উমা পর্ব-৪১+৪২

0
388

#উমা [কপি করা নিষেধ]
#৪১তম_পর্ব

রাজশ্বী মাথা নাড়িয়ে বেড়িয়ে গেলো। শাশ্বতের মাথায় আগুন জ্বলছে। কাজের প্রতি অনীহা তার মোটেই ভালো লাগে না। এদিকে হতাশা তাকে জর্জরিত করে রেখেছে। কোনোভাবেই উত্তম বাবুর কেসের গতি হচ্ছে না। সব রাস্তা যেনো বন্ধ। কোনো কুল কিনারা পাচ্ছে না সে। এর মাঝেই মন্সুর মিয়া চায়ের ট্রে নিয়ে হাজির হয়। দরজা কড়া নাড়লেই শাশ্বতের চোখ যায় তার দিকে। খিটখিটে মেজাজে বলে,
“কি হলো, এতো দেরী হলো যে?”
“স্যার, একখানা খাম আইসে।”

খামের কথা শুনতেই বেশ নড়েচড়ে বসে শাশ্বত। হাত বাড়ায় মন্সুর মিয়ার দিকে। মন্সুর মিয়া বদলে করে আনা খামটা দেয় শাশ্বতের হাতে। ফোস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে খামটি খুলে শাশ্বত। খাম খুলতেই কিছু পত্রিকার কাটিং বেড়িয়ে আসে৷ তার সাথে বেড়িয়ে আসে কিছু লেখা, খসরা এবং কিছু কাগজপত্র। তার সাথে তখনকার তদন্তের কিছু প্রমাণ ও ছিলো। উত্তমবাবুর কেসটি যে পুলিশ অফিসারটির আন্ডারে ছিলো তার নাম শফিকুল ইসলাম, সে এখন খুব বড় পোস্টে রয়েছে। সে জানিয়েছিলো, সে এই তদন্তে মূখ্য কোনো প্রমাণ পায় নি। কিন্তু এখানে খুব পুরোনো কিছু কাগজ, জবানবন্দি রয়েছে যা প্রমাণ হিসেবে খুব সহজে পেশ করা যেতো। শাশ্বত বেশ মনোযোগ দিয়ে কাগজগুলো সাজাতে থাকে। তারপর উত্তমবাবুর সেই ফাইলটি খুলে সামনে রাখে। ক্রমশ কপাল কুঞ্চিত হয়ে আসছে তার। ললাটের বাপাশের শিরাটা ধপধপ করে লাফাচ্ছে। উত্তম বাবু শেষ যে অপরাধীকে পাকরাও করেছিলেন সেই নামটি খুব পরিচিত লাগছে শাশ্বতের কাছে। এই নামটা কোথাও তো দেখেছেছিলো সে। শাশ্বত নিজের আলমারি থেকে একটা ফাইল বের করলো। ফাইলটি অভিনব সিংহের। কাগজগুলোর মধ্যে “কমলাপট ব্রীজ” এর কাগজগুলো বের করে শাশ্বত। “আর এ কন্সট্রাকশন” পেয়েছিলো এই ব্রীজের টেন্ডর। যার বর্তমান মালিক মাহমুদ সরদার। মাহমুদ সরদারকেই পাচারকারী চক্রের জন্য পাকরাও করেছিলেন উত্তমবাবু।

মাহমুদ সরদার বর্তমানে আঠারো মাইল থাকে। অনেকবড় মৎস ব্যাবসায়ী সে। বিঘার পর বিঘা তার মাছের ক্ষামার৷ তার খুব বড় মোটরসাইকেলের শোরুম রয়েছে, সাথে রড, বালি, সিমেন্টের আঠারো মাইলে খুব বড় দোকান রয়েছে। এই দিকের বেশ কিছু সরকারি টেন্ডন তার “আর এ কন্সট্রাকশন” পেয়ে থাকে। তার দাপট অঞ্চল জুড়ে বেশ ভালোই। শাশ্বতের মনে খটকা লাগলো। তার বাবা ঠিক কেনো মাহমুদ সরদারকে পাকরাও করেছিলেন! তার পরেই উত্তমবাবুর খুন হয়। অথচ এই কেসের দারোগা শফিকুল ইসলাম এই প্রমাণ গুলোই গায়েব করে ফেলেন। প্রশ্নের ধোয়া গাঢ় হচ্ছে শাশ্বতের মনে। তার চেয়েও গভীর প্রশ্ন এই লোকটি কে যে তাকে আড়ালে এতো ভয়ংকর সত্যের বীজ শিকড়ের সন্ধান দিচ্ছে!

