উমা পর্ব-৪৯+৫০

0
397

#উমা [কপি করা নিষেধ]
#৪৯তম_পর্ব

উমা কাগজগুলো গুছিয়ে রাখতে থাকে। কাগজ গুছাতে গুছাতে একটা সাদা ফাইল হাতে পড়ে উমার। ফাইলটি খোল ছিলো বিধায় অসর্তকতায় বেশ কিছু দলিল বেড়িয়ে আসে। দলিল গুলো গুছাতে গুছাতে উমার চোখে পড়ে, দলিল গুলো নতুন। মাস খানেক পূর্বে বানানো হয়েছে। এক রাশ কৌতুহল হয় উমার। এই জমি গুলো কবে কিনেছে রুদ্র! সে তাকে এই বিষয়ে কিছুই জানায় নি। যদিও সে মংলায় জমি কেনার কথা বলেছিলো। খুতিয়ে দেখলে খেয়াল করে জমিগুলো শিবপুরের মৌজায় পড়েছে। শিবপুর নামটি বেশ কিছুদিন পূর্বেই খবরের কাগজের কলামে পড়েছিলো উমা। রুদ্রের ব্যাবসা কিংবা কাজের ব্যাপারে কখনোই খুব মনোযোগী হয় নি উমা। রুদ্র নিজ থেকেই অনেককিছু তাকে বলতো, মাঝে মাঝে দু একটা বুদ্ধিও নিতো। সেকারণে তার কিছু কিছু ব্যাপার তার জানার আয়ত্তে রয়েছে। বাকি অনেকটাই একটা গোলকধাঁধা। মনে সন্দেহ না জাগার কারণে সেই ব্যাপারগুলোকে ঘাটে নি উমা। তবে আজ মনের অদূর আকাশে সন্দেহের ধূসর মেঘের আনাগোনা হচ্ছে। না চাইতেও বহু প্রশ্নেরা হুমড়ি খাচ্ছে মনে। যেখানে রুদ্রের কোনো ব্যাবসায়িক কাজ ই নেই সেই অন্ধলে বিঘার পর বিঘা জমি কেনো কিনেছে রুদ্র। মোট সাতখানা দলিল। উমা হিসেব করে দেখলো তাতে মোট ২০ বিঘার ন্যায় জমি রয়েছে। এতো জমি রুদ্র কেনো কিনেছে কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না উমার। উমা ধপ করে বসে পড়লো চেয়ারে। খবরের কাগজের কলামটির একটি লাইন তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে,
“শিবপুরে ভূমিদস্যুর তান্ডব, ঘরহীন মানুষ গায়েব হচ্ছে রাতারাতি”

পালপাড়া ছাড়িয়ে সামনে মেঠোপথ দিয়ে হেটে যাচ্ছে রাজশ্বী এবং সুমন। মাথার উপর আকাশ আলো করা তেজহীন সূর্য। রাজশ্বীর পায়ের গতি মন্থর। সুমন হাপিয়ে হাপিয়ে হাটছে। একটু পর পর শুধু মুখ থেকে বিরক্তির শব্দ করছে। তাদের আজকের পুরোদিনটাই যেনো মাটি লাগছে। কেউ তাদের সাথে কথা বলতেই আগ্রহী নয়। যতটা ঘরে কড়া নাড়ছে সকলে মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিচ্ছে। সুমনের লম্বাটে মুখখানা আরোও লম্বাটে লাগছে। তার মুখে আক্ষেপের এক গাঢ় রেখা। দুপাশে সবুজ ফসলের মাঝে চিংড়ীর ঘের। বসন্তের রঙ লেগেছে। সবুজ ঘাসে ঘেরা ঘের দেখতে খুব ই চমকপ্রদ লাগছে। এর মাঝে কিছু কচি ঘাসের উপর শিশিরবিন্দু চকচক করছে সূর্যের রশ্নিতে। অন্য সময় হলে হয়তো এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মনোরম প্রশান্তি দিতো রাজশ্বীকে। কিন্তু আজ দিচ্ছে না, সে অধৈর্য্য হয়ে উঠেছে। একটি মানুষো মুখ খুলছে না। ব্যাপারটা অবাক করছে তাদের। এর মাঝে এক দম্পতিকে চোখে পড়লো রাজশ্বীর। তারা ব্যাগগুলো কাধে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে৷ মহিলা তার পাঁচবছরের মেয়ের হাতটা শক্ত করে ধরেছে। আর পুরুষটি ব্যাগ বস্তা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। পেছনে একটি টেম্পোর মতো ছোট যানবাহন। সুমন ছুটে গেলো তার কাছে। সুমনের আকস্মিক ছুটে আসা দেখে ঘাবড়ে গিয়েছে লোকটি। আতঙ্কিত কন্ঠে বলে উঠলো,
“কি সমস্যা ভাই? এভাবে ছুটে আসছেন কেনো?”
“ভাই একটু দাঁড়ান, কিছু কথা ছিলো”
“আমরা কোনো কথা কইতে পারব না”

