উমা পর্ব-১১+১২

0
544

#উমা [কপি করা নিষেধ]
#১১তম_পর্ব

হাটুগেড়ে নির্বিকারভাবেই বসে রয়েছে উমা। আশা নামক এক চিলতে কিরণও উদয় হচ্ছে না তার বুকে। হয়ত এভাবেই অন্ধকার গহ্বরে থেকে যাবে চিরকাল। শরীর নিস্তেজ হয়ে আসছে। প্রতিবাদ নামক শব্দটা অর্থহীন মনে হচ্ছে। চোখ বুজে আসছে অচিরেই। হয়তো মৃত্যু দ্বারে এসেছে। উমার আক্ষেপ নেই, সে মরতে চায়, তার মুক্তি চাই। হঠাৎ পুরোনো কাঠের দরজাটা খুলে গেলো, দরজা খোলার শব্দে কেঁপে উঠলো উমা। অন্ধকার ঘরে এক চিলতে হলুদ আলো প্রবেশ করলো। বাগানের হলুদ আলো, সন্ধ্যে হয়ে গেছে। না, হয়তো রাত নাকি গভীর রাত। ঠিক সময়টা ঠাহর করতে পারলো না উমা। তার চোখজোড়া কুঞ্চিত হয়ে এলো আলোর তীক্ষ্ণতায়। তাই সামনে প্রবেশকৃত মানুষটার দিকেও ঠিক মতো তাকাতে পারলো না সে। একটা কালো অবয়ব প্রবেশ করলো দরজা দিয়ে। উমার দৃষ্টি যেনো ঝাপসা হয়ে এসেছে। ভয়, ত্রাশ, বিষাদ, বেদনার সংমিশ্রন তাকে শারিরীক ভাবে দূর্বল করে দিয়েছে, হাতটা ফুলে উঠেছে। কাঁচগুলো চামড়ায় বিধে আছে। চিনচিনে ব্যাথাটা অসহনীয় যন্ত্রণা দিচ্ছে তাকে। মানুষটি যখন তার সন্নিকটে এলো তখন একরাশ ঘৃণায় বিষিয়ে এলো মন। মুখ সরিয়ে নিলো পরমূহুর্তে। ঘৃণা করে এই মানুষটাকে। উমার বিষন্ন, বিমর্ষ মুখখানা দেখে ছ্যাৎ করে উঠে রুদের মনটা। এক তীব্র যন্ত্রণা অনুভূত হয় তার। বিকেলের সময় রাগে ক্রোধে অন্ধ হয়েছিলো। তাই তার চোখে ষোড়শীর যন্ত্রণা, বেদনা। নজরে এলে হয়তো এতোটা নিষ্ঠুর হতে পারতো না। অবশ্য রুদ্রের কাছে নিজের কাজের যথার্থ যুক্তি আছে। সে কোনো ভুল কার্য করে নি। রতী এবং নিখিল মিলে উমার সরলতার সুযোগ নিচ্ছে আর উমা সেটাও বুঝতে পারছে না। উপরন্তু তখন মাথা গরম ছিল তার, উমার অপমানটা তার সহ্য হয় নি। হবেই বা কেনো? যে রুদ্রকে অপমান করার সাহস সারা গ্রামের কারোর নেই। অথচ সেই উমা তাকে অপমান করেছে। উমার জায়গায় অন্য কেউ হলে হয়তো খুন ই করে ফেলতো সে। উমাকে
সবচেয়ে হালকা শাস্তি দিয়েছে।

রুদ্র হাটু গেড়ে বসলো উমার সামনে। আলতো হাতে মুখটা ধরতে নিলেই মুখ ফিরিয়ে নেয় উমা। উমার চোখে নিজের প্রতি ভয় এবং ঘৃণাটা যেনো সহ্য হলো না রুদ্রের। এই ভয়টাই দেখতে চেয়েছিলো সে, কিন্তু সেই ভয়টার সাথে ঘৃণার ছাপ থাকবে সেটা কল্পনা করে নি। অবাককর ব্যাপার এই ঘৃণা তাকে আহত করছে। বুকের মাঝে হাজারো সুই চুবছে যেনো। যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে মুখটা চেপে ধরলো তার। রুদ্র হিনহিনে স্বরে বললো,
“তেজ দেখি কমে নি?ভয় লাগছে না?”
“মৃত মানুষের ভয় থাকে না।“

