উপসংহার পর্ব-০৬

0
38

#ধারাবাহিক গল্প
#উপসংহার
পর্ব – ছয়
মাহবুবা বিথী

বুবু স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে এটা ভেবেই আমার ভালো লাগছে। সেদিন ফোনে বুবুর সাথে কথা হলো। বছর খানিক পর বুবুর গলাটা শুনতে পেলাম। বুবু কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—-তোর এই ঋণ আমি কোনোদিন শোধ করতে পারবো না। তোর কারনে আম্মা আমাকে মেনে নিয়েছে। তবে কি জানিস ওখানে আর কিছুদিন থাকলে আমি মনে হয় মরেই যেতাম।
—-ও কথা কেন বলছো বুবু? ফয়সল ভাই তোমাকে অনেক ভালোবাসে।
—কষ্টে থাকলে ভালোবাসাটা বিষের মতো লাগে। ফয়সলের সাথে আমার দিনরাত্রির চব্বিশঘন্টার মধ্যে চারপাঁচঘন্টা আমরা একসাথে থাকতাম। তাও সেটুকু সময় ঘুমানোর সময়।
—-কেন? বাকি সময় তোমাদের দেখা হতো না?
—-না,ফয়সল খুব ভোরে উঠে নাস্তা করে ওর বাপের আড়তে চলে যেতো। আর আমি ঐ যে রান্না ঘরে ঢুকতাম বের হতাম রাত বারোটায়। চেয়ারম্যানের বাড়ি বলে কথা। সারাদিন বিভিন্ন ধরণের মানুষের আশা যাওয়া লেগেই থাকে। তাদের চা নাস্তা আমাকেই তৈরী করে দিতে হতো। তার সাথে তিনবেলার রান্নার যোগাড় করা মেহমান অতিথী আমাকেই সামলাতে হতো।
—-আমি তো শুনেছিলাম,ওদের রান্নার লোক ছিলো।
—-হা ছিলো,তবে আমি ও বাড়িতে যাওয়ার পর আমার শ্বশুর বিদায় করে দিয়েছে।
—-কেন?
—-কারণ ফয়সল তো কামাই রোজগার করে না তাই আমাদের দুজনকে গতর খাটিয়ে খেতে হবে। তাছাড়া আমি তো আর রাজার ঘরে জন্ম নেই নাই যে সংসারের এই ধকল সইতে পারবো না। গরীবের মেয়ে আমি যা সওয়াবে তাই সহ্য করা সম্ভব হয়।
—-তোমার শাশুড়ী মা প্রতিবাদ করে না?
—–না, কারণ উনার কথার কোনো দাম ঐ সংসারে নাই।সত্যি মিথ্যা যাচাই করে দেখিনি তবে শুনেছি আমার শ্বশুরের নাকি একজন রক্ষিতা আছে। সে কারণে আমার শাশুড়ী মাকে উনি ব্লাকমেইল করেন। উনার কথা না শুনলে ঐ রক্ষিতাকে উনি স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে ঘরে তুলবেন। আর উনাকে তালাক দিবেন। সে কারণেই শাশুড়ী মা কোনো প্রতিবাদ করেন না। আমার শাশুড়ী মা গরীব ঘরের সন্তান। শুনেছিলাম উনাকে নাকি গুন্ডা দিয়ে তুলে এনে আমার শ্বশুর বিয়ে করেছিলেন।
—-তারপরও উনি রক্ষিতা পুষেন।
—-হুম, দশ বছর আগে টিউমার হওয়ার কারনে আমার শাশুড়ী মায়ের জরায়ু ফেলে দেওয়া হয়। তারপর থেকে আমার শ্বশুরও বদলে যেতে থাকে। আর রাজনীতিতে উনার যত উত্থান হতে থাকে জগতের তাবত বদভ্যাসগুলো উনি আয়ত্ব করতে থাকেন। আর আমার শাশুড়ী মা গরীব ঘরের মেয়ে ছিলেন বিধায় সবই মেনে নিতে বাধ্য হন। তছাড়া উনার বাবা মা বেঁচে নেই। একমাত্র ছোটো ভাই সেও আমার শ্বশুরের দয়া দাক্ষিনে চলে। সুতরাং আমার শ্বশুরের তো পোয়া বাড়ো।