লক্ষীদেবীর খুশি বাধ মানছে না। কারণ তার বংশের প্রদীপ আসতে চলেছে। উমা যখন তাকে এই সুসংবাদটি জানায় তার চোখজোড়া আকুল আবেগপ্রবণ হয়ে উঠে। তিনি উমাকে পরম আদরে জড়িয়ে ধরে। ফুলির মাকে তীব্র উল্লাসে বলে আজ তার বউ মার জন্য যত প্রকার পিঠে আসে সব তৈরি করবে। লক্ষী দেবীর প্রসন্ন চেহারাটি উমাকে খানিকটা আবেগপ্রবণ করে তুলে। এতো বছর পর আজ সে শাশুড়ীর মনে কড়া নাড়তে পেরেছে। এতোকাল কেবল একজন খড়কুটোর ন্যায় নির্জীব প্রাণী ছিলো সে শাশুড়ীর দৃষ্টিতে। লক্ষীরাণী রুদ্রের নিকট আবদার করে বসে যেনো তারা আজ রাত্রী এই বাড়ি থেকে যায়। প্রথমে আবদারটি রুদ্র নাকোচ করে দিলেও মায়ের আবেগঘন আবদার ফেরাতে পারে নি সে। রুদ্রের মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় তার মাকে তার কাছে নয়ে রাখতে। কিন্তু পারে না, পতিভক্ত তার মা কখনোই রুদ্রকে তার পিতাকে ছেড়ে যাবে না। অবশেষে রুদ্র এই বাড়িতে থাকার সিদ্ধান্তে রাজী হলো। দীপঙ্করের বিয়ে হয়েছে। তার স্ত্রী মৌমিতা এবং লক্ষী উমার দেখভালের কোনো ত্রুটি রাখছে না। রুদ্রের পুরোনো ঘরের তালা খুলে ঘরটি সুন্দর করে পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে। দীপঙ্করের ছোট মেয়েটি উমাকে খুব পছন্দ করে, যতবার আসে তার কোলে চেপে বসে থাকে। এবারো তাই হলো, এই উৎসবের মাঝে শুধু একজনের মুখখানা বেরাজ হয়ে রয়েছে। তা হলো দীপঙ্কর। রুদ্রের বাড়ি থেকে যাবার পর থেকে সে জ্যেঠুর নিকটতম মানুষ হবার সুযোগটি কাজে লাগিয়েছিলো। তার মনের সুপ্ত লালসা ফন তুলেছিলো বহু আগে, বাবা ছেলের অন্তঃদ্বন্দে নিজের খুটি মজবুত করার চেষ্টায় ছিলো সে। কিন্তু রুদ্রের সুসংবাদে এখন ভয় লাগছে তার যদি তাদের মধ্যের বিবাদের অন্ত হয় তবে ক্ষতিখানা তার ই হবে। আমে দুধে মিলে আটি হয়ে থেকে যাবে সে। তাই রুদ্রের সন্তান আগমনের খবরে খুশি হতে পারছে না সে। মৌমিতার আদিক্ষেতা দেখেও বেশ মেজাজ খারাপ হচ্ছে তার। সুযোগ বুঝে তাকে টেনে আনে নিজ কক্ষে। হিনহিনে স্বরে বলে,
“এতো খুশির তো কিছু হয় নি, এতো লাফালাফি করছো কেনো? তোমার বর দুপুরে খায় নি কিছু সেদিকে খেয়াল আছে?”
“আপনি চটছেন কেনো? আর খুশি হবো না। দিদিভাই মা হতে চলেছে। নতুন সদস্যের আগমনে মুখ গোমড়া করে রাখবো নাকি?”
“আদিক্ষেতা দেখলে গা জ্বলে যায়। এতো খুশি হবার কি আছে শুনি? একবার ভেবে দেখেছো ওই বাচ্চা আসলে আমাদের মেয়েকে কি আর নাতনীর চোখে দেখবে জ্যেঠু জ্যেঠী? তখন ওই বাচ্চাকেই বেশি মাথায় করে নাচবে। আর যদি ছেলে হয় তাহলে তো কথাই নেই।”
“কি বলছেন আপনি? যে আসেই নি তার সাথে কিসের হিংসা?”
“তুমি বুঝলে তো হতোই”

এক রাশ বিরক্তি নিয়ে স্নানঘরে চলে গেলো দীপঙ্কর। মৌমিতার মনে ঈষৎ ভয় উঁকি দিছে। স্বামীর জটিল মনোস্থিতির পরিণাম কোনো অশুভ ঘটনার সূত্রপাত না করে।

খাবারের পর লক্ষী দেবী উমার রুমে আসেন। ধীর স্বরে বলেন,
“আসবো?”

উমা তখন অবহেলিত ঘরটিকে নির্লিপ্ত চিত্তে বিচরণ করছিলো। লক্ষী দেবীকে দেখে স্মিত হেসে বললো,
“ছেলের ঘরে আসবেন, অনুমতি নেবার কি আছে মা!”

লক্ষী দেবী ঘরে প্রবেশ করতে করতে বললেন,
“ভেবেছি হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছো”
“না না, ঘুম আসছে না। বিছানা বদল হবার খারাপ দিক। আর দুপুরে ঘুমাই না। তাই ঘুরে দেখছিলাম ঘরটা।”

লক্ষী দেবী বিছানাতে বসলেন। তার হাতে বেশ কিছু কাপড়। তিনি বসতে বসতে বললেন,
“এই কাপড়গুলো রুদ্রের। কাথা, টুপি, সোয়েটার। এই কাথাটা ওর শরীরে প্রথম জড়ানো হয়েছিলো। এইন্যে টুপিটা দেখছো আমি নিজ হাতে বুনেছিলাম। প্রচুর স্মৃতি জড়িয়ে আছে। পুরোনো অনেক। কিন্তু মূল্যবান এই স্মৃতি। খুব যত্নে আগলে রেখেছিলাম। আমার নাতী এই পৃথিবীতে আসলে তুমি তাকে প্রথম এই কাপড়গুলো পড়াবে। তাই তোমাকে দিতে এসেছি।”

নাতী শব্দটি শুনতেই খানিকটা নড়ে উঠলো উমা। অবাক কন্ঠে বললো,
“সে তো নাতনীও হতে পারে মা। নাতী ই যে হবে এমনটা তো নিশ্চিত নয়।”

উমার কথা শুনে চোখ কুচকে আসে লক্ষীর। সে কথাটি শুনে প্রসন্ন হয় নি তা বুঝতে বাকি রইলো না উমার। খানিকটা বিরক্তিভরা কন্ঠে বললো,
“এ বাড়ির প্রথম সন্তান সর্বদা ছেলেই হয়েছে। এবার তার ব্যাতিক্রম হবে কেনো?”
“এতো আমাদের হাতে নেই। আর আমাদের প্রার্থনা করা উচিত ছেলে কিংবা মেয়ে যাই হোক, সে যেনো সুস্থ হয়।”
“তর্ক করো না তো, কাপড় গুলো সামলে রাখো”