অস্ফূটস্বরে কথাটা বলে উমা। পরমূহুর্তেই তার দৃষ্টি ক্রমশ আধারে ঢেকে গেল। নিস্তেজ শরীরটা মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। উমার মনে হলো ক্রমশ অন্ধকারের প্রবল গহ্বরে ডুবে যাচ্ছে সে। বাঁচানোর কেউ নেই______________

উমার যখন চোখ খুললো তখন নিজেকে রুদ্রের ঘরে আবিষ্কার করলো সে। চোখ খুলতেই আলোর তীব্রতা চোখে জ্বলছে দিচ্ছে। নিজেকে ধাতস্থ করতে বেশ সময় লাগলো উমার। সে অনুভব করলো হাতটা নাড়াতে পারছে না। চিনচিনে ব্যাথাটা প্রচন্ড রুপ নিলো। চোখ ঘুরিয়ে আশেপাশে দেখতেই রুদ্রকে নজরে এলো। উমার স্বাভাবিক দৃষ্টিতেই তাকালো তার দিকে। প্রচন্ড শান্ত দৃষ্টি, যে দৃষ্টিতে নেই কোন রাগ, নেই কোনো দুঃখ, শুধু সুপ্ত ঘৃণা। উমার চোখ খুলতে দেখে এগিয়ে এলো রুদ্র, অস্থির কন্ঠে বললো,
“এখন কেমন লাগছে? দূর্বল লাগছে?”

রুদ্রের অস্থিরতার কারণ বুঝলো না উমা। শুধু অবাক হলো। এই কি সেই ব্যক্তি যে তাকে অন্ধকার রুমে, বিনা খাবার বিনা পানিতে রেখেছিলো? এই কি সে যে তার আর্তনাদ শুনেও না শোনা করে দিয়েছিলো। মানুষ সত্যি পেয়াজের মতো, প্রতি পরদে তার রুপ বদলায়। উমার বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। কোনো উত্তর দিলো না উমা। ইচ্ছে হলো না। নীরবে রুদ্রের পরিবর্তনীইয় রুপ দেখে গেলো সে।

অভিনব সিংহ ফিরলেন শহর থেকে। অবশেষে নিপুন ভাবে সকল কাজ শেষ হলো তার। তার কাজ করার ধরণই আলাদা। একবার কোনো কাজ করতে বসলে সেই কাজের সমাপ্তি না করে শান্ত হয় না সে। গ্রামের চেয়ারম্যান হলেও তার দৌড় গ্রামের পৌরসভায় সীমাবদ্ধ নয়। সে সাতক্ষীরার উচ্চপদস্থ লোকদের সাথে উঠাবসা করেন। সেই বদৌলতে খুব সহজে তার কাজগুলো হয়। অভিনব সিংহ ফিরেই নিজের ছেলেকে ঘরে ডাকলেন। রুদ্র উপস্থিত হতেই খবরের কাগজ ভাঁজ করতে করতে বললেন,
“আমি সব করে এসেছি। এমন ভুল আর যেনো না হয়। কথাটা কি কানে গেলো?”
“জ্বী বাবা, আর হবে না”

নতমস্তকে কথাটা বলল রুদ্র। অভিনব সিংহ পাইপ জ্বালালেন। জমিদার রক্তে পাইপ খাওয়ার অভ্যাসটা রয়েই গেছে। একটা টান দিয়ে বললেন,
“এখানের কি অবস্থা? আমি যাওয়ার পর কোনো কান্ড করো নি তো?”

