উমা পর্ব-৪৩+৪৪

0
389

#উমা [কপি করা নিষেধ]
#৪৩তম_পর্ব

উমার গাড়ি চলছে আপন গতিতে। রুদ্রের কড়া নির্দেশ গাড়ির গতি ধীর রাখতে। উমার যেনো কোনো অসুবিধা না হয়। উমার নজর বাহিরের দিকে। হাতখানা নিজের পেটের উপর। কেউ একজন প্রতিনিয়ত তার মাঝেই বাস করছে ভাবতেই ভালো লাগছে তার। হঠাৎ ক্রমশ জোড়ে ব্রেক কষলো গাড়ি চালক প্রদ্যুত। উমা নিজেকে কোনো মতে সামলালো। ভয়ার্ত কন্ঠে উমা জিজ্ঞেস করে,
“কি হয়েছে প্রদ্যুত দা? ব্রেক করলে যে!”
“বৌমনি, কেউ গাড়ির সামনে চলে এসেছে। আপনি থাকুন আমি দেখছি।”

বলেই বাইরে বের হলো প্রদ্যুত। গাড়ির সামনে লোকের ভিড় জমেছে। মানুষের গোল শোনা যাচ্ছে। উমার বুক কাঁপছে। হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে ভয়ে। আর বসে থাকতে পারলো না সে। বাধ্য হয়ে গাড়ি থেকে বের হলো সে। ভিড় ঠেলে যে দৃশ্য চোখে পড়লো তা হাত পায়ে হিম ধরিয়ে দিলো উমার, তার গাড়ির সামনে রক্তাক্ত একজন লোক পড়ে আছে অবচেতন অবস্থায়। লোকটির ঠোঁট চিরে রক্ত জমাট বেধে রয়েছে। ময়লা একটি শার্ট তার হায়ে জড়ানো। প্রচন্ড নিষ্ঠুরতার সাথে তাকে আঘাত করা হয়েছে। তার সারা অঙ্গের দাগ দেখে শিহরিত হয়ে গেলো উমা। কম্পিত স্বরে বললো,
“প্রদ্যুত দা, উনাকে হাসপাতালে নেবার ব্যাবস্থা করুন। উনার অবস্থা তো করুন”
“কিন্তু বউ মনি আপনার এই অবস্থায় বাড়ি যাওয়া বেশি জরুরি।”
“আপনি কি পাগল হলেন নাকি! উনার রক্তক্ষরণ দেখুন, উনাকে হাসপাতালে না দিলে মৃত্যু ও হতে পারে। আমি ঠিক আছি, প্রদ্যুত দা। আপনি উনাকে গাড়িতে তুলুন। আমরা এখন ই হাসপাতালে যাচ্ছি।”

উমার জড়তাহীন স্পষ্ট কথার বিপরীতে যুক্তি দাঁড় করাতে পারলো না প্রদ্যুত। বাধ্য হয়ে তাকে রক্তাক্ত মানুষটিকে গাড়িতে তুলতে হলো। গাড়ি যাত্রা করলো হাসপাতালের দিকে।

উমা হাসপাতালে পৌছালো তখন সূর্য ঢেলে পড়েছে পশ্চিম গগণে। লোকটির অবস্থায় বেগতিক অবস্থা দেখে অতিসত্বর তাকে ভর্তি করানো হলো। উমার ভেতরটা ঠান্ডা হয়ে আসছে। লোকটাকে হয়তো কেউ বেঁধে রেখেছিলো। ছুট পেয়ে প্রাণ বাঁচাতে ছুটেছে সে। তার মাঝেই উমার গাড়ির সামনে পড়ে গিয়েছে সে। আতঙ্কে অচেতন হয়ে গিয়েছে লোকটি৷ উমা বারান্দায় বসে রয়েছে। প্রদ্যুত ধীর স্বরে বললো,
“বাড়ি যাবেন না?”
“ডাক্তারের সাথে কথা না বলে যাওয়াটা ঠিক হবে না।”
“রুদ্র দাদা চটবেন যে, সন্ধ্যে হয়ে এলো। আপনাকে সন্ধ্যের আগে বাড়ি নিয়ে যেতে বলেছেন”
“একজন মানুষের প্রাণের চেয়ে কি আপনার রুদ্রদার মনরক্ষা করা বেশি জরুরী?”
“কিন্তু…”

