নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলো, “আমি কি আহনাফকে এখনো ভালোবাসি?”
চলবে-
#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-২৮ ||
“তুমি কিন্তু আমাকে বলেছিলে রোজ গল্প শুনাবে?”
ইমানের কন্ঠ শুনে চমকে উঠলো অরুণিকা। পাশ ফিরতেই দেখলো ইমান ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। অরুণিকার হাতে একটি কবিতার বই। বইটি দেখে ইমান জিজ্ঞেস করলো, “এটাও কি সেই হিমালয়ের?”
অরুণিকা মাথা নেড়ে বলল, “মিষ্টিমশাইয়ের।”
“আচ্ছা, নামটা কিন্তু বেশ সুন্দর, মিষ্টি মশাই।”
অরুণিকা মৃদু হেসে বলল, “হুম।”
“তা আমাকে গল্প কবে থেকে শোনাবে?”
অরুণিকা গালে হাত দিয়ে ইমানের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি কখন থেকে শুনতে চান?”
“এই, এই, এভাবে কিন্তু আর কথা বলা যাবে না।”
ইমানের গলার স্বর হঠাৎ পরিবর্তন হতেই অরুণিকা অবাক হয়ে বলল, “কি হলো হঠাৎ? কি বলা যাবে না?”
“আমাকে এখন থেকে তুমি সম্বোধন করতে হবে। আমরা কিন্তু ফ্রেন্ড।”
অরুণিকা কপাল কুঁচকে বলল, “আমি তো আপনাকে একবারো বলি নি, আমরা ফ্রেন্ড!”
“কিন্তু আমি তো ভেবে নিয়েছি।”
অরুণিকা হালকা হেসে বলল, “নিজে নিজে ভেবে নিলে কি হবে?”
“কেন ভাবতে কি কোনো বারণ আছে?”
“হ্যাঁ সিনিয়রদের সাথে বন্ধুত্ব হয় না।”
ইমান দমে গেল। আর কিছু না বলে কানে ইয়ারবাড গুঁজে নিলো নীরবে। অরুণিকা ইমানের কোনো সাড়া না পেয়ে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলো ইমান চোখ বন্ধ করে গান শুনছে। অরুণিকা উঠে দাঁড়াতে যাবে ওমনি ইমান তার হাত ধরে তাকে বসিয়ে দিয়ে নিজেও বসে পড়ল অরুণিকার পাশে। এরপর বলল, “ছাদে আসি তোমার পাশে বসে একটু কথা বলতে। তুমি চলে গেলে আমার একদমই ভালো লাগবে না। নাই বা বন্ধু হলে, অন্তত প্রতিবেশীর দায়িত্ব তো পালন করা যায়!”
“কীভাবে?”
“এই যে আমার একাকীত্বে আমাকে সঙ্গ দিয়ে।”
অরুণিকা তাকিয়ে রইলো ইমানের দিকে। ইমান হুট করে অরুণিকার কানে একটি ইয়ার বাড গুঁজে দিয়ে বলল, “গান শুনে কবিতা পড়ার আলাদা মজা আছে। ট্রাই করে দেখো।”
শ্রবণেন্দ্রিয় জুড়ে বিস্তার করছে মৃদু গান, সেই সাথে যুক্ত মিষ্টিমশাইয়ের লেখা কবিতা। কানে বাজছে পরিচিত একটা গান।
“ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে
তোমার দেখা আমার সঙ্গে
মুখোমুখি আমরা দু’জন
মাঝখানে অনেক বারণ!”
আর অরুণিকার ঠোঁটের আগায় জড়ো হলো মিষ্টিমশাইয়ের লেখা ‘অমাবস্যার আলো।’
“কোনো এক সাঁঝবেলায়
যদি তোমাতে-আমাতে দেখা হইয়া যায়
তুমি কি পারিবে হিয়ার গোপন কথা আমারে কহিতে,
ওগো সাঁঝবাতি! বলিয়া যেও।
বিরান পথভূমিতে পা ফেলিয়া চলি
সময় তো ভাসিয়া যাইতেছে,
বারেবারে তোমারই গৃহখান খুঁজি
না জানি কোন দুশমন মোর প্রেম তরী ডুবাইতেছে।
মোর হিয়ার বার্তা বেশ এলোমেলো হইয়া যায় আজকাল
তোমারে নিয়া লিখিলে কালি পড়ে না সাদা পাতায়।
পরন্তু আমি তোমাতেই ডুবিয়া আছি।
তুমি হইলা মোর হৃদয়ে জ্বালা ধরানো একখান অমাবস্যার আলো।”
অরুণিকা কবিতাটি পড়া শেষে ইমানের দিকে তাকালো। ইমান মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কানে এখনো বাজছে-
“বাইরে তখন হাওয়া ঝোড়ো
তুমি হয়তো অন্য কারো
আরো একবার বলবো সেদিন
আজ যানে কি জিদ না করো!”
অরুণিকা চোখ সরিয়ে নিলো। ইমান হালকা ঝুঁকে বলল,
“আকাশ শান্ত, সমীরণ বিশ্রামে গেছে,
তুমি যদি হতে চাও বন্ধু
আরো একবার বলতে চাই
আজ ফিরিয়ে দিও না আমায়।”
অরুণিকা মৃদু হেসে মাথা দুলালো। ইমান উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। মাথা নিচু করে বসে আছে অরুণিকা। ইমান বললো, “তবে কি ণিকা বন্ধুত্বের দাওয়াত গ্রহণ করেছে?”
অরুণিকা স্মিত হেসে বলল, “হ্যাঁ।”
ইমান হাসলো। অরুণিকাও প্রতিত্তোরে হাসলো।
সামনের ছাদে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আহনাফ। তার দৃষ্টি মুখোমুখি ছাদে পাশাপাশি বসে থাকা অরুণিকা ও ইমানের দিকে। তূর্য তার পাশে এসে দাঁড়াতেই আহনাফ হনহনিয়ে নেমে পড়ল ছাদ থেকে। তূর্য নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
(***)
সকাল থেকেই মাথা ঘোরাচ্ছে রুদবার। দোকানে যাওয়ার জন্য সিঁড়ি বেয়ে নামছিল, তখনই পা ফসকে যেতেই তূর্য তাকে জড়িয়ে ধরলো। রুদবা নিভু নিভু দৃষ্টি মেলে তূর্যকে দেখে হালকা ধাক্কা খেলো। তূর্য ভ্রূ কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। রুদবা ছোট ছোট দৃষ্টিতে তূর্যের দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসলো। তূর্য তাকে সোজা দাঁড় করিয়ে বলল, “তোমার এই অবস্থা কেন?”
রুদবা সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিল না। তূর্য তার হাত ধরে জিজ্ঞেস করলো, “তোমার কি শরীর খারাপ?”