বলেই পাশ কাটালেই সুমন তাদের রাস্তা আটকায়। আকুতির স্বরে বলে,
“ভাই, দুই মিনিট। অল্প কিছু কথা”
“আরে মশাই কে আপনি, তক্ত করে যাচ্ছেন”

রাজশ্বী অবস্থার অবনতি দেখে ছুটে গেল। লোকটিকে ধীর গলায় বুঝানোর চেষ্টা করলো,
“ভাই, আমরা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো থেকে এসেছে। সামনেই তো ভোট, কোনো বাড়িতে কতটা ভোটার আছে সেটা জানতে এসেছে। আপনারা তো এই ইউনিয়নের ভোটার তাই নয় কি?”
“জ্বে”
“আপনারা কি কোথাও যাচ্ছেন?”
“জ্বে যাচ্ছি?”
“দেখে তো মনে হচ্ছে আপনারা একেবারের জন্য কোথাও যাচ্ছেন, কোথায় যাচ্ছেন?”

দম্পতির রাজশ্বীর প্রশ্নে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। রাজশ্বী অধিক আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলো উত্তরের। লোকটি এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বললো,
“আমরা দুজনই ভোট দেই, কার্ড ও আছে। আমরা শহরে যাচ্ছি, আমার জমি ভিটা বেঁচে দিছি।”
“ওমা কেনো?”
“কি আর কমু, হালার পুতেরা আমগোর চাষের জমি দখল কইরা নিছে। এখন কাম ছাড়া চলাম কেমনে? তাই বেঁচে দিছি।”

রাজশ্বীর চোখ চকচক করে উঠে সে সুমনকে দৃষ্টির ইশারা করে। সুমন সেটা বুঝে অবাক হবার রঙ্গ করে বলে,
“দখল কইরে নেছে, কে দখল করছে?”
“ওই চামার গুলান। রাতের অন্ধকারে জমি ঘেরাও দিয়ে দেছে”

লোকটির পত্নী তাকে বাধা দেয়। বাহু টেনে বলে,
“আহ, কি বলছো তুমি”
“আরে কইতে দাও। এরা সরকারি লোক।”

তারপর লোকটি বলতে শুরু করে,
“আর বইলেন না ভাই, রাতের আন্ধারে এক দল লোক আমগোর জমি দখল কইরে নেছে। আমাদের ধানের জমি গুলা রাতারাতি নিজের নামে করে লাইছে। আমরা মূখ্য মানুষ, কথা কইবার জন্য গেলে ওরা কয় প্রমাণ কই? আমাদের বাপ দাদার জমি, এতো কি কাগজ বানাইছি। হালার পুতেরা নকল কাগজ বানায়ে সব দখল করে লাইছে। চেয়ারম্যানের কাছে গেছি বিচারের জন্য। চেয়ারম্যান কয় কাগজ কই? কয়েকজন তো গেছিলো ও তাদের বিপক্ষে কথা কতি। লাভ হলো না গো, ছোয়াল দুটোরে জায়গায় মাইরে লাইলো। পুলিশের কাছে গেছি, পুলিশ কয় ছোটলোকের জাত মরবি ই তো। টাকা দেচ্ছে নে না, পরে আমরা ভাবলাম টাকা দিতাছে যখন তাই নেই। দামের আধা টাকায় বেঁচে দিছি। এখন সব বেঁইচে শহরে যাই। এই টাকায় রিক্সা চালাম, আর কি করবো!”