মনোক্ষুণ্ণ হলো উমা। প্রগতিশীল দেশে আজ ও কন্যা আর পুত্রের মাঝে এতোটা তফাত। উমা মন থেকে চায় তার যেনো একটা কন্যাসন্তান হয়। কিন্তু শ্বাশুড়ির এরুপ প্রতিক্রিয়ায় সে আহত হয়। লক্ষী দেবী চলে গেলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উমা। কন্যা হয়েও লক্ষী দেবীর মনে কন্যার অভিলাষা নেই। ভাবতেও বিরক্ত লাগছে উমার। মানুষের মনোভাবের এরুপ বিরুপ অবস্থা দেখে হতাশায় বুক ভরাক্রান্ত হয়ে উঠে তার।

বিকেল ৪.৩০,
অভিনব সিংহের পাশে দাঁড়িয়ে আছে রুদ্র। বাবা ছেলে পাশাপাশি দাঁড়ানোর পর ও তাদের মাঝে যেনো কথা বলার কিছুই নেই। অভিনব সিংহ শাল জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ঠান্ডা বেড়েছে এই প্রান্তে। বয়সটাও বেড়েছে, সেকারণেই হয়তো এখন তার ঠান্ডা সহ্য হয় না এখন। রুদ্র প্যান্টের পকেটে হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি সামনের বিলানটির দিকে। গ্রাম ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। মানুষ শহরে কর্মের জন্য ছুটছে। নিস্তব্ধতা চিরে রুদ্রই কথার সূচনা করলো। নির্লিপ্ত কন্ঠে বললো,
“শুনলাম, এবার নাকি মেয়রের পদে দাঁড়াচ্ছেন, কখনো ভাবি নি আপনার বিরুদ্ধে দাঁড়াবো”
“আমার বিরুদ্ধে তো এই প্রথম দাঁড়াও নি তুমি”
“আমি তো শুধু মুক্তি চেয়েছি, আপনি আমাকে জোর করে নিজের মুঠোতে রেখেছেন।”
“আমি তোমার বাবা, তোমার ভালো চাই।”

অভিনব সিংহের কথায় বিদ্রুপের হাসি হাসে রুদ্র। তার হাসির ঝংকার অভিনব সিংহের মুখোভাব বদলে দেয়। রুদ্র তখন ধীর স্বরে বলে,
“কোন বাবা নিজের ছেলের প্রগতিতে অখুশি হয় বলুন তো? কোন বাবা শুধু নিজের ছেলেকে নিজের মুঠোয় রাখার জন্য তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে?”

রুদ্রের প্রশ্নে থমকে যায় অভিনব সিংহ। পরমূহুর্তে……..

চলবে

#উমা [কপি করা নিষেধ]
#৪২তম_পর্ব

অভিনব সিংহের কথায় বিদ্রুপের হাসি হাসে রুদ্র। তার হাসির ঝংকার অভিনব সিংহের মুখোভাব বদলে দেয়। রুদ্র তখন ধীর স্বরে বলে,
“কোন বাবা নিজের ছেলের প্রগতিতে অখুশি হয় বলুন তো? কোন বাবা শুধু নিজের ছেলেকে নিজের মুঠোয় রাখার জন্য তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে?”

রুদ্রের প্রশ্নে থমকে যায় অভিনব সিংহ। পরমূহুর্তে রুদ্র রুঢ় স্বরে বলে,
“শুধুমাত্র আমাকে নিজের হাতের মুঠোয় রাখার জন্য, আপনি আমার বন্ধুকেও হত্যা করতে দু বার ভাবেন নি। আপনি জানতেন আমি যদি রাজনীতিতে জড়াই আমি আপনার অধীনে থাকবো না। তাই আপনি করিমকে হত্যা করিয়েছিলেন। আমি ভেবেছিলাম, আমার শত্রুরা আমাকে হত্যা করার জন্য ওর উপর আক্রমণ করেছে। বলুন বাবা, কোন পিতা নিজের সন্তানের সাথে এরুপ আচারণ করে। তার সন্তানের উন্নতির মাঝে বাধা তৈরি করে?”

অভিনব সিংহ অবিচল। শান্ত দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে রয়েছে রুদ্রের মুখপানে। রুদ্রের চোখগুলো জ্বলজ্বল করছে। তার বুকে জ্বলন্ত অগ্নিশিখার প্রতিচ্ছবি চোখে ভেসে উঠছে। তিনি ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো৷ তারপর ধীর স্বরে বললো,
“আমি তোমার ভালো চাই রুদ্র। পৃথিবী অনেক কঠিন। এখানে ক্ষমতার প্রাধান্য সর্বত্র। সেই ক্ষমতার বিষাক্ত খেলায় আমি তোমাকে আনতে চাই নি। আমাকে দেখো, এ হাতে কত মানুষের লহমা লেগে আছে জানা নেই। আমি চাই নি তুমি সেই দুনিয়ায় আসো। এর চেয়ে আমার অপদার্থ মাতাল ছেলেটি হয়ে থাকো তাতে আমার আপত্তি নেই। আমার অধীনে তোমার কেউ ক্ষতি করবে না।”
“তার জন্য আমার ভালোবাসার মানুষের ক্ষতি হবে আর আমি মুখ বুজে দেখবো?”
“এই ভালোবাসা মায়া সব আপেক্ষিক৷ আমাকে দেখো, সম্পর্কের মায়া আমাকে কখনোই দূর্বল করে নি। তোমার মায়ের লাশখানা দেখলেও আমি কাঁপবো না। নিজের বোনকে বিধবা করার সময়ও আমি দু বার ভাবি নি। আমার কাছে সবচেয়ে মূল্যবান আমি নিজে। তোমাকে আমার প্রতিচ্ছবি রুপে গড়তে চেয়েছিলাম। যার ইহজীবনে মায়া নামক দূর্বলতা থাকবে না। যে হবে বজ্রের ন্যায় কঠোর। কিন্তু তোমার জীবনে ওই নিখিলের মেয়ে আসাতে তুমি বদলে গিয়েছো। এখন কি না আমার বিরুদ্ধেই লড়ছো। এখন তুমি পিতা হতে চলেছো, আরো একটি মায়া তোমাকে আকড়ে ধরবে। যখন এই মায়ার বোঝায় নিজেকে দূর্বল বোধ করবে তখন এই পিতার কথা তুমি স্মরণ করবে। যাই হোক, তুমি এখন স্বাধীনচেতা একজন পুরুষ। নিজের সকল সিদ্ধান্ত নিজেই নিচ্ছো। শুনেছি জনগনের মাঝে তোমার প্রবল জনপ্রিয়তা। আশা করি আমাকে হারিয়ে দিবে। তবে আমি কিন্তু নিজের শত্রুদের ছেড়ে দেই না। আমার লক্ষ্যের মাঝে যারা বাধা সৃষ্টি করবে তারাই আমার শত্রু। হোক সে আমার ছেলে মেয়ে অথবা আমার ভগিনীপুত্র।”