রুদবা ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “বাসায় কেউ নেই। সবাই বাড়িতে গেছে। সকাল থেকে শরীর ভালো না। এখন দোকানে যাচ্ছি ওষুধ আনতে।”
“তুমি আমাকে বলো, আমি নিয়ে আসছি। এই অবস্থায় তুমি দোকানে যেতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না, সিঁড়ি বেয়েই যেখানে নামতে পারছো না।”
রুদবা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো তূর্যের দিকে। তূর্য সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করলো না। সে ওষুধের নাম নিয়ে রুদবাকে বাসায় বসিয়ে চলে গেল। মিনিট দশেক পর ওষুধ নিয়ে রুদবাদের বাসায় এলো সে। রুদবা নির্দ্বিধায় তূর্যকে বাসায় বসতে দিলো। কিন্তু তূর্য তাকে ওষুধ খাইয়ে দিয়েই বেরিয়ে গেল। রুদবা দরজা বন্ধ করে পীপহোলে তাকালো। দেখলো তূর্য বাসায় ঢুকে পড়েছে। রুদবা এবার দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ালো। তার মন এক রাশ ভালো লাগায় ছেয়ে গেছে। পরক্ষণেই সে নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলো, “অরু তবে কেন বললো তূর্য শেখ প্লে বয়? উনি এমন সুবর্ণ সুযোগ পেয়েও আমার সাথে ফ্লার্ট করতে চান নি। বাসায় কেউ নেই জেনেও কোনো সুযোগ নেন নি। তাহলে অরুর উনাকে প্লে বয় কেন মনে হলো? তাহলে অরু কি আমাকে মিথ্যে বলেছে?”
(***)
তূর্য অরুণিকার শাড়ি পরা ছবিটি বের করে এনেছিল আজ। ভার্সিটির মেলায় সেই ছবি তুলেছিল তূর্য। ছবিটি টেবিলের উপর রাখা ছিল। তাহমিদ সেই ছবি দেখে থমকে গেল। হাতে নিয়ে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল সেই ছবিটির দিকে। তূর্য তাহমিদের সামনে এসে দাঁড়াতেই তাহমিদ ছবিটা আগের জায়গায় রেখে রুমে ঢুকে পড়লো। তূর্য নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে ছবিটির দিকে মিনিট খানিক তাকিয়ে রইলো। এরপর চোখ বন্ধ করে মিনমিনিয়ে বলল, “আমাকে মাফ করে দিস, তাহমিদ। আমার কারণেই বোধহয় তুই তোর ভালোবাসার মানুষটিকে হারিয়ে ফেললি। কিন্তু আমার কিছুই করার ছিল না। তোরা সবাই আমাকে ভুল চিনলি। আসল আমিটাকে যে কেউ ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে, এই সত্য কেউ জানলো না। পুরো পৃথিবী জানে, তূর্য শেখ উপমা নামের একটি মেয়েকে ঠকিয়েছে। অথচ ঠকে তো আমিই গিয়েছিলাম। এমন ঠকা ঠকেছি, এই পৃথিবীর প্রতিটি নারীকেই এখন ছলনাময়ী মনে হয়।”
তাহমিদ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে শূন্য দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। তার হাতে একটি ডায়েরি। ডায়েরির মলাট উল্টাতেই বেরিয়ে এলো একটি মেয়ের ছবি। পরণে লাল পাড়ের সাদা শাড়ি। মেলায় অরুণিকা যেই শাড়িটা পরেছিল, হুবহু সেই শাড়িতে। তাহমিদ ছবিটি আলতো ছুঁয়ে দিয়ে বলল, “প্রিয় চন্দ্রিমা, এতোদিনে হয়তো বিয়ে করে নিয়েছো! অনেক ইচ্ছে করছে তোমাকে আবার সেই শুভ্র সাজে দেখতে। আপসোস, সাদা শাড়িতে তোমাকে দ্বিতীয় বার দেখার শখ আর পূরণ হয় নি। সেই যে একবার তুমি আমার চোখ ধাঁধালে, সেই দৃষ্টি এখনো কোনো শুভ্রতায় আঁটকাই নি। আমার চোখের কন কোষটিতে হয়তো ধুলো জমেছে। ধূসর দেখছি সব। শুভ্রতাও এখন মলিন হয়ে গেছে। চন্দ্রিমা, নাগচাপা দেখলেই অস্থিরতায় ভার হয়ে আসে আমার মন। তোমার ভীষণ পছন্দের ফুল ছিল! সাদাও তো তোমার প্রিয় রং। মনে আছে, সেই কালবৈশাখীর কথা? তুলা গাছটি যখন ঝড়ো হাওয়ায় পুরো প্রকৃতিতে তুলা ছড়িয়ে দিয়েছিল, তুমি তুষার পড়ছিল ভেবে, কতোটাই না খুশি হয়েছিলে। তোমার সেদিনের উজ্জ্বল চোখ জোড়া দেখে স্বপ্ন দেখেছিলাম, একদিন তোমাকে বরফের দেশে নিয়ে যাবো। কিন্তু সেই স্বপ্নটা এখন তোমাকে নিয়ে অন্য কেউ দেখছে। চন্দ্রিমা, খুব ইচ্ছে করছে তোমাকে দেখতে। তোমাকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে, আমি কি এখনো তোমার হৃদয়ের কোনো অংশে বেঁচে আছি?”