রুদ্র কিছুক্ষণ চুপ রইলো। বাবার সাথে কথা বলতে সর্বদা একটু অস্বস্থি লাগে তার। উপরন্তু সে এখানে অনেক কিছুই করেছে। বাবা ব্যাপারগুলোকে ঠিক কিভাবে নিবে বুঝতে পারছে না। রুদ্রের দিকে ভ্রু উঁচিয়ে তাকালেন অভিনব সিংহ। ঝাঝালো স্বরে বললেন,
“কি হলো?”
“কিছুই হয় নি বাবা, চিন্তা করবেন না”
“সামনে সপ্তাহে মাল আসছে। বেনাপুলে যেতে হবে। যাবে তুমি”
“আমি কেনো বাবা?”
“আমার একটু গ্রামে থাকা দরকার। মাস্টার জট পাকালো কিনা দেখতে হবে না? এমনেই তোমার জন্য কতগুলো দিন আমার শহরে থাকতে হলো। কেনো কোনো সমস্যা?”

রুদ্র তড়িৎ গতিতে উত্তর দিলো,
“না বাবা, কোনো সমস্যা নেই। আমি কি যেতে পারি?”
“হু”

রুদ্র স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। বের হবার সময়েই অভিনব বাবু বলে উঠলেন,
“বউ তোমার একা না, বউনেটা হয়ো না। ক্ষতি তোমার, তুমি জানো আমার দূর্বলতা পছন্দ নয়। বেশি দুর্বল দেখলে গোড়া থেকেই উপড়ে দিবো”

অভিনব সিংহের কথাটা বুঝতে দেরী হলো না রুদ্রের, সে তাকে ধীর স্বরে বুঝিয়ে দিলেন সময় আসলে উমাকে সরিয়ে দিতে সময় নিবেন না তিনি। অর্থাৎ এখানে কি হয়েছে সকল খবর তিনি পেয়েছেন। রুদ্র উত্তর দিলো না। চুপ করে বেড়িয়ে গেলো।

রান্নাবান্না সেরে নিজ ঘরে ফিরলো উমা। ঘামে গা ভিজে গিয়েছে তার। তুলোর মতো ওজনের মেয়েটি সারাদিন হেসেলেই থাকে। নিখিলের বাড়ি থেকে এই বাড়ির একটা পার্থক্য, এখানে দামী খাবার আর পোষাক জোটে। পুরো স্পিডে ফ্যান চালালো সে। ভাগ্যিস বিদ্যুৎ আছে। খাটে বসে একটু জিরিয়ে নিতে যাবে তখনই…………………

চলবে।

#উমা [কপি করা নিষেধ]
#১২তম_পর্ব

রান্নাবান্না সেরে নিজ ঘরে ফিরলো উমা। ঘামে গা ভিজে গিয়েছে তার। তুলোর মতো ওজনের মেয়েটি সারাদিন হেসেলেই থাকে। নিখিলের বাড়ি থেকে এই বাড়ির একটা পার্থক্য, এখানে দামী খাবার আর পোষাক জোটে। পুরো স্পিডে ফ্যান চালালো সে। ভাগ্যিস বিদ্যুৎ আছে। খাটে বসে একটু জিরিয়ে নিতে যাবে তখনই ফুলির মার আগমন হয়। তাকে ছুটে আসতে দেখে উমা স্বাভাবিক ভাবেই জিজ্ঞেস করে,
“কিছু বলবে ফুলির মা?”
“কত্তা মা ডাকছিলো, রুদ্র দাদারে ভাত বাইড়ে দিতি কইসে। বিকেলে সে গ্রামের বাইরে কামে যাইবে।”

কথাটা শুনে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো উমা। আজকাল মনে ভয় লাগে না তার। বরং সবকিছুই ব্যাঙ্গাত্মক মনে হয়। সেদিনের ঘটনার বারো দিন পেরিয়ে গেছে, মৃত্যু নামক যন্ত্রণা কতটা করুন এবং ভয়ংকর হতে পারে সেটার একটা ঝলক তার পাওয়া হয়ে গিয়েছে। এখন ভয় হয়ে কি লাভ? একটা সময় তো সবার ই মরতেই হবে। সর্বাধিক ভয়ংকর ওইটাই। এর থেকে ভয়ংকর কিছুই হতে পারে না। সুতরাং ভয় পেয়ে মাটি কামড়ে পড়ে থাকার কি আদৌও কোনো মানে আছে? উমা তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো,
“তা তোমার রুদ্রদাদা কি কচি খোকা? যে বেড়ে খাওয়াতে হবে?”

