#উষসী_হাসবে_বলে ( ৩৩)
লিখা- Sidratul Muntaz
” আপনারা হয়তো ভাবছেন আমি আমার ব্যক্তিগত বিষয় সবার সামনে এভাবে কেন কনফেস করছি! আসলে ব্যক্তিগত বিষয়টা আমি আর ব্যক্তিগত রাখতে চাইছি না। কারণ এটাই এখন আমার কাছে মেইন ফ্যাক্ট৷ আমার জীবনের লক্ষ্য, আমি এটা পাবলিক করতে চাই। পৃথিবীর সবাইকে তুমুল আনন্দের সাথে জানাতে চাই যে আমি ভালোবাসি একজনকে। সে আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সুর৷ তাকে হারিয়ে ফেলা মানে জীবনের ছন্দ হারিয়ে ফেলা। আমি তাকে কোনো ভাবেই হা’রাতে চাই না। উষসী, তুমি কি বিশ্বাস করে একবার আমার হাতটা ধরবে না?”
চটপটে একটি মেয়ে হাত তুলল। সে মাইকের কাছে এসে কিছু বলতে চায়। ইয়ামিন সরে গিয়ে তাকে জায়গা করে দিল। মেয়েটি কয়েক ধাপ সিঁড়ি পার হয়ে উপরে উঠল। মাইকের কাছে মুখ এনে বলল,” আমি জার্নালিজম বিভাগ থেকে আয়েশা সুলতানা ফাইজা বলছি। ইয়ামিন ইব্রাহীমের অনেক বড় ফ্যান। ভাইয়া, আপনার ছোট থেকে ছোট্ট আপডেটও আমার কাছে থাকে। আজ বিশ্বাসই হচ্ছে না যে আমি আপনার সামনে এভাবে দাঁড়িয়ে আছি। আমি কি আপনার সাথে একটু হ্যান্ডশেক করতে পারি?”
” নিশ্চয়ই।”
মেয়েটি ইয়ামিনের হাত ধরেই রুদ্ধ কণ্ঠে বলল,” ও মাই গড… আ’ম সো এক্সাইটেড…”
সে বুকের উপর হাত চেপে ধাতস্থ হওয়ার চেষ্টা করছে। ইয়ামিন বলল,” আর ইউ অলরাইট? ”
” ইয়েস আ’ম… আই থিংক… এই বছরের সেরা শকিং নিউজ হতে যাচ্ছে এটা। আমি আমার ক্লাসমেটদের ব্রোকেন হার্টের শব্দ শুনতে পাচ্ছি… ”
সবাই হেসে উঠল। ইয়ামিন মাথা নিচু করে মৃদু হাসল। মেয়েটি অনুনয়ের স্বরে বলল,”উষসী, কে তুমি উষসী? প্লিজ কাম হেয়ার। আমরা তোমাকে দেখতে চাই। উই রিয়েলি ওয়ান্না সী ইউ।”
সবাই এতো জোরে জোরে চিৎকার করছে যে উষসী শুনতেই পেল না তার ফোনটা সাইলেন্ট মোডে থেকে অনেকক্ষণ ধরে বাজছে। ব্যাপারটা খেয়াল হতেই ফোনের স্ক্রিনে তাকাল সে। এতোবার ফোন দেওয়া হচ্ছে কেন বাসা থেকে? সে দ্রুত মোবাইল সাইলেন্ট মোড থেকে নরমাল মোডে করল। তখনি দেখল একটা মেসেজ এসেছে,” উষু, তোকে একটা এড্রেস পাঠিয়েছি মা। এখুনি এই হাসপাতালে চলে আয়। উষ্ণতার অবস্থা ক্রিটিকাল। বাথরুমে মাথা ঘুরে পড়ে গেছে আর অসময়েই লেবার পেইন উঠেছে। জানি না কি হবে! আহসানকে নিয়ে দ্রুত আয়। আজ তোর ক্লাস করার কোনো দরকার নেই।”
মেসেজটা এসেছে ডোনার নাম্বার থেকে। পেছন থেকে আহসান ওরফে উষসীর বডিগার্ড বলল,” আমাদের যেতে হবে ম্যাডাম। স্যার ফোন করে আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছেন। বড় ম্যাডাম হসপিটালে।”
উষসী ফ্যাকাশে কণ্ঠে বলল,” হুম৷ আমি এই মাত্র আন্টির মেসেজ পেলাম।”
একবার সম্মুখে তাকাল সে। ইয়ামিনের চোখ দু’টো চিকমিক করছে। জনতারা এখনও গলা ফাটিয়ে ডাকছে উষসীর নাম। ইয়ামিন প্রবল আগ্রহ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার একটা সাড়ার অপেক্ষায়! মেয়েটি বলছে,” আমার মনে হয় উষসী এই মুহূর্তে এখানে উপস্থিত নেই। নাহলে এতো সুন্দর প্রপোজ্যালে সাড়া না দিয়ে থাকা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। ইয়ামিন ইব্রাহীম, ভাইয়া আপনি কি আর কিছু বলতে চান আপনার চিত্রে আঁকা অপসরীর উদ্দেশ্যে? ”
ইয়ামিন মোবাইল হাতে নিয়ে উষসীর নাম্বারে ডায়াল করল। ভীড়ের মধ্য থেকে ফোনের হালকা রিংটোন যেন খুব গাঢ় শব্দে বেজে উঠল। আশেপাশের মানুষ অবাক হয়ে তাকাল। উষসী ফোন রিসিভ করে কানে তুলল,” হ্যালো।”
” উষসী, তুমি কি শুনতে পাচ্ছো?”