উমার মুখশ্রী বিরক্তিতে ভরে এলো। সরু তীক্ষ্ণ চাহনী প্রয়োগ করলো সে প্রদ্যুতের প্রতি। প্রদ্যুত তার তীক্ষ্ণ চাহনীতে মাথা নামিয়ে নিলো। সে মনে মনে ঠিক করলো রুদ্রকে ফোনে জানিয়ে দিবে। এদিকে উমা অপেক্ষা করতে লাগলো কখন ডাক্তার বের হবে। লোকটিকে কেনো যেনো খুব পরিচিত লাগছে উমার কাছে। কোথাও তো দেখেছে কিন্তু মনে পড়ছে না। এর ই মাঝে ডাক্তার বেড়িয়ে এলো। উমা এগিয়ে যেয়ে জিজ্ঞেস করে,
“উনি কেমন আছেন?”
“রোগীর অবস্থা ভালো নেই। কতোদিন না খেয়ে আছেন ঠিক বলতে পারছি না। এক্স রে করিয়েছি, পাজরের হাড় ভেঙ্গে গিয়েছে। ভেতরে রক্তক্ষরণ হবার সম্ভাবনাও রয়েছে। উনি যে বেঁচে আছে এই ভাগ্য। উনাকে কোথায় পেয়েছেন বলুন তো? এতো অমানুষের মতো কেউ মারে মানুষকে! এ পুরোই পুলিশ কেস”

ডাক্তারের কথায় চিন্তিত উমা জিজ্ঞেস করে,
“বেঁচে যাবেন তো?”
“বলতে পারছি না। তবে এটা পুলিশ কেস, আপনি পুলিশে একটা খবর দিন। এমন হতেই পারে উনি এতোকাল গুম ছিলেন৷ কেউ তাকে মারতে চাইছে, হতেই পারে তারা আবার লোকটির উপর হামলা করবে। বুঝতে পারছেন? কোনো চান্স নেওয়া উচিত হবে না।”

উমা মাথা নাড়ালো। ডাক্তার চলে গেলে উমা একবার ওয়ার্ড এ লোকটিকে দেখে এলো। লোকটির মুখে অক্সিজেন মাক্স লাগানো, বুকটা হাপড়ের মতো উঠানামা করছে। সারা গায়ে ব্যান্ডেজের সাদা পট্টি। উমার দীর্ঘশ্বাস ফেললো। লোকটির করুন পরিণতি তাকে বিচলিত করছে। ভাবাচ্ছে বারংবার। উমা ওয়ার্ড থেকে বের হয়ে করিডোর দিয়ে হাটতে লাগলো। প্রদ্যুতকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। হয়তো গাড়িতে গিয়ে বসেছে। তাই উমা সেদিকে খেয়াল না করে সামনে হাটতে লাগলো। লোকটাকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে, লোকটির বেঁচে থাকা জরুরী। নয়তো কখনোই জানা যাবে না তার সাথে এমন অমানবিক নিষ্ঠুর কাজটি কে করেছে। এর মাঝেই তার ফোনটা বেজে উঠে। ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই “রুদ্র” নামটি ভেসে উঠলো। উমার বুঝতে বাকি রইলো না প্রদ্যুত কেনো তার জন্য অপেক্ষা করে নি। উমা ফোন ধরতেই অপর পাশ থেকে থমথমে কন্ঠে কানে এলো,
“তুমি এখন কোথায়?”
“হাসপাতালে”
“তোমার তো হাসপাতালে থাকার কথা নয়!”
“অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটেছে, তাই আসতে হয়েছে।”

রুদ্র কিছুসময় চুপ থেকে বললো,
“তোমার কবে বুদ্ধি হবে বলতো? ভোটের সময় ঘনিয়ে আসছে। হরতাল অবরোধ হচ্ছে হরহামেশা। এখন এতো সময় বাহিরে থাকা কি বুদ্ধিমানের? উপরন্তু তুমি একা নও, একজন জীবন তোমার মাঝে। তবুও তোমার এই গা ছাড়ামিটা বন্ধ হলো না।”
“একজন মানুষকে মৃত্যুর মুখে রেখে কিভাবে মুখ সরিয়ে নিন বলুন তো”

উমা কথা বলতে বলতেই এগিয়ে যায় হাসপাতালের গেটের দিকে। হঠাৎ থমকে যায় সে। রুদ্র গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রুদ্রকে দেখে খানিকটা অবাক হয় উমা। ফোন কেটে সামনে এগিয়ে যায় সে। বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“আপনি এখানে?”

