#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-৩০ ||
আজ সাপ্তাহিক ছুটি। অরুণিকা সকালে টিউশিন করিয়ে বাসায় ফেরার পথে একটি মোটর সাইকেল তার পথ রোধ করে দাঁড়াল। অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে হেলমেট পরা মানুষটির দিকে তাকাল। তখনই সেই হেলমেট পরা যুবকটি অরুণিকার হাত ধরে তাকে জোর করে মোটর সাইকেলে উঠিয়ে বলল, “আমাকে ধরে বস!”
আহনাফের কন্ঠ শুনে অরুণিকা চেঁচিয়ে বলল, “কি সমস্যা তোমার? সকাল, বিকেল, সন্ধ্যা, এমনকি ছুটির দিনেও তোমার কুফা মুখটা কেন দেখতে হয় আমাকে?”
আহনাফ কিছু না বলে মোটর সাইকেলে টান দিলো। স্থির জড়তা কাটতেই আহনাফকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো অরুণিকা, আর চিৎকার করে বলল, “অসভ্য লোক! তোমার বাইকের উপর ঠাডা পরুক। চাকা খুলে ড্রেনের পড়ে যাক।”
আহনাফ মুখ বাঁকিয়ে বলল, “আরো দে, বদদোয়া। মনে রাখিস, বদদোয়া দেওয়ার জন্যই মেয়েরা অধিক জাহান্নামে যায়।”
অরুণিকা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “শুনো, অন্যকে জ্ঞান না দিয়ে নিজের উপর কিছু আমল করো। স্ত্রীকে অসম্মানিত করলে কোনো স্বামী জান্নাতে যায় না। আমার হক নষ্ট করছো না? বেশ। তুমি দেখে নিও, আমিও তোমাকে আঁটকে ফেলবো। আমি মাফ না করলে তুমি জীবনেও আল্লাহর কাছ থেকে ক্ষমা পাবে না।”
“স্বামী অসন্তুষ্ট হলে স্ত্রীও জান্নাতে যায় না। এই কথাও মনে রাখিস।”
“নিজে পাপ করে নিজে অসন্তুষ্ট হলে এখানে স্ত্রীর কোনো অপরাধ নেই। আল্লাহ সব দেখছেন।”
“ডিভোর্স চাওয়াও গুনাহ। এটা শয়তানের ইন্ধন।”
“চুপ। তুমি নিজেকে ঠিক করো আগে। তারপর আমাকে এসব বলতে এসো। নিজে তো পাপী, বউ খুঁজবে ইনোসেন্ট!”
আহনাফ আর অরুণিকার বাকবিতণ্ডা থামলো আহনাফ মোটর সাইকেল থামানোর পর। অরুণিকা মোটর সাইকেল থেকে নেমে আশেপাশে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। আহনাফ হেলমেট খুলে মোটর সাইকেল থেকে নেমে চাবি পকেটে ঢুকিয়ে অরুণিকার হাত ধরলো। অরুণিকা আহনাফের চোখের দিকে তাকালো। ক্ষীণ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “এখানে কেন এনেছো?”
আহনাফ মৃদু হেসে বলল, “মনে আছে এই জায়গাটার কথা।”
অরুণিকা চোখ সরিয়ে সামনে তাকালো। ফিরে গেল অতীতের পাতায়।
সাল ২০১৬। শীত সবেমাত্র শুরু হয়েছে। নবম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা শেষ অরুণিকার। পদার্থবিজ্ঞান পরীক্ষা ভীষণ খারাপ হয়েছে তার। পরীক্ষা দিয়ে এসেই সারারাত কেঁদেছিল সে। সকালে আহনাফের ডাকে ঘুম ভাঙলো অরুণিকার। সেই সময় জুবায়ের করিম চৌধুরী মেয়ের কাছেই বসেছিলেন। আহনাফকে তিনি কোনো বিষয়ে আঁটকাতে পারেন না। বিয়ে হওয়ার পর থেকেই আহনাফের খবরদারি যেন তার মেয়ের উপর তার চেয়েও বেশি। তিনি নীরবে তাকিয়ে আছেন মেয়ের জামাইয়ের দিকে। আহনাফ হাত ধরে টেনে তুললো অরুণিকাকে। অরুণিকা চোখ খুলতে পারছে না। অতিরিক্ত কান্না করেছিল বিধায় চোখের কোণা ব্যথা করছে। সে চোখ ছোট করে আহনাফের দিকে তাকিয়ে ঘুম ঘুম কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, “আমি কি ফেইল করেছি? আমাকে কি আবার নাইনে থাকতে হবে?”
আহনাফ হেসে বলল, “আর এসব স্বপ্ন দেখিস না। হাত-মুখ ধুয়ে আয়, আমি তোকে একটা জায়গায় নিয়ে যাবো। দেখিস, কেমন মিনিটের মধ্যেই তোর মন ভালো হয়ে যায়।”
অরুণিকা বাবার দিকে তাকালো। জুবায়ের করিম চৌধুরী আহনাফের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি অরুকে এতো সকাল সকাল কোথাও নিয়ে যাবে আর আমার পারমিশনও নিচ্ছো না?”
আহনাফ স্মিত হেসে বলল, “এই বাড়িতে ওকে রেখেছেন এই পারমিশন যে আমি দিচ্ছি, এটাই তো অনেক। আমার বউকে আমি তার বাপের বাড়িতে থাকতে দিচ্ছি, এর চেয়ে বড় পারমিশন তো কেউ কখনো কাউকে দেয় নি৷ আর আপনি আমাকে বলছেন, আমি অরুকে কোথায় নিবো, কি নিবো না তার পারমিশন নিতে হবে! তাও আবার আপনার কাছ থেকে!”
জুবায়ের করিম চৌধুরীর রাগে মুখ লাল হয়ে গেছে। একমাত্র মেয়ের জন্য এমন অভদ্র জীবনসঙ্গী তিনি কখনোই আশা করেন নি। আহনাফ পরিস্থিতিই এমন করে ফেলেছে যে তাকে বাধ্য হয়ে মেয়েকে এই অভদ্র ছেলের হাতে তুলে দিতে হয়েছে। এখন শুধু অরুণিকা একবার বড় হোক, এই সম্পর্কটা ভেঙে গেলেই তিনি নিশ্চিন্ত হবেন।
এদিকে অরুণিকা হাত-মুখ ধুয়ে শীতের জামা পরে নিচে নামতেই দেখলো আহনাফ তার মোটর সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অরুণিকার জন্য ছোট হেলমেট কিনেছে সে। সেই হেলমেটটি অরুণিকার মাথায় বসিয়ে দিয়ে আহনাফ বলল, “আমাকে ধরে বসিস কিন্তু।”
অরুণিকা মোটর সাইকেলে উঠে জিজ্ঞেস করলো, “কোথায় যাচ্ছি আমরা?”
“একটা রূপকথার রাজ্যে, যেই রাজ্যে জেগে উঠে স্বপ্ন।
আজ তোকে নিয়ে যাবো এক স্বপ্নপুরীতে,
যেখানে ডানা মেলে উড়তে থাকে রঙিন প্রজাপতি,
ভেসে আসে পাখিদের গান, যেই গানে বিজয়ের ছবি।
নিয়ে যাবো তোকে স্নিগ্ধ শীতল আবহে
যার স্পর্শ নেয় নদীর জল, যেই জল জানিয়ে দেয় জীবন থেমে থাকে না, ব্যর্থতার পরেই আসে মিষ্টি প্রাপ্তি।
তোকে নিয়ে যাচ্ছি সেই অদ্ভুত বাগানে,
যেই বাগানে ফুল ফুটে, অথচ ঘ্রাণহীন।”
“ইদানিং তো দেখছি তাহমিদের মতো কবিতা বানাও। ওর কাছ থেকে চুরি-টুরি করো না-কি?”
আহনাফ শব্দ করে হাসলো। বলল, “তাহমিদ শখের বশে কবিতা লেখে, আর আমি শুধু তোর জন্য কবিতা লিখি। অনলি ফর ইউ মাই ডিয়ার বেইবি ওয়াইফ।”
অরুণিকা লাজুক হাসলো। ঠোঁট কামড়ে আহনাফের শার্ট আরো শক্ত করে খামচে ধরলো। ততোক্ষণে আহনাফ অরুণিকাকে নিয়ে এলো একটি বাগান বাড়িতে। চমৎকার একটি কটেজ সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বড় চৌধুরী সাহেব শখ করে বানিয়েছেন এটি। টাকার অভাব না হলে মানুষের শৌখিনতা প্রকাশিত হয়, যা এই বাড়ি দেখলেই বোঝা যায়। তবে এই বাড়িটি থেকে তিনি বড় দুই সন্তানকে বঞ্চিত করে কনিষ্ঠ সন্তান আমির চৌধুরীর নামেই লিখে দিয়েছেন, কারণ আমির তার অনেক আদরের সন্তান ছিল বিধায়। এরপর কালক্রমে আমির চৌধুরী নিজেও এই বাড়ি নিজের নামে রাখেন নি। আবরার বুদ্ধি প্রতিবন্ধী এটা বুঝতে পেরে একমাত্র সুস্থ সন্তান আহনাফকে এই বাগান বাড়ি লিখে দিয়েছেন তিনি। যদিও তার স্ত্রী শিরিন সুলতানা তার এই সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট ছিলেন। অন্যদিকে আহনাফ অল্প বয়সেই এক বাগান বাড়ির মালিক হয়ে যায়। তবে এই প্রথম সে অরুণিকাকে নিয়ে এসেছে এখানে। অরুণিকার কটেজটি বেশ পছন্দ হয়েছে। গেটের সামনে বাগান বিলাস। ঢুকতেই বিভিন্ন ফুলের বাগান। মাঝখানে পিচ ঢালা পথ। অন্যপাশে কৃত্রিম ঝর্ণা। সামনে কটেজ।
অরুণিকা মুগ্ধ হয়ে স্থানটি দেখছে। আহনাফ মৃদু হেসে বলল, “এটা কিন্তু তোর বরের বাড়ি। তুই বড় হলে আমরা এখানে আসবো। আমাদের সুন্দর মুহূর্ত এখানেই তৈরি হবে।”
অরুণিকা আহনাফের দিকে তাকালো। আলতো হাতে আহনাফের হাত ধরলো সে। ক্ষীণ স্বরে বলল, “থ্যাংক ইউ, আমার মুড ঠিক করার জন্য। এমন শান্ত একটা পরিবেশ দরকার ছিল আমার।”
আহনাফ অরুণিকার হাত শক্ত করে ধরে তাকে নিয়ে ঝর্ণায় পা ডুবিয়ে বসলো। শীতের সকাল, তার উপর ঠান্ডা পানি। অরুণিকার গা শিউরে উঠলো। আহনাফ অরুণিকার হাতের তালুতে হাত বুলাতে বুলাতে খালি কন্ঠে গান ধরলো,
“তুমি আমায় ডেকেছিলে এক মেঘে ঢাকা দিনে
কেন আমি দেইনি সাড়া?
আমার চোখে আকাশ দেখে তুমি বলেছিলে কিছু
বুঝিনি কেন সেই ইশারা?
এখন আমি অন্য আমি হয়ে ছুটে চলি তোমারই শহরে
হারিয়ে চোখের যত ঘুম-
ঝুম,উড়ে উড়ে দূরে দূরে
ঝুম, মেঘে মেঘে ডানা মেলে
ঝুম, উড়ে ঘুরে তারে ডাকি।”
হঠাৎ উত্তপ্ত দেহ আষ্টেপৃষ্ঠে আঁকড়ে ধরায় অরুণিকা বর্তমানে ফিরে এলো। আহনাফ তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে। আহনাফের অধর অরুণিকার ঘাড়ে উষ্ণ স্পর্শ মাখছে। অরুণিকা আহনাফকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলল, “আমি তোমার সাথে কোনো স্মৃতি রাখতে চাই না। আর আমার অনুমতি ছাড়া তুমি আমাকে টাচ করতে পারবে না।”
আহনাফ ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “তুই এখনো রাগ করে থাকবি? আমাকে ক্ষমা করতে পারবি না?”
