উষসী হাসবে বলে পর্ব-১৫+১৬

0
252

#উষসী_হাসবে_বলে (১৫)
লিখা- Sidratul Muntaz

গান থেমে গেছে। তারা চেয়ে আছে একে-অপরের মুখের দিকে। ইয়ামিন ঘোর আবেশ নিয়ে বলল,” তুমিই পেইন্টিং-এর সেই অরূপ মোহিনী। আমার চিত্ররূপসী!”

উষসী মুচকি হাসল। স্পষ্ট কণ্ঠে বলল,” আমি জানি। কিন্তু আপনি তো অস্বীকার করছিলেন।”

” তখন বুঝতে পারিনি। নিজের কাছেই ধোঁকা খেয়েছি। অস্বীকার করেও লাভ কি হলো? ফাইনালি ধরা পড়তেই হলো।”

একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ইয়ামিন। উষসী শব্দ করে হাসল। তার এই হাসি দেখলেই কেমন কেঁপে উঠে ভেতরটা। ইয়ামিন ভ্রুদ্বয় বাঁকিয়ে আরও একটু ঝুঁকে এলো। উষসীকে ভীষণ কাছ থেকে পরখ করে সিরিয়াস গলায় বলল,” তুমি কি জানো, তোমার হাসি কত সুন্দর? তোমার এই মুখ খুঁজে পেতে আমি কতবছর অপেক্ষা করে থেকেছি… অবশেষে পেয়েছি তোমাকে।”

উষসী মনমরা কণ্ঠে বলল,” সবাই তো বলে, আমি দেখতে আমার আপুর মতো!”

” না, তুমি তোমার আপুর মতো না। তুমি অন্যরকম। আমার দেখা সবচেয়ে চমৎকার হাসির অধিকারীনি, সুহাসিনী তুমি।”

“কতটা ভালোবাসেন আমাকে?”

” যতটা ভালোবাসলে নিজেকে ভুলে থাকা যায়, তার চেয়েও বেশি।”

” আপনি নিজেকে ভুলে আছেন?”

” আমি সবকিছু ভুলে আছি।”

” সবকিছু?”

ইয়ামিন উঠে দাঁড়িয়ে বলল,” প্রমাণ দেখতে চাও যে আমি সবকিছু কিভাবে ভুলে আছি?”

তার মুখভঙ্গি অবিচল। উষসী নির্বাক,শুধু তাকিয়ে থাকে। ইয়ামিন তার ক্যানভাসের কাছে গিয়ে নীল চাদোয়া সরিয়ে দেয়। তখনি উন্মুক্ত হয় বিশাল সাদা ক্যানভাসে আঁকা মায়াদেবীর মতো সুন্দর চিত্রটি। তার পাশে লেখা,” সুহাসিনী।” নিচে ইয়ামিনের সিগনেচার।

কি অদ্ভুত মনোরম সেই হাসি মাখা মুখ। নিজের হাসিটা চিনতে উষসীর ভুল হয় না একটুও। সে অনেকবার হাসতে হাসতে আয়নায় মুখ দেখেছে। কিন্তু কখনও বুঝতে পারেনি তার নিজের হাসিতেই যে এতো সৌন্দর্য্য লুকিয়ে আছে! রঙতুলির ছোঁয়ায় তা যেন আরও চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। কিন্তু এমন নির্ভুল চিত্র কিভাবে সম্ভব? ইয়ামিন বুঝি এতোটাই খুঁটিয়ে দেখেছে তাকে?

উষসী প্রশংসা করার ভাষা পায় না৷ ধীরপায়ে এসে পেইন্টিং এর উপর হাত রাখে৷ ইয়ামিন হাত ভাঁজ করে পাশেই দাঁড়িয়ে আছে৷ হঠাৎ বলল,” এটা এখানে বসেই এঁকেছিলাম। শ্যুটিং, রেকর্ডিং সবকিছু প্যাকআপ করে। কারণ কিছুতে মনোযোগ দিতে পারছিলাম না। সবকিছুতে জেঁকে ছিলে তুমি। তোমাকে আঁকার তৃষ্ণা আমার অস্থির মন অচল করে দিচ্ছিল। আই ওয়াজ ফুলি স্টাকড অন ইউ।”

উষসীর হৃদয়ের বর্ষণ চোখ ছাপিয়ে নামে। সে ধরা গলায় বলল,” আমার কাছে পুরো ব্যাপারটা স্বপ্ন মনে হচ্ছে। কবে থেকে আমাকে এতো ভালোবেসেছেন আপনি?”

” বলবো তবে এই মুহূর্তে না। একেবারেই সব জেনে ফেলতে নেই। আস্তে আস্তে জানবে।”

উষসী তাকিয়ে থেকে বলল,” কাল সকালে চলে যাচ্ছি আমরা। আবার কবে দেখা হবে তাহলে?”

” ভাগ্য আমাদের বার-বার দেখা করিয়েছে। যদি ভাগ্যে থাকে তাহলে আবার দেখা হবেই। ”

উষসী জোরে কেঁদে ফেলল। তার মনে চাপা কষ্ট কাজ করছে। সে জানে এটা কখনোই সম্ভব না৷ প্রিয়ন্তি যদি এসব কথা বাড়িতে জানায় তাহলে উষসীর বিদেশে আসার সমস্ত উপায় বন্ধ হয়ে যাবে। তখন ইয়ামিনের সাথে দেখা হবে কিভাবে? ইয়ামিন কি আসবে তার জন্য বাংলাদেশে?

ইয়ামিন তার চোখের পাতার অশ্রুকণা মুছে দিয়ে বলল,” প্লিজ, এই কান্না আমি দেখতে চাই না। সুহাসিনীর হাসি যতটা সুন্দর কান্না ঠিক ততটাই অসুন্দর।”

উষসী পেইন্টিংটা আলতো হাতে জড়িয়ে ধরে বলল,” এটা আমি সাথে নিয়ে যাবো।”

ইয়ামিন কঠিন গলায় বলল,” না। আমার চিত্ররূপসী শুধুই আমার ব্যক্তিগত। অন্যকোনো পেইন্টিং চাইলে দিতে পারি। কিন্তু জলপরী আর সুহাসিনী দেওয়া যাবে না।”

” জলপরী?”

