উষসী হাসবে বলে পর্ব-২৩+২৪

0
236

#উষসী_হাসবে_বলে (২৩)
লিখা- Sidratul Muntaz

সুইজারল্যান্ড থেকে বাংলাদেশে ফেরার দশদিন কে’টে গেছে। এই দশদিনে ইয়ামিনের সাথে যোগাযোগ হয়েছে খুব অল্প। সে তার কাজ নিয়ে এতো ব্যস্ত যে কথা বলার সময়ই পায় না। এই নিয়ে উষসীর অভিমানের শেষ নেই। মাঝে মাঝে সে গাল ফুলিয়ে বসে থাকে। ফোন ধরে না। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ সব জায়গা থেকে ব্লক করে রাখে ইয়ামিনকে। আজও একই কাজ করেছে। গত দুইদিন ধরে সে ব্লক খুলছে না। ইয়ামিন ফোন দিতে দিতে দিশেহারা। প্রতিবারের মতো এবারও প্রিয়ন্তির ফোন আসে।

” উষু!”

” বলো আপু, কি খবর? ভালো আছো?”

প্রিয়ন্তি কণ্ঠে তীব্র বিরক্তি মিশিয়ে বলল,” তোদের জন্য ভালো থাকতে পারছি কই বল? আমার তো নতুন বিয়ে হয়েছে, নাকি? সারাক্ষণ তোদের প্রবলেম সোলভ করলে আমার নিজের সংসার কে সামলাবে শুনি?”

উষসী দায়সারা কণ্ঠে বলল,” তোমাকে প্রবলেম সোলভ করতে কে বলেছে? না করলেই তো পারো।”

” ইয়ামিন আমাকে দুই মিনিটও শান্তিতে টিকতে দিচ্ছে না৷ তুই দয়া করে ওর ব্লকটা খুলে দে প্লিজ।”

” স্যরি, সম্ভব না। তোমার ভাই এমনিতেও প্রচন্ড ব্যস্ত মানুষ। আমার পেছনে তাকে মূল্যবান সময় নষ্ট করতে কে বলেছে? ওকে বলো এসব ছেড়ে নিজের কাজে মন দিতে। আমি এভাবেই ভালো আছি।”

প্রিয়ন্তি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। উষসী মাঝে মাঝে অনেক ঘাড়ত্যাড়া আচরণ করে। নিজে যেটা বলবে সেটাই। তার কথার কোনো হের-ফের হবে না। আজ তাদের ভার্সিটিতে কনসার্ট আছে। উষসী খুব সুন্দরভাবে সাজ-গোজ করেছে।

একটা টকটকে গোলাপি রঙের শাড়ি পরেছে। তাকে এই রঙটায় বেশ মানায়। এভাবে সে সাজলে সবার চোখে লেগে থাকে। আজ সে ইচ্ছে করেই খুব সাজবে। তারপর ফেসবুকে ছবি আপ্লড করবে। ইয়ামিনকে মেসেঞ্জারে ব্লক করা হয়েছে। ফেসবুকে সে এখনও আছে। তাই ছবিগুলো দেখে সে ঈর্ষায় জ্বলবে-পুড়বে.. এটাই উষসীর চাওয়া।

আজ ভার্সিটিতে যাওয়ার পর একটা অঘটন ঘটে যায়। শম্পার সাথে উষসীর মারা’ত্মক ঝগড়া লাগে। উষসীর বারণ সত্ত্বেও শম্পা তার দুলাভাইকে ইয়ামিনের ছবিগুলো দিয়েছিল। সেই ছবি পত্রিকায় ছেপে গেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় তোলপাড় হচ্ছে। ফোন হাতে নিলেই বড় বড় অক্ষরের হেডলাইন দেখা যাচ্ছে- ” লুকিয়ে ডেইট করছেন ইয়ামিন ইব্রাহীম। কে এই অচেনা মানবী?” এখন ইয়ামিনের সাথে মেয়েটিকে জুড়ে নানান রসালো আলাপে ভরপুর নিউজফিড। এসব উষসী জানতো না৷ ভার্সিটিতে আসার পরেই শুনেছে। তারপর গুগল ঘেঁটে দেখা গেল ঘটনা সত্যি! সহ্য করতে পারছে না উষসী। ইয়ামিনের পাশে অন্য মেয়ের নামটাও তাকে বি*ষাক্ত অনুভূতি দেয়। সে শম্পাকে বলেছে এসব যেন ওয়েবসাইট থেকে সরানো হয়। কারণ ব্যাপারটা পুরোপুরি গুজব!

শম্পা বলল,” এটা এখন আর সম্ভব না। সব জায়গায় এমনিই ভাইরাল হয়ে গেছে। এখন ওয়েবসাইট থেকে সরালে আমাদেরই লস। মানুষ তো আর এটা ভুলে যাবে না। সবার টাইমলাইনে এই পোস্ট ঘুরছে। ”

উষসী ক্রোধে ফোস ফোস করে বলল,” আমি তোকে নিষেধ করার পরেও তুই কোন সাহসে তোর দুলাভাইকে ছবি দিলি?”

শম্পা বিদ্রুপের দৃষ্টিতে বলল,” তুই কি আমার বস যে তুই যা আদেশ করবি সেটাই আমাকে করতে হবে? তুই আমাকে ছবি দিয়েছিস আর আমি সেটা কাজে লাগিয়েছি। ব্যস! তাছাড়া ব্যাপারটা সত্যিও হতে পারে। তুই কিভাবে বুঝলি যে গুজব?”