রুদ্র কোনো কথা না বলে জড়িয়ে ধরে উমাকে। রুদ্রের কাজ আরোও অবাক করে উমাকে। তারপর ধীর স্বরে সে বলে,
“প্রদ্যুতের ফোনে তড়িৎ গতিতে এসেছি। দেখো এখনো বুক কাঁপছে।”
“আমি তো ঠিক আছি, কেনো ভয় পান বলুন তো?”
“ভয় কি শুধু শুধু পাই! আচ্ছা আমার কথা শুনলে কি হয়? বাসায় একটা লক্ষী মেয়ের মতো থাকলে কি হয়?মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় তোমাকে বন্ধী খাঁচায় আটকে রাখতে। তাহলে যদি আমার চিন্তা কমে।”
“আমি তো চাই না ঘরের চার দেওয়ালে বন্ধী থাকতে। সর্বদাই তো মুক্ত পাখি ছিলাম। তাহলে কিভাবে বন্দী খাঁচায় ধরা দেই!”

রুদ্রের স্মিত হাসিটা মলিন হয়ে যায়। সে জানে উমাকে চার দেওয়ালে সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব নয়৷ সে উড়তে চায়, সে তার নিজের পথ নিজে তৈরি করতে চায়। রুদ্র কথা বাড়ায় না। ধীর স্বরে বলে,
“গাড়িতে উঠো”
“আমাদের পুলিশ স্টেশন যেতে হবে একটু”

রুদ্রের চাহনী সরু হয়ে আসে৷ প্রশ্ন করে বসে,
“কেনো?”
“যে মানুষটি আমার গাড়ির সামনে পড়েছিলো তার আত্নীয়দের তো জানাতে হবে। নয়তো তারা জানবে কিভাবে?”
“তোমার এ নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলবে”
“মাথা ঘামাবো না কেনো? অদ্ভুত কথা বলছেন। মানু্ষটা কে, কি করে জানবো না? আর তার পরিবার ও অধীর আগ্রহে বসে আছে হয়তো। আমার তো মনে হয় লোকটাকে কেউ আটকে রেখেছিলো। কত অমানবিক ভাবে অত্যাচার করেছে আপনার কোনো ধারণা নেই। চোখের সামনে এমনটা দেখেও চুপ করে কিভাবে থাকি বলুন তো?”

উমার কথা শুনে রুদ্রের চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। সে গম্ভীর স্বরে বলে,
“শুধু শুধু ঝামেলা কাঁধে নেওয়ার কি আছে?”
“ঝামেলা কেনো বলছেন? এটা জরুরী”

এবার রুদ্র চুপ করে যায়৷ কিছু না বলে দৃষ্টি বাহিরে দেয়। নীরবতা বিরাজমান হয় গাড়িতে। উমার খানিকটা বিরক্তবোধ হয়। রুদ্র তাকে কেনো থামিয়ে দিচ্ছে। গাড়ি পিচের রাস্তা চিরে এগিয়ে যায় গন্তব্যের দিকে।

শাশ্বতের সামনে পুনরায় দাঁড়িয়ে আছে রাজশ্বী। আজ কাজ ভালো ভাবেই করেছে সে। শাশ্বতের মুখে প্রশান্তির ছাপ। স্মিত হেসে বললো,
“অবশেষে তুমি কাজ শিখেছো, যাক ভালো। এখন থেকে আরোও কিছু কাজ দিবো। চাপ বাড়বে কিন্তু”
“জ্বী”

রাজশ্বী ছোট করে “জ্বী” বলে। শাশ্বত মুচকি হেসে বলে,
“সেদিন কি বেশি বকে দিয়েছিলাম? এই কদিন তোমার মুখ ই দেখতে পেলাম না, ডুব দিয়েছো মনে হলো”
“ডুব দেই নি, সুমন দা কাজ বুঝিয়ে দিতো।”
“আমাকে ভয় পাও?”

