#উন্মাদিনী
#পর্বঃ১
#লেখিকা_দিশা_মনি
১.
“কতদিন আর এই পাগলীকে নিয়ে সংসার করবি? এবার একটা ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে করে নে।”
নিজের মায়ের মুখে এমন কথা শুনে তাজিব থমকে গেল। সবেমাত্র খেতে বসেছিল সে। কিন্তু খাবার আর তার গলা দিয়ে নামলো না৷ একটু দূরেই মেঝেতে গুটিশুটি মেরে পুতুল নিয়ে বসে থাকা নিজের স্ত্রী স্পৃহার দিকে তাকিয়ে তাজিব বলে উঠল,
“মা, তোমাকে আমি আগেও বলেছি আজ আবারো বলছি পরের বার আর এই বিষয় নিয়ে কথা বলবে না। আমি শুধু স্পৃহাকে ভালোবাসি আর ওকে ছাড়া অন্য কারো কথা ভাবতেই পারি না।”
বলেই সে উঠে দাঁড়ালো। এদিকে নিজের ছেলের বলা কথাটা একদম পছন্দ হলো না তানিয়া বেগমের। তাই তো তিনি বলে উঠলেন,
“এখন তো তোর আমার কথা বিষ লাগবেই। কিন্তু একদিন ঠিকই বুঝতে পারবি। এই পাগলীকে নিয়ে আর কতদিন সংসার করবি? এই সংসারটা টিকিয়ে রেখে লাভটাই বা কি পাবি? আর তুই কি বুঝবি আমার জ্বালা, সারাটা দিন তো অফিসেই থাকিস। আমাকেই সারাদিন এই পাগলীটার বোঝা বয়ে নিয়ে বেড়াতে হয়।”
নিজের মায়ের কথা শুনে তাজিবের ভীষণ রাগ হলো৷ তবুও সে নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে বললো,
“তোমার যদি স্পৃহাকে সামলানো নিয়ে এতটাই সমস্যা থাকে তাহলে আমি ওর জন্য আলাদা কোন আয়া ঠিক করব। আর এমনিতেও, আমি সবটাই জানি। স্পৃহাকে নিয়ে তোমায় মোটেও তেমন সমস্যা পোহাতে হয় না। আমি অফিসে যাওয়ার পর তুমি সারাটা দিন স্পৃহাকে রুমে বন্দি করে রাখ।”
তানিয়া বেগম তাজিবের কথাটা শোনামাত্রই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বললেন,
“এই কথা তোর কানে কে তুলেছে? নিশ্চয়ই ঐ পাগলীটা। এজন্যই বলে, জাতে মাতাল তালে ঠিক। বেশ করি, ঘরে বন্দি করে রাখি। তোর পাগলের সাথে সংসার করার শখ তুই কর আমি কেন ওর জ্বালা সহ্য করব? এসব পাগলের কোন বিশ্বাস আছে নাকি? কোনদিন জানি আমার উপর আক্রমণ করে বসে।”
“আজ অব্দি কখনো কি স্পৃহা তোমার উপর আক্রমণ করেছে মা? তাহলে এসব কথা উঠছে কেন?”
তানিয়া বেগম আর কিছু বলবেন এমন সময় হঠাৎ করে স্পৃহা ছুটে এসে তাজিবকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“বন্ধু..তুমি এসো আমার সাথে আমার পুতুলের না আজ বিয়ে দেব৷ একা হাতে কিভাবে সব সামলাই। তাই তুমি এসে একটু আমায় সাহায্য করো।”
তানিয়া বেগম রাগী কন্ঠে বলে ওঠেন,
“হ্যাঁ, ঐ পুতুলের সংসারই করো সারাজীবন। নিজের সংসার তো ভাসিয়ে দিয়েছ। পাগলী কোথাকার।”
তাজিব রাগী কন্ঠে বলে ওঠে,
“মা, প্লিজ। তোমাকে বলেছি না ওর সাথে এভাবে কথা না বলতে।”
“তুই এই মেয়েটার জন্য আমার সাথে রাগারাগি করছিস।”
স্পৃহা হাততালি দিয়ে বলে ওঠে,
“বেশ হয়েছে। তুমি এই পচা আন্টিকে আরো বেশি করে বকে দাও তো বন্ধু৷ তুমি জানো, এই পচা আন্টি সবসময় আমায় বকে।”
“তবে রে..”
