উপসংহার পর্ব-১১+১২

0
15

#ধারাবাহিক গল্প
#উপসংহার
পর্ব-এগারো
মাহবুবা বিথী

বছর দুই সময় পার হতে চললো। আমার এইচএসসি পরীক্ষার সময় ঘণিয়ে এলো। খুব মনোযোগ দিয়ে লেখা পড়া করতে লাগলাম। আমি বুঝে গিয়েছিলাম, নিজের পায়ের তলার মাটি শক্ত করতে হলে লেখাপড়া ছাড়া আমার আর কোনো বিকল্প নেই। এইচএসসি পরীক্ষা দিলাম। আলহামদুলিল্লাহ জিপিএ ফাইভ পেয়ে পাশ করলাম। এবার এগিয়ে এলো ভর্তি পরীক্ষা। আম্মা দোটানায় ভুগছিলো। আমাকে ভার্সিটিতে পরীক্ষা দিতে দিবে কিনা? শাবাবকে কে সামলাবে? এগিয়ে এলো আমার বুবু। বুবুর তখনও সন্তানাদি না হওয়ার কারণে শাবাবকে চোখে হারাতো। আমিও সে সময় ঐ সুযোগটা নিয়েছিলাম। অবশ্য আমার ছেলের জন্যই নিতে হয়েছিলো। ওকে মানুষ করার জন্য আমি লেখাপড়াটা খুব মনোযোগ দিয়ে করেছিলাম। ভর্তি গাইড কিনে বাসায় পড়া শুরু করলাম। আর ভর্তি পরীক্ষার আগে কোচিং সেন্টারে গিয়ে মডেল টেস্ট দিলাম। মডেল টেস্টের রেজাল্ট খুব ভালো হয়েছিলো। সমস্যা হলো ঢাকায় কিভাবে যাবো? থাকবো কোথায়? অগত্যা কোচিং সেন্টার থেকে ব্যবস্থা করা হলো। বাস ভাড়া করা হলো। আমি একাই দিনাজপুর থেকে কোচিং এর আরো ছেলেমেয়েদের সাথে রওয়ানা দিলাম। সমস্যা হলো প্রতিটা মেয়েই বাবা নয়তো মাকে সঙ্গে এনেছে। আমি একা। কে আমার পাশে বসবে? আমি কোচিং এর ভাইয়াদের বললাম,আমাকে একজন মেয়ের পাশে বসিয়ে দিতে। তারা এখন আমার জন্য মেয়ে কোথায় পাবে। তখনি রাহাত এগিয়ে এসে আমাকে বললো,

—-আপনার যদি কোনো আপত্তি না থাকে তাহলে আমার পাশে বসতে পারেন।

ওর দিকে তাকিয়ে একপলক দেখলাম। কিন্তু আমার আড়ষ্টতা কাটছে না। আসলে পুরুষ মানুষের বিশ্বাস কি? আমার নিরবতা দেখে বললো,
—-আপনি নিশ্চিন্তে আমার পাশে বসতে পারেন।
আর একবার তাকিয়ে দেখলাম। শয়তানী মার্কা চেহারা চোখে পড়লো না। তবে একটা বিষয় ছেলেটা তো আমার ছোটোই হবে। কারণ আমি দুবছর বিরতি দিয়ে আবার পড়াশোনা শুরু করেছি। মনে মনে ঠিক করলাম যদি উল্টা পাল্টা কিছু করে তাহলে আমিও ছেড়ে দিবো না। কিন্তু পরীক্ষার আগে মারপিট করলে পরীক্ষা তো ভালো হবে না।
—+কি অত ভাবছেন? বসতে চাইলে আসুন। নাহলে আমি আমার সীটে গিয়ে বসি।
কোচিং এর এক ভাইয়া এগিয়ে এসে বললো,
—-জবা,রাহাত খুব ভালো ছেলে। তুমি নিশ্চিন্তে ওর পাশে বসতে পারো।
