উইন্টার এন্ড মাই সনেট পর্ব-৩৩+৩৪

0
11

#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-৩৩ ||

আহনাফকে নিয়ে আরাফ আর তাহমিদ দীর্ঘ বাইক রাইডে বের হলো। আহনাফ ক্যাম্পাস থেকে বাসায় গিয়ে তার মোটর সাইকেল নিয়েই বের হয়ে আরাফের বলা স্থানে চলে গিয়েছিল। সেখান থেকেই তিন জনের বাইক রাইড শুরু হলো। বেলা বারোটা। সূর্যের প্রখরতা ছড়িয়ে পড়েছে চতুর্দিকে। সাথে যুক্ত হয়েছে মাতাল হাওয়া। বাইকের গতি বৃদ্ধির সাথে সাথে সেই সমীরণ উন্মাদ আকার ধারণ করছে। বাতাবরণে ছড়িয়ে পড়েছে নবীন স্পন্দন। পাঁচ বছর পর আহনাফ আবার প্রকৃতির সন্নিকটে আসছে। এই পাঁচ বছরে এমন দীর্ঘ বাইক রাইড দিয়েছে কি-না আহনাফের মনে পড়ছে না।

ফাঁকা সরু পিচঢালা পথে ইঞ্জিনের ব্রুং ব্রুং শব্দের সাথে মিশে যাচ্ছে তিন পুরুষের জোরালো হাসির শব্দ, একে অপরের সাথে করা ঠাট্টা-কৌতুক। হাওয়ার তালে বহু মাস পর মিশে যাচ্ছিলো আত্মিক সম্পর্কের উষ্ণতা।

তাহমিদ আহনাফের পাশাপাশি মোটর সাইকেল চালাতে চালাতে হেলমেটের গ্লাস তুলে দিয়ে আহনাফকে জিজ্ঞেস করলো, “কেমন লাগছে তোর?”

বাতাসের তীব্রতার জন্য তারা উঁচু গলায় কথা বলছে। আহনাফ উত্তরে বলল, “তোরা দু’জন একটু পরপর আমাকে এই প্রশ্ন কেন করছিস?”

“তুই যে আমাদের ভুলে যাচ্ছিস! তাই বারবার জিজ্ঞেস করছি। এতোদিন পর আমরা পুরোনো দিন তাজা করছি, জিজ্ঞেস করবো না কেমন লাগছে?”

“ভালোই লাগছে। আমার তো প্রতিদিনই রঙিন। এই মুহূর্তে তো সব রঙিন লাগছে। মনে হচ্ছে সামনেই আকাশের সব তারা কষে পড়ছে। দেখ।”

তাহমিদ ভ্রূ কুঁচকে তাকালো আহনাফের দিকে। আহনাফ হেসে বলল, “সামনে তাকিয়ে চালা। আমার দিকে কি দেখছিস?”

এই বলে আহনাফ মোটরসাইকেলের গতি বাড়িয়ে আরো আগে চলে গেল। আরাফ আহনাফকে এভাবে সামনে চলে যেতে দেখে নিজেও গতি বাড়ালো। তাহমিদের কাছাকাছি আসতেই সে আরাফকে বলল, “আহনাফকে থামা গিয়ে। আমার মনে হচ্ছে ও ঘন্টাখানেকের ভেতর ড্রাগস নিয়েছি। কথাবার্তা বেশ এলোমেলো।”

দু’জনই এবার গতি বাড়ালো। আহনাফের মোটর সাইকেলের গতি যেন বেড়েই যাচ্ছে। আরাফ চিৎকার করে বলল, “আহু, থাম। এভাবে স্পিড বাড়াচ্ছিস কেন?”

তাহমিদ উঁচু গলায় বলল, “আহনাফ, দাঁড়া।”

এদিকে আহনাফের চোখ দু’টি লাল হয়ে গেছে। তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো অরুণিকার কঠিন চাহনি। ঠোঁট কামড়ে ধরলো আহনাফ। উষ্ণ জল গড়িয়ে পড়লো তার চোখ বেয়ে। হঠাৎই তার মাথা ঘুরে উঠলো। দ্রুতই গতি কমাতে লাগলো সে। ধীরে ধীরে চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে তার। মনে হচ্ছে মুহূর্তেই অন্ধকার নেমেছে। হঠাৎ ভারসাম্য হারাতেই মোটর সাইকেলসহ উল্টে অনেকদূর গিয়ে ছিঁটকে পড়লো আহনাফ। এমন দৃশ্য দেখে আরাফ এবং তাহমিদের বুক কেঁপে উঠলো। গতি আরো বাড়িয়ে আহনাফের সামনে এসে মোটর সাইকেল থামালো। ভাগ্যিস, সেই মুহূর্তে আগেপাছে অন্য গাড়ি ছিল না। আর এই রাস্তায় বড় গাড়ির আসা যাওয়াও তেমন নেই।

আরাফ ও তাহমিদ আহনাফকে ধরে বসালো। আহনাফ মোটা গ্লাভস, জ্যাকেট ও হেলমেট পরাই খুব গভীর আঘাত পায় নি। কিন্তু সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না সে। আরাফ রাগী স্বরে বলল, “তোর মাথা ঠিক আছে?”

আহনাফ আরাফের হাত ধরে বলল, “ও আমাকে অনেক ঘৃণা করে, আরাফ। আমি মরে গেলেও ওর কিছুই আসে যায় না।”

আরাফ আর তাহমিদ একে-অপরের দিকে তাকালো। আহনাফ ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “আমিও তো ঘৃণা করি। ও আমার শত্রু। আমার ভাইয়ের খুনী।”

তাহমিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তোর মস্তিষ্কে এই একটা বাক্য গেঁথে গেছে। এটা আগে মাথা থেকে বের কর। সোজা হয়ে দাঁড়া। সবুজ বনের দিকে শান্ত হয়ে মিনিট খানিক তাকিয়ে থাক। বিলিভ মি, তুই অনেক কিছু রিয়েলাইজ করবি।”

আরাফ আর তাহমিদ আহনাফকে উঠিয়ে ঘাসের উপর বসালো। আরাফ আহনাফের মোটরসাইকেল দাঁড় করাতে করাতে বলল, “গেল তোর বাইক। আমি গ্যারেজে কল দিচ্ছি। এটা আর চালাতে পারবি না। নিয়ে যেতে হবে।”

তাহমিদ বলল, “তোর পা ঠিক আছে? কোথাও ব্যথা পেয়েছিস?”

“এতো জোরে পড়লি হাত-পা তো নিশ্চিত ভেঙেছে।”

আহনাফ বলল, “আমার কোথাও ব্যথা করছে না। আই এম ওকে। আমার মনে যে টর্নেডোর আঘাত লেগেছে, ওটা থেকেই এখনো সেরে উঠতে পারি নি।”

এবার আরাফ আর তাহমিদ দু’জন আহনাফের দু’পাশে এসে বসলো। আরাফ বলল, “সবুজের দিকে তাকিয়ে থাকলে মানসিক চাপ কমে যায়। তুই কিছুক্ষণ ওদিকে তাকিয়ে দেখ। একটু রিল্যাক্স হো।”

আহনাফ ক্ষীণ হেসে বলল, “আমার সমস্যার সমাধান ওখানে নেই।”

“কি চাস তুই?”

“অরুকে চাই।”

তাহমিদ বলল, “ও তো তোর ছিল। এখনো আছে। কিন্তু তুই নিজেই ওকে ধরে রাখতে পারছিস না।”

“এখন আর আমার নেই। সেই মায়া, সেই ভালোবাসা ওর চোখে আমি আর খুঁজে পাই না।”

“এটার জন্য তো তুই নিজেই দায়ী। ওকে কষ্ট কি কম দিয়েছিস!”

“আমি ইচ্ছে করে দেই নি। মাঝে মাঝে কি হয়ে যায় আমার, আমি নিজেও নিজেকে চিনতে পারি না।”

“তুই কি কোনো ডিপ্রেশনের ওষুধ খাচ্ছিস?”

আহনাফ চমকে উঠলো তাহমিদের প্রশ্নে। তাহমিদ আঁড়চোখে আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলল, “অনেকেই তো ট্রমাতে থাকলে ডিপ্রেশনের ওষুধ খায়। এটা কিন্তু অনেক ডেঞ্জারাস। মানুষের চিন্তা শক্তিকে দুর্বল করে দেয় এসব মেডিসিন।”

আহনাফ হঠাৎ ক্ষেপে উঠলো। হুট করে দাঁড়াতে গিয়ে পায়ের ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো সে। আরাফ তাকে ধরে বলল, “কি হলো হঠাৎ?”

আহনাফ চেঁচিয়ে বলল, “ও কি ডাক্তার? ও কি বেশি জানে!”

আরাফ ইশারায় তাহমিদকে চুপ থাকতে বলল। আর আহনাফকে বলল, “তাহমিদের কথাটা কিন্তু ভুল না।”

আহনাফ আরাফকে সরিয়ে দিয়ে বলল, “তুই চুপ থাক। তুই কি নিউরোলজিস্ট? আর এখনো ডাক্তারি পড়া শেষ হয় নি তোর। তাই আমাকে জ্ঞান দিবি না।”

আরাফ হালকা হেসে বলল, “রেগে যাচ্ছিস কেন? তুই তো আর খাচ্ছিস না যে রেগে উত্তর দিচ্ছিস। তাহমিদ জাস্ট তোকে জিজ্ঞেস করেছে। তুই না খেলে না বলবি। আর ওষুধের কথা বলায় এমন উগ্র আচরণ করছিস কেন? তুই কোনো ওষুধে আসক্ত হোস নি তো আবার!”

আহনাফ আরাফের দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “আমি বাসায় যাবো।”

আরাফ তাহমিদকে বলল, “আমি আহনাফকে নিয়ে যাচ্ছি। ওর বাইক নেওয়ার জন্য গাড়ি আসবে। তুই গ্যারেজের লোকটাকে সব বুঝিয়ে দিয়ে আসিস।”

এই বলে আরাফ আহনাফকে নিয়ে চলে গেল। তারা যেতেই তাহমিদ তার পরিচিত এক সাইকায়াট্রিস্টকে কল করে আহনাফের ব্যাপারে বলল। তিনি বললেন, “তোমার কাজিন জানেই না যে সে যেই ওষুধগুলো নিচ্ছে ওসব ডিপ্রেশনের না, একপ্রকার হার্মফুল এন্ড পাওয়ারফুল ড্রাগস। আমি এই মুহূর্তে ওর কোনো হ্যাল্প করতে পারবো না। হ্যাল্প তোমরাই করতে পারবে। পেশেন্টকে বিশ্বাস করতে হবে, সে যেই ওষুধ খাচ্ছে ওগুলা ড্রাগস। ওসব খেলে ওর মানসিক আর শারীরিক সমস্যা হবে। যে এই ওষুধগুলো তাকে দিয়েছে তার প্রতি অন্ধবিশ্বাস ভাঙাতে হবে। তুমি বললে, এই কাজ তার মা করেছে। তাহলে সে তার মায়ের চেয়ে বেশি তোমাকে কেন বিশ্বাস করবে? তুমি আগে ওর বিশ্বাস অর্জন করো। ওর মা যে অন্যায় করছে, এটা ওর সামনে প্রকাশ করো। যদি ও বিশ্বাস করতে পারে, তবেই ওর ট্রিটমেন্ট সহজ হবে। কারণ পেশেন্ট নিজে নিজে ড্রাগস নেয় নি। তাকে ডিপ্রেশনের ওষুধ বলে এসব খাওয়ানো হচ্ছে। আর এসব খেয়ে সে ক্ষণিকের জন্য শারীরিক ও মানসিক শান্তি পাচ্ছে। তাহলে সে তোমার কথা কেন বিশ্বাস করবে?”