লোকটির স্ত্রী আঁচলে মুখ গুজে কাঁদে। লোকটি কনুইয়ে জল মুছে। রাজশ্বী স্তব্দ হয়ে যায় লোকটির বক্তব্যে। সুমন লোকটিকে বলে,
“চিন্তা কইরেন না ভাই, সব ঠিক হয়ে যাবে”
“দোয়া করবেন ভাই। আজকেরা আমরা সিধা বইলে মাইনষে আমগোরে ঠকায়ে পায়ের তলে পিসতেছে। আল্লাহ এগোর উপরে ঠাডা ফেলাবো।”

লোকটির চাপা কষ্টটি চোখে ছলছল করছে। এক রাশ বিতৃষ্ণায় বুক বিষিয়ে আসে রাজশ্বীর। না দেখেও কাউকে ঘৃণা করা যায় জানা ছিলো না তার। অন্যায়ের কি কোনো মাত্রা নেই। কতোটা পাশবিক হলে এই অক্ষরজ্ঞান মানুষগুলোর সরলতার সুযোগ নেওয়া যায়। এক অদৃশ্য জিদ চেপে বসে রাজশ্বীর মাথায়। জিদ সত্যকে সামনে আনার। জিদ, ওই পশুগুলোর মুখোশ টেনে ছিড়ার। দম্পতি সামনে এগিয়ে যায়। একটা লেবুনাতে উঠে চলে গেলো। সুমন আক্ষেপের স্বরে বলে,
“মানুষের মূল্যবোধ ধ্বংসাস্তউপে পরিণত হচ্ছে, অথচ আমাদের গর্ব আমরা নাকি মানুষ। পশুরাও এদেএ পাশবিকতায় লজ্জা পাবে”
“আমরা কি এদের থামাতে পারবো না?”

রাজশ্বীর ক্ষুদ্ধ কন্ঠে জিজ্ঞাস করা প্রশ্নে সুমন চুপ হয়ে গেলো। তার সত্যি জানা নেই এই প্রশ্নের উত্তর। সত্যি কি এদের থামানো সম্ভব?

২৫.
রুদ্র দু দিন হয়েছে ফিরে নি। দু-তিনবার কথা হয়েছে উমার সাথে। কিন্তু তা ক্ষনিকের জন্য। অভিনব বাবুর বেল হয় নি। আজ সকাল দশটায় তাকে কোর্টে তোলা হবে। এর পর তার বিচার হবে। উমা পুজো সেরে নিলো। ফুলির মা নাস্তা নিলো টেবিলের। আঁচলখানা টেনে উমা আসলো খাবার রুমে। ফুলির মা উমার শুকনো মুখখানা দেখে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,
“বউ ঘুম হয় নি?”

ফুলির মার প্রশ্নের উত্তর দিলো না উমা। বরং অন্যমনস্ত মনে হেটে হেসেলে ঢুকলো। উমার উদাসীনতা দেখে ফুলির মা তার কাছে এসে তার কাধে স্পর্শ করে। তখন উমা চমকে উঠে। এই দুদিন তার মন বড্ড উদাসীন। সারাটাক্ষণ গভীর চিন্তায় মন বিচলিত রয়েছে। তাই কোনো কিছুতেই তার মনোযোগ নেই। ফুলির মা তাকে চিন্তিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“বউ তোমার শরীরডা কি খারাপ? মুখটা চুপসাইয়া গেসে এক্কেরে। রুদ্র দাদা আইবো না আজকেরা? ওরে কমুনে ডাক্তার দেখাতে।”
“না গো, আমার কিছু হয় নি। শুধু দু দিন ঘুম হয় নি। তাই চোখ বসে গেছে।”
“আজ কলেজে যাওন লাগতো না তোমার। ফিট খাইয়া পইরে যাবা নে। পোয়াতি মাইয়াদের ঘরে থাকাই ভালা।”

উমা বুঝতে পারলো আজ ফুলির মা তাকে কলেজে যেতে দিবে না। কিন্তু আজ তার কলেজে যেতেই হবে। সামনে পরীক্ষা, বান্ধবীদের কাছ থেকে নোটপত্র জোগাড় করতে হবে তার। তাই ফুলির মার কথা বাধা দিয়ে বললো,
“সামনে পরীক্ষা ফুলির মা, এমনিতেও কিছুদিন পর কলেজে যাওয়া হবে না। তাই পরীক্ষাটা ভালো করে দিতে চাই।”
“এতো পইড়ে কিতা হবো?”
“অনেক কিছুই হবে গো, তুমি বুঝবে না”