(***)
অরুণিকার ধ্যানমগ্ন সম্পূর্ণ তার ফোনে। সকাল থেকে রাত অব্ধি অল্প সময়ের বিরতি নিয়ে নিয়ে ফোন দেখছে সে। ইদানিং হিমালয় তার মেসেজের উত্তর দিতে দেরী করে না। হিমালয়ের সময়ের ভাগ পেয়ে অজানা কারণেই অরুণিকা বেশ খুশি। হিমালয় তার বইয়ের জন্য লেখা কিছু অংশ প্রায়ই অরুণিকাকে পাঠায়। এভাবে কেটে গেল দু’সপ্তাহ। ভার্সিটির ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। অরুণিকা একদিনও যায় নি ক্যাম্পাসে। বিকেলে কাজে যায়, রাতে টিউশনে, বাকি সময়টা হিমালয়ের লেখা পড়ে কাটায়। এদিকে রুহানি এখন অরুণিকার সাথে কথা বলতে পারে। তাদের কথোপকথনের নিষেধাজ্ঞা তুলে দিয়েছেন আতকিয়া জাহান। কিন্তু অরুণিকার হাত খরচ এখনো বন্ধ। তবে অরুণিকার এসবে আর কোনো মাথাব্যথা নেই। পাঁচ বছর দুঃখ পাওয়ার পর প্রথম নিজেকে সুখী মনে হচ্ছে তার। অনেক কিছু চেয়েছে এই পাঁচ বছরে। কিন্তু অপূর্ণতার পাল্লা ভারী ছিল। কিন্তু এবার হিমালয়ের মনোযোগ পেয়ে যেন সব আক্ষেপ কেটে গেছে তার। মারাত্মক ভাবে মানুষটার লেখার মায়ায় পড়ে গেছে সে। রুহানি এসব দেখে অবাক হয়ে বলল, “তোর জীবনে তো এখন হিমালয় ছাড়া আর কারো জায়গা নেই দেখছি। প্রেমে-টেমে পড়েছিস না-কি! মনে রাখিস, আহনাফ চৌধুরীর সাথে এখনো বিয়ে ভাঙে নি তোর।”
রুহানির এই কথা যেন অরুণিকার উজ্জ্বল চোখে আঁধার নামিয়ে দিলো। দোটানায় পড়ে গেছে সে। আহনাফের প্রতি মায়া এখনো কাটে নি তার! আবার এদিকে হিমালয় তার মন জুড়ে বিস্তার করছে। কেমন বিশ্রী একটা অবস্থা! চোখ বন্ধ করে সে কিছু চাইতে গিয়েও চাইতে পারছে না। সৃষ্টিকর্তা তার আর্জি শুনবেন কেন? আহনাফ তো তার বর! বিবাহিত হয়ে অন্য পুরুষে মন আঁটকানো যে অনেক ভয়ংকর পাপ। বিয়ে তো সে শীঘ্রই ভেঙে দেবে। কিন্তু এখনো তো ভাঙে নি। অরুণিকা বেশ দ্বিধায় পড়েছে। অপরাধবোধ আর আবেগ এই দু’টোর মধ্যে চলছে মারাত্মক যুদ্ধ। তবুও মেয়েরা আবেগের কাছে হারতে বাধ্য হয়। অরুণিকার পক্ষেও হিমালয়ের মেসেজ উপেক্ষা করা অসম্ভব।
(***)
দুই সপ্তাহ পর ক্যাম্পাসে আসতেই অরুণিকা যতির মুখোমুখি হলো। যতিকে দেখে অরুণিকা মুখ ঘুরিয়ে চলে আসতে যাবে, তখনই যতি বলল,
“আমি আহনাফ স্যারকে পছন্দ করি।”
অরুণিকা খুব বেশি অবাক হলো না। সে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, “তো!”
“আমি জানি তুমি উনার কাজিন। আর তোমাদের অল্প বয়সে পরিবারের জোড়াজুড়িতে বিয়ে হয়েছে। এও জানি তুমি এই সম্পর্ক আর রাখতে চাও না।”
অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে বললো, “আমাকে এসব কেন বলছো?”
“আমি কিন্তু এ কথা কাউকে বলি নি।”
“তুমি আমাদের ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছো?”
“সেদিন তোমাকে স্যারের সাথে দেখার পর আমার একটুও ভালো লাগে নি। এরপর খোঁজ নিয়েছি। আর জানতে পারলাম সব।”
“আমি আশা করবো, তুমি এই কথা নিজের মধ্যেই রাখবে।”
“এক শর্তে।”
অরুণিকা যতিকে আপাদমস্তক দেখে বলল, “তুমি আমাকে শর্ত দিচ্ছো?”
“হ্যাঁ। নয়তো সবাইকে সত্যটা বলে দেবো আমি।”
“তোমার কী লাভ হবে বলে?”
“আমার কোনো লাভ হবে না। তবে তোমার গ্রেজুয়েশন শেষ করতে অনেক কষ্ট হবে।”
অরুণিকা বুকে হাত গুঁজে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে যতির দিকে তাকিয়ে বলল, “কি চাইছো তুমি?”
“স্যারকে আমার হয়ে একটা চিঠি দিতে পারবে? আমি উনাকে পছন্দ করি, এটা জানাবে ব্যস।”
“আর উনি রাজি হয়ে যাবেন?”
“কেন হবেন না? আমি যথেষ্ট সুন্দর। স্মার্ট, ক্লাসেও মনোযোগ দেই। আমার ফ্যামিলিও ভালো। কেন রাজি হবেন না?”
যতি অরুণিকার হাতে একটা চিঠি দিয়ে বলল, “স্যারকে দিও।”
যতি চিঠিটা দিয়ে চলে যেতেই অরুণিকা চিঠিটির দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, “আমার আশেপাশে এতো পাগল কেন? মাঝে মাঝে তো মনে হয় আমি একটা পাগলাগারদে পয়দা হয়েছি। ওহ গড, এইটুকু জীবনে আমি এতো এতো পাগলের সাক্ষাৎ পেয়ে গেছি! এদের নিয়ে রিসার্চ করতেই বোধহয় পৃথিবীতে এসেছি আমি।”
(***)
আহনাফ আজ ক্যাম্পাসে যায় নি। অরুণিকা তাই যতির চিঠি রুহানির দ্বারা আহনাফের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। আহনাফ চিঠি হাতে পেয়ে বেশ খুশি। রুহানি বলে গেছে, এই চিঠি অরুণিকা দিতে বলেছে। সে ভাবছে, তার অরু তাকে নিয়ে চিঠি লিখেছে! এর চেয়ে চমৎকার বিষয় দ্বিতীয়টা হতে পারে না। আহনাফের রং-বেরঙের ভাবনায় কালি ছড়ালো যতির চিঠিটি। বেশ রেগে গেল সে। অরুণিকাকে সঙ্গে সঙ্গেই কল করলো। অরুণিকা কল রিসিভ করলো বিশ মিনিট পর। ওপাশ থেকে আহনাফ শীতল কন্ঠে বলল, “কেমন নির্লজ্জ বউ তুই! তোর বরকে কেউ একজন লাভ লেটার দিলো, আর তুই নাচতে নাচতে চিঠিটা পাঠিয়ে দিলি?”
অরুণিকা মুখ বাঁকিয়ে বলল, “ভাবছি, মুভ অন তো আমি করেই ফেলছি। তোমাকে কেন সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করবো?”
“মুভ অন করছিস মানে কি?”
