উষসী হাসবে বলে পর্ব-৩৫+৩৬

0
229

#উষসী_হাসবে_বলে (৩৫)
লিখা- Sidratul Muntaz

আজকের সকালটা আসলেই খুব সুন্দর। একসাথে দু’টো দারুণ ব্যাপার ঘটেছে। প্রথমত, প্রিয়ন্তি আর ফারদিন বাংলাদেশে আসছে। আজ বিকাল তিনটায় এয়ারপোর্টে যেতে হবে তাদের রিসিভ করতে। উষসীর মন ভালো করার জন্য এটুকুই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু দ্বিতীয়বার যেটা হলো, সেটা সবচেয়ে চমৎকার! আহসান আজ উষসীর সাথে ভার্সিটিতে যাচ্ছে না। ব্রেকফাস্টের সময় উষ্ণতা এই কথা জানিয়েছে। উষসীর মন চেয়েছিল কিছুক্ষণ নাচতে। এর চেয়ে শান্তির ব্যাপার আর হয় না। এতোদিন নিজেকে জেলখানার বন্দী আসামি মনে হচ্ছিল তার। আজ সে মুক্ত পাখি!

উষসী ড্রাইভ করতে লাগল স্বাধীনভাবে। ভার্সিটিতে এমনিও যেতে মন চাইছে না। প্রায় পনেরো দিন কেটে গেছে। ইয়ামিনের সাথে তার কোনো দেখা-সাক্ষাৎ নেই। ইয়ামিনও তাকে ফোন করে না, একবারও দেখা করতে আসে না। কেমন আছে সে? খুব জানতে ইচ্ছে হয়।

উষসী গাজীপুরের দিকে যাচ্ছে। সেলফিশ ইয়ামিন! এই পর্যন্ত উষসীর কোনো খোঁজ রাখেনি। তার কি জানতে ইচ্ছে করে না উষসী ঠিকমতো খেয়েছে কি-না, ঘুমিয়েছে কি-না, নিশ্বাস নিতে পেরেছে কি-না! উষসী মনে মনে সবকিছু গুছিয়ে নিল। প্রথমে সে ইয়ামিনের বাড়ির সামনে যাবে। এখন যে সে বাড়িতেই আছে তা উষসী জানে। কারণ গতরাতেই ইয়ামিনের স্টোরিতে দেখেছিল নিঝুম নীড়ের গার্ডেনে বসে ছবি দিয়েছে সে। উষসী স্টোরি সীন করেনি। উপর থেকে দেখেছে। ব্রেকাপ হয়ে গেলেও ফেসবুকে তারা এখনও ফ্রেন্ড। যোগাযোগ নেই অথচ দু’জনই লুকিয়ে লুকিয়ে স্টক করছে একে-অন্যকে। কেউ কারো পোস্টে লাইক দেয় না।

উষসী তার বাড়ির সামনে গিয়ে তাকে ফোন করবে। নিজের মনেই কাল্পনিক কথোপকথন সাজাল সে।

ইয়ামিন-” হ্যালো।”

উষসী-” কেমন আছেন?”

– “ভালো। তুমি কেমন আছো?”

-” সত্যিই জানতে চান?”

-” জানতে চাই বলেই তো প্রশ্ন করছি।”

” কিন্তু এতোদিন তো একবারও খোঁজ নেননি।”

ইয়ামিন খানিকটা অভিমান মিশ্রিত গলায় বলবে,” তুমিই তো বলেছো, আমাকে নাকি ভুলতে চাও?”

উষসীও তীব্র অভিমান ছুঁড়ে বলবে,” আমি চাইলে আপনিও চাইবেন?”

” মানে?”

” আমি জানি না। আপনি কি আমাকে ভুলে গেছেন?”

” না, তোমাকে আমি সারাজীবন চেষ্টা করলেও ভুলতে পারব না উষসী!”

উষসীর মন ভরে উঠবে। সে হাসবে উত্তাল আনন্দময় হাসি। তারপর বলবে,” তাহলে একবার নিচে আসুন। আমি আপনার বাসার সামনেই আছি।”

ইয়ামিন নিশ্চয়ই তখন বড়-সড় একটা সারপ্রাইজ পাবে। খুশিতে উষসীর চোখ চিকচিক করছে। সে নিজের কল্পনার জগৎ থেকে বের হয়ে ড্রাইভিং-এ মনোযোগ দিল৷ তাকে খুব দ্রুত গাজীপুর পৌঁছাতে হবে। আর তর সইছে না৷ ইশ, রাস্তাটা এতো লম্বা কেন? শেষই হয় না!

