#উষসী_হাসবে_বলে (১৭)
লিখা- Sidratul Muntaz
কনকনে শীতের রাত্রিতেও দরদর করে ঘামছে সে। স্নোফল শুরু হয়েছে। আঁকাবাঁকা রাস্তায় গাড়ি চালানো চ্যালেঞ্জের মতো। তার উপর সে প্রচন্ড ডেস্পারেট হয়ে ড্রাইভ করছে। বরফে ঢেকে আছে সড়ক। তার হাতের আঙুলগুলো মৃদু কাঁপছে। বুকের মধ্যে তুফান শুরু হয়েছে। উষসীর খিলখিল হাসির গায়েবি শব্দ কানে বাজছে।
আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে চমকে ওঠে ইয়ামিন৷ বহুবছর পর সে কাঁদছে। আবারও ভালোবাসার দহনে পুড়ছে তার মন নতুন করে। তবে এবার আর সে কিছু হারাতে চায় না! সহ্য হবে না তাহলে। নিঃস্ব হয়ে যাবে সে। উষসীর গায়ে একটা আঁচড় লাগার আগে সে পৃথিবী তোলপাড় করে ফেলবে!
এসব ভাবতে ভাবতে যখন প্রায় দিশেহারার মতো ড্রাইভ করছিল তখনি বেজে উঠল মোবাইল ফোন।
ওই পাশ থেকে প্রিয়ন্তির গলা ভেসে এলো,” হ্যালো, ইয়ামিন! তুই কোথায়? যেখানেই আছিস ফিরে আয়। উষুকে পাওয়া গেছে!”
ইয়ামিন তার অস্বাভাবিক হৃৎস্পন্দনের কাঁপন সামলে নিয়ে কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,” কেমন আছে ও?”
” ভালো আছে। তুই দ্রুত আয়। আমি রাখছি।”
এক পশলা শান্তির বৃষ্টি নেমে এলো বুকে। প্রশান্তির বাতাসে নরম সুখময় অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল হৃদয়জুড়ে। ইয়ামিন গাড়ি ঘোরাল। এতোক্ষণ নিজেকে জড়বস্তু বোধ হচ্ছিল। এখন সে শ্বাস নিতে পারছে ঠিক করে!
প্রিয়ন্তির শ্বশুরবাড়ি থেকে আসা মেহমানরা সব বিদায় হয়েছে। উষসী লিভিংরুমে বসে আছে চুপচাপ। তাকে ঘিরে সবাই দাঁড়ানো। ডোনা তাকে বকাঝকা করছেন অবিরাম,” রাতে বের হওয়ার কি এমন প্রয়োজন ছিল? তোর কি সাহস বেশি বেড়ে গেছে? কোথায় গিয়েছিলি তুই?”
উষসী থুতনিতে হাত ঠেঁকিয়ে বসে আছে। তার চোখমুখ কেমন অন্যরকম। দেখে মনে হচ্ছে কেঁদেছে। কিন্তু একটা কথাও সে বলছে না। শিমলা আদুরে কণ্ঠে বললেন,” আমাদের চিন্তা হচ্ছে তো উষু। ডোনা আপা কত টেনশনে পড়ে গেছিলেন জানো? কেন বের হলে কাউকে না জানিয়ে? ”
প্রিয়ন্তি ইতস্তত করে বলল,” ও আমাকে জানিয়ে গেছিল।”
ডোনা চোখ গরম করে তাকালেন মেয়ের দিকে,” এই কথা তুই এতোক্ষণে বলছিস? আর তোকে জানিয়ে গেছিল মানে? তুই ওকে যেতে কিভাবে দিলি?যদি কিছু অঘটন ঘটতো?”
” ও বলছিল বাইরে একটু হাঁটতে যাবে। আমি নিষেধ কেন করব?”
ডোনা বিমূঢ় হয়ে বললেন,” আশ্চর্য, নিষেধ করবি না? ও কি এখানকার কিছু চেনে? একা কেন বাইরে যাবে? আহমেদকে নিয়ে গেলেই হতো। এই আহমেদ, তুমি ওর সাথে কেন গেলে না?”
আহমেদ কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলল,” আপামণি যে বের হয়েছে সেই কথাই তো আমি জানি না খালাম্মা।”
উষসী আলোচনা স্থগিত করতে দূর্বল গলায় বলল,” আমি ঠিকাছি… দেখতেই তো পাচ্ছো তোমরা। কিছুই হয়নি আমার। তাহলে এতো প্রশ্ন কেন? চুপ করো প্লিজ।”
” কিছু না হলে তোর মুখের অবস্থা এমন দেখাচ্ছে কেন?” কঠিন গলায় প্রশ্ন করলেন ডোনা।
উষসী উত্তর দিল না। বাইরে গাড়ি ব্রেকের শব্দ শোনা গেল। ইয়ামিন ঢুকছে ভেতরে। শিমলা উচ্ছল কণ্ঠে বললেন,” এইতো আমার ছেলে এসে গেছে। বাবা, আবার কোথায় গেছিলি তুই?”
কাছে এসে ছেলের কাঁধে হাত রাখলেন শিমলা। ইয়ামিন মায়ের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে উষসীর দিকে চেয়ে আছে একদৃষ্টে। উষসীও চেয়ে আছে তার দিকেই। দু’জনই নিশ্চুপ। কেবল দৃষ্টি বিনিময় চলছে নিঃসংকোচে।
বিষয়টা উপস্থিত সবাই খেয়াল করে বিব্রত হয়। প্রিয়ন্তি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বলল,” উষু, ঘরে গিয়ে রেস্ট কর। তোকে টায়ার্ড দেখাচ্ছে।”
ডোনা বললেন,” হুম৷ আমিও যাচ্ছি ওর সাথে।”
উষসীকে হাত ধরে টেনে উপরে নিয়ে যেতে লাগলেন ডোনা। ইয়ামিন তখনও তাকিয়ে আছে একরাশ তৃষ্ণা নিয়ে। তার খুব ইচ্ছে করছে উষসীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে। সেটা সম্ভব না বলেই হাঁসফাস লাগছে। শিমলা ছেলের মুখে হাত রেখে বললেন,” কি হয়েছে বাবা তোর? শরীর ঠিকাছে?”
” ঠিকাছি মা।”
একবাক্যে উত্তর দেয় ইয়ামিন। শিমলা হাসার ভঙ্গি করে বললেন,” আমি তো ভেবেছিলাম একদম বিয়ের দিন সকালে আসবি। আজকেই চলে আসবি সেটা ভাবিনি। প্রিয়ন্তি যখন তোর আসার কথা বলল, আমি তো ভাবলাম মজা করছে!”