” তোমার আগের পেইন্টিংটার নাম দিয়েছি জলপরী।”

” দু’টোই তো আমার ছবি। আমার দু’টোই লাগবে।”

” একটাও পাবে না।”

ইয়ামিনের কণ্ঠ নির্বিকার। উষসী রেগে বলল,” আশ্চর্য, আমার পেইন্টিং আমি কেন পাবো না?”

” কারণ আমি দেবো না।”

” কেন দিবেন না?”

ইয়ামিন চোখে চোখ রেখে বলল,” আমার তাই।”

তার কণ্ঠে এতো অধিকারবোধ উষসীর হৃদয় কামড়ে ধরে। কণ্ঠের তেজ সামান্য কমিয়ে বলল,” যদি আপনারই হয় তাহলে এক্সিবিশনে দিয়েছিলেন কেন?”

” আমি দেইনি। আমাকে না জানিয়ে মা পাঠিয়ে দিয়েছিল।”

উষসী হাত ভাঁজ করে বলল,” আমি তো এমনি নিবো না। ন্যায্য মূল্য দিয়ে কিনে নিবো। তাও দিবেন না?”

ইয়ামিন চোখ ছোট করে বলল,” চিত্ররূপসী আমার কাছে অমূল্য। এর দাম নির্ধারন করাই অসম্ভব।”

উষসী অহংকারে শির উঁচু করে বলল,” আমার পেইন্টিং এতো স্পেশাল! নিজেকে তাহলে প্রিসিয়াস ভেবে ভুল করিনি আমি।”

তার বলার ধরণ দেখে ইয়ামিন হেসে ফেলল। তারপর বলল,” কাগজ আর রঙতুলির দাম না হয় দিলে.. কিন্তু আমার অনুভূতির দাম কি দিয়ে শোধ করবে?”

” যা আপনি চাইবেন।”

” তাই?” ভ্রু উঁচু করে শুধাল ইয়ামিন।

” হুম। ভেবে দেখুন৷ এমন সুযোগ কিন্তু বার-বার আসবে না!”

উষসী ঠোঁট চেপে হাসল। ইয়ামিন চোখ নামিয়ে তাকাল ওই সুন্দর ঠোঁটের দিকে। কিঞ্চিৎ লজ্জায় আড়ষ্ট হলো উষসীর দেহ। অচিরেই দু’জন খুব কাছে এগিয়ে এলো। ইয়ামিন নিচু হয়ে উষসীর কোমরে হাত রাখল।উষসী উঁচু হয়ে ইয়ামিনের কাঁধে হাত রাখল।

উচ্চতার পার্থক্য কমে যেতেই তারা খুব আলতো স্পর্শে ছুঁয়ে দিল একে-অন্যের ঠোঁট। স্পর্শ গভীর হওয়ার আগেই দরজায় করাঘাতের কটূ শব্দ আলোড়ন তুলে দিল সারাঘরে। থমথমে নীরবতা ভেঙে অনুভূতিরা লুটিয়ে পড়ল মেঝেতে।

ইয়ামিন সরে গেল। উষসী পেছনে ফিরে হাত দিয়ে মুখ ঢাকল। নিশ্বাস ভারী হয়ে গেছে। সবকিছু ঘোলাটে, ঝাপসা মনে হচ্ছে। কোনমতে চাদোয়া দিয়ে পেইন্টিং-টা ঢেকেই দরজা খুলে দিল ইয়ামিন। হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢুকে গেল প্রিয়ন্তি। তার পেছনে ঢুকল তৃষ্ণা আর ফারদিন।

ঘরে ঢুকেই জহুরী নজরে প্রিয়ন্তি চারদিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল,” তোরা কি করছিলি?”

উষসী বিষম খেল। তাকে কাশতে দেখে প্রিয়ন্তির চাহনি আরও তীব্র হলো,” কাশছে কেন ও?”

ইয়ামিন বলল,” কোল্ড ফিভার মনে হয়। আজকে গাড়ি থামিয়ে স্নোফলে ভিজেছিল সেজন্যই হয়তো।”

“কিন্তু তোরা দরজা আটকে কি করছিলি?”

উষসী কাশি রোধ করে বলল,” পেইন্টিং দেখছিলাম।”

” দরজা আটকে?” প্রিয়ন্তী রাগ নিয়ে প্রশ্ন করল।

ফারদিন নিচু গলায় বলল,” বাদ দাও না প্রিয়।”

প্রিয়ন্তি পেছনে ঘুরে গরম চোখে তাকাতেই মিইয়ে গেল ফারদিন৷ তৃষ্ণা চোখ তুলে সবাইকে পর্যবেক্ষণ করছে। তার হাতে একটা গরম ড্রিংকস। স্ট্র দিয়ে সেটা খাচ্ছে আরাম করে। প্রিয়ন্তি চড়া গলায় বলল,” উষু, তৃষ্ণাকে নিয়ে রুমে যা।”

” আমি যাব না।” তৃষ্ণার গা ছাড়া উত্তর।

প্রিয়ন্তী চোখ পাকিয়ে তাকাতেই তৃষ্ণা অনুরোধ করল,” সবাই তো এখানেই আছে। তাহলে আমি থাকলে প্রবলেম কি? প্লিজ ফুপস। ”

” কেউ এখানে থাকবে না। এন্টস আর ফারদিন আঙ্কেল যাবে তোমার সাথে। যাও।”

প্রিয়ন্তি কড়া চোখে ফারদিনকে ইশারা দিল। ফারদিন কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলল,”এসো উষু, প্লিজ।”

তার অভিব্যক্তি দেখে মনে হলো ভয় পাচ্ছে। কি আশ্চর্য, বিয়ের আগেই বউয়ের ভয়ে শিটিয়ে আছে বেচারা। এই মুহূর্তে ফারদিনকে সম্পূর্ণ হাজব্যান্ড ম্যাটেরিয়াল মনে হচ্ছে উষসীর। সে আর উচ্চবাচ্য না করে পা বাড়াল। তবে যাওয়ার আগে আঁড়চোখে ইয়ামিনের দিকে তাকাল। ইয়ামিনও তার দিকেই তাকিয়েছিল তখন। উষসী মৃদু হেসে চলে গেল।

পুরো ব্যাপারটাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে খেয়াল করে প্রিয়ন্তি।তারা চলে যেতেই সে দরজা আটকে দেয় ধাম করে। ইয়ামিন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। আজকের দিনটা তার জীবনের দীর্ঘতম দিন। একই দিনে কতগুলো ঘটনা ঘটছে! এখন আবার প্রিয়ন্তিও এসেছে কথা শোনাবে বলে। এটাই বাকি ছিল হয়তো।

প্রিয়ন্তি সামনে এসে ইয়ামিনের মুখোমুখি দাঁড়াল। কাঠখোট্টা গলায় প্রশ্ন করল,” আমি কি দেখছি এসব? এই দিন দেখার জন্যই কি বেঁচে ছিলাম এতোদিন?”

“তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমি কাউকে মা*র্ডার করে ফেলেছি।” ইয়ামিনের নিস্তরঙ্গ উত্তর।

” সেটাও যদি করতি তাও নিজের মনকে বুঝ দিতাম। কিন্তু তুই তার চেয়েও ভ*য়ংকর কাজ করেছিস। আর খবরদার প্রিটেন্ড করবি না। তুই ভালো করেই জানিস আমি কি বলতে চাই।”

ইয়ামিন উত্তর দিল না। সটান হয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে পকেটে হাত গুঁজে। মুখভঙ্গি স্বাভাবিক, যেন কিছুই হয়নি। প্রিয়ন্তি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,” আমি জানি এটা তোর পারসোনাল ম্যাটার। এই নিয়ে আমার কথা বলার অধিকার নেই। কিন্তু আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি। তুই চাইলে যে কাউকে ভালোবাসতে পারিস। কিন্তু সেই মেয়েটা উষসী হতে পারে না! ও তোর জন্য নিষিদ্ধ। এটা আমার থেকে ভালো তুই নিজে জানিস। তবুও কিভাবে ভুল করলি?”

” নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের আকর্ষণটা ফান্ডামেন্টালি আপু। আর আমি তো মহাপুরুষ না। সাধারণ মানুষ। ”

” তোকে আমার থাপ্পড় মারতে মন চাইছে ইয়ামিন।”

” আমি আমার মনের কথা শুনে ফেলি। তোমারও শোনা উচিৎ। নাহলে খুব আফসোস হয়। স্ল্যাপ মি।”

রাগে চিড়বিড় করছে প্রিয়ন্তির শরীরটা। ধমকের স্বরে বলল,” মজা করছিস আমার সাথে? আমি একটা সিরিয়াস ইস্যু নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করছি। আর তুই এমন ভাব করছিস যেন এটা একটা ইয়ার্কি! মানে তুই কি সিচুয়েশনের ভয়াবহতা এখনও বুঝতে পারছিস না?”

ইয়ামিন পরিষ্কার গলায় বলল,”পারছি।”

” তবুও সেদিকেই পা বাড়াচ্ছিস?” বিস্ময়ে ফেটে পড়ে প্রিয়ন্তি।

ইয়ামিন প্রকটভাবে জানিয়ে দিল,” আমি উষসীকে হার্ট করতে পারব না। আমার কাছে ওর হ্যাপিনেস সবকিছুর উর্ধ্বে ইম্পোর্ট্যান্স রাখে।”

” কিন্তু তুই যেটা করছিস তাতে উষসী আরও বেশি হার্ট হবে। তৃষাণ বেঁচে থাকতে তোদের বিয়ে জীবনেও সম্ভব না।”

ইয়ামিন বেপরোয়া ভাবে বলল,” সেটা সময়ই বলে দিবে। আপু, কালরাত থেকে আমি ঘুমানোর একটুও সুযোগ পাইনি। অনেক টায়ার্ড এখন। যদি তোমার কথা শেষ হয় তাহলে যাও এখান থেকে প্লিজ।”

প্রিয়ন্তি আর কিছু বলার আগেই ইয়ামিন দরজা খুলে দিল। কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে বের হয়ে গেল প্রিয়ন্তি। ইয়ামিনকে বোঝানোর সাধ্য তার কোনোদিনও ছিল না। যেই ছেলে ছোট থেকেই নিজের মর্জির মালিক সে কাজিনের কথা শুনবে এই আশা করাও বোকামি। প্রিয়ন্তি বের হয়ে যেতেই ইয়ামিন পিছু ডাকল,” শোনো।”

প্রিয়ন্তি থেমে হতাশ স্বরে শুধাল,” বল? ”

” কাল তোমরা সুইজারল্যান্ড চলে যাচ্ছো?”

“হু। এখানে যা হচ্ছে, যা দেখছি… এরপর মনে হয় না আর থাকা উচিৎ হবে। ”

ইয়ামিন মাথা নিচু করে বলল,” ভালো। উষসীর খেয়াল রেখো। কারণ ওখানে রিয়াসাত আছে।”

” তোকে ভাবতে হবে না সেটা। রিয়াসাতের ব্যবস্থা আমি করেছি।”

ঘড়িতে সকাল সাড়ে সাতটা বাজছে। তাদের ট্রেন আসবে আটটা পয়ত্রিশ মিনিটে। স্টেশনে যাওয়ার জন্য ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছে উষসী। তার হৃদয় ভার হয়ে আছে। কাপড়গুলো ভাঁজ করে ব্যাগে তোলার সময় হঠাৎ একটা মাফলার উঠে এলো। জিনিসটা ধোঁয়া হয়নি। এখনও ইয়ামিনের র-ক্ত লেগে আছে এতে। উষসী মাফলারে মুখ ডুবিয়ে দিল। তার চোখের পানিতে ভিজে যাচ্ছিল গোলাপি মাফলার।

পেছন থেকে প্রিয়ন্তি তাগাদা দেয়,” উষু, হয়েছে তোর?”

নিজেকে সামলে দ্রুত মাফলারটা ভাঁজ করে উষসী। সেটা ব্যাগে ভরতে নিয়েও কি ভেবে থেমে যায়; নিজের গলায় জড়িয়ে নেয়। তারপর উঠে রুমের বাইরে যেতে নিলেই প্রিয়ন্তি থামাল,” যাচ্ছিস কই?”

” বাইরে।”

” বাইরে কেন? সেটাই জিজ্ঞেস করছি।”

” মানে আমি কি নিজের ইচ্ছায় বাইরেও যেতে পারব না?”