উমার কথায় অবাক হলো ফুলির মা, সাথে বাঁকা হাসিও হাসলো। তারপর বললো,
“এতোদিন থাকিছো, আদিক্ষেতা কত রকম হয় তাতো জানোই। বুঝায় কতি হইবো না। চলো চলো, নয়তো কত্তা মা আবার মুখ ফুলাইবো।”

উমা উত্তর দিলো না। লক্ষী দেবী বেশ মার্জিত বৈশিষ্ট্যের একজন নারী, তিনি কখনোই উমার উপর চেঁচামেচি করেন না। তবে তার যে একেবারেই উমাকে পছন্দ হয় না সেটা বলার অপেক্ষ রাখে না। তিনি সোজা মুখে এই অবধি কখনোই উমার সাথে কথা বলেন নি। উমা এতোটাও অবুঝ নয় যে, লক্ষী দেবীর অসন্তোষ এবং বিরক্তি সে বুঝবে না। উমা নির্লিপ্ত কন্ঠে বললো,
“যাও আমি আসছি”

ফুলির মা চলে গেলে স্নান করে আসলো সে। ভেজা চুল খুলে দিলো যেনো শুকিয়ে যায়। সেও মানুষ, সকাল থেকে হেসেল টেনে সেও ক্লান্ত। তার ক্লান্তি পানির ছোয়ায় মুছে ফেলতে চায় সে। এক দন্ড সময় নিজেকে দিতে চায় সে। সবার জন্য ফাইফরমাশ খাটাটাই তার জীবন নয়। আয়নার সামনে নিজেকে এক নজর দেখে উমা, চোখের নিচে কালচে কালি পড়ে গেছে। মুখে ঔজ্জ্বল্য যেনো মিয়ে গেছে, হাড্ডিসার শরীরটা একটা বাশের কুঞ্চির ন্যায় লাগছে যেখানে শুধু শাড়ি জড়ানো। উমার ঠোঁটে মলিন হাসি ফুটে উঠে। জীবিত থেকেও সে মৃত লাশ যেনো। আচ্ছা মেয়েদের জীবনটা এমন কেনো! প্রশ্নের উত্তর তার জানা নেই, তবে উত্তরটা জানতে বড় ইচ্ছে হয়___________

সিঁদুরটা সিঁথিতে ছুইয়ে নিচে নামলো উমা। টেবিলে খাবার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সবাই বসে আছে উমার অপেক্ষায়। অভিনব সিংহ অনেক পূর্বেই খেয়ে উঠেছেন। তার খাবারের সময় একেবারেই নির্ধারিত। বাকিরা চেয়ে আছে উমার পানে। উমা থামতেই লক্ষী দেবী খানিকটা গম্ভীর স্বরে বললেন,
“স্বামীকে অভুক্ত রেখে সাজসজ্জা করাটা কি কোনো নারীর সাজে? আমি তো দেখী নি বাপু?”

লক্ষী দেবীর ঠেস দেওয়া কথাটা গায়ে বিষের মতো লাগে। উমা কখনো কারোর মুখে মুখে তর্ক করে নি। তাই আজও সে কিছুই বললো না। স্বাভাবিকভাবেই রুদ্রকে খাবার বেড়ে দিলো। লক্ষী বেগমের মুখশ্রীতে বিরক্তি স্পষ্ট। বিরক্তি চেপে বললো,
“ছোট অবুঝ, কিন্তু এতোটাও না যে স্বামী বাহিরে যাবে শুনেও ঘরের মধ্যে বসে থাকো। তা বাপের বাড়িতে কি আর কিছু শেখায় নি? তোমার বাড়ির বড় মেয়ে, গ্রামে তোমার ভালোই চর্চা। এখন তো দেখছি সব ভুয়া।”
“ছেলের তাড়া এতো হলে আপনিও তো বেড়ে দিতে পারতেন মা। বাসি ঘর্মাক্ত কাপড়ে আপনার ছেলেকে খাবার বেড়ে দিলে সেটা কি বেশ শোভা দিত?”