অভিনব সিংহের ঠান্ডা স্বর হিম ধরিয়ে দিলো রুদ্রের শিরদাঁড়ায়। অবনমিত চোয়াল খাড়া শক্ত হয়ে উঠলো। বাঁকা হাসি হেসে বললো,
“আমার শিরায় আপনার ই তো রক্ত। হারতে আমিও শিখি নি। শত্রুতা যেহেতু করেছি, নিঁখুত ভাবেই করবো।”

অভিনব সিংহের হাসি প্রসারিত হলো। শীতল পরিবেশ মূহুর্তেই উষ্ণ হয়ে উঠলো। বাবা ছেলের তীক্ষ্ণ চাহনী একে অপরকে ভেদ করছে। তারা ভুলেই গিয়েছে তারা পিতা পুত্র। সূর্য দিগন্তে ভিড় জমিয়েছে। নীলাম্বরি রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে রক্তিম আভায়। পাখিরা ঘরে ফেরায় উদ্যোক্ত। সূর্যাস্ত নতুন সূর্যের উদয়ের যবনিকা, কেউ জানে না আগামী সূর্যোদয়ে তাদের জন্য কি অপেক্ষা করছে।

ফেরার পালা উমাদের। ফুলির মা নিজের টুকরি বেধেছে। সে ও যাবে উমাদের সাথে। উমার এমনাবস্থায় একজন বয়স্ক তার সাথে থাকাটা জরুরী। লক্ষী দেবীর যাওয়া সম্ভব নয়। তাই তিনি ফুলির মাকে পাঠাচ্ছেন। অনেক ধরণের পিঠেপুলি বাক্সবন্দি করে দেওয়া হয়েছে। বাগানের কলা, পেপে বেধে দিয়েছে। হাজারো নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। ছেলে হবার জন্য পুরুতের দেওয়া ফুলটি উমার আঁচলে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। রুদ্র আগে আগেই গাড়িতে উঠে বসেছে। উমা শ্বশুর শাশুড়ীকে প্রনাম করলো। অভিনব সিংহ গতদিন তাকে কিছুই বলে নি। তবে আজ বলছে। শান্ত, গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
“নিজের এবং আসছে নারায়নের খেয়াল রেখো”
“যদি সে লক্ষী হয়?”
“যে আসবে আমার ই রক্ত। সাদরেই গ্রহণ করবো। তবুও বংশের প্রদীপের ব্যাপার ও আছে। মেয়ে মানুষ তো বংশের সূচনা করে না।”

উমা স্মিত হাসে। নম্র স্বরে বলে,
“প্রার্থনা করবেন যেনো সে সুস্থ হয়, মা ছেলে দেক বা মেয়ে। আমরা তাকে মানুষ রুপেই গড়ে তুলবো”

উমার জড়তাহীন কথায় কপাল কুঞ্চিত হয়ে আসে লক্ষী দেবীর। কিন্তু তার শারীরিক অবস্থার কথা ভেবেই দমে গেলেন। মেয়েটি আগে এতো কথা বলতো না। কিন্তু এখন মুখ খুললেই মনে হয় কেঁচি চলে। অভিনব সিংহ বাঁকা হাসি হাসলেন। উমার মাঝের পরিবর্তন দেখলে মনেই হয় না, এই মেয়েটি একদিন মাথা নত করে তার বাড়ির অবহেলিত আসবাবের মাঝে পড়ে থাকতো। উমা গাড়িতে উঠলো। গাড়ি স্টার্ট দিলো রুদ্র। পিচের রাস্তা এগিয়ে গেলো তাদের গাড়ি। কিছুদূর যেতেই জানালার কাঁচ নামিয়ে আঁচলে বাঁধা কুসংস্কারের বীজটি ফেলে দেওয়া হলো একরাশ অবহেলায়। কোথাও না কোথাও এক দলা পাথর নেমে গেলো মস্তিষ্কের কোঠর থেকে___________