কোনো উপায়ন্তর না দেখে রাহাতের পিছু পিছু গিয়ে ওর পাশের সীটে বসলাম। আমাকে ও জানালার পাশে দিলো। কারণ হিসাবে বললো,ওপাশে বসলে আমার গায়ে ধাক্কা লাগতে পারে। আর একটা বিষয় খেয়াল করলাম, ও এমনভাবে বসলো যেন আমার শরীরে কোনো স্পর্শ না লাগে। বরং আমি মাঝে মাঝে ঘুমন্ত অবস্থায় ওর গায়ে ঢলে পড়ছিলাম। ভীষণ লজ্জা লাগছিলো। আমার ঢলাঢলি দেখে একসময় রাহাত বলেই ফেললো,
—বসার আগে তো এমন একটা ভাব নিচ্ছিলেন আমি যেন এক লুইচ্ছা বেডা। এখন—–
আমার মেজাজটা প্রচন্ড খারাপ হলো। রেগে গিয়ে বললাম,
—-ঘুমের মধ্যে এরকম একআধটু হতেই পারে।
—-তা পারে,কিন্তু এই কাজটা যদি আমি করতাম আপনি আমার বারোটা বাজিয়ে দিতেন। কাল তো আমারও পরীক্ষা। কিন্তু আপনার জন্য দুচোখের পাতা এক করতে পারছি না।
লজ্জা পেয়ে বললাম,
—-ঠিক আছে এবার আপনি একটু ঘুমিয়ে নিন।
না,এরপর আমি আর ঘুমাইনি। সকাল সাতটার মধ্যে বাস টিএসসিতে পৌঁছে গেল। নামার সময় রাহাতের দিকে তাকিয়ে বললাম,
—-আমি আপনার সাথেই ফিরতে চাই।
—-ওকে,নো প্রবলেম। আপনার ফোন নাম্বারটা দিন।
আমার ফোন নাম্বার দিলাম। ওরটাও নিয়ে নিলাম।
আমরা দুজনেই ক ইউনিটের পরীক্ষা দিতে এসেছি। একটু ফ্রেস হয়ে আমি আর রাহাত ফুটপাত থেকেই পুরি আর চা খেয়ে নিলাম। এরপর রুম নাম্বার খুঁজে বের করতে লাগলাম। আমাদের দুজনের সীট পড়েছিলো কলাভবনে। যথাসময়ে পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে দুজনেই বেরিয়ে আসলাম। আমি একটু রাহাতের সাথে উত্তরগুলো মেলাতে চাচ্ছিলাম। কিন্ত ও রাজী হলো না। বললো, এতে নাকি দুজনেরই মন খারাপ হবে। আমার সেইদিনটা আজো মনের স্মৃতিঘরে অমলিন হয়ে আছে। যদিও একটু অস্বস্তি হচ্ছিলো। এভাবে কখনও কোনো ছেলের সাথে আমার ঘোরাফেরা করা হয়নি। ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনের স্ক্রীনে তাকিয়ে দেখি আম্মা ফোন দিয়েছে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলে উঠলেন,
—ঠিকঠাকভাবে থেকো। কোনো অঘটন ঘটিও না। ফোন রাখছি।
আম্মার এই ঢাকা ভার্সিটিতে পরীক্ষা দিতে আসা অপছন্দ ছিলো। তাই বুঝি এভাবে কথা বলবে? আমি সত্যি খুব অবাক হয়েছিলাম। পরীক্ষা কেমন হলো,কি সমাচার,দুপুরে খেয়েছি কি খাই নাই সব বাদ দিয়ে আম্মা কিভাবে পারলেন আমার সাথে এভাবে কথা বলতে? যাক রাহাতকে কিছু বুঝতে দিলাম না। দুপুরে রাহাতই আমাকে ভার্সিটির পাশে নীলক্ষেতে একটা খাবার দোকানে খাওয়ালো। আমাকে বিমর্ষ থাকতে দেখে বললো,
—পরীক্ষা কি বেশী খারাপ হয়েছে?