” হুম। আমি আপনাকে দেখতেও পাচ্ছি।”
উষসীর জবাব শুনে আশেপাশের সবাই করতালি বাজাল আবারও। ইয়ামিন হেসে উঠল। তার চোখ দু’টো স্থির হলো জনসমুদ্রের বিশালতার মধ্যে দাঁড়ানো একমাত্র অসাধারণ মুখটির উপর। মানুষের সারি দুই পাশে বিভক্ত হয়ে উষসীকে জায়গা করে দিল সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য।
উষসী তার ফোনটা আহসানের হাতে দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগল। আহসান পেছন থেকে ডাকল,” ম্যাডাম…”
উষসী তাকে থামিয়ে বলল,” আমি পাঁচমিনিট পরে আসছি আহসান ভাই।”
আহসান কিছু বলার সুযোগ পেল না। উষসী কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই ইয়ামিন নেমে এলো। তারপর হাত ধরে উষসীকে নিয়ে উপরে উঠল। সবাই প্রবল আনন্দে করতালি বাজিয়েই যাচ্ছিল৷ শিষ, চিৎকার, উল্লাসের শব্দে মুখরিত পরিবেশ। উষসীর চোখে পানি জমে উঠেছে এসব দেখে। ইয়ামিন জিজ্ঞেস করল,” উইল ইউ ম্যারি মি?”
উষসী কেঁদে ফেলল। তার চোখ ভর্তি দ্বিধা। ইয়ামিন হাত বাড়িয়ে গানের সুরে বলল,,” বেবি জাস্ট হোল্ড মাই হ্যান্ড,
বি মাই গার্ল, আই উইল বি ইউর ম্যান!
আই সী দ্যা ইউনিভার্স ইন ইউর আইস… ”
উষসী কোনো কথা বলতে পারছে না৷ সে শুধু ইয়ামিনের হাতটা শক্ত করে ধরল। সাথে সাথেই জয়ধ্বনি দিতে শুরু করল সবাই। উষসী তখনও অন্যহাত নিজের মুখে ঠেঁকিয়ে কান্না সামলাচ্ছে।
ইয়ামিন আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল,” চলো, সব প্রবলেম সোলভ করি একসাথে। এভাবেই হাতে হাত রেখে। তোমার এই চোখে আমি পুরো ইউনিভার্স খুঁজে পাই যেখানে পৃথিবী খুবই নগন্য! তাই তোমাকে পেলে আমি পৃথিবীও ভুলতে রাজি।”
আবার উল্লাস ধ্বনি ভেসে এলো। সকালের এই চাঞ্চল্যকর পরিবেশটা কতই না মনোমুগ্ধকর আর চমৎকার! ঠিক স্বপ্নের মতোন। উষসী ফুপিয়ে উঠল। সবাই ধরেই নিল খুশিতে কাঁদছে সে। কাঁদার মতোই একটি মুহূর্ত এটি। তাই ধরে নেওয়া যায় উষসীর জবাব হ্যাঁবোধক।
ইয়ামিন তার পকেট থেকে একটা রিং বের করে উষসীর আঙুলে পরিয়ে দিল। তারপর তার হাতে চুমু দিয়ে বলল,” লেটস ম্যারি।”
উষসী জড়িয়ে ধরল ইয়ামিনকে। সবাই উচ্ছ্বাসে, আনন্দে কলরব করছে আর উষসী ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে!
ভীড় ঠেলে সবার মাঝখান দিয়ে যাওয়াও এক যুদ্ধ। এমন ভীড় বোধহয় ভর্তি পরীক্ষাতেও হয় না। বহিরাগতরাই এসে ভীড় জমিয়েছে বেশি। সবাইকে সরিয়ে যেতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। ইয়ামিন অবশ্য উষসীকে সবার মধ্যে থেকে আগলে নিয়ে যাচ্ছে। আজ সবাই উষসীর সাথেই বেশি সেলফি তুলছে। উষসীর বন্ধুরা তো তার কাছাকাছিও আসতে পারল না৷ এর আগেই ইয়ামিন তাকে নিয়ে গাড়িতে উঠে গেল। দূর থেকে প্রীতম সবকিছু দেখছিল। সেদিনের ওই ছেলেটি তাহলে ইয়ামিন ইব্রাহীম ছিল! ভার্সিটির সিনিয়র কেউ না? ভেবেই একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল প্রীতম। যাইহোক, তবুও উষসী সুখী হোক।
ইয়ামিন জিজ্ঞেস করল,” কোথায় যেতে চাও?”
উষসী একবাক্যে জবাব দিল,” হসপিটালে।”
ইয়ামিন উদ্বেগ নিয়ে তাকাল, প্রশ্ন করল সবিস্ময়ে,” হসপিটাল?”
উষসী কান্না-ভেজা গলায় বলল,” উষ্ণতা আপু হসপিটালে। তার অবস্থা ক্রিটিকাল। বাসা থেকে ফোন এসেছিল। ডোনা আন্টি আমাকে হসপিটালের এড্রেস টেক্সট করেছেন। দ্রুত যেতে বলেছেন। যদি আপুর কিছু হয়..”
কথা শেষ না করেই কাঁদতে লাগল উষসী। ইয়ামিন আদুরে ভঙ্গিতে তার মাথায় হাত রেখে বলল,” চিন্তা কোর না। কিচ্ছু হবে না উষু। এইতো, দ্রুত যাচ্ছি আমরা। কোন হসপিটাল?”