“কেন মুভ অন অর্থ জানো না? ছি! ছি! ছি! তুমি না-কি আবার ইংরেজি শিক্ষক।”
আহনাফ দাঁতে দাঁত পিষে বলল, “অরু, প্লিজ।”
“দেখো তোমার বাইক্কা কথা শোনার জন্য আমি ফ্রি বসে নেই।”
এই বলে কল কেটে দিল অরুণিকা। এদিকে আহনাফ চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে হাত মুঠো করে দেয়ালে জোরে আঘাত করলো। হাত ঝিনঝিন করে উঠলো তার। চোখ-মুখ শক্ত হয়ে গেছে। আহনাফ ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “তুই এভাবে আমাকে ভুলে যাবি, অরু? দেখিস, তোকে আমি অন্য কারো হতে দেবো না। তুই আমাকেই ভালোবেসেছিস, দ্বিতীয় বার প্রেমে পড়লে সেই মানুষটাও আমি হবো। তোর ভালোবাসার প্রথম ও শেষ অংশে আহনাফ চৌধুরীর নামই সিল মারা থাকবে। ইটস মাই চ্যালেঞ্জ, ডিয়ার পারমানেন্ট ওয়াইফ।”
(***)
বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাস্তার ছোট ছোট বাচ্চাদের লুকোচুরি খেলা উপভোগ করছে অরুণিকা। এমন দৃশ্য সে ক্যামেরা বন্দি করে ইন্সটাগ্রামে পোস্ট করলো। হঠাৎ নোটিফিকেশনের শব্দ হতেই দেখলো হিমালয় তাকে ফলো করছে। এমন কিছু দেখে আকাশের চাঁদ হাতে পেলো সে৷ যদিও পাব্লিক পোস্ট করেছিল, হিমালয়কে দেখানোর উদ্দেশ্যেই। হিমালয় ছবিটি দেখার পর একাউন্ট আবার প্রাইভেট করে দিল। আর বুকে ফোন গুঁজে মনে মনে বলল, “আমি জানি না, কেন যেন আমার খুব ইচ্ছে করছে এই হিমালয়কে ভালোভাবে জানতে। খুব বেশি ইচ্ছে করছে। মানুষটার কথাগুলো আমাকে খুব এট্রেক্ট করছে। মনে হচ্ছে, প্রথম আমার মনের মতো কেউ আমার জীবনে এসেছে।”
অরুণিকা এসব ভাবছিল তখনই রুহানি রুমে এসে বলল, “আহনাফ স্যার তোকে ডাকছে!”
অরুণিকা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। ভ্রূ কুঁচকে বলল, “উনি এই বিকেলে? উনি না সন্ধ্যায় তোকে পড়াতে আসে?”
“আজ থেকে দু’জনের পড়ার সময় আলাদা। আহনাফ স্যার বিকেলে আসবেন, আর আরাফ স্যার সন্ধ্যায়।”
অরুণিকা বিড়বিড় করে বলল, “এই বদমাশটা আমাকে জ্বালানোর জন্য এই কাজ করেছে! সন্ধ্যায় আমি বাইরে কাজে যাই, আমাকে তো জ্বালাতে পারে না, তাই এখন আমাকে জ্বালানোর জন্য শিডিউলই চেঞ্জ করে ফেলেছে।”
অরুণিকা নীরবে রুহানির রুমে ঢুকতেই আহনাফ রুহানিকে বের হয়ে যেতে বলল। রুহানি তবুও দাঁড়িয়ে আছে শক্ত হয়ে। আহনাফ বলল, “যাও! কি বলছি শুনছো না?”
রুহানি অন্যদিকে ফিরে তাকালো। আহনাফ রুহানির মুখের সামনে তুড়ি বাজাতেই রুহানি এক গাল হাসলো। আহনাফ দাঁতে দাঁত পিষে বলল, “তোমার মাকে ডেকে আরেকটু শক্ত হতে বলবো?”
রুহানি ব্যস্ত কন্ঠে বললো, “না, না, না চলে যাচ্ছি। আমি আসলে এই কয়েকদিন কানে একটু কম শুনছিলাম। বায়ুমন্ডলে মনে হয় অনেক বাঁধা। ধাক্কা খেয়ে খেয়ে কানে আসতে দেরি হচ্ছে।”
রুহানির কথায় অরুণিকা মুখ চেপে হাসলো। আহনাফ রাগী দৃষ্টিতে তাকাতেই রুহানি দৌঁড়ে বেরিয়ে গেল। রুহানি চলে যেতেই আহনাফ অরুণিকার হাত ধরে তাকে জোর করে নিজের কোলে বসিয়ে দিয়ে বলল, “আমার তোকে সরি বলার ছিল।”
অরুণিকা উঠে দাঁড়াতে যাবে তখনই আহনাফ তার কোমড় জড়িয়ে ধরে বলল, “আমি এতো দিন যা আচরণ করেছি, তার জন্য সরি। অরু, আমরা কি সব নতুন করে শুরু করতে পারি না?”
অরুণিকা উঠে দাঁড়ালো। আহনাফ অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অরুণিকার দিকে। অরুণিকা কিছু না বলে চলে গেল। আহনাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এদিকে অরুণিকা বের হতেই রুহানি বলল, “এতো কাহিনি করে জাস্ট সরি বললো?”
“কেন তুই কি ভেবেছিস কোলে নিয়ে রোলারকোস্টারে চড়াবে?”
“লোকটার যা স্বভাব, ভেবেছি উনি গায়ে সুপার গ্লু লাগিয়ে এসেছে, যাতে একবার বসলে আর উঠতে না পারিস।”
“তুই খুব লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিলি এসব?”
“নিষ্পাপ মন আমার! একটু দেখে ফেলি আর কি। অনেক চেষ্টা করেও চক্ষু হেফাজত করতে পারলাম না। থাক না, শুধু তো সরিই বললো। চুম্মা টুম্মা তো আর দেই নি।”
অরুণিকা মুখ বাঁকালো। রুহানি অরুণিকার পিঠে চাপড় মেরে বলল, “তাহলে চৌধুরী সাহেব নরম হচ্ছে!”
অরুণিকা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রুহানির দিকে তাকালো। রুহানি বলল, “এভাবে দেখছিস কেন? গুড নিউজই তো!”
“নো নেভার। আমি ওর সাথে মরে গেলেও সংসার করবো না। টক্সিক মানুষ একটা!”
“আহা! প্রেমের রাজ্যে হিমালয় রাজপুত্র,
চৌধুরী সাহেব যেন দগ্ধ প্রজা।”
(***)
অরুণিকা নিজের রুমে এসে শুয়ে আছে। হঠাৎ মেসেজের শব্দ হলো। স্ক্রিনে হিমালয়ের নাম দেখে উৎসুক হয়ে মেসেজটি পড়তে লাগলো। হিমালয় লিখলো,
“আপনার পোস্ট করা ছবি দেখে আমার ছোটবেলার স্মৃতি মনে পড়ে গেল। আমরাও ছোটবেলায় গ্রামে লুকোচুরি খেলতাম।”
অরুণিকা মৃদু হেসে বলল, “আমাদের গ্রামেও সবাই লুকোচুরি খেলতো সন্ধ্যার পর।”
“তাই না-কি? সন্ধ্যার পর চাঁদের আলোতে।”
“হ্যাঁ। বিলে সবাই মিলে দাঁড়িয়ে থাকতো।”
“বাহ! আমরা অবশ্য বাড়ির উঠানে খেলতাম।”
“আচ্ছা? আমাদের বাড়ির উঠানেও খেলা হতো। তখন বড়রাও আমাদের সাথে খেলতে আসতো।”
“বাহ! আপনাদের বাড়ির বড়রা তাহলে বেশ মিশুক।”
“একটা সময় ছিল।”
“এখন?”