রাগে উষসী চোখে-মুখে অন্ধকার দেখছিল। কথা কা’টাকাটির এক পর্যায়ে সে শম্পার গালে চ’ড় মারে। শম্পাও তাকে চ’ড় মা’রে। এভাবে তাদের মধ্যে মা’রামারি শুরু হয়ে যায় রীতিমতো। প্রীতম এসে থামায় তাদের। উষসীকে কোলে করে গাড়িতে নিয়ে আসে। তারপর নিজে ড্রাইভ করে সোজা বাড়িতে নিয়ে যায়।

উষসীকে র’ক্তাক্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরতে দেখে সবাই অস্থির হয়ে ওঠে। প্রীতম উষসীর অনুরোধেই আর ভার্সিটির ঘটনাটা কাউকে জানায় না। শুধু বলে ছোট্ট এক্সিডেন্ট হয়েছিল। কিন্তু শম্পার ব্যাপারটা উষসীর মাথা থেকে যায় না৷ সে আর কখনও শম্পার সাথে কথা বলবে না। একটা সামান্য ঘটনার জন্য তাদের বন্ধুত্বই নষ্ট হয়ে গেল। তার চেয়েও বড় কথা, তার জন্য ইয়ামিনের ক্যারিয়ারের ক্ষ’তি হবে এটা সে মানতেই পারছে না!

এর দু’দিন পর উষসীর জন্য একটা পার্সেল আসে। তখন উষসী বাড়িতেই ছিল। তৃষাণ অফিস থেকে ফোন করে তাকে,” হ্যালো উষু, তোমার নামে একটা পার্সেল এসেছে আমার কাছে। সম্ভবত জিনিসটা এব্রোড থেকে। তোমার কোনো বন্ধুর কি বাইরে থেকে কিছু পাঠানোর কথা?”

উষসীর বুক ধ্বক করে উঠে। বার কয়েক ঢোক গিলে নেয় সে। গলা শুকিয়ে আসছে। বিদেশ থেকে পার্সেল এসেছে মানে নিশ্চিত ইয়ামিন পাঠিয়েছে। তৃষাণ ভাই এই কথা বুঝে গেলে সর্বনাশ হবে!

উষসী নিজেকে সামলে জানতে চাইল,” হ্যাঁ… ওই আমার একটা বন্ধবীর বিয়ে হয়েছে তো। হাজব্যান্ডের সাথে নরওয়েতে থাকে। সেই মনে হয় পাঠিয়েছে কিছু।”

” এটা তো খুব সুন্দর একটা পেইন্টিং।”

উষসী এবার আরও ভ’য় পেয়ে যায়। তৃষাণ পার্সেল খুলেও ফেলেছে? ও মাই গড…ইয়ামিন তো তার সব পেইন্টিং-এ নিজের সিগনেচার দেয়। সেটা যদি তৃষাণ দেখে ফেলে? নিশ্চয়ই দেখেছে এতোক্ষণে!

উষসী আমতা-আমতা করে বলল,”আমার জন্য পাঠানো পার্সেল তোমার অফিসে কিভাবে গেল ভাইয়া? ওটা তো বাসায় আসার কথা৷ তাইনা? মানে আমি তো আমার বাসার ঠিকানাই দিয়েছিলাম।”

তৃষাণ একটু হেসে বলল,” আসলে এটা প্রথমে বাসাতেই গিয়েছিল। দারোয়ান না বুঝে অফিসে পাঠিয়ে দিয়েছে। নো প্রবলেম… আমি আসার সময় নিয়ে আসব।”

উষসী জানে এটা একটা দাহা মিথ্যা কথা। পার্সেলটা দারোয়ান ভুল করে অফিসে কেন পাঠাবে? আসলে তৃষাণ ইচ্ছে করেই ওটা অফিসে নিয়ে গেছে। কারণ উষসীকে গোপনে কে কি পাঠায় তা সে জানতে চায়। এর আগে একবার প্রীতম তাকে শাড়ি কিনে পাঠিয়েছিল। সেটাও প্রথমে তৃষাণের অফিসে গিয়েছিল৷ বার-বার একই ভুল দারোয়ান কেন করবে?

উষসী পরে অনেক কষ্টে ব্যাপারটা ধামাচাপা দিয়েছিল। আর প্রীতমকেও এজন্য বকা-ঝকা করেছিল। সে অবশ্য শাড়িটা আর নেয়নি। প্রীতমকে ফিরিয়ে দিয়েছিল।

আজ আবার ইয়ামিন পার্সেল পাঠিয়েছে। এখন উষসী কি বলে ধামাচাপা দিবে এতোবড় একটা ব্যাপার? তার উপর যদি তৃষাণ ইয়ামিনের সিগনেচার দেখে ফেলে তাহলে তো কেলেংকারি হয়ে যাবে।

উষসী অবিরাম পায়চারি করতে লাগল। এক পর্যায় অযূ করে নামাযে বসল৷ এতে যদি একটু মন শান্ত হয়! আজ তৃষাণ বাড়ি ফিরলে ভূমিকম্প হবে। বড়-সড় কোনো অঘটন যেন কখনোই না ঘটে মা’বুদ! এর মাঝে ইয়ামিনের ব্লকটাও সে খুলে দিল। তারপর নিজে থেকেই ইয়ামিনকে ফোন করল,” হ্যালো, শুনছেন?”

ইয়ামিন উৎফুল্ল গলায় টিপ্পনী কাটল,” ফাইনালি তাহলে আমার প্রতি দয়া হলো তোমার! পার্সেল পেয়েছো?”

উষসী ক্ষীপ্ত গলায় বলল,” কিভাবে পাবো? ওটা তৃষাণ ভাইয়ের অফিসে চলে গেছে।”

” মানে? এটা কেমন করে হলো? আমি তো তোমার বাসার এড্রেসেই দিয়েছিলাম।”

” যতই বাসার এড্রেসে দেন… পার্সেল তৃষাণ ভাইয়ের অফিসেই যাবে। এটা অলিখিত নিয়ম। এবার বলুন তো, পেইন্টিং এর সাথে কি আপনি আর কিছু পাঠিয়েছেন? মানে তৃষাণ ভাই কি দেখে বুঝে ফেলবে যে ওটা আপনি পাঠিয়েছেন?”

