#উমা [কপি করা নিষেধ]
#৩৭তম_পর্ব
হাতের ফাঁকে সিগারেট জ্বালালো রুদ্র। সুখটান দিতে যাবে তখন ই ফোনটা বেজে উঠে। ফোনের নাম্বারটা অচেনা। অচেনা নাম্বার দেখে ভ্রু কুঞ্চিত হয় তার। ফোনটি রিসিভ করতেই মুখোভাব বদলে যায় রুদ্রের। হিনহিনে স্বরে বলে,
“আমি এখন বাড়ি চলে এসেছি, এই ব্যাপারে আগামীকাল কথা বলবো। যে কাজ দেওয়া হয়েছে সেটা হয়ে গিয়েছে?”
“……”
“ভালো, শুনেছি আগামী মাসে বাবার সম্মেলন। সম্মেলনের আগেই আমাদের সব করতে হবে। মনে থাকে যেনো, রাখছি”
বলেই ফোনটা রেখে দিলো রুদ্র। এগিয়ে গিয়ে জানালার কাছে দাঁড়ালো সে। প্যান্টে হাত গুজে দৃষ্টি দিলো আকাশের পানে। জানালা দিয়ে পূর্ণ চন্দ্রমার স্নিগ্ধ কিরণ গলিয়ে পরছে ঘরে। আলো জ্বালায় নি রুদ্র। মাঝে মাঝে অন্ধকারে থাকতে খুব ভালো লাগে তার। নিজের ভেতরটায় উঁকি দিতে পারে। অন্তরাত্মার সাথে মাঝে মাঝে পরিচিত হতে হয়, গল্প করতে হয়। লুকানো মাটির ব্যাংকটা ভেঙ্গে দেখতে হয় কি পেয়েছে কি হারিয়েছে। রুদ্র সেটাই করে। মনের আঙ্গিনায় লুকিয়ে রাখা মাটির ঘড়াটা ভাঙ্গে, বিশ্লেষণ করে নিজের দেনা পাওয়া। তারপর আবার নতুন ঘড়া মাটিতে লুকায়। আঙ্গুলের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেটটা ছাই হচ্ছে ক্রমশ। সে জানে না কতকাল লড়বে। একটা সময় লড়তে লড়তে অস্ত্র ফুরিয়ে যাবে। তখন ক্রমশ তেড়ে আসা তীরগুলো বুকে নিতে হবে। রক্তক্ষরণ হবে, সেই রক্তক্ষরণে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাবে কিছু স্বপ্ন। এতো ঝড়ের মাঝে একটি জায়গা আছে সেখানে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুদ্র। সেই মানুষটাকে যদি কেউ আঘাত করে মাথা ঠিক থাকে না। হয়তো সেজন্য হাজারো ভুল করে, ভুলগুলো মাঝে মাঝে ভয়ংকর হয়। সেই ভুলগুলোকে পাপ বলে। রুদ্রের আইনের ভয় নেই। ভয় উমাকে হারাবার, উমার চোখে নিজের প্রতি ঘৃণার ঝলক দেখার। যেমনটা চারবছর আগে ছিলো। রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তখন ই দরজা ঠেলে উমার প্রবেশ হয়। এসেই সুইচ অন করে বাতি জ্বালালো উমা। রুদ্র পেছনে ফিরে তাকালো। উমা ধীর পায়ে এগিয়ে আসলো। ধীর কন্ঠে বললো,
“খাবেন না?”
“গোপাল, রাজশ্বী খেয়েছে?”
নিজের টেবিলে বসতে বসতে রুদ্র জিজ্ঞেস করলো। হাতের সিগারেটের ফিল্টারটি ফেললো ছাইদানিতে৷ উমা তার কাছে এগিয়ে আসলো। এলোমেলো ফাইলগুলো গুছাতে গুছাতে বললো,
“ওদের খাওয়া শেষ, গোপাল ঘুমিয়ে পড়েছে। রাজশ্বী পড়ছে। মিনু ঘুমিয়ে পড়েছে শুধু আমি আর আপনি বাকি”
“ওহ”
“আপনি এখনো রেগে থাকবেন?”