“এখন হয়তো সবার বয়স হয়ে গেছে, তাই।”
“খেলার জন্য কোনো বয়স লাগে না।”
“আচ্ছা!”
“আপনি বরং সবাইকে আজ আবার উঠানে নামান।”
“আমি এখন আলাদা থাকি। বাড়ি গেলে দেখা যাবে।”
“আপনি তাহলে বাড়ি থাকেন না? কোথায় থাকেন?”
“মামার বাসায় থাকি। ওখান থেকেই পড়াশুনা করছি।”
“বাহ, আচ্ছা পরে কথা হবে।”
অরুণিকা মন খারাপ করে শুয়ে রইলো। পরে কেন? এখন কেন না? এই মানুষটার চ্যাট করলে মনে এতো শান্তি কেন লাগে বুঝে না অরুণিকা।
চলবে-
#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-২৯ ||
রুহানিকে পড়িয়ে গেট দিয়ে বের হলো আহনাফ। রাস্তায় কানামাছি খেলতে ব্যস্ত কিশোর-কিশোরীর দল। আহনাফ তাদের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় তার সামনে এক কিশোরী এসে দাঁড়ালো। তার চোখে কালো কাপড় বাঁধা। মেয়েটি আহনাফকে ধরার জন্য হাত এগিয়ে দিবে, সেই মুহূর্তেই একটি ছেলে মেয়েটির হাত ধরে তাকে টেনে একপাশে নিয়ে গেল। মেয়েটি চোখ থেকে কালো কাপড় সরিয়ে সব বুঝতে পেরে আহনাফকে দেখে বলল, “সরি ভাইয়া।”
আহনাফ চুপচাপ সামনে হাঁটতে লাগলো। হাঁটতে হাঁটতে অতীতের একটি মিষ্টি মুহূর্ত ভেসে উঠলো চোখের সামনে। মুহূর্তেই হৃদয়ে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করলো সে। বুকে হাত দিয়ে পেছন ফিরে আবার সেই খেলায় মত্ত কিশোর-কিশোরীদের দিকে তাকালো। এরপর সামনে ফিরে বাসার গেট দিয়ে ঢুকে পড়লো।
সাল-২০১৬।
হেমন্তের অপরাহ্নে শকুন্তলা দিঘির পাড়ে বিশাল মাঠে কিশোর-কিশোরীর দল ছোটাছুটি করছে। তাদের একজনের চোখে কালো কাপড় বাঁধা, বাকিরা তাকে ঘিরে ছুটছে। মৃদুমন্দ সমীরণের ধাক্কায় কপালের উপর এলোমেলো হয়ে আছে আহনাফের চুল। সে দৌঁড়াচ্ছে, অথচ ঘামাচ্ছে না। হঠাৎ তার হাত আঁকড়ে ধরলো চোখ বাঁধা একটি মেয়ে। আহনাফ সাথে সাথে দাঁড়িয়ে গেল। তার ঠোঁটে ফুটে উঠলো প্রশান্তির হাসি। যেন এই স্পর্শের অপেক্ষায় ছিল সে।
আহনাফের বয়স কম হয় নি। সবেমাত্র কলেজ শেষ হয়েছে তার। শীঘ্রই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে। বিশ বছরের দাগড়া ছ’জন যুবক বাদে বাকিরা সকলেই কিশোর-কিশোরী। গ্রামে এলেই তাদের বয়স কমে যায়। এই গ্রামেই তাদের বেড়ে উঠা। গ্রামের মাটিতে এখনো শৈশবকালের ঘ্রাণ লেগে আছে। তাই এই মাটিকে সতেজ করতেই যেই বয়সই হোক, একবার অন্তত শৈশবে ফিরে যায় তারা।
আহনাফের দৃষ্টি এই মুহূর্তে চোখ বাঁধা কিশোরীটির দিকে। এদিকে কারো হাত ধরতে পেরে চোখ বাঁধা মেয়েটির ঠোঁটে রাজ্যের হাসি৷ সে আহনাফের হাত ধরে লাফাতে লাফাতে চোখের বাঁধন খুলে ফেললো। চোখ জোড়া মুহূর্তেই স্থির হয়ে গেল আহনাফের দিকে। স্নিগ্ধ শীতল হাওয়ায় শরীর শিউরে উঠলো অরুণিকার। সে অধর কামড়ে ধরেছে। আহনাফ অরুণিকার গালে আঙ্গুল ছুঁয়ে বলল,
“তোর স্পর্শ পাওয়ার লোভে আমি বারবার হতে চাই চোর,
তোর স্পর্শের মধুরতা আমার হৃদয়ে সৃষ্টি করে ঘোর।
হিয়ার গহীনে বাজে সুরের লহর,
তুই যখন কাছে আসিস, থমকে যায় প্রহর।
তোর স্পর্শে সত্যিই আমি বারবার হতে রাজি চোর,
নিজেকে সব দ্বিধা থেকে মুক্ত করে, তুই চাইলেই হতে পারিস আমার একমাত্র হূর।”
অরুণিকার চোখ-মুখ কুঁচকে গেল। আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বললো, “পছন্দ হয় নি?”