২২.
সংঘটনের অফিসে হিসেব মিলাচ্ছে উমা। এই মাসে বেশ কয়েকটা সেলাইমেশিন প্রদান করা হয়েছে। নারীরা প্রগতিকে বরণ করছে ব্যাপারখানা বেশ ভালো লাগছে উমার। প্রতিটি নারীর সাবলম্বী হওয়া উচিত। সাবলম্বী নারীর কারোর দয়ার প্রতীক্ষায় থাকতে হয় না। তাই তো আজ শিল্পীর কারো কাছে দয়াভিক্ষা চাইতে হচ্ছে না। সেদিনের ঝামেলার দু দিবস বাদেই মকবুলের সাথে চরম দূর্ঘটনা ঘটে। একটুর জন্য সে যমের দোয়ারে যায় নি। কিন্তু সারাজীবনের জন্য সে পঙ্গু হয়ে গিয়েছে। হাত পা নাড়াতে পারে না। মকবুলের এমন অবস্থা দেখে শিল্পীর দয়া হয়। যতই হোক মানুষটা তার সন্তানের পিতা। তাই শত অত্যাচারের পর ও সে তাকে অবহেলা করতে পারে নি। নিজের সামান্য আয়েই তাদের সংসার চলছে। উপরন্তু উমা তাকে একটি জমি দিয়েছে। যা কেটে মাছ চাষ করা যাবে। শিল্পী জমিটা বর্গা দিয়েছে৷ ফলে তার অভাব বেশ লাঘব হয়েছে। উমার স্মিত হাসি দেখে শিউলী প্রশ্ন করে,
“এই অসুস্থ শরীরে এদিকে আসা কি খুব জরুরী? রুদ্র দা তোকে আসতে দিয়েছে?”
“আমার কলেজ বাড়ি করতে ভালো লাগে না গো, রাজশ্বীটাও থাকে না। গোপাল স্কুলের পর কোচিং এ যায়৷ মিনুটা টিভি নিয়েই বসে থাকে। আর ফুলির মা সারাক্ষণ এটা সেটায় মুখে পুড়ে দেয়। তাই ইচ্ছে হয় না, বাসায় থাকতে। আর এই সংগঠন টা আমার প্রাণ। প্রাণ ছেড়ে কি করে থাকবো। আর হিসেবটাও তো দেখতে হবে।”
“বিকেল হতে চলেছে, এবার উঠ। গাড়ি এসে পড়েছে হয়তো।”
“আচ্ছা এ মাসে নতুন সদস্য কতজন হলো?”
“দশজন বেড়েছে। তাদের ক্লাস আগামী সোমবার। তুই নিবি?”
“এবার আমি নিবো না। তুমি ই নিয়ে নিও।”

বলে উঠে দাঁড়ালো উমা। শরীরটা ক্লান্ত লাগছে। গর্ভাবস্থার তৃতীয় মাস চলে, সময় পাখির মতো উড়ছে যেনো। এখন সাবধানতা আরোও বেড়েছে তার৷ রুদ্র তার জন্য গাড়িটা বাসায় ই রাখে। উমার যাতায়াতে যেনো কোনো অসুবিধা না হয়। উমা শিউলিকে বাকি কাজ বুঝিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেয়।

শাশ্বতের সামনে মাহমুদ সরদার বসে রয়েছে। তার আঙ্গুলের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেট। মুখে একরাশ কালো ভয় কুণ্ডলী পাকিয়েছে। ক্ষণে ক্ষণে এক একটা টান দিচ্ছে আর প্রবল বেগে হাটু নাচাচ্ছে। শাশ্বত বাঁকা হাসি হেসে বললো,
“কি সরদার মশাই? ভয় টা কি বেশি পেয়ে গেলেন?”
“ভয় পাবো কেনো? আমি কোনো অন্যায় করেছি নাকি?”
“বিঘার পর বিঘা জমি হাতিয়ে মাস চাষ করাটা কি অন্যায় নয়? বেনামী জমি সরকারের, সেই জমি নিজের বলে দাবী করা অন্যায় নয়? ব্যাক্তি মালিকানায় সুদ খাওয়া অন্যায় নয়? চরম সুদে মানুষকে ঋণগ্রস্থ করে তাকে হয়রানি করা অন্যায় নয়? সবথেকে বড় ব্যাপার, চালান পথে মাদকদ্রব্য পাচার করা কি অন্যায় নয়?”

মাহমুদ চোখ নামিয়ে নিলো। শুকনো ঢোক গিলে বললো,
“কি চাই আপনার?”
“ভেবে বলছেন তো? আমি কিন্তু মানুষটি লোভী”
“আরে ভনিতা না করে বলুন ই না কতো টাকা চাই। দিচ্ছি”

সরদারের ব্যাকুল কন্ঠে উচ্চ শব্দে হাসে শাশ্বত। তার হাসির ঝংকারে কেঁপে উঠে মাহমুদ সরদার। তার কাছে শাশ্বত ভয়ংকর একজন ব্যাক্তি। যার মনে কোনো প্রকার ভয়ের রেশ নেই, নেই কোনো দূর্বলতা। তারপর হাসি থামিয়ে শাশ্বত বললো,
“টাকার মোহ আপনাদের মতো অমানুষদের আছে আমার নয়। আমার মোহ সত্যের। আমি যে সত্যান্বেষী। আমি শুধু সত্য জানতে চাই”
“কিসের সত্য?”
“দারোগা উত্তম মুখার্জির মৃত্যুর সত্য”

কথাটা শুনেই সরদারের মুখখানা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। শুকনো ঢোক গিললো সে। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে তার। বুকের বা পাশটায় চিনচিকে ব্যাথা। শাশ্বত তার অবস্থা দেখে বললো,
“দুটো উপায় আছে হয় আমাকে সত্যটা জানাবেন নয় আগামী প্রতিবেদন আপনার নামেই হবে। আর আমি হাওয়ায় হুমকি দেই না”

বলে উঠে দাঁড়ালো শাশ্বত। এবার আর পিছু হটবে না সে। বাবার খুনীকে উপযুক্ত শাস্তি দেবে সে। সে যেই হোক না কেনো!