প্রিয়ন্তি শুকনো হাসি হাসল৷ শিমলা বললেন,” রাত কয়টা বেজে গেছে! খেয়েছিস কিছু? আয়, তোকে খেতে দেই।”
প্রিয়ন্তি উপরে চলে গেল। ডোনা উষসীকে নিয়ে বসে আছেন ঘরে। একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছেন। কিন্তু উত্তর দেওয়ার অবস্থায় উষসী নেই। সে মাথায় হাত ঠেঁকিয়ে বসে আছে মূর্তির মতোন। যেন সে এই জগতে নেই। হারিয়ে গেছে অন্যকোথাও। প্রিয়ন্তি ভেতরে উঁকি দিয়ে বলল,” মা, একটু এদিকে আসো তো।”
ডোনা বের হলেন,” কি হয়েছে বল।”
” তুমি যাও। উষুর সাথে আমি কথা বলছি।”
ডোনা চিন্তিত স্বরে বলল,” দ্যাখ মুখ থেকে কথা বের করতে পারিস কিনা। আমি নিশ্চিত কিছু হয়েছে মেয়েটার। ও আমাদের থেকে লুকাচ্ছে।”
প্রিয়ন্তি মাথা নেড়ে ঘরে ঢুকল। উষসী বিরক্ত স্বরে বলল,” প্লিজ আপু, এখন তুমি আবার জিজ্ঞাসাবাদ পর্ব শুরু কোর না৷ আমার ভালো লাগছে না।”
প্রিয়ন্তি তার কাঁধে হাত বুলিয়ে বলল,” আচ্ছা, আমি কিছু জিজ্ঞেস করব না। কিন্তু অন্তত এইটুকু বল, তুই কি ঠিকাছিস?”
” জানি না।” উষসীর কণ্ঠ নির্লিপ্ত, বিষণ্ণ।
প্রিয়ন্তি কপাল গুটিয়ে প্রশ্ন করল,” তুই কি রিয়াসাতের সাথে দেখা করেছিস?”
” হু।” ছোট্ট করে উত্তর দিয়েই চুপ মেরে যায় উষসী। আর কিছু বলবে না সে। প্রিয়ন্তি কতক্ষণ তার মুখের দিকে চেয়ে রইল। তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,” যদি মন হালকা করতে ইচ্ছে হয়, তাহলে আমার কাছে আসিস প্লিজ। আমি সব শুনবো।”
উষসী হালকা চালে মাথা নাড়ল। প্রিয়ন্তি তাকে একা ঘরে রেখেই চলে গেল বাইরে। রাতে উষসী কিছু খেলও না। চুপচাপ বিছানায় শুয়ে পড়ল।
এদিকে ইয়ামিনের দুশ্চিন্তায় ঘুম আসছে না। উষসীর সাথে একবার কথা না হলে ভালোও লাগবে না তার। বাড়িতে এতো মানুষ কেন? বুকের ভেতর টাল-মাটাল শব্দটা একটুও কমছে না। সবাই শুয়ে পড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে ইয়ামিন। তারপর নিজেকে শান্ত করতে রাতের অন্ধকারেই চলে যায় উষসীর ঘরে।
প্রিয়ন্তি আজ ডোনার সাথে ঘুমিয়েছে। উষসীর সাথে শুয়েছে তৃষ্ণা। সে তার ছোট্ট, লম্বাটে শরীরটা নিয়ে বিছানায় গুটিশুটি মেরে ঘুমোচ্ছে। উষসীর চোখে ঘুম নেই। সে কাঁদছে। এমন সময় দরজায় করাঘাতের শব্দ হয়।
চোখের জল মুছে বিছানা থেকে নামে উষসী। দরজা খুলে দিতেই হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢোকে ইয়ামিন৷ তাকে দেখে চমকে যায় উষসী। ভীত কণ্ঠে বলল,” এতোরাতে এখানে কেন এসেছেন? কেউ দেখে ফেললে কি ভাববে?”
ইয়ামিন দরজা লক করে বলল,” আই ডন্ট কেয়ার। যে যা খুশি ভাবুক।”
এই কথা বলেই সে কাছে এসে উষসীর কাঁধ চেপে ধরল। আঁড়চোখে একবার ঘুমন্ত তৃষ্ণার দিকে তাকাল উষসী। ইয়ামিন পিপাসা মিটিয়ে উষসীকে দেখছে। আদুরে কণ্ঠে বলল,” তোমার কি হয়েছে সুহাসিনী? আর ইউ অলরাইট?
উষসী মাথা নেড়ে বলল,” হুম। ঠিকাছি আমি।”
” মনে তো হচ্ছে না!”
ইয়ামিন বিচলিত। সে গাঢ় দৃষ্টিতে পরখ করছে উষসীকে। তারপর জিজ্ঞেস করল,” রিয়াসাত এসেছিল তাই না?”
” হুম।”
ইয়ামিনের মুখ কাঠিন্যতায় ছেয়ে গেল। রাগে কটমট করে শুধাল,” কি করেছে ও?”
উষসী চুপ করে মাথা নিচু করে রাখল। ইয়ামিন অধৈর্য্যের মতো বলল,” কথা বলো উষসী প্লিজ। তুমি জানো টেনশনে আমার কি অবস্থা হয়েছিল? যখন শুনেছি তুমি আমার সাথে দেখা করতে বের হয়েছো? পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম আমি!”
ইয়ামিন উষসীকে জড়িয়ে ধরতে নিল। কিন্তু উষসী হাত দিয়ে বাঁধা প্রদান করল এবং সরে গেল। ইয়ামিন অবাক হয়ে তাকাতেই সে গম্ভীর গলায় বলল,” তৃষ্ণা জেগে যেতে পারে৷”
ইয়ামিন তার হাত ধরে বলল,” বারান্দায় চলো তাহলে। সেখানে গিয়ে কথা বলি?”
উষসী হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,” না, এখানে দাঁড়িয়েই কথা বলুন। শুনছি আমি।”
ইয়ামিনের অদ্ভুত লাগছে। তার মনে হচ্ছে উষসী যেন তাকে ভ*য় পাচ্ছে! কিন্তু এমন কেন হবে? সে নিরাশ গলায় বলল,” এতোবড় বোকামি কিভাবে করলে উষসী? তোমার এটা বোঝা উচিৎ ছিল যে আমি তোমাকে বাইরে ডাকব না। সরাসরি বাড়িতে এসেই দেখা করব। তাহলে তুমি কেন বাইরে গেলে? আর তুমি আমার নাম্বার চেনো না?”
উষসী যন্ত্রের মতো বলল,” খেয়াল ছিল না।”
” ও কি করেছে তোমার সাথে? কেন ডেকেছিল?”
” যদি কিছু করে… তাহলে কি হবে? আমাকে আর ভালোবাসবেন না? যদি আমি কলঙ্কিনী হই, তাহলে কি ছেড়ে চলে যাবেন আমাকে?”
এমন অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে হতভম্ব হয়ে গেল ইয়ামিন। সে হতভম্ব ভাব কাটিয়ে ওঠার আগেই উষসী মৃদু হেসে বলল,” স্যরি, মজা করলাম৷”
ইয়ামিন এগিয়ে এসে বলল,” তোমার কিছু হয়েছে। স্বাভাবিক নেই তুমি। কি হয়েছে বলো আমাকে?”
” কিছু না।” দায়সারা উত্তর দেয় উষসী।
ইয়ামিন কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তার কপালে চুমু দিয়ে বলল,” কিছু হবেও না। আমি আছি সব কিছু ঠিক করে দেওয়ার জন্য। ইয়ামিন ইব্রাহীম তার ব্যক্তিগত সুহাসিনীর জন্য সবকিছু করতে পারে।”
উষসীর চোখ থেকে টুপ করে জল গড়িয়ে পড়ে। দ্রুত হাতে সে মুছে নেয় সেই জল। ইয়ামিন তার মুখ উপরে তুলে বলল,” জীবনের যে কোনো অবস্থাতে তুমি আমার একান্ত। যাই হয়ে যাক, কখনও এটা ভাববে না যে আমি তোমাকে ছেড়ে যাবো। কারণ এটা আমার পক্ষে অসম্ভব। মনে থাকবে?”