রাজশ্বী উত্তর দিলো না। শাশ্বত এবার হাসি বিস্তৃত করে বললো,
“চলো নতুন কাজ দেই, সামনে তো নির্বাচন। তোমার কি মনে হয় কে জিতবে?”
“জানি না, অনুমান করা কঠিন।”
“আচ্ছা শোনো, জমি দখলের সে প্রতিবেদনটা সেটা তুমি করবে সুমনের সাথে। আমি কিছুদিন ব্যাস্ত থাকবো। এই নির্বাচন নিয়ে।”

বলেই অভিনব সিংহের ফাইলটা বের করে। এক এক করে অভিনব সিংহের কারসাজির সব প্রমাণ বের করে। রাজশ্বী অবাক কন্ঠে প্রশ্ন করে?
“এটা কি?
“এটা হলো প্রমাণ, কারোর সুখের সংসারে আগুন ধরাতে এটুকুই যথেষ্ট”
“এগুলো সব আপনি জোগাড় করেছেন?”
“না, সব না। কেউ আমাকে সাহায্য তো করছে। সে কে আমার জানা নেই।”

রাজশ্বী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে বলে,
“কেউ কোনো মনোবাঞ্ছা ছাড়া কেনো সাহায্য করবে আপনাকে?”

রাজশ্বীর প্রশ্নে থমকে যায় শাশ্বত। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে রাজশ্বীকে চলে যেতে বলে। রাজশ্বী চলে গেলে গভীর চিন্তায় পড়ে যায় শাশ্বত। সে কখনো গভীরভাবে চিন্তা করে নি। অভিনব সিংহের পতনে কার লাভ হবে! রকিবুল মাষ্টার নাকি অন্য কেউ! হঠাৎ ফোনের শব্দে চিন্তায় ভেদ ঘটে। ফোনটা রিসিভ করতেই………

চলবে

#উমা [কপি করা নিষেধ]
#৪৪তম_পর্ব

রাজশ্বী চলে গেলে গভীর চিন্তায় পড়ে যায় শাশ্বত। সে কখনো গভীরভাবে চিন্তা করে নি। অভিনব সিংহের পতনে কার লাভ হবে! রকিবুল মাষ্টার নাকি অন্য কেউ! হঠাৎ ফোনের শব্দে চিন্তায় ভেদ ঘটে। ফোনটা রিসিভ করতেই শাশ্বতের মুখশ্রী বদলে গেলো। এক চিলতে হাসি বিস্তৃত হলো ঠোঁটের কোনায়। নির্লিপ্ত স্বরে বললো,
“আমি আসছি, অপেক্ষা করুন”

ফোন রেখে উঠে দাঁড়ালো শাশ্বত। মানিব্যাগটা পকেটে পুড়ে অফিস থেকে বেড়িয়ে গেলো সে। শাশ্বতের চলে যাওয়া দেখে রাজশ্বী সুমনকে প্রশ্ন করে,
“স্যার কি সর্বদা দৌড়ের উপর ই থাকে?”
“খানিকটা থাকে, আসলে সিনিয়র রিপোর্টার কি না, যেখানে নিউজের কিছু পান কভার করার চেষ্টা করেন। এই পাড়ের সবচেয়ে দাপটে সাংবাদিক উনি। বড় বড় নেতা গোতারাও ভয় পায় তাকে। জানো বহুবার তাকে বলা হয়েছে ঢাকা যেতে, স্যার ই রাজী হন নি। কেনো হন ন উনি ই জানেন”

রাজশ্বী সুমনের কথাগুলো মন দিয়ে শুনছে, কিন্তু দৃষ্টি শাশ্বতের যাবার পানেই রয়েছে। লোকটিকে খুব অদ্ভুত ঠেকে রাজশ্বীর কাছে। কেমন যেনো রহস্যময়ী, সর্বদা কিছুর খোঁজে থাকে। কিসের খোঁজ জানা নেই তবে সর্বদা কিছু না কিছু খুজতেই থাকে। রাজশ্বী শাশ্বতকে খুব সূক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষণ করে। এই তপ সেদিন একজন নামী ব্যাবসায়ী তার অফিসে এসে তার সামনে একটা মোটা বাক্স রাখলো, অনুরোধ করলো যেনো কোনো খবর না করে। কিন্তু শাশ্বত এসবের ধার ধারে না। সে স্পষ্ট স্বরে বলে দিলো,
“এখন ই এই পেটি নিয়ে বেড়িয়ে যাবেন৷ আমি যেনো আপনার মুখখানা দ্বিতীয় বার না দেখি”