ইয়ামিন শান্ত গলায় বলল,” রিল্যাক্স! এইটুকু কমন সেন্স আমার আছে উষসী। তোমার যাতে অসুবিধা না হয় তাই নিজের নামও লিখিনি আমি।”

” কিন্তু পেইন্টিং-এ তো আপনি সবসময় সিগনেচার দেন তাই না? ভাইয়া যদি সেটা দেখে নেয়?”

” পাগল? যেখানে তোমার ফ্যামিলির প্রত্যেকটা মানুষ আমার নাম জানে সেখানে আমি সিগনেচার কেন দেবো উষু?এইটুকু বুদ্ধি কি আমার নেই? ”

তারপর হেসে বলল,” চিন্তা কোর না। তোমার তৃষাণ ভাইয়ের বাপও কিছু বুঝবে না।”

উষসী হাঁফ ছেড়ে বাঁচল এতোক্ষণে,” থ্যাঙ্কিউ, থ্যাঙ্কিউ। ”

রাতে তৃষাণ বাড়ি ফিরে পেইন্টিং এর অনেক প্রশংসা করল। এতো নিখুঁত চিত্রকর্ম নাকি সে আগে কখনই দেখেনি। ছবিতে উষসী একটা কফির মগ নিয়ে বসে আছে। তার গায়ে বেবি পিংক রঙের টপ। চুলগুলো উড়ছে। ঠোঁটে আলতো হাসি। তৃষাণ মুগ্ধ গলায় বলল,” দেখে মনে হচ্ছে জীবন্ত একটা মেয়ে। এখনি কথা বলতে শুরু করবে। কি অদ্ভুত সুন্দর!”

উষসী মুখ টিপে হাসল। তৃষাণ যে এই মুহূর্তে নিজের চিরশত্রুর প্রশংসা করছে তা সে নিজেও জানে না। উষ্ণতা বলল,” সত্যিই ছবিটা খুব সুন্দর হয়েছে। এটা কে এঁকেছে উষু? তোর ফ্রেন্ডের হাজব্যান্ড?”

উষসী ‘হ্যাঁ’ বলতে নিয়েও পারল না। ইয়ামিনকে ফ্রেন্ডের হাজব্যান্ড বানাতে মন চাইছে না। পরে যদি এটাই সত্যি হয়ে যায়? তাই বলল,” না, হাজব্যান্ডের ছোটভাই। মানে দেবর।”

” ও আচ্ছা। তিনি কি পেশাদার আর্টিস্ট?”

” অনেকটা। তার এক্সিবিশনও হয়েছে কয়েকবার।”

তৃষাণ ছবিটা পর্যবেক্ষণ করতে করতে বলল,” আমি ওর সাথে দেখা করতে চাই।”

উষসী চায়ে চুমুক বসিয়েছিল মাত্র। তৃষাণের কথা শুনে তার মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো চা। উষসীর মা ধমক দিয়ে বললেন,” আস্তে খা… দিন দিন দেখি তুই তৃষ্ণার চেয়েও ছোট হয়ে যাচ্ছিস।”

উষসী লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসল। তৃষাণ বলল,” যদি কখনও ছেলেটা বাংলাদেশে আসে তাহলে বাড়িতে দাওয়াত কোর। আমি ওকে দিয়ে একটা পেইন্টিং আঁকাতে চাই।”

উষসী মনে মনে বলল,” সেটা কখনও সম্ভব না ভাইয়া। তাকে তুমি সরাসরি দেখলে নতুন পেইন্টিং আঁকানো তো দূর, পুরনোটাও ছিঁড়ে ফেলতে পারো। এতোবড় রিস্ক নেওয়া যায় না।”

কিন্তু মুখে বলল,” নিশ্চয়ই ভাইয়া। আমি বলে দেখব।”

এরপর উষসী নিজের ঘরে এসে ইয়ামিনকে ফোন করল আর আজকের ঘটনা বলে হাসতে হাসতে অস্থির হয়ে উঠল। ইয়ামিন গম্ভীর গলায় বলল,” এখানে এতো হাসির কি আছে? একদিন না একদিন তো আমাদের মুখোমুখি হতেই হবে। তখন না হয় তোমার দুলাভাইয়ের মাঁকড়সার মতো চেহারার একটা পোর্ট্রেট এঁকে দিবো।”

উষসী অবাক হয়ে বলল,” আপনি কি আমার দুলাভাইকে মাঁকড়সার সাথে তুলনা করছেন?”

” না, আমি তাকে সরাসরি মাঁকড়সাই বলছি। আটপায়ের জঘন্য, বিশ্রী মাঁকড়সা।” ইয়ামিনের অকপট জবাব।

উষসী কটমট করে বলল,” আপনার এতোবড় সাহস?”

ইয়ামিন শীতল হাসল,” হ্যাঁ। আমার সাহস বড় বলেই তো তোমার সাথে প্রেম করতে পেরেছি। ছোট সাহস হলে পারতাম না।”

” যাইহোক, তাই বলে আপনি তৃষাণ ভাইকে মাঁকড়সা বলবেন? তিনি আপনার চেয়ে বয়সে বড়। তাকে ন্যূনতম সম্মানটুকু দেবেন না?”

” তাহলে কি বলা উচিৎ সম্মান দিয়ে? সম্মানিত জনাব মাঁকড়সা সাহেব নাকি মহামান্য মাঁকড়সা সাহেব?”