“আর যদি তাকে বিশ্বাস করাতে পারি?”

“রিহাবে ভর্তি করানো সবচেয়ে উপযুক্ত হবে। ওখানে ওর কাউন্সিলিং হবে। ওরাই ওকে সুস্থ করে বের করবে। এরপর তুমি সাইকায়াট্রিস্ট দেখাতে পারো। যেই ডিপ্রেশনের জন্য ওর এই অবস্থা, ওগুলো সমাধান করতে হবে। পাঁচ বছর ধরে ড্রাগস নিচ্ছে, ইটস নট নরমাল। যা করার তাড়াতাড়ি করো। নয়তো ওর বড় কোনো শারীরিক জটিলতা দেখা গেলে, আর কিছুই করার থাকবে না।”

(***)

সাল ২০১৭। শ্রাবণের ফকফকা প্রভাত। বারিধারার ছাপ রাস্তায় স্পষ্ট। টানা দু’দিন মুষলধারে বৃষ্টিপাতের পর গতকাল দিবাকর দৃশ্যমান হলো। চারপাশে নবীনতার ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছে। আর সেই নবীন প্রকৃতির সৌন্দর্যকে উপভোগ করতে ছ’জন যুবক তাদের নিজেদের মোটর সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। গন্তব্য গুলিয়াখালী সমুদ্রসৈকত। তাদের সামনে অনেক ধাপাধাপির পর অরুণিকাও নিজের যাওয়া নিশ্চিত করতে পারলো। চৌধুরী ম্যানশনে খবর পৌঁছে গেছে, ছ’জন সকাল সকাল ঘুরতে বেরুবে। কিন্তু অরুণিকাকে নিয়ে যাবে এটা কেউ জানতো না। অরুণিকা সকালের নাস্তা করেই তার পছন্দের সাদা টপস পরে, চুলে বেনী করে, তার ছোট কার্টুন ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে আহনাফের মোটর সাইকেলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে রইলো। আহনাফ নিচে নামার আগেই তূর্য এসে অরুণিকাকে তার সাথে উঠিয়ে নিলো। আহনাফ নামতেই তূর্যের কাঁধ আঁকড়ে ধরে অরুণিকাকে বসে থাকতে দেখে ভ্রূ কুঁচকে বললো, “অরু, আমার বাইকে উঠে বস।”

তূর্য চোখ ছোট করে তাকালো আহনাফের দিকে। অরুণিকা লাফিয়ে নেমে আহনাফের কাছে চলে এলো। আহনাফের সব কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে সে। তা দেখে তূর্য বলল, “ওভার পজিজিভ।”

“মোর কান্তার আশ্রয়ের কাঁধ একমাত্র আমিই।
তুমি কোন সর্বনাশা যুবক হে?”

তূর্য মোটর সাইকেল স্টার্ট দিতে দিতে গাইতে লাগলো,
“আমার, সোনার ময়না পাখি
কোন দেশেতে গেলা উইড়া রে….এ..
দিয়া মোরে ফাঁকি রে
আমার সোনার ময়না পাখি।”

আহনাফ চোখ ছোট করে তাকিয়ে রইলো তূর্যের দিকে। তূর্য মোটর সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়তেই বাকি পাঁচজনও তার পিছু পিছু বেরিয়ে গেল। কিছু সময়ের গম্ভীরতা কাটিয়ে তারা মুহূর্তেই হারিয়ে গেল আমোদ-ফূর্তিতে। মোটর সাইকেলের ব্রুং ব্রুং শব্দের সাথে তাদের অট্টহাসিতে মুখরিত হয়ে পড়েছিল সেদিনের আকাশ।

অরুণিকা আহনাফের কাঁধ শক্ত করে ধরে আছে। আহনাফ হঠাৎ অরুণিকার হাত ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে এনে হাতটি তার বুকের সাথে বেঁধে রাখতে বলল। এমন আবদার শুনে অরুণিকা লজ্জায় নুইয়ে পড়ার অবস্থা। সে অবচেতন মনেই আহনাফের পিঠে নাক ঘষতে লাগলো। আহনাফ বুঝতে পেরে মৃদু হাসলো। অরুণিকা আবার হাত কাঁধের উপর রাখতেই, আহনাফ সেই হাত টেনে আবার নিজের বুকের উপর বাঁধতে বললো। অরুণিকার আবেগী মন তখন আকাশে ডানা মেলে উড়ছে। সে খুশিতে আত্মহারা, কিন্তু লজ্জায় প্রকাশ করতে পারছে না কিছুই। শুধু আহনাফের পিঠে নাক ঘষছে। আহনাফ পিঠে অরুণিকার স্পর্শ অনুভব করে ঠোঁট কামড়ে হাসছে আর মোটর সাইকেল চালাচ্ছে।

তারা পৌঁছে গেল গুলিয়াখালী৷ পুরো সকাল সেখানেই কাটালো তারা। বেলা বাড়ার পর কিছু কলেজ পড়ুয়া মেয়ে সেখানে ঘুর‍তে এলো। তাদের হাবভাবে বোঝা যাচ্ছে, তারা বেশ অভদ্র। আচার-ব্যবহারেও অশালীনতা স্পষ্ট ফুটে উঠছে। ছ’জন সুদর্শন যুবক দেখে তাদের হাসাহাসি যেন আরো বেড়েই গেল। তাদের দৃষ্টি একটু পরপর ছ’যুবকের দিকেই আটকাচ্ছে। তূর্য আর ইমন শার্ট খুলে পানিতে নেমেছিল। তারা এখন নগ্ন গায়ে বসে আছে। মেয়েগুলো নিজেদের মধ্যেই কিছু বলাবলি করছে। তাহমিদ এই নিয়ে দুই-তিনটা ডাব শেষ করে ফেলেছে। ইভান গম্ভীরমুখে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ দেখছে। আর আহনাফ বালির উপর শুয়ে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে আছে। অন্যদিকে আরাফ অরুণিকার ছবি উঠিয়ে দিতে ব্যস্ত। তাদের ব্যস্ততার মাঝেই একটা মেয়ে এগিয়ে এলো তূর্য আর ইমনের দিকে। দূর থেকে মেয়েটাকে দেখে ইভান ভ্রূ কুঁচকে বলল, “ওই ছাপড়িগুলো ঘুরেফিরে ওই দিকে যাচ্ছে কেন? এখন কিছু হলেই ন্যাকা কান্না জুড়িয়ে দিয়ে বলবে, বাঁচাও, বাঁচাও, দুইটা ছেলে আমার দিকে তাকিয়েছে। আর ওই বদ দুইটা খালি গায়ে বসে আছে কেন? এটাকে কি ওদের বাপের বীচ না-কি!”

আহনাফ ইভানের কথা শুনে হেসে বলল, “তূর্য হয়তো খেয়ালই করে নি। নয়তো ও আবার বসে থাকার মানুষ!”

আহনাফ বলতে না বলতেই তূর্য পাশ ফিরে তাকিয়ে মেয়েটাকে দেখে ইমনকে বলল, “দেখ, কীভাবে গিলে খাচ্ছে। বেডা দেখে নাই আগে।”

ইমন বলল, “যা, গিয়ে পটা।”

“নো ম্যান, আমার স্ট্যান্ডার্ড হতো লো না। যারা পটে আছে, তূর্য তাদের দুই পয়সার দামও দেই না। ভাব মারা মেয়েগুলোই তূর্যের পছন্দের।”

মেয়েগুলোর মধ্যে একজন অরুণিকার দিকে এগিয়ে আসতেই আরাফ ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। বাকিরা গভীর মনোযোগ দিয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছে। অরুণিকাকে সেই মেয়েটি জিজ্ঞেস করলো, “তোমরা কোথা থেকে এসেছো?”

অরুণিকা কিছু একটা ভেবে বলল, “বাসা থেকেই তো আসে সবাই।”

“বাসাটা কোথায়?”

“চাঁদগাঁও।”

“ওরা তোমার বন্ধু?”

অরুণিকা আরাফের দিকে তাকালো। ইমন তূর্যকে বলল, “আমাদের দেখিয়ে দেখিয়ে কি জিজ্ঞেস করছে?”

“তুই গিয়ে জিজ্ঞেস করে আয়।”

তূর্য গম্ভীরমুখে উত্তর দিলো। এদিকে অরুণিকা মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলো, “কেন?”

“এমনি। ভাই না-কি বন্ধু।”

অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “বলবো না।”

অরুণিকা এরপর আরাফের পাশে চলে গেল। আহনাফ হেসে ইভানকে বলল, “ফিমেইল ইভটিজারও আছে, দেখ।”

……………

পুরোনো অতীত স্মরণ করে বিস্তর হাসলো তূর্য আর ইভান। ক্যাম্পাসে বসে চা খেতে খেতে সেই শ্রাবণ প্রভাতের স্মৃতিচারণ করছিলো তারা। তূর্য বলল, “সেদিন দুপুরে যে ভয়ংকর কান্ড বাঁধিয়েছিল আহনাফ, সেটা মনে পড়লেই আমি ভাষা হারিয়ে ফেলি। সেদিন আহনাফকে প্রথম ওমন হিংস্র হতে দেখেছি।”

(***)

সাল ২০১৭। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর অরুণিকা বীচের পাশে এসে দাঁড়ালো। সে একা এসেই দাঁড়িয়েছে। বাকিরা বেঞ্চে বসে চা খাচ্ছে। হঠাৎ একটা ছেলে কোথা থেকে এসে অরুণিকার পাশে দাঁড়ালো। আহনাফ সেদিকেই তাকিয়ে ছিল। ছেলেটিকে দেখেই সে চা অর্ধ খেয়ে উঠে দাঁড়ালো। আহনাফকে উঠতে দেখে বাকিরা অরুণিকার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালো। এদিকে সেই অপরিচিত ছেলেটি অরুণিকার আরেকটু কাছে এসে দাঁড়ালো। অরুণিকা সেই মুহূর্তে ক্যামেরায় প্রকৃতির চমৎকার রূপ ধারণ করতে ব্যস্ত। সে পাশের ছেলেটিকে খেয়াল করে নি।

হুট করে সেই ছেলে অরুণিকার কোমড়ে হাত রাখলো। মুহূর্তেই অরুণিকা চমকে উঠলো। পাশ ফিরে অপরিচিত এক ছেলেকে দেখতেই তার হাত থেকে ফোন পড়ে গেল। এমন দৃশ্য দেখে আহনাফ “এই” বলে চিৎকার করে উঠলো। সে বালির উপর দৌঁড়ে আসছে। বাকি পাঁচজনও উঠে এলো। তারাও তেড়ে আসতে লাগলো। ছেলেটা আহনাফের চিৎকার শুনেই অরুণিকাকে ছেড়ে দিয়েছে৷ এদিকে আহনাফ অরুণিকার সামনে এসে দাঁড়ালো। অরুণিকা আহনাফকে কাছে পেয়ে শক্ত করে তার শার্ট খামচে ধরলো। এরপর ছেলেটির পেটে সজোরে একটা লাথি মারলো আহনাফ। ছেলেটি পেট ধরে কুঁকড়ে উঠলো। অরুণিকা ভীত দৃষ্টিতে আহনাফের দিকে তাকালো। আহনাফ শান্ত স্বরে বলল, “তুই চুপচাপ ওপাশে গিয়ে বসে থাক।”

এরপর ঝুঁকে নিচে পড়ে থাকা ফোনটা হাতে নিয়ে অরুণিকাকে ধরিয়ে দিয়ে ইশারায় একপাশে বসে থাকতে বললো। অরুণিকা মাথা নেড়ে আহনাফের বলা স্থানে চলে গেল। এবার আহনাফ সামনে তাকালো। ছেলেটি ভয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেল। তার সাঙ্গপাঙ্গরাও আহনাফকে ঘিরে ধরলো। তারা সংখ্যায় মোট পাঁচ জন। তূর্য তখনই পেছন থেকে দু’জনের কাঁধে ভর দিয়ে বলল, “ডনগিরি দেখাতে চাচ্ছিস? শোন, তোরা রাস্তা-ঘাটের ডন হতে পারিস। কিন্তু আমরা ডন-সন না।”

তূর্য ইমনের দিকে তাকাতেই সে বলল, “আমরা সিংহ। আমাদের এলাকায় এলেই খপ করে খেয়ে, এক্কেবারে হাড্ডিও পিস পিস করে ফেলবো।”

অল্প বয়সী হওয়ায় ছেলেগুলো যথেষ্ট ভীত। তবুও তাদের মধ্যে একজন আহনাফকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল, “এই মা** পুত আমার বন্ধুকে….”