রাজশ্বীর মাঝে মাঝে ইচ্ছে জাগে, লোকটির মতো হবার। লোকটির ন্যায় ন্যায়পরায়ণ, সাহসী সাংবাদিক হবার মনোবাঞ্ছা তাকে বিচলিত করে। তাইতো মন দিয়ে কাজ করে সে। যেনো শাশ্বত ভুল ধরতে না পারে। কিন্তু শত চাইবার পর ও কেনো যেনো সব গুবলেট হয়ে যায়। তখন সুমন ধীর স্বরে বলে,
“আচ্ছা রাজশ্বী, এবারে তোমাকে যদি পুরো একখানা খবর কভার করতে দেই কেমন হবে?”
“ঠিক বুঝি নি”
“বলছি, শিবপুর ইউনিয়নের দিকে বেশ কিছু জমি দখল করা হচ্ছে। গ্রামের পর গ্রাম ফাকা হয়ে যাচ্ছে। তুমি কি আমার সাথে অদিকটা যেতে পারবে?”
“কবে যাবেন”

উৎসাহিত কন্ঠে প্রশ্নটি করে রাজশ্বী। সুমন কিঞ্চিত অবাক হয়, তার ধারণা নারী মানেই ভীতু। সে কল্পনা করেছি রাজশ্বীকে প্রশ্নটি করলে সে ভয়ে শিটিয়ে যাবে। কিন্তু তা হলো না। উলটো তার মাঝে এক অদম্য জ্যোতি জ্বলজ্বল করে উঠলো। দূর্দান্ত প্রেরণা নিয়ে উদ্যমী কন্ঠে সে প্রশ্নটি করলো। সুমন স্মিত হেসে বললো,
“তোমার কলেজ বন্ধ না শুক্রবার?”
“শুক্রবার ব্যাতীত যাওয়া যাবে না?”
“সারাদিনের কাজ তো শুক্রবার গেলেই ভালো হয়”

রাজশ্বী কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললো,
“আসলে দিদি জানে না আমি সাংবাদিকতায় যোগ দিয়েছি। সে জানে আমি বাচ্চা পড়াই। তাই চাচ্ছিলাম অন্য এক দিন যেতে।”
“সমস্যা নেই, বলবে ছাত্রীর পরীক্ষা। যেহেতু ওদিকে যাচ্ছি এক বেলা তো লাগবেই।”
“ঠিক আছে তাহলে কথা বলবো নে”
“খুব বড় খবর, তোমার নিজের জন্য ই ভালো”

রাজশ্বী মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। তারপর নিজ কাজে লেগে পড়ে। সত্যি অনেক বড় একটা খবর, সুমনের সাথে এটায় কাজ করলে সাংবাদিকতায় সে একটি বড় ধাপ পাড়ি দিবে। ভেবেই মন প্রসন্নতায় ছেয়ে গেলো রাজশ্বীর, লক্ষের দিকে একপা দুপা করে এগিয়ে যাচ্ছে সে। একদিন ঠিক লক্ষ্যজয় হবেই_________

২৩.
সূর্যোস্তের সময়, নীল আকাশ লাল আভায় ছেয়ে গিয়েছে। পাখিরা বাড়ি ফেরার তাগিদে ছুটছে। আযানের ধ্বনি কানে আসছে। শীতের প্রতাপটা কমছে না, গতরাতে বরফ পড়ার মতো ঠান্ডা লাগছিলো উমার। মাঘের শেষ সপ্তাহ চলছে। গাছের পাতাগুলো খয়েরি হয়ে গিয়েছে। নতুন কচি পাতা মাথা চিরে উঠছে। শীতের প্রকোটতা শেষের লগ্নে, বসন্ত আছসে জানান দিয়ে। বরই গাছটা কেটে ফেলেছে রুদ্র। তুলসি গাছে পানি দিয়ে হাত জড়ো করে প্রনাম করে উমা। ফুলির মা শাখ বাজাচ্ছে। পেটটা একটু ভারী হয়েছে। ডাক্তার তাকে বলেছে বেশি বেশি মাছ মাংস খেতে, ছিপছিপে গড়নের শরীরটা নাকি একটু বেশি দূর্বল। বাচ্চা হবার সময় ঝুকি থাকবে। তাই ক্ষণে ক্ষণে কিছু না কিছু নিয়ে হাজির হয় ফুলির মা। উমা প্রণাম করে প্রদীপ জ্বালায়। তখন ফুলির মার তীক্ষ্ণ কন্ঠ শোনা যায়। মিনুর সাথে লেগেছে। ফুলির মার আসার পর থেকে মিনুর সাথে লেগেই থাকে। উমার মুখে এক রাশ বিরক্তি ভেসে উঠে। সে শালটা ঠিক করে ভেতরে যায়। গোপালের উচ্চস্বরে পড়া শোনা যাচ্ছে। উমা গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“কি হলো ফুলির মা, চিৎকার করছো! যে? গোপাল তো পড়ছে নাকি”
“আমি কিতা করাম, এই মাইয়া একটা কাম চোর”
“মিনু আবার কি করেছে?”