উমার গাড়ি চলছে আপন গতিতে। রুদ্রের কড়া নির্দেশ গাড়ির গতি ধীর রাখতে। উমার যেনো কোনো অসুবিধা না হয়। উমার নজর বাহিরের দিকে। হাতখানা নিজের পেটের উপর। কেউ একজন প্রতিনিয়ত তার মাঝেই বাস করছে ভাবতেই ভালো লাগছে তার। হঠাৎ ক্রমশ জোড়ে ব্রেক কষলো গাড়ি চালক প্রদ্যুত। উমা নিজেকে কোনো মতে সামলালো। ভয়ার্ত কন্ঠে উমা জিজ্ঞেস করে,
“কি হয়েছে প্রদ্যুত দা? ব্রেক করলে যে!”
“বৌমনি, কেউ গাড়ির সামনে চলে এসেছে। আপনি থাকুন আমি দেখছি।”

বলেই বাইরে বের হলো প্রদ্যুত। গাড়ির সামনে লোকের ভিড় জমেছে। মানুষের গোল শোনা যাচ্ছে। উমার বুক কাঁপছে। হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে ভয়ে। আর বসে থাকতে পারলো না সে। বাধ্য হয়ে গাড়ি থেকে বের হলো সে। ভিড় ঠেলে যে দৃশ্য চোখে পড়লো তা হাত পায়ে হিম ধরিয়ে দিলো উমার……….

চলবে

[#উমা [কপি করা নিষেধ]
#৪২তম_পর্ব

অভিনব সিংহের কথায় বিদ্রুপের হাসি হাসে রুদ্র। তার হাসির ঝংকার অভিনব সিংহের মুখোভাব বদলে দেয়। রুদ্র তখন ধীর স্বরে বলে,
“কোন বাবা নিজের ছেলের প্রগতিতে অখুশি হয় বলুন তো? কোন বাবা শুধু নিজের ছেলেকে নিজের মুঠোয় রাখার জন্য তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে?”

রুদ্রের প্রশ্নে থমকে যায় অভিনব সিংহ। পরমূহুর্তে রুদ্র রুঢ় স্বরে বলে,
“শুধুমাত্র আমাকে নিজের হাতের মুঠোয় রাখার জন্য, আপনি আমার বন্ধুকেও হত্যা করতে দু বার ভাবেন নি। আপনি জানতেন আমি যদি রাজনীতিতে জড়াই আমি আপনার অধীনে থাকবো না। তাই আপনি করিমকে হত্যা করিয়েছিলেন। আমি ভেবেছিলাম, আমার শত্রুরা আমাকে হত্যা করার জন্য ওর উপর আক্রমণ করেছে। বলুন বাবা, কোন পিতা নিজের সন্তানের সাথে এরুপ আচারণ করে। তার সন্তানের উন্নতির মাঝে বাধা তৈরি করে?”

অভিনব সিংহ অবিচল। শান্ত দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে রয়েছে রুদ্রের মুখপানে। রুদ্রের চোখগুলো জ্বলজ্বল করছে। তার বুকে জ্বলন্ত অগ্নিশিখার প্রতিচ্ছবি চোখে ভেসে উঠছে। তিনি ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো৷ তারপর ধীর স্বরে বললো,
“আমি তোমার ভালো চাই রুদ্র। পৃথিবী অনেক কঠিন। এখানে ক্ষমতার প্রাধান্য সর্বত্র। সেই ক্ষমতার বিষাক্ত খেলায় আমি তোমাকে আনতে চাই নি। আমাকে দেখো, এ হাতে কত মানুষের লহমা লেগে আছে জানা নেই। আমি চাই নি তুমি সেই দুনিয়ায় আসো। এর চেয়ে আমার অপদার্থ মাতাল ছেলেটি হয়ে থাকো তাতে আমার আপত্তি নেই। আমার অধীনে তোমার কেউ ক্ষতি করবে না।”
“তার জন্য আমার ভালোবাসার মানুষের ক্ষতি হবে আর আমি মুখ বুজে দেখবো?”
“এই ভালোবাসা মায়া সব আপেক্ষিক৷ আমাকে দেখো, সম্পর্কের মায়া আমাকে কখনোই দূর্বল করে নি। তোমার মায়ের লাশখানা দেখলেও আমি কাঁপবো না। নিজের বোনকে বিধবা করার সময়ও আমি দু বার ভাবি নি। আমার কাছে সবচেয়ে মূল্যবান আমি নিজে। তোমাকে আমার প্রতিচ্ছবি রুপে গড়তে চেয়েছিলাম। যার ইহজীবনে মায়া নামক দূর্বলতা থাকবে না। যে হবে বজ্রের ন্যায় কঠোর। কিন্তু তোমার জীবনে ওই নিখিলের মেয়ে আসাতে তুমি বদলে গিয়েছো। এখন কি না আমার বিরুদ্ধেই লড়ছো। এখন তুমি পিতা হতে চলেছো, আরো একটি মায়া তোমাকে আকড়ে ধরবে। যখন এই মায়ার বোঝায় নিজেকে দূর্বল বোধ করবে তখন এই পিতার কথা তুমি স্মরণ করবে। যাই হোক, তুমি এখন স্বাধীনচেতা একজন পুরুষ। নিজের সকল সিদ্ধান্ত নিজেই নিচ্ছো। শুনেছি জনগনের মাঝে তোমার প্রবল জনপ্রিয়তা। আশা করি আমাকে হারিয়ে দিবে। তবে আমি কিন্তু নিজের শত্রুদের ছেড়ে দেই না। আমার লক্ষ্যের মাঝে যারা বাধা সৃষ্টি করবে তারাই আমার শত্রু। হোক সে আমার ছেলে মেয়ে অথবা আমার ভগিনীপুত্র।”