প্রিয়ন্তি এগিয়ে এসে ঠান্ডা গলায় বলল,” ইয়ামিন এখানে নেই। ফারদিনের সাথে বাইরে গেছে। তাই গিয়ে লাভ নেই। ”

উষসী শক্ত মুখে চেয়ে থেকে বলল,” আমি উনার সাথে দেখা করতে যাচ্ছি না।”

” যাওয়া উচিৎও না।”

প্রিয়ন্তি এই কথা বলে তৃষ্ণার আইপ্যাড চার্জ থেকে খুলে ব্যাগে ঢুকিয়ে নেয়। তৃষ্ণা উঠে বাথরুমে গিয়েছে। এখনও বের হয়নি। উষসী হঠাৎ বলল,” তুমি এমন কেন করছো আপু? কি চাও?”

” যদি বুঝতি তাহলে প্রশ্নটা করতি না। তোদের মাঝে ভিলেন হওয়ার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। আমি শুধু তোদের ভালো চাই।”

স্টেশন পর্যন্ত তাদের সাথে ইয়ামিন যাবে। উষসী মনমরা হয়ে গাড়িতে ওঠে। ফারদিন লাগেজে সব ব্যাগ ওঠাচ্ছিল। ইয়ামিন ড্রাইভিং সিটে বসে আছে। প্রিয়ন্তি আর তৃষ্ণা এখনও বের হয়নি৷ তৃষ্ণার ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে।

ইয়ামিন ভিউ মিররে উষসীর মুখের দিকে চেয়ে আছে। উষসী ভাবলেশহীন। নীরবতা ভেঙে ইয়ামিন জিজ্ঞেস করল,” মন খারাপ?”

উষসী তিক্ত কণ্ঠে বলল,” মন ভালো হওয়ার কোনো কারণ আছে? একটু পর আপনাকে বিদায় জানাতে হবে। তারপর আবার কবে দেখা হবে সেটাও জানি না।”

” আমি বিয়েতে আসব। তখন অবশ্যই দেখা হবে।”

” কিন্তু এই কয়দিন? আমি কিভাবে থাকব…”

উষসীর কণ্ঠ বুজে এলো। মিররে তাকাতেই দেখল ইয়ামিন হাসছে। মুখে মৃদু হাসি নিয়েই বলল,” সামান্য কয়েকদিনের দূরত্ব সহ্য হচ্ছে না, আমার জন্য এতো তাড়াতাড়ি এতো পাগল হয়ে গেলে? বাহ! ”

উষসী পেছন থেকে টিস্যু বক্স নিয়ে ছুঁড়ে মারল ইয়ামিনের মাথায়। ইয়ামিন হেসে উঠল আরও জোরে। তখনি প্রিয়ন্তি ঢুকল তৃষ্ণাকে নিয়ে। দু’জনেই চুপ হয়ে গেল। আপত্তি ভরা দৃষ্টিতে একবার ইয়ামিন আর উষসীকে দেখল প্রিয়ন্তি। তারপর একদম উষসীর গা ঘেঁষে বসল। তৃষ্ণা বসল জানালার কাছে। ফারদিন বসল সামনে, ইয়ামিনের পাশে। গাড়িতে উঠেই সে জানতে চাইল,” সব নেওয়া হয়েছে তো?”

প্রিয়ন্তি বলল,” হুম৷ সব ডান। আচ্ছা উষু, আমার লাল শাড়িটা তোর ব্যাগে নিয়েছিলি তো?”

উষসী ইয়ামিনের দিকে চাইল। তারপর একটু আমতা-আমতা করে বলল,” ওটা তো আমি হারিয়ে ফেলেছি।”

” মানে? কিভাবে হারিয়েছিস?”

” স্নোফলে ভিজে গেছিলাম। তাই খুলে গাড়িতে রেখেছিলাম৷ তারপর আর খুঁজে পাইনি।”

” কি বলছিস এসব? এতো কেয়ারলেস তুই!”

সামনে থেকে ফারদিন বলল,” আহা, একটা শাড়ির জন্য এখন ওকে বকা-ঝকা করবে নাকি? বাদ দাও৷ শাড়ি আরও কেনা যাবে।”

” তাই বলে আমার ফেভারিট শাড়িটা.. উষু তোর একটু সাবধানে থাকা উচিৎ ছিল।”

” স্যরি আপু।”

উষসী ভিউ মিররে চাইল। ইয়ামিনও তাকিয়ে আছে। প্রিয়ন্তী হঠাৎ বলল,” আচ্ছা এই ড্রেসের সাথে এটা কি মাফলার পরেছিস? ম্যাচিং হয়নি। খুলে রাখ। দেখতে অড লাগছে। আমি তোকে একটা ব্ল্যাক মাফলার দিচ্ছি দাঁড়া।”

” লাগবে না আপু৷ আমার এটাই পছন্দ।”

“তোর ইচ্ছা। কিন্তু মাফলারটা নোংরা মনে হচ্ছে। দাগও তো লেগে আছে। কিসের দাগ এটা? মনে তো হচ্ছে র-ক্তের। কিভাবে লাগল?”

ইয়ামিন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মাফলারের দিকে তাকাল। তার মনে পড়েছে রিয়াসাতের সাথে দেখা করতে যেদিন সুইজারল্যান্ড গেছিল তারা, সেদিন এই মাফলারটা দিয়েই উষসী ইয়ামিনের রক্ত মুছে দিয়েছিল। ব্যাপারটা মনে পড়তেই মৃদু হাসে ইয়ামিন। ফারদিন বলল,” শালা, সামনে তাকিয়ে গাড়ি চালা। এক্সিডেন্ট করবে তো নাহলে।”

ইয়ামিন খানিক বিব্রত হয়ে সোজা হয়ে বসল। ফারদিন তার কাঁধ চাপড়ে বলল,” শালা বললাম দেখে রাগ করলে নাকি?”

প্রিয়ন্তি বলল,” আরে রাগ করবে কেন? ও তো তোমার শালাই লাগে!”

ফারদিন হো হো করে হাসল। ইয়ামিনও হেসে ফেলল। সবার হাসিতে মুখরিত হলো পরিবেশ। শুধু উষসীর মুখ গম্ভীর। তৃষ্ণাও চুপ করে আছে। ঘুম থেকে ওঠার পর ন্যূনতম আধঘণ্টা তার মেজাজ খারাপ থাকে।

ইয়ামিন উষসীর দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। এভাবে মনখারাপ নিয়ে উষসী চলে যাবে, একটুও হাসবে না? তাই কি হয়? তার মুখে হাসি আনার জন্য কি ইয়ামিনের কিছু করা উচিৎ? নাহলে যে বুকের ভেতর শূন্য হয়ে থাকবে!