উষসী হাসপাতালের ঠিকানা দিল। তারপর বলল,” আপনাকে ভেতরে যেতে হবে না৷ শুধু আমি একা যাবো। সবাই এমনিই পেরেশানিতে আছে তার উপর আপনাকে যদি দেখে…”
ইয়ামিন সাথে সাথে বলল,” ঠিকাছে আমি যাবো না। তোমাকে পৌঁছে দিবো শুধু…”
উষসী ইয়ামিনের দিকে তাকিয়ে তীব্র অপরাধ মাখা গলায় বলল,” আ’ম স্যরি।”
” আরে… এতে স্যরি বলার কি আছে? আমি সিচুয়েশন বুঝতে পারছি৷ এই সময় আমার আসলেই ওখানে যাওয়া ঠিক না।”
” আমি এই জন্য স্যরি বলিনি।” এইটুকু বলেই আঙুল থেকে আংটিটা খুলে সামনে রাখল সে। ইয়ামিন অবাক হয়ে তাকাল। উষসী মাথা নিচু করে বলল,” আমার পক্ষে সম্ভব না আপনাকে বিয়ে করা।”
ইয়ামিনের হাতের পেশি শিথিল হয়ে এলো। অচিরেই গাড়ি ব্রেক করল সে। সামনের দিকে খানিকটা ঝুঁকে পড়ল উষসী। নিজেকে সামলে বলল,” উষ্ণতা আপুর এই অবস্থার জন্য আমি দায়ী। আমার জন্যই টেনশন করতে করতে মানসিক দূরবস্থা হয়েছে তার৷ নাহলে হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ার প্রশ্নই আসে না। এতোদিন সে যথেষ্ট সুস্থ-সবল ছিল। তাহলে আজকেই কেন এই ঘটনা ঘটবে? যখন আপনি আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারে এনাউন্স করছিলেন তখনি আমার কাছে দুঃসংবাদটা এসেছে। ইচ্ছে তো করছিল সব ছেড়ে ছুটে যাই। কিন্তু পারিনি৷ কারণ আমি সেলফিশ। নিজের ভালোবাসার জন্য পরিবারের সবাইকে দুঃখ দিয়েছি।”
গুমরে কেঁদে উঠল উষসী। ইয়ামিন হতাশা ভরা দৃষ্টিতে কেবল তাকিয়ে আছে। উষসী চোখ মুছতে মুছতে বলল,” আমার প্রথমেই উচিৎ ছিল সতর্ক হওয়া। সব জানার পরেও আমি আপনার সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছি। শুধু নিজের সুখকে ইম্পর্ট্যান্স দিয়েছি। কিন্তু এই জন্য যে সবাইকে কষ্ট দিতে হবে সেটা চিন্তা করিনি৷ গত দুইদিন যাবৎ মা আমার সাথে কথা বলছে না ইয়ামিন৷ তার উপর আপুর এই অবস্থা।
আমি কি করব? কিভাবে সবকিছু হ্যান্ডেল করব জানি না… শুধু নিজেকে অপরাধী লাগছে।যদি আমার জন্য আপুর বেবির কিছু হয়ে যায় তাহলে আমি নিজেকে কিভাবে ক্ষমা করব?”
আর্তনাদ করতে লাগল উষসী। ইয়ামিন তাকে সামলানোর জন্য বলল,” প্লিজ চুপ করো। কারো কিচ্ছু হবে না।”
” যারা ভালোবাসতে পারে তারা কখনও স্বার্থপর হতে পারে না। কিন্তু আমি যে ভালোবেসে স্বার্থপর হয়ে গেছি। আপনাকে পাওয়ার লোভে অন্যকিছু চোখেই দেখছি না!সবাইকে এতো কষ্ট দিয়ে ফেলেছি… কিভাবে এবার তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াবো বলতে পারেন? ”
ইয়ামিন নির্বাক, দিশেহারা! কি বলে সান্ত্বনা দিবে উষসীকে? সেও তো একই কাজ করেছে। পরিবার, পরিজন সবকিছু অগ্রাহ্য করে শুধু উষসীর সাথে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভেবেছিল এভাবেই জীবনে সুখ আসবে। কিন্তু আসলেই কি এভাবে সুখে থাকা যায়?
ইয়ামিন ধীরে ধীরে বলল,” ফাবিয়াহর ওরনাটা আমার বিছানায় পাওয়ার পর থেকে খুব হরিবল সিচুয়েশন তৈরী হয়েছে বাড়িতে। মা আমাকে বিয়ের জন্য প্রেশার ক্রিয়েট করছে। আমার নিজের মা আমাকে বিশ্বাস করছে না উষসী! তাই আমি সবাইকে ছেড়ে শুধু তোমার হাত ধরতে চেয়েছিলাম। আমি কি ভুল করেছি?”
উষসী কাঁদতে কাঁদতে বলল,” জানি না। কিন্তু আমার পক্ষে এটা সম্ভব না। আমি আপনার পাশে থাকতে পারব না৷ এই সময় সবচেয়ে জরুরী আমার পরিবার। আমাকে তাদের পাশে থাকতে হবে। আমাকে প্লিজ মাফ করে দিন আপনি। ”
ইয়ামিন বুঝতে পারছে উষসী মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েছে৷ তাই এই মুহূর্তে তাকে আর ভাঙতে চাইল না। সহজ গলায় বলল,” রিল্যাক্স! তুমি যা চাও তাই হবে। তোমার অনুমতি ছাড়া এইভাবে বিষয়টা সবার সামনে কনফেস করা উচিৎ হয়নি আমার। স্যরি উষসী।”
ইয়ামিন গাড়ি চালু করল। উষসী জানালার দিকে চেয়ে আছে। গাঢ় অপরাধবোধে দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে মন। সে স্বার্থপর! তার জন্যই উষ্ণতার এই অবস্থা। কি হবে এবার? কি হবে?
দু’জনের কেউই আর কোনো কথা বলল না এরপর। বিষাক্ত বাতাস তাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে চারদিক থেকে। ক্ষণে ক্ষণেই দমবন্ধ লাগছে। ইয়ামিন গাড়ির এসি বন্ধ করে জানালা খুলে দিল৷ মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিলে যদি একটু ভালো লাগে!
হাসপাতালের ভবনে এসে ইয়ামিন গাড়ি থামাল। শান্ত কণ্ঠে বলল,” এসে গেছি।”
” হু?”