উষসী তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল,” আপনি ফাজলামি করছেন? খবরদার, আমাকে আর একদম ফোন দেবেন না।”

” আরে উষু…”

রাগে উষসী ফোন রেখে দিল। ইয়ামিন আবার কল করতে লাগল। কিন্তু ধরল না উষসী। ফোন বন্ধ করে একসাইডে ফেলে রাখল। সারারাত রাগ নিয়েই বসে রইল সে। ঘুমও এলো না তার। ইয়ামিনের সাথে ঝগড়া হলে সেই রাতে আর ঘুম আসে না। শেষরাতে অবশ্য উষসী একটু ফোন খুলেছিল।

তখন দেখা গেল ইয়ামিনের অজস্র মেসেজে ভরে গেছে মেসেজ বক্স। প্রতিটি মেসেজে শুধু একটাই বাক্য,” আই এম স্যরি। আই এম স্যরি। আই এম স্যরি। আই এম স্যরি। আই এম স্যরি। আই এম স্যরি। আই এম স্যরি। আই এম স্যরি। আই এম স্যরি। আই এম স্যরি। আই এম স্যরি। আই এম স্যরি। আই এম স্যরি। আই এম স্যরি। আই এম স্যরি। আই এম স্যরি।”

উষসীর সব রাগ নিমেষেই উধাও হয়ে গেল। ঠোঁটে ফুটল ভোরের রোদ্দুরের মতো স্নিগ্ধ, স্বচ্ছ আর আদুরে এক টুকরো হাসি!

চলবে

#উষসী_হাসবে_বলে (২৪)
লিখা- Sidratul Muntaz

“প্লিজ আপু, বলো না! কি হয়েছিল সেদিন? তুমি কেন সু*ইসাইড করতে গিয়েছিলে?”

উষ্ণতা ক্রুর দৃষ্টিতে তাকাল। ভ*য় পেল উষসী। সে এর আগে কখনও তার আপুকে এমন করে রাগতে দেখেনি।সহায়হীন চোখে তাকিয়ে রইল সে। উষ্ণতা খুব শীতল গলায় বলল,” যা এখান থেকে। ”

” কিন্তু আমি জানতে চাই আপু, প্লিজ।” নরম গলায় অনুরোধ করে উষসী।

” তুই এসব জেনে কি করবি? কি দরকার তোর এতো জানার?”

তার জানাটা যে কত দরকার সেই কথা আপুকে কিভাবে বোঝাবে? ইয়ামিন বাংলাদেশে এসেছে। তার সঙ্গে কাল দেখা করতে যাচ্ছে উষসী। কতদিন পর দেখা হবে ! গুণে গুণে কেটে গেছে একটি মাস, বারোটি দিন। অবশেষে ইয়ামিন এসেছে।

কিন্তু সকাল থেকেই খুব হাঁসফাঁস লাগছে উষসীর। সত্যিটা এবার জানতে চায় সে। হ্যাঁ, ইয়ামিনকে সে শতভাগ বিশ্বাস করে। কিন্তু অতীতে কি হয়েছে তা পরিষ্কার না জানা পর্যন্ত মনের অন্ধকারটাও যে কা’টছে না! তাছাড়া আপুর চোখে ইয়ামিন কতটা দোষী সেটাও তো জানা দরকার।

উষসী হাত জোড় করে অনুনয় করল,” আপু প্লিজ, প্লিজ, আমাকে বলো। দুইদিন ধরে এই কথা চিন্তা করে আমি ঘুমাতে পারছি না। আমার জানাটা খুব দরকার!”

তৃষাণ রান্নাঘরে ঢুকল। তাকে দেখে সাথে সাথে নিশ্চুপ হয়ে গেল উষসী। তৃষাণ দুই বোনের দিকে একবার চাইল। তারপর লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল,” এক কাপ কফি পাওয়া যাবে? আসলে আমি একটু ব্যস্ত। নাহলে নিজেই বানিয়ে নিতাম।”

উষ্ণতা কেমন অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়ে ছিল। তৃষাণের কণ্ঠে তার ঘোর কাটে। নির্লিপ্ত গলায় বলল,” দিচ্ছি।”

উষসী তাড়াহুড়ো করে বলল,” আমি দেই না, প্লিজ। ভাইয়া তুমি ঘরে যাও। আমি বানিয়ে দিচ্ছি।”

তৃষাণ মৃদু গলায় বলল,” তৃষ্ণার তো এখন ওভালটিন খাওয়ার সময়…ওটাও নিয়ে এসো?”

” ঠিকাছে, আমি এখনি আনছি ভাইয়া। তুমি যাও।”

উষ্ণতা জিজ্ঞেস করল গম্ভীর গলায়,” ছেলে কি করছে?”

” পড়ছে।”

” তোমাকে জ্বালাচ্ছে না তো?”

” তা তো একটু জ্বালাচ্ছেই।” চশমা ঠেলে হালকা করে হাসল তৃষাণ।

উষ্ণতা বলল,” ঠিকাছে, আমি আসছি। যাও।”

তৃষাণ চলে যেতেই উষসী মুখ ভার করে তাকাল, অপরাধী কণ্ঠে বলল,” আমার কথায় কি তোমার মনখারাপ হয়ে গেছে আপু? আই এম স্যরি, আমি আসলে কৌতুহল থেকে..”

উষসী কথা শেষ করার আগেই তার কাঁধে হাত রাখল উষ্ণতা। আম্ভরিক গলায় বলল,” আমি ওসব বাজে স্মৃতি মনে করতে চাই না উষু।”

উষসীর মন বিষাদে সিক্ত হয়ে ওঠে। এই প্রসঙ্গ তোলায় উষ্ণতা কেমন উদাস হয়ে গেছে। তার চেহারায় হতাশার ছাপ স্পষ্ট। ইয়ামিনের মধ্যেও এমন হতাশা লক্ষ্য করেছিল উষসী। তারা দু’জনেই একটা খারাপ স্মৃতি মনে করে কষ্ট পাচ্ছে। অথচ এখানে তাদের কারোই কোনো দোষ নেই। ব্যাপারটা কি ঠিক?