অরুণিকা মুখ হাত দিয়ে আড়াল করে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর হাত সরিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে শক্ত কন্ঠে বলল, “প্রথমবার বিশ্বাস করেছি। আর তুমি পুরো ফ্যামিলির সামনে আমাকে অপমান করেছো। আমি তখন নিঃস্ব ছিলাম, অনাথ ছিলাম। আর তোমার জন্য আমাকে আমার বাবার বাড়ি ছাড়তে হয়েছিল। আমি ট্রমাটাইজ ছিলাম। আমার ম্যান্টল সাপোর্ট দরকার ছিল। তুমি আমাকে আরো ট্রমাটাইজ করে দিয়েছো। এরপর ভাঙা বিশ্বাস নিয়েই বেঁচে ছিলাম। তোমার প্রতি মায়া ছিল বিধায় তোমাকে ভুলি নি। তবে তুমি সেই সুযোগটাও নষ্ট করে দিয়েছো, তোমার মাকে আমার নামে মিথ্যে বলে। আমি তোমার সাথে নোংরামি করতে চেয়েছি বলে, আমার ক্যারেক্টারে আঙ্গুল তুলেছো। প্রথমে বিশ্বাস ভাঙলো, এরপর কেটে গেল মায়া। আর কিছু নেই আমার। তোমার প্রতি আমার আর কিচ্ছু নেই।”
আহনাফ শক্ত মুখে অরুণিকার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। এরপর শব্দ করে হাসলো। আহনাফকে হাসতে দেখে অরুণিকা ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। কেমন উন্মাদ লাগছে আহনাফকে দেখতে! অরুণিকা কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে বলল, “তুমি কি পাগল হয়ে গেছ? এভাবে হাসছো কেন?”
আহনাফ চিৎকার করে বলল, “হ্যাঁ, আমি পাগল হয়ে গেছি। কারণ তুই আমাকে পাগল বানিয়েছিস। আমার ভাইকে মেরে আমার জীবন এলোমেলো করে দিয়েছিস। আমাকে নিঃস্ব করে দিয়েছিস। যেই মেয়েকে আমি ভালোবাসতাম, যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছি, সেই মেয়ে যদি আমার স্বপ্ন ভেঙে দেয়, তাহলে আমি কীভাবে সুস্থ থাকবো? সে যদি আমাকে ঠকায়, আমি কীভাবে ভালো থাকবো?”
আহনাফ হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়লো। নিজের চুল খামচে ধরে বলল, “আমি তোর জন্য অসুস্থ একটা জীবনে পড়ে আছি। তোর জন্য আমার এই অবস্থা হয়েছে!”
অরুণিকার চোখে অশ্রু ভীড় করতে লাগলো। সে দৌঁড়ে বেরিয়ে পড়লো বাগান বাড়ি থেকে। আহনাফ অরুণিকাকে চলে যেতে দেখে নিজেও উঠে তার পিছু নিলো। অরুণিকা চোখ মুছতে মুছতে সামনে হাঁটছে, আর নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করছে, “আমি কীভাবে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করবো? যেদিন আহনাফ সত্য জানতে পারবে, সেদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আহনাফ সত্যটাই তো বিশ্বাস করতে পারবে না।”
হঠাৎ ট্রেনের হুইসেল বেজে উঠলো। মুহূর্তেই অরুণিকা থমকে গেল। কোথা থেকে আসছে এই শব্দ? নিজের কানে হাত চেপে চোখ-মুখ খিঁচে রাখলো সে। আহনাফ অরুণিকাকে রেল লাইনের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দৌঁড়ে আসতে লাগলো। ট্রেন খুব কাছেই চলে এসেছে। আর অরুণিকা বরফের ন্যায় জমে গেছে। ট্রেন অরুণিকাকে ধাক্কা দেওয়ার আগেই আহনাফ তাকে টেনে একপাশে এনে ঠাসিয়া একটা চড় বসিয়ে দিল গালে। অরুণিকা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লো। আহনাফ চেঁচিয়ে বলল, “বোকা না-কি তুই? ট্রেনের নিচে পড়তি এখন। ভাগ্যিস ট্রেনের গতি কম ছিল! তবুও নিচে পড়লে কি বাঁচতি তুই?”
অরুণিকার পাশ দিয়ে ট্রেনটি যাচ্ছে। ট্রেনটির দিকে ভীত চোখে তাকিয়ে আছে অরুণিকা। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে সে। হাত-পা কাঁপছে তার। আহনাফ অরুণিকার দিকে তাকিয়ে রইলো অবাক চোখে। অরুণিকা বুকে হাত রাখলো। তাকে দেখে মনে হচ্ছে শ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। আহনাফ তাকে কাছে টেনে নিতেই অরুণিকা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাকে। কিছু একটা বিড়বিড় করছে সে। তার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে সেই ভয়ংকর দৃশ্য।
অরুণিকা তখন সদ্য দশম শ্রেণিতে উঠেছিল৷ এক সকালে সে বাবা-মাকে জোরাজুরি করছিল, তাকে ঝর্ণা দেখাতে নিয়ে যেতে। তার বায়না মেটাতেই জুবায়ের করিম চৌধুরী ও তার স্ত্রী নীহারিকা মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। বেশ ঘুরাঘুরি করে গোধূলিলগ্নে বাসার পথে রওনা দিয়েছিল তারা। পথিমধ্যে জ্যামে আঁটকা পড়ে যায় তাদের গাড়ি।গাড়ি রেল লাইনের উপর দাঁড়ানো ছিল। এর আগে, পিছে, ডানে, বামে রিকশা, সিএনজি, বাসসহ বেশ কয়েকটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ি আগে পিছে নেওয়ার উপায় নেই। তখনই অরুণিকা আরেক বায়না ধরলো, সে হাওয়ায় মিঠাই খাবে। রাস্তার এক কোণায় বিক্রি করছে হাওয়ায় মিঠাই। জুবায়ের সাহেব তাই গাড়িটা রেল লাইনের উপর রেখেই হাওয়ায় মিঠাই আনতে গেলেন। কিন্তু কেউ জানতো না সেকেন্ড খানিকের মধ্যেই স্থানটি মৃত্যুপুরীতে পরিণত হবে। জুবায়ের সাহেব হাওয়ায় মিঠাই কিনে ফিরে আসতে যাবেন ওই মুহূর্তেই ব্যবস্থাপনার গাফিলতির কারণে হুট করেই ট্রেন এসে যায়। মিসেস নীহারিকা ট্রেন দেখে অরুণিকাকে নামিয়ে দিতে পেরেছিলেন ঠিকই কিন্তু ট্রেনের ধাক্কার সাথে গাড়ি সামনে চলে যাওয়ায় তিনিও ধাক্কা খেয়ে নিচে পড়ে যান। বাস, সিএনজি সহ বড় বড় গাড়িগুলোতে থাকা যাত্রীদের কেউই নিজেদের বাঁচাতে পারে নি। এক নিমেষেই পুরো স্থান জুড়ে হাহাকার শুরু হয়ে গেল। জুবায়ের করিম চৌধুরী এমন দৃশ্য সহ্য করতে পারেন নি। আগে থেকেই তিনি হৃদরোগী ছিলেন। তার চোখের সামনে নীহারিকার নিথর শরীর দুমড়েমুচড়ে যাওয়া গাড়ির সাথে হিঁচড়ে চলে যাচ্ছে। আর রক্তে ভেসে যাচ্ছে রাস্তা। অন্যান্য গাড়িগুলোও দুমড়েমুচড়ে গেছে। গাড়ি থেকে লোহা বেরিয়ে অনেকের শরীর দ্বি-খন্ডিত। অনেকে বাসের জানালা দিয়ে নেমেছে ঠিকই, কিন্তু বাস উঁচু হওয়ায় রাস্তায় লাফিয়ে পড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে নি। এর আগেই ট্রেন তাদেরও পিষে দিয়ে চলে যায়। এরপর ট্রেন থামলো কিছুদূর গিয়ে। আর অরুণিকা রাস্তার উপর বসে চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে যেতে দেখলো গাড়ির ভেতর থাকা একাধিক তাজা প্রাণ। জুবায়ের করিম চৌধুরী জানতেন না তার মেয়ে রাস্তায় জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। তিনি নিথর পড়ে থাকা তার প্রিয়তমাকে দেখেই বুকে ব্যথা অনুভব করলেন। হাওয়ায় মিঠাই তার হাত থেকে পড়ে গেল। তিনি কাঁদতে পারছেন না। শক্ত হয়ে পড়েছেন। মুহূর্তেই তিনি লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে। ভীড়ের মধ্যে অরুণিকা তার বাবাকে দেখে নি। সে বসে আছে মাটিতে। তার ইচ্ছে বাঁচানোর জন্য, তার শখ পূরণের জন্য তার বাবা-মা তাকে পুরো পৃথিবীতে একা করে দিয়ে চলে গেছে।
মিসেস নীহারিকা ঘটনাস্থলেই মারা গেছেন। জুবায়ের করিম চৌধুরীকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। ডাক্তার জানিয়েছে তিনি হার্ট এট্যাক করেছেন। তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। অরুণিকা বাবাকে তিন মিনিটের জন্য দেখতে গিয়েছিল। কথা বলা নিষেধ ছিল, তবুও সে বাবার হাত ধরে বলেছিল, “মা চলে গেছে আমাকে ফেলে। তুমিও আমাকে একা করে দিও না। তুমি চলে গেলে আমার আর কেউ থাকবে না। বাবা, আমি আর কখনো ঝর্ণা দেখতে যাবো না। কখনো হাওয়ায় মিঠাই খাবো না। তুমি আজ গাড়ি থেকে না নামলে মাকেও বের করতে পারতে। মা আমার সিট বেল্ট খুলতে পারছিল না, তাই নামতে দেরি করেছে। তুমি তো জানো, সিট বেল্টে সমস্যা ছিল। তাই মা খুলতে পারে নি। তুমি থাকলে আমরা বেরিয়ে আসতে পারতাম সময় মতো। আজ আমার জন্য তোমাদের এই অবস্থা হয়েছে। তুমি আমাকে মাফ করে দাও, বাবা। আমাকে ফেলে যেও না প্লিজ। প্লিজ, বাবা।”
একদিন পর জুবায়ের করিম চৌধুরীর জ্ঞান ফিরলো মিনিট খানিকের জন্য। অরুণিকাকে দেখতে চাইলেন তিনি। কথা বলতে চাইলেন। তাকে সুযোগ দেওয়া হলো। অরুণিকার হাত ধরে তিনি ক্ষীণ কন্ঠে বললেন, “তুমি আমার আর নীহার একমাত্র ভালোবাসার অংশ। তোমার মা আর আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। নিজের জীবনকে ভালোবাসবে, মা। লাইফ ইজ বিউটিফুল। তুমি নিজেকে একা ভেবে না। মনে রেখো, তোমার ভালো থাকার মধ্যেই আমরা বেঁচে থাকবো।”
পাশের ডাক্তার জুবায়ের করিম চৌধুরীর কথা শুনে বুঝলেন, তিনি আর ফিরে আসবেন না। প্রতিটা মানুষ হয়তো মৃত্যুর আগ মুহূর্তেই বুঝে যায়, তার আর ফেরার উপায় না। এমনটাই তিনি তার বিশ বছরের ডাক্তারি জীবনে দেখে এসেছেন। প্রায়ই লাইফ সাপোর্ট থেকে রোগীরা কিছু সময়ের জন্য ফিরে আসে, এরপর মিনিটের মধ্যেই হারিয়ে যায় অন্য জগতে। তাদের হয়তো অন্তিম ইচ্ছে প্রিয়জনদের শেষবার দেখার। ঠিক তেমনি জুবায়ের করিম চৌধুরী অরুণিকাকে একা রেখে চলে গেলেন। দু’দিনের ব্যবধানে বাবা-মাকে হারিয়ে পাথর হয়ে গেছে অরুণিকা। আর সেদিনের পর থেকে রাস্তা-ঘাটে চলন্ত গাড়ি দেখলেই তার মনে হয়, গাড়ি তাকে দুমড়েমুচড়ে নিয়ে যাবে। অন্যদিকে ট্রেন তো তার মহাভীতি।
(***)