” পৌঁছে গেছি আমরা।”
“হুম…” উষসী ব্যাগ হাতে নিল নামার জন্য। তারপর কি ভেবে ইয়ামিনের দিকে চাইল।
কেমন বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইয়ামিন। তার ওই চোখ দু’টো দেখে হঠাৎই বুক পাজরে টান অনুভব করল উষসী। শূন্য হৃদয়টা খা খা করছে প্রচন্ড। পা দু’টো সেলোটেপের মতো আটকে আছে যেন। যেতে মন চাইছে না। মনে হচ্ছে সে চিরজীবনের জন্য বুঝি ছেড়ে যাচ্ছে ইয়ামিনকে।
অদ্ভুত একটা কাজ করল উষসী এবার। আচমকা কাছে এসে জড়িয়ে ধরল ইয়ামিনের গলা। তারপর তার মুখে অজস্র চু’মু দিতে লাগল। ইয়ামিন বিব্রত, হতচকিত। মুহূর্তেই মন সিক্ত হয়ে উঠল। উষসীর হাত চেপে ধরে বলতে ইচ্ছে হলো,” যেও না উষসী। যাক না দুনিয়া ভেসে, তুমি শুধু আমার হয়ে থাকো।”
কিন্তু চাইলেই কি বলা যায় এমন কথা? উষসী ইয়ামিনকে ছেড়ে ছুটে বেরিয়ে গেল। তারপর একবারও পেছন ফিরে তাকাল না। ইয়ামিন বসে রইল নিশ্চুপ। বিষাক্ত নিঃসঙ্গতা গলা টিপে ধরল তার। বুক পুড়ে যাচ্ছে। ইশ, পরিস্থিতির কাছে ভালোবাসা যদি এতোই অসহায় হবে তাহলে এই অনুভূতি কেন এতো তীব্র হয়? কেন এমন মরণ যন্ত্রণা দেয় প্রতি মুহূর্তে? কেন!
চলবে
#উষসী_হাসবে_বলে (৩৪)
লিখা- Sidratul Muntaz
আগুন রঙা তেজি আকাশের রঙ নিভে আসছে। বিশাল অন্তরীক্ষ অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। কি রহস্যময় একটি দৃশ্য! বিস্তৃত সেই আকাশের দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস মুক্ত করল ইয়ামিন। তার জীবনটাও কি ঠিক আকাশের মতো না? প্রতি বেলায় রঙ বদলায়। কখনও আঁধার, কখনও আলো, কখনও বা রঙিন। তবে উষসীহীন তার আকাশ সর্বদা অন্ধকার!
উষসী অর্থ সকাল! সকাল যদি না আসে তাহলে ইয়ামিনের জীবনের অন্ধকার মিটবে না। অতীতের মতোই পুনরায় গভীর গহ্বরে তলিয়ে যাবে সে। আগেও ভালোবাসা হা’রিয়ে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছিল তার হৃদয়। দ্বিতীয়বার সে পারবে না একই ব্যথা স’হ্য করতে।
বার-বার শুধু একটা মানুষের জন্যই নিজের ভালোবাসা হা’রাতে হবে তাকে। কি আশ্চর্য! নিয়তির কি দুরূহ অবিচার! তবে এবার ইয়ামিন আগেরবারের মতো হা’র মানবে না৷ কারণ তার ভালোবাসার ফুলটি খুব নাজুক, মূল্যবান। নিজের কষ্ট সামলে নিতে পারলেও উষসীর এতোটুকু কষ্ট সে স’হ্য করবে না। তাই উষসীকে জয় করবে সে। তার ভালোবাসা এতো ঠুনকো না যে কঠিন পরিস্থিতির কাছে দমে যাবে এতো সহজেই! সে লড়বে, প্রয়োজনে পৃথিবীর সাথে যু’দ্ধ করে হলেও উষসীকে ছি’নিয়ে আনবে। কারণ উষসী শুধুই তার একান্ত, ব্যক্তিগত চিত্ররূপসী।
আশুলিয়ার বড় ব্রীজের কাছে দাঁড়িয়ে আছে ইয়ামিন। উষসীর খুলে রাখা আংটিটা পানিতে ফেলে দিবে ভাবছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেছে সেম সে যাবে উষসীর কাছে। এখনি যাবে। আবারও তৃষাণের মুখোমুখি হবে। ঝড়-তুফান যাই আসুক, সে উষসীর হাত ছাড়বে না। উষসীর আঙুলে পুনরায় এই আংটি পরিয়ে তবেই ক্ষান্ত হবে।
ঘড়িতে সন্ধ্যা ছয়টা বাজছে। সকাল থেকে প্রতিটি মানুষ না খেয়ে বসে আছে। দুশ্চিন্তায় সবার মুখ শুকনো। কেউ কারো সাথে কথা বলছে না। প্রত্যেকে নিজেদের ধ্যানে ব্যস্ত। মুখে হাসি নেই কারো। ছোট্ট তৃষ্ণাও বিপদের আশঙ্কায় মুখ ভার করে রেখেছে। তার কান্না পাচ্ছে প্রচন্ড। কিন্তু লজ্জায় সে এতোটুকু কাঁদছে না। একটু আগে বাবাকেও কাঁদতে দেখেছে সে। তখন বাবার কাঁধে হাত রেখে বলেছে,” মাম্মামের কিছু হবে না পাপা। তুমি কাঁদছো কেন?”
তৃষাণ তৃষ্ণাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চু’মু দিয়ে বলেছে,” আমার সাহসী ছেলে। ভ’য় লাগছে?”
তৃষ্ণা দুই পাশে মাথা নেড়ে বলেছে,” না। পাপা, এন্টস, দাদুন, নানু সবাই কাঁদছে। তুমিও কাঁদলে তাদের কান্না কে থামাবে?”
তৃষাণ তৃষ্ণার ছোট্ট হাতে চু’মু খেয়ে বলেছে,” তুমি থামাবে বাবা। আমার লায়ন না তুমি?”