হেসেই কথাটা বললো উমা। ফুলির মা বিরক্তি নিয়ে বললো,
“খায়ে নাও তো,বুঝি না বাপু তোমাদের রঙ্গঢং।”

উমা স্মিত হেসে খেতে বসলো। কিন্তু খাবারটা গলা দিয়ে নামলো না। মনের ভেতরে এক অস্বস্তি ডানা মেলে ঘাপতি মেরে আছে। কোনো মতে খেয়ে উঠলো উমা।

কলেজ শেষ হতে বিকেল হলো আজ। তেজহীন সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। উমা ব্যাগ থেকে ফোনটি বের করে দেখলো। রুদ্রের ফোন আসে নি। গতকাল রাতের পর আর কথা হয় নি রুদ্রের সাথে। উমা ফোন দিয়েছিলো ক বার কিন্তু সে ফোন ধরে নি। উমার চিন্তা বাড়লো। এমনটা কখনোই হয় না। সে রুদ্রের নম্বরে ফোন দিলো। কিন্তু ফোনটি বন্ধ। কিছু একটা ভেবে রুদ্রের গুদামে ফোন দিলো। অনেকক্ষণ বাজার পর টেলিফোন তুললো রক্তিম।
“আদাব, কেন বলছেন?”
“আমি উমা, রক্তিম দা?”
“হ্যা বলো উমা, আজ এখানে ফোন করলে যে?”
“উনি কি গুদামে এসেছেন?”
“না রুদ্র তো গুদামে আসে নি।”

উমা বিচলিত হয়ে পড়লো। কোনো অঘটন কি ঘটলো? সে চিন্তিত কন্ঠে বললো,
“উনি কি ফোন করেছিলো? কিছু জানেন ও বাড়ি কি হয়েছে?আমি ফোন করেছিলাম ধরেন নি, উপরন্তু তার ফোন বন্ধ।”
“চিন্তা করো না উমা, ওর সাথে আমার কথা হয়েছে। দুঃসংবাদ তো একটা আছেই। জ্যেঠুর বেল হয় নি। রুদ্র কোর্ট থেকে বের হয়েই ঘেরের দিকে চলে গিয়েছে। আজ কিছু পার্টির সাথে মিটিং আছে তার।”

রক্তিমের কথায় দীর্ঘশ্বাস ফেললো উমা। তারপর বলল,
“রক্তিম দা আমি রাখছি। ভালো থাকবেন”
“আচ্ছা”

ফোন রেখে গাড়িতে উঠলো উমা। প্রদ্যুত কে বললো,
“প্রদ্যুত দা, ঘেরের বাড়ি চলুন তো”
“বাড়ি যাবেন না?”
“দাদাকে নিয়ে তারপর যাবো”

প্রদ্যুত আর কথা বাড়ালো না। মিনিট বিশেক বাদে গাড়িটি থামলো ঘেরের বাড়ি। রুদ্রের মাছের ঘের এখানে। তার মাঝে একটা একতলা বাড়ি। বাড়িটি তত্ত্ববধায়কের থাকা খাওয়ার জন্য করা। রুদ্র প্রায় এখানে আসে। তার যত মিটিং সব এখানেই করে সে। উমা গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে গেলো বাড়ির দিকে। বাড়িটিকে দেখে কেনো যেনো বুকে কামড় পড়লো উমার। শুনশান একটা বাড়ি। হাতঘড়িতে তখন বিকেল ৫.৪৫টা বাজে। অথচ ঘেরের বাড়িতে কোনো সাড়া শব্দ নেই। উমা এগিয়ে গেলো বাড়ির দিকে। বাড়ির অন্দরেও কেউ নেই। পিনপতন নিরবতা৷ উমা এক একে সব ঘর গুলো দেখলো৷ মোট চারটি ঘর এই বাড়িতে। একটি রুদ্রের, বাকিগুলো অন্যদের। তার মধ্যে রুম ঘুরতে ঘুরতে আরেকটি দরজা দেখলো উমা। দরজাটি দেখে মনে হলো আরেকটি ঘরের। কিন্তু উমার জানা মতে এই বাড়িতে শুধু চারটি ই ঘর। সে দরজাটি ধাক্কা দিতেই একটি সিড়ি নেমে গেলো নিচের দিকে। উমার কেনো যেনো ভয় হচ্ছে৷ তবুও কৌতুহলের কাছে ভয় হার মানলো। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো সে। নামতে থাকলো অন্ধকার সিড়ি দিয়ে। মোবাইলের টর্চটা জ্বালিয়ে সাবধানতার সাথে থামতে থাকলো সে। হঠাৎ কারোর চিৎকার কানে এলো তার। বুকটা কেঁপে উঠলো। হিম ধরে গেলো শিরদাঁড়ায়। সিড়ি থেকে থেমেই একটি ঘর। যার দরজা আজানো। মশালের হলুদ রশ্নি ফাঁক থেকে চুইয়ে পড়ছে। উমা কাঁপা হাতে দরজাটা খুললো। যে দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠলো তাতে বুক কেঁপে উঠলো তার। চিনচিনে অসহনীয় ব্যাথায় আহত হলো হৃদয়……….