উষসী মাথা নেড়ে বলল,” থাকবে।”
” রিয়াসাত এখন কোথায়?”
” ও আমার সাথে কিছু করেনি। ওর এতো সাহস নেই। তাই চিন্তা করবেন না।”
” ও তোমাকে শুধু শুধু ডাকেনি নিশ্চয়ই। অবশ্যই কিছু বলেছে।”
” হ্যাঁ বলেছে। কাল ও আমার সাথে আবার দেখা করতে চায়।”
” তুমি যাবে দেখা করতে? ”
” এখনও বুঝতে পারছি না।”
” ঠিকাছে ভয় নেই। আমরা দু’জন একসাথে যাবো।”
উষসী মাথা দুলিয়ে বলল,” হুম।”
ইয়ামিন এবার উষসীর চিবুক ছুঁয়ে বলল,” মাই বিউটিফুল স্মাইল, একটু হাসো প্লিজ!”
উষসী হাসল। ইয়ামিন গাঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,” এই হাসি মাখা মুখটা দেখার জন্য আমি সব ভুলে ছুটে আসতে পারি।”
” আমাকে কতটা ভালোবাসেন?”
” যতটা ভালোবাসলে নিজেকে ভুলে থাকা যায়।”
” কবে থেকে ভালোবাসেন?”
ইয়ামিন একটু ভেবে বলল,” সিলেটে দেখা হওয়ার পর তোমার প্রতি আকর্ষণ তৈরী হয়েছিল….এমনকি পেইন্টিং-এও কখন তোমার মুখ এঁকে ফেলেছি নিজেও বুঝতে পারিনি। তারপর বার-বার তোমার সাথে দেখা হওয়া, তোমার হুটহাট আমার বাড়িতে চলে আসা, সবকিছু তোমার প্রতি আগ্রহের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছিল।
আমি এমনভাবে তোমার প্রেমে পড়ে গেলাম যে নিজেকেই চিনতে পারছিলাম না। দিন দিন তোমার প্রতি অনুভূতির মাত্রা গাঢ় হচ্ছিল। এমনকি তোমার আসল পরিচয় জানার পরেও নিজেকে গুটিয়ে নিতে পারিনি। ততদিনে অনেকটা জড়িয়ে গেছি তোমার সাথে। সেই মায়াজাল থেকে বের হওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। আর না আছে তোমার মন ভাঙার দুঃসাহস। ”
উষসী মাথা উঁচু করে তাকিয়ে আছে। ইয়ামিন মাথা নিচু করে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ আরও একটু নিচু হয়ে সে চুমু দিতে চাইল উষসীর কোমল ঠোঁটে। সাথে সাথে মুখ সরিয়ে নিল উষসী। অস্ফূট স্বরে বলল,” রাত অনেক হয়েছে। এখন রুমে যান প্লিজ।”
উষসীর প্রত্যাখ্যানে ইয়ামিনের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে উঠল। একটু মনক্ষুণ্ণ হলেও সেটা প্রকাশ করল না। স্বাভাবিক গলায় বলল,” ঠিকাছে, তুমি রেস্ট করো।”
সে চলে যেতেই দরজা আটকে মেঝেতে কার্পেটের উপর বসে পড়ল উষসী। মুখে হাত চেপে বড় বড় শ্বাস নিতে লাগল। তার চোখে অশ্রু জমতে শুরু করেছে।
সকাল আটটা। ইয়ামিন লিভিংরুমে এসে দেখল সবাই একসাথে ব্রেকফাস্টে বসেছে। কিন্তু উষসীকে দেখা যাচ্ছে না। আশেপাশে চোখ বুলাতেই তাকে পাওয়া গেল বাইরে, ব্যালকনিতে একাকি দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায়। মিসেস শিমলা ছেলের জন্য প্লেট সাজিয়ে বললেন,” বস বাবা। সবার খাওয়া হয়ে গেছে। শুধু তুই আর তৃষ্ণা লেইট লতিফ।”
প্রিয়ন্তি মৃদু হাসল। ইয়ামিন বলল,” পরে খাবো, মা। নট নাউ।”
এই কথা বলেই সে ব্যালকনির দিকে যেতে লাগল। ডোনা ব্যাপারটা খেয়াল করলেন। তীক্ষ্ণ নজরে দেখলেন ইয়ামিন ঠিক উষসীর পাশেই গিয়ে দাঁড়িয়েছে। তার মুখ থমথমে হয়ে উঠল। তিনি একবার প্রিয়ন্তির দিকে চেয়ে বললেন,” এদিকে আয়।”
তারপর উপরে যেতে লাগলেন। প্রিয়ন্তি বাধ্য মেয়ের মতো মায়ের পিছু নিল। ডোনা ঘরে এসেই প্রশ্ন ছুঁড়লেন,” উষুর কি হয়েছে? আমি জানি তুই সব জানিস। বল আমাকে।”
” তুমি কোন বিষয়ে প্রশ্ন করছো মা?”
” সেটাও তুই ভালো করে জানিস। তুই যা জানিস সব আমাকে বল।”
প্রিয়ন্তি ভাবল মিথ্যা বলে ধরা খাওয়ার চেয়ে সত্যি বলে ধরা খাওয়াই ভালো। তাই বেশি ভণিতা না করে সরাসরিই বলল,” ইয়ামিন আর উষসী ডেইট করছে। ওরা পছন্দ করে একে-অন্যকে।”
ডোনার চোখ দু’টো আগুনের ফুলকির মতো জ্বলে উঠল। সর্বনাশের আশঙ্কায় ঠোঁট কাঁপতে লাহল।এই ভ*য়টাই তো পাচ্ছিলেন তিনি। বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে বিড়বিড় করে শুধু বললেন,” এসব তৃষাণ জানলে কি হবে?”
প্রিয়ন্তি মায়ের কাছে এসে বসল। আকুতি মেশানো কণ্ঠে বলল,” তুমি ছাড়া তৃষাণ আর কারো কথা শোনে না মা। তাই তুমি চাইলেই ওকে বোঝাতে পারো।”
ডোনা আশ্চর্য হয়ে তাকালেন,” তোর কি মাথা ঠিকাছে? আমি কি বোঝাবো?”
প্রিয়ন্তি মৃদু হেসে বলল,” ইয়ামিন আর উষুর সম্পর্কের ব্যাপারে বোঝাবো। ওরা তো অন্যায় কিছু করেনি। মনের উপর কি কারো নিয়ন্ত্রণ থাকে বলো? আমাদের উচিৎ বিষয়টা মেনে নেওয়া আর…”
কথা শেষ করার আগেই সপাটে মেয়ের গালে চড় মারলেন ডোনা। প্রিয়ন্তি হতবাক, টলমলে দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ডোনা ক্রোধে দিশাহীন হয়ে শুধালেন,” তুই কি বলছিস সেটা কি নিজে বুঝতে পারছিস? পাগল হয়ে গেছিস তুই?”