আসলে পরীক্ষা আমার ভালোই হয়েছে। আম্মার কথাগুলো ভালো লাগেনি। যাইহোক আমি কিছু বলতে যাওয়ার আগেই ও আমাকে বললো,
—এতো মন খারাপ করবেন না। আপনার রিজিক যেখানে বাঁধা আছে আপনাকে সেখানেই যেতে হবে।
—-তা ঠিক।
রাহাতের সাথে সেদিন অনেক গল্প হলো। ওর বাড়ী দিনাজপুর সদরে। বাবার চালের ব্যবসা আছে। দুই ভাই একবোন। মা গৃহিনী। ও সবার বড়। সন্ধা সাতটায় আমরা আমাদের নিদিষ্ট বাসের নিদিষ্ট সীটে গিয়ে বসি।
আমার এতো কষ্ট বিফলে যায় নাই। ভার্সিটিতে চান্স পেয়ে গেলাম। রাহাতও চান্স পেলো। দুজনেই ফিজিক্সে ভর্তি হলাম। কিন্তু সমস্যা হলো শাবাবকে নিয়ে। আমার সমস্যা নয়। কিংবা শাবাবেরও নয়। আসলে আম্মাই শাবাবের উসিলা দিয়ে ঝামেলা শুরু করতে লাগলেন। যদিও শাবাব বুবুর কাছে ভালোই থাকে। ফয়সলভাইও শাবাবকে ভীষণ পছন্দ করে। পরে অবশ্য আসল কাহিনী জানলাম। বুবুর শাশুড়ী চায় না শাবাব ও বাড়িতে থাকুক। উল্টা বুবুর সন্তান হচ্ছিলো না বলে প্রতিদিন বুবুকে গালমন্দ করতে থাকে। এদিকে আম্মারও বয়স হয়েছে। শাবাবকে একা সামলানো তার পক্ষে কঠিন হয়ে যায়। সেকারনেই আম্মা চাইছিলেন আমি যেন দিনাজপুর সরকারী কলেজে অনার্স কমপ্লিট করি। কিন্তু আমার বুকটা ভেঙ্গে যাচ্ছিলো। কত কষ্ট করে আমার এতোটা পথ আসতে হয়েছে। এখন কি তাহলে তীরে এসে তরী ডুববে। আমি এর একটা সমাধানের জন্য নামাজ পড়ে আল্লাহপাকের কাছে ফয়সালা চাইলাম।
এরমাঝে সেঁজুতি ফোন দিলো। শাবাবের খবর নেওয়ার পর সে আমাকে বললো,
—-ভাবি তোমার একটা আমানত আমার কাছে গচ্ছিত আছে।
আমি অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাম কি সেই আমানত?
সেঁজুতি আবার বললো,
—-বুঝতে পারছো না তাই না?
—-তুমি না বললে কিভাবে বুঝবো?
—-তোমার দেনমোহরের পাঁচ লাখ টাকা। ভাইয়া দুবছর আগেই আমাকে দিয়েছিলো। তোমাকে জানাতে সাহস হয়নি। তোমার ব্যাংক একাউন্ট নাম্বার দিলে পাঠিয়ে দিবো।
আমি যেন হাতে আকাশের চাঁদ পেলাম। ঐ মুহুর্তে টাকাটার খুব প্রয়োজন ছিলো। যদিও এই আমি আম্মাকে বলেছিলাম,মুশফিকের মতো নোংরা মানুষের কাছ থেকে আমি দেনমোহরের টাকা নিবো না। আসলে আমরা সবাই সময়ের কাছে বন্দী। হয়তো ঐ সময় আমার কাছে তাই মনে হয়েছিলো। আবার এই সময়ে ঐ টাকাটার বড় প্রয়োজন ছিলো।
আমি ঢাকার মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডে ছোটো বাসা ভাড়া করলাম। আম্মাকে আর শাবাবকে নিয়ে ঢাকায় শিফট করলাম। শুরু হলো আমার আর এক নতুন জীবন। তবে ঐ যে ভর্তি পরীক্ষার সময় রাহাত যে সহযোগিতা শুরু করলো তা চলতেই থাকলো। রাহাতের সহযোগিতায় টিউশন যোগাড় করলাম। এই ঢাকা শহরে একলা মেয়ে মানুষের চলা মুশকিল। তাই প্রতিটি মুহুর্ত রাহাতের সহযোগিতা আমার দরকার হয়ে পড়ে। রাহাতও আমার উপর দুর্বল হতে থাকে। ও আমাকে বিয়ে করতে চায়। শাবাব আর আমার দায়িত্ব নিতে চায়। কিন্তু ওর মতো একটা অবিবাহিত ছেলে একজন বাচ্চাসহ ডিভোর্সী মেয়েকে বিয়ে করবে এটা কোনো বাবা মা মেনে নিতে চায় না। ওর পরিবারও এর বাইরে নয়। সে কারনে ওকেও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে।

চলবে

#ধারাবাহিক গল্প
#উপসংহার
পর্ব-বারো
মাহবুবা বিথী

আমি যখন ফোর্থ ইয়ারে তখন এক ছুটিরদিনে দুপুরে শাবাবকে নিয়ে শুয়ে গল্প করছিলাম। আম্মা পাশের রুমে ঘুমিয়েছিলেন। সেদিন শাবাবের কথাগুলো শুনে মনে হয়েছিলো, ” রক্তের টান বুঝি একেই বলে।” ওকে ঘুম পাড়াচ্ছিলাম। ছোটোবেলায় শাবাব যতদিন স্কুলে ভর্তি হয় নাই ততদিন প্রতিদিন দুপুরে ঘুমানোর অভ্যাস ছিলো। স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর সাপ্তাহিক ছুটির দুদিন ওকে জোর করে ঘুম পাড়াতে হতো। না ঘুমালে খুব দুষ্টমী করতো। আম্মা ছিলেন হাইপ্রেসারের রুগী। ওর দুষ্টমীর ঠেলায় আম্মার ঘুম ছুটে গেলে প্রচন্ড মাথা ব্যথা করতো।যারফলে প্রেসার বেড়ে যেতো। সেদিনও ওকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছিলাম। ওর তখন ছয় বছর বয়স। অথচ কথাগুলো ছিলো বড়দের মতো। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম। আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
—-আম্মু আবার বাবা কে?