অভিনব সিংহের ঠান্ডা স্বর হিম ধরিয়ে দিলো রুদ্রের শিরদাঁড়ায়। অবনমিত চোয়াল খাড়া শক্ত হয়ে উঠলো। বাঁকা হাসি হেসে বললো,
“আমার শিরায় আপনার ই তো রক্ত। হারতে আমিও শিখি নি। শত্রুতা যেহেতু করেছি, নিঁখুত ভাবেই করবো।”

অভিনব সিংহের হাসি প্রসারিত হলো। শীতল পরিবেশ মূহুর্তেই উষ্ণ হয়ে উঠলো। বাবা ছেলের তীক্ষ্ণ চাহনী একে অপরকে ভেদ করছে। তারা ভুলেই গিয়েছে তারা পিতা পুত্র। সূর্য দিগন্তে ভিড় জমিয়েছে। নীলাম্বরি রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে রক্তিম আভায়। পাখিরা ঘরে ফেরায় উদ্যোক্ত। সূর্যাস্ত নতুন সূর্যের উদয়ের যবনিকা, কেউ জানে না আগামী সূর্যোদয়ে তাদের জন্য কি অপেক্ষা করছে।

ফেরার পালা উমাদের। ফুলির মা নিজের টুকরি বেধেছে। সে ও যাবে উমাদের সাথে। উমার এমনাবস্থায় একজন বয়স্ক তার সাথে থাকাটা জরুরী। লক্ষী দেবীর যাওয়া সম্ভব নয়। তাই তিনি ফুলির মাকে পাঠাচ্ছেন। অনেক ধরণের পিঠেপুলি বাক্সবন্দি করে দেওয়া হয়েছে। বাগানের কলা, পেপে বেধে দিয়েছে। হাজারো নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। ছেলে হবার জন্য পুরুতের দেওয়া ফুলটি উমার আঁচলে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। রুদ্র আগে আগেই গাড়িতে উঠে বসেছে। উমা শ্বশুর শাশুড়ীকে প্রনাম করলো। অভিনব সিংহ গতদিন তাকে কিছুই বলে নি। তবে আজ বলছে। শান্ত, গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
“নিজের এবং আসছে নারায়নের খেয়াল রেখো”
“যদি সে লক্ষী হয়?”
“যে আসবে আমার ই রক্ত। সাদরেই গ্রহণ করবো। তবুও বংশের প্রদীপের ব্যাপার ও আছে। মেয়ে মানুষ তো বংশের সূচনা করে না।”

উমা স্মিত হাসে। নম্র স্বরে বলে,
“প্রার্থনা করবেন যেনো সে সুস্থ হয়, মা ছেলে দেক বা মেয়ে। আমরা তাকে মানুষ রুপেই গড়ে তুলবো”

উমার জড়তাহীন কথায় কপাল কুঞ্চিত হয়ে আসে লক্ষী দেবীর। কিন্তু তার শারীরিক অবস্থার কথা ভেবেই দমে গেলেন। মেয়েটি আগে এতো কথা বলতো না। কিন্তু এখন মুখ খুললেই মনে হয় কেঁচি চলে। অভিনব সিংহ বাঁকা হাসি হাসলেন। উমার মাঝের পরিবর্তন দেখলে মনেই হয় না, এই মেয়েটি একদিন মাথা নত করে তার বাড়ির অবহেলিত আসবাবের মাঝে পড়ে থাকতো। উমা গাড়িতে উঠলো। গাড়ি স্টার্ট দিলো রুদ্র। পিচের রাস্তা এগিয়ে গেলো তাদের গাড়ি। কিছুদূর যেতেই জানালার কাঁচ নামিয়ে আঁচলে বাঁধা কুসংস্কারের বীজটি ফেলে দেওয়া হলো একরাশ অবহেলায়। কোথাও না কোথাও এক দলা পাথর নেমে গেলো মস্তিষ্কের কোঠর থেকে___________

২২.
সংঘটনের অফিসে হিসেব মিলাচ্ছে উমা। এই মাসে বেশ কয়েকটা সেলাইমেশিন প্রদান করা হয়েছে। নারীরা প্রগতিকে বরণ করছে ব্যাপারখানা বেশ ভালো লাগছে উমার। প্রতিটি নারীর সাবলম্বী হওয়া উচিত। সাবলম্বী নারীর কারোর দয়ার প্রতীক্ষায় থাকতে হয় না। তাই তো আজ শিল্পীর কারো কাছে দয়াভিক্ষা চাইতে হচ্ছে না। সেদিনের ঝামেলার দু দিবস বাদেই মকবুলের সাথে চরম দূর্ঘটনা ঘটে। একটুর জন্য সে যমের দোয়ারে যায় নি। কিন্তু সারাজীবনের জন্য সে পঙ্গু হয়ে গিয়েছে। হাত পা নাড়াতে পারে না। মকবুলের এমন অবস্থা দেখে শিল্পীর দয়া হয়। যতই হোক মানুষটা তার সন্তানের পিতা। তাই শত অত্যাচারের পর ও সে তাকে অবহেলা করতে পারে নি। নিজের সামান্য আয়েই তাদের সংসার চলছে। উপরন্তু উমা তাকে একটি জমি দিয়েছে। যা কেটে মাছ চাষ করা যাবে। শিল্পী জমিটা বর্গা দিয়েছে৷ ফলে তার অভাব বেশ লাঘব হয়েছে। উমার স্মিত হাসি দেখে শিউলী প্রশ্ন করে,
“এই অসুস্থ শরীরে এদিকে আসা কি খুব জরুরী? রুদ্র দা তোকে আসতে দিয়েছে?”
“আমার কলেজ বাড়ি করতে ভালো লাগে না গো, রাজশ্বীটাও থাকে না। গোপাল স্কুলের পর কোচিং এ যায়৷ মিনুটা টিভি নিয়েই বসে থাকে। আর ফুলির মা সারাক্ষণ এটা সেটায় মুখে পুড়ে দেয়। তাই ইচ্ছে হয় না, বাসায় থাকতে। আর এই সংগঠন টা আমার প্রাণ। প্রাণ ছেড়ে কি করে থাকবো। আর হিসেবটাও তো দেখতে হবে।”
“বিকেল হতে চলেছে, এবার উঠ। গাড়ি এসে পড়েছে হয়তো।”
“আচ্ছা এ মাসে নতুন সদস্য কতজন হলো?”
“দশজন বেড়েছে। তাদের ক্লাস আগামী সোমবার। তুই নিবি?”
“এবার আমি নিবো না। তুমি ই নিয়ে নিও।”