স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে প্রিয়ন্তি। ত্রিশ বছরের এই জীবনে প্রথমবার সে মায়ের হাতে চড় খেয়েছে। অভিমানে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল হঠাৎ। উষসী দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল এতোক্ষণ। সে নিজের ঘরে যাচ্ছিল তখনি ডোনার গলা শুনে থেমে দাঁড়িয়েছে।
প্রিয়ন্তি এলোমেলো পায়ে বের হওয়ার সময় ধাক্কা খেল উষসীর সাথে। তার একটা হাত তখনও আঘাতকৃত গালে রাখা। উষসী আহত কণ্ঠে বলল,” স্যরি আপু। আমাদের জন্য তুমি…”
কথা শেষ করার আগেই প্রিয়ন্তি চলে গেল। উষসী কিছুক্ষণ স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে থেকে ভেতরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।
ডোনা বিছানায় বসে আছেন চুপচাপ। এই মুহূর্তে তিনি আফসোসে ম-রে যাচ্ছেন। কি করলেন এটা? আদরের মেয়েটাকে রাগের মাথায় এইভাবে আঘাত করে ফেললেন? কাল আবার মেয়েটার বিয়ে! চিরদিনের মতো পর হয়ে অন্যের ঘরে চলে যাবে। সেই মেয়েকে তিনি কিভাবে চ*ড় দিতে পারলেন?
উষসী কাছে এসে ঠিক ডোনার সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসল। আলতো কণ্ঠে ডাকল,” ভালো আন্টি।”
ডোনার সব রাগ গিয়ে পড়ল উষসীর উপর। তিনি নিষ্ঠুর বাক্যে বললেন,” আমি কারো ভালো আন্টি না। আমার চোখের সামনে থেকে যা তুই।”
উষসীর চোখ ভর্তি অশ্রু। সে গেল না। বরং আরও কাছে এগিয়ে এলো। যতই উপরে তিনি শক্ত খোলশ পরার চেষ্টা করুক, ভেতরে ভালো আন্টি প্রচন্ড নরম। তা উষসী জানে। আর জানে বলেই কাছে এসে ডোনার কোলে মাথা রাখল সে। ডোনা কিছু বললেন না। কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন দেয়ালে।
উষসী বলল,” আমি জানি, আমি খুব বড় ভুল করেছি। তোমার মতে নিশ্চয়ই এটা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ! তাই না? কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি কিছু জানতাম না ভালো আন্টি!”
উষসী কাঁদছে। ডোনা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন না। গাঁট হয়ে বসে আছেন। এমনটা আগে কখনও হয়নি। আমাদের জীবনে অনেককিছুই প্রথমবার ঘটে যা মেনে নিতে প্রথমে খুব কষ্ট হয়। উষসীরও সেই কষ্টটা হচ্ছে।
সে ঢোক গিলে বলল,” গতকাল আমার রিয়াসাতের সাথে দেখা হয়েছিল। সে আমাকে এমন কিছু বলেছে যা আমি বিশ্বাস করতে চাই না। আমি প্রচন্ড মানসিক অস্থিরতায় ভুগছি ভালো আন্টি। এই প্রশ্নগুলোর জবাব শুধু তুমিই দিতে পারবে।
প্লিজ, আমাকে জবাব দাও। ইয়ামিনের জন্যই কি উষ্ণতা আপুর জীবনে অন্ধকার নেমে এসেছিল? সে কি সত্যি এতোটা খারাপ? আমি কি তাকে ভালোবেসে ভুল করেছি?”
ডোনা এবার আর চুপ থাকলেন না। তীব্র রোষ নিয়ে বললেন,” ভুল না, ক্ষমার অযোগ্য পাপ করেছিস তুই। ইয়ামিনের জন্য শুধু উষ্ণতার জীবনে অন্ধকার নেমে আসেনি বরং সে সুই*সাইড করতে নিয়েছিল।”
উষসীর মনে হলো পৃথিবী যেন থেমে যাচ্ছে। মাথায় বিকট শব্দ টের পেল। ডোনা বিষাক্ত কণ্ঠে বলতে লাগলেন,” সেদিন যদি আমি না থাকতাম তাহলে আজ আর উষ্ণতা আমাদের মাঝে থাকতো না। হাসপাতালের সেই দিনটির কথা মনে আছে তোর? সব সর্বনাশ ইয়ামিনের জন্য হয়েছিল। সব কিছুর জন্য দায়ী ওই ছেলে। আর আজকে তুই বলছিস ওকেই তুই ভালোবাসিস? তুই আমার নিজের মেয়ে হলে তোকে এখনি জ্যা*ন্ত কবর দিতাম আমি!”
উষসীর শরীর থরথর করে কাঁপছে। রিয়াসাত তাহলে মিথ্যা বলেনি! কালরাত থেকে মনে-প্রাণে শুধু একটাই প্রার্থনা করেছিল সে। যেন সবটা মিথ্যা হয়। রিয়াসাতের কথা যেন বিশ্বাস করতে না হয়। অথচ সবটাই সত্যি! কারণ ভালো আন্টি কখনও মিথ্যা বলেন না।
সেই দিনটির কথা উষসীর মনে আছে স্পষ্ট। কি দূর্বিষহ সময় ছিল সেদিন। মা লাঞ্চনা-বঞ্চনা সহ্য করতে না পেরে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছিলেন। উষ্ণতা ঘরের দরজা আটকে বসেছিল। ভ*য়ে আর ক্ষুধায় ছোট্ট উষসী কাতর হয়ে কাঁদছিল৷ সে তখন তৃষ্ণার বয়সী।
পাশের বাসা থেকে সামিনা আন্টি এসেছিলেন। তিনি উষ্ণতার ঘরের দরজা ভাঙার ব্যবস্থা করলেন। ভেতর থেকে উষ্ণতাকে অচেতন অবস্থায় বের করা হলো। ওই বয়সে উষসী এটাও বুঝতো না যে আত্ম*হ’ত্যা কি! অথচ নিজের বোনের সেই অবস্থা নিজ চোখে অবলোকন করতে হয়েছিল। কি নির্মম আর নিষ্ঠুর নিয়তি!
তারপর উষ্ণতাকে হসপিটালে নেওয়া হয়। ফেরেশতার মতো সেখানে হাজির হয়েছিলেন ডোনা। উষসীর ভালো আন্টি! তিনি পরম স্নেহে উষসী আর উষ্ণতাকে আগলে নিয়েছিলেন। নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন। কারণ বাড়িওয়ালাও তাদের বাড়ি ছেড়ে যেতে বলেছিল। সেদিন যদি সময়মতো ডোনা না আসতেন তাহলে উষ্ণতাকে বাঁচানো যেতো না!
সেই ভ*য়ংকর দিনটির কথা মনে পড়তেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠল উষসী। সেদিন কি এমন হয়েছিল তা সে জানে না। কিন্তু উষ্ণতার মতো পাথর ধরণের মেয়ে সামান্য কষ্টে আত্ম-হ’ত্যার সিদ্ধান্ত নেবে না! উষসী নিজের বোনকে চেনে! নিশ্চয়ই অনেক বড় কিছু হয়েছিল। কিন্তু কি সেটা? জানে না উষসী। জানার সাহসটুকুও তার নেই।
” সবকিছু ইয়ামিনের জন্য হয়েছিল?” প্রচন্ড হতাশাগ্রস্ত কণ্ঠে জানতে চাইল উষসী।
ডোনা নির্লিপ্তে জবাব দিলেন,” তাহলে আর কার জন্য হবে?”