ইয়ামিন ঠিক পেছনেই ট্যাক্সি নিয়ে উষসীকে অনুসরণ করছে। প্রতিদিন অবশ্য করে না। তবে এই পনেরোদিনের মধ্যে আটদিনই করেছে। বাকি সাতদিন নানান কাজে ব্যস্ত ছিল বলে আসা হয়নি। সে সবসময় আলাদা আলাদা ট্যাক্সি নেয় যাতে উষসী কোনোভাবেই সন্দেহ না কর‍তে পারে।

আজ উষসী একাই বের হয়েছে। আহসান তার সঙ্গে নেই। ইয়ামিনের খুব ইচ্ছে করছে একবার উষসীর সামনে যেতে। কিন্তু চাইলেই কি মনের সব ইচ্ছেকে প্রাধান্য দেওয়া যায় না।

উষসী ভার্সিটির দিকে যাচ্ছে না। সে অন্যকোথাও যাচ্ছে। এটা প্রথমেই বুঝেছিল ইয়ামিন। কিন্তু এবার সে খেয়াল করল, উষসী আসলে গাজীপুর যাচ্ছে! তারই বাড়িতে, ও মাই গড!

ব্যাপারটা বোঝা মাত্রই ইয়ামিন ট্যাক্সি ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে বলল,” ভাই, গাড়ি ঘোরান৷ আর ফলো করতে হবে না।”

” তাহলে কোনদিকে যাব ভাই?”

” শর্টকাট একটা রাস্তা বলে দিচ্ছি। সেদিক দিয়ে চলুন।”

ইয়ামিন উষসীর আগেই বাড়িতে পৌঁছে গেল। নিজেকে একটু ঠিকঠাক করে সুন্দর দেখতে টি-শার্ট পরল। উষসী বলেছিল তাকে সাদা রঙে মানায়। তাই সে সাদাই পরেছে।ক্যানভাসে উষসীর একটা পেইন্টিং আঁকছিল সে। এখনও অসম্পূর্ণ। নীল চাদোয়া দিয়ে ঢেকে নিল ছবিটি। তারপর আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল। চুল ঠিক করল। মনে হচ্ছে যেন অনেক বছর পর দেখা হচ্ছে তাদের! ইয়ামিন ভেতরে ভেতরে কিছুটা নর্ভাস! নিজের ছেলেমানুষীতে হালকা হাসল সে। তবে প্রচন্ড আনন্দে নিশ্বাস ভারী হয়ে এসেছে। ইয়ামিন নিজেকে ধাতস্থ করতে বুকের উপর হাত রেখে সোজা হয়ে দাঁড়াল। ঘড়িতে সকাল সাড়ে দশটা বাজে। উফ, উষসীর আসতে এতো সময় লাগছে কেন?

কিছুক্ষণ পর মিসেস শিমলা হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন। তাঁর হাতে মোবাইল। চেহারায় অদ্ভুত কাঠিন্যতা। ইয়ামিন ব্যস্ত গলায় জিজ্ঞেস করল,” মা, কিছু বলবে?”

শিমলা কটমট করে বললেন,” বলবি তো তুই আমাকে। তার আগে এটা দ্যাখ।”

ইয়ামিন মোবাইল হাতে নিয়ে হকচকিয়ে গেল। কয়েক পল স্থির থেকে উশখুশ করে বলতে চাইল,” মা, আমি.. এটা…”

শিমলা ঠাটিয়ে চ’ড় মা’রলেন ছেলের গালে। জীবনে প্রথমবার মায়ের হাতে চড় খেয়ে ইয়ামিন স্তম্ভিত হয়ে গেল।

নিঝুম নীড়ের সামনে এসে গাড়ি থামাল উষসী। বুক ভরে একটা শ্বাস নিল। ইশ, এই জায়গার বাতাসটাও কত বিশুদ্ধ লাগে! উষসী প্রগাঢ় আনন্দ নিয়ে গাড়ি থেকে নামল। দারোয়ান তাকে দেখেই বলে উঠল,” স্যার বাড়িতে নেই।”

উষসী হতবাক। লোকটা কিভাবে বুঝল যে উষসী কেন এসেছে? অবশ্য সে তো উষসীকে চেনে। যদিও অনেক মাস আগে দেখা হয়েছিল। উষসী হেসে বলল,” কোথায় গেছেন উনি?”