তৃষ্ণা মাথা ঝাঁকিয়েছে। হ্যাঁ, সে বাবার ‘লায়ন’। লায়ন হচ্ছে কিং। যে কোনোকিছুতেই ভ’য় পায় না। বরং সব কঠিন পরিস্থিতি খুব সাহসিকতার সাথে সামলায়। তাই সে আজ একটুও কাঁদবে না। শুধু মায়ের জন্য দোয়া করবে। মনে মনে বলল,” আল্লাহ, মাম্মামের যেন কিছু না হয় প্লিজ।”
তারপর একটু চুপ থেকে আবার বলল,” বোনেরও যেন কিছু না হয়। এটা ঠিক যে আমি ওকে পছন্দ করি না। ওকে চাইও না। বাট তবুও ওকে তুমি ভালো করে দাও। মাম্মাম আর পাপা যেন না কাঁদে। প্লিজ আল্লাহ, প্লিজ!”
উষ্ণতার অবস্থা খুব জটিল৷ তাকে সী সেকশনে নেওয়া হয়েছে। অপারেশনে অনেকটা সময় চলে গেছে। বেশ কিছুক্ষণ পর একজন নার্স এসে জানাল,” ডাক্তার খুব চেষ্টা করছে। আপনারা একটু ধৈর্য্য রাখবেন।”
যুঁথি উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইলেন,” আমার মেয়ে কেমন আছে আপা?”
মধ্যবয়স্কা নার্স নিরাশ কণ্ঠে বললেন,” হয়তো যে-কোনো একজনকেই বাঁচানো সম্ভব। আপনারা প্রস্তুত থাকেন।”
তৃষাণ এই কথা শুনে কাছে এসে যন্ত্রমানবের মতো বলল,” আমি আমার স্ত্রীকে সুস্থ দেখতে চাই, এট এনি কস্ট। তার কোনো ক্ষতি হলে হাসপাতাল জ্বালিয়ে দিবো আপনাদের।”
নার্স কিছু বলল না। তৃষাণের মানসিক অবস্থা বুঝতে পেরে তার চোখে- মুখে মায়া ফুটে উঠল। যুঁথি বেগম কতক্ষণ চেয়ে থেকে হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। ডোনা তাকে সামলাবেন নাকি নিজেকে সেটা বুঝতে পারছিলেন না। উষসীর উদ্দেশ্যে বললেন,” উষু, ধর তোর মাকে।”
উষসী এসে ধরল। তৃষাণ শাশুড়ীকে কোলে করে ইমারজেন্সী ইউনিটে নিয়ে গেল। উষসী একদৌড়ে বাথরুমে চলে এলো। অতিরিক্ত কান্নার কারণে বমি আসছে তার। সকাল থেকে কিছু খায়নি বলে বমিও করতে পারল না। শুধু পানির মতো তরল বের হলো গলা দিয়ে।
উষসী মুখ ধুঁতে লাগল। এতে যদি মনস্তাপ এতোটুকু কমে! কিন্তু কমল না। বরং আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখেই প্রচন্ড ঘৃণা হলো নিজের প্রতি।ভেঙে ফেলতে মন চাইল আয়নাটা। আজ থেকে সে খু’নি। নিজের বোনের নিষ্পাপ বাচ্চার খু’নি!
উষসী দুই হাতে মাথা খামচে ধরে বসে পড়ল মেঝেতে। হাউ-মাউ করে কাঁদতে লাগল পাগলের মতোন। একটা মেয়ে টয়লেট থেকে বের হয়ে তাকে দেখে থম মেরে তাকিয়ে রইল।
ইয়ামিন হাসপাতালে পৌঁছালো রাত আটটায়। এখনও উষসীদের পরিবার এখানেই আছে কারণ নিচে ক্যান্টিনের সামনে আহমেদকে সিগারেট খেতে দেখেছে সে। কিন্তু কয়তলায়, কয় নাম্বার ওয়ার্ডে উষ্ণতারা আছে সেই ব্যাপারে ইয়ামিন কিছুই জানে না! কাউকে জিজ্ঞেস করাও সম্ভব না। কারণ তৃষাণ আগে টের পেয়ে গেলে উষসীর সাথে দেখা করা মুশকিল হবে।
হাসপাতালটা বিশাল বড়। প্রায় সব রোগীই গর্ভাবস্থায় এখানে আসে। আজ নাকি প্রায় চল্লিশ জনের সি সেকশনে ডেলিভারি হয়েছে। এতো মানুষের ভীড়ে সে কিভাবে খুঁজবে উষ্ণতার কেবিন?
কয়েকজন নার্স সবাইকে মিষ্টি বিতরণ করছে। তাদের হাতে বড় বড় মিষ্টির প্যাকেট। দু’জন একটু ফাঁকা স্থানে কিছু মিষ্টি পলিথিনে ভরে নিচ্ছিল। ইয়ামিন তাদেএ পেছনে গেল। একজন বলছে,” এগুলো আমি আজ নাইট ডিউটির সময় খাবো। প্রচুর ক্ষিদা লাগে ওই সময়।”
দ্বিতীয়জন বলল,” বেশি করে নে। আমার জন্যেও রাখিস।”
ইয়ামিন চাদর দিয়ে মুখ ঢেকে আছে। কেউ তাকে দেখলেই চট করে চিনে ফেলার ভ’য় নেই। গলার স্বর যথেষ্ট গম্ভীর রেখে বলল,” আজ সকাল নয়টার দিকে একজন ক্রিটিকাল পেশেন্ট ভর্তি হয়েছিল। নাম লামিরা আজরিন উষ্ণতা। তার কি ডেলিভারি হয়ে গেছে? কেবিনটা কোথায় বলতে পারবেন?”
নার্স দু’জন ইয়ামিনের উপস্থিতি টের পেয়ে প্রথমেই একটু চমকাল। প্রথমজন কটাক্ষ স্বরে বলল,” ফোন করেন। আমরা কি সব পেশেন্টের নাম মুখস্ত রাখি?”
” ফোন করা যাবে না। আপনারা গোপনে একটু খোঁজ নিয়ে জানাতে পারবেন?”