আহনাফ ছেলেটাকে এক বাক্যও আর উচ্চারণ করতে দেয় নি। সোজা নাক বরাবর ঘুষি মেরে মাটিতে ফেলে দিল। ছেলেটা নিচে পড়ে যেতেই আহনাফ তার বুকের উপর বসে ইচ্ছেমতো ছেলেটার নাকে ঘুষি মারতে লাগলো। আরাফ আর ইভান আহনাফকে টেনে নামালো। বাকি ছেলেগুলোও চড়াও হতে এলে ইমন আর তূর্য তাদের ধরাশায়ী করে ছাড়লো।

এই মুহূর্তে রাগে শরীর কাঁপছে আহনাফের। সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলল, “আমার মা’কে নিয়ে একটা বাজে কথা বললে গলা কেঁটে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেবো। আমার মা’কে গালি দিলি কোন সাহসে?”

আহনাফ এগিয়ে গিয়ে আরেকটা লাথি মারলো। স্থানীয় লোকজন জমা হতেই অরুণিকার সাথে বাজে আচরণ করার ফলে ছেলেগুলোকে আরো কয়েকটা চড় খেতে হলো। এরপর তাদের ছেড়ে দেওয়া হলো। ছেলেগুলো তৎক্ষণাৎ চলে গেল সেখান থেকে৷ অরুণিকা আহনাফের হাত ধরে বলল, “আমার জন্য তুমি ওই ছেলেটা এভাবে মারলে!”

……………..

তাহমিদ আর আরাফ হাসপাতালের করিডরে দাঁড়িয়ে আছে। আহনাফকে সোজা হাসপাতালেই নিয়ে এসেছে আরাফ। তাহমিদও মোটরসাইকেল বুঝিয়ে দিয়ে সেখানেই এলো। এতোক্ষণ তারা গুলিয়াখালীর অতীতটাই মনে করছিল। তাহমিদ আরাফকে বলল, “সেদিন চাচীকে গালি দেওয়ায় ছেলেটাকে কেমন ভয়ংকর ভাবে মেরেছিল আহনাফ, অথচ আমরা সবাই বিষয়টা খেয়ালও করি নি।”

আরাফ বলল, “আহনাফ ছোট চাচীকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে। যাকে এভাবে বিশ্বাস করে, সেই যদি ক্ষতির কারণ হয়! এখন কীভাবে সব হ্যান্ডেল করবো আমরা? সত্যটা জানতে পারলে আহনাফের কলিজা ছিঁড়ে যাবে।”

“কিন্তু ওকে বিশ্বাস করাতে হবে আগে।”

তাহমিদকে তার স্যার যা যা বলেছে সে আরাফকে বললো সব। আরাফ সব শুনে বলল, “আমাদের এই মুহূর্তে একটাই টার্গেট। উই হ্যাভ টু সেইভ আওয়ার ব্রাদার।”

(***)

ডাক্তার এক্স-রে দিয়েছে। আহনাফ এখনো ঠিকভাবে হাঁটতে পারছে না। তাকে ওষুধ দেওয়া হয়েছে পায়ে। এক্স-রে শেষে বসে রইলো সে কেবিনে৷ আরাফ কেবিন নিয়েছে তার জন্য। হাতে একটা সফট ড্রিংকসের ক্যান। আহনাফ সেটা হাতে নিয়েই মুচকি হাসলো। তার স্মৃতিও সেই গুলিয়াখালীর সন্ধ্যায় হারিয়ে গেল।

সেদিন সন্ধ্যায় সফট ড্রিংকস খেয়ে ছ’বন্ধু পা ভিজিয়ে বসে রইলো বালির উপর। সূর্যাস্তের পর একটু আগে খাওয়া খালি বোতল ছুঁড়ে মারতে লাগলো একজন আরেকজনের দিকে। এই নিয়ে ছ’যুবকের হাতাহাতি। কে কার গায়ে জোরে আঘাত করতে পারে। এক কোণায় বসে অরুণিকা এই দৃশ্য দেখে মজা পাচ্ছিল। সে আরাফের পক্ষে। আরাফকে কেউ জোরে মারলেই সে ‘আরাফ, আরাফ’ বলে আরাফের উৎসাহ বাড়িয়ে দেয়। এভাবেই পুরো সন্ধ্যা কাটালো তারা। রাতে তিন জনের দল ভাগ করে খেললো ফুটবল। অরুণিকা এবার বেশ বিরক্ত। তার একটা মেয়ে কাজিন কেন নেই, এই নিয়ে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে অভিযোগ দিচ্ছিলো সৃষ্টিকর্তার কাছে। একটা চাচাতো বোন থাকলে বেশ গল্প করতো সে। এখন এই ছ’জনের রঙ্গ-তামাশা আর নিতে পারছে না অরুণিকা। মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হয়ে সে বলল, “আমার আর ভালো লাগছে না। বাসায় যাবো।”

ইভান বলল, “আসতে বলেছিল কেউ? ছেলেদের ট্যুর এমনই হয়।”

অরুণিকা গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। পা ধাপিয়ে বলল, “না, বাসায় যাবো। হাত-পা চুলকাচ্ছে আমার। কতোক্ষণ খোলা মাঠে বসে থাকে মানুষ? গোসলও করি নি আমি।”

“যাও পানিতে নেমে করে আসো।”

আরাফ চোখ গরম করে তাকাতেই ইভান চুপ হয়ে গেল। আহনাফ বলটা ইভানের দিকে ছুঁড়ে মেরে বলল, “বন্ধুর বউকে জ্বালাস কোন সাহসে? রেস্পেক্ট দিয়ে কথা বল। ভাবী তোর।”

ইমন শব্দ করে হাসলো। বলল, “এইটুকু মেয়েটা আবার ভাবী! নো ম্যান, তুই আমাদের বোনের জামাই। তুই উলটো রেস্পেক্ট দিবি আমাদের। আমাদের বোনকে বিয়ে দিয়েছি তোর সাথে। আমরা তোর জ্যেষ্ঠ শালা। রেপেক্ট দে, বেয়াদব।”

“তোর রেস্পেক্ট তোর কাছে রাখ।”

এই বলে আহনাফ অরুণিকার কাছে গেল। অরুণিকা মুখ ছোট করে দাঁড়িয়ে আছে। আহনাফ তার কাছে এসে তার হাত ধরে বলল, “বেশি বোর হয়ে গেছো?”

অরুণিকা মাথা নেড়ে বলল, “হুম।”

আহনাফ হাত ধরে অরুণিকাকে অন্যদিকে নিয়ে গেল। তূর্য তা দেখে দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল, “বুইড়া বেডার রোমান্স উইথ গুঁড়ো মাইফুয়া।”

তূর্যের কথায় ইমন আর তাহমিদ হাসলো। ইভান মুখ বাঁকিয়ে বলল, “আমি তো ত্রিশেও বিয়ে করবো না। মেয়ে মানেই পেইন, ন্যাকা, ঘাড়ত্যাড়া।”

আরাফ বলল, “তোর কপালে দেখিস ওরকম একটা চিস জুটবে।”

ইমন জোর গলায় বলল, “বলো ইনশাআল্লাহ।”

তূর্য আর তাহমিদ জোরে বলল, “ইনশাআল্লাহ।”

ইভান চোখ ছোট করে বলল, “তুই আমাকে বদদোয়া দিচ্ছিস?”

ইমন বলল, “গাধা না-কি তুই। ইনশাআল্লাহ বলছি।”

“ভালো কিছু বলে তো আর ইনশাআল্লাহ বলিস নি।”

“ওমা, বলে কি! পেইন, ন্যাকা, ঘাড়ত্যাড়া তো সব মেয়েই হয়। মেয়ে পাবি এটাই তো আলহামদুলিল্লাহ বল।”

ইভান চুপ হয়ে গেল। আরাফ হেসে বলল, “এভাবে তো ভাবলাম না।”

এদিকে অরুণিকাকে একপাশে নিয়ে গেল আহনাফ। এরপর তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল, “তোর নীল ডায়েরিটা পড়ে ফেলেছি আমি।”

অরুণিকা চোখ বড় বড় করে তাকালো। আহনাফ হেসে বলল, “তুই আমাকে ভালোবাসিস?”

অরুণিকা ঠোঁট কামড়ে নিচের দিকে তাকালো। আহনাফ অরুণিকার দু’হাত তার অধর জোড়ার কাছে এনে আলতো চুমু খেলো। অরুণিকা শিউরে উঠলো আহনাফের স্পর্শে। আহনাফ তার দিকে তাকাতেই চোখ নামিয়ে নিলো সে। আহনাফ বলল, “আমি তোমাকে ভালোবাসি, অরুণিকা। সেই ছোটবেলা থেকেই। যখন আমি বুঝতে শিখেছি একটা মেয়ের প্রতি ভালো লাগা, ভালোবাসা সৃষ্টি হওয়া সবই একটা ছেলের সহজাত বৈশিষ্ট্য, তুমিই সেই মেয়ে ছিলে যার প্রতি আমি আকৃষ্ট হয়েছি। হুম, বয়স কম ছিল। কিন্তু কেন একটা পিচ্ছি মেয়েকে ভালো লেগে গেছে, তা বলতে পারবো না। ভালোবাসার জন্য কোনো কারণের প্রয়োজন নেই। ভালোবাসতেই ভালো লাগে।”

আহনাফ দ্বিতীয় বার চুমু খেলো অরুণিকার হাতের উলটো পিঠে। অরুণিকা পায়ের নখ দিয়ে বালির উপর খোঁচাখুঁচি করছে। তা দেখে আহনাফ বলল, “চল এবার। বাসায় যাবো।”

অরুণিকার এবার ইচ্ছে করছিলো আরেকটু থাকতে। কিন্তু মুখে সেই কথা বলার সাহস ছিল না তার।

(***)