প্ল্যাটফর্মে এসে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। ট্রেন এসে গেছে খুব দ্রুতই। সবাই একে একে ট্রেনে উঠে যায়। কিন্তু ইয়ামিনকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। উষসী দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। সিটে বসছে না। সে কি ইয়ামিনকে একবার বিদায়ও জানাতে পারবে না? আশ্চর্য, ছেলেটা গেল কই? ট্রান্সপারেন্ট দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও উষসী দাঁড়িয়ে থাকে। রাগে তার শরীর কাঁপছে। অভিমানে দৃষ্টি টলমল। ইয়ামিন এই কাজটা কেন করল? বিদায়ের সময় কোথায় হাওয়া হয়ে গেল সে?

প্রিয়ন্তি উষসীকে টেনে এনে সিটে বসালো৷ তার কাঁধে হাত রেখে বলল,” কি হয়েছে তোর?”

“কিছু না।” গম্ভীর গলায় উত্তর দিয়ে জানালায় তাকিয়ে থাকে উষসী। প্রিয়ন্তি বলল,” রিয়াসাতের ব্যাপারে আমাকে জানাসনি কেন?”

উষসী চমকে উঠল,” রিয়াসাত?”

” ও তোকে ডিস্টার্ব করতো তাই না? ইয়ামিন আমাকে সব বলেছে প্রথম দিনই। আমি জানা মাত্রই ওকে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলেছি। তাই টেনশনের কিছু নেই। তুই বাড়ি গিয়ে ওকে আর দেখবি না। ”

উষসী মৃদু হাসল। কিন্তু মন ভালো হলো না। কেমন বিষণ্ণ লাগছে সবকিছু। হঠাৎ তৃষ্ণা চেঁচিয়ে বলল,” এন্টস, সামনে দেখো, আঙ্কেল!”

উষসীর চোখ আটকে গেল পাথুরে ব্রীজের উপরে। ইয়ামিন দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। হাত তুলে উষসীকে বিদায় জানাচ্ছে। তার হাতে অনেকগুলো রঙিন বেলুন।

জানালা খোলা সম্ভব না দেখে উষসী দৌড়ে দরজার কাছে যায়। বিদায়ের উদ্দেশ্যে হাত নাড়তে থাকে। ট্রেনের অন্যান্য যাত্রীরাও অবাক হয়ে দেখছে। তৃষ্ণা উঠে দাঁড়িয়ে হাত তালি দিচ্ছে রীতিমতো। ব্যাপারটায় সে খুব মজা পেয়েছে।তার এমন পাগলামি দেখে উষসী না হেসে থাকতে পারল না। সাথে সাথে ইয়ামিন ফোন করল মোবাইলে। উষসী ফোন ধরতেই শুনল ইয়ামিন হাঁপাচ্ছে খুব। ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে।

” কি হয়েছে আপনার? এভাবে হাঁপাচ্ছেন কেন?”

” দ্রুত ব্রিজে উঠতে গিয়ে হাঁপিয়ে গেছি।”

উষসী কাঁপা গলায় বলল,” এতো কষ্ট কেন করতে গেলেন? কি দরকার ছিল?”

“তুমি মনখারাপ করে ছিলে। ভাবলাম কিছু একটা করি, যা তোমার ভালো লাগবে।”

উষসী হেসে চোখের জল মুছে বলল,” শুধু আমার জন্য এতোকিছু?”

ইয়ামিন গভীর কণ্ঠে বলল,” শুধু তোমার জন্যই সবকিছু।”

চলবে

#উষসী_হাসবে_বলে (১৬)
লিখা- Sidratul Muntaz

প্রিয়ন্তির শ্বশুরবাড়ি থেকে লোকজন আসবে আজ। তাদের জন্য বাঙালি রান্নার আয়োজন করতে বাড়ির সামনে কাঠ জড়ো করে আগুন জ্বালানো হয়েছে। রান্না-বান্নার দায়িত্ব একা হাতেই সামলে নিচ্ছেন মিসেস শিমলা। তাকে সাহায্য করতে জুরিখ থেকে বিখ্যাত শেফ আসার কথা। এখনও এসে পৌঁছাননি। অথচ হাতে সময়ও নেই। রান্না শিমলার কাছে বরাবরই শখের কাজ।তাই তিনি শেফের অপেক্ষায় না থেকে কাজে লেগে পড়েছেন। আহমেদ খুন্তি নেড়ে সাহায্য করছে তাকে। তার কাজ দেখে ডোনা ঠাট্টা করে বললেন,” ভালো একজন বাবর্চি পাওয়া গেল। আর চিন্তা নেই।”

আহমেদ লাজুক ভঙ্গিতে বলল,” যখন ব্যাচেলর ছিলাম, একাই রান্না করে খেতাম। আর বউ বাপের বাড়ি চলে গেলে নিজেকেই রান্না করে খেতে হয় খালাম্মা। তাই টুকটাক শিখে রেখেছি।”

মিসেস শিমলা বললেন,” আমার সাথে দেশে চলো। আমার ইচ্ছা আছে একটা রেস্টুরেন্ট দিবো। তুমি না হয় আমার এসিস্ট্যান্ট হিসেবে থাকলে।”

” না আপা, আমি এখন যে কাজ করছি সেটাতেই ভালো আছি।”

শিমলা চোখ বড় করে তাকালেন,” আপা, আমাকে দেখে তোমার আপা মনে হচ্ছে?”

আহমেদ বিভ্রান্তিতে পড়ে গেল। শিমলা বললেন,” প্রিয়ন্তিকে তুমি কি ডাকো?”

” উনি তো আমার স্যারের বোন। তাহলে আপা।”

” আমি হলাম প্রিয়ন্তির চাচী৷ এবার বলো, আমি তোমার আপা কেন হবো?”

” স্যরি আপা, তাহলে খালাম্মা ডাকি?”