আমি প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। ইচ্ছে হলো ওকে বলি, ওর বাবা মরে গেছে।
কিন্তু কেন যেন বলতে পারলাম না। এটা মুশফিকের প্রতি আমার কোনো রকম টান বা মায়া তা নয়। আসলে শাবাবের কথা চিন্তা করেই বললাম,
—-তুমি তো জানো তোমার বাবা বিদেশে আছেন।
—-জানি,কিন্তু আমাকে দেখতে আসে না কেন? সামিউলের বাবাও তো বিদেশে থাকে। কিন্তু ওকে দেখতে ছ’মাস পর পর দেশে আসে। ওর জন্য কতকিছু নিয়ে আসে। চকলেট, রিমোট কন্ট্রোল গাড়ি,আই ফোন আরো কি কি সব বললো। আমি আর শুনিনি। আমার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। জানো মা, বাবার জন্য আমাকে ক্লাসে মিথ্যা কথা বলতে হয়।
আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে হলো,এটুকু বয়সে আমার ছেলে কি মিথ্যা বলে? তাই ওকে জিজ্ঞাসা করলাম,
—-কি বলো?
—-ওরা জানতে চেয়েছিলো,জন্মের পর আমি আমার বাবাকে দেখেছিলাম কিনা?
কথাটা শুনে আমার ওর ক্লাসের বাচ্চাদের উপর খুব রাগ হলো। পরে ভাবলাম,ওদের উপর রাগ করা উচিত নয়। ওরাতো ভুল কিছু বলেনি। স্কুলে ভর্তি করেছি দুবছর হলো এর মাঝে একদিনও ওর বাবা স্কুলে যায়নি। সে কারনে এই প্রশ্নটা করা স্বাভাবিক। শাবাবের দিকে তাকিয়ে বললাম,
—-তুমি কি বলেছো বাবা?
—-বলেছি, দেখেছি। আরো বলেছি,আমার বাবা আমেরিকাতে অনেক বড় জব করেন তাই তার পক্ষে ঘনঘন দেশে আসা সম্ভব নয়।
—-ভালো বলেছো।
এরপরের কথাটা শুনে আমার বুকের ভিতরটা মোঁচড় দিয়ে উঠলো। ও আমাকে মনমরা হয়ে বললো,
—-এ কথা কেন বলেছি আম্মু জানো?
—-কেন?
—-বাবা ছাড়া তো নাকি কারো জন্ম হয় না। শুধু যে সব মায়েদের স্বভাব চরিত্র ভালো না তারা নাকি বাবা ছাড়া সন্তান জন্মদেন।
আমি রেগে গিয়ে বললাম,
—-এ কথা তোমাকে কে বলেছে?