” জানি না। তবে এই মুহূর্তে স্যার এখানে নেই। আপনি কি কোনো মেসেজ ছাড়তে চান?”

” না৷ থাক, লাগবে না। ”

মনটা খুব বিখড়ে হয়ে গেল। সে গাড়িতে উঠে বসল। উদাসীনভাবে ড্রাইভ করতে শুরু করল। এতো আশা নিয়ে এসেছিল, অথচ দেখাই হলো না! ঠোঁট উল্টে কিছুক্ষণ ভাবল উষসী। তারপর সড়কের একপাশে গাড়ি থামিয়ে ইয়ামিনের নাম্বারে ডায়াল করল। বুকের ভেতর দামামা বাজছে। ইয়ামিন ফোন ধরবে তো? কিন্তু সেগুড়ে বালি, তার ফোন বন্ধ!

উষসী বিষণ্ণ মনে বাড়ি ফিরে এলো, তখন দুপুর দেড়টা বাজছে। দরজা খুললেন যুঁথি বেগম। তিনি প্রায় হুংকার ছেড়ে বললেন,” কোথায় গেছিলি তুই?”

উষসী ভ’য় পেয়ে গেল। সে ভার্সিটি যায়নি এই খবর মা জানল কিভাবে? তার পেছনে কি সিকরেট গোয়েন্দা লাগানো আছে নাকি? উষসীর জবাব না পেয়ে যুঁথি দরজা থেকে সরে দাঁড়ালেন। তখনি সে দেখতে পেল ড্রয়িংরুমে প্রীতি আর যুথি বসে আছে চিন্তিত ভঙ্গিতে। উষসীকে দেখে তারা কেমন করে যেন তাকাল।

উষসী ভ্রু কুঁচকে ভেতরে এলো৷ কিছু হয়েছে নাকি? সবাই এমন গম্ভীর হয়ে আছে কেন? যুঁথি বেগম বললেন,” ওরা এসেছে তোকে খুঁজতে। কারণ তুই নাকি আজ ভার্সিটি যাসনি। তাহলে কোথায় গেছিলি সকাল সকাল?”

উষসী মাথা নিচু করে রইল। যুঁথি বেগম বললেন,” আমি নামাযটা সেরে আসছি। তারপর কথা বলব। তোমরা বসো৷ না খেয়ে যেও না কিন্তু।”

এইটুকু বলেই বন্ধুদের সাথে উষসীকে একা ছেড়ে চলে গেলেন তিনি। প্রীতি আর যুথি ছুটে এসে উষসীকে জড়িয়ে ধরল। প্রীতি আর্দ্র নরম কণ্ঠে বলল,” উষু, আমি তোর মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। কিন্তু প্লিজ মনকে শক্ত কর!”

উষসী প্রীতির কথার অর্থ বুঝল না। যুথির দিকে চাইল। যুথি কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,” এখনও কিভাবে এতো শক্ত আছিস তুই? যদি আমি তোর জায়গায় থাকতাম… তাহলে মনে হয় দুঃখে আর লজ্জায় সু’ইসাইডই করে ফেলতাম।”

প্রীতি ক্ষেপে গেল। যুথিকে ধমক দিয়ে বলল,” ওর সামনে দাঁড়িয়ে এসব কি বলছিস তুই? ফাজিল, একটা চ’ড় দিবো! মেয়েটা এমনিতেই কত আপসেট!”

উষসী তাদের কথাগুলো শুনে হতবুদ্ধির মতো হয়ে গেছে। চোখ কুঁচকে শুধাল,” কি সমস্যা বলবি একটু? ক্লিয়ারলি কথা বল। আমার কি হয়েছে? আমি কেন আপসেট হবো?”

প্রীতি আর যুথি চোখাচোখি করল একবার। প্রীতি শুকনো গলায় বলল,” ও। তুই তাহলে এখনও কিছুই জানিস না?”

যুথি আর্তনাদ করে বলল,” হায়রে কপাল! এদিকে আয়। এখানে বস। ঘটনা শুনলে তো এখন তব্দা খাবি। বয়ফ্রেন্ডের ব্যাপারে এইটুকু খোঁজও রাখতে পারিস না?”

