উপসংহার পর্ব-১৪

0
18

#ধারাবাহিক গল্প
#উপসংহার
পর্ব-চৌদ্দ
মাহবুবা বিথী

—-আমি বিয়ে করলে তুমি খুশী হবে?
—–কেন হবো না? বেস্ট ফ্রেন্ডের বিয়েতে সবচেয়ে বেশী আনন্দ করবো। নাচবো গাইবো আরো কতো কি যে করবো।
আমি কথাটা রিফাতকে বললাম বটে কিন্তু মনে হলো বুকের ভিতরটা শত সহস্র খন্ডে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। কষ্টগুলো গলার কাছে জমাট বাঁধতে শুরু করলো। কিন্তু রাহাতকে সেটা বুঝতে না দিয়ে বললাম,
—বিয়ে করবে ভালো কথা। বউকে কিভাবে পালবে? চাকরি বাকরি কিছু হয়েছে তোমার?
—-সেটা হয়েছে বলেই তো বিয়ে করতে চাইছি। একটা কনসালটেন্সি ফার্মে চাকরি হয়েছে। কর্পোরেট জব। খাটুনি একটু বেশী। তবে বেতন মন্দ নয়। বউ বাচ্চা ভালোই পালতে পারবো।
—-তা বউ কি তোমার পছন্দের নাকি আঙ্কেল আন্টি পছন্দ করেছেন?
—-নাহ্ আমার নিজের পছন্দ। মেয়েটাকে আমি অনেক ভালোবাসি। কতো রাত ওকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছি। কবে ওকে নিজের করে পাবো সেই অপেক্ষায় দিন গুনছি।
মনে মনে আমার ওর উপর খুব অভিমান হলো। ভাবলাম এতোই যদি পিরীত ছিলো তাহলে আমার উঠোনে ভীড় জমাতে কেন? আমি তো কোনোদিন তোমায় বলিনি আমায় ভালোবাসতে হবে। রাগে অভিমানে ওর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হলো না।আর কিছু শুনতেও ইচ্ছে হলো না। সেই কারনে ব্যাগ থেকে টিফিন বক্সটা বের করে ওর হাতে দিয়ে বললাম,
—-তোমার জন্য আম্মা পাঠিয়েছে। খেয়ে নিও। আমার একটা জরুরী কাজের কথা মনে পড়লো। এখনি বের না হলে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।
একথা বলে ওকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আমি লম্বা লম্বা পা ফেলে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলাম। মনে মনে ভাবলাম ও হয়তো পিছু ডাকবে। না, সেদিন ও আমায় আর পিছু ডাকেনি। আমিও ভেবে নিয়েছিলাম হয়তো ওর কাছে আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছে। আর নিজের অজান্তে আমার দুচোখ দিয়ে বর্ষার ধারা বইতে লাগলো। শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছতে লাগলাম। কিন্তু এ পানি ঝরছে তো ঝরছেই। মনে মনে বললাম,মরার চোখে এতো পানি কোথায় লুকিয়েছিলো? আপনমনে বললাম,নাহ্ ওর ম্যাসেজে সাড়া দিয়ে আসাটা ঠিক হয়নি। নিজের বোকামীর জন্য প্রচন্ড রাগ হতে লাগলো।

এদিকে আবারো মেঘের গর্জন শুরু হলো। এখুনি মনে হয় আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামবে। সবাই এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে। বৃষ্টিতে না ভেজার জন্য নিরাপদ স্থানে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু আমার কোথাও দাঁড়ানোর ইচ্ছে হলো না। বরং শাড়িটা ভালো করে গুছিয়ে নিলাম। বৃষ্টিতে ভিজলে যেন শরীরের বাঁকগুলো ফুটে না উঠে। আর মনের সুখে কাঁদতে লাগলাম। বৃষ্টির ঢল আর আমার চোখের জল সব মিলে মিশে একাকার। আশেপাশের মানুষগুলো অবাক হয়ে আমাকে দেখছে। আমি যেন চিড়িয়াখানার জীব। আসলে আজ খুব খারাপ লাগছে। আমিও নিজের অজান্তে রিফাতকে ভালোবেসে ফেলেছি। তাই ওর বিয়ের কথা শুনে এভাবে ভেঙ্গে পড়লাম। মনে মনে ভাবলাম, আমার সাথেই কেন এমন হবে? অথচ জীবনের কাছে আমার খুব বেশী কিছু চাইবার ছিলো না। দুরুমের একটা সংসার আর কিছু হাড়ি পাতিল। এই ছোটো স্বপ্নটুকুই কেন বারবার ভেঙ্গে যায়? পাশ থেকে এক রিকশাওয়ালা মামা বললো,
—-আফা আমার রিকশায় আহেন। কোথায় যাবেন পৌঁছে দিবোনে।
আমি হাসি দিয়ে বললাম,
—-না মামা,লাগবে না।বৃষ্টিতে ভিজতে ভালোই লাগছে।
ফোনটা বেজে উঠলো। একটা গাছের আড়ালে গিয়ে মোবাইল ওপেন করে দেখি আম্মু ফোন দিয়েছে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আম্মু বলে উঠলো,
—-তুই এখন কোথায়?
—-বৃষ্টিতে ভিজতেছি।
—-আশে পাশে কোনো রিকশা নাই? একটা রিকশা নিলে তো পারতি।
—-ইচ্ছে করেই ভিজছি।
—-কি বলিস? তোর না চাকরির জন্য কারো সাথে দেখা করার কথা?
—-করেছি,কিন্তু চাকরিটা হবে না। সে কারনেই ভিজতেছি।
—-কি পাগলের মতো আবোল তাবোল বলছিস? তাড়াতাড়ি বাসায় আয়।
আম্মু লাইনটা কেটে দিলো। বেশ কিছুক্ষণ ভেজার পর শীত শীত লাগছিলো। মনে হচ্ছে জ্বর আসবে। হঠাৎ মনে হলো এ আমি কি ছেলেমানুষি করছি? আমাকে তো শাবাবের জন্য সুস্থ থাকতে হবে। পরে একটা রিকশা নিয়ে বাসায় ফেরার উদ্যেগ নেই।