—-সামিউল বলেছে।
আমি ঠিকই বুঝতে পারলাম,ঐ বাচ্চা ছেলের মাথায় এধরনের জটিল কথা উদয় হওয়া সম্ভব নয়। আসলে বাসায় এগুলো নিয়ে অভিভাবকরা গসিপ করে সেখান থেকেই বাচ্চারা শুনে। কারণ কয়েকদিন আগে শাবাবকে স্কুল থেকে আনার সময় সামিউলের মা আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলো,
—-স্কুলে ভর্তির পর থেকে আপনি শাবাবকে আনা নেওয়া করেন। ওর বাবাকে কখনও আসতে দেখিনি।
স্কুলে অবশ্য মুশফিকের সাথে আমার ডিভোর্সের বিষয়টা গোপন রেখে ভর্তি করেছিলাম। সেক্ষেত্রে সেঁজুতি আমাকে সাহায্য করেছিলো। ভর্তির দিন ও সাথে আসাতে প্রিন্সিপাল ম্যাম ভেবেছেন সবকিছু ঠিকঠাক আছে। আসলে এখনও অনেক স্কুলে ব্রোকেন পরিবারের বাচ্চাদের ভর্তি করতে নানারকম বাহানা করে। সে কারনে স্কুলে না জানিয়ে ভর্তি করেছিলাম। শাবাবের ক্লাসের কেউ এই ব্যাপারটা জানে না। আমিও সেদিন সামিউলের মাকে বলেছিলাম,
—-ওর বাবার পক্ষে আসলে খুব বেশী দেশে আসা সম্ভব হয় না।
এরপর থেকে স্কুল ছুটি হওয়ার বেশ পরে আমি শাবাবকে আনতে যেতাম। তখন প্রায় পুরো স্কুল খালি হয়ে যেতো। শাবাবকে দেখে রাখার জন্য প্রতিমাসে দারোয়ানকে কিছুটাকা বখশিশ দিতাম। অবশ্য শাবাবের মুখে কথাগুলো শুনে বুঝেছিলাম আমার ব্যাপারে স্কুলের প্যারেন্টসদের ভালোই কৌতূহল আছে। তবে সেই মুহুর্তে আমি আমার ছেলের চোখের দিকে তাকাতে পারিনি। কেননা আমার সম্পর্কে ও কি ভাবছে কে জানে? আমাকে খারাপ চরিত্রের মা ভাবছে নাতো? পাশাপাশি ওর জন্য ভীষণ মায়া হচ্ছিলো। এটকুন বয়সে ওকে কি জটিল পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়েছে। ওর কথা শুনে মনে হলো, আমার কি তাহলে মুশফিককে ডিভোর্স দেওয়া ঠিক হয়নি? আসলে শাবাব যখন পেটে ছিলো তখন এসব কথা মাথায় আসেনি। আবার খানিক পরে নিজেকেই নিজে সান্তনা দিলাম,চিকিৎসা না করে শরীরে ক্যান্সার নিয়ে বসবাস করা আত্মহত্যার সামিল। বরং ক্যান্সারকে রিমুভ করে রোগমুক্ত নির্মল জীবন কাটানো উচিত বলে মনে করি। এবং বর্তমান পরিস্থিতির সাথে শাবাবকেও মানিয়ে চলা শিখতে হবে। এমন সময় কলিংবেলটা বেজে উঠলো। শাবাবকে বললাম দরজাটা খুলে দিতে। দরজা খুলতেই যে গলার স্বরটা কানে ভেসে আসলো,আমি চমকে উঠলাম। ছ,বছর সময় পার হয়ে গেলেও সেই স্বরটা আমি ভুলিনি। বিছানা থেকে নেমে গুটি গুটি পায়ে দরজার আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালাম।
—- তোমার নাম কি শাবাব?
—-হুম,আপনি কে?
—-তোমার মা বাসায় আছেন?
—-হুম,
—–তোমার মায়ের কাছে জেনে নিও,আমি কে?
মুশফিকের কথা শুনে রাগে আমার শরীরটা জ্বলে গেল। মনে মনে বললাম,শয়তান লোক একটা। ছেলের সামনে এখন ভালো মানুষ সাজা হচ্ছে। বুঝে পাই না মানুষ এতোটা হিপোক্রেসি কিভাবে করে? সেঁজুতির কাছে শুনেছিলাম রত্নার সাথে ডিভোর্সের পর এক আমেরিকান মহিলাকে বিয়ে করেছিলে। এখন আবার কি মনে করে এখানে উদয় হলো। আমি বুঝেছি সেঁজুতির কাছে শাবাবের কথা শুনেছে। বেচারী পাঁচ বছর পর কনসিভ করেছে। আমার সাথে ওর মাঝে মাঝে কথা হয়। ওই আমাকে ফোন দেয়। কলিংবেলের শব্দ পেয়ে আম্মা ততক্ষণে ঘুম থেকে উঠে দরজার কাছে চলে এসেছে। আমাকে আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কৌতূহল বশতঃ দরজার কাছে উঁকি দিয়ে মুশফিককে দেখে বললো,
—-তুমি এতোদিন পর কি মনে করে?