সেই গুলিয়াখালীর যাত্রাটাই ছিল তাদের ছ’জনের একত্রে শেষ ভ্রমণ। এর আগে তারা প্রায়ই এমন ছোটখাটো ট্যুর দিতো। তাও আবার তাদের সদ্য কেনা মোটরসাইকেলে করে। আগের বছর মোটর সাইকেল চালানো শিখে ছ’জনই কিনে নিয়েছিল এক একটা মোটর সাইকেল। ছ’জনের ইচ্ছে ছিল ভিন্ন ব্রান্ডের মোটর সাইকেল কিনবে। তাই আহনাফ ও তূর্য কিনলো ইয়ামাহা এফজেডএস এফআই। ইভান ও আরাফ কিনলো কালো সুজুকি জিক্সার। অন্যদিকে ইমন ও তাহমিদ জাপানি ব্রান্ড হোন্ডা থেকে একটি সিবি ট্রিগার নিলো। তাদের শখ বেশ ভালোই ছিল। তবে আহনাফ বাদে কেউ বাড়তি অপচয় করতো না। এই পাঁচ বছরে চারবার মোটর সাইকেল পাল্টেছে সে। অরুণিকার সাথে রাগ করে তার প্রথম ইয়ামাহা বিক্রি করে দিয়েছিল, কারণ সেই মোটর সাইকেলের পেছনে অরুণিকা বসতো। দু’বছর আগে চোখে ঝাপসা দেখায় তার পালসার ১৫০ একেবারে দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছিল। এরপর নতুন কিনেছিল হোয়াইট কাওয়াসাকি নিনজা। তবে সেই মোটরসাইকেল তাকে আজ অব্ধি কেউ চালাতে দেখে নি। আর বর্তমানে সে একটা ব্ল্যাক সুজুকি জিক্সার চালাচ্ছে, যেটার অবস্থাও আজ মরতে মরতে বেঁচেছে।

আহনাফ পুরোনো স্মৃতি থেকে বেরিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আরাফ আর তাহমিদ তার সামনে এসে বসতেই সে বলল, “আগের দিনগুলো অনেক ভালো ছিল। আজ তোরা আমাকে অতীতে নিয়ে গেলি। অনেকদিন পর বাইক রাইড দিলাম তোদের সাথে। কিন্তু হঠাৎ চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছিল।”

আরাফ বলল, “শোন, আপতত অন্য ওষুধ বন্ধ রেখে এই ওষুধগুলো চালা। ডাক্তার তোকে টেস্ট করে বলেছে, তুই পাওয়ারফুল ওষুধ খাচ্ছিস। ইস ইট ট্রু?”

আহনাফ থমথমে কণ্ঠে বলল, “আমি ডাক্তারের পরামর্শ নিয়েই খাচ্ছি।”

“কীসের ওষুধ ওগুলো?”

“স্ট্রেস কমানোর জন্য।”

“তুই তো খুব জোর গলায় বলতি তুই মানুষকে স্ট্রেস দেওয়ার জন্য পয়দা হয়েছিস। এখন নিজে স্ট্রেস কমানোর ওষুধ খাচ্ছিস!”

“তুই চুপ থাক। ওষুধগুলো খেলে আমার ভালো লাগে, স্ট্রেস কমে। তুই এসব বুঝবি না। তুই এখনো ইন্টার্ন করছিস। পুরোপুরি ডাক্তার হলে এসব জ্ঞান দিস।”

আরাফ চুপ হয়ে গেল। আহনাফ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, “তোরা আমাকে একটু একা থাকতে দে।”

তাহমিদ পাশের সিটে বসে বলল, “আমি এখানেই থাকি। কেবিনে এসি আছে। বাইরে প্রচুর গরম।”

আরাফও বললো একই কথা। এই মুহূর্তে না, তারা আহনাফকে পরবর্তীতেও একা ছাড়ার সাহস পাচ্ছে না।

চলবে-

#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-৩৪ (১ম ভাগ)||

“মোর ইচ্ছে ঘুড়ি উড়িতেছে গগণবর্ণের বুক ছেঁদিয়া,
অন্তরে জ্বালা ধরাইতেছে একগুচ্ছ সাদা ফুল।
তাজা তাজা সময় যাইতাছে চলিয়া,
বুঝিতেছি না কি করেছি ভুল?
ভোরে গুঞ্জনরত পক্ষিকুলের ডাক
মোর চক্ষুতে ভাসিয়া উঠে বিষাদ চাহনি-
আমি সাড়া দিতে অপারগ
শুধু ঝাপসা দেখিয়া যাই আর শুনি।
বহুদিন পর সকল প্রশ্নের উত্তর পাইলাম,
ঘুড়ি খুঁজিতেছিল তার প্রতিত্তোর
সাদা ফুলের ভীড়েও তারেই দেখিলাম,
সময় থমকায় যেথায় তার বাঁধা আছে ঘর
পক্ষিরা আর দেখাইবে না স্বপ্নবানী,
বুঝিয়াছে কার সেই বিষাদ চাহনি।”

এমন লম্বা কবিতা পড়ে অরুণিকা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লো। আয়নার মুখোমুখি বসেছে সে। সে চোখ তুলে নিজেকে একবার দেখে নিলো। এরপর নিজের গালে হালকা চড় মেরে বলল, “হয়তো ভুলে চলে এসেছে। নয়তো হিমালয় আমার জন্য কবিতা লিখবে? অসম্ভব!”

অরুণিকা ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকালো। দেখলো হিমালয় টাইপিং করছে। অরুণিকা অপেক্ষা করলো। অনেকক্ষণ পর একটা ক্ষুদ্র মেসেজ এলো।

“পছন্দ হয় নি?”

অরুণিকার চোখ দু’টি বিষ্ময়ের ভাব প্রকাশ করছে। ফোনের স্ক্রিন থেকে চোখ তুলে খোলা জানালার দিকে তাকিয়ে ভাবলো, “এইটুকু মেসেজ লিখতে এতো সময় নিলো? একজন সাধারণ পাঠককে মেসেজ পাঠাতে এতো ভাবতে হয়? ভেবে-চিন্তে মেসেজ দেওয়ার অর্থ কি উনি আমাকে অনেক কিছু বলতে চান, কিন্তু পারছেন না? কি বলতে চান উনি?”

অরুণিকা ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকালো। মৃদু হাসি ফুটে উঠলো তার ঠোঁটে। লিখলো, “অনেক পছন্দ হয়েছে। আপনি কবিতাও লিখেন?”

“না। তবে লেখার চেষ্টা চলছে।”

“আপনার ভারী ভারী বাক্য দেখে মনে হলো আপনার চর্চা অনেক দিনের। যে কেউ এই কবিতা সহজে বুঝবে না।”

“কবিতা সহজে কেউ বুঝে না। কবিতার গভীরতা কবির জীবনের অংশের প্রতিচ্ছবি। আর যারা পড়ে তাদের নিগূঢ় কাব্য প্রেমী হতে হয়। নয়তো একটা বাক্যও তার হৃদয় স্পর্শ করবে না। তবে কিছু কবিতা পাঠকের জীবনের স্পন্দনের সাথে তাল মিলিয়ে ফেলে। তখন সে বেশ উপভোগ করে। যেমন গান। গান শুনে আপনি কখনো অশ্রু ফেলেছেন?”

“হ্যাঁ। অনেক বার।”

“গানের অর্থ আর বাদ্যযন্ত্রের মিশ্রণ আপনার হৃদয়ে লুকিয়ে থাকা কথাগুলো বের করে আনতে পারে। তাই আপনি গান শুনে মুগ্ধ হোন। আর কবিতাও ঠিক তেমনি। তবে ভালো আবৃত্তি করতে পারে, এমন কারো কন্ঠে সেই কবিতা শুনলে আপনিও হারিয়ে যাবেন।”

“আপনি পারেন আবৃত্তি?”

কোনো উত্তর এলো না। অরুণিকা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলো। এরপর লিখলো, “কিছু বলছেন না যে!”

উত্তরে হিমালয় লিখলো, “যদি পারতাম, আপনাকে রোজ একটা করে শোনাতাম।”

“কেন পারেন না? আপনি এতো চমৎকার লিখতে পারেন। অথচ আবৃত্তি!”

“হিমালয়ের সুর নেই। ভাষাহীন হিমালয় আপনাকে শুধু লিখেই মুগ্ধ করতে পারবে।”

অরুণিকা স্তব্ধ হয়ে পড়লো। লিখলো, “আপনি কি কথা বলতে পারেন না?”

অরুণিকা মেসেজ পাঠিয়ে আবার আনসেন্ট করে দিল। মনে মনে ভাবছে, “এমন অভদ্র প্রশ্ন করা কি ঠিক হলো?”

হিমালয় লিখলো, “সংকোচ করছেন কেন? আমি আপনার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিচ্ছি। আমার কন্ঠে সুর নেই। হিমালয়ের সৃষ্টি বিনা সুরে। তবে চাইলে সেই সুর যুক্ত করা সম্ভব।”

“কীভাবে?”

“কেউ যদি সেই সুরে প্রাণ দেয়।”

অরুণিকা পাশে ফোন রেখে দিলো। চোখ বন্ধ করে নিলো সে। হিমালয় কথা বলতে পারে না জেনে খুব কষ্ট পাচ্ছে সে। কিন্তু কেন? হিমালয়ের প্রতি এতো মায়া কেন জমছে তার হৃদয়ে? অরুণিকার চোখ ভিজে উঠলো। ফোন হাতে নিয়ে সাথে সাথেই লিখলো, “আমি যদি সুর হতে চাই?”

হিমালয়ের উত্তর এলো সাথে সাথেই।

“ভারী সৌভাগ্য হবে আমার।”

অরুণিকা চোখ জোড়া বন্ধ করতেই অশ্রু গড়িয়ে পড়লো তার গাল বেয়ে। চোখ মুছে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “একটা মানুষ এতো চমৎকার, তার মন এতো চমৎকার, অথচ তার কন্ঠে প্রাণ নেই। আর ওদিকে আহনাফ নামক ফজ্জাতটার মনে সব শয়তানি, আর কন্ঠটাও আল্লাহ তাকে সুরেলায় দিয়েছে।”

হিমালয়ের সাথে কথা শেষে অরুণিকা মহাকাল বইটি নিয়ে বসলো। পুরো সন্ধ্যা কাটলো। রাত গভীর হলো। মাঝে চায়ের বিরতিই নিয়েছে অরুণিকা। একদম ভোর ছ’টায় শেষ হলো মহাকাল বইটি। অরুণিকা বইটা পাশে রেখে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগলো। প্রায় মিনিট দশেক পর ফোনের নোটিফিকেশনের শব্দ হলো। হিমালয়ের মেসেজ। প্রতিদিন ভোরে একসাথেই সূর্যোদয় দেখে তারা। তবে এই কয়েক সপ্তাহ শুধু হিমালয় দেখছে। নিচ তলায় বাসা নেওয়ায় সূর্য দেখার সুযোগ হয় না অরুণিকার। হিমালয় আকাশের ছবি পাঠিয়ে দিতো। অরুণিকা সেটাই দেখতো। কিন্তু আজ অরুণিকার মন ভারী। সে পা টিপে টিপে বেরিয়ে পড়লো বাসা থেকে। উঠে পড়লো ছাদে। যদি ছাদ খোলা থাকে বেশ ভালো হবে। বারান্দা তো নেই নিচতলায়। তাই বাধ্য হয়েই অরুণিকার ছাদে উঠা।

অরুণিকাকে আকাশের ছবি পাঠিয়েছে হিমালয়। আর ছবির নিচে লেখা,
“ভোরের মিষ্টি সূর্যের সাথে দমকা হাওয়ার শুভেচ্ছা, প্রিয় হৃদি।”

অরুণিকা মেসেজের উত্তর লিখতে লিখতে ছাদে উঠলো। ছাদের গেট হালকা চাপানো। গেট ঠেলে দিয়ে সামনে তাকাতেই থমকে গেল অরুণিকা। ছাদের রেলিঙে পা ঝুলিয়ে বসে আছে আহনাফ। অরুণিকাকে দেখে চমকে উঠলো সে। অরুণিকা মনে মনে ভাবছে, “সকালটাই যদি এই মানুষটাকে দেখে শুরু হয়, কেমন ভয়ংকর দিন কাটবে আজ আমার!”