অরুণিকা মাথা নেড়ে বলল, “মাথার উপর দিয়ে গেল।”
আহনাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনে এসে কালো কাপড়টি আরাফের হাতে দিয়ে বলল, “তোরা খেল, আমার এই বাকোয়াস খেলা ভালো লাগছে না।”
তূর্য গা কাঁপিয়ে হেসে বলল, “মধু না পেলে ফুল তো আর ফুল লাগবে না, বাকোয়াসই লাগবে।”
আরাফ চোখ পাঁকিয়ে তাকালো। তূর্য আরাফের দৃষ্টি দেখেই তার হাসি গিলে ফেললো। ওদিকে আহনাফ হনহনিয়ে চলে যাচ্ছে। অরুণিকা দু’হাত পেছনে নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আহনাফের যাওয়া দেখছে। নবম শ্রেণিতে পড়ছে সে। বয়স পনেরো পার করেছে। উঠতি বয়স, আবেগে টইটম্বুর মন। বিয়ের ব্যাপারে সহপাঠীদের না জানালেও আহনাফের মতো সুদর্শন যুবকের মনোযোগ পাওয়ায় সহপাঠীদের মধ্যে আলাদা ভাব নিয়ে চলছে সে। অরুণিকা এখনো প্রেমের গভীর অর্থ বোঝেনি ঠিকই, কিন্তু প্রেমের প্রতি তীব্র আকর্ষণ তার মনের তীরে বড় বড় ঢেউয়ের আকারে আছড়ে পড়ছে। অরুণিকা আহনাফের প্রতি গভীর আকর্ষণ অনুভব করছে, যা মোটেও ভালোবাসা না, তবে শুধুই আকর্ষণ। স্কুল ছুটির পর আহনাফ তাকে নিতে এলে, তার খুশির মাত্রা আকাশচুম্বী। আহনাফ ইদানীং কাছে টেনে নিলে আর বাঁধা দেয় না সে। দাদী তাকে মুখস্থ করিয়ে দিয়েছে আহনাফ তার বর। সেই মুখস্থকরণের ফলাফল সে আহনাফের কোনো স্পর্শেই বাঁধা দেয় না। উলটো তার কাছে এসব রূপকথার গল্পের মতোই হৃদস্পর্শী। তাই এই মুহূর্তে আহনাফের প্রস্থানে তার হৃদয়ে অভিমানের ঝড় উঠেছে। সে নিজেও এদিক-ওদিক তাকিয়ে একটু পর আহনাফের পিছু পিছু চলে গেল। অরুণিকাকে চলে যেতে দেখে আরাফ, তাহমিদ আর তূর্য স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল সেদিকেই। ইভান আর ইমন দূরে বসে অনেক আগে থেকেই সেই দৃশ্য উপভোগ করছিল।
এদিকে অরুণিকা ছুটতে ছুটতে আহনাফের পাশে এসে হাঁটতে লাগলো। আহনাফ তাকে নিজের পাশে দেখে মুখ ভার করে বলল, “তোর তো সব মাথার উপর দিয়েই যাই। ভেতরে কিছু ঢুকে না!”
অরুণিকা আহনাফের হাত ধরতেই সে চমকে উঠলো। অরুণিকার দিকে তাকিয়ে বলল, “কি বলবি?”
অরুণিকা মলিন মুখে বলল, “আমাকে বুঝিয়ে দিলেই হতো। তুমি না একটু বেশি জ্ঞানী সাজো! আমি কি তোমার মতো কলেজ শেষ করেছি? আমার বাংলা কবিতা পড়তেই দাঁত ভেঙে যায়, তোমার আবিষ্কার করা কবিতা মাথার উপর দিয়ে না গিয়ে যদি ভেতর দিয়ে যেতো, তাহলে তো আমার মস্তিষ্কই ফুঁটো হয়ে যেতো। ভাগ্যিস উপর দিয়ে গেছে!”
আহনাফ অরুণিকার হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, “এসব কথাগুলো তো ঠিকই মাথায় আসে। একটা কথাও মাটিতে পড়ে না। ক্যাচ করে ধরে, এক্কেবারে ছুঁড়ে মারিস মুখের উপর। শুধু আমি কিছু বললে তোর মস্তিষ্ক ফুঁটো হয়ে যায়!”
“তোমার কথাগুলো অনেক ধারালো তাই।”
অরুণিকা বুঝে-শুনে এই কথা বলে নি। তার মুখে যা এসেছে, তাই বলে ফেলেছে। কিন্তু আহনাফের বেশ ভালো লাগলো অরুণিকার উত্তর। সে মৃদু হেসে অরুণিকাকে নিজের কাছে টেনে আনলো। অরুণিকার হৃদস্পন্দন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। অহেতুক গাল গরম হয়ে যাচ্ছে। আহনাফ অরুণিকার কাছে এসে বলল, “এই ধারালো কথা শুনে একটু তো প্রেমে পড়।”
অরুণিকা লাজুক হাসলো। অরুণিকার হাসিতে ইদানীং সম্মতি খুঁজে পায় আহনাফ। তবুও সীমা ছাড়াতে চাইছে না সে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে অরুণিকাকে ভালোবাসছে। অনেক বুদ্ধির প্রয়োগে তো অরুণিকাকে বউ করে নিয়েছে, এখন আর কীসের ভয়? এবার সব ধীরে ধীরেই না হয় আগাক।
(***)
সাল ২০২২। বর্তমানে। অরুণিকা ক্যাম্পাসে ঢুকে কেন্টিনে চলে গেল। কেন্টিনের কাছে যেতেই মেয়েদের জটলা বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিঞ্চিৎ অবাক হলো সে। মেয়েগুলোকে পাশ কাটিয়ে সামনে তাকাতেই সে মোটামুটি অবাকই হলো। আহনাফ চোখে কালো সানগ্লাস পরে নাস্তা করছে। অরুণিকা বিড়বিড় করে বলল, “যত্তোসব ঢং!”
অরুণিকা আশেপাশে কোথাও চেয়ার খালি না পেয়ে বাধ্য হয়ে আহনাফের পাশের টেবিলে গিয়ে বসলো। আহনাফ সামনে তাকিয়ে আছে, কিন্তু চোখ অরুণিকার দিকেই স্থির। অরুণিকা চোখ ছোট করে আহনাফের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো, “এই বেটা নিশ্চিত আমাকেই দেখছে। ফজ্জাত একটা! আমাকে দেখার অভিনব কৌশল বের করেছে।”
অরুণিকা সিঙ্গারা খাওয়ায় মনোযোগ দিচ্ছে, এমন সময় যতি এসে তার সামনে বসে পড়লো। যতিকে দেখে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো অরুণিকা। যতি এক গাল হেসে বলল, “স্যারকে চিঠিটা দিয়েছো?”
অরুণিকা মুখ বাঁকিয়ে বলল, “পাশেই আছেন, পড়েছে কি-না জিজ্ঞেস করে দেখো।”
যতি আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলল, “লুক, কেমন হ্যান্ডসাম লাগছে। স্যার আসলেই হিরোদের মতো।”
অরুণিকা যতির কথায় আহনাফের দিকে তাকালো। আপাদমস্তক পরখ করে মিনমিনিয়ে বলল, “ভেতরটা একদম জানোয়ারের মতো!”
অরুণিকা খাওয়া শেষে চা নিয়ে উঠে গেল। আহনাফও উঠে দাঁড়ালো। যতি আহনাফের সামনে এসে বলল, “স্যার সরি, অরুণিকাকে দিয়ে আপনাকে ওইটা পাঠিয়েছি।”
আহনাফ খাবারের বিল টেবিলে রেখে যতিকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। আহনাফের এমন ভাবলেশহীন ব্যবহারে মনঃক্ষুণ্ন হলো যতি। ঠোঁট কামড়ে আশেপাশে তাকালো। না, কেউ তাকে দেখছে না। এরপর এক রাশ অভিমান নিয়ে ক্লাসে চলে গেল সে। এদিকে আহনাফ ক্লাসে ঢোকার আগেই অরুণিকা তাকে পাশ কাটিয়ে হনহনিয়ে ক্লাসে ঢুকবে, আহনাফ তার হাত ধরে তাকে দাঁড় করিয়ে বলল, “আমাকে ধাক্কা দিয়ে ক্লাসে ঢুকবে না-কি!”