বলে উঠে দাঁড়ালো উমা। শরীরটা ক্লান্ত লাগছে। গর্ভাবস্থার তৃতীয় মাস চলে, সময় পাখির মতো উড়ছে যেনো। এখন সাবধানতা আরোও বেড়েছে তার৷ রুদ্র তার জন্য গাড়িটা বাসায় ই রাখে। উমার যাতায়াতে যেনো কোনো অসুবিধা না হয়। উমা শিউলিকে বাকি কাজ বুঝিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেয়।

শাশ্বতের সামনে মাহমুদ সরদার বসে রয়েছে। তার আঙ্গুলের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেট। মুখে একরাশ কালো ভয় কুণ্ডলী পাকিয়েছে। ক্ষণে ক্ষণে এক একটা টান দিচ্ছে আর প্রবল বেগে হাটু নাচাচ্ছে। শাশ্বত বাঁকা হাসি হেসে বললো,
“কি সরদার মশাই? ভয় টা কি বেশি পেয়ে গেলেন?”
“ভয় পাবো কেনো? আমি কোনো অন্যায় করেছি নাকি?”
“বিঘার পর বিঘা জমি হাতিয়ে মাস চাষ করাটা কি অন্যায় নয়? বেনামী জমি সরকারের, সেই জমি নিজের বলে দাবী করা অন্যায় নয়? ব্যাক্তি মালিকানায় সুদ খাওয়া অন্যায় নয়? চরম সুদে মানুষকে ঋণগ্রস্থ করে তাকে হয়রানি করা অন্যায় নয়? সবথেকে বড় ব্যাপার, চালান পথে মাদকদ্রব্য পাচার করা কি অন্যায় নয়?”

মাহমুদ চোখ নামিয়ে নিলো। শুকনো ঢোক গিলে বললো,
“কি চাই আপনার?”
“ভেবে বলছেন তো? আমি কিন্তু মানুষটি লোভী”
“আরে ভনিতা না করে বলুন ই না কতো টাকা চাই। দিচ্ছি”

সরদারের ব্যাকুল কন্ঠে উচ্চ শব্দে হাসে শাশ্বত। তার হাসির ঝংকারে কেঁপে উঠে মাহমুদ সরদার। তার কাছে শাশ্বত ভয়ংকর একজন ব্যাক্তি। যার মনে কোনো প্রকার ভয়ের রেশ নেই, নেই কোনো দূর্বলতা। তারপর হাসি থামিয়ে শাশ্বত বললো,
“টাকার মোহ আপনাদের মতো অমানুষদের আছে আমার নয়। আমার মোহ সত্যের। আমি যে সত্যান্বেষী। আমি শুধু সত্য জানতে চাই”
“কিসের সত্য?”
“দারোগা উত্তম মুখার্জির মৃত্যুর সত্য”

কথাটা শুনেই সরদারের মুখখানা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। শুকনো ঢোক গিললো সে। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে তার। বুকের বা পাশটায় চিনচিকে ব্যাথা। শাশ্বত তার অবস্থা দেখে বললো,
“দুটো উপায় আছে হয় আমাকে সত্যটা জানাবেন নয় আগামী প্রতিবেদন আপনার নামেই হবে। আর আমি হাওয়ায় হুমকি দেই না”

বলে উঠে দাঁড়ালো শাশ্বত। এবার আর পিছু হটবে না সে। বাবার খুনীকে উপযুক্ত শাস্তি দেবে সে। সে যেই হোক না কেনো!

উমার গাড়ি চলছে আপন গতিতে। রুদ্রের কড়া নির্দেশ গাড়ির গতি ধীর রাখতে। উমার যেনো কোনো অসুবিধা না হয়। উমার নজর বাহিরের দিকে। হাতখানা নিজের পেটের উপর। কেউ একজন প্রতিনিয়ত তার মাঝেই বাস করছে ভাবতেই ভালো লাগছে তার। হঠাৎ ক্রমশ জোড়ে ব্রেক কষলো গাড়ি চালক প্রদ্যুত। উমা নিজেকে কোনো মতে সামলালো। ভয়ার্ত কন্ঠে উমা জিজ্ঞেস করে,
“কি হয়েছে প্রদ্যুত দা? ব্রেক করলে যে!”
“বৌমনি, কেউ গাড়ির সামনে চলে এসেছে। আপনি থাকুন আমি দেখছি।”

বলেই বাইরে বের হলো প্রদ্যুত। গাড়ির সামনে লোকের ভিড় জমেছে। মানুষের গোল শোনা যাচ্ছে। উমার বুক কাঁপছে। হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে ভয়ে। আর বসে থাকতে পারলো না সে। বাধ্য হয়ে গাড়ি থেকে বের হলো সে। ভিড় ঠেলে যে দৃশ্য চোখে পড়লো তা হাত পায়ে হিম ধরিয়ে দিলো উমার……….

চলবে