ডোনা মুখে আঁচল চেপে হেসে দিলেন৷ শিমলা বললেন,” তুমি চাইলে আমাকে চাচি বলেও ডাকতে পারো।”

” ঠিকাছে, চাচি আম্মা।”

” আম্মা না, শুধু চাচি।”

” জ্বী চাচি।”

উষসী বারান্দায় দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখছে৷ রান্নার সুঘ্রাণে তার ঘুম ভেঙেছে। তবে একটা কারণে তার খুব মনখারাপ। তারা প্যারিস থেকে সুইজারল্যান্ডে ফিরেছে প্রায় আটচল্লিশ ঘণ্টা৷ অর্থাৎ দুইদিন। এই দুইদিনে ইয়ামিন একবারও তাকে ফোন করেনি! উষসী নিজে থেকে যতবার তাকে ফোন করেছে ততবারই ইয়ামিন কেটে দিয়েছে নয়তো অফলাইনে ছিল। এতো কিসের ব্যস্ততা তার?

উষসী গায়ে মোটা গরম কাপড় জড়িয়ে নিচে নামল। শিমলা তাকে দেখেই হাসলেন,” গুড মর্ণিং উষু।”

” গুড মর্নিং আন্টি। আপনার রান্না দেখতে এলাম।”

” ভালো করেছো। আহমেদকে দিয়ে শুধু খুন্তি নাড়ানো ছাড়া আর কিছুই করানো যাচ্ছে না। তুমি পেঁয়াজ কাটতে পারো?”

উষসী ইতস্তত করে বলল,” জ্বী।”

” এসো তাহলে। পেঁয়াজগুলো কেটে ফেলো।”

উষসী দেখল ঝুড়িভর্তি একগাদা পেঁয়াজ রাখা। সে জীবনে একটা পেঁয়াজ ঠিক করে কাটতে পারেনি। সেখানে এতো পেঁয়াজ কাটা অসম্ভব ব্যাপার৷ তবুও ছু’রি নিয়ে বসল।

ডোনা বললেন,” পারবি তো? নাকি আমি হেল্প করবো?”

” আমি পারব। সমস্যা নেই।” মিসেস শিমলাকে খুশি করার জন্য উষসী এই কথা বলে তো দেয়, কিন্তু একটু পরেই সে পেঁয়াজের বদলে ছু’রির আঁচড়ে নিজের আঙুলটাই কে-টে ফেলে।

উষসীর হাতে ব্যান্ডেজ করা হয়। শিমলা আফসোস করে বললেন,” তুমি এই কান্ড করবে জানলে আমি ভুলেও তোমার হাতে ছু’রি দিতাম না। ইশ, কি অবস্থা হলো। শীতের মধ্যে ক্ষ-তটা ভোগাবে মনে হচ্ছে।”

” তেমন কিছুই হয়নি আন্টি। জাস্ট অল্প একটু কেটেছে।”

তৃষ্ণা সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে বলল,” এন্টস তোমার ফোন।”

উষসী দ্রুত ছুটে যেতে লাগল। পেছন থেকে শিমলা বললেন,” সাবধানে যাও৷ পড়ে গেলে আবার একটা কেলেংকারি হবে।”

উষসী বিড়বিড় করে বলল,” আপনার ছেলে ফোন করেছে আন্টি। আমি পারলে উড়ে চলে যাই।”

ঘরে এসেই ফোন হাতে নিল সে। তার সিক্সথ সেন্স ঠিক বলছিল। ইয়ামিনেরই ফোন। উষসী প্রফুল্লচিত্তে শুধাল,” হ্যালো, কেমন আছেন? আপনার কোনো খোঁজ নেই কেন? ফোনটা পর্যন্ত ধরছিলেন না। আমার কি টেনশন হয় না? ”

” রিল্যাক্স। এইতো ফোন দিয়েছি এখন।”

” পাক্কা দুইদিন পর ফোন দিয়েছেন আপনি। এই দুইদিন কোথায় ছিলেন? কার সাথে ছিলেন?”

” কার সাথে মানে?” ইয়ামিন হাসার চেষ্টা করল।

উষসী রেগে বলল,” সব ছেলে মানুষ এক। পেয়ে গেলেই আর মনে থাকে না। অথচ দুইদিন আগেও এমন ভাব করছিলেন যেন আমি আপনার লাইফের জ্যাকপট! আর এখন আমি অপশন, তাই না?”

” আশ্চর্য, তোমাকে অপশন কে বলল?”

” দুইদিন ধরে আপনি আমাকে ফোন কেন দেননি সেই হিসাব দেবেন আগে।”

” শ্যুটিং-এ ছিলাম উষসী!”

” মানে? দুইদিন ধরে আপনি শ্যুটিং-এ ছিলেন? এই কথা আমাকে বিশ্বাস করতে হবে?”

” সত্যি বলছি। খুব ব্যস্ত ছিলাম৷ একদমই সময় পাইনি বিশ্বাস করো। তুমি চাইলে আমার ডিরেক্টরের সাথে কথা বলতে পারো। বলবে?”

” হ্যাঁ অবশ্যই বলব। কোথায় ডিরেক্টর? ফোন দিন তাকে!”

ইয়ামিন থতমত খেয়ে বলল,” সত্যিই কথা বলবে নাকি? আরে আমি তো এমনি বললাম। তুমি উনার সাথে এই ব্যাপারে কথা বললে উনি কি ভাববে বলো?”

” যখন আমাকে বিদায় জানাতে বাচ্চাদের মতো বেলুন নিয়ে ব্রীজে উঠে গেছিলেন তখন সবাই কি ভাববে মাথায় আসেনি? আর এখন ডিরেক্টরের সাথে কথা বলাতে এতো লজ্জা লাগছে?”

ওই পাশ থেকে শোনা গেল ইয়ামিনের পরাজিত দীর্ঘশ্বাস। একটু সময় চুপ থেকে বলল,” ওকে,হোল্ড অন। আমি আরমান ভাইকে ডাকছি।”

উষসী সাথে সাথে বলল,” থাক লাগবে না। মজা করছিলাম। আমি আপনাকে বিশ্বাস করি, ঠিকাছে? এই বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবেন আশা করি।”

ইয়ামিন হাসল। এতো সুন্দর তার ভরাট হাসির শব্দ! সবকিছুতেই মুগ্ধ হয় উষসী। জীবনের প্রথম প্রেম বুঝি এমনই। সারাক্ষণ সুখ সুখ একটা অনুভূতি জাপটে ধরে থাকে মনকে।

” তোমার কি অবস্থা বলো, কেমন আছো?”