আহনাফ অরুণিকার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল আর বলতে লাগলো, “কি হয়েছে তোর? আমি আছি তো তোর সাথে। কিচ্ছু হবে না তোর। কিচ্ছু হবে না।”
অরুণিকা অনেকক্ষণ পর আহনাফকে ছেড়ে দিলো। সেদিন ২০১৭ সালের শেষ বসন্ত ছিল, যেদিন অরুণিকা তার বাবা-মাকে হারিয়েছিল। আর আজ ২০২২ সালের শরতের শুরু। কতোগুলো মাস পেরিয়েছে। এই মুহূর্তে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি ছাড়া আর কোনো সত্য সম্পর্ক নেই তার জীবনে। অথচ এই মানুষটাও তাকে ঠকিয়েছে। তবে বাবা-মার মৃত্যুর পর পুরো পরিবারের চক্ষুশূল হয়ে পড়েছিল সে। বড় চৌধুরী সাহেব অরুণিকাকে তার পুত্র হারানোর একমাত্র কারণ ভেবে নিয়েছেন। মিসেস চৌধুরীও অরুণিকার সাথে কথা বলতেন না। অরুণিকার কোনো ভাই না থাকায় জুবায়ের করিম চৌধুরীর সম্পত্তির বেশিরভাগ অংশই তার ভাই ও সন্তানরা পাবে। কিন্তু আরাফ আর আহনাফ অরুণিকার নামেই সব লিখে দেওয়ার জন্য জোর করতে থাকায় দুই চাচার অপছন্দের মানুষ হয়ে যায় অরুণিকা। সম্পদের প্রতি তীব্র আকাঙ্খা আত্মীয়তার সম্পর্ক নষ্ট করে দেয়৷ যেমনটা অরুণিকার সাথে হয়েছে। সে বাবা হারানোর পাশাপাশি সেদিনই বাবার দিকের সব সম্পর্কও হারিয়ে ফেলে। তবে তাহমিদ, আহনাফ ও আরাফের কারণেই সে চৌধুরী ম্যানশনে থাকতে পেরেছিল। নয়তো তার দুই চাচার কেউই তার দায়িত্ব নেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল না। আর পুত্র হারানোর শোকে অরুণিকার দাদা-দাদিও এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন নি। এরপর অরুণিকাকে আহনাফ তাদের ফ্ল্যাটে নিয়ে এলো। এর পরবর্তী ছ’মাস অরুণিকার জীবনের চমৎকার ছ’টি মাস ছিল। আর ছ’মাস পর সেই অধ্যায়টি শুরু হলো যেই অধ্যায়টি জীবনে আসবে তা অরুণিকার কল্পনার বাইরে ছিল।
চলবে-
#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-৩১ ||
রুহানি দরজা খুলতেই দরজার ওপাড়ে অরুণিকাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, “কোথায় গিয়েছিলি? আমি কতোবার ফোন দিলাম তোকে।”
অরুণিকা রুহানির প্রশ্নের কোনো জবাব দিল না। নিঃশব্দে ঢুকে পড়লো বাসায়। রুহানি দরজা আঁটকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অরুণিকার যাওয়ার পানে। অরুণিকার নিস্তরঙ্গ চাহনি আড়াল করে রেখেছে তার হৃদয়ে সৃষ্টি হওয়া অজস্র ঢেউ। সে রুমে ঢুকে দরজা আঁটকে ধপ করে বসে পড়লো। মেঝেতে দুই হাত রাখলো। শরীরের ভার সেই দুই হাতের উপর। মাথা ঝুঁকিয়ে চোখের জল ফেলতে লাগলো সে। রুহানি দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। অরুণিকার ক্রন্দন শুনতে পেয়ে দরজায় ঠোকা দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “ওই শয়তানটা আবার কিছু করেছে, অরু?”
অরুণিকা দরজায় হেলান দিয়ে বসলো। দ্রুত চোখ মুছে গলা স্বাভাবিক করে বলল, “না। আমার টায়ার্ড লাগছে। তোর সাথে পরে কথা হবে।”
রুহানি এরপর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেল। আর অরুণিকা দরজায় হেলান দিয়ে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছে। ব্যাগটা পাশেই রাখা আছে। ধীর হস্তে ব্যাগ থেকে ফোনটা নিয়ে মোবাইলের স্ক্রিনে ভেসে উঠা জুবায়ের করিম চৌধুরী ও মিসেস নীহারিকার ছবির দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সে। ভেজা কন্ঠে বললো, “আই মিস ইউ মা, বাবা। মিস ইউ সো মাচ।”
হঠাৎ অরুণিকা চোখ তুলে তাকালো। তার মনে হলো পুরো ঘর অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেছে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তার। চোখের সামনে ভেসে উঠলো অতীতের এক অরঞ্জিত মুহূর্ত।
ষোলো বছর বয়সী অরুণিকা কাঁদছে বাবা-মা’র ছবি বুকে জড়িয়ে। তার ক্রন্দন গতি গাঢ় হলো কাঁধে কারো স্পর্শ পেতেই। অরুণিকা ফোঁপাতে ফোঁপাতে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখল আহনাফ তার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। অরুণিকা আহনাফের হাত জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে দিল। আহনাফ অরুণিকাকে বুকে জড়িয়ে নিলো, আর ধীরে ধীরে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। অরুণিকা ফুঁপিয়ে বলল, “আহনাফ, আমার তো আর কেউ নেই। আমি একা হয়ে গেছি। একদম একা। বাবাও চলে গেল মায়ের কাছে। আমি কি করবো এখন? আমার তো আর কেউ নেই। সবাই আমাকে ঘৃণা করে। দেখো, কেউ কথা বলে না আমার সাথে। দাদা, দাদি, কেউ কথা বলে না। আমাকে কেন নিয়ে যায় নি ওরা? আমাকেও নিয়ে যেতো। আমি ওদের ছাড়া ভালো থাকবো না, ওরা কি জানে না?”
আহনাফ অরুণিকাকে ছেড়ে দিয়ে তার মুখোমুখি বসালো। এরপর অরুণিকার ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে বলল, “হুস, তুই একা কে বলেছে? আমি আছি তোর সাথে। বউ তুই আমার। তোর একটা স্মার্ট বর আছে। তোকে আমি অনেক ভালোবাসি, অরু। অনেক ভালোবাসি। চাচ্চু আর চাচি তোকে নিয়ে গেলে আমার কি হতো রে? তোকে ছাড়া আমি ভালো থাকবো না। একদম ভালো থাকবো না। তুই আমার আসক্তি। আমার হৃদয়ের একমাত্র ওষুধ। ওরা এটা জানে দেখেই তো তোকে আমার দায়িত্বে রেখে গেছে।”
অরুণিকা কান্না করা ভুলে গেল। আহনাফ তার হাত থেকে জুবায়ের করিম চৌধুরী ও মিসেস নীহারিকার ছবিটা নিয়ে পাশে রেখে দিয়ে বলল, “আজ থেকে তুই আমার বউ না। আমার ছোট বান্ধবী। অরু, আমাকে বর না ভাব, অন্তত বন্ধু ভাবতে পারিস। বেস্ট ফ্রেন্ড!”
অরুণিকা আহনাফের হাত শক্ত করে ধরে আছে। আহনাফ সেই হাত ঠোঁটের কাছে এনে গভীর চুমু খেল। এরপর অরুণিকার ললাটে এঁকে দিল তার মিষ্টি ও গাঢ় স্পর্শ। অরুণিকার অক্ষি জোড়া বেয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রু মুছে দু’চোখে নিবিড়ভাবে আদর মেখে দিল। অরুণিকার শুষ্ক ঠোঁটে আঙ্গুল ছুঁইয়ে দিল। তার দৃষ্টি সেই অধরে আঁটকে আছে। মুহূর্তেই চোখ সরিয়ে নিল আহনাফ। দেয়ালে হেলান দিয়ে অরুণিকাকে ছেড়ে তার পাশাপাশি বসলো। নীরবতা বিরাজ করলো দু’জনের মাঝে। হঠাৎ অরুণিকা আহনাফের হাত ধরে অস্থির কন্ঠে বলল, “আমাকে ছেড়ে যাবে না তো? চাচী আমাকে একটুও ভালোবাসে না। তোমাকে যদি বলে, তুমি কি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে?”
আহনাফ মৃদু হেসে বলল, “আমার নিজেরই সেই সাহস নেই। তোকে ছাড়লে আমি নিজেকেই হারিয়ে ফেলবো, অরু। একটুখানি একটা মেয়ে কখন যে আমার এই ক্ষুদ্র জীবনের এক ফালি সুধানিধি হয়ে পড়লো, আমি নিজেও জানলাম না।”
অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। বুঝলো না আহনাফের কথার অর্থ। তবে জিজ্ঞেসও করলো না। ভালোই লাগছে আহনাফের কথা। মানুষটা আরেকটু কথা বলুক। তার মনের সব ভার কেটে যাবে।
মুহূর্তেই কেটে গেল সেই অন্ধকার, যেই অন্ধকার অরুণিকাকে নিয়ে গিয়েছিল অতীতের পাতায়। সে এবার ফিরে এলো বাস্তবে। এলোমেলো ভাবে তাকাতে লাগলো এদিক-ওদিক। কোথাও কেউ নেই। বুকটা হুঁ হুঁ করে উঠলো। মুখে হাত দিয়ে নিজের কান্না থামানোর চেষ্টা করলো। মেঝে হাতড়ে উন্মাদের মতো খুঁজতে লাগলো আহনাফের করে আসা অতীতের সব প্রতিজ্ঞা। কিন্তু কিছুই খুঁজে পেলো না। অরুণিকা শব্দ করে কাঁদতে লাগলো। কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার সব। সে কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বলল, “তুমি আর নিজেকে কোথায় হারালে? বন্ধু হবে বলে আমাকে তোমার চরম শত্রু বানিয়ে ফেলেছো। কোথায় হলাম আমি তোমার সুধানিধি? তুমি তো আমার হৃদয়ে কাঁকর ঢেলে দিয়েছো। সুধানিধির পরিবর্তে আমি এখন তোমার জীবনে এক জ্বলন্ত কয়লা। পুড়িয়ে পুড়িয়ে যাকে ছাই করে দিয়েছো। আমাকে আর কতো ছাই করলে তোমার মিথ্যে প্রতিশোধের তেষ্টা মিটবে? ছ’মাসের ভালোবাসা দেখিয়ে আমাকে সারা জীবনের জন্য পঙ্গু করে দিয়েছো তুমি, আহনাফ। আমিও দেখবো, আমার হৃদয়ের আর ক’টা অদৃশ্য হাঁড় ভেঙে তুমি শান্তি পাও।”
(***)
সকাল সকাল কলিংবেল বেজে উঠতেই অরুণিকা দরজা খুলে অবাক হয়ে গেল। ভ্রূ কুঁচকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আগন্তুককে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কে?”
লোকটি একটা সাদা প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলল, “মিস অরুণিকা?”
“জি!”
“এটা আপনার পারসেল।”
“কিন্তু আমি তো কিছু অর্ডার করি নি।”
“হিমালয় স্যার পাঠিয়েছেন।”
অরুণিকার চোখ দু’টি মুহূর্তেই বড় বড় হয়ে গেল। প্যাকটটি দ্রুত হাতে নিতেই লোকটি চলে গেল। সাদা মোড়কটি নাকের কাছে আনতেই অরুণিকার হৃদস্পন্দন তীব্র হয়ে উঠলো। দরজা আঁটকে দ্রুত নিজের ঘরে চলে এলো সে। ভাগ্যিস মামীর ঘুম এখনো ভাঙে নি! নয়তো তুলকালাম বাঁধিয়ে ফেলতো। অরুণিকা প্যাকেটটি খুলে দেখলো সাদা মোড়কে বাঁধা একটি বই। অরুণিকা ফোন হাতে নিয়ে দ্রুত হিমালয়ের ইনবক্সে ঢুকলো। কোনো মেসেজ আসে নি। শেষ মেসেজটি অরুণিকার ছিল। কিন্তু কোনো উত্তর দেয় নি হিমালয়।
অরুণিকা লিখলো, “আপনি আমার নামে পারসেল পাঠিয়েছেন?”