“আমি তো রেগে নেই”
বেশ নির্লিপ্ত কন্ঠে কথাটা বলে রুদ্র। নতুন প্রজেক্টের ফাইল খুলে বসে সে। উমার রাগ হয়। লোকটার এমন গা ছাড়াভাব তার মোটেই ভালো লাগে নি। বকাঝকা করতে ইচ্ছে করলে করো না বাপু! অহেতুক মুখ ফুলিয়ে রাখার কি মানে? উমা এগিয়ে যেয়ে ফাইলটা রুদ্রের হাত থেকে নিয়ে নেয়। উমার কান্ডে এক রাশ বিরক্তি ভরা চাহনীতে তাকায় রুদ্র। উমা তখন রাগান্বিত স্বরে বলে,
“বলেছি তো আর হবে না, শিল্পী আপার কথাটা না শুনলে সত্যি যেতাম না৷ আর আমার শরীর এখন ভালো আছে। দুপুরে খুব লম্বা ঘুমিয়েছি। বিশ্বাস না হলে মিনুকে জিজ্ঞেস করেন”
উমার দিকে কিছুসময় স্থির চাহনীতে তাকিয়ে থাকে রুদ্র। তারপর তর্জনী দিয়ে কিছুক্ষন কপাল ঘষে উমার হাত টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসে। তার কোমড় জড়িয়ে ধরে মুখ গুজে রুদ্র। রুদ্রের তপ্ত নিঃশ্বাসে কেঁপে উঠে উমা। কাঁপা হাত বুলিয়ে দেয় রুদ্রের কালো চুলের মাঝে। নিঃশব্দ মূহুর্তগুলো ঘন হতে থাকে। উমা সেভাবেই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। রুদ্রের বেষ্টনী খুব শক্ত না, আবার হালকাও না। উমা স্মিত হেসে বলে,
“ভয় পেয়েছিলেন?”
“খুব”
“আর হবে না।”
রুদ্র কথা বলে না। নিঝুম ঘরে নিঃস্তব্ধতার মেলা বসে। রুদ্রের এমন আচারণগুলো আরো মোহে ডুবায় উমাকে। প্রায় নিজেকে একটি প্রশ্ন করে,
“কেনো ভালোবাসে সে রুদ্রকে?”
মন উত্তর দেয়,
“কারণ সে রুদ্র”
উমা স্মিত হাসে। রুদ্র আরো নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ধরে উমাকে। উমাও পরম যত্নে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
২০.
পড়ার টেবিলের ল্যাম্পখানা জ্বলছে। রুদ্র গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। উমার এই সময়টা পড়তে ভালো লাগে। নিবিড় শান্ত পরিবেশে পড়াটা ভালো হয়। সারাদিন নানা কাজে থাকলেও পড়াশোনার ব্যাপারে বেশ দৃঢ় সে। তাই প্রতিরাতে নিজের পড়াখানা এগিয়ে রাখে। তার ইচ্ছে সরকারী চাকরি করার। জানানেই এই স্বপ্ন কি আদৌও সফল হবে কি না। উমা তার প্রানী বিজ্ঞানের মোটা বইটা খুলে বসে। পাতা উলটাতে উলটাতে হঠাৎ থেমে যায়। হলুদ রঙ্গের খামটা চোখে পড়ে তার। খামটিতে কি আছে সে ভালো করেই জানে। নিখিলের সেই চিঠিটা এখনো কাছে রেখেছে সে। উমা বুকের বা পাশের চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করে। কাঁপা হাতে চিঠিটা খুলে সে। এলোমেলো হাতের লেখা। মাত্রাগুলো একটাও ঠিক নেই। বছর কেটে যাওয়ায় লেখাগুলো বসে গেছে। বলপয়েন্ট কলমের কালো রঙ্গ খয়েরি হয়ে গিয়েছে। সাদা কাগজটা হলদেটে বর্ণ নিয়েছে। উমা চোখ বুলায় কাগজে। সাধু চলিত মেশানো চিঠিটা পড়তে খুব ভালো লাগে উমার।