” ভালো… তবে এই মুহূর্তে হাতের আঙুল কেটে বসে আছি।”

” মানে? আঙুল কিভাবে কাটল?” উদগ্রীব শোনায় ইয়ামিনের গলা।

উষসী হেসে ফেলে বলল,” আপনার মাকে ইমপ্রেস করতে চেয়েছিলাম। আজকে প্রিয়ন্তি আপুর শ্বশুরবাড়ির মানুষ আসবে তো… তাই আন্টি রান্না করছে। আমাকে পেঁয়াজ কাটতে বলেছিল। কিন্তু আমি তো পেঁয়াজ ধরতেও জানি না… কাটবো কি?”

” তারপর?”

” তারপর আর কি? আঙুল কেটে ফেললাম!”

” ওহ শিট, কতটুকু কেটেছে.. দেখি তো।”

ইয়ামিন পরক্ষণেই ভিডিওকল দিল। উষসী দ্রুত আয়নার কাছে গিয়ে ওরনা, চুল সব ঠিক করে নিল। তারপর আস্তে-ধীরে কল রিসিভ করল। ইয়ামিন বসে আছে একটা রেস্টুরেন্টে৷ পেছনে খুব সুন্দর ভিউ। তার মাথায় সাদা কানটুপি। গায়ে কালো জ্যাকেট। সামনে কিছু চুল এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। উষসী ফিসফিস করে বলল,” মাই হ্যান্ডসাম হাংক।”

ইয়ামিন বলল,” আঙুল দেখি?”

উষসী আঙুল উঁচু করে দেখাল। ইয়ামিন নরম গলায় বলল,” ইশ, অনেকটা কেটেছে দেখছি।”

” আন্টি স্যাভলন দিয়ে ওয়াশ করে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিয়েছে।”

ইয়ামিন হতাশ স্বরে বলল,” যেটা পারো না সেটা করতে গেলে কেন? কি দরকার ছিল? পাগল তুমি?”

” আন্টিকে খুশি করতে চেয়েছিলাম একটু।”

” আন্টিকে খুশি করে লাভ কি? তার চেয়ে ভালো আন্টির ছেলেকে খুশি করো।”

ইয়ামিনের ঠোঁটে ফিচেল হাসি। উষসী বলল,” আন্টির ছেলে অলরেডি পটে বসে আছে। নতুন করে তাকে পটানোর কিছু নেই।”

এ কথা বলেই বেশ ভাব নিয়ে নখে ফুঁ দিল সে৷ ইয়ামিন ভ্রু উঁচু করে বলল,” আচ্ছা, তাই নাকি?”

উষসী খিলখিল করে হেসে উঠল। ইয়ামিন তাকিয়ে থেকে বলল,” তোমাকে সুন্দর লাগছে।”

হঠাৎ প্রশংসা পেয়ে লজ্জায় মিইয়ে পেল উষসী। কিছুক্ষণ আগেই ঘুম থেকে উঠেছে সে। মুখে ময়েশ্চারাইজার লাগানো হয়নি। শুষ্ক হয়ে আছে ত্বক, চোখ-মুখ। এই অবস্থায় তাকে বিশেষভাবে সুন্দর লাগার কোনো কারণ নেই। তবুও ইয়ামিনের চোখে কত মুগ্ধতা! উষসী মুখ নামিয়ে নিল কিছুটা। একটু পর ইয়ামিন বলল,” তোমার জন্য সন্ধ্যায় একটা সারপ্রাইজ আছে।”

” কি সারপ্রাইজ?” হালকা গলায় জিজ্ঞেস করল উষসী।

ইয়ামিন রহস্যের ভঙ্গিতে বলল,” সন্ধ্যায় জানবে।”

সন্ধ্যার আসর খুবই জমজমাট। তুষারাচ্ছন্ন সাদা বাড়ি জুড়ে লাইটিং। উষসীর মনে হলো তারা ক্রিসমাস সেলিব্রেট করছে। সে ভেবেছিল আজ অনেক মানুষ আসবে বুঝি। কিন্তু এসেছে মাত্র পাঁচজন। ফারদিন নিজে আসেনি। তার দুইবোন, একবোনের স্বামী, তাদের দুই বাচ্চা ফারিশা আর আরিশা আর প্রিয়ন্তির শাশুড়ী এসেছেন। তাদের হাতভর্তি জিনিসপত্র। বড় একটা লাগেজে বিয়ের শাড়ি-গয়না সব আনা হয়েছে। আজকে মেহেন্দি আর হলুদও সেরে ফেলা হবে।

প্রিয়ন্তি ছোট থেকেই খুব ইন্ট্রোভার্ট। বিদেশে বাবার কাছে একা বড় হয়েছে। তার মধ্যে স্বজনপ্রীতি নেই বললেই চলে। তবে মিসেস শিমলাকে সে বিশেষ পছন্দ করে বলেই তিনি বিয়েতে এসেছেন। এছাড়া কেউই নেই। খুব ঘরোয়া আয়োজনে বিয়ের অনুষ্ঠান হবে৷ আত্মীয়-স্বজনের চেয়ে সুইস প্রতিবেশীর সংখ্যাই বেশি। আর প্রিয়ন্তীর ভার্সিটি লাইফের কিছু বন্ধুরা আসবে কাল।

উষসী হাতে মেহেদী লাগিয়ে বাড়ির সামনে চেয়ার পেতে বসে আছে। বাচ্চারা দৌড়াদৌড়ি খেলছে। আরিশা আর ফারিশা বেশ চঞ্চল। উষসীর মাথা ভনভন করছে এদের দেখে। তৃষ্ণা খুব শান্ত স্বভাবের হওয়ায় চঞ্চল বাচ্চা দেখে অভ্যস্ত নয় উষসী। ফারিশার বয়স নয় আর আরিশার ছয়। এরা দুইজন পরিবেশ মাতিয়ে তুলেছে। কিছুক্ষণ আগেই দু’টো চায়ের কাপ ভেঙেছিল৷ তাই উষসী এদের নিয়ে বাইরে চলে এসেছে।

” উষসী আপু, তোমাকে ভাবি ডাকছে।” ফারদিনের ছোটবোন ফারিয়া ব্যালকনির সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

উষসী বলল,” কি দরকার?”

” তুমি নাকি ভালো মেকাপ করাতে পারো?”

” ও হ্যাঁ। আমার মেহেদী শুকিয়ে গেছে। আমি এখনি আসছি।”

প্রিয়ন্তীর গায়ে একটা সবুজ রঙের জামদানি শাড়ি। চুল উঁচু করে বেঁধে রাখা হয়েছে। উষসী বিমুগ্ধ কণ্ঠে বলল,” তোমাকে এতো স্নিগ্ধ লাগছে আপু!”