ফুলির মার ধারণা মিনু একজন অকর্মণ্য মেয়ে। তার বিয়ে হলে সে স্বামীর ঘরে কিছুই করতে পারবে না। উমার প্রশ্নে সে কালো পোড়া পাতিল এগিয়ে বলে,
“দেখো বউ, আমি ওরে বললাম, আমি শাখ বাজাতে যাচ্ছি তুই বউ এর জন্য আপেলটা কাটে দে আর দুধ গরম কর। মাইয়া টিভি দেখতে বইছে। দুধ টা পুড়ায়ে দিছে। কতবড় অমঙ্গল হইলো”
“এগুলো কুসংস্কার, এসব কিছুই হয় না”
“তুমি জানো না বউ, দুধ পোড়া অশুভ। না জানি কোনো অঘটন ঘটবে। এই ছেড়ীরে কইলাম ল, দুধ পোড়াবি না। কিন্তু সারাডাক্ষণ শুধু ডিব্বার সামনে বইসে গীত শুনে।”

উমা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সময় এগোলেও মানুষগুলো এখন আগের মতোই আছে। কুসংস্কারে ঘেরা। শীতল কন্ঠে বললো,
“ফুলির মা, এমন কিছুই হয় না। অসর্তকতায় দুধ পুড়ে গেছে। ব্যাপারটি খুব স্বাভাবিক একটি ঘটনা। এই নিয়ে এতোটা চিন্তা করার কি আছে তাতো বুঝছি না। আর মিনু, তোমাকে বারংবার বোঝাতে বোঝাতে আমি ক্লান্ত। ঠিক সময়ে ফুলির মা যদি না দেখতো একটা অঘটন ঘটে যেতে পারতো। পাতিল দেখে বোঝা যাচ্ছে আগুন ধরে গিয়েছিলো। তাই বলি একটু সতর্ক হও। অঘটন৷ ঘটতে সময় লাগে না। গ্যাসের চুলো। আগুন ধরলে রক্ষে নেই। তাই বলছি একটু সতর্ক হও। ফুলির মা, তুমিও রবার ক্ষান্ত দেও। বাচ্চা মেয়ে, বুঝালে বুঝবে।”

উমার কথায় শান্ত হলো ফুলির মা, কিন্তু মন কু ডাকছে। কেনো যেনো তার মনে হচ্ছে কোনো অঘটন ঘটবে। তাও অতি শীঘ্রই।

উমা নিজের ঘরে পড়তে বসে। গর্ভাবস্থায় ও পড়ালেখায় কোনো ঘাটতি রাখে নি উমা। কলেজে যাচ্ছে, পরীক্ষাও দিচ্ছে। ছয়মাসের সময় শিক্ষকদের বলে বন্ধ দিবে সে, রুদ্রের সাথে তেমনটাই কথা হয়েছে। এর মাঝেই ফোনটা বেজে উঠে তার। অচেনা নম্বর দেখে কপাল কুঞ্চিত হয়ে আছে উমার। ফোনটা ধরতেই এক অচেনা কন্ঠ কানে আসে উমার,
“উমা রায় বলছেন?”
“জ্বী, বলুন”
“আমি কালীগঞ্জ থানার ওসি শ্রাবণ মুখোপাধ্যায় বলছি, বিগত সপ্তাহে আপনি একজন নিখোঁজ মানুষের নামে রিপোর্ট করান। সেই বিষয়ে কিছু কথা বলতাম”
“জ্বী, উনার পরিবারের মানুষের খোঁজ পাবার জন্য রিপোর্টটি করিয়েছিলাম। উনি হাসপাতালে ভর্তি এখনো। তার চিকিৎসা চলছে। জ্ঞান ফিরেছে উনার?”

উমার প্রশ্নে শ্রাবণ ধীর কন্ঠে বলে,
“জ্বী, উনার জ্ঞান ফিরেছে। কিন্তু একটা খারাপ খবর ও আছে।”
“খোলশা করে বলুন তো”
“উনার জ্ঞান ফিরেছিলো গতকাল রাতে, কিন্তু আজ সকালেই উনাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না……….

চলবে।