তবে অরুণিকা নিচে নামলো না। আহনাফের জন্য সে সূর্যোদয় কেন দেখবে না?

ছাদের একপাশে বসার বেঞ্চ আছে। অরুণিকা হনহনিয়ে সেখানে গিয়েই বসলো। এরপর ঘাড় ফিরিয়ে এক নজর পেছনে তাকালো। দেখলো আহনাফ এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। অরুণিকা চোখ সরিয়ে ফোনের স্ক্রিনে লেখা মেসেজটি হিমালয়কে পাঠালো।

“কাল সারারাত জেগে মহাকাল পড়েছি। শেষ অংশ পড়ে অনেক কেঁদেছি। ঘুমাই নি আমি। মনে হয় না আর পারবো। যেই সমাপ্তি টেনেছেন! তাই আজ ভোরের সূর্যটা দেখার জন্য ছাদে উঠলাম। জানেন, আপনার উপর আমার খুব অভিযোগ। কেন আপনার গল্পের চরিত্রগুলো পূর্ণতা পায় না? কেন তাদের ভালোবাসা অসমাপ্ত থেকে যায়?”

হিমালয় মেসেজটি দেখলো। কিন্তু কোনো উত্তর দিলো না। অরুণিকা ঘাড় ফিরিয়ে আহনাফের দিকে তাকালো। আহনাফ এখনো এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। অরুণিকা সাথে সাথেই চোখ সরিয়ে আবার ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকালো। কিন্তু কোনো উত্তর আসছে না। অরুণিকা ব্যস্ত হাতে লিখলো,
“খুব বেশি ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে ফেলেছি? আচ্ছা, সরি।”

তবে এবারের মেসেজটি আর দেখলো না হিমালয়। অরুণিকা আবার পেছন ফিরলো। আহনাফের দৃষ্টি এখনো তার দিকে আঁটকে আছে। অরুণিকা এবার বেশ বিরক্ত হলো। উঠে আহনাফের সামনে এসে বলল, “এতোটুকু ম্যানার্স নেই? একটা মেয়ে ছাদে উঠলে এভাবে তাকিয়ে থাকার কি আছে? আমি আনকাম্ফোর্ট ফিল করছি।”

আহনাফ উঠে দাঁড়ালো। নিঃশব্দে চলে যেতে লাগলো। আহনাফকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে দেখে বেশ অবাক হলো অরুণিকা। ভাবতে লাগলো, “সেদিন বাস থেকে ফেলে দেওয়ায় পা ভেঙে যায় নি তো! এই কয়েকদিন ক্যাম্পাসেও দেখি নি।”

অরুণিকা আহনাফের সামনে এসে ক্ষীণ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “পায়ে কি হয়েছে?”

আহনাফ শুকনো হেসে বলল, “বাইক এক্সিডেন্ট করেছি।”

কথাটি বলেই আহনাফ অরুণিকার দিকে তাকিয়ে রইলো। অরুণিকা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “ভাগ্যিস বাস থেকে পড়ার কারণে এই অবস্থা হয় নি। নয়তো তোমার মা আমাকে আবার পুলিশে দিতো।”

আহনাফ ক্ষীণ হেসে বলল, “অনেক ভয়ংকর এক্সিডেন্ট। জিজ্ঞেস করবি না কীভাবে বেঁচে গেছি?”

“জেনে কি হবে। বেঁচে তো যাবেই। আমার লাইফটা হেল করা এখনো তো বাকি! শুনেছি খারাপ মানুষগুলো সহজে মরে না।”

আহনাফ অরুণিকার গালে হাত দিয়ে বলল, “ভালোই তো। তুই একটা খুনী, আর আমি তোর দৃষ্টিতে খারাপ মানুষ। এখন তো আমরা দু’জন অনেক দিন বাঁচবো। এমনিতেই আমি তোকে ছাড়া মরবো না। তোকে নিয়েই মরবো।”

অরুণিকা ইশারায় তাকে যাওয়ার পথ দেখিয়ে দিলো। আহনাফ বিনাবাক্যে চলে গেল। অরুণিকাও আবার আগেই জায়গায় এসে বসলো। কিন্তু হিমালয়ের কোনো উত্তর আসে নি। হতাশ হলো অরুণিকা। আকাশের দিকে বেশ খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিচে নেমে পড়লো।

চলবে-

#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-৩৪ (২য় ভাগ)||

আশ্বিন মাস। ১৪২৪ বঙ্গাব্দ। গোধূলি আকাশ দেখতে ছাদে উঠেছে অরুণিকা। চৌধুরী ম্যানশনের ছাদ সন্ধ্যার আগেই বন্ধ করে দেন বড় চৌধুরী সাহেব। এই কথা সবারই জানা। তবুও অরুণিকা ছাদে গেল আজ। সে জানতো ফিরে আসতে হবে। কিন্তু ছাদের গেট খোলা দেখে বেশ অবাক হলো সে। বিকেল পাঁচটার পর ছাদের গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে তালা লাগানো হয় না। প্রয়োজনে রাতে কেউ চাইলেই ছাদে উঠতে পারে। তবে মাগরিবের আগে বড় চৌধুরী সাহেব গেট বন্ধ চান। তিনি কারণ হিসেবে বলেছেন, খারাপ জিনেরা এই সময় ছোটাছুটি করে। এই সময় জানালা, দরজা বন্ধ করে দেওয়া উত্তম। তার এই কথা ফ্ল্যাটের সব মালিকই মেনে নিয়েছে। আর তাই প্রতিদিন দারোয়ান এসে সন্ধ্যার আগে গেট বন্ধ করে দেয়। কিন্তু আজ ব্যতিক্রম দেখে অরুণিকা চিন্তায় পড়ে গেল। সে হালকা ভেজানো গেটটি ধাক্কা দিয়ে ছাদে পা রাখতেই চমকে উঠলো। সামনের মানুষটিও তাকে দেখে থমকে গেল। হকচকিয়ে পিছিয়ে যেতেই হোঁচট খেয়ে ছাদের মেঝেতে বসে পড়লেন তিনি। অরুণিকা ছাদের রেলিঙে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পেলো আবরারকে। অরুণিকা আবরারের দিকে এগিয়ে যেতেই, ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে মানুষটি নেমে পড়লো তরতর করে। অরুণিকা দ্রুত আবরারের হাত ধরলো। তাকে টেনে উঠানোর চেষ্টা করতে লাগলো সে। কিন্তু মানসিক প্রতিবন্ধী আবরার অরুণিকার কথা বুঝতে পারলো না। সে ঝুলেই আছে। নিজে উঠার চেষ্টা করছে না। তার ভর টেনে তোলার জন্য অরুণিকার শরীর বেশ দুর্বল ছিল। সে কাউকে সাহায্যের জন্য ডাকবে সেই সুযোগটাও আর হলো না। হাত ফস্কে যেতেই আবরার চোখের পলকে দশ তলা ভবন থেকে নিচে পড়ে গেল। অরুণিকা ভীত দৃষ্টিতে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। তার হাত-পা অসার হয়ে আসছে। চোখের সামনে তার আরেকটা মৃত্যু দেখতে হলো!

এদিকে আবরার নিচে পড়ার আগ মুহূর্তেই আহনাফ বাসায় ঢুকছিল। আহনাফের সামনেই আবরারের শরীরটা ধপ করে ইটের রাস্তায় এসে পড়লো। নিষ্প্রাণ দেহটি দেখে আহনাফ স্তব্ধ হয়ে মাটিতে বসে পড়লো। মুহূর্তেই মায়ের কান্নার শব্দ আহনাফের হৃদয় ভেঙে চুরমার করে দিলো। তার হাতে থাকা বাক্সটি রাস্তায় পড়ে আছে। সেখানে থাকা কাচের চুড়িগুলো সব হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেছে। সেদিকে কারো খেয়াল নেই। ভাঙা চুড়ি মারিয়ে সবাই নিথর দেহ দেখতে ভীড় করছে। অরুণিকা দ্রুত নিচে নেমে এলো। শিরিন সুলতানা অরুণিকার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, “আজ তোমার জন্য আবরারের এই অবস্থা। তুমি এর জন্য দায়ী।”

আহনাফ চোখ তুলে অরুণিকার দিকে তাকালো। অরুণিকা অশ্রুসিক্ত চোখে বলল, “আমি ফেলি নি আবরারকে। আমি তো ওকে ধরে উঠাতে চেয়েছি।”

“আমি নিজ চোখে দেখেছি। তুমি আমার ছেলেকে ধাক্কা দিয়েছো।”

অরুণিকা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো শিরিন সুলতানার দিকে। আর শিরিন সুলতানার চোখ-মুখ শক্ত হয়ে আছে।

(***)

আবরারকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। ডাক্তার তাকে দেখে মৃত ঘোষণা করলেন। এদিকে মুহূর্তেই পুরো এলাকায় রটে গেল অরুণিকা আবরারকে ছাদ থেকে ফেলে দিয়েছে। পুলিশ এলো। শিরিন সুলতানার বয়ানে তারা অরুণিকাকে নিয়ে গেল। এরপর কিশোর অপরাধীর তালিকায় যুক্ত হলো অরুণিকা চৌধুরীর নাম। তাকে শোধরানোর জন্য পাঠানো হলো একটা কারাগারে। তবে সেখানে তাকে এক রাতের বেশি থাকতে হয় নি। মিসেস চৌধুরীর অনেক কাকুতি-মিনতির পর মামলা তুলে নিলেন তার ছেলে। আশেপাশের সবাইকে জানানো হলো, একটা বড় ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। আবরারকে অরুণিকা ধাক্কা দেয় নি, সে পা পিছলে নিচে পড়ে গিয়েছিল। তবুও অরুণিকার গায়ে যেই অপবাদ লেগেছে সেই অপবাদ কাটে নি। স্কুলের চেয়ারম্যান অরুণিকাকে বহিষ্কার করলেন৷ সে বছর অরুণিকা আর মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসতে পারে নি।

(***)

অরুণিকার জীবনের গতি হুট করেই থমকে গেল যেন। বাবা-মার মৃত্যুর পর চৌধুরী বাড়ির সবাই তাকে একপ্রকার অবহেলা করছিল৷ কিন্তু আবরারকে খুন করার অপবাদ লাগায় এবার তো কেউ তার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। তূর্য, ইভান, ইমন, আরাফ ও তাহমিদ টুকটাক কথা বলতো তার সাথে। কিন্তু আবরারের রুমে থাকা সিসিটিভি ফুটেজ দেখার পর সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। জগত সংসারে এই মুহূর্তে অরুণিকা নিজেকে একা আবিষ্কার করছে। যেখানে তার সাথে কথা বলারও কেউ নেই।

একাকী অশ্রু ফেলতে ফেলতেই প্রায় দু’মাস কেটে গেল। আজ তার টেস্ট পরীক্ষায় বসার কথা। কিন্তু এর পরিবর্তে সে রুম বন্ধ করে বসে আছে। হঠাৎ রুমের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনেই অরুণিকা দরজার দিকে তাকালো। আহনাফ রুমে ঢুকেই অরুণিকার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো। অরুণিকা ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “আমার জীবনটা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, আহনাফ। কেউ আমাকে বাঁচাতে আসছে না। আমি মুক্তি চাই এই যন্ত্রণা থেকে। আমার তো কোনো অপরাধই নেই। আমি মারি নি আবরারকে।”

আহনাফ হুট করে অরুণিকাকে জড়িয়ে ধরলো। ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “আমি তোকে বিশ্বাস করি। আমি জানি তুই এমন জঘন্য কাজ করবি না। কিন্তু সিসিটিভি ফুটেজে এসব কি দেখছি?”