প্রিয় উমা,
কেমন আছো তুমি? এই চিঠিখানা যখন পাইবে তখন হয়তো আমি তোমার সম্মুখে উপস্থিত থাকিবো না। তবে স্মরণ রাখিও আমার আশীর্বাদ সর্বদা তোমার সাথেই থাকিবে। বাবা হিসেবে কর্তব্য পালন করার ক্ষেত্রে তোমার পিতা বহুঅংশে অপারগ। আমি তাহা জানি, কিন্তু সত্যি বলিতে তোমাকে আমি কখনো কম স্নেহ করি নি। প্রত্যেকে পিতার একটাই প্রার্থনা থাকে ভগবানের কাছে। তার পুত্র কন্যারা যেনো সুখে থাকে। আমিও সেটাই চাহিয়াছিলাম। তাই তোমার মায়ের মৃত্যুর পর রতীলে বিবাহ করি। বিয়েখানা করার উদ্দেশ্য তোমার জন্য একজন ভালো মা বাছাই। কিন্তু ভাগ্যের ফেরটাই বদলে যায়। রাজশ্বী হবার পর তোমার অবুঝ কাজে তার প্রান যাইবার উপক্রম হয়। রতী কন্যা শোকে তোমাকে ভালোমন্দ বলে। সেদিন প্রথমবার আমি তোমাকে শাসন করি৷ সেদিন থেকে তুমি আমার থেকে বহুক্রোশ দূর চলে যাও। কিন্তু তোমাকে কাছে টানার কিংবা এই কষ্টের থেকে মুক্তি দেবার কোনো উপায় পাই নাই। দোকানের কাছে সারাদিন মগ্ন থেকে জানিতেও পারি নাই বাড়তে তোমার সাথে কি কি হয়েছে! তুমিও এতো ভালো মেয়ে ছিলে কখনো নিজ থেকে আমাকে কিছুই বলিতে না। আমার ই দোষ ছিলো আমি তোমার অব্যক্ত কথা বুঝবার চেষ্টাও করি নি। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও উমা। কিন্তু আমি কখনোই নিজের বোঝা ভাবী নি। তোমার সাথে রুদ্রের বিয়ে খানা হয়তো তোমার জন্য অন্যায় ছিলো। তোমার মতের বিরুদ্ধে বিয়েখানা আমি ঠিক করি। কিন্তু তা এজন্য মোটেই নয় যে তোমাকে আমি বোঝা ভাবী। আমি বিয়েখানায় সম্মতি দেই কেবল তোমার মঙ্গল ভেবে। তোমার শ্বশুরটি মোটেই ভালো মানুষ নয়। আমার ভয় ছিলো তোমার কোনো ক্ষতি না করিয়ে দেয়। এই ভয়ে আমি সম্মতি দেই এই বিয়েতে।
আমি জানি এই কথাগুলোতে আমার পাপ ধুইয়া যাইবে না। আমি মানুষটা বরাবর ই কাপুরুষ। কখনো অন্যায়ের উপরে কথা বলার সাহস আমার হয় নি। নর্দমার কিটের মতো জীবন ব্যাহিত করেছি। তোমার মতো কন্যার পিতা হবার যোগ্যতা আমার নেই। কিন্তু ইহজীবনে তোমাকে রাজশ্বী এবং গোপালকে সমান ভালোবেসেছি৷ আমার এখনো স্মরণ আছে সেই মূহুর্ত যখন মা তোমাকে আমার কোলে দিয়েছিলো। সদ্য ফুটন্ত শিউলিকে যেনো আমার হাতে পেয়েছিলাম। দিনখানা সপ্তমী ছিলো। মায়ের ত্রিনয়নের সাথে তোমার জনম হইয়াছিলো। তাই তোমার নাম উমা রাখিয়াছিলাম। আমার মতে তুমি সর্বদা দেবীর অংশ ই রইবে। পারলে তোমার এই কাপুরুষ পিতাকে ক্ষমা করে দিও। আমি আশীর্বাদ করি যেনো তুমি খুব বড় মানুষ হতে