উষ্ণতা চলে যাচ্ছিল। উষসী পেছন থেকে ডেকে বলল,” কার উপর তোমার রাগ আপু? ইয়ামিন ইব্রাহীম? তাকে কি তুমি ঘৃণা করো?”

প্রশ্নটা করেই প্রায় নিঃশ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে রইল উষসী। তার বুকের ভেতর দামামা বাজছে। কিছুক্ষণ নীরবতা বয়ে যায়। উষ্ণতা সময় নিয়ে ঘুরে তাকায়। বেশ আশ্চর্য হয়ে বলল,” তুই কিভাবে জানলি যে এসবের পেছনে ইয়ামিন দায়ী?”

উষসীর মনে হলো তার হৃদয়ে কেউ জ্বলন্ত কয়লা চেপে ধরেছে। এতো কষ্ট হচ্ছে! ভেতরটা জ্বলে-পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যেতে চাইছে। নিচের ঠোঁট চেপে আবেগ সামলায় সে। প্রশ্ন করে উদ্বিগ্ন হয়ে,” তার মানে সবকিছু ওই ইয়ামিন ইব্রাহীমের জন্য হয়েছিল?”

উষ্ণতা ভ্রু কুঁচকে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। কেমন ঘোরগ্রস্তের মতো মাথা নাড়ল সে। মৃদু স্বরে বলল,” না। ইয়ামিনের দোষ ছিল না। দোষ আমার কপালের।”

একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে উষ্ণতা। উষসী কাছে গিয়ে তার আপুর হাত চেপে ধরে। তাকে টেনে এনে কিচেন কেবিনেটের উপর বসায়। তারপর নিজেও বসে। বোনের গলা জড়িয়ে ধরে আদুরে কণ্ঠে প্রশ্ন করল,” আমাকে বলো আপু। খারাপ স্মৃতি চেপে রাখতে নেই। শেয়ার করলে মন হালকা হয়। প্লিজ বলো!”

উষ্ণতার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল তপ্ত একফোঁটা অশ্রু। উষসীর হাতের বাঁধন ছাড়িয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল,” ইয়ামিনের বন্ধুরা মিলে করেছিল। ওরা আমার ড্রিংক্সের সাথে নেশার মতো কিছু মিশিয়ে দিয়েছিল। আমি হুশে ছিলাম না সেদিন। ইয়ামিনও তাদের এই নিকৃষ্ট কাজে সাহায্য করেছিল। সে জানতো যে তারা আমার সাথে খারাপ কিছু করবে। কিন্তু এতোটা খারাপ তা হয়তো বুঝতে পারেনি। ও নিজেই ভিডিওটা দেখে আক্রোশে উন্মাদ হয়ে পড়েছিল। সবকিছু ভেঙে-চুরে একাকার করে ফেলেছিল। আমার জীবনের সবচেয়ে বীভৎস দিন ছিল সেটি। আমি একদম মনে করতে চাই না ওই দিনটি। একদম না! প্লিজ আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করিস না উষু, প্লিজ!”

উষ্ণতা কেমন অপ্রকৃতস্থের মতো আচরণ করছে। উষসী নিজের কাঁধে তার বোনের মাথাটা চেপে ধরে কাঁদতে লাগল। তার বুকজুড়ে তীক্ষ্ণ ব্যথা। কিছু একটা ভেঙে পড়তে চাইছে। জ্বালাময়ী এই অনুভূতির দহন সহ্য করতে পারছে না উষসী। ইয়ামিনও তাদের সাহায্য করেছিল?

” তারা কে ছিল আপু? ওই জানোয়ারদের নাম কি?”

” আরিশা, সোহানা…”

” মেয়ে?” উষসী হতভম্ব হয়ে গেল।

উষ্ণতা হতাশ কণ্ঠে বলল,” এজন্যই বলে… মেয়েরা মেয়েদের বড় শত্রু!”

উষসী মুখ টিপে কান্না সামলালো। সে এই সবকিছুর শোধ তুলবে একদিন। তার আপুর চোখের জলের দাম তাদের দিতে হবে!

ইহতেশাম সাহেবের সামনে বসে আছে ইয়ামিন। এতোদিন পর বাবার সাথে তার দেখা, প্রায় দুইবছর কেটে গেছে। ব্যবসার কাজে ইহতেশাম সাহেব নিঃশ্বাস নেওয়ার ফুরসত পান না। অধিকাংশ সময় তিনি বিদেশেই থাকেন। মহাব্যস্ততায় কাটে বাবা-ছেলের ভিন্ন দুই জীবন। ইয়ামিনও আজ-কাল নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এবার অবশ্য ভিন্ন ঘটনা ঘটেছে। বাবাও দেশে এসেছে আর ছেলেও ঘরে ফিরেছে। একদম সাপে বর হয়েছে। তাই আজ বহুদিন পর দু’জন মুখোমুখি। তবুও দূরত্ব ঘোচেনি এতোটুকু। একটা দুঃসংবাদ এলোমেলো করে দিয়েছে সবকিছু।

” তুমি তাহলে ফাবিয়াহকে বিয়ে করতে চাও না?”

” না।”

ইয়ামিনের নির্বিকার,স্পষ্ট জবাব। ইহতেশাম কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। কঠিন গলায় জানতে চাইলেন,” কেন?”