“ওগুলো তো ওর উপর রাগ করে করেছি। ভাই-বোনে কি মারামারি হয় না? কিন্তু আমি কেন ওকে মেরে ফেলবো?”

“তাহলে আবরার সেদিন সন্ধ্যায় ছাদে কীভাবে গেল?”

“আমি নিজেই তো ছাদে উঠে ওকে দেখেছি। ওখানে চাচীও ছিলেন। চাচীকে জিজ্ঞেস করো। আমাকে দেখেই তো উনি পালিয়ে গেছেন। উনি দেখেছিলেন আবরার রেলিঙের উল্টোপাশে ঝুলছিল। উনি আবরারকে না উঠিয়ে চলে গেলেন কেন জিজ্ঞেস করো উনাকে? আমার দোষ কেন দিচ্ছে উনি?”

আহনাফ অরুণিকাকে সরিয়ে দিয়ে বলল, “মায়ের কথা বলছিস?”

“হ্যাঁ। ছোট চাচী ছাড়া কেউ ছিল না সেদিন ছাদে। উনি মিথ্যে বলছে। আমি আবরারকে ফেলি নি। আমি তো পরে এসেছি। আবরার আগে থেকেই রেলিঙে ঝুলছিল।”

আহনাফ চুপচাপ উঠে চলে গেল। অরুণিকা শক্ত হয়ে মেঝেতে বসে আছে। দু’মাস আগে আবরারের লাশ বাসায় আনার পর পুলিশ এসে অরুণিকাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। এরপর তাকে একটা বদ্ধ ঘরে বসিয়ে রাখা হয়েছিল। ঘন্টাখানেক পর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এরইমধ্যে শিরিন সুলতানা বদ্ধ ঘরটিতে ঢুকলেন। অরুণিকা তাকে দেখে মুখ ফুলিয়ে বলল, “আপনি মিথ্যুক। আপনিই আবরারকে রেলিঙের উপর উঠিয়েছেন।”

শিরিন সুলতানা শান্ত স্বরে বললেন, “এই কথা তুমি আর আমি ছাড়া কেউ জানে না।”

“আল্লাহ জানে সব।”

শিরিন সুলতানা হেসে বললেন, “তোমার আল্লাহ তোমার পক্ষে জবাব দিতে আসবে না।”

অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে বললো, “আপনি অনেক খারাপ।”

শিরিন সুলতানা চেয়ার টেনে অরুণিকার সামনে বসে বললেন, “তোমার কাছে কোনো প্রমাণ নেই, অরুণিকা। ছাদের সিসি ক্যামেরা নষ্ট অনেকদিন হচ্ছে। লিফটে কোনো সিসি ক্যামেরা লাগানো হয় নি। আর আমাদের ফ্লোরের ক্যামেরা আমি নিজ হাতে নষ্ট করে দিয়েছি। আর এরপরই এই প্ল্যান করেছি। তুমি শুধু শুধু ছাদে উঠতে গেলে। আমি ভালোই ভালোই আবররাকে উপরে পাঠিয়ে দিতাম। সবাই ভাবতো, ও প্রতিবন্ধী তাই নিজে নিজেই পড়ে গেছে। আর ছাদের গেট খোলা রাখার অপরাধে দারোয়ান শাস্তি পেতো। কিন্তু তুমি এসে আমাকেও দেখে ফেললে, নিজেও ফেঁসে গেলে।”

“আমি সত্যটা সবাইকে বলে দেবো।”

শিরিন সুলতানা মুখ চেপে হাসলেন। বললেন, “পাগল মেয়ে! আবরার আমার কলিজার টুকরা। তোমার এই কথা কে বিশ্বাস করবে, বলো? উলটো মনে করবে, নিজের দোষ ঢাকার জন্য তুমি মিথ্যে বলছো।”

অরুণিকা নির্বাক তাকিয়ে রইলো শিরিন সুলতানার দিকে। শিরিন সুলতানা অরুণিকার থুতনি ধরে বললেন, “তোমাকে আমার আহনাফের জন্য মোটেও পছন্দ ছিল না। তোমাকে আহনাফের জীবন থেকে ধাক্কা দিয়ে বের করার জন্য অনেক চমৎকার একটা প্ল্যান করেছিলাম। শুনবে?”

অরুণিকা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো শিরিন সুলতানার দিকে। তিনি বললেন, “আবরারকে তুমি মাঝে মাঝে মারতে। কেন মারতে? ও তোমাকে বাজে কথা বলতো তাই। তোমাকে বাজেভাবে টাচ করতো। কিন্তু আমার ছেলেটা না অবুঝ। এসব বুঝে না। মেয়ে-ছেলের ভেদাভেদ বুঝার বুদ্ধি ওর নেই। আমিই ওকে এসব শিখিয়ে দিয়েছিলাম। বলেছি, তোমাকে বাজেভাবে ছুঁয়ে দিতে। দেখিয়ে দিয়েছি কোথায় কোথায় স্পর্শ করলে, তোমার মাথা খারাপ হবে। আর আমার লক্ষী বাচ্চাটা আমার কথামতো সব করতো। তুমি ভাবতে ও প্রতিবন্ধী হওয়ার ভান ধরেছে। মাঝে মাঝে তোমার জিনিসপত্র ভেঙে দিতো। নষ্ট করে দিতো। সব আমি শিখিয়ে দিয়েছি। কারণ তুমি যদি এসব আহনাফকে অভিযোগ দাও, ওকে যদি বলো আবরার তোমার সাথে এমন বাজে আচরণ করেছে, ও তোমাকে কখনো বিশ্বাস করবে না। তুমি যদি বলো ও ভান ধরেছে, তখন সবাই তোমাকে ভুল বুঝবে। আমি জানি, আবরার আহনাফের জান। তাই আবরারের রুমে সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছি। তুমিও তো এরপর আবরারের উপর বিরক্ত হয়ে যখন তখন ওর গায়ে হাত উঠিয়েছিলে। ওকে রুমে বন্ধ করে রাখতে। আর সবাই সেই ফুটেজে ততোটুকুই দেখবে, যতোটুকু আমি দেখাতে চেয়েছি। এর পেছনের কারণ কেউ জানবে না। আর তুমি বললেও কেউ বিশ্বাস করবে না। আর এখন তোমার উপর আবরারের হত্যার দায় উঠেছে। সেই ফুটেজের সাথে যুক্ত হলো এই অপবাদ। তুমি তো এবার আমার ছেলের জীবন থেকে বের হবেই। সাথে চৌধুরী ম্যানশন থেকেও।”

সব শুনে অরুণিকা ধরা গলায় বলল, “আপনি আবরারকে কেন মেরেছেন?”

“আহা! সব কথা জিজ্ঞেস করা যায় না। এটা টপ সিক্রেট। তোমাকে বলা যাবে না। আর কেউ সত্যটা কখনোই জানবে না। সাপও মরে গেছে, লাঠিও ভাঙে নি।”

অরুণিকা মেঝেতে বসে দু’মাস আগে শিরিন সুলতানার বলা কথাগুলো ভাবতে লাগলো। ওদিকে আহনাফ তার মায়ের সামনে এসে দাঁড়ালো। অরুণিকার বলা প্রতিটি কথা তুলে প্রশ্নবিদ্ধ করলো শিরিন সুলতানাকে। শিরিন সুলতানা মুহূর্তেই মেঝেতে শুয়ে পড়লেন। আহনাফ ব্যস্ত হয়ে তাকে টেনে বসালো। শিরিন সুলতানা আহনাফের হাত ধরে ভেজা কন্ঠে বললেন, “দু’মাসও হয় নি আমি আমার আদরের ছেলে হারিয়েছি, এখন আরেক ছেলে এসে আমাকে একটা খুনির কথা বিশ্বাস করে এমন প্রশ্ন করছে?”

শিরিন সুলতানা আহনাফকে ধরে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আমি তো অরুকে ভালো মনে করেছি। একটুখানি মেয়ে এমন পটর পটর করে মিথ্যে বলে দিলো? আমি তো ছাদে ছিলামই না। আবরারকে বাসায় না পেয়ে তাকে খুঁজতে ছাদে গিয়েছিলাম। সেখানেই দেখলাম ওই মেয়ে আমার ছেলেকে নিচে ফেলে দিয়েছে।”

“তুমি অরুকে ধাক্কা দিতে দেখেছো?”

“হ্যাঁ, দেখেছি। ও-ই তো আমার ছেলেকে ধাক্কা দিলো।”

আহনাফ কিছুক্ষণ চুপ থেকে শিরিন সুলতানাকে ছেড়ে দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল, “আবরার আমার সামনে এসে পড়েছিল। আমি নিচেই ছিলাম তখন। আমি পাথর হয়ে গেছি ওকে দেখে। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই তুমি কাঁদতে কাঁদতে দৌঁড়ে এলে! অরু অনেক দেরীতে নেমেছে। তুমি তাহলে দশতলা থেকে এতো তাড়াতাড়ি কীভাবে নামলে? তুমি যদি অরুকে ধাক্কা দিতে দেখেই থাকো, ওখানেই কেন ওকে একটা চড় লাগালে না? এতো সহজে কীভাবে ফেলে দিতে দেখলে? ওকেসহ কেন উল্টে ফেলে দিলে না? আর এতো তাড়াতাড়ি কীভাবে নেমেছো তুমি?”

শিরিন সুলতানা কাঁপা কন্ঠে বললেন, “লিফটে নেমেছি আমি।”

“খুব স্বাভাবিক লাগছে তোমার এসব? আমার তো ব্রেইনই কাজ করছিল না তখন। তুমি এতো সহজে নামলে কীভাবে? আমার তো লিফটের বাটন চাপতেও ভুল হতো। আমি তো চলার শক্তিই হারিয়ে ফেলতাম। তুমি এতো তাড়াতাড়ি কীভাবে নামলে, মা?”

“তুই আমাকে সন্দেহ করছিস, আহু? তাও আবার ওই মেয়ের কথায়?”

“না, ওর কথায় না। আমি জানি, তুমি আবরারকে খুন করতে পারো না। মা কীভাবে তার সন্তানকে খুন করবে? কিন্তু তুমি অরুকেও ধাক্কা দিতে দেখো নি। তুমি এখানেই মিথ্যে বলছো। তুমি হয়তো আবরারকে খুঁজতে নেমেছিলে। তাই এতো তাড়াতাড়ি নামতে পেরেছো। নয়তো তোমার স্টেটমেন্টের সাথে ফ্যাক্ট মিলছেই না।”

শিরিন সুলতানা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আহনাফের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আহনাফ শক্ত গলায় বলল, “কেইস চালানো উচিত ছিল তোমাদের। আসল সত্য তখনই বেরিয়ে আসতো।”

শিরিন সুলতানা কিছু বলার আগেই আহনাফ বেরিয়ে গেল। শিরিন সুলতানা দরজা বেঁধে দিয়ে ভাবতে লাগলেন, “যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব আহনাফের মাথা থেকে এই সন্দেহ দূর করতেই হবে।”

(***)

সাল ২০২২। ঘড়িতে সন্ধ্যা ছ’টা। রুহানিকে পড়াতে এসেছে আরাফ। দু’জনই মুখোমুখি বসেছে। আরাফ গম্ভীর কন্ঠে বলল, “বই বের করো। প্রতিদিন কেন বলতে হয় তোমাকে? আমি আসার আগে বই বের করতে পারো না?”