বাসায় ফিরে ওয়াশরুমে গিয়ে দ্রুত গোসল সেরে নেই। কাপড় বদলে ঘরে এসে দেখি টেবিলের উপর কদম ফুলের তোড়া রাখা আছে। হা কদম ফুল আমার খুব পছন্দ। কিন্ত আজ কেন যেন কদম ফুলটাকে কদাকার লাগছে। ঘ্রানটাও জঘন্য লাগছে। মনে হচ্ছে এখুনি বমি হয়ে যাবো। ফুলগুলো যখনি জানালা দিয়ে ফেলতে যাবো অমনি শাবাব এসে বলে,
—-আম্মু ফুলগুলো ফেলে দিও না। আমার প্রিয় একজন মানুষ ফুলগুলো দিয়েছে।
মনটা এতোটাই বিষন্ন ছিলো যে জানবার ইচ্ছে হয়নি প্রিয় মানুষটা কে? এর মাঝে যোহরের আযান দিলো। আমি নামাজ পড়ে নিলাম। এরপর দুপুরে খেয়ে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিলাম। এরমাঝে আম্মা এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
—-যদি রাগ না করিস তাহলে তোকে একটা কথা বলি।
এমনিতেই মন মেজাজ খারাপ। তাই একটু বিরক্ত হয়ে বললাম,
—–জানোই যদি কথাটা শুনলে আমার রাগ হবে তাহলে বলার দরকার কি?
—- তুই আমার সাথে এভাবে কেন কথা বলছিস?
—-আম্মা আমার মন মেজাজ ভালো না। কি বলতে এসেছো তাড়াতাড়ি বলো। আমি একটু ঘুমোবো। খুব শীত শীত লাগছে।
—+এভাবে মাঝ রাস্তায় বৃষ্টিতে ভিজলে নিশ্চয় গরম লাগার কথা নয়। যাক গে সে কথা। আমি বলি কি তুই একটা বিয়ে কর। দেখবি সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। ভালো একটা প্রস্তাব এসেছে।
মেজাজটা আসলেই খারাপ হয়ে গেল। রেগে গিয়ে তেঁতে উঠে বললাম,
—-আমার জীবনটা নষ্ট করার পরেও আপনার সাধ মেটেনি। এখনও যেটুকু অবশিষ্ট আছে সেটাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারতে চাইছেন?
আমার রুদ্র মূর্তি আর কথার তীব্রতা যেন আম্মা সইতে পারলেন না। তাই আমার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আম্মা চলে যাবার পর আমার হুঁশ হলো। কেন আম্মার সাথে এভাবে কথা বললাম। বুকের ভিতরটা মোঁচড়াতে লাগলো। আম্মা চলে যাবার কিছু পরে বিছানা থেকে উঠে আম্মার রুমে গেলাম। দেখলাম আম্মা কপালের উপর হাত রেখে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। আমি ধীর পায়ে আম্মার মাথার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। কিছুক্ষণ দাঁড়ানোর পর আম্মার সাড়া শব্দ না পেয়ে যখনি ফিরে আসতে চাইলাম অমনি আম্মা বললেন,
—-কিছু বলবি?
—-সরি আম্মা। আপনার সাথে এভাবে কথা বলা উচিত হয়নি।
আম্মা শোয়া থেকে উঠে বসলেন। এরপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
—-আমি কিছু মনে করিনি। তবে——
—-তবে কি?
—–আমি বলি কি, বিয়ে করবি কি করবি না সেটাতো পরের কথা। আগামীকাল ছেলেটার সাথে একবার দেখা করে আসলে কি হয়? ছেলেটা তোর সাথে কথা বলতে চেয়েছে। আমি যেহেতু সিদ্ধান্ত নিয়েছি বিয়ে করবো না সেকারনেই ছেলেটার ডিটেইল নিতে ইচ্ছা হলো না। আমি আগামিকাল একটা টাঙ্গাইলের সাদা শাড়ি পরে রেডী হলাম। আম্মা আমার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হয়ে বললো,
—-এভাবে বিধবার বেশে যাচ্ছিস কেন? তোর কি কোনো ভালো শাড়ি কাপড় নেই?
আমি আর কোনো কথা না বলে বাসা থেকে বের হয়ে একটা রিকশা নিয়ে ঢাকা ভার্সিটির মেট্রোস্টেশনের দিকে রওয়ানা দিলাম। মনে মনে ভাবলাম রেস্টুরেন্ট বাদ দিয়ে ছেলে আমাকে কেন ওখানে যেতে বললো। আমি স্টেশনে পৌঁছে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম। হঠাৎ দেখলাম আমার সামনে স্যুট টাই পড়া রাহাত দাঁড়িয়ে আছে। সবসময় সাদামাটা পোশাকে দেখা রাহাতকে এভাবে স্যুটেট বুটেট দেখে চিনতে পারছিলাম না। অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,
—-তুমি এখানে কেন?
—-আন্টি তোমাকে কিছু বলেনি?
—-বলেছে,পাত্র আমাকে দেখতে চেয়েছে।
—–তুমি জানতে চাওনি পাত্রটা কে?
—–না ইচ্ছে হয়নি,

চলবে