বলেই তানিয়া বেগম স্পৃহার দিকে এগিয়ে আসতে নেন এমন সময় তাজিব তাদের মাঝখানে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
“স্পৃহা তুমি যাও তোমার পুতুলের বিয়ের আয়োজন করো আমি আসছি।”
স্পৃহা বাধ্য মেয়ের মতো চুপচাপ গিয়ে আবার ফ্লোরে বসে পড়ে পুতুল নিয়ে। তানিয়া বেগম তাজিবের উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“দেখলি মেয়েটার ব্যবহার। কিভাবে আমার সাথে কথা বলছে। এরপরও তুই ওর হয়ে কথা বলবি?”
তাজিব বলে,
“স্পৃহার নাহয় মানসিক সমস্যা আছে..কিন্তু তুমি তো একদম ঠিক আছ মা। স্পৃহাকে আমি কিভাবে কি বলি যেখানে তুমি একদম সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ হয়েও অস্বাভাবিক আচরণ করছ।”
“তাজিব!”
“আমি আর ঝামেলা চাই না,মা। স্পৃহাকে নিয়েই আমি সুখে আছি। আর এই কথা আজ তোমায় আমি স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলাম। আশা করি, এরপর আর কখনো তুমি আমার দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে কোন কথা তুলবে না।”
বলেই তাজিব কিছুটা দূর এগিয়ে গিয়ে স্পৃহার সাথে বসে পড়ে। তার খেলায় সঙ্গী হয়। দূর থেকে এদৃশ্য দেখে তানিয়া বেগমের গায়ে যেন ফোস্কা পড়ে। তিনি দাঁত কড়মড় করতে করতে নিজের রুমে যান। অতঃপর নিজের মেয়ে তোহাকে ফোন করেন। কিছু সময় পর তোহা ফোনটা রিসিভ করেই বলে,
“হ্যাঁ, মা। বলো কি খবর? ভাইয়াকে দ্বিতীয় বিয়েতে রাজি করাতে পারলে?”
তানিয়া বেগম কাদো কাদো স্বরে বললেন,
“বাদ দে তোর ভাইয়ার কথা। যে নিজের ভালো বোঝে না তাকে আমি কি বোঝাব? তুই আমাকে এখান থেকে তোর বাসায় নিয়ে চল। নাহলে এই পাগলীর সাথে থাকতে থাকতে আমিও না পাগল হয়ে যাই।”
তোহা বলে,
“উফ মা, একটু ধৈর্য ধরো। এতো অধৈর্য হলে চলবে না। ঐ পাগলীকে ভাইয়ার জীবন থেকে তাড়াতেই হবে। নাহলে তো আমাদের সংসারে শান্তি আসবে না।”
“শান্তি আর কিভাবে আসবে? কত শখ করে ছেলের বিয়ে দিয়েছিলাম। কত ইচ্ছা ছিল বছর ঘুরতে নাতি-নাতনির মুখ দেখব। শেষ বয়সে একটু বউয়ের হাতে সেবা-টেবা পাব। সে আর হলো কই। বিয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতে আমার ছেলের বউ এক্সিডেন্ট করে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে পাগলী হয়ে গেল। এখন সেবা পাওয়া তো দূরের কথা তার সেবা করতে করতে আমার জীবন ওষ্ঠাগত।”
“সেটাই মা। তোমার কষ্টটা আমি বুঝতে পারছি। বাবার মৃত্যুর পর তুমি কত কষ্টে আমাদের দুই ভাই-বোনকে মানুষ করেছ। এই বয়সে এসে তো তুমিও একটু সুখ ডিজার্ভ করো।”
“একমাত্র তুই আমার কষ্টটা বুঝিস তোহা। নাহলে তোর বড় ভাই তো নিজের পাগলী বউ নিয়ে আদিখ্যেতা করে কুল পায়না। এখন আবার শুনছি,বউয়ের জন্য আয়া রাখবে।”