” মানে?”

প্রীতি তার ফোনে কিছু একটা বের করে উষসীর দিকে বাড়িয়ে দিল। ফাবিয়াহ আর ইয়ামিনের ঘনিষ্ট ছবিগুলো দেখে উষসীর হাত-পা থরথর করে কাঁপতে লাগল।

যুথি মাথায় হাত রেখে বিলাপ করে বলছে,” সেদিন যখন ইয়ামিন ইব্রাহীম তোকে সবার সামনে প্রপোজ করতে ভার্সিটিতে এসেছিল, আমি যে কত খুশি হয়েছিলাম! সত্যি বলছি তোর উপর ঈর্ষায় ম’রে যাচ্ছিলাম। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি আসল কাহিনী। অতি ভ’ক্তি চোরের লক্ষণ। আরে সেলিব্রিটিদের চরিত্র এমনই তো হয়! তুই ঠিকই বলতি উষু। এই ইয়ামিন ইব্রাহীম একটা জঘন্য লোক। কিভাবে তোকে ধোঁকা দিল দেখলি? তুই কিভাবে এর সঙ্গে প্রেম করলি বলতো…. ”

“শশশ!” প্রীতি চোখের ইশারায় থামতে বলল যুথিকে।

উষসী মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে চুপচাপ। তাকে অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে। তিনজনই কিছুক্ষণ নীরব হয়ে রইল। একটু পর প্রীতি বলল,” উষু, তুই কি ঠিকাছিস?”

উষসী উঠে দাঁড়াল হঠাৎ। প্রীতির ফোনটা তাকে ফিরিয়ে দিতে দিতে বলল,” তোরা প্লিজ এখান থেকে চলে যা।”

যুথি হড়বড় করে বলল,” কিন্তু এখন কি করবি তুই? ব্রেকাপ?”

প্রীতি শান্ত স্বরে বলল,” এটা ওদের পারসোনাল ব্যাপার। আমরা এসব নিয়ে কথা না বললেই ভালো। উষু, তুই স্পেস নে। ঠান্ডা মাথায় চিন্তা কর। আর ভালো থাকিস।”

উষসী একদৃষ্টে মেঝেতে তাকিয়ে আছে। যন্ত্রের মতো মাথা ঝাঁকাল সে। প্রীতি আর যুথি বের হয়ে যাচ্ছিল। একটু পর যুঁথি বেগম নামায শেষ করে লিভিংরুমে এলেন। দেখলেন কেউ নেই। উষসী একা বসে আছে সোফায়। তাকে কেমন অপ্রকৃতস্থ লাগছে। যুঁথি অবাক হয়ে বললেন,” আরে, মেয়েগুলো না খেয়েই চলে গেল? কিরে উষু, ওদের বসতে বলবি না?”

উষসী জবাব দিল না। তাকালও না। যুঁথি কাছে এসে মেয়ের কাঁধে হাত রাখলেন৷ তাকে ঝাঁকিয়ে বললেন, ” উষু, কি হয়েছে তোর?”

চোখ তুলে তাকাল উষসী। তার দৃষ্টি কেমন নিষ্প্রাণ৷ কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে হঠাৎই সে ঝাঁপিয়ে পড়ল মায়ের বুকে। কাঁদতে লাগল অবুঝ শিশুর মতোন। যুঁথি মেয়ের আচরণ দেখে হতভম্ব হয়ে গেলেন।

চলবে

#উষসী_হাসবে_বলে (৩৬)
লিখা- Sidratul Muntaz

গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা চলছিল কেবিনে৷ প্রফেসর আবদুস সালাম একটা এক্সিডেন্টে মৃ-ত শরীরকে ডেমো বানিয়ে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের লেকচার দিচ্ছেন।ফাবিয়াহ সহপাঠীদের সাথে দাঁড়িয়ে আছে। সকলেই খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে মানব শরীরের জটিল রহস্য উন্মোচন। ঠিক এমন সময় বাইরে থেকে শব্দ এলো,” আপনি ভেতরে যেতে পারবেন না।”

” আমাকে যেতেই হবে। সাইড দিন।”

” আরে, সংঘাতিক লোক তো!”