” সে কি করেছিল? কি অন্যায় ছিল তার? আর রিয়াসাত এসব কিভাবে জানল?” চেঁচিয়ে জানতে চায় উষসী।
ডোনা নির্জীব কণ্ঠে বললেন,” রিয়াসাত কিভাবে জানল সে কথা আমি জানি না। কিন্তু সে ভুল কিছু বলেনি।”
উষসী ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। এটা নিশ্চয়ই কোনো দুঃস্বপ্ন। তার দম আটকে আসছে। ঘরে ঢুকে দরজা আটকাল সে। ক্লান্ত পায়ে বিছানায় বসতেই ড্রেসিংটেবিলের আয়নায় ইয়ামিনকে দেখে চমকে উঠল।
বারান্দায় টেবিল-চেয়ার পেতে বসে আছে ইয়ামিন। তার সামনে কফির পট। দু’টো কফির মগ পাশাপাশি রাখা। একটা মগে খুব যত্ন করে ক্রিম দিয়ে লভ শেইপ আঁকছে সে। উষসী সেখানে গিয়ে দাঁড়াতেই ইয়ামিন প্রফুল্ল কণ্ঠে বলল,” ওয়েলকাম মাই লভ। তোমার জন্যই ওয়েট করছিলাম৷ বসো এখানে। দেখো, সামনে কত সুন্দর ভিউ! আমরা এই ভিউ দেখতে দেখতে কফি খাবো আর গল্প করব। ওকে?”
সে চেয়ার টেনে দিল। তার সুন্দর মুখে চমৎকার হাসি। কিন্তু উষসীর মুখ মলিন। সে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল। বসল না। ইয়ামিন তার দিকে চেয়ে অনুরোধের স্বরে বলল,” আর মুখ ভার করে থেকো না প্লিজ। তোমার হাসি ছাড়া পৃথিবীর সব সৌন্দর্য্য নিরর্থক মনে হয়।”
চলবে
#উষসী_হাসবে_বলে (১৮)
লিখা- Sidratul Muntaz
প্রিয়ন্তির মন আজ খুব খারাপ। আগামীকাল তার বিয়ে।অথচ বাবা তার পাশে নেই। ড্রয়ার থেকে বাবার একটা ছবি বের করে জড়িয়ে ধরে আছে প্রিয়ন্তি৷ তার এতো খারাপ লাগছে কেন? মৃত্যুর আগে বাবার শেষ ইচ্ছা ছিল একমাত্র মেয়ের বিয়ে দেখে যাবেন৷ কিন্তু তাঁর ইচ্ছা অপূর্ণই রয়ে গেছে।
প্রিয়ন্তি এমন একজনকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বাছাই করেছে যে ঠিক তার বাবার মতো সৎ,পরিশ্রমি আর খুব ভালো মনের মানুষ। যার মধ্যে প্রিয়ন্তি নিজের বাবার ছায়া খুঁজে পায়।
প্রিয়ন্তি আরহাম সাহেবের ছবিটা ছুঁয়ে বলল,” আমার জীবনের এতো স্পেশাল দিনে তুমি আমার পাশে নেই, ভাবতেই বুক ভেঙে আসছে বাবা। আমি সহ্য করতে পারছি না তোমার এবসেন্স। কিন্তু তুমি যেভাবে চেয়েছিলে আমি ঠিক সেভাবেই বিয়ে করছি। খুব ছোট্ট আয়োজন। বেশি কেউ আসেনি। শুধু শিমলা চাচি আর আমার মা এসেছেন। যখন মা ছিলেন না, তখন শিমলা চাচি আমাকে মায়ের মতো আগলে রেখেছিলেন। নিজের এই বিশেষ দিনে তাকে কিভাবে আমি ভুলে যাই বলো?আমার জীবনের তিনজন স্পেশাল মানুষের মধ্যে দুইজনই আমার পাশে আছে। কিন্তু তুমি নেই। তোমার অভাব কেউ পূরণ করতে পারবে না, বাবা। টুডে আই এম মিসিং ইউ সো মাচ! আই লভ ইউ।”
বাবার ছবিতে চুমু দিল প্রিয়ন্তি। তখনি অনুভব করল কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ। পেছনে ঘুরে চাইতেই দেখল ডোনা দাঁড়িয়ে আছেন৷ প্রিয়ন্তি চোখের জল মুছতে লাগল। ডোনা স্নেহ মাখা কণ্ঠে বললেন,” মায়ের উপর অভিমান করে বাবার কাছে বিচার দেওয়া হচ্ছে বুঝি?”
প্রিয়ন্তি হেসে বলল,” না। আমার শুধু বাবার কথা খুব মনে পড়ছে মা।”
ডোনা বসতে বসতে বললেন,” মৃ-তের ছবি জড়িয়ে ধরে এভাবে কাঁদতে নেই মা। তাহলে আত্মা কষ্ট পায়।”
” কি করব? আমি বাবাকে আজ খুব মিস করছি।”
” সেটাই স্বাভাবিক৷ আজকের দিনে তোর বাবা থাকলে কত খুশি হতেন!”
ডোনা প্রিয়ন্তির থেকে ছবিটা নিয়ে তাকিয়ে রইলেন একদৃষ্টে। প্রিয়ন্তি জিজ্ঞেস করল,” তুমি কি বাবাকে একটুও মিস করো না মা?”
ডোনার ঠোঁটে আলতো হাসি,” করি তো। খুব মিস করি৷ তোর বাবা খুব ভালো মানুষ ছিলেন।”
” আচ্ছা, তোমার আর বাবার বিয়েটা কিভাবে হয়েছিল? ওটা কি লভ ম্যারেজ ছিল? বলো না, কখনও তুমি এই বিষয়ে আমার সাথে গল্প করোনি।”
ডোনার মুখ ভার হয়ে এলো। কিছুসময় চুপ থেকে অল্প হাসলেন তিনি। তারপর ভাবনায় বুদ হয়ে যেতে যেতে বললেন,” লভ ম্যারেজ না, তবে ওয়ান সাইড লভ বলা যায়। আমার বাড়িতে নানু অসুস্থ ছিলেন তখন। আমি ভার্সিটিতে পড়ি৷ পাশাপাশি নানুর খেয়াল রাখি। কারণ এক নানু ছাড়া দুনিয়ায় কেউ ছিল না আমার। ওই সময় মেয়েদের ভার্সিটিতে পড়া অনেক বড় ব্যাপার। আমাকে রোজ বাজে ছেলেরা উত্যক্ত করতো৷ খুব কষ্টের জীবন ছিল। তারপর হঠাৎ করেই তোর বাবা রাজপুত্র হয়ে এলেন আমার জীবনে। ভার্সিটির এক ফাংশনে আমি নেচেছিলাম। তোর বাবা স্পেশাল গেস্ট ছিলেন। আমার নাচ দেখে পছন্দ করে বিয়ের প্রস্তাব দেন।”
” এক নাচ দেখেই সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব? ইন্টারেস্টিং তো! তারপর?” প্রিয়ন্তির চোখ আগ্রহে ঝিকমিক করছে। ডোনা কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে পাশ কাটানো গলায় বললেন,” তারপর আর কি? আমি রাজি হয়ে গেছি। আমাদের বিয়ে হয়েছে৷ তারপর তুই পৃথিবীতে এসেছিস।”
” কিন্তু তোমাদের ডিভোর্স কেন হয়েছিল?”