হিমালয় সাথে সাথেই মেসেজটি দেখলো, যেন অরুণিকার প্রশ্নের অপেক্ষায় ছিল সে। লিখলো, “জি।”
অরুণিকার মনে জমে থাকা আঁধার একরাশ ভালো লাগায় ছেয়ে গেল। বইটি হাতে নিয়ে মুচকি হেসে লিখলো, “থ্যাংক ইউ।”
“প্লেজার।”
অরুণিকা মোড়ক খুলে বইটি বের করলো। বইয়ের নাম মহাকাল। অরুণিকা বই খুলেই চমকে উঠলো। প্রথম পৃষ্ঠায় একটি চিরকুট ভাঁজ করে রাখা। অরুণিকার বুক ধকধক করছে। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা! চিরকুটটি কাঁপা হাতে খুললো সে। লাল কালিতে স্পষ্ট লেখা,
“হৃদি,
আপনার বিরাগী মনে একটুখানি সুর দেওয়ার বৃথা চেষ্টায় এই উপহারটি পাঠালাম। কিছু মাস আগে আপনার একটি ছবি দেখেছিলাম। আপনার আঁখি জোড়ায় লুকায়িত আছে অজস্র গল্প। হয়তো অপ্রকাশিত, হয়তো-বা প্রকাশিত। আমি তো বড্ড দূরের, তাই অজানা সবটাই। ভেবেছিলাম আমার লেখায় শত শত পাঠক মুগ্ধ হয়, অথচ আমি মুগ্ধ হলাম আপনার ছবির নিচে কাঁচা হাতে লেখা ছোট্ট বাক্যগুলোতে। আপনার কি মনে হচ্ছে আমাদের মধ্যে এই কয়েক সপ্তাহে এক অদৃশ্য বন্ধন সৃষ্টি হয়েছে? আমি ইতোপূর্বে কোনো পাঠকবন্ধু বানাই নি। অথচ এখন ইচ্ছে হচ্ছে। আপনি কি আমার এই বন্ধুত্বের আহ্বানে সাড়া দিতে আগ্রহী? বেশি কিছু আশা করবো না। এক কাপ চায়ের নিমন্ত্রণও দেবো না। শুধু সূর্যোদয় দেখার মুহূর্তে আপনার সঙ্গ চাই। ভোর হলেই জগতের অন্ধকারে ঢাকা আমার হৃদয় নতুন বাক্য বুনতে পারে। সেই মুহূর্তে আপনার সঙ্গ চাইছি। আমি লিখবো, আপনাকে দেখাবো, আপনি পড়বেন, আর একটুখানি আপনার কাঁচা হাতের নতুন সংযোজন হলেই চলবে। উত্তরের অপেক্ষায় আছি।
ইতি,
হিমালয়।”
অরুণিকা বাকরুদ্ধ হয়ে বসে আছে। হাত-পা কাঁপছে তার। কোনো লেখক তাকে এভাবে চিঠি লিখবে, এটা অবিশ্বাস্য একটা ঘটনা, তাও আবার এতো পরিচিত একজন লেখক! সে মনে মনে ভাবছে,
“উনি কি সত্যিই হিমালয়? উনি কি আসল হিমালয় না-কি সেই নামের অন্য কেউ?”
পরক্ষণেই ভাবলো, “না, এটাই তো তার মেইন একাউন্ট। অনেক বড় বড় লেখকের সাথে তার যোগাযোগ আছে।”
অরুণিকা ফোন হাতে নিলো। লিখলো,
“আপনি আমাকে হৃদি বলে সম্বোধন করলেন যে!”
উত্তরে হিমালয় লিখলো, “হৃদি অর্থ হৃদয়। যেই মানুষ হৃদয়ে নাড়া দেয় তাদের হৃদি না ডেকে অন্য কি নামে ডাকা যায় বলুন?”
“আপনি অনেক বড় সেলেব্রিটি। অথচ আমার মতো সাধারণ একটা মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব করতে চান?”
হিমালয়ের উত্তর এলো না। কিন্তু অরুণিকা উত্তরের অপেক্ষায় বসে রইলো।
(***)
একটি অন্ধকার কক্ষে বিছানার উপর দু’পা ছড়িয়ে বসে এক জোড়া চোখ ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে। ফোনের স্ক্রিন বন্ধ করে দিতেই অন্ধকারে মুখটি আড়াল হয়ে গেল। শুধু একটা উত্তর এলো, যেই উত্তর চার দেয়ালে সীমাবদ্ধ হয়ে রইলো।
“হৃদি, আমি খুবই সাধারণ। আমাকে অসাধারণ কেন ভাবছেন? আমি চাই আপনার মতো মুক্ত হাওয়ার স্বাদ নিতে। আমি এক হরিণবাড়িতে আঁটকে আছি। যেই বাড়িতে দেয়াল নেই, জানালা নেই, দরজা নেই, শুধু কলম আছে। আর আছি আমি। আপনাকেই কেন বন্ধুত্বের আহবান করলাম? কি বলবো! এর উত্তর আপনাকে জানাতে চাই না। এইটুকু বলতে চাই, আপনার সাথে সুস্থ কথোপকথন আমার বহুদিনের শখ পূরণ করেছে।”
অনেকক্ষণ কোনো উত্তর না আসায় অরুণিকা লিখলো, “কিছু বলছেন না যে!”
এবার হিমালয়ের উত্তর এলো, “আমিও একজন সাধারণ মানুষ, অসাধারণ কেউ নই। আপনি কি আগ্রহী না-কি প্রত্যাখ্যান করবেন?”
অরুণিকা মৃদু হেসে লিখলো, “আপনার সাথে বন্ধুত্ব বেশ জমবে মনে হচ্ছে। তবে মিথ্যে প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হয়ে বন্ধু হয়ে এসেছিল কেউ একজন। এখন শূন্য মেঝেতে তার ফিরে আসার শব্দও হয় না। তার অস্তিত্বও আর খুঁজে পাই না। সে হারিয়ে যাবে না বলে, নিঃস্ব করে দিয়ে হারিয়ে গেল।আপনার বন্ধুত্ব তেমন না হলেই ভালো।”
হিমালয় মেসেজটি দেখলো। কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো উত্তর এলো না। অরুণিকা ফোন পাশে রেখে বইটি হাতে নিলো। হঠাৎ কিছু একটা ভেবে ফোন হাতে নিয়ে হিমালয়কে লিখলো, “আমার এড্রেস কীভাবে জানলেন?”
অন্ধকার ঘরটি মৃদু আলোকিত হলো ফোনের স্ক্রিন জ্বলে উঠায়। হাতে ফোন নিতেই অরুণিকার মেসেজটির দিকে তাকিয়ে রইলো এক জোড়া চোখ। স্ক্রিনের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেই চোখ জোড়া। মিনিট খানিক পর হাত চললো কি-বোর্ডে। লিখলো, “কখনো মুখোমুখি হলে বলবো। গল্পের মতো এটাও না হয় সাসপেন্স থাকুক।”
অরুণিকা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো ফোনের স্ক্রিনের দিকে। ভাবতে লাগলো, অজানা উত্তরটি কি হতে পারে!
(***)
কেটে গেল কয়েক সপ্তাহ। বিকেলে অরুণিকা বসে মহাকাল বইটি পড়ছিল, এমন সময় মামীর চিৎকারে আত্মা কেঁপে উঠলো তার। রুম থেকে বেরুতেই ভয়ে তার হাত-পা কাঁপাকাঁপি শুরু করলো। রুহানি অরুণিকাকে দেখে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো। অরুণিকা কাঁপা কন্ঠে বললো, “আগুন!”
মুহূর্তেই তারস্বরে চিৎকার করতে লাগলো অরুণিকা, রুহানি এবং আতকিয়া জাহান। চিৎকার শুনেই পাশের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এলো ইমান ও তার বাবা-মা। ক্ষণিকের মধ্যেই পুরো ভবনের বাসিন্দা জড়ো হলো অরুণিকাদের ফ্ল্যাটের সামনে। আতকিয়া জাহান চুলার উপরে কাপড় শুকাতে দিয়েছেন, আর আঁচ লেগে সেই কাপড়ে আগুন ধরে যায়। কাপড় পুরোপুরি পুড়ে, সেটা সিলিন্ডারের পাইপের উপর পড়লো। ধীরে ধীরে আগুনের উত্তাপে পাইপ গলে গ্যাস ছড়িয়ে পড়লো পুরো রান্নাঘরে। সেখান থেকেই আগুন ধরে এখন বসার ঘর পর্যন্ত দাউদাউ করে জ্বলছে। পর্দায় আগুন লেগে যাওয়ায় কোনোভাবেই দরজা খুলতে পারছে না তারা। অরুণিকা বারান্দায় এসে চিৎকার করে সাহায্য চাইছে। এলাকায় লোক জড়ো হয়ে গেছে। এদিকে ইমানসহ বিল্ডিংয়ের আরো কয়েকজন দরজা ভাঙার চেষ্টা করছে। চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ শুনে আহনাফ, আরাফ, তাহমিদ, তূর্য, ইভান ও ইমন নিচে নেমে এলো। আর রুদবা বারান্দায় দাঁড়িয়ে বুঝার চেষ্টা করছে কি হচ্ছে। ইমন সামনে এগিয়ে দেখলো অরুণিকাদের বিল্ডিংয়ে আগুন লেগেছে। সে চেঁচিয়ে বাকিদের বলতেই পাঁচজনই দৌঁড়ে ভেতরে ঢুকলো। আহনাফ উপরে উঠে দেখলো ইমান দরজা ভাঙার চেষ্টা করছে। সে ইমানকে সরিয়ে দিয়ে জোরে জোরে দরজায় লাথি মারলো। আরাফ আর তূর্যও তার সাথে দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা দিতেই তালা ভেঙে গেল। আহনাফ আগুন পরোয়া না করে লাফিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো। আতকিয়া জাহান, রুহানি আর অরুণিকা ভেতরের রুমে বসে কান্নাকাটি করছে। আহনাফকে দেখে অরুণিকা বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। আহনাফ ছুটে গেল অরুণিকার কাছে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, “কিচ্ছু হবে না। আমি তোকে বের করবো এখান থেকে। চিন্তা করিস না। কিছু হবে না দেখিস।”
এদিকে ইমানদের বাসা থেকে বালতি আর ড্রাম ভর্তি পানি এনে ইমন, তূর্য, তাহমিদ আর ইভান সমানে পানি দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছে। অন্যদিকে আরাফ নিচে নেমে পাশের সেলুনে থাকা কার্বন ডাই-অক্সাইড সিলিন্ডার এনে স্প্রে করে দিতেই আগুন ধীরে ধীরে নিভে গেল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে দুয়েক ঘন্টা লাগলো। সবাই এখনো আতঙ্কগ্রস্ত। হঠাৎ এসবের মধ্যে বাড়ির মালিক আতকিয়া জাহানের উপর চড়াও হয়ে উঠলেন। তাদের মতো উদাসীন ভাড়াটিয়া তিনি চান না। মুহূর্তেই বাড়ি ছাড়ার আদেশ দিলেন। নয়তো এক্ষুণি ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবেন। ইমান বলল, “এক্ষুণি কিভাবে যাবে! বাসা খুঁজতেও তো অনেক সময় লাগে।”
ইমানের মা তাকে থামিয়ে দিল। আতকিয়া জাহান অপমানিত হয়ে সবার সামনে অরুণিকার গালে কষিয়ে একটা চড় বসিয়ে দিলেন। অরুণিকা চড় খেয়ে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো মামীর দিকে। রুহানি চেঁচিয়ে বলল, “ওকে কেন মারছো?”
“কারণ ও তখন কি করছিল? সারাদিন বই একটা নিয়ে বসে থাকে। কি বই পড়ে সারাদিন?”
আহনাফ অরুণিকার দিকে তাকিয়ে রইলো। আরাফ বলল, “আপনার ভুলের জন্য এমন হয়েছে। আপনি নিজের দোষ ঢাকার জন্য আমার বোনের গায়ে হাত তুলতে পারেন না!”