ফোনটা রাখার পর মনে মনে ভাবলাম,কথাটা একদম সত্যি। গরীবঘরের সুন্দরী মেয়েকে বউ করে আনলে শ্বশুরবাড়ির মানুষগুলো এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বামী ব্যক্তিটিও ফায়দা লুটে নিতে পিছপা হয় না। যেমন আমার স্বামীর লাম্পট্য তো আমাকে হজম করে নিতে হচ্ছে। এই তো গত সপ্তাহে মুশফিক রত্নাকে নিয়ে কক্সবাজার ঘুরে এলো। শুধু যাওয়ার সময় বলে গেল আমি যেন ওর মাকে এসব না জানাই। এতে নাকি আমারই অসম্মান হবে। কেননা আমি আমার স্বামীকে ধরে রাখতে পারিনি। আমি অবাক হয়ে মুশফিকের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম,”একে তো চোর তার উপর সিনা চোর।” আমি অবশ্য শাশুড়ী মাকে বলেছি,মুশফিক ভার্সিটি থেকে শিক্ষা সফরে গিয়েছে।
মানুষ কি করে এতোটা নির্লজ্জ হতে পারে? চোখের দিকে তাকিয়ে নিজেদের পাপ কাজগুলোকে জায়েজ করে নেয়। এদেরকে ধর্মীয় জ্ঞান একদমই নাই। নাকি এদের পরিবারে এসব বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয় না? এমন ভাব করছে এটা যে ওরা যেনা করছে সেটা যেন জানেই না। কিংবা জেনেও নিজেদের এসব অবৈধ কর্মগুলোকে সমাজে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বৈধ করে নিতে চাচ্ছে। অথচ এই যেনার কারনে আল্লাহপাক হাশরের ময়দানে কঠিন শাস্তি দিবেন তা কোরআনুল কারীমে উল্লেখ করেছেন। যাক আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে হেদায়াত দান করুন।
শাশুড়ী মা কিছুটা সুস্থ হয়ে যাওয়াতে আমাকে ঠেলে মুশফিকের রুমে পাঠিয়ে দিলেন। আমার বড় অস্বস্তি লাগে। কিম্তু কিছু করার নেই। আমি ডিভানের উপর গুটিশুঁটি মেরে শুয়ে থাকি। পাশাপাশি আমার শাশুড়ী মা ভয়ানক স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন। আমি তার ঘর ভর্তি করে নাতি নাতনী জন্ম দিবো।
এরমাঝে একটা ভয়ানক ঘটনা ঘটলো। আমার দুলাভাই মানে ফয়সল ভাইকে কে বা কারা পিটিয়ে আধমরা করে বিলের ধারে ফেলে রেখেছে। শয়তান চেয়ারম্যান পুরো দোষটাই চাপিয়ে দিলো আমার আম্মার উপর। উনার অভিযোগ হচ্ছে আম্মা যেহেতু বুবু আর ফয়সল ভাইয়ের বিয়েটা মেনে নেয়নি সে কারনেই সুযোগ পেয়ে ফয়সলভাইকে মেরে ফেলার জন্য পিটিয়েছে। চেয়ারম্যানের কাছে অভিযোগ পেয়ে থানার ওসি এসে আম্মাকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যায়। এখবর পেয়ে আমি আমার শাশুড়ী মায়ের কাছে হিলি যাওয়ার জন্য অনুমতি চাই। এবং আমার মায়ের বিপদে আমাকে এখন মায়ের পাশে থাকা উচিত সে কথাও তাকে স্মরণ করিয়ে দেই। আমার ননদটা বেশ ভালো। ও খবর পেয়েই