ডোনা এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না। কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন বাইরে। প্রিয়ন্তি একটু পর মায়ের কাঁধে মুখ গুজে বলল,” আ’ম স্যরি আম্মু। তোমাকে আপসেট করতে চাইনি।”
ডোনা পরম যত্নে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন৷ তার চোখ থেকে পানি ঝরছে গলগল করে। তিনি এই মাত্র মেয়ের কাছে এক গাদা মিথ্যা বলেছেন। আসলে আরহাম সাহেবের সাথে তার কোনোদিন বিয়েই হয়নি। তাদের মধ্যে যা হয়েছিল তা শুধুই একটা এগ্রিমেন্ট ছিল। প্রিয়ন্তির মা হয়ে থাকার এগ্রিমেন্ট। আর এই মাত্র তিনি যে ঘটনার কথা বলেছেন সেটি ছিল তৃষাণের বাবার গল্প। তৃষাণের বাবা আর তার বিয়েটা এভাবেই হয়েছিল। কিন্তু বিয়ের পর তিনি জানতে পারলেন তিয়াশা নামের এক ভদ্রমহিলাকে তিনি আগেই বিয়ে করেছেন। কিন্তু সে কখনও মা হতে পারবে না৷ সেজন্যই দ্বিতীয় বিয়ের আয়োজন। ডোনা সব দুঃখ-কষ্ট নিজের মনে রেখে তৃষাণের বাবাকে ডিভোর্স দিয়েছিলেন। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছিল। তৃষাণ তার পেটে চলে এসেছিল। সেসব অনেক দুঃখের গল্প। এগুলো বলে তিনি দুঃখী মেয়েটাকে আরও দুঃখী করে দিতে চাননা৷
__________
” আমি দেখা করতে পারব না রিয়াসাত। তোমার যা বলার ফোনে বলো।”
” সব কথা ফোনে বলা যায় না ডার্লিং।”
উষসীর চোয়াল শক্ত হয়ে এলো,” ডন্ট কল মি ডার্লিং।”
ওই পাশ থেকে অট্টহাসির শব্দ ভেসে আসে। উষসীর গা জ্বলে যায়। সে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে আরও বলল,” আমি তোমার সাথে দেখা করতে পারব না। এটা কোনোভাবেই সম্ভব না। কালকের পর থেকে সবাই আমার উপর নজর রাখছে। কেউ বাসা থেকে বের হতে দিবে না আমাকে।”
” তোমাকে সামহাউ ম্যানেজ করতে হবে। কারণ কিছু করার নেই। নাহলে সত্যিটাও জানতে পারবে না।”
” জানতে চাই না আমি সত্যি..”
” ভয় পাচ্ছো? এই ওয়েট… তুমি আবার ইয়ামিনের থেকেই সত্যি জানার চিন্তা করছো নাকি? খবরদার, একদম এইটা করতে যেও না। বিরাট বোকামি হবে তাহলে।”
” আমি তোমাকেই বা বিশ্বাস করব কেন রিয়াসাত? তুমিও তো আমার সাথে সেভেরাল টাইমস মিথ্যা বলেছো।”
রিয়াসাত মোলায়েম কণ্ঠে বলল,” আমি এই বিষয়ে কোনো মিথ্যা বলিনি সেই প্রমাণ তুমি পেয়েছো। ডোনা আন্টি নিজমুখে সব স্বীকার করেছেন। আর সেটা তুমি নিজেই বলেছো। তাহলে আমাকে অবিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই।”
উষসী দ্বিধায় পড়ে যায়। সত্যিটা তাকে জানতে হবে। কিন্তু ইয়ামিনের সাথে এই ব্যাপারে ঠান্ডা মাথায় কথা বলা কি উচিৎ? সে কি সত্যি বলবে? যদি বলার হতো তাহলে এতোদিন কেন বলেনি? গোপন কেন করেছে?
এখন কি তাহলে রিয়াসাতের সাথেই দেখা করা উচিৎ? কিন্তু সেও যে সত্যিটাই বলবে তার নিশ্চয়তা কি? কিছুই বুঝতে পারছে না উষসী। প্রচন্ড সিদ্ধান্তহীনতায় মাথা ভনভন করছে।
রিয়াসাত বলল,” আমি আজও ঠিক কালকের জায়গাতেই অপেক্ষায় থাকব। তুমি সময়মতো চলে এসো। মনে আছে তো কখন আসতে হবে? রাত আটটার মধ্যে। রাখছি।”
উষসী কোনো জবাব দেয় না। রিয়াসাত লাইন কেটে দেয়। গভীর দুশ্চিন্তায় বুদ হয়ে যায় উষসী৷ সারাদিন কাটে দুশ্চিন্তায়।
বাইরে প্রচন্ড ঠান্ডা। তীক্ষ্ণ ফলার মতো শীতল বাতাস গেঁথে যাচ্ছে শরীরে৷ ভারী বরফ বর্ষণ হচ্ছে। তৃষ্ণা মোটা হুডি আর মাফলার গায়ে বের হয়েছে। উষসীর শরীর সাদা চেক ল্যাপেল উল কোটে মোড়ানো। মনের আনন্দে স্নোম্যান বানাচ্ছিল তারা। ঠিক রাত আটটার আগে উষসী তৃষ্ণাকে বলল সে সামনে হাঁটতে যাচ্ছে একটু। পাঁচমিনিটের মধ্যে ফিরে আসবে। তৃষ্ণা যাতে আঙিনার বাইরে না যায়। তৃষ্ণা বলল,” ওকে।”
পকেটে হাত গুজে হাঁটতে থাকে উষসী। নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছেই রিয়াসাতের নাম্বারে ডায়াল করল।অনেক অন্ধকার এখানটায়।
” হ্যালো, কোথায় তুমি?”
” ঠিক তোমার পেছনে আছি.. একটু ঘুরলেই দেখবে।”
উষসী পেছনে ঘুরতেই দেখল খোলা জায়গায় ক্যাম্প-ফায়ার করে বসে আছে রিয়াসাত। তার পাশেই ছোট-খাটো একটা সাদা ভ্যান। গতকালও সে এটা নিয়ে এসেছিল। উষসীর মনোযোগ আকর্ষণের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ল সে। উষসী তার কাছে গিয়ে বলল,” পারমানেন্টলি ভ্যানেই থাকা শুরু করেছো নাকি?”
” আমি তো আগে থেকেই ভ্যানে থাকতাম। জানতে না তুমি?”
” যা বলার দ্রুত বলো। আমাকে যেতে হবে।”
” এতো তাড়া কিসের? বসো, চলো আমরা ডিনার করি।”
” আমি এখানে ডিনার করতে আসিনি!” তেজ নিয়ে কথা বলে উষসী৷ রিয়াসাত হেসে ফেলে।
উষসী নিজের ফোন এগিয়ে দিয়ে আবার বলল,” এখানে আসার আগে আমি লোকেশন অন করে এসেছি। শুধু একটা ফোন করলেই দশমিনিটের মধ্যে পুলিশ চলে আসবে। সো বি কেয়ারফুল।”
” তুমি দেখি আমাকে একদম বিশ্বাস করো না।” ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে রিয়াসাত।
উষসী হাত গুটিয়ে বলল,” না করি না বিশ্বাস। আমি শুধু সত্যিটা জানতে এসেছি।”
” সত্যি বললে বিশ্বাস করবে?”