প্রিয়ন্তী গম্ভীর কণ্ঠে বলল,” বেশি মেকাপ দিস না প্লিজ। আমার বয়সের সাথে কম্পারেবল থাকে যেন।”

” তুমি কি নিজেকে বয়স্ক বধূ ভাবছো?”

” বয়স্ক না, আমি বুড়িই। ত্রিশ বছর বিয়ের জন্য অনেক বেশি বয়স।”

” কে বলেছে? তোমাকে এখনও দেখতে কত প্রিটি লাগে। মনেই হয় না ত্রিশ বছর।”

প্রিয়ন্তি শুকনো হাসি হাসল। তারপর বলল,” ইয়ামিন ফোন করেছিল তোকে?”

উষসী প্রিয়ন্তির চোখে আইলাইনার দিচ্ছিল৷ তার হাত কেঁপে উঠল একটু। নিচু স্বরে বলল,” হুম।”

” কখন আসবে ও?”

” আসবে?” উষসী চোখ বড় করে চাইল।

প্রিয়ন্তি বলল,” আমাকে তো বলেছে আসবে। তোকে মনে হয় সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল। নষ্ট করে দিলাম আমি।”

উষসী মুচকি হেসে বলল,” ভালোই করেছো বলে। এখন আমার সাজতে ইচ্ছে করছে।”

প্রিয়ন্তি কিছু বলতে নিয়েও বলতে পারল না৷ তারা দু’জন এতো খুশি আছে, তাদের সুখে বাঁধা হতে ইচ্ছে করছে না। উষসী প্রিয়ন্তির মেকাপ শেষ করেই নিজের ঘরে ছুটে যায়। সে কি আজ শাড়ি পরবে?

উষসী শুধু শাড়িই পরল না। ভারী মেকাপ লাগিয়ে নিল মুখে। চুল খোলা রেখে পিঠময় ছড়িয়ে দিল। সে জানে তাকে খোলা চুলে সবচেয়ে সুন্দর লাগে! ছোট কানের দুল পরল। গলায় পরল সুন্দর একটা শীতাহার। তার সাজগোজের মাঝখানেই ফোন এলো হঠাৎ। অচেনা নাম্বার দেখে উষসী একটু বিভ্রান্ত হলো। কিন্তু ফোন রিসিভ করতেই শোনা গেল ইয়ামিনের কণ্ঠ। সে নাকি নিচে অপেক্ষা করছে।

উষসী তড়িঘড়ি করে একটা ওভারকোট জড়িয়ে রুম থেকে বের হয়। ফারিয়া তাকে দেখে কমপ্লিমেন্ট দিল,” তোমাকে এতো সুন্দর লাগছে আপু!”

” থ্যাঙ্কিউ।”

উষসী চঞ্চল পায়ে নামতে থাকে সিঁড়ি ভেঙে। আচমকা ধাক্কা খায় প্রিয়ন্তির সাথে। প্রিয়ন্তি বলল,” আরে আস্তে… এতো কিসের তাড়া?”

তারপর উষসীর মুখ দেখেই চমকে উঠে বলল,” এতো সেজেছিস কেন? বউ কি তুই না আমি?”

উষসীর মুখ লাল হয়ে গেল। ক্ষীণ গলায় বলল,” স্যরি। একটু পরেই মুখ ধুঁয়ে ফেলব। তুমি মাইন্ড করো না।”

” মুখ ধুঁতে কে বলল? সুন্দর লাগছে তোকে। কিন্তু হঠাৎ এতো সাজগোজ? ইয়ামিন তো আসেনি এখনও। ওর লেইট হবে মনে হয়।”

” ও এসে পড়েছে। বাইরে অপেক্ষা করছে।”

প্রিয়ন্তি অবাক হয়ে বলল,” ঘরে না ঢুকে বাইরে কেন?”

” জানি না। আমাকে যেতে বলল। আমি যাই?”

প্রিয়ন্তি ভ্রু নাচিয়ে শুধাল,” আমি নিষেধ করলে কি তুই যাবি না?”

” যাব।”

” তাহলে যা। জিজ্ঞেস করছিস কেন?”

উষসী হেসে দ্রুত যেতে থাকে। প্রিয়ন্তি সেদিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে আর ভাবে, মায়ের সাথে একবার এদের বিষয় নিয়ে কথা বললে কেমন হয়?

রাত নয়টায় ইয়ামিন উপস্থিত হলো। তখন চারদিকে শোরগোল পড়ে গেছে। কারণ উষসীকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রিয়ন্তি ইয়ামিনকে আড়ালে নিয়ে ব্যগ্র কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,” কোথায় উষু? তোর সাথেই তো দেখা করতে গিয়েছিল ও।”

ইয়ামিন আশ্চর্যের সীমান্তে পৌঁছে বলল,” আমার সাথে মানে? আমি তো মাত্রই এলাম।”

প্রিয়ন্তি কিংকর্তব্যবিমুঢ়। ইয়ামিন কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে কটমট করে বলল,” শিট, ওকে তুমি যেতে কিভাবে দিলে?”

প্রিয়ন্তি ফিসফিস করে উচ্চারণ করল,” রিয়াসাত!”

ইয়ামিন প্রিয়ন্তিকে আগলে ধরে বলল,” কখন বের হয়েছে?”

” আরও দুইঘণ্টা আগে…” দূর্বল কণ্ঠে কথাটা বলেই প্রিয়ন্তি ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। ইয়ামিন দৃঢ় কণ্ঠে বলল,”আমি দেখছি, খুঁজে আনবই ওকে। চিন্তা কোর না। ওর কিচ্ছু হবে না। ”

প্রিয়ন্তি দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। ইয়ামিন ঝড়ের গতিতে গাড়িতে উঠে বসে। কাঁপা হাতে ডায়াল করল উষসীর নাম্বার। কিন্তু ফোন সুইচড অফ দেখাচ্ছে। ইয়ামিন অযথাই নিজের মোবাইল ছুঁড়ে মারে। স্টেয়ারিং এ আঘাত করে জোরে। রাগে দপদপ করছে তার মাথার শিরা। সে কোনমতে ড্রাইভিং শুরু করল। কিন্তু কোনদিকে যাবে? দিশেহারা লাগছে। সবকিছু অন্ধকার মনে হচ্ছে।

চলবে