অরুণিকা মুখ বাঁকিয়ে বলল, “সরো তো! এটা তোমার ক্লাস না।”
“এক্সকিউজ মি। আমি তোমার স্যার!”
“ওপস সরি, সরুন তো! এটা আপনার ক্লাস না।”
“অরুণিকা!”
“এতো ঢং করে ক্লাসে এসেছেন কেন? যতিকে ইমপ্রেস করার জন্য?”
“কেন আমার নতুন রূপে কি তোমার হৃদয় পুড়ছে?”
“সরি, এসব ফালতু রিজনে আমার সুন্দর হৃদয় দগ্ধ করার কোনো ইচ্ছে নেই। আর তোমার দর্শনে পুরো পৃথিবী উন্মাদ হলেও, এই অরুণিকা চৌধুরী কখনো হবে না।”
“অবশ্যই হবি না। তুই তো আমার আসল রূপটা দেখে ফেলেছিস। পুরো নারী জাতি আমাকে যেভাবে চিনবে, তার চেয়ে ভালো চিনবে আমার বউ। বউয়ের চেয়ে ভালো তার বরকে আর কেউ চেনে না। তাই সবাই যেখানে উন্মাদ হবে, তুই সেখানে উন্মাদনা ছাড়িয়ে স্থির হবি। এমনিতেই পারমানেন্ট কিছুতে উন্মাদনা মানায় না। এখানে স্থিরতা থাকে।”
অরুণিকা চোখ ছোট করে বলল, “তুমি সিলেবাসের বাইরে কথা বলা বন্ধ করো। আর শুনলাম, এই সেমিস্টারে তুমি আমাদের ক্লাস পাচ্ছো না? এক সপ্তাহ না-কি অন্য স্যারের এবসেন্টে ক্লাস নিয়েছিলে? ভাগ্যিস আমি এক সপ্তাহ আসি নি ক্যাম্পাসে। জানো, আমি এই সেমিস্টারে আর একটা ক্লাসও মিস দিচ্ছি না। থ্যাংক ইউ এই সেমিস্টারে ক্লাস না নেওয়ার জন্য।”
“কথাটা ইংরেজিতে বল তো দেখি!”
অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। আহনাফ বাঁকা হেসে অরুণিকার হাত ছেড়ে দিয়ে চলে গেল ক্লাসে। অরুণিকাও মুখ বাঁকিয়ে নেচে নেচে ক্লাসে ঢুকলো।
(***)
বিকেলে দোকানে বসেছে অরুণিকা। তার পরণে সাদা টি-শার্ট ও কালো জিন্স। গলায় কালো উড়না। ডিউটির শেষ ভাগে দোকানে তিনজন পুরুষ কাস্টমার ঢুকলো। অরুণিকা এই মুহূর্তে একাই ডিউটিতে আছে। দোকানের মালিক একটু বাইরে গেছেন। অরুণিকা কাস্টমার দু’জনের সামনে এসে বলল, “কি লাগবে, স্যার?”
পেছনের কাস্টমারটি জরুরি কল আসায় এক পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। ওদিকে বাকি দু’জন অরুণিকাকে আপাদমস্তক দেখছে। অরুণিকা তাদের চাহনি দেখে আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। একপাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তাদের মধ্যে একটি ছেলে শার্ট নেওয়ার বাহানায় অরুণিকার দিকে ঝুঁকে আসতে লাগলো। অরুণিকার ভয়ে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। সে সরে দাঁড়াতে যাবে অন্যজন অরুণিকা পেছনে হাত রেখে শক্ত করে ধরলো। অরুণিকা রাগী দৃষ্টিতে লোকটির দিকে তাকিয়ে সশব্দে চড় বসিয়ে দিলো। অন্যজন তা দেখে ফুঁসে উঠলো। অরুণিকার গায়ে হাত দিতে যাবে তখনই জোরে ধাক্কা লাগায় মাটিতে লুটিয়ে পড়লো সে। অরুণিকা চোখ বড় বড় করে সামনের মানুষটির দিকে তাকিয়ে আছে। চড় খাওয়া পুরুষটি রাগী স্বরে বলল, “আহনাফ, তুই জানিস এই মেয়ে কি করেছে? আমাকে চড় মেরেছে। আর তুই একে কিছু না বলে, ইশমামকে ধাক্কা দিলি? একে তো উঠিয়ে নিয়ে এক্কেবারে…..”
আহনাফ বাঁধনের আরেকটা গালে চড় মেরে তার মুখ বন্ধ করে দিলো। বাঁধন স্তব্ধ হয়ে গেল আহনাফের ব্যবহারে। এদিকে ইশমাম উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “তুই শালা, এই দুই পয়সার মেয়ের জন্য…!”
আহনাফ ইশমামকে থামিয়ে দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “সি ইজ মাই ওয়াইফ।”
এরপর ইশমামের গলা চেপে ধরে রাগী স্বরে বলল, “তুই ওর গায়ে হাত দিলি কোন সাহসে?”
বাঁধন ভীত কন্ঠে বললো, “আরেহ আহনাফ, আমরা কি জানি মেয়েটা তোর বউ?”
ইশমাম আর বাঁধন দু’জনই অরুণিকার কাছে বার কয়েক ক্ষমা চাইলো। অরুণিকা আহনাফের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আহনাফের হাত মুঠো হয়ে আছে এখনো। চোখে এখনো সেই কালো সানগ্লাস। তার দৃষ্টি অরুণিকার দিকেই আঁটকে আছে। তবে অরুণিকা বুঝতে পারছে না। ইশমাম আর বাঁধন কিছু বলতে যাবে আহনাফ চিৎকার করে বলল, “গেট লস্ট।”
তারা দ্রুত বেরিয়ে পড়তেই অরুণিকা শক্ত মুখে আহনাফের দিকে তাকালো। এরপর হুট করে চোখ থেকে সানগ্লাসটি টেনে নিয়ে মেঝেতে ফেলে দিলো। মেঝেতে আছড়ে পড়তেই সানগ্লাসটির গ্লাস খুলে পড়লো ফ্রেম থেকে। আহনাফ নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ দু’টি লাল। অরুণিকা আহনাফের বাহু ঝাঁকিয়ে বলল, “তুমি এখনো ওই বখাটে রাস্তার ছেলে দুইটার সাথে বন্ধুত্ব রেখেছো? আরাফ, তূর্য ওরা জানে এসব?”
আহনাফ অরুণিকার দিকে আঙ্গুল তাক করে বলল, “চুপ কর, আর এখানে কি করছিস বল?”