—–শাবাবকে দেখতে এসেছিলাম,
আম্মা একটু বিরক্ত হয়ে বললো,
—–এতো দিন পর তোমার ছেলের কথা মনে পড়লো?
—-আরো আগেই আসতে চেয়েছিলাম,সাহস করে উঠতে পারিনি।
আম্মা শাবাবের দিকে তাকিয়ে বললেন,
—উনি তোমার বাবা হন। ভিতরে আসতে বলো।
শাবাব দরজা আটকে ধরেই বললো,
—-আমাকে এতোদিন দেখতে আসেননি কেন?
মুশফিক ন্যাকামী করে বললো,
—-বড্ড ভুল হয়ে গিয়েছে।
আমি দ্রুত নিজের রুমে চলে গেলাম। তবে উঁকি মেরে মুশফিকের চেহারাটা দেখলাম। বয়সের তুলনায় বেশী বয়স্ক লাগছে। হয়ত তার অনিয়ন্ত্রিত জীবন এর জন্য দায়ী। ও ঘরে এসে সোফায় বসলো।দুই ব্যাগ ভর্তি করে অনেক কিছু এনেছে। শাবাবের দিকে তাকিয়ে বললো,
—-এগুলো সব তোমার জন্য,
শাবাব ব্যাগ দুটো হাতে নিয়ে বললো,
—-এত্তোগুলো জিনিস সব আমার!
—-হুম,সব তোমার।
আম্মাকে দেখলাম কিচেনে কিছু একটা বানাচ্ছেন। হয়ত মুশফিকের জন্য নাস্তা তৈরী করছেন। ঘন্টাখানিক শাবাবের সাথে সময় কাটিয়ে মুশফিক চলে গেল। যাবার আগে শাবাবকে বললো,”কাল ওর ফ্লাইট। শীঘ্রই আবার দেশে আসবে।” শাবাব মাঝখানে একবার আমাকে ডাকতে এসেছিলো। আমি যেতে রাজী হয়নি। ওকেই ওর বাবার সাথে সময় কাটাতে বললাম।
মুশফিক চলে যাবার পর শাবাব ওর জিনিসগুলো খুলে দেখতে লাগলো। আর আমার দিকে খুশী মনে তাকিয়ে বললো,
—-আম্মু কাল স্কুলে কিছু চকলেট নিয়ে যাবো। বন্ধুদের দিয়ে বলবো, আমার বাবা বিদেশ থেকে আমার জন্য নিয়ে এসেছেন।
—-ঠিক আছে নিয়ে যেও।
আমার নিরাসক্ত ভাব দেখে ছেলে আমায় বললো,
—-আব্বু এসেছে তুমি খুশী হওনি আম্মু?
আমি মুচকি হেসে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,
—-তুমি খুশী হয়েছে তো?
—-হুম,
—-তাতেই আমার চলবে।
ওর দিকে তাকিয়ে ভাবলাম,আজকেই ওর বাবার কথা মনে পড়লো। আর মুশফিক ও চলে আসলো। কি সুন্দর ট্যালিপ্যাথি যোগাযোগ।
তবে আমি চাইছিলাম না মুশফিকের কোনো ছায়া শাবাবের জীবনে পড়ুক। কিন্তু উপায় কি? তবে সেসময় আমার বাসায় ফোনের ব্যবস্থা সহজলভ্য না থাকার কারনে মুশফিক শাবাবের সাথে যোগাযোগ করতে পারতো না। আমার একটা মোবাইল ছিলো। তবে সেটা স্মার্ট ফোন নয়।
এদিকে রাহাতও বসে নেই। আমি যেহেতু বিয়েতে রাজী হচ্ছিলাম না সে কারনে প্রায়ই বিকালে এসে শাবাবের সাথে সময় কাটাতে লাগলো। ওর হোমওয়ার্কও দেখে দিতো। আম্মার সাথেও খাতির করার চেষ্টা করতে লাগলো। আম্মার ওষুধ থেকে শুরু করে টুকটাক জিনিষ কিনে আনতে শুরু করলো। সে সময়টাতে আমি টিউশনে থাকতাম।

চলবে