” আগে বলো, তারপর ডিসাইড করছি।” উষসীর গা কাঁপছে।
রিয়াসাত বলল,” বসো,বসো। ওভার হাইপ হওয়ার কিছু নেই।”
উষসী ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। তার কিছুটা ভয় ভয় লাগছে। এখানে আসার সিদ্ধান্তটা ভুল হয়েছে। ঝোঁকের মাথায় সে আবারও ভুল করে ফেলেছে। এখন এতোদূর এসে আবার চলে যাওয়াও সম্ভব নয়। সত্যিটা তাকে জানতে হবে।
রিয়াসাত তার ভ্যানের কাছে যেতে যেতে বলল,” ভেতরে এসো উষু। এটলিস্ট একবার তোমাকে হোস্ট করার সুযোগ দাও। আবার কবে না কবে দেখা হয়… বলা যায় না৷ তাছাড়া বাইরে অনেক ঠান্ডা।”
উষসী কঠোর স্বরে জানাল,” আমি এখানেই ঠিকাছি।”
” আরে আশ্চর্য, তুমি এমন করছো কেন? তোমাকে আমি যেই প্রুভ দেখাব সেই ডকুমেন্ট আমার ল্যাপটপে আছে।”
” কিসের প্রুভ?”
” তুমি কি জানো দশবছর আগে যে তোমার আপুর নু’ডিটি ভাইরাল হয়েছিল?”
উষসী একটা বড় ধাক্কার মতো খেল। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো সে ভুল শুনেছে। তাই আবার শুধাল,” কি?”
” তোমার আপুর ন্যু’ড ভিডিও।”
উষসী কোনমতে উচ্চারণ করল,” মিথ্যা বলছো তুমি।”
” জানতাম মানবে না৷ ব্যাপারটা তোমার জন্য কতটা শকিং আমি বুঝতে পারছি। সেজন্যই আমি প্রুভ এনেছি। সেটা দেখার জন্য তোমাকে ভেতরে আসতে হবে।”
” আমার আপু এমন কিছু করতেই পারে না।”
” হ্যাঁ ঠিক বলেছো। এখানে তোমার আপুর দোষ ছিল না৷ কারণ ওই সময় সে ড্রাংক ছিল। আর কে তাকে ড্রাংক করিয়ে এসব ভিডিও বানিয়েছিল জানো?”
উষসী তুমুল গতিতে মাথা নাড়ল। তীক্ষ্ণ গলায় বলল,” ইয়ামিন এতোটা নিচ কাজ করতে পারে না।”
” কিন্তু সে করেছে।”
রিয়াসাত দুই কদম এগিয়ে আসতেই উষসী তিন কদম পিছিয়ে বলল,” তুমি তোমার ল্যাপটপ বাইরে নিয়ে আসছো না কেন?”
” ভেতরে আসতে কি প্রবলেম? আমাকে বিশ্বাস করে এতোদূর আসতে পেরেছো৷ তাহলে আর পাঁচ কদম আসতে পারবে না?”
উষসীর মনে হলো সে এই হাড় কাঁপানো ঠান্ডাতেও ঘামছে। রুদ্ধ কণ্ঠে বলল,” বাড়াবাড়ি করবে না রিয়াসাত। আই উইল শাউট।”
” এইখানে কে শুনবে তোমার শাউট? ছেলেমানুষী কোর না প্লিজ। এদিকে এসো।”
রিয়াসাত হাত চেপে ধরতেই জোরে চেঁচিয়ে উঠল উষসী। তখনি প্রচন্ড বেগে কেউ ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল রিয়াসাতের উপর। উষসী কিছু বোঝার আগেই দেখল সাদা বরফে লাল র*ক্ত ছড়িয়ে পড়ছে ক্রমাগত। তার মাথা ঘুরে উঠল। সে ধপাস করে পড়ে গেল নিচে।
রিয়াসাতের গায়ের উপর উঠে এলোপাথাড়ি আঘাত করেই যাচ্ছে ইয়ামিন। হঠাৎ উষসীর পড়ার শব্দ পেয়ে পেছন ফিরে চাইল সে। ভ*য়ে তিরতির করে কাঁপছে মেয়েটার দেহ। ইয়ামিন উঠে এসে হাত বাড়িয়ে দিল। সেই হাত ধরে দাঁড়াল উষসী।
ইয়ামিন গম্ভীর গলায় বলল,” আমাকে না জানিয়ে আসতে নিষেধ করেছিলাম।”
উষসী জবাব দিতে পারল না। টলমল চোখে তাকিয়ে রইল। রিয়াসাতের অবস্থা দেখে সে ঘাবড়ে গেছে। ইয়ামিন আবার তার দিকে তেড়ে যায়। পেট বরাবর কয়েকটা উত্তরোত্তর ঘুঁষি মেরে বলল,” তোর সাহস কিভাবে হয় এতোকিছুর পরেও ওর সাথে দেখা করতে আসার? আজকে যদি তোকে মেরে এখানেই পুঁতে ফেলি তাহলে আমার হাত থেকে কে বাঁচাবে তোকে বল!”
ইয়ামিন গর্জন করে উঠল। উষসী কাছে গিয়ে মিনতির স্বরে বলল,” প্লিজ, ছেড়ে দিন।”
তারপর রিয়াসাতের দিকে চেয়ে বলল,” তোমার কাছে যা আছে আমাকে দিয়ে দাও রিয়াসাত প্লিজ। দোহাই লাগে।”
ইয়ামিন আশ্চর্য হয়ে বলল,” কি আছে ওর কাছে?”
উষসী মাথা নিচু করে বলল,” আপুর ভিডিও।”
ইয়ামিন হতবুদ্ধির মতো কতক্ষণ চেয়ে থাকল। উষ্ণতার ভিডিও সব নিজেই ওয়েবসাইট থেকে ডিলিট করিয়েছিল দশবছর আগে। তাহলে সেটা রিয়াসাতের কাছে কি করে আসবে? সে পুনরায় রিয়াসাতকে আঘাত করল। টুটি চেপে ধরে বলল,” কোথায় কি আছে সত্যি কথা আছে বল।”
রিয়াসাত অস্ফূটস্বরে বলল,” কিছু নেই। আমার কাছে কিছু নেই। আমি মিথ্যা বলেছি।”
উষসী বলল,” ওর ল্যাপটপে সব আছে।”
ইয়ামিন ওকে ছেড়ে ভ্যানের ভেতরে ঢুকল। তারপর ল্যাপটপ খুঁজে সেটা আছাড় মেরে ভেঙে ফেলল। তখনি সাইরেন বেজে উঠল। উষসী ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে বলল,” পুলিশ আসছে।”
” পুলিশ কে ডেকেছে?” ইয়ামিন অবাক। উষসী নিচু গলায় বলল,” আমি ডেকেছিলাম।”
পরক্ষণেই আবার তড়িঘড়ি করে বলল,” আমাদের কিছু করতে হবে। পুলিশ এখানে এসে গেলে আপনি ফাঁসবেন। ওরা আপনাকে এরেস্ট করবে।”
” ফাঁসলে ফাঁসবো।” ইয়ামিন দায়সারা। উষসী করুণ স্বরে বলল,” প্লিজ এমন করবেন না। আমাদের এখান থেকে যেতে হবে।”
ইয়ামিন রিয়াসাতের দিকে ইশারা করে বলল,” তাহলে এটাকে কি করব?”
উষসী নিরুপায় কণ্ঠে বলল,” সাথে নিয়ে যাবো।”
ইয়ামিন কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে রিয়াসাতকে উঠিয়ে ভ্যানের মধ্যে নিয়ে গেল। উষসীকে বলল তার ফোন বন্ধ করে দরজা লক করতে৷ তারপর ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসতে। উষসী নির্দেশ পালন করল। ইয়ামিন র*ক্তাক্ত রিয়াসাতের হাত-মুখ শক্ত করে চেপে ধরে আছে আর উষসী ড্রাইভ করছে। একটু পর রিয়াসাত ক্লান্ত কণ্ঠে বলল,” আমি কিছু করব না ভাই। ছাড়ো আমাকে।”
” আগে বল তুই উষসীর পিছু কবে ছাড়বি? আর কয়বার শিক্ষা দিতে হবে তোকে?”