অরুণিকা পালটা প্রশ্ন করলো, “তুমি কি নেশা করো? চোখ লাল হয়ে আছে কেন তোমার?”
“পাগল হয়ে গেছিস তুই? চোখে সমস্যা ছিল, তাই লাল হয়ে আছে। চোখ উঠেছে, তূর্যকে ফোন করে জিজ্ঞেস কর।”
“তুমি ওই ছেলে দুইটার সাথে এখনো যোগাযোগ রেখেছো, যারা তোমাকে সিগারেট ধরিয়েছিল? যাদের জন্য চাচ্চুর হাতে মার খেয়েছিলে! যাদের জন্য ডাক্তারি পরীক্ষায় ফেইল করে ইংরেজি নিয়ে পড়তে হয়েছে! তুমি দেশের বাইরে যাবে বলেছিলে না? না-কি এদের জন্যই দেশ ছাড়তে পারছো না?”
“আমি তোর জন্য দেশে পড়ে আছি। আর শোন, আমি সিগারেট খাই না। আমার গায়ে কি আর সিগারেটের গন্ধ পাস?”
আহনাফ অরুণিকার দিকে এগিয়ে আসতেই অরুণিকা তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। আহনাফ সেকেন্ড খানিক অরুণিকার দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে হুট করে একটা শার্ট হ্যাঙ্গার থেকে নিয়ে বলল, “ট্রায়াল রুম কোথায়?”
অরুণিকা পাশে ইশারা করতেই আহনাফ সেখানে ঢুকে পড়লো। অরুণিকা এখনো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক জায়গায়। হঠাৎ ট্রায়াল রুম থেকে আহনাফের ডাক শুনে অরুণিকা সেদিকে যেতেই আহনাফ বলল, “কেমন শার্ট? ঠিকমতো হচ্ছেই না!”
অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “না হলে অন্য সাইজ আছে!”
“এটাই আমার সাইজ।”
“তো এখন আমি না হলে কি করতে পারি?”
“হওয়াবা।”
“মানে?”
“মানে পরাই দিবা।”
এই বলে অরুণিকাকে টেনে ট্রায়াল রুমে ঢুকালো আহনাফ। দরজা আঁটকে দিতেই অরুণিকা আহনাফের বাহুতে জোরে ঘুষি মেরে বলল, “স্যার দেখলে কি মনে করবে?”
“আবার কোন স্যার দেখবে?”
“দোকানের মালিক!”
“দোকানে কেউ নেই। শুধু তুমি আর আমি আছি।”
অরুণিকা দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল, “সিসি ক্যামেরা আছে।”
আহনাফ হেসে বলল, “হু কেয়ার?”
এই বলে আহনাফ তার শার্ট খুলে ফেললো। অরুণিকা অন্যদিকে মুখ ঘোরাতেই, আহনাফ তার দুই হাত অরুণিকার দুই পাশে রেখে তাকে ট্রায়াল রুমের দেয়ালের সাথে আঁটকে ধরলো। অরুণিকার গলা শুকিয়ে গেছে। সে জোরে জোরে শ্বাস ছাড়ছে। আহনাফ অরুণিকার আরো কাছ ঘেঁষে দাঁড়ালো। আহনাফের উন্মুক্ত বুকে অরুণিকার হাতের স্পর্শ লাগতেই অরুণিকা সোজা নিচে বসে পড়লো। আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে বলল, “এভাবে বসে গেলি কেন?”
“তুমি আমাকে এখানে কেন ঢুকিয়েছো?”
“আমাকে শার্ট পরিয়ে দিবি না? কাস্টমারের সেবা করবি না? আমার ট্র্যাপ থেকে বাঁচতে এখানে কাজ নিয়েছিস! বেশ তো, এখন কাজ কর।”
অরুণিকা আহনাফের দিকে মাথা তুলে তাকালো। আহনাফ অরুণিকার সামনে দু’পা ভাঁজ করে বসে পড়লো। অরুণিকা চোখ সরিয়ে বলল, “শার্ট গায়ে দাও।”
“কেন প্রেমে পড়ে যাচ্ছিস?”
“ইস, এমন বিশ্রী বডি দেখে তোমার ফিমেইল ভার্সনগুলোই প্রেমে পড়বে!”
আহনাফ চোখ বড় বড় করে বলল, “মানে?”
“মানে, ছ্যাঁচড়ার ফিমেইল ভার্সন ছ্যাঁচড়ি। লাইক, আহনাফ ইজ ইকুয়েল টু যতি। সেইম সেইম।”
আহনাফ নতুন শার্টটা হাতের মুঠোয় নিয়ে মুচড়ে ভাঁজ ভেঙে অরুণিকার মুখের উপর ছুঁড়ে মেরে বেরিয়ে গেল। অরুণিকা আহনাফের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “অসভ্যের প্রো ভার্সনে পৌঁছে গেছে ফজ্জাতটা!”
(***)
নির্জন রাস্তায় ইশমাম আর বাঁধন গড়াগড়ি খাচ্ছে। দু’জনের নাক ফেঁটে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। পুরো শরীরে আঘাতের চিহ্ন। হঠাৎ নিরিবিলি পথে ভূতুড়ে শব্দ তুলে একটা মোটর সাইকেল তাদের সামনে এসে থামলো। ইশমাম মাথা তুলে সামনে তাকিয়ে বলল, “আহনাফ! বাঁচা আমাদের।”
আহনাফ মোটর সাইকেল থেকে নেমে ইশমাম আর বাঁধনের এমন অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করলো, “তোদের এই অবস্থা কীভাবে হলো?”
বাঁধন কাঁপা কন্ঠে বললো, “জানি না। ভাই, ভীষণ ব্যথা শরীরে। একটা সাদা বাইকে করে সাদা জ্যাকেট, সাদা ট্রাউজার, সাদা হেলমেট, পুরো সাদায় ঢাকা একটা মানুষ আমাদের বাইকের সামনে এসে দাঁড়ালো। ভাই, কীভাবে যে মারলো আমাদের দুই জনকে! আমাদের অপরাধ কি সেটাও বললো না!”
আহনাফ ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “তোরা কি করেছিস?”
“কিছুই তো করি নি।”
“উঠ, এখন। এজন্যই বলি একটু ভেবেচিন্তে চল।”
“দোস্ত, ভাবীর বদদোয়া লাগছে নিশ্চিত।”
আহনাফ চুপ করে রইলো। ইশমামের রক্ত তার হাতে লেগে গেছে। সেই রক্তের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আহনাফ। ইশমাম বলল, “আমাদের হাস্পাতালে নিয়ে চল, ভাই।”
আহনাফ তাদের জন্য গাড়ি ঠিক করলো। তাদের গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে মোটর সাইকেলে উঠে তাদের গাড়ির পিছু পিছু যেতে লাগলো।
চলবে-