উমার ধীর স্বরে জড়তা হীন প্রশ্নে খানিকটা নড়েচড়ে বসেন লক্ষী দেবী। উমার মুখে কখনো বাড়তি কথা তিনি শুনেন নি। সে শুধু মাটির দিকে তাকিয়ে মাথা কাত করে। অথচ আজ সেই উমা তার মুখের উপর উত্তর দিচ্ছে৷ উমার কন্ঠে রুদ্রকেও চমকে দিলো। মালিনী বাঁকা স্বরে বললো,
“বৌদি, তোমার বউ মা তো মুখে মুখে তর্ক করে!”
“সেই তো দেখছি, বুলি ফুটেছে পাখির বাচ্চার।”

উমা স্মিত হাসি দিয়ে বললো,
“তর্ক কোথায় করলাম পিসি? আমি তো শুধু উত্তর দিলাম।”

লক্ষী দেবী আহত হলেন, চেয়ারম্যান পত্নীকে এই প্রথম কেউ কথার পালটে কথা বলছে। যা তার জন্য হজম করা নিতান্ত কষ্টদায়ক। তিনি আহত কন্ঠে বললেন,
“রুদ্র এই দেখার বাকি ছিলো? আমি কি কিছু ভুল বলেছি?”

মায়ের ধরে আসা কন্ঠ রুদ্রের ভালো লাগলো না। তাই শক্ত কন্ঠে বললো,
“উমা মার কাছে ক্ষমা চাও। তুমি অজান্তেই মাকে অপমান করছো। সে তোমার বড়, ক্ষমা চাও।”
“ক্ষমা করবেন কিন্তু আমি কোনো ভুল কিছু বলি নি। পোকার মতো আর কতদিন বাঁচবো বলুন তো? আমিও মানুষ! আমার ও স্বত্তা আছে। কিন্তু এ বাড়ির লোকেরা তা ভুলতে বসেছে। তাই একটু মুখ খুলতেই হলো”

উমা আর দাঁড়ালো না। সকলকে উপেক্ষা করে হনহন করে উপরে চলে গেলো উমা। নিজের আত্মসম্মান নিজেকেই রক্ষা করতে হয়। আপনি ব্যাতীত কেউ আপনার সম্মান রক্ষার দায়ভার রাখে না। উমার ব্যাতীক্রম আচারণ বেশ কদিন যাবৎ ই লক্ষ্য করছে রুদ্র। এখন আর তার ভেতর জড়তা নেই। আহের ন্যায় চোখে ভীতি নেই। বরং স্বচ্ছ একটা দৃষ্টি। যে দৃষ্টিতে ভয়ের চিল পরিমাণ জায়গা নেই। এমন দৃষ্টি খুব কম লক্ষণীয়। রুদ্র শুধু আরেকটি মানুষের এমন নির্ভীক দৃষ্টি দেখেছিলো। তবে কেনো যেনো সে বিরক্ত নয়, বরং উমার প্রতি তার নেশা যেনো ক্রমশ বাড়ছে। মালিনী হিনহিনে স্বরে বললো,
“বউ এর দেমাগ দেখলি? তোকে ছাড়লো না! কেমন চটাং চটাং কথা কয়ে উপরে চলে গেলো!”
“ওকে বলো না মালিনী, ও তো বউ লেউটা হয়েছে। বউ এর জন্য নিজেকে শুধরাচ্ছে। যাক গে, আমি বুড়ো হয়েছি। এখন এগুলো তো কেনে নিতেই হবে।”