” কারণ এটা কখনোই সম্ভব না। মাকে আমি সব বলেছি। আশা করি তুমিও এর কারণ জানো।”

ইহতেশাম দরাজ গলায় বললেন,” যদি তোমার বিয়ে করার ইচ্ছাই না থাকে, তাহলে দেখা করতে গিয়েছিলে কেন?একটা মেয়ের জীবন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তোমার গাফিলতির জন্য।”

ইয়ামিন অবাক হয়ে তাকাল,” আমার গাফিলতির জন্য? আমি কি করেছি বাবা? ওই ছবি তো আমার জন্য ভাইরাল হয়নি! আমি নিজেও এর ভিক্টিম। আমার ক্যারিয়ারের উপর প্রভাব পড়ছে।”

” কিসের ক্যারিয়ার তোমার? ওটাকে ক্যারিয়ার বলে নাকি বেহায়াপনার জীবন বলে? তুমি ছোট থেকেই উচ্ছন্নের জীবন বেছে নিয়েছিলে। কত স্বপ্ন ছিল তোমাকে নিয়ে আমার। পড়াশুনা করে আমার ব্যবসা সামলাবে, বার্ধক্যে আমার নির্ভরতা হবে…কিন্তু কোথায় কি? তুমি বেহায়ার মতো গান গেয়ে বেড়াচ্ছো। তোমাকে ছেলে বলে পরিচয় দিতেও আমার লজ্জা হয়।”

ইয়ামিনের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল নিমেষেই। ইচ্ছে হলো এই মুহূর্তে এখান থেকে উঠে চলে যায়। কিন্তু পারল না। শিমলা স্বামীর ভারী কণ্ঠ শুনে লিভিংরুমের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন। করুণ দৃষ্টিতে তিনি তাকিয়ে আছেন ছেলের দিকে।

ইয়ামিন মাথা ঠান্ডা করে জানতে চাইল,” এতোদিন পর আমাদের দেখা হয়েছে বাবা। তুমি কি শুধু এসবই বলবে? আর কিছু বলার নেই তোমার আমাকে?”

সে তাকিয়ে আছে অবাক দৃষ্টিতে। তার চোখ দু’টো র’ক্তিম। ইহতেশাম সাহেবের পুরো মুখ থমথম করছে। তিনি কেটে কেটে বললেন,” তোমার মতো দায়িত্বজ্ঞানহীন ছেলেকে আমার কিছুই বলার নেই। আমার শুধু খারাপ লাগছে ফাবিয়াহর জন্য। মেয়েটা উল্টা-পাল্টা কিছু করে বসলে নিজেকে মাফ করতে পারবে তুমি?”

” মানুষের কথায় ও কেন নিজের জীবন নষ্ট করবে? এতোটা বোকা ওকে আমার মনে হয়নি।”

” পৃথিবীর সব মানুষকে নিজের মতো নির্লজ্জ ভেবো না। ও একটা ভদ্র পরিবারের মেয়ে। সমাজে ওদের সম্মান আছে। যা তোমার মতো লাফাঙ্গারের জন্য নষ্ট হয়ে গেছে। তা নিয়ে ন্যূনতম অনুশোচনা আমি তোমার চোখে-মুখে দেখতে পাচ্ছি না। আবার গর্ব করে বলছো অন্যকাউকে ভালোবাসো? এই দিন দেখার জন্য কি জন্ম দিয়েছিলাম তোমাকে? ঘৃণা হচ্ছে আমার নিজের প্রতি। বের হয়ে যাও তুমি ঘর থেকে। আর কখনও আমার সামনে পড়বে না।”

ইয়ামিন এবার আর ধৈর্য্য রাখতে পারল না। তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেল বাড়ি ছেড়ে। মিসেস শিমলা পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে অশ্রুপূর্ণ দৃষ্টিতে সবকিছু দেখছিলেন। কিছুই করতে পারলেন না তিনি। বাবা-ছেলের এই যুদ্ধে তিনি চিরাচরিত অসহায়।

গাড়িতে উঠে ইয়ামিন ফুলস্পিডে ড্রাইভিং শুরু করল। পাথরের মতো শ’ক্ত হয়ে আছে তার চোখ-মুখ। এই মুহূর্তে সে কোথায় যাচ্ছে নিজেও জানে না। এতোদিন পর বাবার সাথে তার দেখা! ইচ্ছে ছিল অন্তত একবার বাবাকে জড়িয়ে ধরবে। নিজের ইনকামের টাকায় বাবার জন্য কেনা রোল্যাক্স ঘড়িটা নিজেই পরিয়ে দিবে। একসাথে লাঞ্চ করবে, ডিনার করবে। ছোটবেলার মতো বাবার সাথে দাবা আর ক্যারাম খেলবে। সোনালী দিনগুলো আবার ফিরে আসবে। কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল!

কোথাকার কোন মেয়ে ফাবিয়াহ, তার দুঃখে ভদ্রলোক বেচাল হয়ে উঠেছেন। অথচ নিজের ছেলের মনের অবস্থাটা একবার বুঝতে চাইছেন না। কেমন বাবা তিনি? ইয়ামিন আর ফিরবে না ওই বাড়িতে। প্রয়োজনে হোটেলে থাকবে। তবুও আর ফিরবে না। তার অভিমানের পাহাড়টা বাড়তে বাড়তে আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছিল। আজ সেখানে শুধুই আগ্নেয়গিরি।

ফোন হাতে নিতেই উষসীর নাম্বারটা দেখে মনের মধ্যে এক টুকরো শান্তির বাতাস বয়ে গেল যেন। ইয়ামিনের এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে তার মনের যন্ত্রণা অপসারণের জন্য উষসীর সান্নিধ্য অত্যন্ত জরুরী। একবার উষসীকে জড়িয়ে ধরে বুক ভরে শ্বাস নিলেই বাতাসের বিষাক্ততা কেটে যাবে। মেজাজ ফুরফুরে হয়ে উঠবে। সে উন্মত্ত হয়ে ফোন করল উষসীর নাম্বারে।

অথচ উষসী ফোন ধরল না। বিনিময়ে মেসেজ করল,” ক্লাসে আছি।”

ইয়ামিন লিখল,” ঠিকাছে। আমি আসছি।”

” আসছি মানে? আপনি আমার ভার্সিটিতে আসবেন?”