বাইরের স্টাফকে ধাক্কা মে’রে ইয়ামিন ভেতরে ঢুকে পড়ল। তার মুখে মাস্ক ছিল। সে দরাজ গলায় ডাকল,” ফাবিয়াহ আফরোজ।”

তাকে দেখে ফাবিয়াহর পিলে চমকে উঠল। প্রফেসর ভারী স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন,” কে আপনি? এমন হাঙ্গামা করে ভেতর ঢুকেছেন কেন? এই ধরণের বেয়াদবির অর্থ কি?”

ফাবিয়াহ চোখের চশমা ঠেলে বলল,” স্যার… আমাকে মনে হয় একটু বাইরে যেতে হবে।”

” এতো ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাস রেখে তুমি চলে যাবে? ওকে, এজ ইউর উইশ।”

সবাই হাঁ হয়ে তাকিয়ে আছে। ফাবিয়াহ ইতস্তত করতে করতে ইয়ামিনের সামনে এসে বলল,”মনে হচ্ছে ইমারজেন্সি কিছু? আমি ক্লাস পোস্টপন্ড করে দিয়েছি। চলুন, ক্যান্টিনে গিয়ে বসি।”

ইয়ামিনের চেহারা যথেষ্ট গম্ভীর। ফাবিয়াহ সামনে পা বাড়াতে নিলেই সে পেছন থেকে তার হাত চেপে ধরল। দূর্বহ কণ্ঠে বলল,” নাটক করার প্রয়োজন নেই। আপনি ভালো করেই জানেন আমি কেন এসেছি, ইউ ব্লাডি বিচ!”

সবাই হতবাক, বিমূঢ়। ফিসফাস শুরু হয়ে গেছে। প্রফেসর গর্জন করে বললেন,” সাইলেন্ট! আপনি আমাদের মূল্যবান সময় এবং পরিবেশ দু’টোই নষ্ট করছেন। কিছু বলার থাকলে ওকে নিয়ে বাইরে যান।”

ইয়ামিন বলল,” না,আমি এখানে দাঁড়িয়েই কথা বলব তারপর চলে যাবো। বেশি সময় নিবো না। সর্বোচ্চ পাঁচমিনিট। তারপর আপনারা আবার আপনাদের ক্লাসে জয়েন করতে পারেন। ”

সবাই কেমন উদগ্রীব হয়ে উঠল। ইয়ামিনের রূঢ় আচরণ দেখে তাদের আগ্রহের মাত্রা আরও বেড়ে গেছে। সহপাঠীদের সামনে তীব্র অস্বস্তিতে ফাবিয়াহর মুখ ফ্যাকাশে। সে সহজ ভাবে হাসার চেষ্টা করে বলল,” আমাদের ব্যক্তিগত কথা কি এখানে দাঁড়িয়ে বলা ঠিক হবে?”

” ফার্স্ট অফ অল, আপনার সাথে আমার কোনো ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরীই হয়নি। আর কোনো দিন হবেও না। দিবাস্বপ্ন দেখা বন্ধ করুন। এন্ড সেকেন্ডলি, আপনি কেমন সেটা আপনার ক্লাসমেটদেরও জানা উচিৎ।”

ফাবিয়াহর মুখ অপমানে অন্ধকার হয়ে যায়। চারপাশে তাকাতে থাকে সে। সবাই দেখছে, শুনছে, ঘটনা বোঝার চেষ্টা করছে। ফাবিয়াহ অনুরোধের স্বরে বলল,” বাইরে চলুন, প্লিজ।”

ইয়ামিন তার মুখ থেকে মাস্কটা টেনে খুলল। তার চেহারা দেখে হতবিহ্বল বনে গেল সবাই। ইয়ামিন ফাবিয়াহর দিকে খানিকটা এগিয়ে এসে বলতে লাগল,” আমি প্রথমে আপনার বাড়িতে গেছিলাম। সেখানে আপনি ছিলেন না। আপনার ফুপু এই হাসপাতালের এড্রেস দিলেন। আমার এখানে আসার একটা বিশেষ উদ্দেশ্য হলো আপনার ইনোসেন্ট ফেসের মুখোশ উন্মোচন করা!”