রুহানি চোখ-মুখ বাঁকিয়ে রাখলো। মনে মনে বলল, “ধুর, এই খচ্চর স্যারটার উপর শুধু শুধু ক্রাশ খেয়ে বসে আছি। অদ্ভুত একটা! সারাদিন মুখটা তেলাপোকার মতো করে রাখে।”

এসব ভাবতে ভাবতেই কোথা থেকে একটা তেলাপোকা উড়ে এসে রুহানির টেবিলের উপর বসলো। তা দেখেই লাফিয়ে উঠলো সে। চেঁচাতে চেঁচাতে পুরো ঘর মাথায় তুললো। আরাফ ফ্যালফ্যাল করে রুহানির দিকে তাকিয়ে আছে। আতকিয়া জাহান ও অরুণিকা দৌঁড়ে রুহানির ঘরে ঢুকলো। রুহানি কাঁপা কন্ঠে এক কোণায় বসে বলল, “তেলাপোকা!”

অরুণিকা তেলাপোকা শুনেই না দেখে চেঁচাতে লাগলো। অরুণিকার সাথে পাল্লা দিয়ে রুহানিও চেঁচাচ্ছে। আতকিয়া জাহান অরুণিকার হাত ধরে বললেন, “আরেকবার চেঁচালে থাপ্পড় দিবো একটা।”

অরুণিকা দুই গালে হাত দিয়ে দ্রুত নিজের রুমে চলে গেল। এদিকে রুহানি পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বলল, “অরু, আমাকেও নিয়ে যা।”

আরাফ রুহানির অবস্থা দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসছে৷ রুহানি দু’হাত জোড় করে বলল, “সরি তেলাপোকা মামা, তোমাকে আর কখনো যার-তার সাথে তুলনা করবো না। তুমি রাগ করেছো, তাই না? তুমি তো অনেক সুন্দর। ওই স্যারটা তো কুনোব্যাঙের মতো দেখতে।”

আরাফ ভ্রূ কুঁচকে বললো, “তুমি আমাকে বলছো?”

রুহানি চেঁচিয়ে বলল, “আপনি না ডাক্তার? তাড়াতাড়ি একে অজ্ঞান করে আমাকে উদ্ধার করেন।”

আরাফ অবাক হয়ে বলল, “তেলাপোকাকে অজ্ঞান করবো?”

“হ্যাঁ, ইচ্ছে করলে মেরেও ফেলতে পারেন।”

আরাফ তেলাপোকাটা খপ করে ধরে ফেললো। তা দেখে রুহানি সেখানেই পা ধাপাচ্ছে। আরাফ হাত মুঠো করে রুহানির দিকে এগিয়ে আসতে যাবে, রুহানি মেঝেতে বসে বলল, “আল্লাহর দোহাই লাগে স্যার, আপনি ওকে এদিকে আনবেন না। আপনাকে দুই ঘন্টায় তিন বার নাস্তা খাওয়াবো আমি।”

আরাফ রুহানির কথা শুনে শব্দ করে হেসে উঠলো। আতকিয়া জাহান দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রুহানির কান্ড দেখে চোখ গরম করে তাকিয়ে আছেন। রুহানি মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “এভাবে না তাকিয়ে তেলাপোকাটা বের করতে স্যারকে সাহায্য করো। তোমার একটা মাত্র মেয়ে স্ট্রোক করলে, নিঃসন্তান হয়ে যাবে তুমি।”

আরাফ তেলাপোকাটা জানালা দিয়ে ফেলে দিল। রুহানি তাড়াতাড়ি জানালা বন্ধ করে দিয়ে বলল, “কালকে যদি রিভিঞ্জ নিতে চলে আসে? একেবারে মেরে ফেললেই তো হতো!”

আরাফ চোখ ছোট করে বলল, “এখন পড়তে আসো।”

আরাফ চেয়ারে বসতেই রুহানি নাক সিঁটকে বলল, “আরেহ আপনি তো দেখি চরম খাইস্টা!”

আরাফ ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। আতকিয়া জাহান কোমড়ে হাত রেখে বললেন, “বেশি বলছিস তুই, রুহু।”

রুহানি মুখ ছোট করে বলল, “উনি তেলাপোকা ধরে হাত ধুয়ে আসে নি। এখন আমার বই ধরবে। ইস, আমি এরপর আর ওই বই ধরবো না। তখন ফেইল করলে তোমার দোষ।”

এবার আরাফ উঠে পাশের বেসিনে গিয়ে হাত ধুয়ে নিলো।আতকিয়া জাহানা শুকনো মুখে বললেন, “কিছু মনে করো না, বাবা।”

আরাফ ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “না, আন্টি। সমস্যা নেই। এখনো ওর মধ্যে ম্যাচিউরিটি আসে নি। কিছু কিছু মানুষের দেরিতে ম্যাচিউরিটি আসে।”

আতকিয়া জাহান চলে যেতেই রুহানি আরাফের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। আরাফ তার চাহনি দেখে বলল, “এভাবে কি দেখছো?”

“আপনি এমন সাহসী কাজ করেছেন, তাই ভেবেছি আপনাকে শাবাশ বলবো। বাহবা দেবো আপনাকে। কিন্তু আপনি বললেন আমি ইম্যাচিউর? তেলাপোকা দেখলে যেখানে আমার জান হাতে চলে আসে, সেখানে আমি মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকবো? আমাদের কলেজের বায়োলজি স্যার বলেছিল, কোনো কিছুতে ভয় পেলে হাইপোথ্যালামাসে সংকেত যায়, আর সেখান থেকে একটা রিয়েকশন আসে। আর যদি কেউ সেটা দেখাতে না পারে, চাপটা সরাসরি মস্তিষ্কে গিয়ে পড়ে। তখন মানুষ স্ট্রোক করে। আমি স্ট্রোক-ম্রোক করতে চাই না। তাই চেঁচামেচি করেছি।”

আরাফ রুহানির দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি বায়োলজিতে টেনেটুনে পাশ করেছিলে না?”

রুহানি চোখ ছোট করে বলল, “এটা জানি তার মানে এই না যে সংজ্ঞা, কোষের সংখ্যা, কোন হাড্ডির নাম কি, কোন অঙ্গ দেখতে কেমন, কোনটা ভাইরাস, কোনটা ব্যাকটেরিয়া এসবও মনে রাখতে হবে!”

“তুমি আসলে ইম্যাচিউর না। তুমি একটা প্রতিবন্ধী।”

রুহানি ঠোঁট ফুলিয়ে মাথার ওড়না টেনে দিলো কপাল পর্যন্ত। কীভাবে অপমান করলো স্যারটা! এখন তো মুখটাও দেখাতে লজ্জা লাগছে তার।

(***)

দু’দিন পর হিমালয়ের মেসেজ এলো। লেখা ছিল,
“দুঃখিত, কিছু ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে এতোদিন অনলাইনে আসতে পারি নি।”

অরুণিকা হিমালয়ের মেসেজ দেখেই খুশিতে আত্মহারা। এই দু’দিনে তার অস্থিরতার সাক্ষী সে একাই ছিল। সে উত্তরে লিখলো, “আমি তো ভেবেছি, আমার প্রশ্নে আপনি বিব্রত হয়েছিলেন।”

“না, মোটেও না। আপনার কিছুতেই আমি বিব্রত হই না। আপনি আমাকে নাজেহাল করলেও আমার আপত্তি নেই।”

অরুণিকা এক গাল হাসলো। হিমালয় লিখলো, “অসমাপ্ত লেখা কি আপনার ভালো লাগে না?”

“লেখা বেশ ভালো হয়েছে। কিন্তু অনেক কষ্ট পেয়েছি। এমন বেদনাদায়ক লেখা পড়লে ঘুম আসে না। অস্থির লাগে।”

“তাহলে তো নতুন লেখাটা আপনাকে দেওয়ার সাহস পাবো না।”

অরুণিকা ব্যস্ত হয়ে লিখলো, “না, না, অবশ্যই দেবেন।”

“কিন্তু হিমালয় আপনাকে আঘাত করতে চাই না।”

“আরেহ, এভাবে কেন বলছেন? এটা তো জাস্ট গল্প। আমি মেনে নিতে পারবো।”

“পারবেন না।”

অরুণিকা মলিন মুখে লিখলো, “এখন কি আর গল্প পাঠাবেন না আমাকে?”

“কেন পাঠাবো না? তবে আমি চাইবো, গল্পে দিগন্ত নামক পুরুষ চরিত্রের জায়গায় আপনি এমন কাউকে কল্পনা করবেন, যাকে আপনি খুব অপছন্দ করেন। আর নারীর চরিত্রে নিজেকে কল্পনা করবেন।”

অরুণিকার চোখের সামনে মুহূর্তেই ভেসে উঠলো আহনাফের চেহারা। হিমালয় লিখলো, “এবার দেবো?”

“হ্যাঁ।”

হিমালয় তার গল্পের পিডিএফ পাঠালো। এরপর অরুণিকা পড়তে লাগলো সেই গল্প। গল্পটি দিগন্ত নামক এক ছেলের, অরুণিকার কল্পনায় যার নাম আহনাফ। গল্পের আহনাফ খুব ভালোবাসতো তার অরুণিকাকে। কিন্তু ভাগ্যক্রমে গল্পের অরুণিকা ঘর বাঁধলো অন্য পুরুষের সাথে। অরুণিকার কল্পনায় আপনা-আপনি সেই পুরুষের স্থান নিয়ে নিলো হিমালয়। গল্পটির অরুণিকা ও হিমালয়ের চমৎকার সংসার চলছে, আর আহনাফ দূর থেকে সেই সংসার দেখে কষ্ট পাচ্ছে। অনেক চেষ্টা করেও সে তার প্রেয়সীর ক্ষমা পেলো না। এরপর বেছে নিলো মৃত্যুর পথ। আত্মহননের আগে একটা চিঠি লিখেছিল সে। সেখানে লেখা ছিল-

প্রিয় রিমঝিম,
তোমাকে রিমঝিম কেন বলি জানো? কারণ তোমার আগমনে আমার হৃদয় শ্রাবণ ধারায় সিক্ত হয়ে যায়। তোমার সুধাময়ী সুর আমার বুকের প্রশান্তি বাড়িয়ে দেয়। তোমার একটুখানি স্পর্শে আমার বুকে কাঁপন ধরে, মনে হয় ঘূর্ণিঝড় লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে সেই বুক। নীরবে থরথর করে কাঁপি আমি। তোমাকে ছাড়া তাহলে আমার কি দুরবস্থা হচ্ছে ভেবে দেখো? তোমাকে দিব্যি দেখার শখ আমার এই জন্মে পূরণ হয় নি। সেটা ছিনিয়ে নিলো অন্য কেউ। তোমার সুর শুনি না আর। আমার জীবনের শান্তিটাই উবে গেছে এখন। তোমাকে প্রতিদিন অন্য কারো বাহুতে মাথা রাখতে দেখলেই বুক ফেঁটে যায় আমার। এভাবে বাঁচা সম্ভব না, রিমঝিম। তাই এক রাশ দুঃখ নিয়ে হারিয়ে গেলাম। তোমাকে দেওয়ার মতো কিছুই নেই আমার। অপরাধী আমি। তোমার হাত ধরে তোমাকে আগলে রাখতে পারি নি। পাপী আমি। এই পাপীর প্রায়শ্চিত্তেরও কোনো সুযোগ নেই। আমি তাই তোমাকে আমার শেষ সনেট উৎসর্গ করে গেলাম।

“রিমঝিম আঁখি জোড়ায় ভয়ংকর ঘেন্না,
অন্তরে উঠে কাঁপন, নিস্তব্ধ রাতেরা পুড়ে ছাই।
জানা-অজানার ভীড়ে সত্য যেখানে ফেলনা
কোন ভুলে আমি মিথ্যে নামক পথে হেঁটে যাই?