আমার শ্বশুরবাড়িতে চলে আসে। এখন সমস্যা হচ্ছে আম্মাকে জামিন করাতে হবে। কিভাবে করবো? কোর্ট কাছারী সম্পর্কে আমার কোনো অভিজ্ঞতা নাই। আমার শাশুড়ী মা মুশফিককে বলছিলেন,আমাকে সাহায্য করার জন্য। কিন্তু সে সাফ জানিয়ে দেয় সে এসবের মধ্যে জড়াতে চায় না। কারণ তার পিএইচডি করতে দেশের বাইরে যাওয়ার ইচ্ছা আছে। এরকম কোর্ট কাছারীর ঝামেলায় পড়লে তার ক্যারিয়ারের সমস্যা হবে।
ওদিকে ফয়সল ভাইকে নাকি রংপুর মেডিকেলে আইসিইউতে রাখা আছে। তার সুস্থ হওয়াটা খুব জরুরী। কেননা তার মুখেই শোনা যাবে আসল ঘটনা। সে সময় আমার নিজেকে খুব অসহায় মনে হলো। আসলে এই জন্যই লেখাপড়া করা দরকার। তখন জাবেদ ভাই মানে আমার ননদ সেঁজুতির হাসবেন্ড পাশে এসে দাঁড়ায়। সে উকিল ঠিক করে আমাকে সাথে নিয়ে খুব ভোরে গাড়ি ভাড়া করে হিলির উদ্দেশ্য রওয়ানা দেয়। পুরোটা পথ আমাকে সান্তনা দিয়ে গেল। খুব ভদ্র আর বিনয়ী মানুষ। এই ল,ইয়ার তাদের ফ্যামিলি ফ্রেন্ড। আমার শাশুড়ী মায়ের যত্নটা আমি খুব আন্তরিকতার সাথে করেছি। আসলে অসুস্থ মানুষের সেবা করলে আল্লাহপাকের সন্তষ্টিও অর্জন করা যায়। সে কারনে সেঁজুতির চোখে মুখে কৃতজ্ঞতা ঝরে পড়ে। সে কারনে হয়তো জাবেদ ভাই হয়তো আমাকে একটু বেশীই সম্মান করে। অথচ মুশফিককে কখনও এটা প্রকাশ করতে দেখিনি। অবশ্য লম্পট মানুষের কাছে এসব নৈতিকতা আশা করা বৃথা। যাইহোক উকিল জামিন করাতে পেরেছে। বিনিময়ে তাকে প্রচুর অর্থ দিতে হয়েছে। এই টাকাটা অবশ্য মুশফিক দিয়েছে। আম্মাকে জামিন করিয়ে বের করে আনলাম। উনাকে খুব নিরব মনে হলো।আমি উনার হাতে হাত রেখে বললাম,
—টেনশন করবেন না আম্মা। আমরা আপনার পাশে আছি।
জাবেদ ভাইও আমার কথায় সায় দিয়ে আম্মাকে সান্তনা দিলেন। এরপর আমরা সবাই মিলে বাড়িতে আসলাম। বুব আম্মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—-আম্মা আমি আপনার কুলাঙ্গার সন্তান। আমার কারনে আজ আপনাকে এতো অপমান হতে হলো।
আম্মা বুবুকে সরিয়ে দিয়ে বললেন,
—-কথায় কথায় চোখের পানি ফেলাটা আমার পছন্দ না।
যাও ওদের খাবারের ব্যবস্থা করো।
একথা বলে আম্মা ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে এসে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিলেন। আমি সত্যি আমাকে দেখে খুব অবাক হই। খুব কঠিন মনের মানুষ। কখনও তার চোখে আমি অশ্রু দেখিনি। সবরকম বিপদে আল্লাহপাকের উপর ভরসা করে শক্ত থাকার চেষ্টা করেন। যাইহোক বুবু ডিম ভুনা, ডাল আর আলু ভর্তা করে আমাদের খাইয়ে দিলো। সব ঝামেলা মিটিয়ে আমরা আবার ঢাকার পথে পাড়ি জমালাম। জাবেদ ভাইকে অনেক ধন্যবাদ জানালাম। উকিল সাহেবকেও ধন্যবাদ জানালাম। উনি পথে নেমে গেলেন। জাবেদ ভাই লজ্জিত হয়ে বললো,