প্রশ্নটা করেই ইয়ামিন নিজের ওয়ালেট বের করল। চকচকে নোট দেখে খুশি হয়ে গেল নার্স। দ্বিতীয়জন বলল,” একমিনিটের কাজ। জলদি দেন। এখনি খবর জানাচ্ছি।”
ছো মেরে ইয়ামিনের থেকে টাকা নিল সে। তারপর খুশি হয়ে বলল,” মিষ্টি খাবেন?ভিআইপি পেশেন্টের বাচ্চা হয়েছে। ফুটফুটে মেয়ে সন্তান। তাই মেয়ের বাবা পুরো হাসপাতালে মিষ্টি বিতরণ করছে। কি যে খুশি তারা! নিন, খুশি হয়ে আপনাকেও একটা দিলাম আমার ভাগ থেকে। ”
ইয়ামিন ভ্রু কুঁচকে সিরিয়াস গলায় বলল,” ভিআইপি সেই পেশেন্টের নাম কি?”
” নাম দিয়ে আমাদের কাম কি? আমাদের কাম মিষ্টি খাওয়া।”
জোর করে ইয়ামিনের হাতে মিষ্টি গুজে দেওয়া হলো। প্রথম নার্সটি বলল,”আমার মনে হয় আপনি যাকে খুঁজছেন উনিই সে। তার নামও উষ্ণতা। আসলে নামটা খুব সুন্দর তো, তাই মনে আছে!”
ইয়ামিন মিষ্টির দিকে চেয়ে মৃদু হাসল৷ তার মনে পড়ে গেল ছোটবেলার কথা। প্রজাপতির মতো চমৎকার, চঞ্চল, ছোট্ট উষসীর কথা! প্রায় নয়বছর আগের কথা। উষ্ণতার সাথে তৃষাণের সাথে বিয়ে হয়েছে। ইয়ামিন তখনও সেই খবর জানে না। সে এসেছিল উষ্ণতাকে একনজর দেখবে বলে। তখন বাড়িতে শুধু ছোট্ট উষসীই আছে। সে চটপটে গলায় বলল,” আমাকে মিষ্টি বিতরণ করতে সাহায্য করবে রাক্ষসমানব? তোমাকেও মিষ্টি খাওয়াবো।”
উষসী জোর করেই দু’টো মিষ্টি খাইয়েছিল ইয়ামিনকে। কথায় কথায় গর্জন করতো বলে ছোটবেলায় উষসী ইয়ামিনকে ‘রাক্ষসমানব’ বলে ডাকতো।
ইয়ামিন মিষ্টি খাওয়ার পর জানতে পারল ওগুলো নাকি উষ্ণতার বিয়ের মিষ্টি ছিল! প্রচন্ড রাগে আর মনোকষ্টে সে উন্মাদ হয়ে উঠেছিল। তার সমস্ত রাগ প্রকাশ পেয়েছিল ছোট্ট উষসীর উপর। বাচ্চা মেয়েটিকে নির্বোধের মতো মাঝরাস্তায় গাড়ি থেকে নামিয়ে দেওয়া তারপর পুনরায় হন্যি হয়ে তাকে সারারাস্তায় খুঁজে বেড়ানো… অবশেষে কুকুরের ভ’য়ে গুটিয়ে থাকা অবুঝ উষসীকে কাঁধে বয়ে বাড়ি নিয়ে আসা! আহ, বিষাক্ত স্মৃতিগুলো বাদ দিলে অতীতটা বুঝি খুব মন্দ ছিল না!
উষসীর কোলে মোমের পুতুলের মতো ফুটফুটে সুন্দর একটা ক্ষুদ্র প্রাণ। যেন স্বর্গ থেকে আসা ছোট্ট পরী সে। এতো সুন্দর! গোলাপি গাল, বড় চোখ, পাতলা ঠোঁট। উষসী শুধু চু’মু দিচ্ছে। তার মন আনন্দে ভরে উঠেছে। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে ডোনা আর যুঁথি। দু’জনের চেহারাতেই উপচে পড়া খুশির ভীড়। উষ্ণতা তার কেবিনে বিভোর হয়ে ঘুমাচ্ছে সেই সময়। তৃষাণ একবার প্রিয়তমা স্ত্রীর মুখ দেখার জন্য ডাক্তারের সাথে তর্ক করে ভেতরে ঢুকেছে।
এদিকে কেবিনের বাইরে ছোট্ট পরীকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেছে সবাই। ডোনা বললেন তৃষ্ণাকে,” আমার দাদুভাই, এদিকে আসো না! বোনকে কোলে নাও।”
” না, না, এখন না। ও তো অসুস্থ। যদি কাঁদে?”
তৃষ্ণার জবাব শুনে হেসে ফেলল সবাই। যুঁথি বললেন,” কাঁদবেই তো। ভাই তাকে একটুও আদর করে না। এজন্যই তো ওর মনখারাপ। দেখো, কেমন চোখ বন্ধ করে আছে!”
তৃষ্ণা একবার তাকাল বোনের মুখের দিকে। ইশ, এতো সুন্দর কেন! সে মুহূর্তেই চোখ ফিরিয়ে নিল। মাথা নিচু করে সামান্য লাজুক গলায় বলল,” আমি আদর করি তো ওকে!”
উষসী হেসে ফেলল। ঠোঁট চেপে হাসল ডোনা আর যুঁথিও। উষসী অভিমানের সুরে বলল,” তাই? তাহলে একবারও তো ওকে ডাকলি না তুই!”
” কি বলে ডাকব? ওর কি নাম আছে?”
উষসী ‘বিরাট ভুল হয়েছে’ এমন ভাব করে বলল,” আরে তাইতো! ওর তো নামই রাখা হয়নি৷ তৃষ্ণা, বলতো? কি নাম রাখা যায় আমাদের এই সুন্দর পরীটির?”
তৃষ্ণা আগ্রহ নিয়ে বলল,” সোফিয়া!”