ফাবিয়াহ আৎকে উঠল। ইয়ামিন সবার উদ্দেশ্যে বলল,” আপনাদের মধ্যে কেউ কিন্তু ভুলেও এই মেয়ের সাথে ছবি তুলতে যাবেন না। বিশেষ করে ছেলেদের বলছি। ফেঁসে যাবেন একদম। প্রথমে আত্ম*হত্যার নাটক করবে সে। তারপরেও যদি কাজ না হয় তাহলে আপনার অচেতন অবস্থার সুযোগ নিয়ে ঘনিষ্ট ছবি তুলে সেটা ভাইরাল করবে। যাতে ওকে বিয়ে করা ছাড়া আপনার কাছে আর রাস্তাই না থাকে! হোয়াট আ ডেভিলিশ প্ল্যান, রাইট? ”

ফাবিয়াহর শরীর জমে গেছে। হাতটা মৃদু কাঁপছে। ইয়ামিন তখনও তার হাত ধরে আছে। এবার ফাবিয়াহর দিকে একটু ঝুঁকে এসে বলল,”রেজাল্ট ফার্স্ট ক্লাস হলে কি হবে? আপনার মেন্টালিটি এখনও থার্ড ক্লাস লেভেলের। ”

ফাবিয়াহ মাথা একদম নিচু করে নিল। কথা বলতে চাইছে কিন্তু গলায় আসছে না। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছে।ইয়ামিন বিড়বিড় করে বলল,” আমার সাথে এখন পর্যন্ত হাজারও মানুষ ছবি তুলেছে। কিন্তু আপনার মতো নোংরামি কেউ করেনি, বিশ্বাস করুন। এতোটা লো মাইন্ডেড কোনো মেয়ে মানুষ হতে পারে সেটা আপনাকে না দেখলে আমি জানতেই পারতাম না মিস ফাবিয়াহ!”

ফাবিয়াহ আর্তনাদের স্বরে বলল,” কি বলতে চান আপনি?”

ইয়ামিন উচ্চকণ্ঠে বলল,” তবুও দেখুন ভাগ্যের কি দূর্দশা! এতোকিছুর পরেও আমি আপনাকে বিয়ে করব না। সেজন্য যদি আমার ক্যারিয়ারও ডুবে যায় তাতেও আমার কিছু যায়-আসে না। আই ডন্ট কেয়ার একচুয়েলি।”

ফাবিয়াহ চোখের জল ফেলছে। ইয়ামিন নিজেকে সামলাল। এখানে আর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে হয়তো ভ’য়ংকর কিছু ঘটে যাবে। সে সামনে তাকিয়ে বলল,” আমার পাঁচমিনিট শেষ। এবার আপনারা ক্লাস শুরু করতে পারেন। বায়।”

কথা শেষ করেই দ্রুত প্রস্থান করল ইয়ামিন। ফাবিয়াহ দেয়ালের সাথে লেগে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর হঠাৎ দৌড়ে বেরিয়ে গেল। তার আজ সত্যিই সু’ইসাইড করতে মন চাইছে। বেঁচে থাকার আর কোনো কারণ অবশিষ্ট নেই। বন্ধুদের সামনে সে আর কখনও দাঁড়াতে পারবে না।

ছোট্ট সোফিয়া শুয়ে আছে বিছানায়। তৃষ্ণা মনখারাপ করে তাকিয়ে আছে। একটা মানুষ সারাদিন কিভাবে এতো ঘুমায়? সে তার বোনের নাম দিয়েছে, ঘুমপরী। তবে ঘুমের মধ্যে যখন সোফিয়া একটু একটু হাসে, সেই দৃশ্যটা দেখতে সবচেয়ে ভালো লাগে তৃষ্ণার। সে কয়েকটা ছবিও তুলেছে। এগুলো প্রিন্ট করিয়ে একটা এলবাম বানাতে হবে।

সোফিয়া হঠাৎ কেঁদে উঠল। উষ্ণতা এই সন্ধ্যায় গোসল করতে গেছে। সারাদিন কাজের জন্য একটুও সুযোগ পায়নি। তৃষ্ণা ঘরে একা। সে জানে, এভাবে ঘুমের মধ্যে কেঁদে ওঠার মানে তার ক্ষিদে পেয়েছে নয়তো ডায়পার বদলাতে হবে। তৃষ্ণা প্রথমে সোফিয়ার মুখে কাঁচের ফিডার চেপে ধরল। সাথে সাথেই মুখ ঘুরিয়ে নিল সোফিয়া। দ্বিগুণ তেজে কাঁদতে শুরু করল। সাদা মুখ গোলাপি হয়ে উঠল। খুব জেদি মেয়ে!