চলবে

#উমা [কপি করা নিষেধ]
#৫০তম_পর্ব

হঠাৎ কারোর চিৎকার কানে এলো তার। বুকটা কেঁপে উঠলো। হিম ধরে গেলো শিরদাঁড়ায়। সিড়ি থেকে থেমেই একটি ঘর। যার দরজা আজানো। মশালের হলুদ রশ্নি ফাঁক থেকে চুইয়ে পড়ছে। উমা কাঁপা হাতে দরজাটা খুললো। যে দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠলো তাতে বুক কেঁপে উঠলো তার। চিনচিনে অসহনীয় ব্যাথায় আহত হলো হৃদয়। শাবীব, তূর্য দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সামনে চারজন মানু্ষ নগ্ন দেহে হাটু গেড়ে বসে রয়েছে। তাদের শরীর চিরে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। একজনকে খুব সহজেই চিনে ফেললো উমা। বেঁধে রাখা লোকগুলোর সামনে একজন শ্বেত প্রশস্থ দেহধারী মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। তার শরীর ঘামে ভেজা, হাতে একখানা চিকন রডের ন্যায় বস্তু। তাতে তাজা রক্ত লেগে রয়েছে। উমার লোকটিকে চিনতে কষ্ট হলো না। হাতে থাকা মোবাইলটি মাটিতে পড়ে গেলো অগোচরেই। চোখ ঝাপসা হয়ে এলো একরাশ বিষাক্ত যন্ত্রণায়, মুখ থেকে আড়ষ্ট কন্ঠে বেড়িয়ে এলো,
“নিষ্ঠুর”

উমার কন্ঠ কর্ণপাত হতেই মানুষটি তার দিকে ফিরে তাকায়। রক্তিম হিংস্র চোখজোড়া তীর্যক দৃষ্টি প্রয়োগ করে উমার দিকে। উমা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। তার বুকটা কাঁপছে, অসহ্য যন্ত্রণায় জ্বলছে। সামনে থাকা লোকটিকে যে সে বিশ্বাস করতো, ভালোবাসতো। রুদ্রের পাশবিকতায় বাতাসটি যেনো আজ কলুষিত, বিষাক্ত। রুদ্রের হাতে থাকা রডটি খসে পড়ে মাটিতে। চোখের হিংস্রতা পরিণত হয় দুশ্চিন্তা এবং ত্রাশে। আড়চোখে অবস্থার বিবেচনা করে সে, তারপর দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে উমাকে চেপে ধরে নিজের সাথে। শাবীবের উদ্দেশ্যে বলে,
“এদের ভেতরে নিয়ে যা”

শাবীব তূর্য লোকগুলোকে ওই ঘরের পাশের ঘরে নিয়ে যায়। উমা এখনো স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। আতঙ্কে তার পাজোড়া হিম ধরে গিয়েছে। কালো ভয়ে মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। বিশ্বাসের প্রাচীর ভাঙ্গলে যে রক্তক্ষরণ হয় তা শরীরের রক্তক্ষরণের চেয়েও অধিক অসহনীয় এবং যন্ত্রণাদায়ক হয়। রুদ্র উমার মুখখানা তুলে ধরে আকুল কন্ঠে বললো,
“দুঃস্বপ্ন ছিলো ভুলে যাও”