পারো। কখনো অন্যায়ের সামনে মাথানত করবে না উমা। মা অন্নপূর্ণার মতো নিজেকে দয়ালু করবে। দরিদ্র মানুষের পীড়নকে অনুধাবন করার চেষ্টা করিও। মনে রাখিবে, ধরণীও নারী, তুমিও নারী। তোমাতেই জীবের সঞ্চার। নারী নরম হলে মায়াবতী, কঠিন হলে মা কালী। তুমি রক্তজবা হও। এই আশীর্বাদ রইল। আর একখানা কথা, পারলে ওই বাড়ি থেকে পালাবার প্রচেষ্টা করিও। ওরা ভালো না। তোমার পরান নেবার মূহুর্তে দুবার ভাববে না।
ইতি
তোমার বাবা
নিখিল
উমা তাকিয়ে রয়েছে চিঠিটির দিকে। খেয়াল করলো গালদুটো ভিজে এসেছে তার। এ যেনো নতুন নয়। চারবছর যাবৎ এই চিঠিটা আগলে রেখেছে উমা। কিন্তু এই যাবৎ চিঠির শেষ কথাগুলোর মর্মার্থ বুঝতে পারে নি সে। মৃত্যুর পূর্বেও তার পিতা কিছু বলবার প্রচেষ্টায় ছিলেন। চেয়ারম্যান বাড়ির কোনো রহস্যের কথাটা বলতে চেয়েছিলেন তিনি। উমা চিঠিটা বইয়ের ভাজে রেখে দিলো। পেছনে ফিরে রুদ্রের ঘুমন্ত মুখখানা দেখলো সে। বাবা জীবিত থাকতে তাকে বলতো,
“বাবা, তুমি চিন্তা করো না। যতক্ষণ আমার পাশে এই মানুষটা আছে আমার কিছু হবে না”
দীর্ঘশ্বাস ফেললো উমা। ঠোটে এক চিলতে হাসি অঙ্কিত হলো।
কালীগঞ্জ থানায় বসে আছে শাশ্বত৷ অপেক্ষা তার বন্ধুর। এক কালে এই থানার দারোগা ছিলেন উত্তম বাবু। আবদুল্লাহ বদলি হয়ে অন্য থানায় গিয়েছে। নতুন অসি শ্রাবণ মুখোপাধ্যায় শাশ্বতের খুব ভালো বন্ধু। একই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছে তারা। শাশ্বতের আগমনে প্রথম দিন অবাক হয় শ্রাবণ। শাশ্বত তাকে সবটা বললে সে চিন্তিত স্বরে বলে,
“এতোকাল আগের তথ্য কি পাওয়া যাবে? এ খানিকটা খড়ের গাদায় সুই খোজার মতো হবে না তো?”
“জানি কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। এটুকু তো জানাই যাবে বাবার শেষ কেসখানা কি ছিলো।”
“কিন্তু সময় লাগবে বন্ধু। এতো সহজে কিছুই হয় না। টাকাও যাবে। তবে খানিকটা লুকিয়েও কাজ করতে হবে। বোঝোই তো সরকারী ব্যাপার স্যাপার।”
“তুমি নিশ্চিন্তে থাকো।”
সেদিনের পর আজ এসেছে শাশ্বত। শ্রাবণ লাঠিটা টেবিলে রেখে লজ্জিত কন্ঠে বললো,
“অনেক সময় কি চলে গিয়েছে?”
“না না আমি কেবল ই আসলাম”
বসতে বসতে শ্রাবণ বলল,
“যেকারণে তোমাকে ডেকেছি, একটা সুতো পেয়েছি বন্ধু। আমার মনে হয় কাকার মৃত্যুতে এই সুতোর হাত আছে”
“কি সুতো?”
“উত্তম কাকু শেষ যে কেসখানা নিয়ে কাজ করছিলেন, সেটি একটি তদন্ত। মাদকদ্রব্য পাচার তদন্ত……….
চলবে
#উমা [কপি করা নিষেধ]
#৩৮তম_পর্ব
সেদিনের পর আজ এসেছে শাশ্বত। শ্রাবণ লাঠিটা টেবিলে রেখে লজ্জিত কন্ঠে বললো,
“অনেক সময় কি চলে গিয়েছে?”