তৃষ্ণা মুচকি হাসল। ড্রয়ার খুঁজে ডায়পার বের করল এবার। উষসী সোফিয়ার কান্না শুনতে পেয়ে দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। তখন দেখল তৃষ্ণা অতি যত্নের সাথে ছোট্টবোনের ডায়পার বদলে দিচ্ছে। অন্য সময় হলে এই দৃশ্য দেখে সে খুব হাসতো। কিন্তু এই মুহূর্তে কোনো অনুভূতিই কাজ করছে না। সে কি দেখছে তা হয়তো নিজেও বুঝতে পারছে না। কেবল দাঁড়িয়ে আছে মূর্তির মতো।

তৃষ্ণা হঠাৎ উষসীকে খেয়াল করেই বলল,” এন্টস, কিছু বলবে?”

উষসী জবাব দিল না। যেন তৃষ্ণার কথাও শুনতে পায়নি। সে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে সোফিয়ার দিকে। আজ-কাল এই বাচ্চা মেয়েটাকেই তার সবচেয়ে বেশি ঈর্ষা হয়। সারাক্ষণ ঘুমানো আর খাওয়া ছাড়া দুনিয়ার কোনো জটিলতাই বোঝে না সে। এর চেয়ে ভালো জীবন আর কি হতে পারে?

হঠাৎ তৃষাণ পেছনে এসে দাঁড়াল। তাকে দেখে তৃষ্ণা উল্লাসের স্বরে বলল,” পাপা, সোফিয়া উঠে গেছে। চলো না, ওকে নিয়ে আমরা একটু ওয়াকে যাই।”

তৃষাণ গম্ভীর চিত্তে বলল,” ও এখনও অনেক ছোট বাবা। ঠান্ডার মধ্যে ওকে নিয়ে বাইরে যাওয়া ঠিক হবে না।”

উষসী তৃষাণের গলা শুনে পেছনে তাকাল। তারপর পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই তৃষাণ বাঁধ সাধল,” ভেতরে এসো উষু।”

এই কথা বলে সে ভেতরে ঢুকে গেল। উষসী একটু দাঁড়িয়ে থেকে সেও ঢুকল। তৃষাণ সোফিয়াকে কোলে নিতে নিতে তৃষ্ণার উদ্দেশ্যে বলল,” তোমার আরবি টিচার আসবে একটু পর। অযূ করে কোরআন শরীফ নিয়ে টেবিলে অপেক্ষা করো। যাও।”

ঘড়িতে মাত্র সাড়ে ছয়টা বাজে। টিচার আসতে এখনও আধঘণ্টা বাকি। তাও তৃষ্ণা উঠে চলে গেল। তর্ক করল না এই ব্যাপারে। কারণ সে বুঝতে পারছে.. বাবা আর এন্টস এখন জরুরী কথা বলবে। আর বড়দের জরুরী কথায় সে থাকতে পারবে না। তাই চুপচাপ উঠে চলে এলো।

সোফিয়া যেন বাবার কোল চেনে। কোলে নিলেই বাবা খুব আরাম করে দোল দিতে থাকে। সেই দোলে আরাম পেয়ে সোফিয়া দ্রুত ঘুমিয়ে যায়। তৃষাণ মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে বিছানায় শুয়িয়ে দিল। কপালে একটা চু’মু দিয়ে তাকাল মেয়ের দিকে। এই মেয়েটা তার প্রশান্তির দ্বিতীয় উৎস। প্রথম উৎস মেয়ের মা। সোফিয়ার বিছানা ঠিকঠাক করে তৃষাণ এবার উঠে বসল। উষসীর দিকে চেয়ে বলল,” মা বলছিল তুমি নাকি সারাদিন ধরে কিছু খাওনি?”

উষসী নিষ্প্রাণ গলায় বলল,” ক্ষিদে পায়নি৷ আমাকে নিয়ে চিন্তা কোর না। আমি ঠিকাছি।”

” তুমি ঠিক নেই, উষু। আর তুমি কেন ঠিক নেই সেটাও আমি জানি। ইয়ামিন ইব্রাহীম তাই না? আমার কাছেও এসেছে ছবিগুলো। বিশ্বাস করো আমি একটুও অবাক হইনি৷ ওর মতো ছেলের থেকে আমি এটাই আশা করেছিলাম। এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো যে কেন আমি তোমাদের বিয়ের ডিসিশন এপ্রুভ করিনি? ”