উমার চোখ বেয়ে সূক্ষ্ণ জলের রেখা গড়িয়ে পড়ে কোমল গালে। বিতৃষ্ণা, ঘৃণা, ক্রোধে ঝাপসা হয়ে যায় চোখগুলো। এতোটা পাশবিকতা কি কোনো মানুষের মাঝে থাকতে পারে। মাথাটা ঘুরছে উমার। মেঝেতে কালো রক্তের ছাপ চোখে পড়তেই গা গুলিয়ে আসছে। দৃশ্যটি এতোটাই রুঢ় এবং নিষ্ঠুর যে মস্তিষ্ক কিছুতেই মেতে নিতে পারছে না। মাথার পেছনটা দপদপ করছে। নিস্তেজ শরীরটা নিজেকে ধরে রাখার শক্তি পাচ্ছে না। চোখের দৃষ্টি আবছা হয়ে এলো। ঢলে পড়লো সে রুদ্রের বুকে। অচেতন শরীরটা ভার ছেড়ে দিলো। তলিয়ে পড়লো উমা নিকষকৃষ্ণ গভীর আঁধারে________

জ্ঞান ফিরতে নিজেকে রুদ্রের ঘরে আবিষ্কার করলো উমা। উমা চোখ ঘুরিয়ে দেখে নিলো স্থানটা। উমার অনুভব হলো যেনো শরীরের ভারটা অধিকগুন বেড়ে গিয়েছে এবং এক বিন্দু শক্তি অবশিষ্ট নেই। শরীরটিকে তুলে ধরা তার পক্ষে সম্ভব হলো না। গলাটা শুকিয়ে এসেছে। মস্তিষ্ক যেনো নিস্ক্রিয় হয়ে উঠলো৷ কিছুক্ষণ পূর্বের দৃশ্য গুলো চোখের সামনে সিনেমার পর্দার ন্যায় এক এক করে ভেসে উঠলো। সেই দৃশ্য মনে পড়তেই পেট মুচরিয়ে বমি পাচ্ছে। ঘরে পিনপতন নিস্তব্ধতা। টিউবলাইটের সফেদ আলোতে আঁধার ঘরে সেই দৃশ্য গুলো ভ্রম মনে হতে লাগলো। সত্যি কি যেগুলো ঘটেছিলো? নাকি সব কেবল অবচেতন মনের কল্পনা! এক মূহুর্তের জন্য সব কিছু অবিশ্বাস করতে করতে ইচ্ছে হলো উমার। বাস্তব এবং কল্পনার মাঝে নিজেকেই গুলিয়ে ফেলেছে সে। ঠিক তখন ই রুদ্রের আগমণ ঘটলো৷ জলের গ্লাস হাতে সে প্রবেশ করলো রুমে। উমা সরু দৃষ্টিতে তার পানে চাইলো। সেই হিংস্র চোখজোড়া এখন পরম মায়ায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু তার সফেদ শার্টের কোনায় রক্তের ছিটায় উমার সকল ভ্রম বাস্তবতায় পরিণত হলো। চোখ ঝাপসা হয়ে এলো নোনা বিষাদে। রুদ্র তার দিকে এগিয়ে আসতেই মুখ ঘুরিয়ে নিলো উমা। তার বিশ্বাস গলা টিপতে দুবার ভাবলো না এই পুরুষটি! এতো পাষন্ড কাউকে আদৌও ভালোবাসতে পারে! সে ভালোবাসা কি আদৌ সত্য ছিলো! নাকি সব কিছুই ক্ষণিকের বাসনা! ক্ষণিকের মরীচিকা! মূহুর্তের রঙ্গিন জীবন ধূসর ছাই বর্ণের হয়ে গেলো! উমার মনে হলো তার রংধনুর মূহুর্তগুলো সব মিথ্যে। রুদ্র চোয়াল শক্ত। তার চোখে শান্ত দৃষ্টি। বুকটা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে প্রেয়সী চোখে নিজের জন্য ঘৃণার রেখায়। চেয়ারটা টেনে বসলো রুদ্র। জলের গ্লাসটি এগিয়ে দিয়ে শান্ত গলায় বললো,
“জলটা খেয়ে নাও”

উমা ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে তাকালো রুদ্রের দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে ক্ষুদ্ধ কন্ঠে বলে উঠে,
“কোনো মানুষ এতোটা পশু হতে পারে আমার জানা ছিলো না!”
“তোমার জানার বাহিরেও অনেককিছু আছে উমা; সবকিছু জানতে হবে এমনটাতো কথা নেই”
“নির্মম পাশবিক অত্যাচার করার সময় হাত কাঁপলো না আপনার! তারাও কারোর পিতা, কারোর ছেলে, কারোর স্বামী। একটি বার নিজের সন্তানের কথাও ভাবলেন না! এই রক্তাক্ত হাতে কিভাবে ছুবেন তাকে! আপনি আমায় কথা দিয়েছিলেন, কথা দিয়েছিলেন এই হাতে কারোর রক্ত লাগতে দিবেন না! কি হলো সেই কথার! সব মিথ্যে! সব ধোয়াশা! কেবল মরীচিকা!”