” আমি কিছু করিনি এবার। ও নিজেই এসেছে আমার কাছে।”
” কেন এসেছে? উষ্ণতার ভিডিওর কথা তুই কিভাবে জানিস বল?”
ইয়ামিন তার ক্ষতস্থানে জোরে চাপ দিল। ব্যথায় কোঁকাতে লাগল রিয়াসাত। আকুতির স্বরে বলল,” তোমার ফ্রেন্ড আরিশা।”
” এসবের মধ্যে আরিশা কোথ থেকে এলো?”
” আরিশা আমাকে ওই ভিডিও পাঠিয়েছিল। বলেছে ওটা নাকি তুমি শ্যুট করেছিলে।”
প্রচন্ড ক্ষোভে গর্জে উঠল ইয়ামিন,” আমি কোনো ভিডিও শ্যুট করিনি। তুই উষুকে এইসব বলার জন্য ডেকেছিলি?”
বাজে শব্দের গা’লি দিয়ে সে প্রচন্ড জোরে রিয়াসাতের মাথা ধরে দেয়ালে ঠুঁকতে লাগল। রিয়াসাত জ্ঞান হারিয়ে ফেলল অচিরেই। সামনে থেকে উষসী আর্তনাদ করে বলল,” প্লিজ ওকে ছেড়ে দিন। আর মা-রবেন না। পুরো মুখ র*ক্তে ভরে গেছে। আরও মা’রলে ম’রেই যাবে।”
ইয়ামিনের ঠোঁট আক্রোশে কাঁপছে। বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে সে। তারপর সামনে এসে উষসীর পাশে বসল। থমথমে গলায় বলল,” তুমি রিয়াসাতের কথা বিশ্বাস করেছো?”
উষসীর হাতের পেশি শিথিল হয়ে যায়। জোরে ব্রেক কষে গাড়ি থামায় সে। ইয়ামিন র-ক্তিম দৃষ্টিতে আবারও প্রশ্ন করল,” বিশ্বাস না করলে তুমি এখানে কেন এসেছো? একবারও আমাকে এই নিয়ে প্রশ্ন করতে পারলে না অথচ ওর কথা বিশ্বাস করে এতোদূর চলে এলে? আমার থেকে ওই স্কাউন্ড্রেলের কথা তোমার কাছে বেশি ইম্পোর্ট্যান্ট?”
উষসী কাঁদতে লাগল। আলতো হাতে চোখের জল মুছে অপরাধী স্বরে বলল,” আই এম স্যরি।”
” হোয়াট স্যরি উষসী? হোয়াট স্যরি? যদি আমি তোমাকে ফলো করে এখানে না আসতাম তাহলে কি হতো চিন্তা করতে পারছো?”
” উষ্ণতা আপুর ওই ভিডিও কে শ্যুট করেছিল?” মুখের উপর প্রশ্ন করে বসল উষসী।
ইয়ামিন বাকরুদ্ধ হয়ে যায়৷ তৎক্ষণাৎ কোনো জবাব এলো না মুখে। অতীতের সবচেয়ে নিদারুণ স্মৃতিগুলো একের পর এক ভাসতে লাগল চোখের সামনে। ইয়ামিন দূর্বল হয়ে পড়ল।
উষসী ভাঙা কণ্ঠে আবার জানতে চাইল,” রিয়াসাত বলেছে এগুলো আপনার জন্য হয়েছিল। সত্যিই কি আপনি দায়ী? প্লিজ বলুন! আপনি নির্দোষ তাই না? আপনি এসবের কিছুই জানতেন না। আপনার জন্য কিছু হয়নি।”
ইয়ামিনের চোখ ভরে উঠল অশ্রুতে। সে শীতল স্বরে জানাল,” আমার জন্য সব হয়েছিল। আমি নিজেকে নির্দোষ বলতে পারব না। তাহলে মিথ্যা বলা হবে।”
উষসী ভীষণভাবে আহত হলো। হতভম্ব দৃষ্টিতে কিছুসময় চেয়ে থেকে মুখে হাত দিয়ে কাঁদতে লাগল। ইয়ামিন তার কাঁধে হাত রাখতে নিলেই সে ছটফট করে বলল,” ডন্ট টাচ মি।”
তারপর চোখে চোখ রেখে ব্যথাতুর কণ্ঠে বলল,” আই হেইট ইউ ইয়ামিন ইব্রাহীম।”
ইয়ামিনের হৃদয়ে বিস্ফোরণ হয়ে গেল। বামচোখ থেকে যন্ত্রণার ধারাপাত সরলরেখার মতো গড়িয়ে পড়ল নিচে। উষসী তার কথা শেষ করেই ভ্যান থেকে নেমে দৌড়াতে শুরু করল। ইয়ামিন কিছুক্ষণ বসে থেকে সেও উষসীর পিছু নিল।
সর্বোচ্চ গতিতে ছুটছে উষসী৷ তার পেছনে ছুটছে ইয়ামিন। চেঁচিয়ে বলল,” প্লিজ উষু থামো। কোথায় যাচ্ছো তুমি এই অন্ধকারে? ”
উষসী কোনো কথা শোনে না। প্রচন্ড কষ্টে তার বুক চিঁড়ে যাচ্ছে। মাথা ফেটে যাচ্ছে৷ সামনে সাইরেনের শব্দ তীক্ষ্ণতর হয়ে ওঠে। হেডলাইটের তীব্র আলোয় চোখে হাত ঠেঁকায় উষসী৷ একের পর এক ইউনিফর্ম পরিহিত পুলিশ নামতে থাকে। মোট তিনজন এসে দাঁড়ায় তাদের সামনে। ফ্রেঞ্চ ভাষায় প্রশ্ন করে,” কি হয়েছে?”
উষসী ইংরেজিতে বলল,” সেভ মি।”
ইয়ামিন বোকার মতো তাকিয়ে থাকে। উষসী পুলিশদের পেছনে লুকিয়ে বলল,” হি ইজ দ্যা ক্রিমিনাল। আমার চোখের সামনে একজনকে মে’রে র’ক্তাক্ত করেছে। এরেস্ট হিম অফিসার, প্লিজ।”
পুলিশদের মধ্যে একজন জিজ্ঞেস করল,” আমাদের কি আপনিই ফোন করেছিলেন?”
উষসী মাথা নাড়ল। ইয়ামিন বিস্মিত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে তার প্রেয়সীর দিকে। কি প্রচন্ড ঘৃণা ওই চোখে। ঠিক সেই মুহূর্তে ইয়ামিন উপলব্ধি করল তার বেঁচে থাকার সমস্ত আকাঙ্খা শেষ হয়ে গেছে। মৃ’ত্যু হলেও এখন আর কিছু যায়-আসবে না তার।
ইয়ামিনের হাতে হ্যান্ডকাপ পরানো হয়। পুলিশ দায়িত্ব নিয়ে রিয়াসাতকে হাসপাতালে নিয়ে যায়, উষসীকে বাড়ি পৌঁছে দেয় আর ইয়ামিনকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যায় পুলিশ স্টেশনে।
চলবে