উষসী চোখ তুলে তাকাল। তৃষাণ কাছে এসে বলল,”এই ছেলের সাথে যদি তোমার বিয়ে হতো তাহলে কতবড় ক্ষ’তি হতো কল্পনা করতে পারছো? তোমার তৃষাণ ভাইয়া কখনও তোমার খারাপ চায়নি উষু। আমি যা করেছি সব তোমার ভালোর জন্য। তোমার মুখের হাসি আমাদের সবার কাছে অনেক ইম্পর্ট্যান্ট। তুমি আমাদের কাছে কতটা মূল্যবান সেটা তুমি জানো না। আর জানো না বলেই ইয়ামিনের মতো একটা ফালতু ছেলের জন্য চোখের জল ফেলছো। প্লিজ, বি নরমাল! ধরে নাও ওই ছেলে কখনও তোমার জীবনে ছিলই না!”

উষসী এবার সরাসরি তৃষাণের চোখের দিকে তাকিয়ে সাহসী গলায় প্রশ্ন করল,” দশবছর আগে যখন উষ্ণতা আপুর ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল তখন তুমিও কি তাকে ছেড়ে ‘বি নরমাল’ হয়ে গেছিলে? তোমার সৎমা তিয়াশা আন্টিও নিশ্চয়ই এভাবেই তোমাকে বলেছিল, ফালতু মেয়েটিকে ভুলে যাওয়ার কথা! তুমি কি মানতে পেরেছিলে তখন?”

তৃষাণ হতভম্ব হলো। রাগে চোয়াল শক্ত করে বলল,” তুমি কিসের সাথে কি কম্পেয়ার করছো উষু?”

” একদম ঠিকই বলছি আমি। ওই ঘটনায় উষ্ণতা আপুর কোনো দোষ ছিল না। কারণ সে ড্রাংক ছিল। সে জানতোই না তার সাথে কি হচ্ছে! কিন্তু পৃথিবীর কেউ সেটা বিশ্বাস করেনি। আমার আপু কতটা অসহায় হয়ে গেছিল সেটা আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। তখন তুমি তার পাশে ছায়ার মতো ছিলে ভাইয়া। একবারের জন্যেও তার হাত ছাড়োনি। তাকে বিশ্বাস করেছো। তার নির্ভরতা হয়ে তার পাশে থেকেছো। সত্যিকারের ভালোবাসা তো এমনই হয়.. তাই না?”

তৃষাণ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। উষসী এগিয়ে এসে বলল,” আমিও তো ইয়ামিনকে ভালোবাসি। যতটা তুমি উষ্ণতা আপুকে ভালোবাসতে… ততটাই। বিশ্বাস করো আমার ভালোবাসাও কোনো অংশে কম নয়। আমি তাকে বিশ্বাস করি। নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করি। তাই পুরো পৃথিবী তার চরিত্রের উপর আঙুল তুললেও আমি তুলব না। বরং সবার সামনে চিৎকার করে বলতে পারব, ইয়ামিন নির্দোষ। সে কখনও আমাকে ধোঁকা দিতে পারে না! আমি তাকে এতোটাই গভীরভাবে চিনি যতটা সে নিজেও নিজেকে চেনে না।

আমি জানি, এই মুহূর্তে ইয়ামিন প্রচন্ড মেন্টালি আপসেট। উষ্ণতা আপুর পাশে তো তাও তুমি ছিলে। কিন্তু ইয়ামিনের পাশে এখন কেউ নেই। আমি নিজের জন্য কাঁদছি না। বরং আমি কাঁদছি ইয়ামিনের জন্য। এমন একটা কঠিন পরিস্থিতিতেও আমি তার পাশে থাকতে পারছি না বলে। তোমরা আমার পায়ে শিকল বেঁধে রেখেছো। কিছুতেই ওর কাছে যেতে দিচ্ছো না আমাকে। যদি এরপর উষ্ণতা আপুর মতো সেও কিছু ভুল করে ফেলে… তাহলে আমি আমার ভালোবাসাকে হা’রিয়ে ফেলব! তখন আমার কষ্টের জন্য একমাত্র দায়ী হবে তুমি, তোমরা! আমি তোমাদের কখনও মাফ করব না ভাইয়া। কখনও না!”

উষসী কান্নার দমকে আর কিছু বলতে পারল না। মুখ টিপে এক দৌড়ে বের হয়ে গেল ঘর থেকে।

চলবে