উমা চিৎকার করে কাঁদছে। তার বিলাপ কানে আসছে রুদ্রের। কিন্তু সে নির্বিকার। শান্ত দৃষ্টিতে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। উমা এক সময় চোখ মুছে নিলো, খুব কষ্ট করে উঠে বসলো সে। মনের জোর যেখানে গুড়ো গুড়ো হয়ে যায় সেখানে শরীর ও কেবল ই মাংসের দলা। উমাকে উঠতে দেখে নড়ে চড়ে উঠে রুদ্র। চেয়ার ছেড়ে উমাকে ছুতে নেয়। উমা তাকে বাধা দেয়,
“ছোবেন না আমাকে, রক্ত লেগে আছে এই হাতে। নিস্পাপ মানুষের রক্ত। অবশ্য অভিনব সিংহের রক্ত কি ভালো হতে পারে! কি অপরাধ ছিলো তাদের! কেনো এতোটা পাশবিক অত্যাচার করছেন! কেনো? ওই ডাক্তারটিকে আপনি এতোদিন আটক করে রেখেছিলেন তাই না? তাই তো যখন হাসপাতাল থেকে সে গায়েব হয়ে গেলো আমাকে পুরো ঘটনা থেকে দূরে রেখেছিলেন। কি দোষ এদের! কেনো এসব! উত্তর দিন!”

উমা রুদ্রের শার্ট আকড়ে ধরে। একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকে! এতোসময় পর রুদ্র অবশেষে মুখ খুলে,
“এদের বাঁচার অধিকার নেই, মানুষ রুপী জানোয়ার গুলো পৃথিবীতে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া শ্রেয়। আমিতো তাও এদের বাঁচিয়ে রেখেছি।”

রুদ্রের উত্তরে স্তব্ধ হয়ে যায় উমা। উমার মনে হলো এই রুদ্র সেই পূর্বের রুদ্র, নির্মম, নিষ্ঠুর রুদ্র। যার কাছে মানুষ কেবল ই এক দলা হাড় মাংসের স্তুপ। রুদ্র উমার চোখে চোখ রেখে বললো,
“জিজ্ঞেস করছিলে না এদের দোষ কি! তবে জেনে রাখো, এদের জন্মানোটাই দোষ। আমার কাছে এরা নর্দমার কিট। আর রুদ্র সিংহ রায় কাউকে দয়া করতে শিখে নি। এই ধরণীতে নরকের স্বাদ কেমন লাগে তাদের ও জানা উচিত। উমা, আমি কখনো ভালো ছিলাম না। অভিনব সিংহের রক্ত কি ভালো হতে পারে! আমি এমন ই, আমার সন্তান ও তার জানোয়ার বাবাকে চিনবে!”

উমা স্তব্ধ হয়ে রইলো। আজ মানুষটির কথাগুলোও তার অচেনা লাগছে। অজানা লাগছে সেই চির পরিচিত মানুষটিকে। উমা সঠান হয়ে দাঁড়ালো, রুদ্রের চোখে চোখ রেখে বললো,
“একটা প্রশ্নের উত্তর দিবেন?”
“বলো”
“কেনো? সব তো ভালোই ছিলো”
“আমি এমন ই, আমি তো বলেইছিলাম উমা। নিজেকে বদলাতে পারবো না। এই পৃথিবী ভালো মানুষের নয়। বাদল, মকবুল, এই ডাক্তারের মতো মানুষগুলো তোমাকে ভালো থাকতে দিবে না।”