“কি করবে তুমি? নিয়ে যাবে ওকে? নিয়ে যাও। আপদ বিদায় হবে।”
আরাফ কিছু বলতে যাবে তূর্য আরাফের হাত ধরে বলল, “কিছু বলিস না। হিতে বিপরীত হবে।”
এদিকে বাড়ির মালিক বলে গেল একদিনের মধ্যেই যেন বাড়ি খালি করে দেয়। সাথে দেয়ালে পোড়া দাগ লাগায় যাতে ক্ষতিপূরণ দিয়ে যায়। আতকিয়া জাহান হতাশ হয়ে মাটিতে বসে পড়লেন। কোন বিপদে যে পড়লেন তিনি! এই মুহূর্তে বাসা কোথায় পাবেন?
(***)
অরুণিকাকে চৌধুরী ম্যানশনে ঢুকতে দেখেই শিরিন সুলতানা তেড়ে এলেন। তাকে গেটের বাইরে ধাক্কা দিয়ে বের করে বললেন, “ডিভোর্স লেটার পেয়ে যাবি সময় মতো। আবার কেন এসেছিস এখানে?”
অরুণিকা কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর বলল, “আমরা যেখানে থাকি ওটা খালি করে দিতে বলেছে। এই মুহূর্তে….”
অরুণিকাকে থামিয়ে শিরিন সুলতানা বললেন,
“শুনেছি সব। তোমার ভ্রাতাগণ শুনিয়েছে সেই করুন কাহিনী। আগে এটা বলো, এখানে তোমার কাজ কি?”
“যতোদিন বাসা পাবো না। মামীদের নিয়ে এখানে উঠবো ভাবছি।”
শিরিন সুলতানা তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন, “ভাবলে কোন সাহসে?”
অরুণিকা শক্ত কন্ঠে বলল, “সাহসের কি আছে! এটা আমার বাবার বাড়ি।”
“শোনো মেয়ে, এখানে তোমার কোনো অধিকার নেই। ভুলে গেছো, কিভাবে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হয়েছিল? লাজ-লজ্জার মাথা খেয়েছো তুমি। আমার ছেলের জীবনে গ্রহণ লাগিয়ে কি শখ মেটেনি এখনো?”
“লিসেন, মিসেস শিরিন সুলতানা, আপনি ভালো করেই জানেন আপনার ছেলে কেমন। এটাও জানেন আপনি নিজে কেমন। এমনকি আপনি আরো ভালো করে জানেন, আমি কেমন। তাই অপাত্রে বাক্য ব্যয় করে আমাকে বাধ্য করবেন না, আপনার মুখের সামনে আমি আয়না তুলে ধরি।”
শিরিন সুলতানা ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন অরুণিকার দিকে। অরুণিকা ভেতরে যেতে নেবে তখনই রুহানির কল এলো। অরুণিকা কল ধরতেই ওপাশ থেকে রুহানি বলল, “নিচ তলায় একটা বাসা পাওয়া গেছে। রুদবাদের বিল্ডিংয়ে। ভাড়া অনেক কম। মা এক পায়ে রাজি। কিন্তু একটা কাহিনী হয়ে গেছে। তোকে তাড়াতাড়ি আসতে হবে।”
অরুণিকা দ্রুত বেরিয়ে পড়লো। আর শিরিন সুলতানা রাগী দৃষ্টিতে অরুণিকার যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে রইলো।
(***)
অরুণিকা রুদবাদের বিল্ডিংয়ে নিচ তলাটি দেখে রুহানির হাত ধরে বলল, “আপতত হয়ে যাবে।”
রুহানি মাথা নেড়ে পেছনে ইশারা করতেই অরুণিকা পেছন ফিরে আহনাফকে দেখে অবাক হয়ে গেলো। আহনাফ পকেটে হাত গুঁজে ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে আছে। তখনই আতকিয়া জাহান আহনাফের পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “তোমাকে অনেক ধন্যবাদ, বাবা। তোমার জন্য এই বাড়ির মালিক আমাদের এই ঘরটা দিয়েছেন।”
অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। আহনাফ বলল, “কিন্তু শর্তটা!”
“আরেহ চিন্তা করো না, বাবা। ও তোমার সব শর্ত মেনে নেবে। তাই না অরু?”
অরুণিকা জিজ্ঞেস করলো, “কি শর্ত!”
আহনাফ অরুণিকার দিকে ঝুঁকে বলল, “যদি চাও বাসা ভাড়া নিতে, তাহলে তোমাকে আমার জন্য কাজ করতে হবে। আন্ডারস্ট্যান্ড?”
অরুণিকা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, “চট্টগ্রামের ডন হয়ে গেছো না-কি?”
“বলতেই পারো। তবে সুযোগ নিজে এসেই আমার কাছে ধরা দিয়েছে। দেখো, প্রকৃতিও চায়, তুমি আমার অনুগত থাকো।”
“এই বাসা আমাদের লাগবে না। রাখো তোমার বাসা তোমার পকেটে।”
আতকিয়া জাহান অরুণিকার হাত মুড়ে দিয়ে বললেন, “এই চুপ, বেয়াদব মেয়ে। একটা কথা বেশি বলবি না তুই। আহনাফ যা বলেছে, তাই হবে। তুই ও যা বলবে, তাই শুনবি।”
রুহানি আতকিয়া জাহানের হাত ধরে বলল, “মা, কি যা তা বলছো? তুমি জানো ওরা ডিভোর্স নিচ্ছে।”
“হবে না ডিভোর্স। আহনাফ না চাইলে হবে না।”
“এটা ওদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। তুমি অরুকে ফোর্স করতে পারো না।”
“পারি। আমাদের মাথার উপর ছাদ নেই। তোর বাবাও দেশে নেই। ওই বাড়ির মালিক বের করে দিলে আমরা কোথায় থাকবো? সামনে তোর পরীক্ষা। এই মুহূর্তে মাসের মাঝখানে কোথাও বাসা পাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই আমি আর কোনো কথা শুনতে চাই না। যতোদিন এই বাড়িতে থাকবো, আহনাফ যা বলবে অরুণিকা তাই করবে। আমি জবান দিলাম।”
আহনাফ বাঁকা হেসে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে তার কানে ফিসফিসিয়ে বলল, “ওয়েলকাম টু মাই ওয়ার্ল্ড, ডিয়ার ওয়াইফ।”
(***)
জিনিসপত্র নতুন বাসায় উঠানো শেষ। টুকটাক সবাই অরুণিকা ও রুহানিকে সাহায্য করছে। আতকিয়া জাহানের রুম ঠিক করতে সাহায্য করছে রুদবা। লোক এসে মালপত্র রেখে যেতেই রুহানি নিজের ঘর গোছাতে ব্যস্ত। তাকে সাহায্য করতে এসেছে আরাফ আর ইমন। এদিকে অরুণিকা ইমানকে দিয়েছে ড্রয়িংরুমের দায়িত্ব। বই-পুস্তক, ফুলদানি সব গুছিয়ে রাখছে ইমান। অন্যদিকে তাহমিদের জোরাজুরিতে বাধ্য হয়ে আহনাফ আর ইভান রান্নাঘরের জিনিসপত্র গোছাতে সাহায্য করছে তাহমিদকে। ইভানের মেজাজ চটে আছে। তবুও একটু পরপর থেমে থেমে কাজ করছে সে। এদিকে তূর্য অরুণিকাকে সাহায্য করছে। তারা টুকটাক গল্পও করছে। অরুণিকার রুম থেকে হাসির শব্দ ভেসে আসছে একটু পরপর। সেই শব্দ রুদবার কান অব্ধি পৌঁছালো। সে আতকিয়া জাহানের রুম থেকে বের হয়ে শব্দনুসরণ করে অরুণিকার রুমের সামনে এসে অবাক হলো। দেখলো তূর্য আর অরুণিকা কোনো একটা বিষয়ে বেশ হাসাহাসি করছে। রুদবার ভালো লাগলো না ব্যাপারটা। সে দৌঁড়ে নিজের বাসায় চলে এলো। বাসায় এসে মনে মনে বলল, “অরু আমাকে বলেছে তূর্য প্লে বয়, অথচ সে তো খুব ঘেঁষাঘেঁষি করছে তূর্যের সাথে। আমি তো একদম শিউর, অরুণিকা আমাকে মিথ্যে বলেছে। হয়তো ও তূর্যকে পছন্দ করে। পছন্দ করে বললেই তো হতো। আমি কি ওর কাছ থেকে তূর্যকে কেঁড়ে নিতাম? কিন্তু মিথ্যে বলে আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে অরু। আমাকে তো অরু একপ্রকার ঠকিয়েছে। বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে এমনটা কি করে করলো অরুণিকা?”
এদিকে সব জিনিস গুছিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বের হলো ইমান। অরুণিকা ইমানের দিকে তাকিয়ে বলল, “থ্যাংক ইউ সো মাচ। তুমি ফ্যামিলি না হয়েও অনেক হ্যাল্প করেছো।”
আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে তাকালো অরুণিকার দিকে। তাদের কথার মাঝখানে বলল, “তুই ইমানকে তুমি করে ডাকিস? ও সিনিয়র তোর!”
ইমান হেসে বলল, “স্যার সমস্যা নেই। আমরা অনেক আগেই বন্ধু হয়ে গেছি।”
ইমানের কথায় আহনাফ চোখ ছোট করে অরুণিকার দিকে তাকালো। অরুণিকা আহনাফের চাহনি দেখে দ্রুত বিদায় দিলো ইমানকে। না জানি এই হতচ্ছাড়াটা ইমানের সামনে কি না কি করে বসে।
চলবে-
#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-৩২ ||
চারপাশে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। সেই নিস্তব্ধতার মাঝে টিমটিমে সড়ক বাতির নিচে ওড়না আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে রুহানি। সে শেভরন থেকে বেরিয়েছে মাত্র। ডাক্তারকে আতকিয়া জাহানের রিপোর্ট দেখাতে এসেছিল সে। ডাক্তার ব্যস্ত থাকায় রিপোর্ট দেখতে দেখতে রাত হয়ে গেছে। অন্যান্য সময় এই পথ এতো সহজে ঘুমিয়ে পড়ে না। তবে আজ কেন? রুহানি ভীত দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। রাস্তায় একটা রিক্সাও নেই। সে হাঁটতে হাঁটতে পাঁচলাইশ থানা পার করে ফেলেছে। থানা পার করতেই ভয় আরো বেড়ে গেল তার। হঠাৎ সাঁই সাঁই করে দু’টি মোটর সাইকেল রুহানিকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। রুহানি মনে মনে বলতে লাগলো, “আল্লাহ রক্ষা করো আমাকে।”
কিছুদূর যেতেই মোটর সাইকেল দু’টি থেমে গেল। রুহানি চোখ বড় বড় করে সামনে তাকিয়ে আছে। হেলমেট পরা আরোহী দু’জন পেছন ফিরে তাকালো। রুহানি তা দেখে থেমে গেল। মোটর সাইকেল আরোহী দু’জনের মধ্যে কিছু কথোপকথন হলো। রুহানি তা বুঝতে পেরে মিনমিন করে বলল, “খাতাম, রুহানি। তুই শেষ। পালা তাড়াতাড়ি।”
মোটর সাইকেল দু’টির মধ্যে একটি সামনে চলে গেল। আরেকটি ঘুরে রুহানির দিকে আসতে লাগলো। রুহানি দ্রুত পেছন ফিরে দৌঁড়াতে লাগলো। কিন্তু তার আগেই মোটর সাইকেলটি তার সামনে এসে থামলো। রুহানি ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আরোহীর হেলমেট আবৃত মুখের দিকে। কয়েক পা পেছাতেই হেলমেটের গ্লাস উপরের দিকে তুললো সেই আরোহী। রুহানি হেলমেটের আড়ালে থাকা চোখ দু’টি দেখতে পেয়ে প্রাণ ফিরে পেলো। স্বস্তির হাসি হেসে মানুষটির শার্টের কোণা খামচে ধরলো সে। মানুষটি চোখ নামিয়ে রুহানির আঙ্গুলের ফাঁকে নিজের শার্ট খামচে ধরা দেখে হেলমেট খুলে ফেললো। রুহানি ঠোঁট উলটে বলল, “এভাবে কেউ রোবটের মতো বাসা থেকে বের হয়?”