নিজ ভুলে জমা রয়ে গেল অসমাপ্ত অভিমান
তবুও বাঁচতে চাইছি ছায়ার হাত ধরে
নীলেরা হারিয়েছে, দখল করেছে কালো আসমান
চার দেয়ালেই রোজ তোমার আমিটা মরে।

প্রিয় রিমঝিম, তুমি আমার কবিতা ছিলে
কতো সহজে বিধাতা তোমায় অন্যের করে দিলে,
ভেবো না আমি মরেছি মিছেমিছি
আমি তোমার জীবনের আসা সর্বনাশা মাছি,
যারে তুচ্ছ করে ফেলে দিলে জলে
সে তোমায় দেখে শত শত তারার আড়ালে।”

অরুণিকা ফোনের স্ক্রিন বন্ধ করলো। চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো তার। এই মুহূর্তে তার আহনাফকে খুব মনে পড়ছে। বুক ফেঁটে যাচ্ছে গল্পের চরিত্রে আহনাফকে কল্পনা করে। হিমালয়ের মেসেজ এলো অনেকক্ষণ পর। লিখলো, “কেমন লেগেছে?”

“আপনি কীভাবে বুঝলেন আমি এতোক্ষণ লেখাটাই পড়েছি?”

“আমার বিশ্বাস ছিল। যদি বিশ্বাসের জয় হয়, তবে তো ভালোই।”

“সত্যিই আমি এতোক্ষণ লেখাটাই পড়ছিলাম। প্রধান চরিত্রে অপছন্দের মানুষটিকে রেখেও কোনো লাভ হলো না। এখনও কষ্ট পাচ্ছি। কেন আত্মহত্যা করলো সে?”

“আপনি কি চান সে বেঁচে থাকুক?”

“হ্যাঁ, অবশ্যই। কষ্ট পাক, কিন্তু বেঁচে থাকুক।”

“তবে তাই হবে।”

“কীভাবে?”

“লেখার অংশটা পরিবর্তন করে দেবো।”

“সত্যি? আমার জন্য লেখা পরিবর্তন করবেন আপনি?”

“আপনাকে দুঃখ দিতে পারছি না তাই।”

অরুণিকা হাসলো। এরপর হিমালয়ের সাথে কথা বলে ফোনটা পাশে রাখলো। অস্থিরতা এখনো কাটে নি তার। আহনাফকে সেই চরিত্রে কল্পনা করতে বলে আহনাফের প্রতিই মায়া বাড়িয়ে দিয়েছে হিমালয়। ঘৃণা করেও ঘৃণা করা যায় না, এমন চরিত্র সৃষ্টি করেছে সে। অরুণিকা পাশ ফিরে চোখ বন্ধ করলো। মুহূর্তেই ভেসে উঠলো আহনাফের মুখ। সাথে সাথেই চোখ খুললো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত বারোটা। পা টিপে টিপে বেরিয়ে পড়লো বাসা থেকে। বারান্দা না থাকায় মন হালকা করার জন্য একমাত্র ছাদই তার আশ্রয়স্থল। এতো রাতে কেউ ছাদে থাকবে না ভেবে উঠে পড়লো সে। ভয় আর অস্থিরতা মুহূর্তেই বিষ্ময়ে পরিণত হলো আহনাফকে ছাদে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে দেখে। আহনাফ অরুণিকাকে দেখে সিগারেট ফেলে দিলো তাড়াতাড়ি। নিজেকে সহজ করে বলল, “তুই এতো রাতে?”

গল্পের রেশ এখনো কাটে নি অরুণিকার। সামনের ভয়ংকর মানুষটির প্রতি কোথা থেকে এসে মায়া ভীড় করলো তার মনে। এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি সিগারেট খাও?”

আহনাফ মুখ ঘুরিয়ে বলল, “খাই, হালকা পাতলা।”

“তুমি ভালো হয়ে যেতে পারো না?”

আহনাফ সরে দাঁড়িয়ে বলল, “বেশি কথা বলিস না। চলে যা এখান থেকে।”

“আজব তো! ছাদে এসেছি হাওয়া খেতে। ঘরে দমবন্ধ লাগছিল। তুমি আছো জানলে কখনোই আসতাম না।”

“এখন জেনেছিস তো! চলে যা এবার।”

“তুমি চলে গেলেই পারো।”

“আমি যেতে পারবো না। তুই চলে যা। নয়তো খারাপ কিছু হবে।”

“অদ্ভুত! তুমি আমাকে ওপেনলি থ্রেট দিচ্ছো? আমি করলামটা কি? আচ্ছা, সরি। খাও সিগারেট। আমার সমস্যা নেই।”

এই বলে অরুণিকা ছাদের অন্যপাশে গিয়ে দাঁড়ালো। আহনাফ চোখ বন্ধ করলো। জোরে জোরে শ্বাস ছাড়লো সে। জোর গলায় বলল, “অরু, এখান থেকে নেমে যা, প্লিজ।”

অরুণিকা অবাক হয়ে তাকালো আহনাফের দিকে। আহনাফের চোখ দু’টি লাল হয়ে আছে। অরুণিকা বিড়বিড় করে বলল, “জোম্বি হয়ে গেল না-কি!”

অরুণিকা ভয় পেলো। তবুও আহনাফের কাছে এগিয়ে আসতেই দেখলো মাটিতে হঠাৎ একটা খালি প্যাকেট পড়লো। অরুণিকা প্যাকেটটা তুলে আহনাফকে বলল, “এটা এই মাত্র তোমার হাত থেকে পড়েছে।”

আহনাফ ছোঁ মেরে প্যাকেটটি নিয়ে লাইটার দিয়ে জ্বালিয়ে দিলো। অরুণিকা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আহনাফের দিকে। আহনাফ হুট করে অরুণিকার কোমড় জড়িয়ে ধরে বলল, “এভাবে শার্ট গায়ে কেউ ছাদে আসে?”

“অদ্ভুত! ছাড়ো আমাকে। এভাবে ধরেছো কেন?”

আহনাফ হুট করে অরুণিকার ঘাড়ে মুখ গুঁজলো। অরুণিকা থরথর করে কাঁপছে। আহনাফের উন্মাদ আচরণে চোখ মুহূর্তেই অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো তার। আহনাফকে ছাড়ানোর জন্য জোরাজুরি করতেই আহনাফ তার চুল খামচে ধরলো। হিংস্র কন্ঠে বলল, “তোকে কে বলেছে ছাদে উঠতে? মরতে এসেছিস? দাঁড়া তোকে মৃত্যু দেখাবো আমি।”

এই বলে আহনাফ অরুণিকাকে ছাদের রেলিঙের কাছে নিয়ে গেলো। গলা চেপে ধরে বলল, “মরতে চাস?”

অরুণিকা কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বলল, “তুমি পাগল হয়ে গেছো।”

আহনাফ অরুণিকাকে টেনে এনে তার ঘাড়ে কামড় বসিয়ে দিলো। অরুণিকা আহনাফের চুল খামচে ধরলো। আহনাফ ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে অরুণিকাকে ছেড়ে দিলো। অরুণিকা সেই সুযোগে কনুই দিয়ে আহনাফের বুকে জোরে ঘুষি মারলো। আহনাফ বুকে হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়লো। অরুণিকা হতবিহ্বল হয়ে ছাদ থেকে নামতে যাবে, তখনই আরাফের সাথে ধাক্কা খেলো। অরুণিকা আরাফের হাত ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। আরাফ আহনাফকে মাটিতে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে, অরু?”

অরুণিকা ফুঁপিয়ে বলল, “ও একটা জানোয়ার। ও আমার সাথে নোংরামি করতে চাইছিল।”

আহনাফ ছাদের গেটের দিকে তাকালো। আরাফকে দেখে নিজেকে স্বাভাবিক করে উঠে দাঁড়ালো। আরাফ অরুণিকার হাত ধরে বলল, “তুই চুপচাপ ঘরে যা। এতো রাতে তোকে কে বলেছে ঘর থেকে বেরুতে? বেক্কেল মেয়ে। থাপড়ানো উচিত তোকে।”

অরুণিকা আরাফকে ধাক্কা দিয়ে বলল, “এখানেও আমার দোষ? তোমাদের চোখে আমি বেক্কেল, আমাকে থাপড়ানো উচিত, আমিই খুনি। আর ওই আহনাফ তো ফেরেশতা। যাও কোলে নিয়ে বসে থাকো তোমার ভাইকে।”

এই বলে অরুণিকা নেমে পড়লো নিচে। আরাফ আহনাফের কাছে আসতেই আহনাফ ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “আমি বুঝতে পারি নি, কি করেছি। দোষটা আসলে আমার। আমিই কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলেছিলাম।”

“তোর এই এগ্রেসিভ বিহেভিয়ারের কারণ কি জানিস?”

“কি?”

“তুই গত পাঁচ বছর ধরে এক ওয়াক্ত নামাযও পড়িস নি।”

আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে তাকালো আরাফের দিকে। আরাফ বলল, “এভাবে তাকাচ্ছিস কেন?”

“আমি নামায পড়বো সময় হলে।”

“তুই কি নেশা করছিস?”

“অদ্ভুত প্রশ্ন করছিস!”

“কারণ তোর আচরণ স্বাভাবিক না।”

আহনাফ বিরক্ত হয়ে পড়লো আরাফের কথায়। হনহনিয়ে নিচে নেমে পড়লো। আরাফও একটুপর নামলো। তাহমিদ তাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, “কোথায় ছিল ও?”

“ছাদে।”

“মারাত্মক তো ছেলেটা! আমরা রুমে বসে আছি, তাই ছেলে ছাদে উঠে গেছে।”

আরাফ হতাশ কন্ঠে বলল, “অরুর সাথে জোরাজুরি করছিল।”

“অরু এতো রাতে ছাদে কেন গেছে?”

“নিজের দুঃখ ডাকতে!”

“এখন কি করবি?”

“ওকে টেনেটুনে নামাজে নিস কালকে।”

“নামাজ হবে ওর?”

“জানি না। অন্তত গিল্ট যদি হয় আর কি!”

“ও তো জানেই না ও কি নিচ্ছে।”

“আগে এসব বন্ধ করতে হবে। ও নিজেকে এতোটুকু নিয়ন্ত্রণ করছে অনেক বেশি। এমন ড্রাগস নিলে মানুষ অনেক বড় ক্রাইম করে ফেলে।”

“আমরা তো ওয়েট করতে পারবো না এমন কিছুর। ও ড্রাগসগুলো কোথায় রেখেছে সব বের করতে হবে। ওকে যদি কিছুদিনের জন্য কোথাও পাঠানো যেতো, তাহলে ওর রুমের তালা ভেঙে সব চেক করা যেতো।”

আরাফ বলল, “বাড়িতে একটা বিয়ে আছে সামনে। ওখানে যাচ্ছি আমরা সবাই। আমাদের মধ্যে কেউ এখানে থেকে যদি আহনাফের রুম তল্লাশি করতে পারে, ড্রাগস পেয়ে যাবে।”

“যদি সব ব্যাগে ভরে নিয়ে যায়?”

“এতো সহজ! আমি দাঁড়িয়ে ওর ব্যাগ বাঁধবো। দেখি কীভাবে নেয়!”

চলবে-