রুদ্রের হেয়ালী কথার মর্মার্থ বুঝতে পারবো না উমা। উমা তীক্ষ্ণ গলায় বলে উঠে,
“যদি অপরাধী হয়ে থাকে তবে আইন আছে”
“তোমার মনে হয় আইন সত্যি আছে? যখন আইন ই দূষিত থাকে, তখন কোনো আইন সত্যি অন্ধ হয়ে যায়। আর আমি কখনোই আইনের অপেক্ষা করি নি, প্রতিবার শাস্তি নিজ হাতেই দিয়েছি।”

রুদ্র এবার শান্ত গলায় বললো,
“আজ যা হয়েছে ভুলে যাও, ভুলে যাও এখানে এসেছিলে, ভুলে যাও কিছু দেখেছো। আমাদের জীবন যেমন ছিলো তেমন ই থাকবে।”
“সম্ভব নয়! সব ভুলে পুনরায় আগের মতো থাকতে যে পারবো না আমি। মানলাম তারা অন্যায় করেছে। কিন্তু আপনার কোনো অধিকার নেই এই পাশবিক কর্মকান্ড চালানোর। তারা যদি দোষী হয় আপনিও নিষ্কলুষ নয়।”

রুদ্রের উত্তরটা জানা ছিলো। কিন্তু তবুও সে উমার রুঢ়তা নিতে পারছে না। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। রুদ্র চোখ বুঝে নিজেকে সামলে নিলো। উমার চোখে চোখ রেখে দৃঢ় কন্ঠে বললো,
“আফসোস এই পশুর সাথেই তোমাকে থাকতে হবে। এই প্রশুর সাথেই থাকতে হবে চিরটাকাল। ঘৃণা করো বা ভালোবাসো এই পশুই তোমার সন্তানের পিতা”

রুদ্রের দৃষ্টিতে হিংস্রতা স্পষ্ট, সাথে এক অদম্য জিদ। জিদ উমাকে নিজের সাথে বেধে রাখার। উমা নিশ্চুপ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো রুদ্রের দিকে, এতো কাছে থেকেও এক অদৃশ্য দেয়াল তাদের মাঝে। এই দেওয়াল ভাঙ্গা ইহজীবনে কি সম্ভব___________

অভিনব সিংহ মাটিতে বসে আসেন। তার সেলটি অন্যরকম। যথেষ্ট পরিষ্কার, মাটিতে শুলেও মোটা দুটো কম্বল দেওয়া হয়েছে। অভিনব সিংহ সেলে পায়চারী করছেন। তখন ই এক কস্টেবল এসে খুলে দিলো তার সেলের লকাপ। হিনহিনে স্বরে বললো,
“আপনার সাথে দেখা করতে এসেছে। আসুন। সময় পনেরো মিনিট”

অভিনব সিংহের সাথে এমন হেয় ভাবে কথা এই প্রথম কেউ বললো। কিন্তু সে এই অপমান গিলে নিলেন। দেখা করার জায়গায় জালের ওপাশে দীপঙ্গকর দাঁড়িয়ে আছে। অভিনব বাবুকে দেখেই সে জিজ্ঞেস করলো,
“জ্যেঠু, কেমন আছেন?”
“দীপঙ্কর আমাকে দেখে তোমার কি মনে হচ্ছে?”

দীপঙ্কর একটু দমলো। অভিনব বাবু তখন বললো,
“বাহিরের অবস্থা কি?”
“কি বলবো জ্যেঠু, কোনো উকিল আপনার কেস লড়তে চাচ্ছে না। শাশ্বত একেবারে ঝোপে কোপ মেরেছে। এতো নিঃশব্দে এতো বড় চাল চালবে বুঝতেই পারি নি। একেবারে ঘোড়ার আড়াই।”
“বেশি কথা ভালো লাগে না দীপঙ্কর”
“আমাকেই বকে গেলেন জ্যেঠু৷ অবশ্য আপনার ও মাথা কি ঠিক আছে৷ যেখানে দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পুষেছেন। ছোবল তো দিবেই। অবশ্য দুটো কালসাপ এক সাথে ছোবল দিলে তো মৃত্যু নিশ্চিত থাকে”

দীপঙ্কর অপ্রাসঙ্গিক কথায় বিরক্ত হলেন অভিনব বাবু। হুংকার ছেড়ে বললেন,
“খলসা করে বলো দীপঙ্কর”

এবার দীপঙ্কর বললো,
“শাশ্বত একা আপনাকে ফাঁসায় নি, রুদ্রদাদা ছিলো পেছনে………..

চলবে।