আরাফ ভ্রূ কুঁচকে বললো, “এক্সকিউজ মি! আমাকে বলছো?”
রুহানি মাথা নেড়ে বলল, “জি!”
“আমি রোবটের মতো বের হয়েছি?”
“হেলমেট পরলে আপনাকে রোবটই মনে হয়।”
আরাফ এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল, “এতো রাতে এখানে?”
“রিপোর্ট দেখাতে এসেছি।”
“একা এসেছো?”
“হুম।”
“তোমার মা কোথায়?”
“বাসায়।”
“সিরিয়াসলি? তোমার মা এতো কেয়ারলেস? একটা উঠতি বয়সী মেয়েকে রাত বারোটাই একা রাস্তায় ছেড়েছে! ভেরি ডিসেপয়েন্টিং।”
রুহানি মুখ বাঁকিয়ে বলল, “দোষ আপনাদের। আপনাদের মতো পুরুষ জীবের জন্য আমরা বের হতে ভয় পাই। যেমন একটু আগে আপনার বাইকের শব্দ শুনে কলিজা বেরিয়ে গিয়েছিল। আপনার সাথে আরেকজন কে ছিল?”
“তূর্য ছিল। আমরা তো তোমাকে দেখেই থামালাম। এখন বাইকে উঠো।”
চোখের ইশারায় রুহানিকে মোটর সাইকেলে উঠতে বলল আরাফ। রুহানি আরাফের কাঁধে হাত রেখে উঠে বসলো। মোটর সাইকেল স্টার্ট দিলো আরাফ। দমক হাওয়া আর মোটর সাইকেলের গতি রুহানির চুলগুলো এলোমেলো করে দিচ্ছে। সামনের গ্লাসে চোখ পড়তেই আরাফ সেকেন্ড খানিকের জন্য থমকে গেল। মুহূর্তে ভারসাম্য হারাতেই রুহানি পেছন দিক থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাকে। আরাফ সাথে সাথেই মোটর সাইকেল থামালো। রুহানি এখনো চোখ খিঁচে আরাফকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। এবার আরাফ গলা খাঁকারি দিতেই রুহানি চোখ খুললো। নিজেকে আরাফের কাছাকাছি দেখে দ্রুত সরে পড়লো। আমতা-আমতা করে বলল, “রোলার কোস্টারের মতো বাইক চালায় কেউ? আপনি তো দেখি বাইকও চালাতে পারেন না।”
আরাফ কিছু না বলে আবার মোটর সাইকেল স্টার্ট দিলো। রুহানি সামনের গ্লাসে তাকাতেই আরাফের মুখটা দেখতে পেলো। চশমা পরা ছেলেরা সুদর্শন হয় শুনেছে, কিন্তু এতো সুদর্শন হতে পারে? আরাফের কপালের নিচে একটা কাটা দাগ। এই দাগটির জন্য মানুষটিকে আরো চমৎকার লাগছে।
মোটর সাইকেল বাসার সামনে এসে থামতেই রুহানির ঘোর কাটলো। সে নেমে আরাফের কাছে এসে বলল, “থ্যাংক ইউ বাসায় নামিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু আপনি ভালোভাবে বাইক চালাতে পারেন না। আরেকটু শিখবেন। আমি আজ পড়ে গেলে কি হতো?”
আরাফ বলল, “এখানে আমার দোষ নেই। হাওয়ায় তোমার চুলগুলো যেভাবে উড়ছিল, মিনিট খানিকের জন্য লেগেছে আমার পেছনে কোনো জ্বিন বসে আছে।”
কথাটি বলেই আরাফ হাসতে লাগল। রুহানি চোখ-মুখ কুঁচকে তাকিয়ে রইলো আরাফের দিকে। আরাফ হাসি থামাতেই রুহানি তাকে অবাক করে দিয়ে মুচকি হেসে বলল, “আপনি শুধু শুধু মুখটা বাংলার পাঁচের মতো করে রাখেন। হাসলে আপনাকে খুব সুন্দর লাগে। আপনার মুখে হাসিই মানায়।”
আরাফ রুহানির কথায় চকিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। মুহূর্তেই গিলে ফেললো হাসিটা। রুহানি মুখ বাঁকিয়ে বলল, “থাক, শুরুতে আপনি আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন, তাই আমিও না হয় জ্বিন সেজে একটু ভয় পাইয়ে দিলাম। এখন কাটাকাটি হয়ে গেছে।”
এই বলে রুহানি ভেতরে চলে গেল। আরাফ রুহানির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। এরপর চোখ সরিয়ে মোটর সাইকেলের ফ্রন্ট গ্লাসের দিকে তাকালো। সেকেন্ড খানিক আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে রইলো সে। এরপর নিজেকে দেখে মৃদু হাসলো সে। তখনই আহনাফ পেছন থেকে এসে আরাফের পিঠে চাপড় মেরে বলল, “নিজেকে দেখে দেখে হাসছিস?”
আরাফ চোখ তুলে আহনাফকে দেখে বলল, “ভুল দেখেছিস তুই।”
এই বলে মোটর সাইকেল গ্যারেজে ঢুকিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। আহনাফের পেছনে এসে তূর্য বলল, “ঘুরেফিরে আমরা ছ’বন্ধু শত্রুদেরই প্রেমে পড়ি মনে হয়।”
আহনাফ বলল, “ইমন আর ইভান এই গণনার বাইরে আছে আপতত। ওদের তো কোনো গতিই নেই।”
“কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে, আরাফের লাইফে তোর চেয়ে বড় থ্রিল আসবে।”
(***)
আজ থেকে ক্যাম্পাসে যাতায়াতের জন্য বাসের ব্যবস্থা করেছে অথোরিটি। আপতত বাসের পরিমাণ কম। নির্দিষ্টও করা হয় নি। তাই শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা একই বাসে উঠছে। বাসের জন্য গলির মুখে এসে দাঁড়ালো অরুণিকা আর রুদবা। রুদবা এই কয়েকদিন অরুণিকার সাথে খুব একটা কথা বলে নি। সে রাস্তার ওপাড়ে একা একাই হেঁটে পার হয়ে গেল। আর অরুণিকা রুদবার এমন শীতল আচরণে হতভম্ব হয়ে গলির মুখে দাঁড়িয়ে রইলো। সে এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে দেখলো রাস্তায় গাড়ি আসছে আর যাচ্ছে। কীভাবে রাস্তা পার হবে, এটা ভাবতেই হুট করে হাতে কারো স্পর্শ পেয়ে পাশ ফিরে তাকাতেই চমকে উঠলো অরুণিকা।
আহনাফ সামনে হেঁটে যাচ্ছে, অরুণিকার হাত তার হাতের মুঠোয় আবদ্ধ। সে অরুণিকাকে রাস্তা পার করে দিয়ে হাত ছেড়ে দিলো। তূর্য আর ইভান আহনাফের দিকে তাকিয়ে দু’জনের মধ্যে কিছু ফিসফিস করছিল। ইমান দূর থেকেই অরুণিকাকে দেখে দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসছিল, কিন্তু তার আগেই আহনাফ অরুণিকার হাত ধরে রাস্তা পার করিয়ে দিল। ইমান সেখানেই দাঁড়িয়ে স্থির দৃষ্টিতে আহনাফের দিকে তাকিয়ে রইলো। আহনাফের সাথে ইমানের চোখাচোখি হতেই রহস্যময় হাসি ফুটে উঠলো আহনাফের ঠোঁটে। একটু পর একটা বাস এলো। একটা সিট থাকায় কেউ উঠতে চাইছিল না। রুদবা তূর্যের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। অরুণিকা রুদবার জন্য উঠে নি। আর ইমান অরুণিকার জন্য উঠতে চাচ্ছে না। কিন্তু আহনাফ জোর করেই ইমানকে সেই বাসে উঠিয়ে দিয়ে বলল, “তাড়াতাড়ি ক্যাম্পাসে পৌঁছে ক্লাসে গিয়ে বসো। সিনিয়রদের দেরীতে যাওয়া মানায় না।”
ইমান হতাশ দৃষ্টিতে অরুণিকার দিকে তাকালো। আর আহনাফ বাঁকা হেসে ইমানের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, “আমি এতো সহজে আমার অধিকার ছাড়ি না। একদিকে হারালে, অন্য উপায়ে ধরে রাখি। তোমার কোনো চান্স নেই, ইমান। ইটস মাই ফিল্ড। এন্ড আই এম দা ওনার অব দিস ল্যান্ড।”
(***)
আরেকটি বাস আসতেই তূর্য আর ইভান উঠে পাশাপাশি বসলো। মেয়েদের জন্য একটা সিট খালি ছিল। রুদবা সেখানে গিয়েই বসে পড়লো। রুদবার পাশে একজন মহিলা শিক্ষক বসা। এদিকে অরুণিকা রুদবার ব্যবহারে ভীষণ কষ্ট পেল। এই মুহূর্তে আহনাফের পাশে বসেই যেতে হবে তাকে। অরুণিকা জানালার পাশে বসতেই আহনাফ সেই সিটে রুদবাকে ডেকে বসালো। আর আহনাফ নিজে গিয়ে সেই মহিলা শিক্ষকের পাশে বসলো। দু’জনই বেশ গল্প করে গেল। অরুণিকা অবাক হয়ে আহনাফের হাবভাব দেখছে। আর মনে মনে ভাবছে, “এই ইডিয়ট লোকটা কি আমাকে আবার ফাঁদে ফেলার জন্য এমন সুইট বিহেইভ করছে, না-কি সত্যিই হেদায়েত প্রাপ্ত হয়েছে!”
পরক্ষণেই অরুণিকা বাঁকা হেসে বলল, “হোক ভদ্র। আমিও এবার অভদ্র হয়ে দেখাবো। মামীকে দুই দুইবার জব্ধ করে আমাকে হারানোর চেষ্টা করেছে এই শয়তানটা। আমি এবার আমার অবস্থান থেকেই হতচ্ছাড়াটাকে শায়েস্তা করবো।”
এরপর বাস ক্যাম্পাসে ঢুকতেই অরুণিকা রুদবার দিকে তাকিয়ে এক গাল হাসলো। রুদবা কিছু না বলে চুপচাপ বাস থেকে নেমে পড়লো। এদিকেনঅরুণিকা মিনমিনিয়ে বলল, “রিভেঞ্জ নম্বর ওয়ান, সবার সামনে আমাকে হেনস্তা করার রিপ্লাই। জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ, মিস্টার চৌধুরী।”
অরুণিকা বাস থেকে নামলো না। সে আহনাফ নামার আগ মুহূর্তেই নামার জন্য সিট থেকে উঠে দাঁড়ালো। আহনাফ অরুণিকার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। অরুণিকা তার পিছু পিছু নামছে। আহনাফ নামার আগ মুহূর্তেই অরুণিকা পা বাড়িয়ে দিতেই তার পা অরুণিকার পায়ের সাথে আঁটকে যেতেই, সে পা উলটে মুখ থুবড়ে নিচে পড়ে গেল। আহনাফ পড়ে যেতেই অরুণিকা মিথ্যে সহানুভূতির ভান দেখিয়ে লাফিয়ে আহনাফের হাতের উপর দাঁড়ালো। আহনাফের থুতনি ইটের রাস্তার সাথে ঘষা লেগে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। তার উপর অরুণিকা তার হাতের উপর দাঁড়াতেই আঙ্গুলের গিঁটে ঘষা লাগায় সেখানেও রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। তূর্য অরুণিকাকে সরিয়ে দিয়ে বলল, “টুইংকেল! কি করলে তুমি এটা?”