“না না আমি কেবল ই আসলাম”
বসতে বসতে শ্রাবণ বলল,
“যেকারণে তোমাকে ডেকেছি, একটা সুতো পেয়েছি বন্ধু। আমার মনে হয় কাকার মৃত্যুতে এই সুতোর হাত আছে”
“কি সুতো?”
“উত্তম কাকু শেষ যে কেসখানা নিয়ে কাজ করছিলেন, সেটি একটি তদন্ত। মাদকদ্রব্য পাচার তদন্ত, প্রতিবছর বর্ডার থেকে প্রচুর পরিমানে মাদকদ্রব্য, ঔষধ, গরু পাঁচার হয় আমাদের দেশে। বেনাপোল বর্ডারটা অন্যতম। যদিও কড়া প্রহরী থাকে বিডিআর (তখন বিজিবি বিডিআর ছিলো) বাহিনীর, তবুও এই অমানুষ গুলো তাদের কাজ ঠিক ই করে। লাস্ট এই কেসটাই কাকুর আন্ডারে ছিলো। কিন্তু কাকু কোনো রিপোর্ট করেন নি। তার পূর্বেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এখন তিনি কি সেই গোষ্ঠীকে আদৌও পাকরাউ করেছিলেন কি না জানা নেই।”
শাশ্বত মনোযোগ দিয়ে ফাইলটা দেখতে থাকে। সুতোটা খুব ই সরু। যে কোনো মূহুর্তে ছিড়ে যাবার ভয় রয়েছে। শ্রাবণ হাত জোড়ো করে থুতনি ঠেকায়, ধীর স্বরে বলে,
“বন্ধু আমি তোকে কখনোই হতাশ করতে চাই না। কিন্তু সত্যি বলতে সময়টা অনেক বেশি হয়ে গিয়েছে। এখন পুরোনো কঙ্কাল চেটেও কিছু বের হবে না।”
শ্রাবণের কথা যৌক্তিক। কিন্তু শাশ্বতের মনে এক দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে এই রহস্যের শেষবিন্দুতে সে পৌছাতে পারবে। শাশ্বত স্মিত হাসি দিয়ে বললো,
“দেশে এখন সব সম্ভব। বিদ্যুতের খাম্বাচুরি যদি ধরা পরে, এই রহস্যের জট ও খুলবে। এই ফাইলটা নিয়ে যেতে চাই পারবো?”
“হ্যা, এগুলো তোর জন্যই আমি প্রস্তুত রেখেছি। তুই নিতে পারিস। কিন্তু বন্ধু, কেউ যেনো এই ব্যাপারটা না জানে। আমার চাকরি মিয়ে টানাটানি হবে।”
“নিশ্চিন্তে থাক বন্ধু, কিচ্ছু হবে না।”
শাশ্বত বেড়িয়ে গেলো থানা থেকে। ব্যাগে মোটা ফাইল। যেখানে উত্তম বাবুর আন্ডারে থাকা সকল কেসের কুষ্ঠি আছে। শাশ্বত পিচের রাস্তায় হাটতে লাগলো। কড়া রোদে তার চামড়া ঝলসে যাচ্ছে। কিন্তু এই প্রকোপের মাঝেও পৌষের হিম বাতাস বইছে। উড়ছে এলোমেলো চুলগুলো শাশ্বতের। শাশ্বতের মনে হাজারো প্রশ্নের দলা জমেছে। উত্তর গুলো নিকষকৃষ্ণ আধারে হাতড়াতে হচ্ছে। যে তাকে আড়ালে থেকে এতো কিছুর খোঁজ দিচ্ছে সে জানে এই রহস্যের বীজ কোথায়! সেই মানুষটাকে যদি খুজে বের করা যেতো। হয়তো তখন এই জটগুলো এক এক করে খুলে যেতো।
অফিসে পৌছাতেই শাশ্বতের জুনিয়র সুমন ছুটে এলো তার কাছে। সুমন হাফাচ্ছে, শাশ্বত তার ব্যগ্রতা দেখে বাকা হেসে বললো,
“কি গো সুমন বাবু? কিছু না করেই হাফাচ্ছো দেখি? খুব কঠিন খবর রিপোর্ট করতে দিলাম কি?”