—-ভাবি এটা করা আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সুতরাং ধন্যবাদ জানাবেন না। নিজের মানুষের জন্য ধন্যবাদ প্রযোজ্য নয়। বরং আমি আশা করেছিলাম মুশফিক ভাই আমাদের সাথে আসবেন। যদি ও শাশুড়ী বলে আপনি নিজ দায়িত্ব বোধ থেকে উনার অসুখের সময় সেবা যত্ন করেছেন কিন্তু মুশফিক ভাইয়ের তো মা। সেক্ষেত্রে আপনার মায়ের বিপদে উনার এগিয়ে আসা উচিত ছিলো।
ভোরে শ্বশুর বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। জামিন হয়েছে বলে শাশুড়ী মা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। উনি আমাদের দুজনকে কিছু খেয়ে বিশ্রাম নিতে বললেন। জাবেদ ভাইও অনেক টায়ার্ড। উনি নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লেন। আমরা ভোরের দিকে একটা ভালো রেস্টুরেন্টে খেয়ে নিয়েছি। আসলে ড্রাইভারের একটু ঝিমুনী আসছিলো। সে কারনে রেস্টুরেন্টে গিয়ে পরোটা সব্জি ভাজি, ডিম ভাজি আর ঘণ দুধের চা খেয়েছি। তাই খাওয়ার ঝামেলা আপাতত নেই। আমি রুমে এসে বাথরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে ডিভানে শরীরটা এলিয়ে দিতেই মুশফিক বিছানা থেকে উঠে আমার পাশে এসে বললো,
—-তুমি বিছানায় আরাম করে শুয়ে পড়ো। আমি এখন আর ঘুমাবো না। তাছাড়া আমার সামনে ফাইনাল পরীক্ষা। আমি এখন থেকে হলে থাকবো।
এমনিতেই ওর আচরণে আমার মন মেজাজ দুটোই খারাপ। সে কারণে ওকে আমি বললাম,
—আমাকে নিয়ে আপনার এতো ভাবতে হবে না। তাছাড়া আপনি যদি আমার সাথে সংসার করতে না চান তাহলে আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দেন। আমার এই মিথ্যা সম্পর্কের অভিনয় করতে আর ভালো লাগছে না।
—-হুম,আমার পরীক্ষাটা হয়ে গেলেই তোমার সাথে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলবো। একটা প্লান করেছি।
আমার খুব কৌতুহল হলো। তাই প্লান জানতে জিজ্ঞাসা করলাম,
—-কি ফন্দী এঁটেছেন আমি কি জানতে পারি?
—-হুম আম্মু তো বেবি নেওয়ার জন্য প্রেসার দিচ্ছে। সে কারনে আম্মুকে বলবো তোমার বেবি না হলে আমার কি করার আছে? আম্মু তখন ডাক্তার দেখাতে বলবে। আর অনেক টাকা দিয়ে ডাক্তারের কাজ থেকে একটা প্রেসক্রিপশন করিয়ে নিবো। সেখানে লেখা থাকবে, তুমি বাঁজা। তোমার কখনও সন্তান হবে না। যার ফলে তোমাকে তখন ডিভোর্স দেওয়া সহজ হবে। অবশ্য তোমাকেও ঠকাবো না। অনেক টাকা দিবো। সেটা দিয়ে তুমি আবারও বিয়ে করে নতুন করে সংসার করতে পারবে।
সত্যি মুশফিকের প্লান শুনে আমি সেদিন ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলাম।

চলবে