“সরি, স্যার। আমি ইচ্ছে করে করি নি।”
পুরো ক্যাম্পাসের সামনে বাস থেকে নামার সময় ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের লেকচারের মুখ থুবড়ে পড়ে গেছেন, যা এই মুহূর্তে সবাই ভীড় জমিয়ে দেখছে। ইভান আর তূর্য আহনাফকে উঠে বসালো। আহনাফ অরুণিকার দিকে তাকাতেই সে মৃদু হেসে চোখ মারলো। এরপর মুহূর্তেই মুখ ভার করে বলল, “সরি স্যার।”
পরক্ষণেই অরুণিকা মনে মনে বলল, “মিস্টার আহনাফ, দেখো, আজ সবাই তোমার অধঃপতন দেখছে। কেউ তোমাকে বাঁচাতে আসছে না। কি ইন্সাল্টিং, রাইট? আমাকে যেদিন সবার সামনে হেনস্তা করেছিলে, সবাই এভাবেই আমাকে ঘুরে-ঘুরে দেখছিল। আজ তোমাকে দেখছে। তবে তোমার শুধু মুখে আঘাত লেগেছে, আর আমার মনে, আমার চরিত্রে। সেটাও সময় সুযোগ পেলে যদি ফিরিয়ে দিতে পারি!”
(***)
সাল ২০১৭। অরুণিকা আজ খুবই খুশি। জীবনে প্রথম সে ক্লাসমেট থেকে গিফট পেয়েছে। তাও আবার ছেলে সহপাঠী। গিফট নেওয়ার সময় ক্লাসের অন্যান্য মেয়েরা যেভাবে তাকিয়ে ছিল, ঘনিষ্ঠ মেয়ে বন্ধুরা যেভাবে খোঁচাখুঁচি করছিল, বেশ লজ্জা পেয়েছিল অরুণিকা। অরুণিকা রুমের দরজা আঁটকে প্যাকেট খুলতেই দেখতে পেলো একটা স্ট্র্যাপলেস ফ্রক। সাথে একটা চিঠি। অরুণিকা চিঠির ভাঁজ খুলতেই দেখলো, সেখানে লেখা-
“স্কুল প্রোগ্রামে এটা পরলে তোমাকে ভালো লাগবে।”
অরুণিকা ফ্রকটি এপাশ-ওপাশ করে দেখলো। গোলাপী রঙের উপর সাদা সাদা ফুলের কাজ করা। অরুণিকা কৌতুহলি হয়ে পরে নিলো সেই ফ্রক। যদিও পরার আগে সে বুঝে নি, ফ্রকটার কাঁধ নেই। কিন্তু পরার পর অনেক চেষ্টা করেও সে হাত দু’টি কাঁধ পর্যন্ত উঠাতে পারলো না। এর আগে কখনো এমন ফ্রক সে পরে নি। তাই বুঝতে পারছিলো না, এটি এমনই। হঠাৎ রুমের দরজা খুলে যেতেই অরুণিকা ভীত চোখে পেছন ফিরে তাকালো। মুখ ছোট করে ভাবলো, “ভুলেই তো গিয়েছিলাম, দরজার তালা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল!”
এদিকে আহনাফ অরুণিকাকে এমন পোশাকে দেখে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। পরক্ষণেই ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “এই ড্রেস কোথায় পেলি, অরু?”
অরুণিকা নিচের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি নক করে এলে না যে?”
“আমি তোর বর। আমারও কি নক করে আসতে হবে?”
অরুণিকা চুপ করে রইলো। আহনাফ তার কাছে এসে তার হাত ধরে বলল, “তোকে কেউ এরকম ড্রেস পরা দেখলে ভর্তা বানিয়ে দেবে। তুই এখন বড় হয়েছিস।”
অরুণিকা মলিন মুখে বলল, “আমি জানতাম না, এটা এমন হবে।”
“দেখে কিনিস নি! আর তুই একা একা এটা কবে কিনতে গেলি? আমাকে বলতি। আমি তোকে নিয়ে যেতাম।”
“এটা আমি কিনি নি। আমার ক্লাসমেট দিয়েছিল।”
আহনাফ কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “কোন ক্লাসমেট এটা!”
“নোমান।”
আহনাফ দাঁতে দাঁত পিষে বলল, “ছেলে?”
অরুণিকা ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে মাথা নাড়লো। এরপর আহনাফ কোথা থেকে একটা কাচি এনে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলল, “তাড়াতাড়ি জামাটা খুলে আয়। আমি এটা কুঁচিকুঁচি করে ওই হনুমানের মুখের উপর ছুঁড়ে মারবো।”
অরুণিকা দ্রুত ওয়াশরুমে গিয়ে কাপড় পালটে এলো। আহনাফ ফ্রকটা আর কাঁটলো না। কাচিটা মেঝেতে ছুঁড়ে মারলো। অরুণিকা ভয়ে রীতিমতো কাঁপছে। আহনাফ নিজেকে শান্ত করে অরুণিকার হাত ধরে নরম সুরে বলল, “তুই বড় হয়ে গেছিস। এখন যার-তার কাছ থেকে কিছু নিবি না। হয়তো তোকে ফোর্স করেছে। কিন্তু তোকে এভয়েড করা শিখতে হবে। ছেলেদের যতো এভয়েড করবি, ওরা ততো তোকে ভারী ব্যক্তিত্বের মনে করবে। আবার আমার উপর এই থিওরি এপ্লাই করতে যাবি না কিন্তু। আমি তো তোর বর। আমি ছাড়া অন্য কেউ তোর এটেনশন নেওয়ার অধিকার নিয়ে জন্মায় নি। বুঝলি?”
অরুণিকা মাথা নাড়লো। পরদিন নোমানের বাবা-মার নম্বর সংগ্রহ করে আহনাফ সোজাসুজি তাদের কাছেই অভিযোগ দিলো। অরুণিকা এসব দেখে বলল, “ওকে যদি মারে?”
আহনাফ মুখ বাঁকিয়ে বলল, “তোর এতো দরদ বেয়ে বেয়ে পড়ছে কেন? মারলে মারুক, তোর কি?”
অরুণিকা আহনাফের দিকে তাকিয়ে রইলো। আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কিছু বলবি?”
অরুণিকা মৃদু হেসে বলল, “তুমি অনেক ভালো। ঠান্ডা মাথায় ভেবে বুঝলাম, তোমার জায়গায় যদি আজ বাবা থাকতো, আমাকে হয়তো এভাবেই বুঝাতো।”
সেদিনের পর অরুণিকার মন জুড়ে তার বাবার পর একমাত্র অভিভাবকের জায়গা করে নিলো আহনাফ। সে নিজেও আহনাফ আর তার বিয়েটা পুরোপুরি মেনে নিয়েছে। অল্প বয়সী হওয়ায় আবেগে আহনাফের ভালোবাসায় সিক্ত হওয়ার তীব্র আকাঙ্খা চড়ে বসেছিল তার মাথায়। বয়ঃসন্ধির সময়টাই এমন। হরমোনের প্রভাবে মেয়েরা ছেলেদের প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে। তার উপর আহনাফ তাকে ভালোবাসে। এমনকি সে আহনাফের বৈধ স্ত্রীও। কিন্তু আহনাফের সেদিকে কোনো হেলদোল নেই। সে কোনোভাবেই বন্ধুত্বের সীমা অতিক্রম করছে না। আর এদিকে অরুণিকার ভালো লাগা বাড়তেই লাগলো। এর কিছুদিন পর মোটর সাইকেল চালাতে গিয়ে গাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়ে আহনাফকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হলো। অরুণিকা আহনাফকে দেখতে এসে অস্থির হয়ে যাচ্ছিল। আহনাফের ব্যথায়, সে নিজেই কুঁকড়ে যাচ্ছে। আহনাফ অরুণিকার এমন ব্যবহার দেখে তার মাথায় গাট্টা মেরে বলল, “এমন করছিস কেন?”
অরুণিকা অশ্রুসিক্ত চোখে আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলল, “আই হেইট রাস্তা-ঘাট, গাড়ি-ঘোড়া।”
আহনাফ হেসে বলল, “ঘরে বসে থাকবো না-কি?”
“দরকার হলে ঘরেই থাকবে। তবুও নো ঘরের বাইরে।
“হঠাৎ আমার জন্য তোর এতো চিন্তা!”
অরুণিকা লাজুক হেসে বলল, “আমি ইউর ওয়াইফ। এজন্য।”
আহনাফ ফোঁসফোঁস করে বলল, “এই তোর ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বন্ধ কর তো।”
“তুমিই তো পড়ো ইংরেজিতে। আমিও তাই শিখছি। ক্লাসে তো ওভাবে ইংরেজিতে কথা বলে না। তাই আমি স্পিডে বলতে পারি না।”
“যা, আমিই তোকে শেখাবো।”
“সত্যিই?”
আহনাফ মাথা নাড়লো। অরুণিকা উৎসুক কন্ঠে বলল, “তাহলে শেখাও।”
“এখন?”
“তো!”
“এখন দেখছি মরে গেলেও কবর থেকে উঠে এসে ইংরেজি শেখাতে হবে!”
“তুমি আমার ইংরেজি টিচার হবে, এটা তো আমার ড্রিম। তোমাকে মরতে দেবো না আমি। টিচার না হওয়া অব্ধি তোমার নো ডাই।”
আহনাফ শব্দ করে হাসলো। বলল, “কান্ট ডাই। নো হবে না। বলবি, ইউ কান্ট ডাই।”
অরুণিকাও মুখে মুখে বলল, “ইউ কান্ট ডাই।”
আহনাফ বুকে হাত রেখে মৃদু হেসে ‘উফ’ শব্দ করে উঠলো। অরুণিকা ব্যস্ত কন্ঠে বললো, “কি হলো, ইউ ডাই ডাই?”
আহনাফ মুখ চেপে হেসে বলল, “তোর ইংরেজি শুনে ভেরি সুন ডাই।”
অরুণিকা মুখ বাঁকিয়ে বলল, “হুহ, দেখিও একদিন খুব স্পিডে বলবো। তখন হাঁ করে দেখবে।”
“স্পিড না। ফ্লুয়েন্টলি।”
“হইছে এককথা। তুমি বুঝলেই হবে। আগে বলো, বুকে হাত দিলে কেন? বুকেও ব্যথা পেয়েছিলে?”
আহনাফ অরুণিকার গালে হাত রেখে বলল, “তোর মুখে বেঁচে থাকার কথা শুনে মনে হয়েছিল, আজ আমার বেঁচে যাওয়াটা যেন স্বার্থক। এভাবেই ভালোবাসিস আমাকে, অরু। আমি বারবার বেঁচে ফিরে তোর কাছেই আসতে চাই।”
আহনাফ থুতনিতে ওষুধ লাগাতে লাগাতে অতীতের স্মৃতিই মনে করছিল। তার চোখ দু’টি লাল হয়ে আছে। কেবিন রুমে কাউকে ঢুকতে দেয় নি সে। ওষুধ লাগানো শেষে চেয়ারে বসে পড়লো নিঃশব্দে। মিনিট খানিক স্থির হয়ে বসে রইল সে। বুকে অসহ্য ব্যথা করতে লাগলো। ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বের করলো আহনাফ। পরক্ষণেই সেটি ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেললো। মাথাটা টেবিলের উপর ফেলে দিল সে। শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো চেয়ারের হাতল। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যর্থ চেষ্টা করে হেরে গেল আহনাফ। সে দ্রুত প্যাকেটটি হাতে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল।
(***)
আরাফ আর তাহমিদ মিসেস তাওসিফের মুখোমুখি বসে আছে। তাহমিদ মায়ের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মিসেস তাওসিফ বললেন, “এতোদিনে সময় হলো তোর?”
“মা, আরাফ সময় বের করতে পারছিল না। কিন্তু হয়েছে কি? এভাবে এখানে ডাকলে কেন?”
আরাফ বলল, “সরি, চাচী। একটু ব্যস্ত ছিলাম। গুরুতর কিছু কি?”
মিসেস তাওসিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “আহনাফ তোমাদের সাথেই থাকে, অথচ তোমরা জানোই না ওর কি অবস্থা! ওর সাথে কি হচ্ছে?”