সুমন নিজেকে সামলে বললো,
“স্যার, আপনাকেই খুজছিলাম। আমি রিপোর্টটা প্রায় তৈরি করে ফেলেছি। শুধু আপনার একটু গাইড পেলে জব্বর হতো।”
“বাহ, সুমন বাবু দেখি খুব ফাস্ট হয়ে গেছে। আমি ভাবলুম, এক কোনে বসে মাথা চাপড়াচ্ছে।”
“কি যে বলেন স্যার, আপনি ই তো বলেন, “when life gives you a lemon, make it lemonade””
শাশ্বত হাসে, কিন্তু সুমনের কথাটি তার মনের কর্ণিশে জমা হতাশার কালো বাদলকে সরিয়ে আশার নতুন প্রভা উজ্জ্বলিত করে। শাশ্বতের হাসি প্রসারিত হয়। যতই আধার থাকুক এবার তদন্তের শেষ অবধি যাবেই সে। এর মাঝেই পিয়ন মন্সুর মিয়ার আগমন হয়। ধীর স্বরে বলে,
“স্যার একখানা মেয়ে এসেছে। বলছেন আপনার সাথে দেখা করতে চায়।”
শাশ্বত খানিকটা অবাক হয়। অবাক হবার ই কথা, যে পুরুষ ইহজীবনে নারী প্রলভনে আকৃষ্ট হয় নি সেই পুরুষের কাছে নারী আসবে ব্যাপারখানা বেশ অবাক করেছে তাকে। মালিনী মুখে ফেনা তুলে ফেললো,
“বাবু, বিয়েটা কর”
কিন্তু কে শুনে কার কথা, সে বিয়ে করবেই না। কোনো মেয়েকেই তার মনে ধরে না। আর যার ক্ষণিকের মায়া মনে উঁকি দিয়েছিলো সেই নারী তার ধরা ছোয়ার বাহিরে। শাশ্বতের অবাক হবার আরো একটি কারণ হলো, এই সংবাদপত্র অফিসে নারীর আনাগোনা বড্ড বিরল। সংবাদ পত্র অফিস তো কোনো কফি শপ না, সে মেয়েরা আসবে আড্ডা দিতে। শাশ্বত গম্ভীর কন্ঠে বলে,
“আমার অফিসে পাঠিয়ে দাও।”
মন্সুর মিয়া ঘাড় কাত করলো। মানে সে বুঝতে পেরেছে। শাশ্বত সুমনের উদ্দেশ্যে বললো,
“প্রতিবেদন টা পাঠিয়ে দিও। আমি কারেকশন করে দিবো ক্ষণ”
“জ্বী স্যার”
শাশ্বত ব্যাগটা খুব যত্নে আগলে রাখলো তার আলমারীতে। তারপর চোখের চশমাটা ঠিকে করে বসলো কম্পিউটারের সামনে। কম্পিউটারের প্রচলন এখন বেশ বেড়েছে। প্রায় সকল অফিসেই একটা কম্পিউটার থাকবে। এখন প্রিণ্ট বের করে কালকের মধ্যে কিছু প্রতিবেদন ফ্যাক্স করতে হবে। ক্রাইম রিপোর্টার হবার এই এক ফয়দাও। যেকোনো ক্রাইম হলেই বড় একখানা প্রতিবেদন করতে হয়। এই যে গত পরশু, দেবহাটা উপজেলায় এক স্কুল যাত্রী মেয়েকে এক গোষ্ঠী মিলে ধর্ষন করেছে। শুধু তাই নয়, তাকে ধর্ষণ করে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে। মেয়েটির লাশ ভোরের দিকে ড্রেনের পাশে নগ্ন অবস্থায় পায় পুলিশ। তদন্ত চলছে, তবে মেয়েটির মা-বাবার মতে এই কাজটি ইউনিয়নের এক নামী নেতার দলবলের কাজ। তদন্ত চলছে। দেখা যাক, দোষীটি ধরা পরে নাকি? উপরন্তু নতুন এক মৎস চাষের জন্য বেশ কিছু বেনামী জমি দখল হয়ে যাচ্ছে। বেশ কিছু গ্রামের দরিদ্র কৃষকেরা বিলীন হয়ে যাচ্ছে গ্রাম ছেড়ে। রাতারাতি তারা খুলনা, যশোর পাড়ি দিচ্ছে। এই বিষয়টাও ভাবাচ্ছে শাশ্বতকে। ভাবছে এই বিষয়ের তদন্ত ও করবে সে। এর মাঝেই নরম মেয়েলী কন্ঠটি কানে এলো তার,
“আসতে পারি? ”
কি বোর্ড থেকে মুখ তুললো শাশ্বত। চোখ জোড়া কুচকে এলো তার। এক কৌতুহল জমলো মনে, অবাক কন্ঠে বললো,
“তুমি? এখানে?”