” কোনো সমস্যা?”

উষসী ঢোক গিলে লিখল,” না, মানে… কেউ দেখে ফেললে?”

” মাস্ক পরে আসব। চিনবে না কেউ।”

” মুখে দশটা মাস্ক পরলেও মানুষ আপনাকে চিনে ফেলবে ইয়ামিন ইব্রাহীম। আপনার ভার্সিটিতে আসার কোনো প্রয়োজন নেই।”

” আমি গাড়ি থেকে বের না হলে কেউ চিনবে কিভাবে? তুমি শুধু আমার ফোনের অপেক্ষায় থাকো। আমি এসেই কল করব।”

উষসী ভোঁতা মুখে তাকিয়ে রইল ফোনের স্ক্রিনের দিকে। তাদের হিস্ট্রি ক্লাস চলছে তখন। রাবিনা ম্যাম ছোট্ট চুলে আঙুল বুলিয়ে লেকচার দিয়ে যাচ্ছেন। সেই লেকচার গোগ্রাসে খাতায় টুকছে শিক্ষার্থীরা। উষসী পেছনের বেঞ্চিতে একা বসে আছে। তার সামনে খাতা-কলম আছে ঠিকই, কিন্তু সে লিখছে না। খাতার নিচে ফোন লুকিয়ে চ্যাট করছে ইয়ামিনের সাথে।

হঠাৎ রাবিনা ম্যাম ব্যাপারটা খেয়াল করলেন। কোনো কারণে ম্যাডামের মেজাজ বোধ হয় খারাপ ছিল। তিনি উষসীকে ডাকলেন,” এই মেয়ে, দাঁড়াও তুমি।”

মুহূর্তেই পুরো ক্লাসরুমের মনোযোগ উষসীর উপর এসে পড়ল। অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল সে। রাবিনা ম্যাম বললেন,” কি করছো বেঞ্চের নিচে? তোমার হাতে কি? ফোন!”

উষসী অস্বীকার করার সাহস দেখাল না। ম্যাডাম তাকে দাঁড় করিয়েছেন মানে নিশ্চিত ফোন দেখেছেন। তাই মাথা নাড়ল। রাবিনা দ্বিগুণ তেজে বললেন,” বের হও আমার ক্লাস থেকে। আমি কোনো আবর্জনা ক্লাসে দেখতে চাই না।”

উষসীর মনে মনে খুশিই লাগল। এই ক্লাসটা যথেষ্ট বিরক্তিকর লাগে তার কাছে। লিখতে লিখতে হাত অবশ হয়ে যায়। তার চেয়ে ভালো নিচে গিয়ে ক্যাফেটেরিয়ায় বসে দুই কাপ কফি খাওয়া। সে বিনা দ্বিধায় ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে গেল। ভালোই লাগছে এখন। তবে একগাদা স্টুডেন্টের সামনে অপমানিত হয়ে একটু লজ্জাও লাগছে। অন্য ডিপার্টমেন্টের ছেলেরাও ছিল। জুলোজি, বোটানি, ফিজিক্স, লাইব্রেরী সাইন্স, সবাই তো এখানে এসেই ক্লাস করে। কিভাবে তাকিয়ে ছিল তারা, ইশ!

ইয়ামিন এসে পৌঁছালো দেড়ঘণ্টা পর। আকাশে অনেক মেঘ করেছে। মনে হয় বৃষ্টি হবে। পরিবেশ অন্ধকারে ঢেকে গেছে। শীতকালে বৃষ্টি একমাত্র বাংলাদেশেই সম্ভব। এখানে ঠান্ডায় স্নোফল হয় না, ওয়াটারফল হয়। ঝিলের এই জায়গায় একটা মানুষও নেই। সবাই ছায়া খুঁজে আশ্রয় নিয়েছে। বর্ষণ এখনও শুরু হয়নি। ঠান্ডা বাতাস দিচ্ছে। উষসীর গায়ে একটা মেরুন রঙের শাড়ি। ইয়ামিনের সাথে দেখা করবে বলেই এটা পরে এসেছিল। সোয়েটার ইচ্ছে করেই নেয়নি। বড় ভুল হয়ে গেছে। এখন যে শীত লাগছে খুব!

হঠাৎ দূর থেকে কাউকে হেঁটে আসতে দেখা গেল। অবয়বটা চিনতে অসুবিধা হলো না উষসীর। তার মুখে মাস্ক থাকলেও ওই তীক্ষ্ণ চোখ দু’টি দেখেই ছলাৎ করে উঠল বুক। চিত্ত পুলকিত হলো। সেই সাথে বাড়তে লাগল হৃৎস্পন্দন। কতদিন পর দেখা! ইয়ামিন গায়ের জ্যাকেট খুলে নিচ্ছে। তাই দেখে ভ্রু কুঁচকাল উষসী। এই ঠান্ডার মধ্যে ছেলেটার মাথা খারাপ হয়েছে নাকি? জ্যাকেট কেন খুলছে?