আরাফ আর তাহমিদ একে-অপরের দিকে তাকালো। মিসেস তাওসিফ কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললেন, “ভেবেছি, তোমাদের কাছ থেকেই শুনতে পারবো সব। আহনাফের সাথে এক বাসায় থাকলে তোমরা ঠিকই সব বের করে ফেলবে। কিন্তু তোমরা তো কিছুই করতে পারছো না আহনাফের জন্য। আর অরুর সাথে যা হচ্ছে, তা দেখার পর আমিও আর চুপ থাকতে পারছি না।”
তাহমিদ চিন্তিত সুরে বলল, “কি হয়েছে, বলো?”
“আহনাফ ড্রাগ এডিক্টেট।”
আরাফ আর তাহমিদ বিষ্ময়ভরা দৃষ্টিতে মিসেস তাওসিফের দিকে তাকিয়ে আছে। মিসেস তাওসিফ ক্ষীণ কন্ঠে বললেন, “তোমরা কি বুঝলে না?”
আরাফ কপাল চেপে বসে রইলো। তাহমিদ ক্ষীণ স্বরে বলল, “ও একটু এগ্রেসিভ হয়ে গেছে। কিন্তু ড্রাগ নিচ্ছে তো মনে হয় নি।”
“ও নিজেই জানে না ও ড্রাগ নিচ্ছে।”
আরাফ চমকে তাকালো মিসেস তাওসিফের দিকে। জিজ্ঞেস করলো, “ও জানে না মানে?”
মিসেস তাওসিফ হতাশ কন্ঠে বললেন, “জানি না আবরারের মৃত্যুর পেছনে কে দায়ী! কিন্তু আমারও মাঝে মাঝে মনে হয়, অরু আবরারকে ছাদ থেকে ফেলে দেয় নি। এখানে অন্য কোনো রহস্য আছে। মাঝে মাঝে শিরিনকে আমার সন্দেহ হয়। আবার মাঝে মাঝে আমির ভাইকে। আমি সত্যিটা জানি না। তাই এখানে আমার কিছু বলা ঠিক হবে না। কিন্তু আহনাফ আবরারের মৃত্যুর পর অনেক ভেঙে পড়েছিল। ভাইয়ের লাশ দেখে ভেঙে পড়া স্বাভাবিক। কিন্তু অরুণিকা যখন কেঁদে কেঁদে সবাইকে বলছিল, ও কিছু করে নি, আহনাফ ওকে ক্ষমা করে দিয়েছিল।”
তাহমিদ বলল, “মা এটা ওর অভিনয় ছিল। অরুর কাছ থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য…”
তাহমিদকে থামিয়ে দিয়ে মিসেস তাওসিফ বললেন, “না, আহনাফ শিরিনকে সত্যটা বোঝাতে চেয়েছিল। অরু এমন কিছু করবে এটা তো আহনাফ বিশ্বাসই করতে পারে নি। কিন্তু শিরিনই অরুর নামে অনেক মিথ্যে কথা বলে আহনাফকে ওর বিরুদ্ধে করেছিল। সিসিটিভি ফুটেজে যেই ভিডিও ধরা পড়েছিল, এসবে অরুণিকারও খুব একটা দোষ নেই। আবরার অসুস্থ ছিল। শিরিন যা শিখিয়ে দিতো, ও তাই করতো। জুবাইয়ের ভাই আর নীহারিকা ভাবীর মৃত্যুর পর অরুণিকা তো আহনাফদের বাসায় থাকা শুরু করেছিল। সেই সময় শিরিন আবরারের রুমে অনেক কৌশলে অরুণিকাকে পাঠাতো। কারণ ওই রুমেই ক্যামেরা লাগানো ছিল। এরপর শিরিন আবরারকে শিখিয়ে দিতো অরুকে বিরক্ত করার জন্য। আর আবরার তাই করতো। আর অরুণিকা বিরক্ত হয়ে আবরারের গায়ে হাত তুলতো। আমি নিজ চোখে দেখেছি, কয়েক মাসে অরুকে কীভাবে বিরক্ত করে ফেলেছিল আবরার। শিরিনের তো কোনো লজ্জা নেই। সে তো অসুস্থ ছেলেকে বাজে ইঙ্গিত শিখিয়ে দিতো। অরুও খুব রেগে গিয়েছিল আবরারের উপর। এখন এটা কি অরুর উপর মিথ্যে অপবাদ চাপিয়ে দেওয়ার পূর্ব প্রস্তুতি ছিল কি-না সেটাই বুঝতে পারছি না।”
তাহমিদ শক্ত কন্ঠে বলল, “তুমি পাঁচ বছর ধরে চুপ ছিলে কেন, মা? আমাদের আগে জানাও নি কেন এটা?”
মিসেস তাওসিফ চুপ করে রইলেন। তাহমিদ উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়তেই আরাফ তাকে টেনে বসালো। ইশারায় শান্ত থাকতে বললো। এরপর চাচীর দিকে তাকিয়ে আরাফ জিজ্ঞেস করলো, “আহনাফ ড্রাগ নিচ্ছে এটা আপনি কীভাবে জানলেন?”
“কারণ আহনাফকে ড্রাগস শিরিন দিচ্ছে।”
আরাফ আর তাহমিদ আরেক দফা অবাক হলো। মিসেস তাওসিফ বললেন, “শুধু ড্রাগস না। ওর উপর ব্ল্যাক ম্যাজিকও করছে।”
তাহমিদ হতবাক হয়ে বলল, “ইম্পসিবল।”
“এটাই সত্য। আমি নিজেও প্রথমে বুঝতে পারি নি। ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম। আহনাফ অরুণিকাকে যখন অন্ধ বিশ্বাস করছিল, শিরিন তখনই এই উপায়টা বের করে। আমি চুপচাপ থাকি, তাই শিরিন আমাকে অনেকবার ইঙ্গিত দিয়েছিল। ও জানে, তোমার বাবা, তোমার চাচারা আমাকে বিশ্বাস করবে না। শিরিনকে সবাই অনেক পছন্দ করে। অনেক বিশ্বাস করে। আর এমন কাজ একটা মা তার ছেলের সাথে করবে, এটা কি বিশ্বাস করার মতো? আমি তো দেখেও বিশ্বাস করি নি। ব্ল্যাক ম্যাজিকের কোনো ফলাফল আসে, তাও আমি বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু অরুণিকার চুল কেঁটে দেওয়ার পর আমার মনে হচ্ছে, আহনাফের উপর সত্যিই ব্ল্যাক ম্যাজিক করা হয়েছে। আর ড্রাগের ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। একদিন শিরিন আমার সাথে কথা বলতে এসে ভুলে তার ফোন আমার রুমে ফেলে গিয়েছিল। তখনই একটা উদ্ভট মেসেজ দেখে আমি একটা চ্যাটে ঢুকে সত্যটা জানতে পারি। শিরিন ডাক্তারের সাথে কথা বলে সেই ড্রাগ আহনাফকে দিয়েছে। আহনাফ ভাবছে, এটা ওর রাগ নিয়ন্ত্রণ করবে। ওর মনের দুঃখ কমাবে। কিন্তু না। এটা ওকে আরো এগ্রেসিভ করে তুলছে। আমি ওষুধগুলোর নামও নিয়ে এসেছি।”
মিসেস তাওসিফ ব্যাগ থেকে কাগজ বের করে আরাফকে দিলেন। আরাফ নাম থেকে অবাক হয়ে বলল, “এটা তো খুব পাওয়ারফুল।”
তাহমিদ জিজ্ঞেস করলো, “কি হয় এটা খেলে?”
আরাফ চাপা স্বরে বলল, “সেক্সচুয়াল ইম্পালস বাড়ায়। শুধু বাড়ায় না, মাত্রাতিরিক্ত বাড়ায়। এটা প্রোস্টিটিউডরা নেয়। ছোট চাচী এমন জঘন্য কাজ করতে পারে, আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না। আর এটা খেলে আসলেই আহনাফের মাথা ঠিক থাকার কথা না। ওকে সহজেই ম্যানিপুলেট করা যাবে। ও নিজের ব্রেইন দিয়ে চিন্তাভাবনা করতে পারবে না। অন্যের কথায় সহজেই ম্যানিপুলেট হয়ে যাবে।”
তাহমিদ বলল, “ও একটা ভার্সিটির লেকচারার। কীভাবে ম্যানেজ করছে ও নিজেকে? আর নিজেকে ফিজিক্যালি নিয়ন্ত্রণ করছে কীভাবে? আমার মনে হচ্ছে খুব বাজে কিছু হচ্ছে আহনাফের সাথে। নামাজও ছেড়ে দিয়েছে ও।”
“হুম, দ্রুত এটা বাসার সবাইকে জানাতে হবে। ওকে রিহাবে পাঠাতে হবে।”
“চাচী জেদের বশে ওর ভবিষ্যৎ নষ্ট করে ফেলছে। অরুণিকা এসব জানলে কি ভাববে? কীভাবে নিবে বিষয়টা? অনেক সাংঘাতিক খবর এটা। আমরা বাকিদের কীভাবে বলবো? আহনাফকে কীভাবে ওখান থেকে ফিরিয়ে আনবো?”
আরাফ মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। চোখ লাল হয়ে গেছে তার। মিসেস তাওসিফ বললেন, “আমি যে তোমাদের এই কথা বলেছি, এটা দয়া করে কাউকে বলো না। তোমরা নিজেরাই ড্রাগসগুলো খুঁজে পাও কি-না দেখো। ওকে হাতে-নাতে ধরো। ওর চিকিৎসা শুরু করো। আমি এখন আসি।”
এই বলে মিসেস তাওসিফ উঠে চলে গেলেন। আরাফ শক্ত কন্ঠে বলল, “আমার হাসিখুশি থাকা ভাইটাকে তিলে তিলে শেষ করে দিয়েছে ওই মহিলা। আমার বোনের জীবনটা এলোমেলো করে দিয়েছে ওই মহিলা। আহনাফকে আয়না দেখাতে হবে। এটাও বের করতে হবে, আবরারের মৃত্যুর রহস্য কি!”
তাহমিদ আরাফের কাঁধে হাত রেখে বলল, “আমি তোর সাথে আছি।”
এদিকে আহনাফ দেয়ালে হেলান দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। চোখ দু’টি লাল হয়ে গেছে তার। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মুখ দেখে বেসিনে জোরে একটা ঘুষি মারলো। হাত টনটনিয়ে উঠলো তার। হাতের দিকে তাকিয়ে মেঝেতে বসে মুখে গুঁজে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে সে। নিজেকে আঁটকাতে না পেরে নিজের হাত কামড়ে ধরলো আহনাফ। তখনই ফোন বেজে উঠলো। সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালো সে। মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে কাঁপা হাতে রুমাল দিয়ে মুখ মুছে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলো আরাফের কল। কলটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আরাফ বলল, “কেমন আছিস, আহু?”
আহনাফ আরাফের কণ্ঠ শুনে ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তার চোখ বেয়ে উষ্ণ জল গড়িয়ে পড়তেই সে শার্টের হাতায় চোখ মুছে বলল, “আমার কি হবে? ভালোই আছি।”
“ক্যাম্পাসে?”
“হ্যাঁ।”
“ছুটি নিতে পারবি?”
আহনাফ যেন এমনই আবদারের অপেক্ষায় ছিল। ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “তোর সময় আছে!”
“অনেক সময়।”
“আমি আসছি।”
আহনাফ আবার ওয়াশরুমে ঢুকলো। মুখে ভালোভাবে পানির ঝাপটা দিলো। পকেটে থাকা খালি প্যাকেটটিতে লাইটার দিয়ে আগুন ধরিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিল। এরপর বেরিয়ে গেল রুম থেকে। তূর্য আর ইভান তার রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। আহনাফকে দেখে তূর্য তার থুতনি ধরে বলল, “তুই ঠিক আছিস!”
আহনাফ বলল,
“আরাফ যেতে বলেছে। আমি ছুটি নিচ্ছি আজকে। ক্লাস নিতে পারবো না।”
আহনাফ এই বলে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলো। তখনই অরুণিকার মুখোমুখি হলো সে। অরুণিকা কঠিন দৃষ্টিতে তাকালো আহনাফের দিকে। আহনাফ সেই কঠিন চোখ জোড়ার দিকে তাকিয়ে শুকনো হেসে নিচে নেমে পড়লো। অরুণিকাও সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল।
চলবে-