” বাহ, চমৎকার! ” উষসী হেসে উঠল।
ডোনা আর যুঁথি হাত তালি দিলেন। ডোনা বললেন,” খুব সুন্দর নাম হয়েছে তো।”
বাচ্চাটি এতোক্ষণ চোখ বন্ধ রেখেছিল। এবার সে তাকাল। সামান্য হাত নাড়ল। যেন উল্লাস প্রকাশ করল। আদরে, আহ্লাদে গলে পড়ল সবাই। আনন্দে ঝলমল করছে প্রত্যেকের চেহারা। ইয়ামিন দূর থেকেই দেখতে পাচ্ছে উষসীর মুখের মায়াবী হাসিটা। যে হাসি দেখলেই অসীম শান্তিতে মন শীতল হয়ে ওঠে তার! এভাবেই যদি উষসী খুশি থাকে, তাহলে দরকার নেই তার সামনে যাওয়ার। ইয়ামিন উষসীর সেড়ে যাওয়া ক্ষততে নতুন করে আঘাত করতে চায় না! সে ফিরে এলো একরাশ আক্ষেপ ভরা প্রশান্তি নিয়ে।
দুশ্চিন্তায় শিমলার চোখে ঘুম নেই। অনমকে ফোন করে জানা গেছে ইয়ামিন নাকি সকাল থেকেই নিরুদ্দেশ। এদিকে সোশ্যাল মিডিয়ায় তার আর উষসীর প্রেমের সংবাদ নিয়ে ঝড় উঠে গেছে। সেই ঝড়ের দাপটে ফাবিয়াহ বিকাল থেকে বাড়িতে এসে বসে আছে৷ বেশ কান্নাকাটিও করছে। শিমলা বুঝতে পারছেন না কি বলে এই মেয়েকে সান্ত্বনা দিবেন তিনি!
ঠিক রাত এগারোটায় একটা অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটল। ইয়ামিন বাড়ি ফিরে এলো। অথচ সে রাগ করে বাড়ি ছেড়ে গিয়েছিল। এতো সহজে তার ফেরার কথা না। তাও ফিরেছে নেশাগ্রস্ত অবস্থায়! তাকে দারোয়ান ধরে ধরে ভেতরে এনেছে। শিমলা আর্তনাদ করে বললেন,” এ কি অবস্থা!”
দারোয়ান বলল,” ছোট স্যার গেইটের সামনে বসেছিল ম্যাডাম। আমি না দেখলে মনে হয় ওখানেই পড়ে থাকতো। ”
শিমলা মুখে হাত ঠেঁকালেন। এতো খারাপ অবস্থা হয়েছে ছেলেটার? তিনি ছেলেকে ধরে কোনমতে সোফার কাছে আনলেন। ফাবিয়াহ ছুটে এলো। ইয়ামিনের বাহু ধরে বলল,”আমি হেল্প করছি আন্টি..”
শিমলা ছেড়ে দিলেন। ফাবিয়াহ ইয়ামিনের শরীরের অর্ধেক ভর নিজের কাঁধে তুলে নিল। তারপর তাকে বেডরুমে নিয়ে যেতে লাগল। শিমলা রান্নাঘরে গেলেন লেবুর শরবত বানাতে। গৃহকর্মী শুয়ে পড়েছে। শীতের রাতে বেচারিকে আর না জাগানোই ভালো।
ফাবিয়াহ সাবধানে ইয়ামিনকে বিছানার কাছে নিয়ে আসে। বালিশ গুছিয়ে শোয়াতে নিলেই ইয়ামিন চোখ খুলে তাকায়। সামনের মানুষটিকে একপলক দেখেই আচমকা তেতে ওঠে। কাঁধ থেকে ফাবিয়াহর হাত সরিয়ে বলল,” ডন্ট টাচ মি, ইউ লেডি পারভার্ট!”
ফাবিয়াহ গা’লি শুনে থতমত খায়। ইয়ামিন ক্রোধে উন্মত্ত প্রায়। ফাবিয়াহকে দেখে তার মেজাজ গেছে বিগড়ে।জোরে চিৎকার দিয়ে কাঁচের টেবিলে লাথি মা’রে সে। টেবিলের উপরে থাকা টিস্যুর বক্স, ফুলের টব, আর পানির গ্লাস পড়ে ভেঙে যায় চুরচুরিয়ে।
ফাবিয়াহ আতঙ্কে জড়সড়। ইয়ামিন মৃদু হাসে। ঘোরের কণ্ঠে বলল,” প্রস্টিটিউটদেরও সম্মান আছে। কারণ তাদের টাকা দিয়ে কিনতে হয়। কিন্তু আপনার মতো মেয়েদের কোনো সম্মান নেই জানেন। আপনি প্রস্টিটিউটের চেয়েও লোয়ার লেভেলের।”
ফাবিয়াহ মুখ টিপে ধরল। তার চশমাটা খুলে পড়ে গেছে। কাঁপা হাতে ফ্লোর থেকে চশমা তুলল সে। শিমলা ছুটে এসেছেন ভাঙচুরের আওয়াজ শুনে। ফাবিয়াহর কান্না মাখা চেহারা আর ইয়ামিনের রাগান্বিত দৃষ্টি দেখে পরিস্থিতি বুঝতে অসুবিধা হলো না তাঁর। তিনি বিব্রত হয়ে বললেন,” তোমার এবার বাড়ি যাওয়া উচিৎ ফায়া। তোমার বাবা ফোন করেছিলেন। দুশ্চিন্তায় আছেন। আমি ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি… তুমি চলে যাও।”
ফাবিয়াহ জবাব দিল না। মাথা নিচু করে চোখের চশমা ঠিক করল। শিমলা আস্তে-ধীরে ইয়ামিনকে বিছানায় শোয়ালেন। ইয়ামিন ফাবিয়াহর দিকে আঙুল ইশারা করে বলল,” গেট লস্ট। আউট।”
শিমলা অনুরোধ করে বললেন,” ফায়া, তুমি যাও মা। প্লিজ।”
ইয়ামিন হাই তুলে বলল,” ফায়া না, ফ্রড। এই মেয়ে একটা ফ্রড। আর তুমি তো একটা স্টুপিড মা। নিজের ছেলেকেও বিশ্বাস করো না এই ফ্রডের কথা শুনে! শেইম অন ইউ।”