“সিরিয়াসলি মা? আয়া রাখা মানে তো খরচ বাড়া। উফ,এই পাগলীটা তো সংসার জ্বালিয়ে রেখে দেবে দেখছি।”
“তা নয়তো আর বলছি কি। এমনি এমনি কি আর ওকে তাড়াতে চাই। আমার ছেলেটা করে তো ঐ ক”টা টাকা বেতনের চাকরি যা দিয়ে সংসার চালানো, ঐ পাগলীর চিকিৎসার খরচ করতে হয়। তার উপর আবার যদি আয়ার খরচ যোগ হয় তাহলে তো ভিটেমাটি হারিয়ে পথে বসতে হবে।”
“এজন্যই তো আমি ভেবেছিলাম যে একটা ভালো মেয়ে দেখে ভাইয়ার বিয়ে দেব। তারপর ঐ পাগলটাকে পাগলাগারদে পাঠাবো। কিন্তু ভাইয়া নিজের ভালো না বুঝলে আর কি করার।”
“সেটাই। কিন্তু আমিও তানিয়া বেগম৷ এত সহজে হাল ছাড়বো না৷ এই পাগলীকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দম নেবো বলে দিলাম।”
বলেই একটা নৃশংস চাহনি দেন।
★★
তাজিব স্পৃহার সাথে বসে বসে পুতুল খেলছিল। স্পৃহা আজ অনেক খুশি কারণ তার প্রিয় পুতুলের বিয়ে হচ্ছে। তাজিব অপলক তাকিয়ে স্পৃহার বাচ্চামিগুলো দেখছে। স্পৃহা তার মেয়ে পুতুলকে বলছে,
“এই মেয়ে কবুল বল..কবুল না বললে কিন্তু তোকে অনেক মারব আমি। কবুল বল..”
কথাগুলো শোনামাত্রই তাজিব হঠাৎ করে তার হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নেয়। অতীতের কিছু বাজে স্মৃতি তার মানসপটে ভেসে ওঠে। তাই সে অস্বাভাবিক ঘামতে শুরু করে ও জোরে শ্বাস নিতে থাকে। স্পৃহা খেলার মাঝেই সেটা খেয়াল করে বলে,
“কি হয়েছে বন্ধু? তোমায় এমন লাগছে কেন?”
তাজিব রুমাল দিয়ে নিজের ঘাম মুছে নিয়ে বলে,
“কিছু না…”
অতঃপর সে স্পৃহাকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,
“শোনো, বন্ধু। তুমি না গুড গার্ল তাই আমার একটা কথা মন দিয়ে শোনো। মায়ের সাথে আর কখনো খারাপ ব্যবহার করবে না আর তাকে পচা আন্টি বলে ডাকবে না। মা বলে ডাকবে। এসব ব্যাড ম্যানারস। বুঝলে?”
স্পৃহা মাথা নাড়িয়ে বলে,
“আমি ওনাকে মা বলে ডাকলে উনি রেগে যান। এর আগে একদিন আমায় মারতেও এসেছিল..জানো সেইসময় আমার খুব ভয় হচ্ছিল। মনে হয়েছিল যে,আমি বোধহয় মার খেয়ে স্টার হয়ে যাব। যেভাবে আমার মম স্টার হয়ে গেছে।”
স্পৃহার কথাটা শোনামাত্রই তাজিব তাকে নিজের বুকে টেনে নিয়ে বলে,
“একদম এসব কথা বলবে না। আমি থাকতে কেউ তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। তোমার উপর দিয়ে কোন বিপদকে যেতে হলে সেই বিপদকে আগে আমায় স্পর্শ করতে হবে।”
বলেই সে স্পৃহার কপালে হামি দেয়। স্পৃহাও একটা হামি দেয় তাজিবের কপালে। আর বলে,
“আমার খুব ঘুম পাচ্ছে বন্ধু। আমায় একটা ঘুমপাড়ানি গান শোনাবে?”
“বেশ, তুমি রুমে চলো আমি তোমায় ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি।”
“আচ্ছা।”
বলেই তারা রুমের দিকে রওনা দেয়।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