মেয়েটি আর কেউ নয়, রাজশ্বী। চটের ব্যাগটা সামনে ফ্যাকাশে মুখে আবারো সে জিজ্ঞেস করলো,
“আসবো”
“এসো”
রাজশ্বী ধীর পায়ে এসে বসলো। তার কপালে ঘামের সরু মতি, ঠোঁট জোড়া ঈষৎ কাঁপছে। বেশ স্নায়ুবিক লাগছে তাকে। শাশ্বত চশমাটা খুলে রাখলো। হাত জড়ো করে থুতনি ঠেকিয়ে এক রাশ বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“পেয়ারা গাছের পেত্নী আজ এখানে?”
“আপনাদের একখানা বিজ্ঞাপন দেখেছিলাম। ইন্টার্ণ রিপোর্টার নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি”
ঈষৎ কাঁপা কন্ঠে কথাটা বললো রাজশ্বী। শাশ্বতের বিস্ময় আসমান ছুলো। বলে কি এই মেয়ে, সে সাংবাদিকতায় আসতে চায়? অবাক স্বরে বলে,
“তুমি সাংবাদিক হতে চাও।”
“জ্বী, পার্টটাইম জব হিসেবে করতে চাই। বর্তমানে আমি প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছি সাতক্ষীরা কলেজে। ওখানে কিছু বলা ছিলো না। তাই এসেছি।”
শাশ্বত কিছু বললো না। বরং মনোযোগ দিয়ে সামনে বসা মেয়েটিকে দেখতে লাগলো। চার বছরে কতটা বদলেছে মেয়েটি। কে বলবে এই সেই মেয়ে যে বট গাছে বসে সবাইকে পেয়ারা ছুড়তো আর ভয় দেখাতো।
ক্লাস শেষ হয়েছে দুপুর গড়িয়ে গেছে। এখন বাড়ি ফেরার সময় হয়ে এসেছে উমার। চাদরটা ভালো করে মুড়িয়ে নিলো। বেশ ঠান্ডা লাগছে। অফিস গেলে মন্দ হতো না। কিন্তু রুদ্রের কড়া বারণের পর আর অবাধ্য হতে মন চাইলো না উমার। হাতটাও সাড়ে নি এখনো। এক সপ্তাহ হয়ে গেলো এখনো ব্যাথা কমে নি। হাতের ব্যাথাটা শীতের কারণে ব্যাথা বাড়ছে। এর মাঝেই তার ফোনটা বেজে উঠলো উমার। অচেনা নম্বরটি দেখে কৌতুহল জাগলো উমার। ফোন ধরতেই অপাশ থেকে একখানা তীক্ষ্ণ বৃদ্ধ কন্ঠে কানে এলো,
“উমা রায় বলছেন?”
“জ্বী, আপনি কে বলছেন?”
“আমি মহানগর ডায়াগনস্টিক থেকে বলছি। আপনার রিপোর্ট খানা নিয়ে যাবেন।”
রিপোর্টের কথাটা শুনেই অনুভূতিশুন্য হয়ে গেলো উমা। বিগত সপ্তাহেই রক্ত এবং প্রসাব পরীক্ষা করতে দিয়েছিলো উমা। সেই রিপোর্টটাই হয়তো এসেছে। বুকটা ধরফর করছে উমার। কৌতুহল হচ্ছে ফলাফলের আসায়। উমা ধীর স্বরে বললো,
“রিপোর্টে কি এসেছে জানতে পারি?”
মহিলা কিছুক্ষন থেমে বললো,
……….
চলবে।