রুদ্রের বিরক্ত লাগছে। খেতে বসে মেয়েমানুষের প্যানপানানি যেনো একেবারেই সহ্য হলো না তার। এক রাশ বিরক্তি নিয়ে অন্নের থাল ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। রাগী স্বরে বললো
“এক দন্ড আরামে খাবো তার ও জো নেই। যতসব অশান্তি”

বলেই উঠে গেলো সে। ভাতের থালায় হাত ধুয়ে উপরে চলে গেলো। রুদ্রের পরিবর্তিত আচারণ দেখে মালিনী তীক্ষ্ণ স্বরে বললো,
“বৌদি, রুদ্রটা যেনো আগের মতো নেই। সেদিন বউ মূর্ছা কি গেলো, ছেলে তোমার বউ এর আঁচল ধরা হয়ে গেলো।”

লক্ষী দেবী কিছু বললেন না, শুধু সরু দৃষ্টিতে রুদ্রের যাবার পানে চেয়ে রইলেন।

ঘরে এসেই উমাকে খুজতে লাগলো রুদ্র। তিনদিনের জন্য বাড়িতে থাকবে না, ব্যাপারটা ভাবতেই বিরক্ত লাগছে। উমাকে ছাড়া এক দন্ড মন বসাতে পারে না কোথাও। এই অনুভূতিটার নাম জানা নেই রুদ্রের। শুধু এটুকু জানে উমাকে তার চাই, প্রতি দিন, প্রতি ক্ষন, প্রতি মূহুর্ত। উমা ব্যাতীত শ্বাস নিতেও তার কষ্ট হয়। মেয়েটা বুকের খাঁচায় আটকে রাখতে পারলে হয়তো খুব ভালো হতো। কিন্তু তা অসম্ভব! কারণ মেয়েটি তার খাঁচায় ধরা দিবে না। সুযোগ পেলেই পালাবে। এমন কি কোনো উপায় নেই যেখানে উমার অবাধ্য মনটাকে নিজের জালে আটকানো যায়। শরীরে রাজত্ব করলেও মনের রাজত্ব পাওয়া যে খুব কঠিন। হঠাৎ গুনগুনের শব্দ কানে এলো রুদ্রের।
“যখন বেলা-শেষের ছায়ায়
পাখিরা যায় আপন কুলায়-মাঝে
সন্ধ্যা পূজার ঘন্টা যখন বাজে
তখন আপন শেষ শিখাটি জ্বালবে এ জীবন
আমার ব্যথার পূজা হবে সমাপন
আমার সকল দুখের প্রদীপ জ্বেলে
দিবস গেলে করব নিবেদন”

রুদ্র ধীর পায়ে বারান্দায় গেলো। হলুদ সবুজ পাতা বিছানো মেঝের এক কোনায় হাটুগেড়ে বসে রয়েছে। পাশের আম গাছের ডাল নুয়ে এসেছে খানিকটা বারান্দায়। সূর্যের তাপের প্রচন্ড বিদ্রোহ আজ দেখা যাচ্ছে না। বরং কালো মেঘের ভেলা বসেছে। দু এক ফোটা শীতল বিন্দু নামছে পৃথিবীর পানে। এই মৃদু হাওয়ার কল্লোলে একা বসে গুনগুন করছে উমা। তার হৃদয়ের কালো মেঘের উত্তাল শুরু হয়েছে। মনটা বিষাদ সিন্ধুর পানে হেলে পড়েছে। কিন্তু সে কাঁদবে না, অহেতুক মানুষের জন্য কাঁদতে ভালো লাগে না তার। হঠাৎ পায়ে শীতল স্পর্শ পেলো উমা। আকাশ থেকে নজর সরাতেই চমকে উঠে সে। রুদ্র তার পায়ে আলতা দিয়ে দিচ্ছে; আঁকা বাঁকা লাল আচড় টানছে। উমার বিস্ময় যেনো চূড়ান্ত রুপ নিলো যখন রুদ্রের পুরুষালী গম্ভীর কন্ঠে দুটো পঙক্তি শুনলো,
“”আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি যুগলপ্রেমের স্রোতে
অনাদি কালের হৃদয়-উৎস হতে।
আমরা দুজনে করিয়াছি খেলা কোটি প্রেমিকের মাঝে
বিরহবিধুর নয়নসলিলে, মিলনমধুর লাজে–
পুরাতন প্রেম নিত্যনূতন সাজে।”