ফাবিয়াহ একদৌড়ে ঘরের বাইরে চলে এলো। চোখ উপচে টপটপিয়ে পানি পড়ছে তার। চশমা ভিজে একাকার হয়ে গেছে। চশমা খুলে ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে বসল সে।
ঠিক মাঝরাস্তায় এসেই গাড়িটা নষ্ট হয়েছে। আহসান বলল,” ম্যাডাম, একটু অপেক্ষা করেন। আমি উবার নিচ্ছি।”
উষসী বলল,” লাগবে না আহসান ভাই। মাত্র কিছু পথ। আমি হেঁটেই যেতে পারব।”
” কি বলেন ম্যাম? হাঁটবেন? স্যার জানলে…”
” কিছুই হবে না। আপনি গাড়ি গ্যারেজে নিয়ে যান। আমি একা বাসায় চলে যেতে পারব।”
আহসান আর কিছু বলল না। উষসী হাঁটতে শুরু করল। ভার্সিটির ক্লাস শেষ করে ফিরছে সে। হঠাৎ মনে হলো কেউ বুঝি তাকে অনুসরণ করছে। পেছনে ফিরে আশেপাশে একবার তাকাল সে। না তো, কেউ নেই। আবার হাঁটতে লাগল। এখন অবশ্য সে খুব বিখ্যাত ব্যক্তি। তাই রাস্তায় তাকে মানুষ অনুসরণ করতেই পারে। এটা অস্বাভাবিক কিছু না। এক নামে পুরো ভার্সিটি তাকে চেনে। অথচ যার জন্য এতো পরিচিতি.. সে-ই জীবনে নেই।
আগে তাদের সম্পর্কের ব্যাপারে কেউ জানতো না। তারা লুকিয়ে প্রেম করছিল। আর এখন পুরো বিশ্ব জেনে গেছে, অথচ তাদের মধ্যে কোনো যোগাযোগই নেই। কি অদ্ভুত! উষসী নিজেকে সামলালো। দ্রুত বাড়ি ফিরতে হবে আজ। অনুষ্ঠান আছে বাড়িতে। সোফিয়ার আকিকা! দেখতে দেখতে সাতদিন কেটে গেছে। উষ্ণতা এখন অনেকটা সুস্থ হওয়ার পথে। তৃষাণ নিজের বউ-সন্তান নিয়ে এতো ব্যস্ত যে উষসীর উপর আগের মতো কড়া নজরদারিও করছে না। সব ঝামেলা ভালোয়-ভালোয় মিটে গেছে বলা চলে। শুধু একটাই সমস্যা… উষসী গভীর নিঃশ্বাস নিল।
ইয়ামিনের সাথে এই সাতদিনে একবারও দেখা হয়নি তার। কথাও হয়নি। সে কেমন আছে, কিভাবে আছে, কিছুই জানে না উষসী। কয়েক বার তাকে ফোন করার কথা ভেবেছিল। কিন্তু শেষমেষ সাহস করে উঠতে পারেনি। উষসী নিজেই তো ব্রেকাপ করেছে। তারপর ইয়ামিন আর একবারও তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেনি। এর মানে কি সে সব মেনে নিয়েছে এতো সহজেই? সে কি ভুলে গেছে উষসীকে?
সেলিব্রিটিদের তো ব্রেকাপের কষ্ট ভুলতে সময় লাগে না। তারা খুব দ্রুত মুভঅন করে। তাদের কাছে অনেক অপশন থাকে। ইয়ামিনও কি সবার মতো ভুলে যাবে উষসীকে? চলতি পথে এসব কথা ভেবে হঠাৎই চোখ টলমল হয়ে উঠল উষসীর। মাঝরাস্তায় বি’চ্ছেদের কথা স্মরণ করে এভাবে কেঁদে ভাসানোর কোনো মানে হয় বুঝি? উষসী চোখ মুছল দ্রুত। ইয়ামিনের কথা আর একদম ভাববে না সে। সব ভুলে যাবে। আর এটাই সবার জন্য ভালো। কিন্তু মন…. মনকে যে বেঁধে রাখা যায় না!
উষসী মেইন গেইটে ঢুকতেই দেখল অনেক মানুষ খাওয়া-দাওয়া করছে। আকিকার অনুষ্ঠানে তৃষাণ বিশাল গরু জ’বাই করেছে। তৃষ্ণার সময় তো পাঁচটা খাসি আনা হয়েছিল। এবার যে গরু জ’বাই হয়েছে সেটাও পাচঁ খাসির থেকে কম নয়। মনে হয় এলাকার সব মানুষ দাওয়াত করা হয়ে গেছে। শহরের সব এতিমখানার ছেলে-মেয়েদের বুঝি ডাকা হয়েছে। কারণ এতোবড় করিডোর আর গ্যারেজ মিলেও জায়গা হয়নি।মেইন গেইটের বাইরেও পাটি বিছিয়ে বসে গেছে অনেকে। উষসী শখ করেই হাতের ব্যাগটা একপাশে রেখে বাচ্চাদের খাবার বেড়ে দিতে লাগল।
ইয়ামিন দূরে দাঁড়িয়ে ছিল৷ মুখ থেকে চাদরটা একটু সরালো সে। আজ খুব ইচ্ছে করছিল উষসীকে দেখতে। তাই কিছু না ভেবেই তার ভার্সিটি চলে গেছিল সরাসরি। পুরো রাস্তা তাকে অনুসরণ করতে করতে এসেছে এখানে। বাচ্চাদের সাথে উষসীর খুনশুটি দেখে ইয়ামিন আনমনে হাসল। তার উষুফুল এতো স্নিগ্ধ কেন? ইয়ামিন দীর্ঘসময় নিয়ে ওখানে দাঁড়িয়ে রইল। একসময় উষসী ভেতরে চলে গেল। ইয়ামিন আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেল।
চলবে