একদম কাছে এসে ইয়ামিন উষসীর গায়ে জড়িয়ে দিল ল্যাদারের কালো জ্যাকেটটা। তার এমন যত্নে উষসীর মন ভরে উঠল। উষ্ণ শীহরণে খিলখিলিয়ে উঠল সে। আরও একটু উষ্ণতা আর আদর পাওয়ার লোভে তৃষ্ণার্তের মতো শক্তভাবে ইয়ামিনকে জড়িয়ে ধরল উষসী। ইয়ামিন তার চুলে মুখ ডুবিয়ে দিল। কপালে চু’মু দিল অজস্র। বুক ভরে শ্বাস নিতেই খেয়াল করল তার মনের সব ক্লিষ্টতা, যন্ত্রণা, ব্যথা নিঃশেষ হয়ে গেছে মাত্র একটা আলিঙ্গনেই। সব যেন বৃষ্টির পানিতে ধুঁয়ে-মুছে যাচ্ছে।

আকাশ ফেটে বৃষ্টি নামতে শুরু করেছে। সেই সাথে উষসীর চোখেও নেমেছে বর্ষণ। আনন্দে রীতিমতো কান্না পাচ্ছে তার। ইয়ামিন অনেকক্ষণ উষসীকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। ছাড়ার নাম নেই। উষসীও যেন একটু একটু করে ঢুকে যাচ্ছে ইয়ামিনের ভেতরে। বৃষ্টির বড় বড় ঠান্ডা ফোঁটা ভিজিয়ে দিচ্ছে তাদের। অথচ কারোই হুশ নেই। এতোটুকু শীত অনুভব হচ্ছে না তাদের। তারা শুধু অনুভব করছে একে-অন্যের স্পর্শ। দীর্ঘ বিচ্ছেদের ব্যথা সহ্য করে অবশেষে এই মিলনের তীব্র সুখ অবর্ণনীয়!

তাদের থেকে অনেকটা দূরে ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে আছে প্রীতম। একজনের থেকে ছাতাটা ধার করে এনেছিল উষসীর কাছে যাওয়ার জন্য। মেয়েটা একা ঝিলপাড়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে ভেবেছিল তাকে মেইন গেইট পর্যন্ত ছাতা দিয়ে এগিয়ে দিবে। কিন্তু হঠাৎই লম্বাদেহী আগন্তুককে দেখে থেমে দাঁড়িয়েছে সে। থমকে গেছে তার বুকের বামপাশের স্পন্দনও৷ কে এই ভদ্রলোক? উষসীর সাথে তার কিসের এতো ঘনিষ্টতা? সে কি ইউনিভার্সিটির সিনিয়র কেউ? হবে হয়তো!

এতো দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে না ইয়ামিনের মুখটা। বৃষ্টির কারণে ঝাপসা প্রকৃতি। এতে সুবিধাই হয়েছে। প্রীতম নিজের দু’চোখের বয়ে চলা অবাধ বর্ষণটা অনায়াসেই লুকাতে পারছে। সে আর দাঁড়িয়ে থাকল না। শূন্য মন নিয়ে উদ্দেশ্যহীন হাঁটতে লাগল। তার চেনা পথগুলো আজ ভীষণই অচেনা ঠেঁকছে। খুব হারিয়ে যেতে মন চাইছে এমন কোথাও, যেখানে হারালে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না তাকে।

ইয়ামিন ঘোর মাখা কণ্ঠে হঠাৎ বলল,” এই পিচ্চি, চলো বিয়ে করব।”

উষসী হেসে জিজ্ঞেস করল,” কবে?”

” খুব দ্রুত।”

” কাউকে না জানিয়ে? একা একা?”

ইয়ামিন দুইপাশে মাথা নাড়ল। উষসীকে টেনে তুলে তার চোখের দিকে তাকাল। পূর্ণ আত্মবিশ্বাস ভরা কণ্ঠে বলল,” লুকিয়ে কখনও বিয়ে করব না আমি তোমাকে। বরং সবার অনুমতি নিয়ে, সবাইকে জানিয়ে পুরো বিশ্বকে সাক্ষী রেখে ঘরে তুলব। কথা দিচ্ছি। আর সেটা খুব শীঘ্রই। কারণ আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না। আমার এই অসুস্থ জীবনের একমাত্র নিরাময় তুমি। তোমাকে আমার ভীষণ দরকার সুহাসিনী।”

উষসীর মুখ মলিন হয়ে উঠল। হতাশাভরা কণ্ঠে শুধাল,” আমাদের বিয়ে কি আদৌ সম্ভব? কেউ রাজি হবে না।”

ইয়ামিন উষসীর মাথাটা বুকে চেপে ধরে বলল,” অবশ্যই সম্ভব। সবাই রাজি হবে।”

উষসী ভেবেছিল ইয়ামিন এমনি বুঝি এসব বলছে। কিন্তু বাড়ি ফেরার পর সবচেয়ে বড় অঘটনটা ঘটল। উষসী মাত্র গোসল সেরে বের হয়েছে তখন। লাঞ্চের জন্য মা ডাকছেন। অথচ উষসী ইয়ামিনের সাথে বাইরে থেকে খেয়েই এসেছে। সেই কথা তো আর বলা যাবে না। তাই জোর করে অল্প একটু খেয়ে নিতে হবে। বসে বসে সেই কথাই ভাবছিল। এমন সময় তার ফোন বেজে ওঠে। আহমেদ ভাই ফোন করেছে অফিস থেকে।

উষসী বলল,” হ্যালো।”

ওই পাশ থেকে শোনা গেল আহমেদের বিপর্যস্ত গলা। ইয়ামিন নাকি একটু আগেই অফিসে এসেছে। সে তৃষাণের সাথে জরুরী কথা বলতে চেয়েছে। তাকে দেখে তৃষাণ প্রথমে খুব রেগে গেছিল। আপাতত তারা লিফটে করে ছাদে যাচ্ছে। এটুকু শুনেই উষসীর মাথা খারাপ হয়ে যায়। প্রথমত ইয়ামিন কোন সাহসে তৃষাণের সামনে গেল? আর তৃষাণ তাকে নিয়ে ছাদেই কেন যাবে? ওখানে তাদের কি কাজ? কি আশ্চর্য! বিভিন্ন ভ*য়ংকর চিন্তা উষসীর মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। সে বুঝি আতঙ্কে হার্ট এটাক করে ফেলবে!

চলবে