রুদ্রের মতো দাম্ভিক, নিষ্ঠুর মানুষের হাতে আলতার তুলি নয় বরং বিষাক্ত নীল ছুরি মানানসই। কন্ঠে কবিতা নয় মৃত্যুর হুমকি মানায়। রুদ্র এক স্নিগ্ধ হাসি একে বললো,
“তিনদিন থাকছি না, তাই বলে তোমাকে মুক্তি দিচ্ছ তা কিন্তু নয়”

কথার মর্মার্থ বুঝতে পারলো না উমা। উমার নিচে যেমন ব্যাবহার করেছে তার বদলে রুদ্র তাকে বকবে কিংবা হুমকি দিবে অথচ সে তাকে কবিতা শুনাচ্ছে। উমাকে আরোও অবাক করে এক জোড়া রুপোর নুপুর পড়িয়ে দিলো তার পায়ে। নুপুর পড়ানোর সময় ধীর স্বরে বলে,
“অনেক আগেই এই নুপুরজোড়া মনে ধরেছিলো। তোমার চঞ্চল পাজোড়াকে আটকাতে এর চেয়ে ভালো আর কিছুই হতে পারে না। মনে রাখবে, আমি কিন্তু শিকলটা পড়িয়ে গেলাম। খোলার চেষ্টা করবে। নয়তো ভালো হবে না।”

বলেই ললাটে উষ্ণ পরশ ছোঁয়ালো রুদ্র। উমা অবাক নয়নে তার দিকে তাকিয়ে থাকলো। লোকটাকি পাগল! তার হৃদয়ের গহীনের তল সত্যি ই বুঝে উঠতে পারে না উমা।

কাপড় গুছিয়ে নিলো রুদ্র। বিকেল হতে হতেই বেরিয়ে পড়বে সে। অভিনব সিংহের হাক ডাক শোনা যাচ্ছে। তিনি রুদ্রের নিচে নামার প্রতীক্ষায় আছেন। রুদ্রের কেনো যেনো মন সায় দিচ্ছে না উমাকে ছেড়ে যেতে। উমা যখন তার কাপড় গুছাচ্ছিলো সে বারংবার তার সন্নিকটে যাচ্ছিলো। একটা কথাই বলছিলো,
” তোমায় নিয়ে যেতে পারলে ভালো হতো”

উমার এতে মোটেই কষ্ট হচ্ছে না। বরং ভালো লাগছে, অন্তত তিনদিন তো সে রুদ্রের পাগলামি থেকে মুক্তি পাবে। ব্যাগটা নিয়ে নিচে নামতেই রুদ্রের চক্ষুচড়ক গাছ। সে কল্পনাতেও ভাবে নি এই সময়ে তার সামনে শাশ্বতের আগমন ঘটবে। বলা নেই কয়া নেই শহর থেকে শাশ্বত এসেছে। সে তো শুধু বছরে এক বার ই গ্রামে আসে। কিন্তু এখন তার আসার কি কারণ। শাশ্বতের আকস্মিক আগমনে অভিনব সিংহের থমথমে মুখে বাক্য নেই। শাশ্বত কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে অবাক কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,
“রুদ্র কি কোথাও যাচ্ছিস?”

আমতা আমতা করে রুদ্র বললো,
“কাজে যাই”
“কি কাজ? আমি যতদূর জানি গ্রামের বাহিরে তেমন কোনো কাজ নেই মামা মশাই এর। কি কাজে যাচ্ছিস?”

শাশ্বতের হঠাৎ প্রশ্নে কিংকর্তব্যবিমূঢ় রুদ্র। সে কিছু বলার আগেই……….

চলবে।